॥ ১ ॥
রাত দুটোয় রাহুলের একটা দমবন্ধ করা কষ্টের অনুভব নিয়ে ঘুম ভেঙে গেল । জেগে উঠে দেখে কষ্ট আর কিছু নয়, টুবলার হাতটা বুকের উপর এসে পড়েছে । সরাতে গিয়ে ছেলের ঘুমন্ত শান্তির ছবিতে রাহুলের মনে পড়ে যায় একটি পুরনো কবিতার একছত্র । কিন্তু এক্ষেত্রে পিতাই কি নিষ্ঠুর ? যেমন কবিতা বলছে, তেমন করে পিতা তো সহসা চলে যায়নি কোথাও । বরং তার মা-ই তো চলে গিয়েছে, দুম্ করে । নাকি পিতাও একটু-একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে এখন ?
টুবলাকে ঢাকাঢুকি দিয়ে শুইয়ে দিয়ে উঠে পড়ে সে, অন্ধকার ফ্ল্যাটের লিভিং রুমে এসে পায়চারি করে, জল খায় । জানালা দিয়ে এই রাতেও এক আধটা গাড়ির হুশ করে চলে যাওয়া দেখা যায় । সোডিয়াম আলোর হলুদ আভায় রাত দুটোই বা কি আর রাত দশটাই বা কি । এই বারোতলার ওপর থেকে দূরে সুপার-মার্কেটের নিওন-সাইন দপদপ্ করে জ্বলে-নেভে । রাহুল কিছুটা যৌনতাবোধে আক্রান্ত হয় । যাবে নাকি একবার বাথরুমে ? তাতে যদি ঘুম আসে -- কালকে অফিসের একটা পিকনিক আছে, ঠিক পিকনিক নয়, এসব রবিবাসরীয় তামাশার গালভরা নাম হল অ্যানুয়াল বিজনেস রিভিউ । ছোট-সেজ-মেজ-বড় সব কর্তারা থাকবেন সেখানে, সে নিজেই মেজর দলে পড়ে । নিজে ফিট না থাকলে পুরো ব্যাপারটা ম্যানেজ করা যাবে না । হুল্লোড় শুরু করার আগে ভজন গাইবার মত পাওয়ার পয়েন্টে বিশ্বদর্শন করানোর মত কিছু কাজ থাকবে তার ।
রুনা চলে যাবার পর থেকে এরকমই হচ্ছে তার, কখনো কখনো রাতে ঘুম ছুটে যাচ্ছে । কখনো হয়ত শরীর জাগছে, কখনো বিষাদ ।
যিনি সদা ভ্রাম্যমান, জনপদে, জঙ্গলে, বিজনে -
এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছুটে যান ত্রক্রমাগত -
যিনি এই আসছি বলে, দূরে চলে যান অকস্মাৎ
কবিতাটি আবার মনে পড়ে তার ।
রুনাই কি চেয়েছিল চলে যেতে ? দ্বিতীয়বারে কেমো-র পর যখন মাথা খালি হয়ে গেল, রুনা বলেছিল, দেখলে, তোমার চিরকালের শখ একটা টেকো মেয়ের সাথে প্রেম করা, সেটাও এবার হয়ে গেল । বরং প্রথমবারে, ম্যাসটেকটমির পর রাতের পর রাত রুনা দেওয়ালের দিকে ফিরে শুয়ে একলা একলা কাঁদত । ঘটনাচক্রের আকস্মিকতায় তাদের শারীরিক সম্বন্ধের পাট প্রায় চুকেই যাচ্ছিল, পাশাপাশি দুটি শরীরের শুধুমাত্র সান্নিধ্যের উত্তাপ ফিরিয়ে আনাই একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছিল । বিচক্ষণ ডাক্তার চৌধুরি বলেছিলেন মিসেস রয় ফাইট করবেন সব সময়-- এটা আপনার জীবন । রুনা মাথা নেড়ে বলেছিল না, এটা আমার টুবলার জন্য ফাইট । তা গত দু বছরের হাসপাতালকেন্দ্রিক জীবনে সে সেই ফাইটটা করেছিল ভালমতই ।
