• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪১ | এপ্রিল ২০০৮ | রম্যরচনা
    Share
  • কমলদা বনাম চিয়ারলিডার : জলধর সাহারায়

    আই পি এল দেখছেন তো ? এখন ক্রিকেটে ওভারের মাঝে নেচে যায় চিয়ারলিডার, উইকেট পড়লে বড় স্ক্রিন পুঙ্খানুপুঙ্খ সূক্ষ্মতায় দেখায় আউট হবার বিবরণ । ক্রিকেটের এই চিয়ারলিডার-যুগে কমলদাদের কথা বেশি করে মনে পড়ে । আমরা যখন ক্রিকেটে মনপ্রাণ সঁপে দিতে শুরু করেছি, তখন কোথায় চিয়ারলিডার, কোথায় স্নিকোমিটার । টিভিও আসেনি কলকাতায় । আমাদের সময়ে একমাত্র ভরসা ছিল রেডিও ।

    'আমাদের সময়' বললে কিরকম দাদু-দাদু শোনায় । কিন্তু সত্যি বলতে আমাদের সময়ে আর আজকের ক্রিকেট দেখাশোনায় আকাশপাতাল তফাৎ হয়ে গেছে ।

    সে সময়ে রেডিও কমেন্ট্রি মনোপলাইজ করে রেখেছিলেন অজয় বসু, পুষ্পেন সরকার আর বিশেষজ্ঞ হিসেবে কমল ভট্টাচার্য - ইউনিভার্সাল কমলদা । পুষ্পেন সরকার মোটমুটি টু-দি-পয়েন্ট কমেন্ট্রি করতেন । অজয়দার সঙ্গে পাল্লা দিতে যেটুকু না করলেই নয় সেটুকুই করতেন । তবে কল্পনার বহর দেখাতেন খেলুড়েদের সংলাপে । যেমন হয়তো ওভারের মাঝে দুজন ব্যাটসম্যান নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন । পুষ্পেনদা বললেন, "গাভাসকার বলছেন বিশ্বনাথকে, ভাই বিশু তুমি হাত চলিয়ে খেল আমি এদিকটা দেখছি ।"

    অন্যদিকে অজয়দার ভাষার বাক্যচ্ছটায় খেলা যেত হারিয়ে । ফোর্থ ইনিংসের খেলা চলছে । ওয়েস্ট ইণ্ডিজ চেপে ধরেছে । পাঁচ উইকেটে পড়ে গেছে । একদিকে একা বিশ্বনাথ লড়ে যচ্ছে । খুব উত্তেজনা । কিন্তু অজয়দা বলে চলেছেন প্রকৃতি, এরিয়ান মাঠ - এইসব । "হাইকোর্টের দিক থেকে আসছেন অ্যাণ্ডি রবার্টস । ওদিকে হাইকোর্টের পেছনে এক পোঁচ কালো মেঘে ঘিরে ধরছে হাইকোর্টের চূড়া । হয়তো গ্রাস করবে ইডেনের আকাশও । কি ভাবছেন মনসুর আলী খান পতৌদি ? তাঁর স্মৃতি কি পাড়ি দিয়েছে আজ থেকে ছত্রিশ বছর আগে ? ঠিক এমনভাবেই বৃষ্টির করালছায়া পড়েছিল একটি জমে ওঠা ম্যাচে । খেলা চলছিল হোলকারের সঙ্গে বাংলার । এরিয়ান মাঠে । হোলকারের হয়ে মুশতাক আলী ছোটাচ্ছিলেন শটের অপুর্ব রামধনু আর বাংলার পক্ষে নির্মল চ্যাটার্জি তাঁর বলের কারুকার্যে আঁকছিলেন সুইং-এর সূক্ষণ আলপনা - বলতে বলতে আরও দুটি উইকেট পড়ে গেছে । বিশ্বনাথও সাতাত্তর থেকে উপর্যুপরি পাঁচটি চারের সাহায্যে পৌঁছে গেছে সাতানব্বইয়ে । হ্যাঁ যা বলছিলাম, নির্মল চ্যাটার্জি আর মুশতাক আলীর সেই অভূতপূর্ব যুগলবন্দী ..."

    তবে কল্পনার শেষ কথা ছিলেন কমলদা । ওনার অবার 'ন' বলায় একটু অসুবিধে ছিল । "এতক্ষল বল করছিলেন ল্যান্স গিব । খুব বড় বোলার । অলেক উইকেট পেয়েছেল । আরও অলেক উইকেট পাবেল । খুব বড় বোলার ।" তারপরে একটু ড্রামাটিক পজ । 'আসলে ল্যান্স গিবরা তিন ভাই । ল্যান্স গিব, ড্যান্স গিব আর চ্যান্স গিব । ওদের মা ওদের একসঙ্গে গিবস বলে ডাকেন । সেই থেকে ওর লাম হয়ে গিয়েছে গিবস । ল্যান্স গিবস । খুব বড় বোলার' । ডাহা গুল কিন্তু ।

    অজয়দাও অবশ্য গল্পে থেমে থাকার লোক নন । 'কমলদা, এই যে গ্যারি সোবার্স, যার পায়ে শার্দূলের ক্ষিপ্রতা, চোখে চিতার তীক্ষণতা, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় (কমলদা: হ্যা, খুব বড় খেলোয়াড়), তিনি কিন্তু খুব গরীব ঘরের সন্তান । দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন শুধু মেধা আর অধ্যবসায় দিয়ে । তার মেধার কাছে নতিস্বীকার করে দারিদ্র যেন এক পাশে সরে মাথা নুইয়ে বলছে, বিজয়ী হও । (কমলদা: খুব বড় প্লেয়ার । খুব চমত্কার খেলেল ।) বাল্যকালে দিনের পর দিন সোবার্স একা একাই খেলে যেতেন ব্যাট বল নিয়ে । বলও জুটত না সবসময়ে । তবু সারাদিন পড়ে থাকতেন মাঠে । সন্ধে হলে, ঘরে ঘরে যখন বাতি জ্বলে গেছে, সমবয়সীরা বসে গেছে পড়ার বই নিয়ে, তখন মা এক বাটি মুড়ি নিয়ে এসে ডাকতেন 'সোবু, সোবু ।" খেয়াল হত সোবার্সের । ফিরে আসতেন ঘরে, দরিদ্র জননীর কোলের কাছে ।"

    আমরা শুনতাম । আর ভাবতাম । আমরাও মুড়ি খাব আর একদিন সোবার্স হব, বিশ্বনাথ হব । হয়ত বয়েস অতটা অল্প ছিল বলেই । কিন্তু আমাদের কল্পনাকে খুব উস্কে দিতে পারতেন এনারা ।

    কমলদা আবার ভুলেটুলেও যেতেন খুব । পুষ্পেন সরকার বেশ অকালেই মারা যান । ধরুন পুষ্পেন সরকারের স্মৃতিতে টিভিতে অনুষ্ঠান হচ্ছে । অজয় বসু পুষ্পেন সরকারের অনেকদিনের সহকর্মী । তিনিই অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন । কমলদাও আছেন । অজয় বসু তার স্বাভাবসিদ্ধ পত্রপুষ্পেপল্লবিত ভাষায় খানিক স্মৃতিচারণ করে কমলদাকে 'কিছু' বলতে বললেন । কমলদা ততক্ষণে পুষ্পেন সরকারের শোকে খুব বিচলিত হয়ে পড়েছেন । ধরা গলায় বলতে শুরু করলেন, "হ্যাঁ, অজয় তো মারা গেল । বড় ভাল ছেলে ছিল অজয় । অজয় ... এই ! অজয় তো সামনে বসে আছে । কে যেন মারা গেল ? পুষ্পেল, পুষ্পেল । হ্যাঁ, পুষ্পেল বড় ভাল ছেলে ছিল । আমরা কত খেলা একসঙ্গে বসে দেখেছি, কমেনটারি করেছি । খুব ভাল কমেনটারি করতে পারত পুষ্পেল । আর কি জানার আগ্রহ ছিল । খালি জিগেস করত, 'কমলদা, এটা কি ? কমলদা, ওটা কি ?' আর আমিও বলতাম, 'পুষ্পেল, এটা এই । পুষ্পেল, ওটা ঐ ।' বড় ভাল ছেলে ছিল ।"

    তারপর তো টিভি এল । মানে একেবারে আগমন যাকে বলে । আমরা সব দল বেঁধে খেলা দেখতে যেতাম । আমরা দুয়ানি-চারানিরা বসতাম সামনে, মেঝেতে । একেবারে যাত্রার সতরঞ্চি স্টাইল । কিন্তু ছবি-টবি বিশেষ কিছু বোঝা যেত না । মানে ধরুন একজন বল করতে ছুটে আসছে, আমরা দেখছি তিনজন আসছে । কোনজন যে আসল আর কোন দুটো যে ছায়া, কে জানে ! বল করল । তিনজন বোলারের হাত থেকে তিনটে বল ছুটে গেল তিনজন ব্যাটসম্যানের দিকে । এইরকম আর কি । তবে যখন ছায়ার সংখ্যা খুব বেড়ে পাঁচ-টাঁচ হয়ে যেত তখন একজন ছোকরা মতন লোক তড়াক করে লাফিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেত । তারপরে শুরু হত এক অদ্ভুত সাংকেতিক কথাবার্তা । একতরফা । ঘরের ভেতর থেকে কর্তাগোছের একজন চ্যাঁচাতেন :

    - হ্যাঁ ঘোরা ।

    - আরো ।

    - না না বেশি হয়ে গেল ।

    - হ্যাঁ ঠিক আছে ।

    - না না আগেরটাই ভাল ছিল ।

    - হ্যাঁ এই ঠিক আছে । তুই চলে আয় ।

    মানে ছায়ার সংখ্যা আবার তিনে নেবে এসেছে । আমরা আবার মন দিয়ে তিনটে আইডেন্টিকাল খেলা দেখতে শুরু করতাম । ইতিমধ্যে ছোকরামতন লোকটা নেবে অল্প ঘ্যাম নিয়ে নিচ্ছে, "আরে, অ্যান্টেনা ঘোরাব কি, ঐ মল্লিকদের বাড়ি এমন কাপড় টাঙিয়েছে যে একটা ফাঁক বার করতে জান কয়লা হয়ে গেল । শেষ পর্যন্ত কাগজ দিয়ে গ্যাটিস মারলাম, তবে ঠিক হল ।"

    কিন্তু কমলদারা বাঙালিকে এমনই মোহিত করে রেখেছিলেন যে টিভিতে খেলা দেখা হলেও কিন্তু টিভির সাউণ্ড বন্ধ করে রেডিওতে কমলদার কমেন্ট্রি সঙ্গে সঙ্গে চলত । একটু ল্যাগে । মানে টিভিতে যখন বল উইকেটকিপারের হাতে চলে যাচ্ছে, তখনও পুষ্পেনদা বলছেন, "বল করতে আসছেন ..."

    ওপরে যে সব কথা লিখলাম, সবই প্রায় আমার বানানো আর নয় বন্ধুদের থেকে শোনা । কিন্তু এইরকম চালেই চলত রেডিওর কমেন্ট্রি । আসলে বলতে চাইছি যে, খেলার মাঝে আমাদের এনটার্টেন করার জন্যে কোন চিয়ারলিডারের প্রয়োজন পড়ত না । কমলদা বনাম চিয়ারলিডারের লড়াইতে কমলদারা আজও জিতে যেতেন হইহই করে । শুধু কল্পনার জোরে ।



    (পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments