মুন্নি ঘর ঝাঁট দিচ্ছিলো । হালকুর দিকে ফিরে বললো, `আছে তো খালি তিনটা টাকা । তাও দিয়ে দিলে কম্বল আসবে কোথ্থেকে শুনি ? পোষমাসের রাত এখন - খেতে থাকবেই বা কি করে ? বলে দাও ফসল তোলার পর দিয়ে দেবো, এখন না ।'
থতমত খেয়ে হালকু খানিক দাঁড়ালো । পৌষমাস এক্কেবারে চলেই এসেছে । রাতের বেলা বিলে কম্বল ছাড়া ঘুমানোর সাধ্য নাই-ই বলা চলে । মগর মানার লোক জমিদার নয়; ধমকাবে, অপমান করবে । শীতে মরি তো কি, আপদ তো বিদায় হবে - এই ভেবে হালকু ওর ইয়া বড় গতর (যা ওর নামকে মিছা বানিয়েছে) নেড়ে নেড়ে বিবির কাছে গিয়ে খোশামোদ করা ধরলো । বললো, `দে দে । আর কোনও আমি বের করে নেবো ।'
মুন্নি ঝটকা মেরে আর একদিকে গিয়ে চোখ পাকিয়ে বললো, `অন্য উপায় খোঁজার কোশেশ তো বহুত করেছো । শুনতে পাব একবার কি উপায় বের করবে তুমি ? কম্বল তো আর তোমাকে কেউ দেবে না । আল্লাহ্ মালুম আরও কত কর্জ বাকি, শেষ হতেই চায় না । আমি বলি কি, বর্গা চাষ বাদ দাও ! মরে মরে চাষ করো, তার ওপর যা ফসল পাও সব ওই বাকি কর্জ শুধতে শুধতে চলে যায় । ছেড়ে দাও না কেন এসব ? খালি কর্জ শোধ করতেই যেন জন্মেছি । পেটের দায়ে পয়সাকড়ি কিছু কামাও, খামার-টামার বাদ দাও । টাকা আমি দেবো না, কিছুতেই না !'
মনে চোট পেয়ে হালকু বললো, `তো ও বেটার বকুনি খেতে হবে আর কি ।' ঝেঁঝে উঠলো মুন্নি `কেন বকা দেবে - রাজত্ব পেয়েছে নাকি ?'
কথাটা মুখ থেকে পড়তে না পড়তেই ওর কোঁচকানো ভুরু দুটি মিলিয়ে গেলো । হালকুর কথায় যে নির্মম সত্য লুকিয়ে আছে তা যেন ওর দিকে বুনো জানোয়ারের নাহান তেড়ে আসছে হামলা করতে ।
মুন্নি কুলুঙ্গি থেকে টাকা কটা এনে হালকুর হাতে দিয়ে বললো, `চাষবাস এবার ছেড়ে দাও । দিনমজুরি করলেও তো দানাপানির সুন্দর একটা গতি হবে । কারো চোখ রাঙানি সইতে হবে না । আচ্ছা কাজ তো - পরের জমি চষা ! যা রোজগার কর সব ওখানেই ঢেলে দাও আর লাভের ভাগে পাও খালি চোখ রাঙানি ।'
টাকা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো হালকু । মনে হচ্ছে যেন নিজের কলিজাটাই আজ ছিঁড়ে দিতে যাচ্ছে । রোজগারের টাকা থেকে এক পয়সা এক পয়সা করে বাঁচিয়ে কম্বল কেনার জন্য সে দলা করেছিলো । এই টাকা কটাও আজ খসে যাচ্ছে । একেকটা কদমের সাথে সাথে মাথাটাও যেন গরিবানার ভারে নুয়ে পড়ছে ।
২
পৌষের ঘুটঘুটে আঁধার রাত । আসমানের তারার দিকে চাইলে মনে হয় ওরাও কাঁপছে শীতে । হালকু খেতের একধারে আখ পাতার ছাউনির নিচে বাঁশের মাচার ওপর পুরানা চটের চাদরটা মুড়ি দিয়ে শীতে কাঁপছে । আর মাচার তলায় তার দোস্ত কুকুর জবরা পেটে মুখ গুঁজে শীতে কুঁই কুঁই করে চলেছে । ঘুমানোর সাধ্য নাই কারও ।
