রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন যে তাঁর বন্ধুসংখ্যা অল্প । সেই অল্পের মধ্যে রামানন্দ ছিলেন তাঁর অন্যতম সুহৃদ । পন্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনের কথায় - "রামানন্দবাবুর ওপর রবীন্দ্রনাথের অগাধ শ্রদ্ধা ছিল । আর রামানন্দ বলেছিলেন, "আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্য রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব লাভ ।" সুদীর্ঘকালব্যাপী এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক এই দুই মনীষীকেই অনাবিল আনন্দ দিয়েছে ও আমৃত্যু তা অটুট থেকেছে ।
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ২৮শে মে ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে । রবীন্দ্রনাথের থেকে তিনি চার বছরের ছোট ছিলেন । তাঁদের দুজনের সাক্ষাৎ পরিচয় হয় ১৯০০ সালে এলাহাবাদে । কলকাতায় আসার আগে রামানন্দ এলাহাবাদে থাকতেন । ১৯০৮ সালে কলকাতায় এসে তিনি কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের পাশে একটি ছোট বাড়ি ভাড়া করে সেখানে প্রবাসী ও মডার্ন রিভিউ - এই দুটি কাগজ চালাতে লাগলেন । সমসাময়িক বাঙালি জীবনে তাঁর সম্পাদিত এই দুটি পত্রিকার প্রভাব ও প্রেরণা অসামান্য ছিল । বিশেষ বিশেষ বিষয়ের অন্যান্য মাসিকপত্র নিশ্চয়ই সে সময় উচ্চ মানের ছিল, কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিচার করলে প্রবাসীর জুড়ি তেমন কোনওটিই ছিল না ।
`প্রবাসী' সম্পাদনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে রামানন্দের কৃতিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ । রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রকাশ পত্রিকাটির এক বিশেষ আকর্ষণের বিষয় ছিল । `প্রবাসী'র প্রথম সংখ্যাতেই তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল -
তারপর অবিরামভাবে প্রতি সংখ্যায় প্রথম কবিতাটি রবীন্দ্রনাথেরই হত । রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি প্রসারে পত্রিকা দুটি যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল । ভারতের বাইরে কবিকে চিনবার সুযোগ মানুষ প্রথম পায় `মডার্ন রিভিউ'এর সাহায্যে । রবীন্দ্রনাথের আশ্চর্য প্রতিভা জগতের সামনে পূর্ণভাবে প্রকাশের জন্য রামানন্দ সর্বতোভাবে সচেষ্ট ছিলেন । তিনি ছিলেন একেবারে সহজ সরল মানুষ, তেমনই সাধারণ ছিল তাঁর জীবনযাত্রা । কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের বাড়িটির ছোট একটি ঘরে তাঁর দুটি পত্রিকার অফিস । ত্রক্রমে সেই জায়গাটি নানা দেশের মনীষীদের একটি তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠল । সেখানে হার্বাট ফিসার, রামজে ম্যাকডোনাল্ড, সিস্টার নিবেদিতা, অধ্যাপক গেডিস প্রমুখ বিদেশী বিশিষ্ট মানুষদের এবং রবীন্দ্রনাথ, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, গোখলে প্রমুখ ভারতীয় মহাপুরুষদের যাতায়াত ছিল । রবীন্দ্রনাথ সেখানে বহুবার গেছেন । অনেকসময় জোড়াসাঁকো থেকে হেঁটেই ঐ বাড়িতে তিনি যেতেন । কোনও কোনও সময় কন্যা ও পুত্রসহও সেখানে যেতেন । অনুরূপভাবে রামানন্দও পরিবারস্থ কাউকে নিয়ে জোড়াসাঁকোয় যেতেন । দুই পরিবারে নিমন্ত্রণ মাঝে মধ্যেই হত ।"পরবাসী আমি যে দুয়ারে চাই,
তারি মাঝে মোর আছে যেন ঠাঁই,
কোথা দিয়ে সেথা প্রবেশিতে পাই
       সন্ধান লব বুঝিয়া !
ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়
       তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া"॥
প্রবাসীর আগে `প্রদীপ' ও `দাসী' নামে আরও দুটি পত্রিকার সম্পাদনা রামানন্দ করেছিলেন । এই `প্রদীপ'-এ প্রথম বছরে (১৩০৪-৫) রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি বিখ্যাত কবিতা প্রকাশিত হয় । "সময় হয়েছে নিকট এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে", "আজি কি তোমার মধুর মুরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে", "ভালবেসে সখি নিভৃত যতনে" ইত্যাদি প্রসদ্ধি কবিতার যে `প্রদীপ'-এই প্রথম প্রকাশ ঘটে, তা হয়ত আমাদের অনেকেরই জানা নেই । এই `প্রদীপ'-এর যুগ থেকে `প্রবাসী'র যুগ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রামানন্দের নানান বিষয়ে আলাপ আলোচনা চলত এবং কবিতা ও লেখা প্রকাশ হত । প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথের আশ্চর্য প্রতিভা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল, যা দিনে দিনে গভীর ভালবাসায় পরিণত হয় । রবীন্দ্রনাথ যে কোনও লেখা দিতে একদিনও দেরি করতেন না, তাতে নিয়মনিষ্ঠ রামানন্দ মুগ্ধ ও বিস্মিত হতেন । তিনি কবি মানুষ, কিন্তু সেইসঙ্গে উচ্চ আদর্শবাদী ও শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের জন্য সর্বত্যাগী দেখে রামানন্দের ইচ্ছা হল এই ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমের উচ্চ আদর্শকে সার্থকতা দান করবার জন্য তিনিও যদি কিছু করতে পারেন । এই চিন্তা থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথের আদর্শ ও সাহিত্যপ্রচারে ব্রতী হলেন । শুধু রবীন্দ্রনাথের রচনা `প্রবাসী'তে ছাপানো নয়, তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা প্রবাসীর বিশেষ বিভাগ "বিবিধ প্রসঙ্গের" সাহায্যে প্রচার, বিশ্ববিদ্যালয়ে ও শিক্ষাবিভাগে তাঁর বই পাঠ্য করবার চেষ্টা, আশ্রমের আদর্শ প্রচার করা - এই সমস্ত কাজই তিনি সারাজীবন ধরে করে গেছেন ।
যখন কবির ইংরেজি `গীতাঞ্জলি'র জন্ম হয়নি, তখনও তাঁর ইংরেজি লেখা `মডার্ন রিভিউ'এ প্রকাশিত হত । ১৯১১ সালে রামানন্দ একবার কবির কাছে তাঁর কিছু ইংরেজি অনুবাদ চান । কবি তাঁর বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিতের করা "নিস্ফল কামনা" (সাক্ষী) কবিতার অনুবাদ রামানন্দকে পাঠিয়ে দেন । "যশণ্ণঠঞত্ংযয ঙশষ্" নামে তা ১৯১১ সালের মে মাসের মডার্ন রিভিউ-এ বেরোয় । সন্ধ্যাসঙ্গীতের "তারকার আত্মহত্যা" কবিতাটি 'ঈংছঞচ্ ধী ছ নঞছশ' নাম দিয়েও বেরোয় । এর পরে রামানন্দ রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নিজের কবিতা নিজেকেই অনুবাদ করতে বলেন । কবি ছোটবেলায় ইংরেজি শিক্ষায় অবহেলা করেছেন, এই অজুহাত দেখিয়ে নিস্কৃতি চাইলেন । কবি তাঁর `মায়ার খেলা' থেকে উদ্ধৃত করে বললেন -
রামানন্দ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সমাজনৈতিক - নানা বিষয়েই লিখতেন । রাজনীতি বিষয়ে কিছু লেখার আগে রবীন্দ্রনাথ রামানন্দের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতেন, ভারতপ্রেমিক এই বন্ধুটির ওপর রবীন্দ্রনাথের এমনই গভীর প্রত্যয় ছিল । জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের পর `স্যার' উপাধি ত্যাগের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন । রামানন্দবাবু নির্ভীক লেখনীর জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন । তাঁর সঙ্গে যে রবীন্দ্রনাথের কোনও কোনও বিষয়ে মতভেদ হত না, তা নয়, তবে তাতে তাঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধার বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটেনি । ১৯১৭ সালে অ্যানি বেসান্তকে কবি যখন কংগ্রেসের নেত্রী করতে চান, তখন তাতে রামানন্দ সম্মত ছিলেন না । অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপারেও অনেক প্রসঙ্গে উভয়ের মধ্যে মতপার্থক্য ঘটেছিল । অকুতোভয় রামানন্দ তাঁর নিজস্ব মত প্রকাশে কখনও দ্বিধা করতেন না । তাঁদের আশ্চর্য বন্ধুতা তার জন্য কোনও দিন স্বচ্ছতা হারায়নি ।
রামানন্দের পরিবারও রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন । রাজা, শারদোত্সব প্রভৃতি যে সব নাটক আশ্রমে অভিনীত হত তাতে প্রত্যেকবারই তিনি সপরিবারে আসতেন । একটি কুটির কিনে সেখানে বহুদিন বসবাস করেছিলেন এবং তারপরও বহুবার শান্তিনিকেতনে এসেছেন । নোবেল প্রাইজ পাবার পর কবিকে সম্বর্দ্ধনা জানানোর জন্য কলকাতা থেকে বিশেষ ট্রেনে সাহিত্যজগতের যেসব মানুষ শান্তিনিকেতনে আসেন, সেই ১৯১৩ সালে ২৩শে নভেম্বর রামানন্দ সপরিবারে তাঁহাদের মধ্যে ছিলেন । বাংলার ১৩০৮ সালে রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়ায় টাউন হলে যে কবি সম্বর্ন্ধনা হয়, সেখানেও তিনি সপরিবারে উপস্থিত ছিলেন । সেদিন তাঁর লেখার উপসংহারে ছিল, "তাঁহার সম্বর্দ্ধনার জন্য বাঙালী আরও অধিক আয়োজন করিলেও অতিরিক্ত হইত না ।" রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছর পূর্ণ হওয়ার পর কলকাতায় রবীন্দ্র জয়ন্তী সভায় তাঁকে রামানন্দ "গোল্ডেন বুক অফ টেগোর" বইটি উপহার দেন । একই সঙ্গে তিনি এই কমিটি ও বইটির সম্পাদক ছিলেন ও এর ভূমিকাটি তাঁরই লেখা ছিল । রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দ উভয়েই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন । কবির আশিবছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষ্যেও রামানন্দ সেখানকার জয়ন্তী অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করেন ও অভিভাষণ দেন । অসুস্থ শরীরে কবি সেখানে আসতে পারেননি, অভিভাষণটি পড়ে লেখেন - "সেন্ট জেভিয়ার্সের রবীন্দ্র জয়ন্তীতে আপনার সুগ্রথিত অভিভাষণটি পড়ে বিশেষ আনন্দ লাভ করেছি । আমার উদ্দেশ্যে আপনাদের এই অকৃত্রিম শ্রদ্ধার বাণী আমার জীবনে বিধাতার প্রসন্নতাকে সার্থক করে ।"
১৯১৭ সালে রামানন্দ শান্তিনিকেতনে তাঁর কেনা কুটিরে একটানা দুবছর ছিলেন । এই সময় তিনি কবির `দেহলি' বাড়ির ছাতে এসে কবির কাছে বসতেন । এ সময় তাঁরা দুজনে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতেন । শিশুদের জন্য বিশ্বের নানান সাহিত্য থেকে ভাল ভাল জিনিস নিয়ে বাংলাভাষাতে নূতন নূতন বই রচনা বিষয়ে ও বিশ্বের নানান সাহিত্যের বই অনুবাদ করবার বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা চলত । দেশের অবস্থা, রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি নানান বিষয়ে দুজনের মধ্যে চিন্তার আদানপ্রদান চলত । বিশ্বভারতীতে যখন শিক্ষা-ভবন অর্থাৎ কলেজ বিভাগ স্থাপিত হয় তখন কবি রামানন্দকে সেই বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন । তিনি বিনা বেতনে সেই কাজে যোগ দিয়েছিলেন । যতদিন শান্তিনিকেতনে ছিলেন, ততদিন ছাত্রদের সাহিত্যসভায় সভাপতির কাজ করতেন ও বহু মূল্যবান উপদেশও দিতেন ।
বাইরের দিকে রামানন্দ গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে সরসতার অভাব ছিল না । কবিকে তিনি বলতেন, "দূর হইতে দেখিলে মনে হয় আপনার বোধহয় খুব আড়ম্বরময় জীবন । কিন্তু কাছে আসিয়া দেখি আপনার ঘরে একখানি হাতপাখা পর্যন্ত নাই । দারুণ গ্রীষ্মে মধ্যাহ্নে আপনি সব জানলা-দরজা খুলিয়া সারাদুপুর চৌপর দিন কাজ করেন । চেয়ার নাই, টেবিল নাই, মাদুরে বসিয়া সামান্য ডেস্কে রাখিয়া লেখেন । ঘরের জিনিস শিকাতে ঝুলাইয়া রাখেন । আসলে আপনার চেহারাটাই রাজসিক । একখানি ফর্সা কাপড় পরিলেই আপনাকে রাজার মত দেখায় ।" এসব কথা ক্ষিতিমোহন সেনের লেখা থেকে আমরা পাই । রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে মাঝে মাঝে সব মজার মজার চিঠি আসত । কবি সেসব রামানন্দকে দেখাতেন ও দুই বৃদ্ধ বসে বসে তার রস সম্ভোগ করতেন । রামানন্দের পুত্র মুলু আশ্রমের ছাত্র ছিল ও নানান কাজে জড়িত ছিল ।
রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ রামানন্দকে গভীর স্নেহ করতেন । তাঁকে তিনি পরিহাস করে "প্রবাসী মঠের রামানন্দ স্বামী" বলতেন । তাঁর পৌত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ সে সময় আশ্রমে থাকতেন । তিনি খুব মজলিশী মানুষ ছিলেন । নেপাল চন্দ্র রায়, রামানন্দ, ক্ষিতিমোহন সেন দীপুবাবুর বাড়ি সরগরম করে তুলতেন । এইসব সময় কোনও কোনও সময় রবীন্দ্রনাথও উপস্থিত থাকতেন । একদিকে দ্বিজেন্দ্রনাথ, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজপুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ সঙ্গে একই সঙ্গে রামানন্দের প্রীতিপূর্ণ বন্ধুত্ব ছিল ।
জীবনের সুখে দু:খে রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দের গভীর নৈকট্য দুজনকেই প্রাণে বল জুগিয়েছে ও দুজনকেই সমৃদ্ধ করেছে । ত্রক্রমশ: কবির অসুস্থতা রামানন্দকে ম্রিয়মাণ করেছে । তাঁর শেষ অসুস্থতার সময়ে রামানন্দ জোড়াসাঁকোয় প্রতিদিনই উপস্থিত থাকতেন, কিন্তু ডাক্তারের বারণ থাকায় নীরবে কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে যেতেন । ২১শে শ্রাবণ কবির জ্ঞান চলে যাবার পর রামানন্দকে নিয়ে আসা হল । তিনি কবির পাশে বসে উপাসনা করলেন । অন্তরঙ্গ বন্ধুর প্রয়াণে শোকাহত রামানন্দ লিখলেন - "আকাঙ্খা ছিল কবির আগে আমার মৃত্যু হয় । রবীন্দ্রহীন জগতের কল্পনা কখনও করি নাই । ভাবি নাই রবীন্দ্রবিহীন জগত দেখিতে হইবে ।" রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে চতুর্থদিনে রামানন্দ এক মর্মস্পর্শী উপাসনা করেন । তিনি বলেন, "যে মহামানবকে গড়িয়া তুলিতে বিধাতার এত যুগ লাগিয়াছিল, তাঁহাকে শুধু এ আশিটি বত্সরের জন্য তিনি সৃষ্টি করিয়াছিলেন, বিশ্বাস করিতে পারিতেছিনা ।" রবীন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের দিন সন্ধ্যায় উত্তরায়ণে তিনি উপাসনা করেন । শ্রীযুক্ত জীবনময় রায় এ প্রসঙ্গে লিখলেন " কবির সহিত তাঁর নিবিড় বন্ধুতা ও আধ্যাত্মযোগের দ্বারা প্রভাবিত শোকগম্ভীর উপাসনার প্রতিটি বাক্য সকল অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করিল ।"
এরপর রামানন্দ যতদিন সুস্থ ছিলেন, বিশ্বভারতীর স্বার্থরক্ষার জন্য প্রাণপণ সচেষ্ট ছিলেন, প্রয়োজনবোধে এর জন্য সংগ্রামও করেছেন । রবীন্দ্রহীন জগতে তিনি আর বেশীদিন বাঁচেননি । দুবছর পর তাঁর দেহাবসান হয় । মৃত্যুশয্যাও শুয়েও বলেছিলেন "আমার
কালের ইতিহাসে এই দুই মনীষীর সখ্যতা ও সুসম্পর্ক অক্ষয় হয়ে রইল ।
(পরবাস-৪০, জানুয়ারি, ২০০৮)
রামানন্দ ছাড়বার পাত্র নয় । ক্ষিতিমোহন সেনের স্মৃতি থেকে আমরা জানতে পারি - রামানন্দ বললেন, "আপনি ইংরাজীকে নয়নজলে বিদায় করেন নাই । প্রেমের লীলায় ওসব লোক দেখানো উপেক্ষার ভঙ্গিতে আমি ভুলিব না । তাহার সহিত আপনার যে প্রীতির যোগ আছে সে কথা আমার কাছে লুকাইবেন না ।" অবশেষে কবিকেই হার স্বীকার করতে হল । ফেব্রুয়ারি মাসের মডার্নরিভিউ পত্রে প্রকাশ ঘটল "আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী" গানের অনুবাদ । কবি এইভাবে যে নিজের কবিতার অনুবাদের কাজে প্রবৃত্ত হলেন, তারই ফল "গীতাঞ্জলি" । তাঁকে এই কাজে যাঁরা অনুপ্রাণিত করেন, তাঁদের মধ্যে রামানন্দবাবু প্রধানতম । তাঁর কাগজেই এই কবিতাগুলির প্রথম প্রকাশ হয় । কর্মক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে `প্রবাসী'তে লেখার কথা ভুলে যেতেন, এইসব সময়গুলিতে রামানন্দবাবু রবীন্দ্রনাথের কাছে লোক পাঠিয়ে লেখার জন্য তাগাদা দিতেন । রবীন্দ্রনাথ তাদের বসিয়ে রেখে লেখা শেষ করেছেন কত সময় । "গোরা"র জন্য অনেক কিস্তি এইভাবে লেখা । ক্ষিতিমোহন সেন লিখছেন, "দারুণ গ্রীষ্ম, জানালা কবাট খোলা, বাহিরে `প্রবাসী'র লোক, রবীন্দ্রনাথ মাদুরে বসিয়া লেখা শেষ করিতেছেন, এমন দৃশ্য বহুবার দেখিয়াছি । রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বহু লেখা এবং রবীন্দ্রনাথের লেখার অন্যের কৃত ইংরেজি অনুবাদও রামানন্দবাবু চিরদিন আগ্রহ করিয়া ছাপাইয়াছেন ।"
"বিদায় করেছি যারে নয়ন জলে
এখন ফিরাব তারে কিসের ছলে ।"