মানুষের আদিম প্রবৃত্তির মধ্যে অস্তিত্ব রক্ষার কামনা অন্যতম । যৌন বাসনার মূল এই কামনা । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই বাসনার বিবিধ প্রকাশে উজ্জ্বল বেশ কিছু গল্প লিখেছেন । `শৈলজশিলা' (`গল্পলহরী', শ্রাবণ, ১৩৩৯) `সরীসৃপ' (`কসশ্রী' আশ্বিন ১৩৪০) `সরীসৃপ' (`পূর্ব্বাশা', ১৯৩৩) - এইসব গল্প প্রখ্যাত মনে করা যায় । টিকে থাকার বেঁচে থাকার কামনার সঙ্গে মানুষের মনে অস্তিত্বলোপের আশঙ্কাও সমভাবে ক্রিয়াশীল । মানুষের সকল ভয়ের উত্স এই বিনাশের ভয়, মুছে যাবার শঙ্কা । মৃত্যুকে মানুষ ভয় পায় এজন্যই । কিন্তু মৃত্যুকে মানুষ ঠেকাতে পারে না । তাই মানুষ কল্পনায় নির্মাণ করেছে মৃত্যুপারের জগৎ । সে জগতে মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা লাভ করে নতুন জীবন নতুন শক্তি । অসৎ মানুষ সে জগতে আরও শক্তিমান হয়ে ওঠে । এই মানব-আত্মার বিভিন্ন নাম আর রূপ পৃথিবীর সব দেশে দেখা যায় । বাংলায় তার নাম ভূত ।
মরতে ভয় পায় বলেই আদি মানব ভয় পেত অন্ধকারকে । প্রথম মানুষের টিকে থাকার সংগ্রামের শক্তি ছিল শারীরিক বল আর দৃষ্টি, শ্রুতি, ঘ্রাণের সম্যক ব্যবহার । বিনাশ-উন্মুখ হিংস্র পশু আর বিরোধী মানব ঘিরেছিল তার চারপাশ । তখনও আগুন জ্বালানোর কৌশল অনায়ত্ত ছিল । বেঁচে থাকার যুদ্ধের প্রধান সহায় দৃষ্টি আলোর অভাবে রাত্রিতে কাজ করত না । অ-দৃষ্ট পরিবেশ তাই আদি মানবের কাছে ছিল অশুভ শক্তির বিচরণ-ভূমি । আবার মৃত শত্রুর আত্মারা চলাফেরা করে অন্ধকারে - এই বিশ্বাস তার মনে গড়ে উঠেছিল । এইভাবে অন্ধকারের ভয় আর মৃত্যুর ভয় অন্বিত হয়ে গেছে মানুষের মনে সভ্যতার সূচনা থেকেই । ত্রক্রমে সেই ভয় বিস্তৃত হয়েছে । মৃত আত্মা তথা `ভূত' সম্পর্কে নানা বিশ্বাস গড়ে উঠেছে । মানুষ মনে করেছে সৎ মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর পর অনিষ্টকারী ভূত হয় না বটে কিন্তু তখন তার শক্তি যায় বেড়ে । বিশেষ করে মনের গোপন চিন্তাও তার অ-জানা থাকে না । এই মৃত আত্মা জীবিত মানুষের কাছে ভয়ের বস্তু । কারণ হয়তো তার সম্পর্কে জীবিতের মনে বিরাগ থাকতে পারে ------- আর মৃত তা জেনে হয়ে হিংস্র হয়ে উঠবে, তার অনিষ্টসাধন করতে চাইবে ।
আবার যাকে হত্যা করা হয়েছে, যে মারা গেছে কোন দুর্ঘটনায় -- দ্বিবিধ মৃতের আত্মা অকালপ্রয়াণ হেতু হয়ে ওঠে অতীব নিষ্ঠুর । এসব মৃতের যদি বিধিসম্মত সত্কার না হয় তবে তারা আরও জীবনবিদ্বেষী হয় । বস্তুত মৃতের প্রেতরূপে জীবিতের উপর অত্যাচারের পথ বন্ধ করাই সত্কার সংক্রান্ত বিধিনিয়মের কারণ । মৃত্যু-পরবর্তী অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধ, পিণ্ডদান -- সবই মৃতের আত্মাকে তৃপ্ত রাখার প্রয়াস, কারণ অসন্তুষ্ট আত্মা জীবিত আত্মীয়ের অমঙ্গল সাধনে সক্ষম -- এ বিশ্বাস বিশ্বের সর্বত্র দৃঢ়মূল ।
দিনের আলোয় মৃতের আত্মার কোন শক্তি থাকে না -- রাত্রির অন্ধকার তাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় -- পৃথিবীর সব দেশেই আছে এ বিশ্বাস । এর মূলে আদিম অন্ধকারভীতি । বাঙালিরা অবশ্য বিশ্বাস করে যে দিনরাতের মিলন সময়ে, অর্থাৎ সন্ধ্যায় প্রেতরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে থাকে ।
প্রেত বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রেত-প্রতিরোধ বিদ্যাও ধীরে ধীরে পৃথিবীর সর্বত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল । নিজের নির্মিত ভর অতিক্রমের উপায় মানুষ নিজেই সন্ধান করে নিয়েছিল । ভূত-প্রেত প্রতিরোধের জন্য বিশেষ দ্রব্য, প্রক্রিয়া আর শব্দসমষ্টি বা মন্ত্র ব্যবহৃত হত -- বাংলা দেশেও এর ব্যতিক্রম ছিল না । এ বিদ্যায় অভিজ্ঞদের বলা হত ওঝা । সাধারণত নিম্নশ্রেণির মানুষই এই বিদ্যা শিক্ষা করত । মানুষের সাহিত্যসৃষ্টির অন্যতম প্রাথমিক উত্স ভূতের ভয় । ভূতের প্রকৃতি, তার আক্রমণ ঠেকানোর উপায় জানা - এসবই ছিল প্রথম দিকের ভূতের গল্প রচনার কারণ । যখন মানুষ যুক্তি--বুদ্ধির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভূতবিশ্বাসকে কিছুটা অতিক্রম করতে পারল তখন ভূতের গল্প স্বতন্ত্র স্বীকৃতি পেল । অবশ্য সামগ্রিকভাবে সাহিত্যভুবনে ভূতের গল্প সম্বন্ধে কিছুটা অবজ্ঞার মনোভাব থাকলেও দেখা যায় এই সাহিত্য-সংরূপটি পৃথিবীর সর্বত্রই অনেক প্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যিকে আকৃষ্ট করেছে । বাংলা সাহিত্যেও দেখা যায় আদি থেকে আধুনিক -- বিদ্যাসাগর--বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ--বুদ্ধদেব বসু -- সকলেই কিছু না কিছু অতিপ্রাকৃত চেতনাভিত্তিক গল্প লিখেছেন । স্বভাবতই তাঁদের মানস--প্রবণতার ভিন্নতার ছাপ পড়েছে সেসব গল্পে ।
বাংলা কথাসাহিত্যের আধুনিক পর্বের প্রধান লেখক বন্দ্যোপাধ্যায়-ত্রয়ী -- তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক -- সকলেই কয়েকটি অতিপ্রাকৃত গল্প লিখেছেন । এঁদের মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) মানুষের মনের বিচিত্র প্রবণতার শব্দচিত্র নির্মাণে কৃতীশিল্পী । গহন মনের আলো-অন্ধকারের বিচিত্র ছায়ারূপ নির্মাণে দক্ষ মানিককে আকর্ষণ করেছিল ভূত সংস্কার বা অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের বিবিধ স্তর । অন্তত চারটি এ ধরনের গল্প লিখেছিলেন তিনি । চারটির মধ্যে তিনটিই লেখা হয়েছিল কিশোরদের জন্য ।
সাধারণত বাংলা ভূতের গল্পের বেশিরভাগই প্রকাশিত হয়েছে কোন না কোন কিশোর পত্রিকায় । সেই সত্য মনে রাখলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক্ষেত্রে প্রচলিত ধারারই অনুসারী বলতে হবে । কিন্তু গল্প তিনটিতে মানিকের স্বতন্ত্রতার স্বাক্ষর অবশ্যস্বীকার্য ।
`তৈলচিত্রের ভূত' (প্রথম প্রকাশ `মৌচাক' ফাল্গুন ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ) এমনই একটি গল্প । স্পষ্ট উদ্দেশ্যমূলকতা সত্ত্বেও ভূতের ভয়ের ভাষাচিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে গল্পটি বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে । একই সঙ্গে দীর্ঘলালিত সংস্কার সত্ত্বেও মানুষই ভয়ের সত্যতা যাচাই করতে চায়, ভয় পার হয়ে নিজস্বতায় স্থিত হতে চায় -- সেই সত্যের সাবলীল প্রকাশে গল্পটি লাভ করেছে স্মরণযোগ্যতা ।
মামাবাড়িতে বড়ো হয়েছিল নগেন । কিন্তু মামার প্রতি প্রসন্ন ছিল না সে । মামা মারা গেলেন -- তারপর জানা গেল উইলে তাকে বেশ কিছু টাকা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে গেছেন তিনি । পরাশর ডাক্তারের কাছে গেল নগেন । ডাক্তার নগেনের মাতুল--বিতৃষ্ণার কথা জানতেন । নগেনের মুখে ছিল শঙ্কার ছাপ । পরাশরকে সে জানায় `নিজের তৈলচিত্রে ভর করে' মামার প্রেত তারে করেছে আঘাত । সে আঘাতের কারণ সম্ভবত তার গুপ্ত বিরাগ সম্পর্কে মৃত্যুর পরে অবহিত হয়েছেন তিনি ।
মামা তাকে টাকা দিয়ে গেছেন শুনে নগেন পূর্বমনোভাবের জন্য হয়েছিল অনুতপ্ত । লাইব্রেরি ঘরে নতুন টাঙানো মামার তৈলচিত্র স্পর্শ করে রাতের অন্ধকারে সেই চাইতে গিয়েছিল ক্ষমা । কিন্তু ছবি ছোঁয়ামাত্র কে যেন তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় ।
নগেনের বিশ্বাস মৃত্যুর পরে প্রাপ্ত অ-লৌকিক শক্তির কারণে মামা জেনেছেন তার মাতুল বিরাগের কথা । এই শঠতার জন্য নগেনকে তিনি ঘৃণা করতে শুরু করেছেন । তাঁর তেলরঙে আঁকা ছবিতে তিনি নগেনের হাত দেওয়া পছন্দ করছেন না । দিনে বা আলো জ্বেলে ছবিতে হাত ঠেকালে কিছুই হয় না । নগেনের মনের গভীরে নিহিত আছে এই সত্য যে প্রেত দিবসে আলোয় শক্তিহীন হয় । তাই তার মনে রাতের ঘটনা হয়ে উঠেছে প্রেত-অস্তিত্বের প্রমাণ । অন্ধকার রাতে নির্জনে ছবিতে হাত দেওয়ামাত্র --"মামা আমাকে ঠেলে দেন । সমস্ত শরীর যেন ঝনঝনিয়ে ঝাঁকানি দিয়ে ওঠে ।" (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিশোর রচনাসম্ভার, সম্পাদনা পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, প্রথম প্রকাশ ২০০৬, পৃ. ১৬১) ।
প্রশ্ন জাগে নগেন কেন এল পরাশর ডাক্তারের কাছে ? মানিক যে গল্পটিকে পৌঁছে দেখেন তারই ভূমিকা হিসেবে কি এসেছে ডাক্তার পরাশর ? অথবা ব্যাধি থেকে যিনি দেহকে মুক্তি দিতে সক্ষম -- তিনিই মনকে মুক্ত করবেন ভয় থেকে -- এ বিশ্বাস থেকেই নগেন হয়তো সমবয়সের কোন বন্ধুর পরিবর্তে গেছে ডাক্তারের কাছে । যে বিজ্ঞানমনস্ক পরাশর শঙ্কিত নগেনকে দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন ভূত বলে কিছু নেই । আরও বলেছেন রাত বারোটায় তাকে নিয়ে লাইব্রেরিঘরে গিয়ে তিনি উদ্ঘাটন করবেন ব্যাপারটির রহস্য ।
শব্দহীন নৈশ অন্ধকারে নির্জন অন্ধকারে নগেনের সঙ্গে লাইব্রেরিঘরে গিয়ে তাঁর মনে কিন্তু জাগে ঈষৎ ভয় । তিনি বুঝতে পারেন -- "মানুষের মন চিরদিনই মানুষের মন । যুক্তি-তর্ক, বিশ্বাস-অবিশ্বাস দিয়ে মানুষ ভয়কে জয় করতে পারে না । দেহে আঘাত লাগলে যেমন বেদনাবোধ হবেই, তেমনি উপযুক্ত ভয়ের কারণ উপস্থিত হলে মানুষকে ভয় পেতেই হবে ।" (পূর্বোক্ত গ্রন্থ পৃ. ১৬৩) । মনের বক্র জটিল প্রবণতা । কতটা সচেতন ছিলেন -- মনস্তত্ত্বের জ্ঞান লেখকের কত গভীর আর ব্যাপ্ত ছিল উদ্ধৃতিটি তারই প্রমাণ ।
আপ্রাণ প্রয়াসে নিজেকে সংযত রেখে পরাশর দাঁতে দাঁত লাগিয়ে তৈলচিত্রের `ফ্রেম' স্পর্শ করেন । তত্ক্ষণাৎ বিদ্যুতের ঘায়ে ঝনঝনিয়ে ওঠে তার শরীর ছিটকে মেঝেয় বসে পড়েন তিনি । আতঙ্কিত নগেন ততক্ষণে জ্বেলে দিয়েছে আলো । বৈদ্যুতিক আলোয় উদ্ভাসিত তৈলচিত্রের রূপোর ফ্রেম আর দুদিকে লাগানো দুটি বাল্ব দেখে তিনি বুঝে যান ভূতটি কে । তাঁর প্রশ্নের জবাবে বলে সম্প্রতি ছবিতে দেওয়া হয়েছে রুপোর ফ্রেম আর বাল্ব দুটি ছবিতে `ফিট' করেছে তার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র মামাতো ভাই ।
পরাশর এবার নগেনের ভূতের ধাক্কার রহস্য ব্যাখ্যা করেন । ভূত নয় -- ইলেকট্রিক শক-এর ধাক্কায় সে পড়ে গিয়েছিল । দিনে মেন সুইচ বন্ধ থাকে । তাই ছবি ছুঁলে ঘটে না কোন অঘটন । পাঠকমনে কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় বাড়িটিতে কি আলোই জ্বলত চলত না পাখা ?
গল্প রচনার সময়ে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান সময়ের মতো বৈদ্যুতিন যন্ত্রাদির আধিক্য ছিল না । তবে সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারে -- যে পরিবারে তৈলচিত্র আঁকানোর মতো সে ছবিতে রূপোর ফ্রেম লাগানোর মতো সংগতি আছে তাদের বাড়িতে পাখা চলত না এটা ঠিক বিশ্বাস করা যায় না । পাখা যদি থাকে তবে মেন সুইচ বন্ধ থাকলে কেমন করে ঘুরত সেই পাখা সে সম্বন্ধে লেখক সম্পূর্ণ নীরব ।
তাই মনে হয় গল্পটি যেন স্বত:স্ফূর্ত সৃষ্টি নয় -- অনেকটাই বানিয়ে তোলা । কিশোরমন থেকে ভূতের ভয় দূর করার সচেতন উদ্দেশ্য গল্পটির উত্স । পরাশরের বিশদ বিশ্লেষণে সেরকমই মনে হয় পাঠকের । পরাশর এরপরে বলেছেন রূপোর ফ্রেমের নীচে কাঠ জাতীয় কিছু বিদ্যুৎ অ-পরিবাহী । তাই সন্ধ্যায় আলো জ্বললেও বিদ্যুতের বিল তেমন বাড়ে না । আবার সব আলো জ্বলে বলে ছবির ফ্রেম-এর বিদ্যুতের থাকে না শক দেবার মতো শক্তি । লাইব্রেরি কক্ষের আলো জ্বললেও একই কারণে ছবিতে হাত দেওয়া যায় সহজেই । যখন রাতে নিভে যায় সব আলো তখন রূপোর ফ্রেম-এর প্রবাহিত বিদ্যুৎ হয়ে ওঠে আঘাত দেওয়ার মতো শক্তিমান । তখন ছবি স্পর্শ করলেই মানবশরীরে প্রবেশ করে বিদ্যুৎ । তৈলচিত্রের ভূত তখনই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় সেই মানুষটিকে ।
ভূতের গল্প হিসেবে গল্পটি তেমন সফল নয় । কিন্তু ভূত-সংক্রান্ত সংস্কার যথা ভূতের সর্বজ্ঞতা, প্রতিশোধ স্পৃহা, ভূতভীতির কারণ বিশেষত ভয় পাওয়া সম্পর্কে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত অথচ সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ তাঁর লিখননিপুণতা আর মনস্তত্ত্ব জ্ঞানের গভীরতার প্রমাণ `তৈলচিত্রের ভূত' গল্পটি । এজন্যই গল্পটিকে অতিপ্রাকৃত গল্প হিসেবে তুচ্ছ মনে করা যায় না ।
`এলো' -- সাধারণ ভূতের গল্পের উপাদাননির্ভর অসাধারা একটি গল্প । অনবদ্য উপস্থাপন ভঙ্গির গল্পটি প্রথম মুদ্রিত হয় কিশোর পত্রিকা `রংমশাল'-এর ১৯৫৩ বঙ্গাব্দের শারদ সংখ্যায় । দুটি পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ঘিরে গড়ে উঠেছে এ গল্পের কাঠামো ।
হরিশবাবু আর কিশোর বিমানের বাবার (গল্পে নেই তাঁর নাম) বাস ছিল দুই পৃথক বাড়িতে । পরিবার দুটির মধ্যে ছিল প্রীতির সম্পর্ক । বিমান আর হরিশবাবুর ছেলে গোরা - দু জনের মধ্যে ছিল গাঢ় বন্ধুত্ব । হঠাৎ হরিশবাবু বিমানের বাবাকে একটি ঠিকানা দিয়ে চলে যান বাড়ি ছেড়ে । তালা দেওয়া বাড়িটি ভাড়া নিতে উত্সুক ব্যাক্তিবৃন্দ আর বিমানের বাবা -- কেউই ওই ঠিকানায় চিঠি দিয়েও হরিশবাবুর সঙ্গে করতে পারেননি যোগাযোগ । সময় বয়ে যায় । কেটে যায় চার-পাঁচ বছর । মারা যায় বিমানের এক দিদি ।
এক সকালে মায়ের কাছে বিমান শোনে গতরাতে বাড়ি ফিরেছেন হরিশবাবু এবং তাঁর পরিবার ।
উদগ্র আগ্রহে বিমান যায় হরিশবাবুর বাড়ি। দরজা-জানালা খোলা থাকলেও বাড়ির গেট ছিল বন্ধ । বিমানের ডাক শুনে কেমন যেন ত্রক্রুদ্ধ বিরক্তি নিয়ে বাইরে আসেন হরিশবাবু; অদ্ভুত হেঁড়ে গলায় জানতে চান `ক্যা' । বিমান অবাক হয়ে দেখে "... কেমন যেন গোলাকার হয়ে গেছে হরিশবাবুর মুখটা ।" (পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১৯৭) তাঁর আচরণ গেছে পালটে । বিমানকে তিনি দিতে চান না পূর্বের মতো সস্নেহ প্রশ্রয় । বিমান ফিরে আসে বাধ্য হয়েই ।
তার বাবার সঙ্গেও হরিশবাবু করেন এমনই অস্বাভাবিক ব্যবহার । বিমানের বাবার কথায় জানা যায় পথে দেখা হলেও হরিশবাবু -- "ভালো করে কথাই বলল না । ফিরে এসে যেন রাজা করেছে আমাদের । অসভ্য ভূত কোথাকার ।" (তদেব) ।
এই একবারই `ভূত' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে গল্পে । সে ব্যবহার বিমানের বাবার বিরক্তির স্বাভাবিক প্রকাশ মাত্র -- কোন অতিপ্রাকৃতের ইঙ্গিত তাতে নেই । তবে ত্রক্রমে ফিরে আসা পরিবারটির অ-স্বাভাবিক দিকটি হয়ে উঠেছে স্পষ্ট । যারা গিয়েছিল আর যারা এল -- তারা যে এক নয় -- এ সত্য আখ্যান-চরিত্রের মতো পাঠকও বুঝতে পারেন । পরিবারটি যে মৃত্যুর ওপার থেকে এসেছে -- তার ইঙ্গিত আছে তাদের আচার আর আকার পরিবর্তনের বর্ণনায় । সকালে হরিশবাবুকে ভালো দেখার সময় পায়নি বিমান । দুপুরে মেলে সে সুযোগ ।
স্কুলে যাবার পথে ট্রামের জন্য অপেক্ষা করছিল বিমান । তখন-- "হরিশবাবু পাশে এসে দাঁড়ান । তাকিয়েও দ্যাখেন না তার দিকে । বিমান তাকায় আশ্চর্য হয়ে, ... মুখটা কেমন বদলে গেছে হরিশবাবুর । সকালে যেরকম দেখাচ্ছিল সে রকম নয় । একটু যেন লম্বাটে হয়ে গেছে মুখটা, তখন একটু ঢিলে আর ঝাপসা মনে হয়েছিল মুখেঅ চামড়া, এখন যেন চকচক করছে । বয়স মনে হচ্ছে অনেক কম । হরিশবাবু না হয়ে হরিশবাবুর ভাইটাই হলে যেমন দেখাত । ছোট ভাই কী আছে হরিশবাবুর ? ইনি কি হরিশবাবু নন, তিনি ?" (পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১৯৭)
মৃত্যু মুছে দেয় পার্থিব সব যন্ত্রণা -- এমনই মানুষের বিশ্বাস । আবার এ সংস্কারও মানবমনে দৃঢ় যে, প্রেত অবয়ব পরিবর্তনে সক্ষম । হরিশবাবুর বয়স কম মনে হওয়া, সকাল-দুপুরের মুখের ভিন্নতা -- যেন নির্দেশ চিহ্ন হরিশবাবুর প্রেতত্বের । বিমান বুঝতে পারেনি বলেই সে হয়েছে বিস্মিত । হরিশবাবুকে জীবিত মানুষ বলেই ভেবেছে সে । তাই দু-জনে ট্রামে ওঠার পর বিমান এক সময় পূর্ব ঘনিষ্ঠতার সূত্রে ডাক দিয়েছে `হরিশজ্যাঠা' বলে । বাইরে দৃষ্টি রেখে বসেছিলেন হরিশবাবু । এবার তিনি "... ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে চোখ পাকিয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকেন, মুখ দেখে মনে হয় অসহ্য রাগে যেন কাঁপছেন ভেতরে ।
"কী"
কথা শুনে কিন্তু মনে হয় যে রাগ তো নয় তিনি যেন অসহ্য কান্না চাপছেন ভেতরে ।" (তদেব)
অনিবার্য মৃত্যু সম্বন্ধে নিরুপায় ক্রোধ আর জীবন-বিচ্ছিন্ন হওয়ার অসহায় বেদনা এভাবেই যেন মানিকের লেখনীতে হয়ে উঠেছে সাবয়ব । হরিশবাবু আর কিছু না বলে বিমানের সঙ্গে আলাপ না করে বাইরে চেয়ে থাকেন । তিনি যে জীবিতের সঙ্গে, বেঁচে থাকার প্রিয় মানুষের সঙ্গে আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও যোগ স্থাপন করতে অসমর্থ তার প্রমাণ যেন এই বাইরে তাকিয়ে থাকা । আর তাঁর শরীরী রূপ, যথাসম্ভব জীবিততুল্য বিচরণ জীবনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষান্তিহীন প্রয়াসের প্রমাণ ।
তাঁর সে প্রচেষ্টা সর্বদা সফল হয় না । মুর্হুমুহু বদলে যায় তাঁর আকার । এভাবেই বিমান এবং পাঠক ধীরে ধীরে অনুভব করে হরিশবাবুর মধ্যে এসেছে আমূল কোন পরিবর্তন । তাই হরিশবাবু নামার জন্য উঠে দাঁড়ালে বিমান চমকে ওঠে -- "একটা ঝাঁকি লাগে বিমানের মনে । হঠাৎ রোগা আর লম্বা হয়ে গেছেন হরিশবাবু অদ্ভুত রকম ! পাঞ্জাবির হাতার মধ্যে কাঠির মতো হাত দুটি নড়বড় করছে, এমন সরু হয়ে গেছে গলাটা যে মাথাটাকে মনে হচ্ছে প্রকাণ্ড স্ট্যান্ডৈর ওপর বসানো গ্লোবের মতো ।" (পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১৯৮) হরিশবাবু যেন প্রাণপণে অস্বীকার করতে চাইছেন মৃত্যুকে -- তাই তাঁর চলাফেরা স্বাভাবিক । সাধারণ মানুষের মতো পোশাক পরে তিনি যাতায়াত করেন ট্রামে । তাঁর জীবনহীনতার প্রমাণ তাঁর অস্বাভাবিক এবং পরিবর্তনশীল শরীর । প্রেত- শরীর হবে কঙ্কালসদৃশ -- বাংলার এই লোকসংস্কার নিপুণভাবেই ব্যবহার করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হরিশবাবুর শরীর বিবরণে । বহু লেখকের গল্পে এ সংস্কার নানাভাবে রূপ লাভ করেছে । মনে করা যায় পরশুরাম (রাজশেখর বসুর ১৮৮০-১৯৬০ -ছদ্মনাম) লিখিত `ভূশণ্ডীর মাঠে' (`গড্ডালিকা' : ১৯২৫) গল্পে কারিয়া পিরেতের বর্ণনা -- "মাথায় পাগড়ি, কালো লিকলিকে চেহারা কাঁকলাসের মতো একটি জীবাত্মা..." (`গড্ডালিকা এম. সি. সরকার অ্যাণ্ড সন্স, প্রথম সংস্করণ ১৩৩২ ব. ত্রয়োদশ সংস্করণ ১৩৬৯ ব. পৃ. ১১৪) ।
প্রভেদ এই যে পাঠককে পরশুরাম প্রেত অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছেন গল্পের শুরুতেই । মানিক কিন্তু আশ্চর্য লিপিকুশলতায় পাঠককে বুঝতেই দেননি প্রেতের আবির্ভাব কথা । বরং তাঁর দেওয়া বর্ণনায় সন্দেহ জাগে পাঠকমনে হরিশবাবুর শারীরিক আর মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে । প্রেত সম্পর্কে স্বাভাবিক ভীতির অবকাশ গল্পটিতে প্রায় নেই । বিমানও বিন্দুমাত্র শঙ্কিত হয়নি হরিশবাবুর আচরণে বা কথায় । বরং প্রথমে হরিশবাবুকে দেখে ও কথা শুনে তার মনে জেগেছিল অভিমান । দ্বিতীয়বার হরিশবাবু তার সঙ্গে আলাপ না করায় সে রেগে ওঠে । আবার তাঁর বদলে যাওয়া মুখ আর শরীর দেখে চমক লেগেছিল তার । `ঝাঁকি লাগে' শব্দবন্ধটির সুষ্ঠু ব্যবহার বিমানের মানসিক অবস্থা হয়ে গেছে স্পষ্ট ।
অতি সূক্ষ্মভাবে আখ্যান-অবয়বে মানিক সঞ্চারিত করে দিয়েছেন আতঙ্ক । হরিশবাবু আর তাঁর পরিবার সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে বিমান আর পাঠক । স্কুল-ফেরত বিমান হরিশবাবুর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যায় । কেন না বাড়ির ভেতর থেকে অস্পষ্ট একটা গোঙানি কানে এসেছে তার । সেই শব্দ চাপা কান্নারও হতে পারে । এবার ভয় পায় বিমান । গায়ে কাঁটা দেয় তার - মনে পড়ে দিদির মৃত্যুর পর মায়ের উচ্চরবের কান্না রাতে হয়ে গিয়েছিল অমনই নিস্তেজ গোঙানি । এমন করেই হরিশবাবুর পরিবারের সঙ্গে মৃত্যুর যোগ সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছেন লেখক । ত্রক্রমে বিমানের মতো পাঠকমনেও জাগে শঙ্কা মিশ্রিত কৌতূহল -- "গেটে তালা, হরিশবাবুর ওরকম খাপছাড়া ব্যবহার, গোরার টিকিট দেখতে না পাওয়া, গোঙিয়ে গোঙিয়ে কান্না -- এসব কী চলছে গোরাদের বাড়িতে ।" (তদেব) কিশোর বিমান করতে চায় রহস্য-উন্মোচন । জানার যে আগ্রহ ঘটনার ঊর্ধ্বে ওঠার যে সাহস মানুষের তথা মানব সভ্যতার অগ্রগমনের কারণ তার স্পর্শ লাগে বিমানের মনে । সে গোরার নাম ধরে দেয় ডাক । তখনই থেমে যায় গোঙানি -- দেখা যায় গোরার মাকে । ছেলের বন্ধুকে দেখে আপ্যায়ন দূরে থাক -- কথাই বলেন না তিনি -- "দু হাতে জানালার শিক ধরে কালা-বাবা-অন্ধের মতো নিথর নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ।" (তদেব) ।
বিমানের চোখে পড়ে গোরার মায়ের চেহারা আগের মতো নেই -- "মুখখানাও কেমন যেন গোলাকার হয়ে গেছে মনে হয় বিমানের, চামড়া যেন ঢিলে হয়ে ঝুলে পড়েছে । কপালটা ছোট হয়ে আধখানা হয়ে গেছে ।" (তদেব)
যে প্রাণ সঞ্জীবিত রাখে মানুষকে -- সেই জীবন রসের অভাবে এসেছে এই পরিবর্তন -- মানিকের বর্ণনায় রয়েছে তারই সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা । জীবন আর জীবিতের সঙ্গে মৃতের থাকে ব্যবধান । বিমানের সঙ্গে কথা না বলে গোরার মা যেন দিতে চান তার ইঙ্গিত । হরিশবাবু পুরুষ বলেই হয়তো প্রবলভাবে অতিক্রম করতে চেয়েছেন সেই বাধা । চেষ্টার ব্যর্থতায় তিনি ত্রক্রুদ্ধ বিরক্ত । আর নারী গোরার মা জীবনে যেমন মৃত্যুতেও তেমনই নীরবে সহ্য করতে চেয়েছেন এই অবস্থার বেদনা । এভাবে বিচার করলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোবিশ্লেষণ প্রবণতা আর বাস্তব জ্ঞানের প্রখরতা হয়ে ওঠে স্পষ্ট ।
বিমানের বাবার চোখে পড়েছিল হরিশবাবুর আচরণের অস্বাভাবিকতা । আর তার মায়ের চোখে ধরা পড়েছে গোরার মায়ের আচরণ-অসংগতি । মধ্যবিত্ত দুই গৃহিনীর মধ্যে গড়ে উঠেছিল সহজ প্রীতিতে স্নিগ্ধ সম্পর্ক । তারই সূত্রে তিনি মধ্যাহ্ন-অবকাশে দেখা করতে গিয়েছিলেন গোরার মায়ের সঙ্গে । কিন্তু -- "কেউ দরজাও খুলল না সাড়াও দিল না । গোরার মা ওপরের জানলায় দাঁড়িয়ে এক নজর দেখে সরে গেল ।" (পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১৯৮)
দীর্ঘ অদর্শনের পর দেখা হওয়ার ক্ষণে প্রত্যাশিত সমাদরের ব্যতিক্রমে তাঁর মনে লাগে খটকা । কিছুটা আহতও তিনি হয়েছিলেন । একই সঙ্গে স্বাভাবিক কৌতূহলে তিনি দেখেছিলেন পূর্ব সখীর অবয়ব আগের মতো নেই "... শুকিয়ে যেন কাঠি হয়ে গেছে একেবারে, মুখখানা চুপসে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে । অমন সুন্দর দেখতে ছিল মানুষটা ।" (তদেব) এ বিবৃতিও দেয় এই ইঙ্গিত যে প্রত্যাগতদের মধ্যে জীবনের সরস সৌন্দর্য আর নেই ।
মৃত জীবিতের সঙ্গে মিলিত হতে অসমর্থ । জীবিত অক্ষম মৃতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে । এই অক্ষমতার বেদনা হরিশবাবুর ক্রোধ আর তাঁর স্ত্রীর কান্নার উত্স । তাঁদের সজীব মানুষ মনে করাই -- বিমান আর তার বাবা-মায়ের বিস্মিত হওয়ার কারণ ।
এরপর গল্পটি দ্রুত অগ্রসর হয় সমাপ্তির দিকে । স্কুল-ফেরত বিমান যাবে ফুটবল খেলতে । মা তাকে ছোট মেয়ের বায়নার কথা জানিয়ে একটি টাকা দিয়ে আনতে বলেন ইলিশ । সেই সঙ্গে মৃত অন্য মেয়ের ইলিশপ্রিয়তার স্মৃতি তাঁর চোখে আনে জল ।
মাছ কেনার সময় বিমানের মনে পড়ে গোরাও ভালোবাসত ইলিশ । এক বন্ধুর বাড়িতে ওই মাছ রান্না হলে অন্য বন্ধুর নিমন্ত্রণ ছিল বাঁধা । বিমান ঠিক করে গোরাকে ডেকে নেবে নিজেদের বাড়ি; খাওয়াবে পূর্বের প্রিয় মাছ । তাই মায়ের দেওয়া টাকার সঙ্গে নিজের পয়সা যোগ করে ষোলো আনার বদলে আঠারো আনায় কিনে নেয় ইলিশ । সময় তখন সন্ধ্যা, বৃষ্টিও নেমেছে । বিমান হরিশবাবুদের বাড়ির দিকে রওনা হয় ।
কাছে এসে সে অবাক হয়ে দেখে আলোকিত বাড়িটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে গোরা ! বন্ধু দুজন পরস্পরের নাম ধরে ডাক দেয় । এবার প্রাকৃতের মধ্যে এসে যায় অতিপ্রাকৃত । "চোখের পলকে গোরা নিজেই বারান্দা থেকে রাস্তায় নেমে আসে ।" (পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ২০০) তত্ক্ষণাৎ নিভে যায় বাড়ির সব আলো । ঘটনাদুটির অস্বাভাবিক সংযোগ ধরতে পারে না বিমান । ফিউজ নষ্ট হওয়ার কথা মনে আসে তার; তা ছাড়া বহু দিন পরে বন্ধুকে পেয়ে সে তখন আনন্দে বিহ্বল -- "অ্যাদ্দিন পরে এলি তবে সত্যি ?" (তদেব) ।
গোরা যে মৃত তা বোঝেনি বিমান; বুঝতে পারেনি প্রেত গোরাকে টেনে এনেছে ইলিশ । বেঁচে থাকতে প্রিয় ছিল তার ওই মাছ । মৃত্যুর পর মত্স্যপ্রিয়তার প্রেত সংস্কার যুক্ত হওয়ায় তার লোভ গেছে বেড়ে । তাই সে কাছে এসে বন্ধুর ধরেছে হাত, কথাও বলেছে । কিন্তু জীবন-উষ্ণ নয় গোরার স্পর্শ; প্রাণহীনতায় -- "ঠাণ্ডা কনকনে ... কেনার সময় ইলিশ মাছটা যেমন ছিল ।" (তদেব)
বরফ-রক্ষিত মৃত ইলিশের হিম স্পর্শের সঙ্গে তুলনাটি গোরার জীবনহীনতাকে করে তুলেছে স্পষ্ট ।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে প্রেতের মত্সপ্রিয়তা সম্পর্কিত বাংলার লোক সংস্কারটি নিপুণভাবে ব্যবহার করেছেন । মৃতের হিম-স্পর্শ বিষয়ে প্রায় বিশ্বজনীন বিশ্বাসের প্রয়োগও এখানে হয়ে উঠেছে অনবদ্য । মৃত আত্মার স্পর্শ জীবিতের পক্ষে শুভ নয়, কেন না প্রেত সর্বদা জীবিতকে মৃত্যুরাজ্যে নিয়ে যেতে চায়; করতে চায় আপন সহচর । এই লোকসংস্কারটির ইঙ্গিত যেন এখানে দিয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় । গোরা হাত ধরার পরই বিমানের দেহ-মনের সজীবতা নষ্ট হতে থাকে । কুশলী বাক্যবিন্যাসে সে পরিবর্তনকে মানিক করে তুলেছেন বিশ্বাস্য । গোরা হাত চেপে ধরার পরই -- "হঠাৎ কেমন ঝিমিয়ে যায় বিমান কেন যেন বিরক্তি বোধ হয় তার । গোরা ফিরেছে বলে সে উত্সাহ উদ্দীপনা জেগেছিল সব যেন কেমন হিম হয়ে যায় এক দণ্ডে । বাড়ি গিয়ে একটু শোবার জন্য প্রাণটা ছটফট করে ওঠে । কতক্ষণ এখন গোরার সঙ্গে বকবক করতে হবে কে জানে ! চোখ বুজে বিমান ঢোক গেলে । অতি কষ্টে তারপর সে চোখ মেলে -- যেন কাঁচা ঘুম থেকে জাগতে হচ্ছে ।" (তদেব) ।
উদ্ধৃতিটির মধ্যে বিমান যে ত্রক্রমে জীবনহীনতার দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে তার ইঙ্গিত আছে । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুভবকে শরীরী করে তোলার অ-তুল্যতার উদাহরণ এই অংশ -- তা স্বীকার করতেই হয় পাঠককে ।
সাধারণত ভূতের গল্পে এরপরেই মানুষটি হারায় চেতনা । মানিক অনুসরণ করেননি সেই প্রচলিত পদ্ধতি । তাঁর গল্পে প্রেত স্পর্শে পালটে গেছে জীবিতের মন ।
অসুস্থ বন্ধুকে এবার সহজে পাওয়া যাবে কাছে । সম্ভবত এ জন্যই অন্তর্হিত হয় গোরা । চোখ খুলে বিমান তাই দেখতে পায় না তাকে । এই অ-সৌজন্য ত্রক্রুদ্ধ করে বিমানকে । সে তো গোরাকে প্রাণহীন প্রেত বলে বোঝেনি । তাই সে ভাবে -- "গোরার এরকম ব্যবহার তার সঙ্গে এতকাল পরে ফিরে এসে ? দু দণ্ড দাঁড়াবার সময় হল না, বাড়িতে ডেকে একবার বসতে বলতে খেয়াল হল না ! রাগে যেন জ্বালা করতে থাকে বিমানের মগজ । যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত লাগিয়ে সে হন হন করে এগিয়ে যায় নিজের বাড়ির দিকে ।" (তদেব) ।
বন্ধুর আচরণে আহত বন্ধুর মানস-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে অশরীরীর স্পর্শজনিত ব্যাধির সূত্রপাত -- উভয় দিককেই বিশ্বাস্য বাস্তব করে তুলেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে । কী বিরল লিখনকৃতি ছিল তাঁর -- এই অংশটি তার আর একটি প্রমাণ ।
বিমান বোঝেনি যে সে সুস্থ নয় । গুরুতর ব্যাধিতে আক্রান্ত বহু মানুষের মনে দেখা যায় এ ধরনের অসচেতনতা । অন্য প্রিয়জনের চোখে ধরা পড়ে অসুস্থতা । এখানেও মানিক সেই সাধারণ ব্যাপারটি ব্যবহার করেছেন । বাড়িতে ঢুকতেই বিমানকে দেখে মা বুঝে যান ঘটেছে কোন অসম্ভব ঘটনা । তাই তাঁর ছেলে আর সুস্থ নেই । স্বভাব সংগত তাঁর প্রতিক্রিয়া । সভয় আতঙ্কে তিনি জানতে চেয়েছেন -- "কী হয়েছে রে ? মুখ যে কালি মেরে গেছে একেবারে । জ্বর হয়নি তো ?" বলতে বলতে কপালে হাত রেখে চমকে উঠলেন "যা ভেবেছি ! গা পুড়ে যাচ্ছে ।" (পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ২০০)
এখানেই সমাপ্ত হয়েছে গল্প । বিস্তৃত বিবৃতির অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যানের প্রচলিত রীতির ব্যতিক্রম হেতু গল্পটি হয়ে উঠেছে অনন্য । অতিপ্রাকৃত গল্প যে সংশয় আর বিশ্বাসের মধ্যে আবর্তিত হয় তারই দৃষ্টান্ত এ গল্প । পাঠক কল্পনা করে নিতে পারে অনেক কিছু । বিমান কি মারা গেল অথবা কাটিয়ে উঠল অসুস্থতা -- এই প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর পাওয়া গেলে গল্পটির অনন্যতা ক্ষুন্ন হত । সম্ভাবনার বিস্তৃত অবকাশ নির্মাণের কারণে গল্পটি অতিক্রম করেছে সাধারনত্বের সীমা ।
অন্য লেখকের কলমে যা হত সাধারণ একটি ভূতের গল্প তাকে ইঙ্গিতে -- সংকেতে অপরূপ করে তুলেছেন মানিক । মৃত, অ-মৃতের ব্যর্থ মিলন প্রয়াসের যন্ত্রণা গল্পটিকে করে তুলেছে অনুভববেদ্য ।
প্রেত-বিশ্বাস বা অবিশ্বাস -- কোনোটি গল্পে পায়নি প্রাধান্য । সংশয়-অসংশয়ের যে সংযোগবিন্দুতে অতিপ্রাকৃত চেতনার অবস্থান গল্পটি তারই শব্দনির্মিত চিত্র । মানব-মনস্তত্ত্ব এবং অতিপ্রাকৃত সংস্কারের সুষম অন্বয়ে অনন্য হয়ে উঠেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র প্রেত উপস্থিতি-নির্ভর একমাত্র গল্প `এলো !' । [প্রথম কিস্তি]
(ডিসেম্বর, ২০০৮; পরবাস-৪২)