হাঁটুর ওপর থুতনি চাপতে চাপতে হালকু বললো, `কি রে জবরা, শীত করছে ? বলি নাই তোকে, বাড়িতে খড়ের গাদায় আরামসে ঘুমা ? কী করতে এলি এখানে ? মর এখন ঠাণ্ডায়, আমার কিছুই করার নাই । হালুয়া-পুরি খেতে আসছি ভেবে তো আগে আগে দৌড়ে এলি । চেঁচা এবার আরজু পুরিয়ে ।'
জবরা শুয়ে শুয়ে লেজ নাড়তে লাগলো । তারপর লম্বা একটা হাই তোলার মত চিত্কার দিয়ে আবার চুপ করে গেলো । তার সারমেয় এলেম দিয়ে সে হয়তো ঠাহর করতে পেরেছে তার ডাকে মনিবের ঘুম আসছে না ।
হাত বের করে জবরার ঠাণ্ডা পিঠে বুলাতে বুলাতে হালকু বললো, `বুঝলি, কাল থেকে আর আসিস না আমার লগে । নইলে ঠাণ্ডা লাগবে । এই শালার বানচোত পশ্চিমা বাতাস যেন এক্কেবারে বরফ ঢেলে দিচ্ছে রে । দেখি, উঠে এক ছিলিম তামাক সাজিয়ে নি । আট ছিলিম তো সাবাড় করেই দিলাম, রাতটা কোনমতে গুজরান হবে । এ-ই তোর চাষবাসের মজা । কারও কারও কপাল কী ফর্সা দ্যাখ - ঘরে আরামসে বসে আছে । ওদের কাছে শীত যদি আসেও গরম লাগার ডরে পালাবার পথ পায় না । মোটা মোটা গদি, লেপ, কম্বল ! আসুক দেখি শীত ! কপালের ফের আর কী - খেটে মরবো আমরা আর মজা লুটবে অন্যে !'
সে উঠে গর্ত থেকে কিছু জ্বলন্ত আংরা নিয়ে ফের কলকে সাজালো । জবরাও উঠে বসলো । ছিলিম টানতে টানতে হালকু বললো, `তামাক টানলেও দেখি শীত কমে না । থোড়া আরাম পাওয়া যায় এই আর কি ।'
জবরার চোখে ভালবাসা উপছে পড়ছে ।
জবরা থাবা দুইটা হালকুর হাঁটুর উপর তুলে দিয়ে মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে দিলো । তার গরম গরম নিশ্বাস হালকুর গায়ে লাগছে ।
ছিলিম টানা শেষ করে হালকু শুয়ে পড়লো । এবার সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ- যে করেই হোক ঘুম এবার দেবেই । মগর এক মিনিট যেতে না যেতে বুকে কাঁপুনি ধরে গেলো । একবার এপাশ ফিরে শোয়, একবার ওপাশ ফিরে শোয় । কিন্তু শীত যেন পিশাচের মত বুকে চেপে বসেছে ।
শীত কিছুতেই বাগ মানছে না দেখে সে উঠে জবরাকে আস্তে করে কোলে তুলে নিলো । তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তার কোলেই ঘুম পাড়িয়ে দিতে লাগলো । কেমন একটা গন্ধ আসছে কুকুরটার গা থেকে । তবু তাকে ভালো করে জড়িয়ে ধরে হালকু বড় সুখ পেলো । বেশ কয়েকমাস হয় এমন সুখের দেখা সে পায় না । জবরা ভাবছে, এ বুঝি বেহেশত । আর হালকুর সাফ দিলে জবরার এই বদবুর কারণে কোনো অপমানবোধ নাই । যে মোহাব্বতে জড়িয়ে ধরে আছে জবরাকে । যে গরিবানা তাকে আজ এই দশায় ফেলেছে, তা কিন্তু তাকে মোটেও পঙ্গু করে দিতে পারে নাই । বরং এই নিবিড় দোস্তি তার অন্তরের বেবাক দরোজা হাট করে দিয়েছে, আলোয় আলোয় আলোকিত করে তুলেছে অন্তরের বেবাক অণু ।
হঠাৎ কিছু জানোয়ারের চলাফেরার শব্দ কানে আসলো জবরার । অন্তরঙ্গ এই দোস্তি জবরার মধ্যে নয়া হুঁশিয়ারবোধ পয়দা করেছে, তুমুল ঠাণ্ডা বাতাসেরও সাধ্য নাই কাবু করার । লাফিয়ে টং থেকে বেরিয়ে এসে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো সে । হালকু তাকে তু তু করে বেশ কয়েকবার ডাকলো । জবরা আসলো না । ঘেউ ঘেউ করে খেতের আলে আলে চক্কর দিতে লাগলো । একটুর জন্য হয়তো ফিরে আসে, কিন্তু তক্ষুণি আবার ছুট লাগায় । কর্তব্যবোধ তার মনে এখন আকাঙ্খার জায়গা দখল করে আছে ।
হালকুর খেত থেকে এক ঢিল-ছোড়া দূরেই একটা আমবাগান । গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়েছে, রাশি রাশি পাতা পড়ে আছে বাগানে । হালকু ভাবল, বাগানে গিয়ে এক গাদা পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে যদি পোহাতে পারতাম । এই নিশিরাতে কেউ পাতা কুড়াতে দেখলে নির্ঘাৎ ভূত ভেবে বসবে । অবশ্য আমার খেতের কোথাও কোনো জানোয়ার টানোয়ারও ঘাপটি মেরে ওৎ পেতে থাকতে পারে । এখানে তো আর এক লহমাও বসে থাকবার পারছি না ।
পাশের খেতে গিয়ে কিছু ডালপালা একটানে ছিঁড়ে নিয়ে সে একটা ঝাড়ু বানিয়ে নিলো । তারপর হাতে আগুন ধরানো ঘুঁটের লকড়ি নিয়ে বাগানের দিকে হাঁটা দিলো । ওকে আসতে দেখে জবরা লেজ নেড়ে নেড়ে ওর দিকে দৌড় দিলো ।
হালকু বললো, `আর সইতে পারছি না রে জবরা । চল তো আমবাগানে আগুন পোহানোর পাতা কুড়াই গে । গা থোড়া গরম করে পরে ফিরে এসে শুয়ে পড়ব । রাত পোহাতে বহুত দেরি ।'
জবরা তার সারমেয় জবানে সম্মতি জানিয়ে দুলকি চালে বাগানের দিকে চললো । গাছতলায় ঘুটঘুটে আঁধার । আর এই আঁধারে শয়তান বাতাস পাতায় ঝাঁকা দিচ্ছে । টুপটাপ শিশির ফোঁটা ঝরে পড়ছে ডালপালা থেকে ।
দমকা হাওয়ার তোড়ে হালকু আচমকা মেহেদি ফুলের খোশবু পেলো । `এমন খোশবু আসছে কোথ্থেকে রে, জবরা ? পাচ্ছিস না ?'
জবরা কোথায় জানি একটা হাডিড পেয়েছে, চিবাচ্ছে । মাটিতে আগুন রেখে হালকু পাতা জড়ো করা শুরু করলো । খানিকক্ষণের মধ্যেই একগাদা পাতা জড়ো করে ফেললো । ঠাণ্ডায় হাত জমে গেছে, খালি-পা দুইটাও অবশ হয়ে আসছে । তবু পাতার রীতিমতো একটা পাহাড় জমিয়ে ফেললো । আর তাতে আগুন ধরিয়ে সে শীত পোড়াবে ।
খানিক বাদেই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো । আগুনের শিখা উঠে ডালপালার দিকে যাচ্ছে । সেই চঞ্চল আলোয় বাগানের সব গাছ দেখে মনে হচ্ছে তারা মাথায় ঘুটঘুটে আঁধার ভর করে আছে । আঁধারের অপার দরিয়ায় এই আলো যেন নৌকার মতো এদিক ওদিক হেলে দুলে চলছে ।
হালকু গা গরম করে নিতে আগুনের সামনে বসলো । খানিক বাদে গায়ের শালটা খুলে নিয়ে পেছনে গুঁজে নিল, তারপর দুই পা ছড়িয়ে বসলো - ভাবটা এমন যেন শীতকে বুড়া আঙুল দেখাচ্ছে । শীতের অসীম শক্তিকে সে হঠিয়ে দিয়েছে, এই জয়োল্লাস মনে ধরে রাখা তার সাধ্যে কুলাচ্ছে না ।
জবরাকে বললো, `তো জবরা, তোর আর শীত লাগছে না, তাই না ?'
জবরা ঘেউ ঘেউ করল, যেন বলতে চাইছে, `কিসের আবার শীত এখন ?'
