• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৯ | আগস্ট ২০০৭ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • অনন্তের অ্যানাটমি : অমিত রঞ্জন বসু

    স্বাতী ভট্টাচার্য, অনন্তের অ্যানাটমি, কলকাতা : গাঙচিল, বোর্ড বাঁধাই, ১৫১ পৃ., ২০০৭ ঝনজব্‌ ৮১-৮৯৮৩৪-১৮-৫

    বাংলাভাষায় আধুনিক চিকিত্সাবিজ্ঞান ও তার সাথে সমাজ-সংস্কৃতির সম্পর্ক নিয়ে লেখালেখির ঐতিহ্য কয়েক শতকের । বলা যেতে পারে যে-সময় থেকে পশ্চিমি চিকিত্সাবিজ্ঞানের বইপত্র অনুবাদ করা শুরু হল সেই সময় থেকে । আমাদের প্রবন্ধ-সাহিত্যের এই বিশিষ্ট ধারাটি যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং আধুনিক চিকিত্সাবিজ্ঞানকে আমাদের পরিষেবার প্রধান উপায় হিসাবে গ্রহণ করলেও তার প্রতি নানান সমালোচনা কিন্তু থেমে থাকেনি । তাছাড়া, ঔপনিবেশিক আধুনিকতায় বিজ্ঞান তথা চিকিত্সাবিজ্ঞানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাসও সরল বা একমাত্রিক নয় । অর্থাৎ কাহিনী বা আখ্যানটি আধুনিক চিকিত্সাবিজ্ঞানের সাহায্যে একটি `বর্বর' সমাজকে `সভ্য' করে তোলার বিবর্তনবাদী ইতিহাস নয় । সংশয়, সমালোচনা, খণ্ডনের ভাষ্যগুলি নানা প্রসঙ্গে এবং নানা স্তরে বিন্যস্ত । শুধুই ঔপনিবেশিক প্রভু আর উপনিবেশিত দাসের ছকে সেটির জটিলতা ও ক্ষমতার টানাপোড়েন বোঝা যায় না । দরকার হয়ে পড়ে ক্ষমতার ক্রিয়াকলাপকে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে বোঝার, বিশেষ করে জ্ঞান/ক্ষমতার কার্যকারিতার প্রভাবকে বোঝার ।

    আশির দশক থেকে এই ধারাটির মধ্যে একটা নতুন পরিবর্তন লক্ষ করা যায় । যে-খাতে এই সমালোচনা-সাহিত্য বইছিল সেখানে এল ছেদ । স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের রাজনীতির প্রসঙ্গ বিজ্ঞানের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন নিয়ে সামনে উঠে এল । বিজ্ঞান, বিশেষ করে চিকিত্সাবিজ্ঞান সমালোচিত হলেও তার জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তি ভূমি নিয়ে বাংলা প্রাবন্ধিকের তেমন কোনো সংশয় ছিল না । এই জ্ঞানতত্ত্বের কাঠামোটা কীভাবে গড়ে উঠেছে এবং কীভাবে ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নির্মাণ করছে - এ-সব প্রশ্ন নতুন । বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য বা পাবলিক হেল্থ-এর ব্যাপ্তি, গভীরতা ও রাজনৈতিক নানান জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্ঞানচর্চার রাজনীতির বিষয়টি এক সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রায় আজ সামনে এসে হাজির হয়েছে । বিজ্ঞান, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় যার সূত্রপাত, আজ উত্তরৌপনিবেশিক প্রসঙ্গে এসে তার সেই স্বতন্ত্র, নিরপেক্ষ, আর মানবিক হবার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না । এটা আমার কাছে শ্লাঘার ব্যাপার মনে হয় যে, এই নতুন ধারার প্রবন্ধ রচনায় বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত ও নবীন রচনাকারেরা বিগত দুই দশকে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন । এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে দীপেশ চক্রবর্তীর প্লেগ, মহামারী ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে লেখা অনুষ্টুপ -এর (১৯৮৮:২৩) প্রবন্ধটির কথা । সে সময়ে এ-ধরনের একটি প্রবন্ধ যথেষ্ট ব্যাতিক্রমী এবং র্যাডিকাল ছিল । এর পরেই নাম করতে হয় প্রদীপ বসুর, স্বাস্থ্যপত্রিকা, রান্নার বই আর আরোগ্য নিকেতন নিয়ে তাঁর চমত্কার সব প্রবন্ধ আছে । আশিস লাহিড়ীর বই ও রচনাগুলিও মনোযোগ দাবি করে তাঁর খুঁটিয়ে গবেষণা করা ঐতিহাসিক তথ্যের জন্য, যদিও এই নতুন প্রশ্নের দ্বারা তিনি তেমন প্রভাবিত নন । দেখতে পেলাম যে একঝাঁক ভালো প্রবন্ধ উঠে আসছে ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিদ্যা আর রাজনীতির সংমিশ্রণে, যাকে আমরা ইন্টারডিসিপ্লিনারি বলে থাকি । সেখানে আমার পাঠতালিকায় এসেছেন অনির্বাণ দাশ, শান্তনু চক্রবর্তী, স্বাতী ঘোষ, অনূপ ধর, অর্ণব সাহা, অরবিন্দ সামন্ত, দেবাশিস বসু, চিরন্তন সরকার, চিত্রা দেব, সুমন্ত বন্দোপাধ্যায় এবং স্বাতী ভট্টাচার্যের নাম । বলাই বাহুল্য এর বাইরেও আরো অনেক রচনাকার আছেন যাঁদের লেখার সাথে আমার পরিচয় ঘটেনি এখনও ।

    প্রবন্ধগুলি শুধু তার বিষয়বৈচিত্রেই নয়, তাত্ত্বিক প্রশ্নে, তাদের পদ্ধতি চয়নে, এবং বিশ্লেষণের গুণেই আকর্ষণীয় । শুধু তাইই নয়, এভাবেই আমাদের শিক্ষিত পাঠককুলের একাংশ একদম সাম্প্রতিক তত্ত্ব-গবেষণা ও বিতর্কের সাথে পরিচিত হয়ে উঠছেন । স্বাতীর বইটি এই নতুন ধারারই একটা উপস্থাপনা বলে আমি মনে করি । স্বাতীর বিদ্যার্জনের ইতিহাসও সেই দিকেই ইঙ্গিত দেয় । দর্শনের কৃতী ছাত্রী স্বাতী পরে মিডিয়া স্টাডিজ এ স্নাতকোত্তর পাঠ নেন । পেশাদারী সাংবাদিক হিসাবে কাজ শুরু একটি ইংরাজি দৈনিকে পরে বাংলায় । ফলে তাঁর রচনায় এই ইন্টারডিসিপ্লিনারি প্রভাব স্পষ্ট । কিন্তু যে বিষয় নিয়ে তিনি জোরালো ভাবে তাঁর পাঠকদের আকর্ষণ করেন সেটা হল নারী - অধিকার, স্বাস্থ্য আর বিজ্ঞান । বই এর প্রচ্ছদেও আছে আদি-কোষিকা ও জেনেটিক লিপির প্রেক্ষাপট । তাঁর নির্বাচিত রচনাগুলি শরীর, যৌনতা আর লিঙ্গ রাজনীতির সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ ।

    বইটা শুরু হয়েছে অরিন্দম চক্রবর্তীর একটি মনোজ্ঞ ও গভীর প্রশ্ন-তাড়িত মুখবন্ধে । দর্শনের অধ্যাপক শ্রী চক্রবর্তী মনে করেন ভারতীয় দর্শনের ভিত্তিভূমি হল চিকিত্সাশাস্ত্র । সেটা অল্প কথায় উপমাসহ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি টেনেছেন পশ্চিমি জড়বাদী বিজ্ঞানের সাথে তার সম্পর্ক ও কথোপকথনের প্রসঙ্গ । দেখার চেষ্টা করেছেন আমাদের সমালোচনার উত্সগুলিকে । স্বাতীর রচনাগুলি পড়ে তিনি মনে করেছেন :

    বাংলায় দর্শনচর্চা যাঁরা করেন, তাঁরা যদি ... দেহের ও সমাজদেহের দৈনন্দিন সমস্যাগুলি নিয়ে সংস্কৃত এবং পশ্চিমি চিন্তার দ্বারা যুগপৎ নিষিক্ত মন নিয়ে লিখতে শুরু করেন, তাহলে হয়ত `জীবনমুখী গানের' মতো জীবনমুখী দর্শন ও এদেশে পুষ্পিত হয়ে উঠবে । যদি হয় - তা হবে নিতান্ত শুভসংবাদ । (পৃ. ১৫)
    অনন্তের অ্যানাটমি শুরু হচ্ছে আয়ুর্বেদ আর ভারতীয় দর্শনের দেহ ও শরীরতত্ত্ব নিয়ে এবং সেখান থেকে স্বাতী এসেছেন জেনেটিক্স-এর সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ তত্ত্বের আলোচনায় । এই যাত্রায় তিনি খুঁজে পেয়েছেন ভারতীয় শাস্ত্রের আলোচনার সঙ্গে আধুনিক জেনেটিকস্‌ তত্বের কোনো এক সংযোগ, যা মানবশরীরের গভীরে খোঁজ করতে গিয়ে এসে দাঁড়ায় অনন্তের সামনে । স্বাতী এখানে আধুনিক বিজ্ঞানেরই অনুগামী । তাই ক্লোনিং এর অপব্যবহার ও ব্যর্থতা নিয়ে বললেও মলিকিউলার জেনেটিকস্‌ দিয়ে চেতনা বা কনসাস্নেসের ব্যাখ্যায় আশা রাখেন । যদিও স্বাতীর রচনাটি থেকে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে দেশীয় (বলা ভাল আয়ুর্বেদিক) তত্ত্বে দেহের স্বরূপ ও তার উপলব্ধি আধুনিক বিজ্ঞানের দেহ-চেতনার চেয়ে মৌলিকভাবে ভিন্ন । কিন্তু সর্বজনীন জিন-তত্ত্বের যেটা সমস্যার দিক সেটা হল তার ফেনোটাইপ নিয়ে । যেখানে পরিবেশের প্রভাবে জিনের মৌলিক বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটে । এতদ্সত্বেও যদি শুধু ভারতের কথাই ধরা যায়, তাহলে জিন-তত্ত্বের মানবোপকারী প্রয়োগ কতটা বিস্তৃত হবে বলা দু:সাধ্য ! এমনকি উচ্চশিক্ষিত জনগণও জিন-তত্ত্ব নির্মিত আত্মপরিচিতিকে আজ একবাক্যে মেনে নেবেন কি না সন্দেহ আছে । কিন্তু সেই মনোভাবকে কি একবাক্যে `অবৈজ্ঞানিক' বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে ?

    জীববিজ্ঞান আর চিকিত্সাবিজ্ঞানের ক্ষুদ্রতম বস্তুর আলোচনা থেকে আমরা চলে আসি চিকিত্সক আর চিকিত্সিতের সম্পর্কের বিশ্লেষণে । এখানে স্বাতী শুরু করেছেন তারাশংকরের আরোগ্য নিকেতন -এর জীবনমশায়কে নিয়ে । রচনাটি অনেকের মতেই, জনপ্রিয়তা হারাতে বসা আয়ুর্বেদ ও আধুনিক চিকিত্সাবিজ্ঞানের বাড়বাড়ন্তের এক দার্শনিক বিতর্কের অসামান্য দলিল । তাই জীবনমশায়কে সামনে এনে স্বাতী তোলেন চিকিত্সক আর চিকিত্সিতের সম্পর্কের নীতির প্রশ্ন যা আজকের দৈনন্দিন প্রয়োগে খুবই ভঙ্গুর দেখায় । ডাক্তার-পেশেন্ট সম্পর্কের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে এসে পড়ে ক্ষমতার কথা এবং মিশেল ফুকোর তত্ত্ব । ফুকোর তত্ত্বই একাধারে উদারনৈতিক মতবাদ ও মার্কসবাদী মতবাদের সমালোচনা করে দেখায়, যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই জ্ঞানচর্চা সংগঠিত হয়ে উঠেছে সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্যে রোগী কখনই অসাম্য থেকে মুক্ত হতে পারে না । এই সংগঠিত জ্ঞানচর্চার প্রভাবেই রোগী চিকিত্সক ও চিকিত্সাব্যবস্থার বিধান গুলি অন্তর্গত বা ইন্টারনালাইজ করে ফেলে এবং এই বিশ্বাসে আচরণ করে যে এটাই তার পক্ষে ভালো । এই ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ায় রোগীর শরীর সর্বদা সবসময় `জ্ঞানের বস্তু' ।

    স্বাতী অবশ্য ফুকোবাদী বিশ্লেষণে না গিয়ে চলে এসেছেন সরেজমিন অভিজ্ঞতার বিবরণী আর সমীক্ষায় । দেশ ও বিদেশের তথ্য ঘেঁটে তিনি দেখিয়েছেন পরিষেবা ব্যবহারকারী হিসাবে রোগীদের সংগঠিত আন্দোলনের প্রভাবে কি কি পরিবর্তন ঘটেছে । বেশ আন্তরিকতার সাথে খতিয়ে ভেবেছেন স্বাতী সম্পর্কটি নিয়ে এবং মন্তব্য করেছেন :

    রোগীর অধিকার, ডাক্তারের দায়, এই ধারণার নিরিখে আলোচনা এগিয়েছে এত দিন কিন্তু আজ মনে হয়, এবার নতুন কোনও মাত্রা যোগ করার দরকার হয়ে পড়েছে । আজ বড় প্রয়োজন নতুন কোন দার্শনিকের, যিনি চিকিত্সক-রোগীর সম্পর্কের এই সংকট একবিংশ শতাব্দীর `বিশ্বায়িত' সমাজের নিরিখে বিচার করবেন । (পৃ. ৬১)

    আগের এই দুটি প্রবন্ধে নানাভাবে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাওয়া গেলেও তৃতীয় প্রবন্ধ পয়স্বিনী তে সরাসরি নারীবাদী বিশ্লেষণের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে । এখানে একটি সাম্প্রতিক বাংলা ছবি শূন্য এ বুকে র সূত্র ধরে তিনি প্রবেশ করেছেন নায়িকার স্তন নিয়ে তাঁর মনস্তাত্ত্বিক জগতে এবং সেখান থেকে চলে এসেছেন নারী-স্তন বিষয়ক ডিসকোর্সে । স্বাস্থ্য থেকে যৌনতা সবকটি প্রসঙ্গকেই তিনি ধরার চেষ্টা করেছেন এবং উথ্থাপন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ তর্ক । চলে এসেছেন তথাকথিত নিরীহ স্বাস্থ্য শ্লোগান ব্রেস্ট ফীডিং এর রাজনৈতিক জটিলতায় । স্বাতীর অ্যাক্টিভিস্ট সত্তাটি এখানে বেশ স্পষ্ট :
    তবে সৌন্দর্যের যে স্বৈরতন্ত্রে এখন মেয়েরা বিবশ হয়ে পড়ছে, যার দৌলতে নয় বছরের মেয়ে শৈশবের জীবন প্রাচুর্য ভুলে ডায়েটিং করে, উনপঞ্চাশের মেয়ে গোধূলির নরম আমেজে দেহ না এলিয়ে হরমোন রিপ্লেস্মেন্ট থেরাপির ওষুধ গেলে, আর মাঝের সবকটা বছর প্রতিটি মেয়ে মোটা হয়ে যাওয়ার আশংকায় বিষন্ন, উত্কন্ঠিত হয়ে থাকে, তা চিন্তা করলে আজও কিছু একটা ভেঙেচুরে পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করেই । (পৃ. ৭২)

    সংকলনটিকে যদি দুভাগে ভাগ করা যেত তাহলে আমি এই তিনটি প্রবন্ধের পরের রচনাগুলিকে সাংবাদিকতামূলক রচনার ভাগে ফেলতাম । আগের রচনাগুলিতে যে বিস্তার ও গভীরতার রস আছে, তর্কের ও প্রতি-তর্কের বিন্যাস আছে পরেরগুলিতে ততটা নেই । পরিসর ছোট হবার দরুণ এগুলি সংবাদপত্রের নিবন্ধের মেজাজে লেখা । যদিও বিষয় নির্বাচনের গুরুত্বে রচনাগুলি মৌলিক এবং তাদের নিহিত সম্ভাবনাগুলিকে ভবিষ্যতে অনুসন্ধান করা যায় ।

    যেমন নগ্নতা, পর্ণোগ্রাফি ও গণমাধ্যম রচনাটি আমার পড়া বাংলায় প্রকাশিত এ বিষয়ক প্রথম নারীবাদী রচনা এবং সাহসীও বটে । `দেখা' র যে প্রেক্ষিত পর্নোগ্রাফিকে সক্রিয় ও সংগঠিত করে তোলে স্বাতী সেগুলিকে উপস্থাপিত করেছেন তাঁর বর্ণনায় । বলেছেন নারীবাদী জগতে পর্নো-সমর্থক ও তার বিরোধিদের বিতর্কের কথা । বই থেকে ইন্টারনেট, সবধরনের গণমাধ্যমকে ধরে তিনি আলোচনা করেছেন । তবে সমস্যা হল যে, মানুষের গড়া কামচর্চার লোক-পরিসর বা পাবলিক ডোমেন এতই জটিল ও নানা ধরনের যোগাযোগের সমাবেশে বিচিত্র যে, সেখানে বাজার আর উপভোক্তার ছকে পর্নোগ্রাফির বিশ্লেষণ সীমিত লাগে । এবং এই ছকে নারী, শিশু ও অন্যান্য কাম-প্রতিরূপের কোনো মুক্তি নেই ! বিশেষ করে যেখানে আইন করে এই নতুন টেকনোলজির ওপর সর্বৈব নিয়ন্ত্রণ আনা মুশকিল । একই বৌদ্ধিক সম্পত্তি আইন লংঘন করে নিশান্ত এর অগুণতি চোরাই কপি এবং পর্নোছবির কপি খুব একটা ঝক্কি না নিয়ে তৈরি করে ফেলা যায় । তার ওপর মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তোলা ছবির বিতরণ ধরলে তো কথাই নেই ! এর প্রতিরোধি চিন্তাগুলি নগ্নদেহ ও কাম বিষয়ে মরালিস্ট অবস্থান থেকে কিছু করে উঠতে পারছে না কারণ নগ্নতা ও কাম এ দুয়েরই মুক্ত হবার উপায় আধুনিক রাষ্ট্রের প্রশাসনিকতায় নেই । কাতরিনের সঙ্গে ট্রাফিক জ্যামে রচনাটিকে এর ধারাবাহিক বলা চলে । এখানে স্বাতীর দ্রষ্টব্য বিসমকামী যৌনসঙ্গমকে চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত করার সমস্যা । কাতরিনের বিখ্যাত ও বিতর্কিত ছবিগুলি : সেক্স ইজ কমেডি (২০০২), দ্য ফ্যাট গার্ল (২০০১), এবং রোমান্স (১৯৯৯) আলোচনার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে নারীবাদের অন্তনির্হিত যৌনসত্তার দ্বন্দ্বের কথা যা সঙ্গম কে প্রকাশ্য করার মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে । `আসল' আর `যা দেখানো হবে' তার মধ্যে কি রয়েছে লিঙ্গ-রাজনীতির সমস্যা ? কাতরিনের সেই বক্তব্যই লিপিবদ্ধ করেছেন স্বাতী ।

    খাচ্ছিটা কী , আঁশ রচনাদুটি আমাদের খাদ্যাভাসের প্রধান উপাদান শাক-সব্জি আর মাছ নিয়ে লেখা তথ্যনিষ্ঠ রচনা । নতুন নতুন কৃত্কৌশলের প্রয়োগে কিভাবে আমাদের আহার্য বস্তু দূষিত পদার্থ নিয়েই সৃষ্ট হচ্ছে সেই ভয়াবহ প্রক্রিয়াটির দিকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন । এত মোটা কেন ? লেখাটি হাল আমলের ফ্যাশন আর নারীশরীরের স্থিরীকৃত নন্দনতত্ত্ব নিয়ে নারীবাদী সমালোচনা । প্রথম টেস্ট টিউব সন্তান দুর্গার ( দুর্গা ও তারপর ) বড় হয়ে ওঠার কথা বলতে বলতে স্বাতী এসেছেন কৃত্রিম প্রজনন কৌশল বা আর্টিফিশিয়াল রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজির বিকাশের কথায় । এসেছে, ভারতে তার প্রথম রূপকার ড: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের যন্ত্রণাদায়ক গবেষণা অভিজ্ঞতার স্মৃতি । কিন্তু নারীবাদী স্বাতী এখানে নারীর একক মাতা হবার মতন গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গটি কেন আনলেন না বোঝা গেল না ! পরিবার পরিকল্পনার নারী বন্ধ্যাকরণ কর্মসূংইচর ওপর লেখাটি ( উলটো মানত ) কর্মসূচির ব্যর্থতার দিকগুলিকে বেশ সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে । নিম্নবর্গের নারীশরীর আর বন্ধ্যাকরণের `সুফল' এই দুইয়ের টৈনশন তৈরি হয় নানাবিধ নারীবিরোধী শক্তির সমন্বয়ে । শেষ রচনার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুগম্ভীর ও বিতর্কিত ( ইচ্ছামৃত্যু ) । নানান বিতর্ক থেকে উদাহরণ তুলে আনলেও রচনাটি যথেষ্ট গভীরে ঢুকতে পারেনি । আমাদের ঐতিহ্যেই শুধু নয়, আমাদের আধুনিক জ্ঞানচর্চার ইতিহাসেও ইচ্ছামৃত্যু নিয়ে যে জ্ঞানভাণ্ডার আছে সেখানে তিনি হানা দিতে পারেননি । আমাদের আধুনিক দর্শন আলোচনাতেও প্রসঙ্গটি নানাভাবে এসেছে । যে আধুনিক-রাষ্ট্র হিংসার ওপর প্রতিষ্ঠিত সেইই কিন্তু চায় না তার প্রসাশিত শরীর নিজেকে শেষ করার ক্ষমতা রাখতে পারে ! এই প্যারাডক্সটি খুঁড়ে দেখা দরকার । আবার এটাও দেখা গেছে যে, অনেক আত্মহত্যাকামী মানুষ একটিবারের জন্য কথা বলতে পেরে ঘুরে গিয়েছেন উল্টো দিকে ! তাই এ বিষয়ে `সমবেত সুর' সৃষ্টি করা যাবে কি না জানি না, তবে মানুষের এই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করাটা খুব অসম্ভব কিছু নয় । সেটা মানবিকও নিশ্চয় ।

    সবমিলিয়ে অনন্তের অ্যানটমি একটি উপভোগ্য পাঠ । বিষয়বস্তু নির্বাচন ছাড়াও স্বাতীর ঝরঝরে, সাবলীল বাংলাভাষা এক ব্যাপক পাঠকসমাজকে ছোঁবার ক্ষমতা রাখে । ভাষার এই সহজবোধ্য ভাবটি কিন্তু বক্তব্যের জটিলতাকে মসৃণ করে দেয় না । এখানেই স্বাতীর মুন্সিয়ানা । তবে রচনাগুলি সাজানোর সময়ে বড় রচনাগুলির ফাঁকে ছোট রচনাগুলিকে রাখলে একটা ভারসাম্য আসত । কারণ বড় রচনাগুলি পড়ার পর পাঠকের মধ্যে যে আশার সঞ্চার হয় পরবর্তী ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রতর লেখাগুলি পড়তে গিয়ে সে আশায় বাধা আসে । একটি প্রবন্ধে কিছুটা ফুকো আলোচনা করলেও, স্বাতীর সব রচনারই মূল সুর দৃষ্টবাদী বা পজিটিভিস্টিক । অর্থাৎ বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর আস্থা গভীর, দু-একটি অপপ্রয়োগকে বাদ দিলে । কিন্তু সেই বিজ্ঞানকে সংস্কৃতির মাধ্যমেই পৌঁছতে হবে । তার খুঁজে আনা `সত্য' কে ভাষা / চিহ্ন দিয়েই প্রবাহিত হতে হবে । কোন নিরপেক্ষ, ফাঁপা, সমসত্ব সময়ে সেই `সত্য'কে চিরপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব ? সেই প্রশ্নটির সাথে স্বাতী ভিন্নমত হতে পারেন কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারেন কি ? তাছাড়া নারীবাদই তো সবথেকে বেশি নাড়া দিয়েছে বিজ্ঞানের, বিশেষত জীববিজ্ঞানের ভিত্তিকে । আজ স্ত্রী/পুরুষের জৈব-লিঙ্গের নিশ্চয়তা নিয়েও সংশয় উঠেছে । স্বাতীর নারীবাদী বিশ্লেষণ বা বিবরণীতেও বিসমকামী যৌনতা / কামচর্চার আধিক্য অবিসমকামী যৌনতার প্রসঙ্গগুলিকে আড়ালে পাঠিয়ে দিয়েছে । আসেনি জিন বিষয়ে সমকামী গবেষণার কথা কিংবা রূপান্তরকামী মানুষের কথা, সর্বোপরি তৃতীয় লিঙ্গের কথা । আশা করা যায় তাঁর আগামী কাজগুলিতে এ বিষয়ে আমরা আরও জানতে পারব ।

    স্বাতীর লেখার একটি প্রধান গুণ তথ্যনিষ্ঠা । যদিও তথ্যচয়নের ক্ষেত্রে তিনি শরীর বিষয়ক বিখ্যাত নারীবাদী তাত্বিক জুডিথ বাটলারকে কেন বর্জন করলেন বোঝা গেল না ! এ ছাড়াও আমাদের দেশের নারীবাদী তাত্ত্বিকদের বই বা রচনার প্রয়োগও তুলনামূলকভাবে কম । সে কারণটিও স্বাতী ব্যাখ্যা করেননি । এ-সত্বেও স্বাতীর বইটি বাংলা প্রবন্ধের এই বিশেষ ধারার এক উল্লেখজনক সৃষ্টি হয়েই থাকবে । এ সময়ের নতুন প্রশ্নগুলিকে দর্শন ও রাজনীতির সমন্বয়ে নতুন নতুন প্রেক্ষিত থেকে বিশ্লেষণ করতে হবে, সেই প্রসঙ্গটি স্বাতী তাঁর প্রতিটি রচনায় জোরালোভাবে উপস্থিত করেছেন । তাছাড়া একমলাটের মধ্যে শরীর, জীববিজ্ঞান আর লিঙ্গ-রাজনীতির একটা সমসাময়িক তথ্য ও তত্ত্বভিত্তিক বিশ্লেষণ, বাংলা ভাষায় পাওয়া অবশ্যই এক নতুন প্রাপ্তি । শুধুই সাধারণ পাঠকরা স্বাতীর বইটি পড়ে উপকৃত হবেন না । আমি মনে করি মানবীবিদ্যাচর্চা, সমাজবিদ্যা আর মিডিয়া স্টাডিজ এর পাঠক্রমেও বইটা অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত । আমাদের স্থানীয় প্রসঙ্গটিকে বোঝার সুবিধার জন্য শুধু নয়, বাংলাভাষায় কীভাবে সমসাময়িক আন্তর্জাতিক জ্ঞানচর্চাকে আমাদের সংস্কৃতিতে যাচাই করে নিতে হয়, সেই শিক্ষার জন্য । সেই বাংলাভাষা শেখানোর চর্চা যদি পাঠক্রমে না থাকে তবে কীভাবে সমৃদ্ধ হবে সৃষ্ট হওয়া এই নতুন ধারাটি ? সেদিক থেকেও স্বাতী গণমাধ্যম শিক্ষার্থীর জন্য একটা উত্কৃষ্ট নমুনা তৈরি করে গেলেন ।

    (পরবাস ৩৯, জুন, ২০০৭)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments