লখনের গা ভর্তি ছোট ছোট পোকা, পিঁপড়ে । রক্তের গন্ধে পচা লাশের গন্ধে আরো নানা জানোয়ারও এসে পড়ছেই । গন্ধে গন্ধে এসে পড়বে বুঝি পুলিশও । গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়ার আগে ওরা সব্বাই বলেছিল জুরগিকে । কানু-ভিখু-ডমন বলেছিল লখনকে নিয়ে যাবে চৌকা ছাড়িয়ে সদরে । সেখানে আছে আরো অনেক ভিখু-কানু-ডমন । লখনের লাশ পুলিশের হাতে পড়ার আগেই ওদের কাছে পৌঁছনো দরকার । খবর পৌঁছনো দরকার । জুরগি দেয়নি । কিসের এক অপেক্ষায় আগলে রেখেছে লখনকে ।
এ ঘরটা গ্রামের একেবারে শেষ মাথায়, জঙ্গল ঘেঁষে । তাই বোধ হয় পুলিশ টের পায়নি । সাত গাঁয়ের মানুষ জুরগিকে `ডান' বলে । সে ভয়ে পুলিশ আসেনি তাও হতে পারে । তা ছাড়া জুরগির সঙ্গে লখনের কোন সম্পর্ক ছিল এমন কথাও কেউ জানে না । খামোকা ঐ ডাইনিটা লখনের লাশ নিয়ে যাবেই বা কেন ! এত পাহাড়, কোথাও ফেলে দিলেই হল .. পাথরের খাঁজে আটকে থাকতে থাকতে পাথরেই মিশে যাবে । কিংবা জঙ্গলে কোথাও পুঁতে দিয়েছে হয়ত । লাশ জ্বালায়নি, সে খবর জানে পুলিশ ।
হাইওয়ের ওপর বাসস্ট্যান্ড । বাসস্ট্যান্ডকেই চৌকা বলে ওরা । কোকচো গ্রামের চৌকা থেকে গহীন জঙ্গলে অনেকখানি পথ এলে এ গ্রামে আসা হয় । সদর বাজারের মানুষ এ গাঁয়ের খোঁজ রাখেই না । বেশ ক'বছর আগে মাদলের শব্দে শব্দে এসে পড়েছিলেন এক ফরেস্টার বাবু । সেই প্রথম বাইরের মানুষ আসা । পুলিশও খোঁজ পেয়ে গেল ।
পাহাড়, জঙ্গল, আকাশ আর সিংবোঙ্গা - এই নিয়েই জগত । সমস্ত পরব জঙ্গল নিয়ে, নাচগান-মাদল-ধামসা- কেঁদ্রি-রুতু সব জঙ্গল নিয়ে । করমপূজার জন্যে করমডাল, সরহুলের সময় শালফুল, ঘর ছাইবার জন্যে দু-চারটে কাঠ-পাতা, রান্না করার জন্যে বিটিছেলারা আনে দু-চারটে কাঠকুটো । রান্নাই বা কি ! নুন আর ভুট্টাসেদ্ধ । ক্ষেতি হয় । ধান-যব-বাজরা আর আলু । বুনো আলু, মেটে আলু । হাঁড়িয়া খেয়ে পড়ে থাকা । হাঁড়িয়া খেলে বেশ ঘুম-ঘুম ঝিমুনি, কাজের ইচ্ছেও হয় না । সঙ্গে কাঁচা ছোলা, ভিজিয়ে ফুলো ফুলো, নুন-লেবু মাখিয়ে অমৃতেরে স্বাদ । বেশ পেট ভরেও থাকে । ওদের এর চেয়ে বেশি দরকার পড়ে না । মাঝে মাঝে মনে বেশ ফুর্তি হলে চালভাজা, মহুলভাজা আর কালোই । কালোই, সদরের মানুষরা যাকে বাদলাপোকা বলে ।