`এই খেয়ালটা আমাদের আগেই করা উচিত ছিল, তা হলে শীতে এত কাবু হতে হতো না ।' জবরা লেজ নাড়লো । `ঠিক আছে, এখন আগুনটা লাফিয়ে পার হই, কি বলিস ? দেখি কেমন পারি । মগর পুড়ে টুড়ে গেলে দাওয়াই দেয়ার বেলা আমি নাই ।
জবরা ভয়ে ভয়ে আগুনের দিকে তাকালো ।
`দেখিস আবার মুন্নিকে বলে দিবি না কালকে । তা হলে ঝগড়া না-বাঁধিয়ে ও ছাড়বে না ।'
বলেই সে একটা লাফ দিয়ে আগুন টপকে গেলো । পায়ে থোড়া ছ্যাঁকা লাগলেও পাত্তা দিলো না । জবরা আগুনের পাশ দিয়ে ঘুরে তার কাছে এলো । হালকু বললো, `উঁহু, এ তো হলো না । সোজা লাফিয়ে আয় ।' বলে সে লাফিয়ে ফের ওপাশে চলে গেলো ।
হালকু আবার চাদর দিয়ে নিজেকে ভালো করে জড়ালো । তারপর গরম ছাইয়ের পাশে বসে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো । গা থোড়া গরম হয়েছে বটে, কিন্তু যেই শীত পড়া ধরলো ফের তাকে কুঁড়েমিতে পেয়ে বসলো ।
জবরা বিকট চিত্কার করে খেতের দিকে ছুট দিলো । হালকু বুঝলো এর মানে খেতে হয়তো বুনো জানোয়ারের যূথ নেমেছে । নীল বলদ হতে পারে । নড়াচড়ার আওয়াজ সে বিলক্ষণ পেয়েছে । মনে হলো খেতে চরে বেড়াচ্ছে । কি যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে - আওয়াজও পাওয়া যায় ।
ও ভাবল, `না, জবরা থাকতে তো কোনো জানোয়ারের খেতের সীমা মাড়াতে পারার কথা না । জবরা ওকে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলবে । নির্ঘাত আমার ভুল হচ্ছে । কই, আর তো আওয়াজ নাই ? কি শুনতে কি শুনে বসেছি ।'
হাঁক পাড়লো সে, `জবরা ! জবরা !'
জবরা ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে, কাছে আসলো না ।
খেতে ফের কড়মড় করে চিবিয়ে খাওয়ার আওয়াজ হচ্ছে । এবার আর ভুল হয় নাই । মগর, ডেরা ছেড়ে উঠলেও মনে হয় ধরে পেটানো হচ্ছে । এত জুত করে ডেরা পেতে বসছে, এই শীতে উঠে খেতে গিয়ে জানোয়ার তাড়ানো তার বেজায় অসহ্য মনে হলো । ও নড়লো না ।
জোরে ডাক দিলো সে, `হিলো, হিলো........'
জবরা আবার ঘেউ ঘেউ করে উঠলো । ফসল যেই না পেকে উঠেছে অমনি জানোয়ারের দল বেবাক সাবাড় করে দিচ্ছে । বেশ ফসল হয়েছে এবার ! আর এই বানচোত জানোয়ারগুলো বেবাক বরবাদ করে দিচ্ছে । মনকে এবার বেঁধে সে উঠে কয়েক কদম এগিয়ে গেলো । কিন্তু আচম্বিতে বিচ্ছুর ছুঁচের নাহান এক ঝটকা বাতাস এসে তাকে যেন হুল ফুটিয়ে দিলো । ফিরে এসে নিভু নিভু আগুনের সামনে বসে ঠাণ্ডা গা ফের একটু গরম করে নিতে লাগলো । নীল বলদের দল খেত ছারখার করে দিচ্ছে বলে জবরা গলা ফাটিয়ে চিত্কারের পর চিত্কার করেই যাচ্ছে আর হালকু আরামসে বসে আছে গরম ছাইয়ের পাশে । ওর চারদিকে এখন আলসেমি আর শিথিলতার এক অবিশ্বাস্য বেড়াজাল । শাল ভালভাবে জড়িয়ে ছাইয়ের পাশে গরম মাটিতে সে গা এলিয়ে দিলো ।
সকালে যখন ঘুম ভাঙলো দেখলো চারদিকে ঝলমলে রোদ খেলা করছে । মুন্নি ডাকছে ওকে, `সারাদিন ঘুমানোর মতলব করেছ নাকি -- এতক্ষণ এখানে আরামসে কাটিয়ে দিলে আর ওদিকে দেখ গিয়ে গোটা খেতের বারোটা বেজে গেছে ।'
হালকু উঠে বললো, `তুই কি এইমাত্র এলি খেত থেকে ?'
`হুঁ, বেবাক ছারখার হয়ে গেছে । আর তুমি ওভাবে ঘুমাচ্ছো ! টং বানিয়ে তা হলে ফায়দা কি হলো ?'
হালকু সাফাই গাইতে লাগল, `মরতে মরতে কোনোমতে রাতটা পোহালাম আর তুই আছিস ফসলের চিন্তায় । কি যে পেটব্যথা করছিলো, কি আর বলব তোকে !'
তারপর দুইজন খেতের চারপাশ ঘুরে দেখতে লাগলো । দেখলো, গোটা খেত মাড়ান, জবরা টং এর নিচে চিৎ হয়ে মরার নাহান পড়ে আছে ।
তছনছ হয়ে যাওয়া খেতে তাদের চোখ স্থিরনিবদ্ধ । মুন্নির মুখে বিষাদের ছায়া । হালকু খুশি ।
মুন্নি বললো, `দিনমজুরি করে এখন খাজনা শোধ কর গে ।'
সন্তোষের হাসি হেসে হালকু বললো, `শীতকালের রাত তো আমাকে আর এখানে কাটাতে হবে না ।'
ডিকেন্স, তলস্তয়, কার্ল মার্কস, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখের বিস্তর প্রভাব তাঁর উপর পড়েছিলো । তাঁর গল্পে সামন্ততন্ত্র, গান্ধিবাদ আর বামপন্থা যেমন ধরা দেয়, তেমনি গ্রামের জমিদার, জোতদার, চাষা-ভুষা, তোয়াঙ্গর, পাতি ব্যবসায়ি, পেশাজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণী, দেশপ্রেমিক, মোনাফেক, পণ্ডিত, বৈদ্য ও হেকিমের দল-বিশেষ করে অস্পৃশ্য, সমাজবর্জিত সর্বরিক্ত লোক রক্তমাংস নিয়ে উঠে আসে । হিন্দু-মুসলমান ঐক্য এবং আজাদ ভারতবর্ষ ছিলো তাঁর স্বপ্ন । বিশেষ, ভারতবর্ষের গ্রামাঞ্চল তাঁর রচনার সবচেয়ে বড় প্রেরণা ।
দুই দশকের লেখক জীবনে প্রেমচাঁদ চৌদ্দটা উপন্যাস, শ'তিনেক ছোটগল্প, শ'খানেক প্রবন্ধ, অসংখ্য সম্পাদকীয়, তর্জমা, চিত্রনাট্য লিখেছেন । তাঁর সবচেয়ে খ্যাতনামা উপন্যাস `গোদান' । তিনি ১৯৩৬ সনে এন্তেকাল করেন ।)
(পরবাস, অক্টোবর, ২০০৫)
৩
আরও একঘন্টা গত হলো । আজ রাত ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস দিয়ে শীত আরও শানিয়ে তুলছে । হালকু উঠে দুই হাঁটু ছাতিতে গুঁজে হাঁটুর ফাঁকে মুখ লুকিয়ে বসল, শীত তবুও কনকনে । মনে হচ্ছে গায়ের বেবাক রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে । রক্তের বদলে শিরায় শিরায় বরফ চলাচল করছে । পেছনে হেলে সে একবার আসমানের দিকে চাইলো । রাত এখনও কত বাকি ! সপ্তর্ষিতো এখনও অর্ধেক আসমানও চড়ে নাই । উঠে এক্কেবারে মাথার উপর চলে এলে তবেই না ফজর ফাটবে । রাতের এখন তিন ঘন্টাও গত হয় নাই ।
৪
পাতা সব পুড়ে ছাই । বাগান আবার আঁধারে ছেয়ে গেলো । ছাইয়ের তলায় থোড়া আগুন রয়ে গেছে, বাতাসের ঝাপটা পেলে হালকা জ্বলে ওঠে, খানিক বাদেই ফের মিট মিট করতে থাকে ।
মুনশি প্রেমচাঁদ