কেউ কেউ তার মধ্যেই ফুটিয়ে তোলে দু চারটে লাউ, কিংবা ঝিঙে । দশ মাইল দূরের হাটে গিয়ে বেচে আসে মেয়েরাই । অনেক কিছুই নেই, তবু আদিবাসি খুশির কমতি নেই । নাচবে, গান গাইবে, ধামসা-মাদল বাজাবে । শাল-আকন্দ-মহুয়া, পাহাড়-ডুলুং-আকাশ-সিংবোঙ্গা, পাহাড়ি ফুল আর নারী । আদিবাসি নারীকে সরিয়ে রাখে না । আদিবাসি বেশি কথা বলে না । যত কথা বলে তার চেয়ে বেশি গান গায় । যতবার টাঙ্গি হাতে নেয়, তার চেয়ে বেশি হাতে থাকে ধামসা-মাদল । পুরুষ মাদল বাজায়, নারী তখন বুনোফুল কালোয় আলো, গন্ধে মাতাল, নাচের তালে চিতল হরিণ ।
তাদের কালো শরীরে মসৃণ ঢেউ, আদিম সরলতা, নাচের আখড়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা নাচ ... কামুক সভ্য মানুষের গভীর ষড়যন্ত্র বুঝে ওঠার আগেই শিকার হয়ে যায় তারা । `জঙ্গলে ঢুকে কাঠ চুরি করেছিস', এই আইনের শাসনে ভায়া ফরেস্টগার্ড পুলিশের কোতোয়ালিতে চালান হয় । কাঠচোরনিকে বহুক্ষণ দড়ি বেঁধে ঝুলিয়েও রাখা হয়, শাস্তিস্বরূপ । কোতোয়ালির সব পুরুষের শাস্তিদান পালা শেষ হলে ফরেস্টগার্ড ও শাস্তি দেবার অধিকার পায় । পরের দিন ছেঁড়া টেনা-রুখু চুল-গালে শুকিয়ে থাকা কামুক নোংরা লালা আর ঝুড়ি কাঠকুটো সমেত জঙ্গলের ধারে পড়ে থাকা ।
মাঝে মাঝে বোকা মানুষদের মধ্যেও আগুন জ্বলে । পাহাড়ু, মাটকু, চিটা, ভিখু, কানু সা-জোয়ান ছেলেগুলোর রক্ত গরম হয় আজকাল । সঙ্গে সঙ্গে চড়চাপড়, জেল হাজত । ফরেস্টগার্ড সদরের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলে, `এই এরা গাছ কাটছিল' । তিন মাস, চার মাস করে জেল হয়ে যায় তাদের, সদরে চালান হয় । সদর থেকে কেউ কেউ কুলি লাইনে চলে যায় । কেউ পাথর ভাঙতে । বাকিরা ফিরে আসে গ্রামে, জঙ্গলের তীর আছে, হাতে টাঙ্গি আছে, আর হাতের কাছেই নখ-দাঁত বার করা শত্রু আছে ।
আবার পুলিশ আসে গ্রামে । এবার তিনমাস সশ্রম কারাবাস । জেলের মধ্যে বুটের ঠোকা দিয়ে হুজুর বলে, `তোদের জন্যে সরকারি চাকরি রিজার্ভ থাকছে, ইশকুল-হাসপাতাল, টিকা দিচ্ছে, নিরোধ বিনা পয়সায়, কলেরা-টাইফয়েডের ইনজেকশন, রাস্তাঘাট-বিজলি আসবে শিগ্গির, তোদের নিয়ে কত রিসার্চ, মাইকা বা তামা মাইন্স খুঁজে পেলেই তোদের লোকজনের চাকরি । পেয়ে পেয়ে অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে তোদের । জংলী অসভ্য সব, গরমেন্টও যেমন, তোদের মানুষ করবে ! ছো: ...'
কোতোয়ালিতে মাত্র দুজন খাকি উর্দি । হাঁড়িয়া, পান্তাভাত, নুন খাওয়া শরীরগুলো তবু সাহসে লাফায় না । হুজুর মাই-বাপ । কত্ত জানে উয়ারা !
লখন বাস্কে অন্যরকম বলতে শুরু করল একদিন । পরপর কতকগুলো বিশ্রী ঘটনা ঘটে যাবার পর । টুসু পরবে প্রতি বছর মেলা বসে । ঝোরায় স্নান করে আশপাশের দশ-বারো গাঁয়ের আদিবাসি যোগ দেয় তাতে । হারমোনিয়াম বাজিয়ে রাবণকবি টুসুর গান গায়, মশাল হাতে কুনা-ভেলা-মাটকুরা নাচে, কুনি-বালিকা-মোতি-মঞ্জুরা পুরু ঠোঁটে পানের রসে লাল করে করঞ্জতেল-কুসুমতেলের সুগন্ধে মাতাল হয়ে নাচে । তারপর যেমন হয় ... গাছের পাতায় ডালে কামুক চোখ, ইশারা ... মেলা থেকেই উধাও হয় কজনা । পরদিন কিংবা তারও পরদিন কান্না চোখে, ছেঁড়া টেনায় গাঁয়ে ফেরা ।
হায় সিংবোঙ্গা, ক্যানে বিটিছেলা-জনম দিলে !
লখন চুটা ধরিয়ে টান দেয়, গাঁয়ের ঘরে ঘরে ঘুরে কথা বলে ।
`লোহা লিলে, তামা লিলে, খাদান সব লিলে । কয়লা লিলে । চুপ থেকেছি । দরকার হলেই জঙ্গলে হাত বাড়ালে, চুপ থেকেছি । বিটিছেলাগুলোকে যখন তখন লিয়ে যাচ্ছ, চুপ থেকেছি । কিন্তুক আর লয় । শালের বদলে সেগুন লাগাচ্ছ, আদিবাসি জঙ্গলে ঢুকলে জেলে ধরে লিয়ে যাচ্ছ । কিছুক চাই না আমরা । বড়ি-নিরোশ-ইশকুল-গির্জা । জঙ্গল দাও । আমাদের জঙ্গল ।'
মুখে কালো কাপড় বাঁধা শার্ট-প্যান্ট পরা মানুষজন পাহাড় থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামে, সবার সঙ্গে কালো কালো অস্ত্রশস্ত্র -বন্দুক, রাইফেল, স্টেনগান ! তারাও বলে । দফায় দফায় মিটিন হয় - `আদিবাসি উন্নয়ন দফতর খোলা হয়েছে । সেখানে মন্ত্রী ঘুষখোর, আমলা থেকে বিডিও সব জোচ্চর, কামুক । ঐ নিরোধ-ইশকুল-ইনজেকশন সব বাজে । তোমাদের ভুলিয়ে রাখার জন্যে । গালুডিতে খড়িয়াদের বাড়িঘর করে দিয়েছিল, খড়িয়ারা সে সব ছেড়ে আরও গভীর জঙ্গলে চলে গেছে । জঙ্গল তোমাদের । ট্রাকবোঝাই কাঠ, আধবেলায় জঙ্গলের এক একটা দিক সাফ হয়ে যাচ্ছে । দেখছ না তোমরা ?'
গ্রামের পুরুষরা সবাই, যারা সদরে গিট্টিকলে কিংবা খাদানে কাজ করতে যায় আর ফি শনিবার গাঁয়ে আসে, তারাও বলল - `ঠিকা মজুর আমরা । আমাদেরই জমি, খাদান, জঙ্গল, সিখানে আমরা ঠিকা মজুর । প্রভিডেন-ফান্ড নাই, গ্রাচুটি নাই, মেডিকেল নাই' .. অনেক ইংরাজি শব্দ বলে ।
পুলিশও খবর পায় ঠিক ঠিক ।
ঝাঁক ঝাঁক বুলেট ছোঁড়ে, হা হা করে হাসে । জবাবে নদীর ওপরে সেতু উড়ে যায় একদিন, পুলিশের জিপ চলা রাস্তায় একদিন ল্যান্ডমাইন পাতা থাকে, আকাশজোড়া আওয়াজে বলি হয় প্রাণ । প্রতিশোধের জ্বালায় পুলিশ এবার ছারখার করে এক একটা গ্রাম, জোয়ান মরদকে জিপের সঙ্গে বেঁধে টেনে নিয়ে যায়, তাগড়া বিটিছেলাগুলোকে টানতে টানতে নিয়ে যায় । আগুন চোখে বিষ-মাখানো তীর ছুঁড়ে কটা পুলিশ মারে আদিবাসি । মুখে কালো কাপড় বাঁধা বন্ধুরা বন্দুক চালানো শিখিয়ে দেয় । শত্তুর মারাই আসল কাজ ।
জুরগি এই পাঁচদিন ধরে ভাবছে খুব । লখনের লাশ ... বুলেট-খাওয়া শরীর খুব ভাবাচ্ছে । এতদিনের মধ্যে এই প্রথম ভাবা এমন । এমন নয় যে, লখন জুরগির প্রণয়ী ছিল । জুরগিকে কত আগে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে সবাই মিলে । শাকপাতা খাওয়া জুরগির কালো চেহারায় কুসুমতেলের গন্ধ, যুবকরা সব বশ ... ফরেস্টার বাবুরা পর্যন্ত গন্ধে গন্ধে মাতাল হয়ে ছুটে আসে ... রাতে পাঁচ সেলের টর্চ আর ট্রান্জিস্টার থেকে গান, আর হুল্লোড় । গ্রামের বুড়োরা মহিলারা যুবতীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল । জুরগির সব লক্ষণ ডাইনির মত । এত রস, দুনিয়াজোড়া মরদে আশ মেটে না, ওকে গ্রাম থেকে বার করে দাও । জুরগি সেই থেকে এই জঙ্গলের ধারে থাকে । যুবকরা এখনও আসে, রাতের বেলায় আসে । ডান হলেও জুরগির শরীর জোড়া সবুজ ক্ষেতের আঘ্রাণ ।
লখন আসেনি কোনদিন । তবে কালো-কাপড় বাঁধা বন্ধুরা এসেছে । ওরাই প্রথম বলেছে জুরগিকে, `তুমি ডান নও, আস্ত একজন মানুষ । অনেক কাজ আছে তোমারও ।'
মিটিন হয়েছে জুরগির ঘরে, সেইখানেই লখনকে দেখেছে জুরগি । মুখের দুপাশে হাত রেখে `হো ও ও ও' ডাকে পলকে দশজন যুবককে এনে ফেলেছে লখন । মিটিন হয়েছে অনেক রাত । পরবের নেশায় গ্রাম বেহুঁশ, লখনরা ডিগ ডিগ শব্দে মাদল বাজিয়েছে সারা রাত ।
সেই লখন ।
কৃষ্ণপক্ষের রাত । ওপরে আকাশে তারারা জ্যোতিষ্মান, নিচে বনভূমিতে জোনাকিরাও তেমনই জ্যোতিপুঞ্জ । নিবছে আর জ্বলছে । জ্বলছে আর নিবছে । ঝিল্লির ঝনঝন শব্দ আর নৈশকুসুমের সুরভি প্রবল হয়ে উঠেছে । লখনের মৃত শরীরের পচা গন্ধ ছাপিয়ে সুগন্ধে ভরে উঠতে পারছে না জুরগির ছোট্ট ঘরখানা ।
জুরগি কেবল ভাবছে । সেই গত বৃষ্টির সময় তার ঘরে এসে লুকিয়ে ছিল একজন কালো-মুখোশের বন্ধু । পরে জেনেছিল, কিরিবুরু না কোথায় ল্যান্ডমাইন রেখে পুলিশের জিপ উড়িয়ে এসেছিল তারা । কঠিন গলার স্বর, নিজের কাজ নিজে করে নেওয়া, যা দাও তাই খেয়ে নেওয়া, ভোর হলেই জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়ে থাকা । পুলিশ এসেছে অনেকবার, খোঁজ পায়নি । ভোরবেলা জুরগি ওঠারও আগে জঙ্গলে চলে যেত বন্ধু । একদিন, শুধু একদিন আগে ঘুম ভেঙেছিল জুরগির । দেখেছিল ঘুমন্ত ছেলেটির মুখোশ খোলা কিশোর মুখ, বুকের কাছ থেকে জামাটা সরে গিয়ে অসম্ভব ফর্সা বুকের একটুখানি । ডাইনি জুরগির মাতৃসত্তা প্রবল হয়েছিল মুহুর্তে । আহা, ভালো বাড়ির ছেলে মনে হচ্ছে ! ভদ্দরলোকের বাড়ির ছেলে । কে জানে, ওর মা-বাবা কোথায় । জুরগি শুনেছে, উয়ারা সবাই পড়ালিখা বটেক । জুরগিদের জন্যে, আদিবাসিদের জন্যে ঘরবাড়ি স্বজন ছেড়ে এই বনে জঙ্গলে প্রাণ হাতে নিয়ে ঘোরা ।
সুমিত্রা ম্যাডাম বলেছিল ।
সুমিত্রা টুডু, কলেরার টাইফয়েডের ইনজেকশন দিতে আসে ওদের গ্রামে । জুরগির ঘরেও আসে । ডান বলে ভয় পায় না । সুমিত্রা ম্যাডামই বলেছিল জুরগিকে । অনেক কথা বলে সুমিত্রা ম্যাডাম, জুরগি ঠিক ঠিক বোঝে না । এখন একটু একটু করে ভাবছে সব ।
বলেছিল ম্যাডাম, `সদরের মানুষজন জঙ্গলের আদিবাসিদের নিচু চোখে দেখে । কিন্তু আদিবাসিরও তাতে দোষ কম নেই । এই যে গাঁয়ের লোকেরা, জঙ্গল কেটে বসত বানিয়ে আছে এত বছর ধরে, বাইরের দুনিয়ায় কত কি ঘটে যাচ্ছে তার খবর রাখেই না ।'
লখন বলেছিল একদিন । ঐ ভিখু-মাটকুদের বলছিল, `আগে জানতেম আমাদের দেশটার নাম ছোটনাগপুর, তারপর শুনলেম ঝাড়খন্ড । এবার সদরে গিয়ে ঠিক ঠিক জেনে এসেছি, দেশের নাম হল ইন্ডিয়া ।'
দেশ মানে ইন্ডিয়া ? সে আবার কি ? এই যে বসনের বিটির বিয়া হল সদরে, উয়ারা তো `দেশ জেচ্ছি' বলে গাঁয়েই আসে । নিজের জন্মোস্থানটাই তো দেশ । মাঝখান থেকি ইন্ডিয়া এল কেমনে !
ধৈর্য ধরে বুঝিয়েছিল কালো-মুখোশের বন্ধুরা, সুমিত্রা ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করে আরও ভালো করে বুঝেছে জুরগি । শুধু এই বেড়াপোতা গ্রাম নয়, একটা বড় দেশ আছে । জুরগিদের সবার দেশ । শুধু ফরেস্টার বাবুরা, বা বিডিও সাহেবরা নয় ... সদরের লোকেরা নয় ... সে দেশটার লোক বেড়াপোতা গ্রামের সবাই । দেশ খুব ভালো, দেশ সব্বার । দেশ আর জুরগিদের মধ্যে আছে বাজে কিছু মানুষ .. তাদের হাত থেকে জুরগিদের বাঁচাবার জন্যে ঐ বন্ধুরা ।
খুব ভাবে জুরগি ।
সারা রাত সারা দিন ধরে ভাবে ।
লখনটা এমন হঠাৎ মরে গিয়ে মুশকিল হল ।
লখনরা গাঁয়ের বিটিছেলাগুলাকে বাঁচাবে বলেছিল । মাঝখান থেকে পুলিশের গুলি এসে সব নাশ করে দিল । হায় সিংবোঙ্গা, এত যে পুজা করি তুমার, লখনকে বাঁচালে না তুমি !
কদিন আগে কালো-মুখোশের বন্ধুদলের চারজন এমনভাবেই মরে গেল । শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল জুরগি । আহা, ঐ ছেলেটা ... জুরগি দেখে ফেলেছিল ওর মুখখান ... পরাণের বয়সীই হবে তো ... উই যেবার খুব জল হল, বান এল নদীতে, জুরগির বাপ ভেসে গেল জলে, সেই বছরেই তো পরাণ হল । এই ছেলেটার ভালোমন্দ কিছু হলে ওর বাপ-মা তো খবরও পাবে না ।
দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকালো জুরগি ।
ভালো রাখো সিংবোঙ্গা । ছেল্যাটাকে বাঁচায়ে রাখো ।
বাইজুকবি গান বাঁধে, তার একখান গান ছিল । এক দেশে এক অত্যাচারী রাজা ছিল । রাজার সঙ্গে লড়তে গিয়েছিল এক আদিবাসি ছেল্যা । রাজা তাকে মেরে পাহাড় থেকে লাশ ফেলে দিল । তার মা সে লাশ নিয়ে এসে শুকিয়ে শোবার ঘরের খাটের নিচে পুঁতে ফেলল, রোজ রাতে এক ঘটি করে জল ঢেলে দিত । মাটির নিচে বেঁচে উঠল সেই ছেল্যা । তার শরীর লম্বা হয়ে গেল, পাঁচ মাইল সাত মাইল লম্বা। শেষে একদিন মাটির তলা থেকে রাজার বাড়ি, দুর্গ সব ধ্বংস করে ফেলল সে ।
জুরগি খুব ভাবছে তাই । লাশটা শোবার ঘরের মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেখবে নাকি !
হঠাৎ ঝিঁঝিঁ ডাক কমে আসে, অন্ধকারে টর্চ হাতে ধুপ ধুপ করে এসে পড়ে কারা । `লাশ নিয়ে যাব আমরা । গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরবে এ লাশ । পঞ্চাশ মরদ কাঁধ দেবে । সাতগুরুং পাহাড় থেকে পনেরো মাইলের মধ্যে সব গ্রাম । তারপর চিতা জ্বলবে ।'
লখনের টাঙ্গিটাই হাতে তুলে নেয় জুরগি, `না । এ লাশ কাউকে দেব না । আমরা লিব । কারো হক নাই ।' - `তুমি একা পারবে না মা, পুলিশ আসবে মিলিটারি আসবে, গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেবে ।'
মা ! জুরগি শিউরে ওঠে ।
মা । তাই তো । মা পারে না এমন কি আছে দুনিয়ায় ! মা পারে না এমন হত্যালীলা বন্ধ করতে ? আহা, এই ছেল্যাগুলা ! রাতের আঁধারে এসেছে জুরগিদের যেন কুনো বিপদ না হয় তাই । জুরগি দেখবে না ছেল্যাগুলার যেন বিপদ না হয় !
কবে বন্ধ হবে এই মারণখেলা ? লখনের শরীর পাঁচ সাত মাইল বেড়ে গিয়ে ধ্বংস করে দেবে যে সব ! বেড়াপোতা গ্রাম-সাতগুরুং পাহাড় - সবরনেখা নদী - ক্ষেতের সবুজ ধান .... সব । সব । ধ্বংস হয়ে যাবে এই পাহাড়, জঙ্গলের দেশ, দেশ যার নাম নাকি ইন্ডিয়া ! মাঝখানের বাজে লোকগুলো না থাকলেই যার পরশ পাবে জুরগিরা । সে দেশে জুরগিকে কেউ ডান বলে একঘরে করবে না, মা বলে ডাকবে এই ছেল্যাদের মত । মা !
পারবে না জুরগি ? নিজেরাই নিজেদের বাঁচাতে ? পারবে না এ গাঁয়ের বিটিছেলাগুলা ? তাইলে তো আর লখনদের বলি হয় না । পারবে না ?
লখনের শরীর আড়াল করে দরজা আগলে দাঁড়ায় জুরগি, `হিম্মত থাকে তো এ গাঁয়ে আগুন জ্বালাবেক । আমি জ্বালাব আগুন, লখনের চিতা । আমরা জ্বালাব । দেখি কে কি করে ।'
ঠোঁটের দুপাশে হাত রেখে গলার শির টানটান হয়, `হো ও ও ও ও' ... ঠিক লখনের মতই । `ওহো ও ও ও ও'
তিন চারবার ডাকের পর অরণ্যের অভ্যন্তর থেকে প্রত্যুত্তর ভেসে এল । স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জুরগি । বহুদূর থেকে একটা আওয়াজ - দিম দিম দিমা দিম । স্থির রইল জুরগি ।
বহুক্ষণ পর ... কালো-মুখোশের বন্ধুরা যখন অধৈর্য হয়ে উঠেছে, `ডান'-এর ডাকে কোন মানুষই বুঝি সাড়া দেবে না ... খুব কাছ থেকে ডালপালা সরিয়ে মিহিগলায় আওয়াজ শোনা গেল, `ওহো ও ও ও' ... মাল্তী, লখনের বিটি ।
ছোট থেকে ভয় পেয়েছে জুরগিকে ... `উ ডান বটি .. বাপের অক্তমাখা শরীল যখন মাটিতে পড়ল ... মেয়ে মরদ সব লাফিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যাচ্ছে ... ঐ ডান এসে বাপকে কোলে তুলে লিয়ে গেল ! অক্ত খাবে বুঝি !' শিউরে উঠেছিল মাল্তিরা ।
রোজ রাতে লুকিয়ে দেখতে আসত ওরা কজনা । লখনের লাশ আগলে বসে আছে জুরগি, এই দেখেছে । মরদগুলা পজ্জন্ত ভয়ে ফেরার, উয়ার ভয় নাই ! নিজেদের মধ্যে অনেক কথা হয়েছে ওদেরও । দিকুর বুড়া বাপ, সে-ই নাকি এ গ্রামে পরথম বসত করেছিল, দশ গাঁয়ের লোক মানে, বলেছিল একদিন, `ও লাশ রাখ্যি কি হবেক ? উ কি আর দাঁড়াবেক ? তেরাত্তির পর তো ও ভুত হয়েছে । পোকা খাক, শকুন খাক ! জুরগির সঙ্গ সঙ্গ লাশে আগুন দে বাপারা । উ একা মেয়ামানুষ, কি করবেক !'
মেয়ামানুষ !
এই প্রথম ডান জুরগির সম্বন্ধে এমন একটা কথা শুনল ওরা । মায়েরাও অন্য কথা বলতে লাগল দুদিন পর থেকেই । `বিটিছেল্যাটার যা হিম্মত, সাত গাঁয়ের মরদের নাই ।'
মাল্তিরা এসেছে আজ তাই । গাঁয়ের সবাই একে একে আসবে ওরা বুঝেছে নিজে থেকেই । `বিপদের সময় একত্তর থাকন লাগে', লায়া বুড়াও বারবার বলেছে ।
শেষরাতে বেড়াপোতা গ্রামের ধারে জঙ্গল ঘেঁষে লখনের চিতার আগুন জ্বলে । গাঁয়ের সব বৌ-ঝিরা কাজটি নিখুঁত সম্পন্ন করে । `তুমরা যাও গ বাছারা । মোদের ক্ষতি কেউ করতে লারবে না আর । লখন এখন ঘুমাবেক । ফিরা এসো পরবের দিনে । তুমরা বন্ধুলোক বটি । আবার এসো ।'
হাতে হাতে ধরে দাঁড়ায় মাল্তী-বিম্লা-হেমা-সরোজ-লালমণিরা ... ঠিক টুসুনাচের ভঙ্গিমায় ... হাতে হাতে মাথায় ফুল চোখ আগুন লাল । জুরগির খোলা চুলে কালোচোখে লখনের চিতার আগুনের ছায়া । লখনের বিটি, ভিখুর মা, দিকুর বৌ সেই আগুনের দিকে চেয়ে নিশ্চুপ ।
সিংবোঙ্গা, তু বনদেবী রূপ ধরলি !
ভোরের আকাশও বুঝি আগুনের তাপেই লাল ।
(পরবাস-৪০, জানুয়ারি, ২০০৮)