বিছানায় ফিরে গিয়ে আবার ঘুমের জন্য প্রার্থনা করতে থাকে সে । রাত দুটো দশ ।
সেও তো এক বছর হল । আট বছরের বিবাহিত জীবন, অনেক ঝগড়া, ভাব, ইন-লজ (কখনো কখনো ঝগড়ার সময় যাদের আউট-লজ বলে উল্লেখ করা হত, রাহুলের মা-বাবা চলে গেছেন অনেক দিন আগে ।) একটি অবোধ শিশু ও একখানি ছবি, এই বাকি থেকে গেল । রুনা চলে যাবার পর রাতের পর রাত তার ঘুম আসত না, আশচর্য এই যে, সেটা ঠিক শোকজনিত বলে তার মনে হয়নি । বরং খানিকটা মৃত্যুভয়ের মত, আমিও যেকোনদিন চলে যেতে পারি, এরকমের একটা দমচাপা অবস্থা । যেমনভাবে মৃত্যুদূত এসে ডাক দিয়েছিল ছত্রিশের রুনাকে, চল্লিশের রাহুল রায়কেও এসে তেমনভাবে বলতে তাদের বাধবে না, রয়, ইটস টাইম ইউ জয়েন আস । রাহুল বোন-ভগ্নিপতিকে ফোন করে, ভগ্নিপতি আইনজীবি, তাকে উইল করে রাখবার কথা বলে, মাঝখানে হঠাৎ বোকাসোকা বোনটা সেসব কথা শুনে হাউ-হাউ করে কাঁদে, সে বিরক্ত হয়, ফোন রেখে দেয় । অথচ একদিন অন্তর একদিন সে ডাক্তারের কাছে যায় । আজ ইসিজি করার কথা বলে, কাল গলার কাছে কাঁটা ফোটার মত ব্যথা । ডাক্তার পুরি অতি সজ্জন, দিন দুই ধৈর্যভরে শোনবার পর, একদিন বললেন রয়, আই থিঙ্ক হোয়াট ইয়ু আর ফেসিং ইজ জাস্ট বিরিভমেন্ট ট্রমা । আই অ্যাম সরি টু বি সো ব্লান্ট । ট্রাই টু বিয়ার উইথ ইট । থিংস উইল ব্রাইটেন আপ, আয়াম শিওর । রাহুল ইঙ্গিতটা বোঝে, অন্যমনস্কের মত চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে স্টুলে ধাক্কা খায় ।
দুবছর আগেও তারা টুবলার জন্মদিন পালন করেছে ধুমধাম করে । দুবছরের বাচ্চার জন্মদিন মানে ছোট বাচ্চা ও তাদের মায়েদের যৌথ জমঘট । হলই বা ম্যাকডোনাল্ডস্-এর দোকানের ভাড়া করা আতিথেয়তা, ক্ষুদে অতিথিদের সামলাতে যথেষ্ট ঝক্কি । রুনা চুল পাতলা মাথায় স্কার্ফ ঢাকা দিয়ে তার সাথে পাল্লা দিয়ে সব সামলেছে । তাদের মনে হয়েছিল মাথার ওপর থেকে একটা কালো ছায়া সরে যাচ্ছে বুঝি, শেষ অবধি । তখন রুনার মা, বাবাও ছিলেন পাশে । কিন্তু রুনার চলে যাবার পর তাঁদের আর বেশিদিন আটকানো যায়নি । এখন গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে তাঁরা ইউ কে তে, ছোট মেয়ের কাছে । আধুনিক আণবিক পরিবারের বাপ-ব্যাটা ফের একলা । হাওয়ায় ভাসা ছোট একখানি বুদ্বুদের মত ।
রাহুলের বোন হায়দ্রাবাদ থেকে খবর নেয়, বাচ্চার দাদু-দিদা ফোন করেন । শালির সন্তানজন্মের খবর এলে শালিকে অভিনন্দন জানায়, এইসব ছোট ছোট সূর্যকিরণে তাদের জীবনে এক পশলা পরিবর্তন হয় । রাহুল লক্ষ করছে এমনিতেই মিতবাক টুবলা আজকাল রুনার কথা অনেক কম জিজ্ঞেস করে । রাহুল তাই আরও বেশি করে ছেলের জগতে ঢুকে পড়ে । তার কাজের জীবনেও তার ছাপ পড়ে । পাওয়ার পয়েন্টে আইডিয়া বেচতে বেচতে, এযাসাইনমেন্ট বলতে গিয়ে হোমটাস্ক বলে ফেলে । অন্যরা তার চোখ বাঁচিয়ে ফিসফাস করে । সে কখনো কখনো অস্বস্তি বোধ করে, কখনো কখনো লক্ষই করে না ।
সন্ধ্যাবেলা কোনরকমে বাড়ি পৌঁছেই ছেলেকে আনতে ছোটে, মিসেস ডি কুনহা লোক এমনিতে ভালো তবে ওই ঘরেই সন্ধ্যাবেলা তাঁর ছেলে সালসা শেখায়, তখন ছোট বাচ্চা বাড়িতে বসে থাকলে তাঁর মুখ ভার হয় । মাঝে মাঝে মৃদু অনুযোগও শুনতে হয় তাকে, "অনুরাগ হ্যাজন্ট ইটেন ইনাফ টুডে....." । ততক্ষণে টুবলা তার স্কুলব্যাগ নিয়ে তৈরি । রাহুল ছেলেকে নিয়ে ঘরে পৌঁছয়, টুবলা মাঝে মাঝে বায়না করে, বাবা আমি লক নিজে খুলি ? ঘরে ঢুকে চা চাপায়, টুবলার জন্য দুধ । কাজের লোক তার নিজের চাবি দিয়ে ঘর খুলে রান্নাবান্না করে রেখে গেছে -- সেসব দেখে নেয় । দিনের আলো থাকলে তখন সে টুবলাকে সাথে নিয়ে হাঁটতে বের হয় । টুবলা গিয়ে পার্কের বাচ্চাদের জায়গাটা জরিপ করে নেয় । বন্ধু-চেনাশোনা কাউকে দেখতে পেলে একটা হাসি ফুটে ওঠে তার এমনিতে সিরিয়াস মুখখানিতে । তারপর সে তার খেলায় ঢুকে পড়লে রাহুল গিয়ে একটা বেঞ্চে বসে । পাড়াটা নতুন, এবং যাকে বলে পশ্, কাজেই রাস্তায় প্রতিবেশি কাউকে দেখে হাই-হ্যালো করবার রেয়াজ নেই, অচেনা মানুষের সামাজিক অবস্থান না জেনে সম্ভাষণ তো অকল্পনীয় । রাহুল অবশ্য এই অনামিতায় স্বস্তিই বোধ করে ।
সাড়ে সাতটায় বাড়ি ফিরে সে রাইস-কুকার লাগায়, তরকারি গরম করে । মাছ বেছে খাওয়া সমস্যা বলে ওদের মাছের পাট আর নেই । টুবলাও ছোট ছোট রুটির টুকরো দিব্যি ডাল বা সব্জি দিয়ে খেয়ে নেয় । শনি-রবি হলে চিকেন বা মাটন, তবে টুবলা এখনো মাটন খেতে গিয়ে ছিবড়ে করে ফেলে । তারপর তারা টুবলার হোমওয়র্ক নিয়ে বসে । টুবলার খাতায় ক্লাস-টিচারের রিরাইট এগেইন গোছের দায়সারা ভুল নির্দেশ দেখেও দেখে না । দ্য মাউস রান আপ দ্য ক্লক, টুবলা আড়চোখে ঘড়ি দেখে, ওর প্রিয় কার্টুন কখন আসে টিভিতে সেটা ও জানে । ঘড়ি দেখা নয়, শুধু সাড়ে ন'টার ছবিটা ঘড়ি থেকে ও পড়ে ফেলে । দশটায় লাইট-আউট ।
কিন্তু যেদিন তার দেরি হয়, সেদিনই সমস্যা । ফোনে মিসেস ডি কুনহার নট আ প্রবলেম বলার ভঙ্গিমাতেই বোঝা যায় যে ভালোরকম প্রবলেম রয়েছে । ফেরার পথে, সে যখন মিসেস ডি কুনহার ফ্ল্যাট থেকে ঘুমন্ত টুবলাকে একহাতে কোলে তুলে নিয়ে অন্য হাতে ব্যাগ সামলাতে সামলাতে লিফটের বাটন চাপছে, তখন মিসেস ডি কুনহা তাঁর ইণ্ডিয়ান ইংলিশে বলে ওঠেন, রয়, উই শ্যাল বি গোইং টু আওয়ার নেটিভ প্লেস ফর আ উইক, উই হ্যাভ ইস্টার, নো ! তখন সে একটু বিভ্রান্ত বোধ করে । সে কি করে এখন ? আগে আরেকজন বেবি সিটার খুঁজবে, নাকি বাড়ি গিয়ে আজকের রাতটা অন্তত ঘুমিয়ে নেওয়া বেশি জরুরি ! বাড়িতে ফিরে দোটানায় ভোগে, আচ্ছা এখন কোনটা বেশি জরুরি টুবলাকে যেমন ঘুমোচ্ছে তেমনই ঘুমোতে দেওয়া না, ঘুম থেকে তুলে খাওয়ানো । রুনা থাকলে এইসময় কি করত তা ভেবে বের করতে চেষ্টা করে । এই দুই পরস্পর বিরোধী সমাধান-সূত্র তাকে পীড়িত করতে থাকে এবং এক সময় খাওয়া-দাওয়া না করেই সে সোফাতে ঘুমিয়ে পড়ে ।
বাড়িতে ফিরে তারই জের চলে । টুবলা হোমটাস্ক না করার জন্য বকা খায়, কাঁদে । তাদের রাতের খাওয়া শেষ হলে আবার বিপাশাকে ফোন করে সে । রাগে তার গলা থমথম করে । বিপাশা তার দাদার এই প্রতিক্রিয়া আশা করেনি । বাক্যরহিত বিপাশাও । কাঁদে । তখন যুধাজিৎ ফোন ধরে, ঠাণ্ডা গলায় ক্ষমা চায় । দাদা এতটা আপসেট হবেন জানলে এই অনধিকার চর্চা তারা কখনোই করত না, ভবিষ্যতে তারা আর দাদার ব্যাপারে নাক গলাবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি । তার গলার কাঠিন্য রাহুলের কানেও বাজে, কিছুটা সম্বিৎ ফেরে তার ।
সাইটটার শুরু হচ্ছে অ্যানিমেশন দিয়ে -- একটি পাখি মালা ঠোঁটে নিয়ে বসে, আরেকটি পাখি উড়ে আসছে তার দিকে, তারও ঠোঁটে একখানি মালা, কিন্তু মাঝপথে সে হঠাৎ ভ্যানিশ হয়ে গেল । তার পর আরেকটি পাখি উড়ে এল মালা নিয়ে । এরপরেই দুটি পাখি পাশাপাশি উড়তে থাকে মালা গলায় ।
বোকা বোকা এই অ্যানিমেশন শেষ হলে সাইটটা তাকে লগ ইন করতে বলে । তার লগ ইন প্রম্পট-এর দুপাশে কিছু কিছু বিবাহেচ্ছু ব্যক্তির ছবি দেওয়া আছে । বিপাশা তার লগ ইন কি করেছে সে জানে না, অতএব সে দুপাশের প্রোফাইলগুলোয় নজর দেয় --
সাতাশ বছরের বান্টি ওয়ালিয়া, আর্টস গ্র্যাজুয়েট ফ্রম এল এস আর, ম্যারিড ইন জুন, টু থাউজ্যাণ্ড থ্রী, ডাইভোর্সড ডিউ টু ম্যারিটাল ডিসকর্ড ইন জুন, টু থাউজ্যাণ্ড ফাইভ । সঙ্গের ছবিটা দেখলে মেয়েটিকে একুশ-বাইশের বেশি বলে কিছুতেই মনে হয় না ।
কিংবা চল্লিশের আর বেণুগোপাল, যে কিনা বেশ বড় গলা করেই লিখছে যে সে তার প্রথমা স্ত্রীকে চিটিং এবং ব্যাড বিহেভিয়ারের জন্য ডিভোর্স করে দিয়েছে ।
আটত্রিশের রেণু সহায় । দুটি বাচ্চা নিয়ে বিধবা, বাবা রিটায়ার্ড, ভাইয়ের সংসারে গলগ্রহ থাকবার চেয়ে একটি বিবাহ সম্বন্ধের মধ্যে নিরাপত্তা খোঁজার চেষ্টা ।
লক্ষ করবার মত বিষয় হল পুরুষদের মধ্যে পুনর্বিবাহের কারণ দেখানোর খুব একটা তাগিদ দেখা যাচ্ছে না । একটা বৌ ছিল, এখন নেই কাজেই দ্বিতীয় বিবাহ, ব্যস্ । মেল ইগো এর একটা কারণ হতেই পারে । কিন্তু দ্বিতীয় বিবাহেচ্ছু মেয়েদের ক্ষেত্রে একটা ক্ষীণ বিভাজন চোখে না পড়ে যায় না, মহিলাদের মধ্যে যারা জীবন ও জীবিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত তাঁদের এষণা সঙ্গলাভ । অন্য দিকে আছেন রেণু সহায়ের মত বিপন্ন একলা নারী, যার নিরাপত্তাবোধের প্রশ্ন একটি বিবাহসম্পর্কের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত ।
প্রথমে খুব একটা চিত্তাকর্ষক না লাগলেও তারপর থেকে রাহুল প্রতিদিন একবার করে ওই সাইটটাতে যেতে লাগল । এটাতে তার একটা নেশা ধরে গেল । বাড়ি ফিরে রাতে টুবলাকে বিছানায় পাঠিয়ে দিয়েই তার নৈশ-অভিযান শুরু হয় । যেসব ক্ষেত্রে অকালমৃত্যু এই দ্বিতীয়বিবাহ-এষণার কারণ সেই পোষ্টগুলি বার বার দেখে সে । অজানা মানুষের অজানা খাঁখাঁ-ভাব আর নিজের জীবনের এই শূন্যতা নিয়ে খেলায় আসল নকল, অতীত বর্তমান মিশে যেতে থাকল । রুনা কি তাকে নিয়ে পরিপূর্ণ সুখী ছিল ? বিশেষ করে ম্যাসটেকটমির পর, তাদের যৌথ আনন্দের ক্ষণগুলি কতটা স্বতস্ফূর্ত, কতটা পরিকল্পিত প্রেসক্রিপশন মনে করার চেষ্টা করে সে । রুনা কাছে আসতেই চাইত না হক কথা, কিন্তু সে কি চাইত না রাহুল জোর করুক, তাকে কাছে টানুক । প্রতি দশ-বারোটি কিছুই না ঘটে ওঠা দিনে কি আরো অনেক কিছু ঘটতে পারত না ? রুনার ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল না, তার ই-মেল আই ডি-র পাসওয়ার্ড সে জানে না । জানার চেষ্টাও করেনি কখনো কিন্তু রুনা চলে যাবার একবছর পরে সেই অর্থহীন চেষ্টায় তার কিছু বিনিদ্র রাত কাটতে লাগল ।
এইভাবে রোজ রাতে একটা-দেড়টা বাজে, তারপর সে ক্রেজি ঘোড়া, সেক্সি বেবস এরকম কোথাও ঢুকে পড়ে । প্রথমে কিছু সাদাসিধে ছবি । তারপর সব গরম করার বন্দোবস্ত । নেট-এ সব আছে । যেরকম চাও । মানবশরীরের সামান্যতম রহস্যময়তাটুকুও বাকি রাখতে নারাজ । একঘন্টা কেবল কিছু শরীর, কিছু স্তন, কিছু যোনি, কিছু নগ্ন পুরুষ-নারী, বেশির ভাগটাই নারী ।
তারপর যা হবার হয় । নি:শেষ ঢলে পড়া বিছানায় । রুনার কথা তখন সে আর মনে করতে চায় না, অথচ ভেতরে শূন্যতার হাজারদুয়ারি । নিজের ভেতরের দুটো আলাদা মানুষকে না মেলাতে পারার গ্লানি কোন কোন দিন এর পরেও ঘুম এনে দেয় না চোখে । দেরি করে ঘুমোনোর ফলে সকালেও উঠতে দেরি হয়ে যায় । সকালে ঘুমহীন লাল চোখে, চোখের কোলে অপরাধবোধ নিয়ে টুবলাকে তুলতে গিয়ে চেঁচামেচি করে, গাড়ি বের করতে গিয়ে মি: শর্মার সাথে কথা কাটাকাটি । টুবলা এই অচেনা বাবাকে দেখে কুঁকড়ে থাকে । রাত্রে কোনরকমে টুবলার পড়া শেষ হতে না হতেই তাকে প্যাক আপ করিয়ে খেতে বসিয়ে দেয়, সারাদিনে বাবা-মার সঙ্গহীন টুবলা তখন একটু খেলতে চায় পাখা মেলতে চায় কাঁদে বকা খায় ।
অথচ কতবার যে ইচ্ছে করে একবার বিপাশাকে ফোন করে অথবা রিনিকে, রুনার বোনকে । রিনিকে একবার ফোন করেওছিল সে । কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা রিনি তুমি ঠিক জানো রুনার কোন অপূর্ণতা অতৃপ্তি ছিল কিনা । হকচকিয়ে গিয়ে রিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে রাহুলদা, সামনের মাসে মা-বাবা যাওয়া মনস্থ করেছেন মনে হয় টিকেটস এসে যাবে নেক্সট মান্থে । রাহুলও অপ্রতিভ হয়ে নতুন প্রসঙ্গে চলে আসবার চেষ্টা করে, কিন্তু তার অস্বস্তিও লাগে । যদি রিনি উল্টে বলত যে সেটা তো তারই জানবার কথা, তাহলে সে কি বলত উত্তরে ?
রুনার শ্রাদ্ধের দিন নিমন্ত্রিত একজন বর্ষীয়সি বাঙালি মহিলা পিণ্ডদানের সময় বলছিলেন ওই দেখো প্রেতকার্য কিনা, ঠিক কাক এসে গিয়েছে । সেদিন রাহুলের মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল, চটকানো ভাতের আর কলার পিণ্ডি খেতে এমনিতে খুব একটা খারাপ হবার কথা নয়, কাক তো আসবেই । আপনি-আমিও খেতে পারি কিন্তু । যদিও সেসব কথা বলে উঠতে পারেনি, ভদ্রতার খাতিরে । কিন্তু এইরকম অদ্ভুত রাতগুলিতে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যদি ডিয়ার মিস্টার ক্রো ওপারের খবর এনে দেন, এস এম এস একটা নিদেনপক্ষে -- যেরকম তারা বিয়ের পরে বিনিময় করত অফিসে বসে ।
রাহুল অবশ্যই পারে, কিন্তু মেয়েটিকে সে চিনবে কি করে ? দোশি বলছে মেয়েটিকে সে রাহুলের গাড়ির নম্বর জানিয়ে দিচ্ছে এবং তাদের বাড়ির কাছেই যে ম্যাকডোনাল্ডের দোকান ঠিক তার সামনে ওয়েট করতে বলছে ।
মেয়েটি ঠিকই অপেক্ষা করছিল । বয়সটা দেখে ঠিক ট্রেইনি হবার মত মনে হয় না, উনত্রিশ-তিরিশের সাধারণ চেহারা শান্ত চাহনি । গলার স্বরও খুব কুন্ঠিত, মৃদু । রাহুলের মনে হল মাধবীর সঙ্গে বেশিদিন থাকলে এই মেয়ের কি হালত হবে কে জানে ! জিনস এবং টপে সে যে খুব স্বস্তি বোধ করছে তাও মনে হচ্ছিল না । কে জানে আজকের সাজ নিয়ে হয়ত মাধবীই কড়া হুকুম জারি করেছে, যেমন সে করেই থাকে সহকর্মীদের ওপর । জেণ্ডার ইসু নিয়ে, পলিটিকাল কারেক্টনেস নিয়ে পরিবেশ সবকিছু নিয়ে মাধবীর বক্তৃতার থেকে আত্মরক্ষা করতেই তারা অভ্যস্ত ।
রাহুল তাকে সহজ করার জন্য গান চালিয়ে দেয় । এ আর রহমান শুনলে যদি সাবিত্রী সদ্য চেন্নাই থেকে আসা মেয়েটি একটু সহজ-স্বচ্ছন্দ বোধ করে । তাছাড়া সে এখন কথা বলতে চায় না ।
রবিবারের সকাল । অতএব পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগল না । সাড়ে নটায় তারা একদম নতুন, ঝাঁ চকচকে বিজনেস সেন্টারের দরজায় । সেমিনার হলে আই টির কিছু বাচ্চা ছেলে যন্ত্রপাতি সেট করছে । রাহুল তার তদারকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ।
মাধবী এল একটু পরে । এসেই একটা তির্যক চাহনি সো রয় হোয়াট ডিড ইয়ু ডিসকাস অন দি ওয়ে ? নট বিজনেস আই হোপ ? রাহুল তিতিবিরক্ত হয়ে বলে, নাউ মাধবী গেটফ মাই ব্যাক আই হ্যাভ সামথিং ইমর্পট্যান্ট টু ডু ।
মাধবী হাসে । ও ওইরকম । প্রচণ্ড বলবতী খুব দয়ালু কিন্তু খুব উচ্চকিত । পেশাদারিত্বের সীমারেখা ভেঙেই ও কেমন অনায়াসে ঢুকে পড়ে অন্যদের জীবনে । অথচ, ঠিক এইজন্যই কি রুনা এত পছন্দ করত মাধবীকে ? রুনা চলে যাবার ঠিক আধঘন্টার মধ্যে খবর পেয়ে হসপিটালে যে প্রথম এসে পৌঁছেছিল সে মাধবী । তাকে ভাগিয়ে দিলেও রাহুল একবার ভাবে মাধবীকেই জিজ্ঞেস করবে কিনা রুনার শেষ কদিনের মনের অবস্থার কথা ।
প্রেজেনটেশন হয়ে গেল ভালোয় ভালোয় । বেলা এগারোটায় যারা হুইস্কি খেতে পারেন তারা স্বচ্ছন্দে নেমে পড়লেন গাছকোমর বেঁধে । মাধবী আবার কি একটা পানীয় হাতে নিয়ে ফ্রি তে জ্ঞান বিতরণ করে যাচ্ছে নতুন ট্রেইনিদের । বড়-মেজ সায়েবদের দলটা আরেক প্রান্তে পানীয় হাতে কে জানে কোন পাওয়ার গেম-এ মত্ত । রাহুলের কোন দলেই খেজুরে আলাপের ইচ্ছা নেই, কাজেই সে একটা চেয়ার নিয়ে লনের একধারে বসে । লনটা বেশ সুন্দর করে সাজানো । পানীয়র ঢালাও ব্যবস্থা একটা ক্যানোপির নিচে । কিন্তু তাকে নিজে গাড়ি চালিয়ে ফিরতে হবে অতএব সে গুড়ে বালি ।
কিছুক্ষণ পর মাধবী নিজেই এল, তার পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল ।
-- রয়, য়ু আর ওকে ?
-- অ্যাবসোলিউটলি ফাইন মাধবী । হাউ মেনি ব্লাডি মেরিস য়ু হ্যাভ ডাউণ্ড বাই নাউ ? হু ইজ গোইং টু ড্রাইভ য়ু হোম টুডে ?
-- ওহ্ ছোড়ো মেরি বাত । তুমহারা বতাও । ক্যায়সি লগা সাবিত্রী তুমহে ?
-- সো ইট ওঅজ ইয়োর প্ল্যান টু ফিক্স মি আপ উইথ সামওয়ান ?
-- মে বি ।
-- ইন দ্যাট কেস, আই উইল রিকোয়েস্ট ইয়ু টু শেল্ভ দোজ ওল্ড অ্যানড উইয়ার্ড প্ল্যানস, ফর হেভেনস সেক ।
বলতে বলতেই তার একটা অদম্য ইচ্ছা হয় প্রশ্নটা করে ফেলার । করে ফেলেও ।
-- আচ্ছা মাধবী, তোমার কি রুনাকে মনে পড়ে ?
মাধবী ত্যারছা চোখে তাকায় । রাহুল ব্যক্তিগত বিষয়ের আলোচনা যাকে বলে প্রবলভাবে অপছন্দ করে । মাধবী জানে এবং গ্রাহ্য করে না । এটাই চলে আসছে এতদিন ।
-- রয়, আর য়ু আ বিট হাই ? কি খেয়েছ বলত ?
-- না: আয়াম পারফেক্টলি সেন অ্যাণ্ড সোবার--বল না ।
মাধবী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর আস্তে আস্তে বলে --
-- রয়, আই ওঅজ দেয়ার অ্যাট হার বেডসাইড বিফোর দি রেস্ট অভ ইয়োর ফ্যামিলি অ্যারাইভড ফর দি লাস্ট রাইটস ।
-- জানি । কিন্তু তারও আগের কথা বল রুনার সাথে তোমার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল বলে - তুমি সেই জীবিত রুনার কথা বল । মনে পড়ে ।
-- একটা আস্ত মানুষকে ভুলে যাব একবছরের মধ্যে এরকম কি সম্ভব রয় ?
-- তাহলে তুমিই বল একবছরের মধ্যে নতুন কিছু ভাবা কি আমার পক্ষেও সম্ভব ?
মাধবী নিরুত্তর । একটা কাঠবিড়ালি তাদের থেকে ফুট তিনেক দূরে দাঁড়িয়ে । পড়ে থাকা পকোড়ার টুকরোর দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ । কিন্তু সম্ভাব্য মানবিক বিপদ তাকে এগোতে দেয় না । হয়তো ঠিক এই গাছের কোটরেই তার সংসার, তার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় । তুড়ুক শব্দ করে সরে যায় কাঠবিড়ালি । মাধবী গভীর অভিনিবেশে তাকে লক্ষ করে, রাহুলের দিকে না তাকিয়েই বলে,
-- কিন্তু তুমি ঠিক কি জানতে চাইছ ?
-- রুনা কি আমাকে নিয়ে সুখী ছিল ? তোমার কি মনে হয় ?
-- এর উত্তর কি আমি দিতে পারি রয় ? একটা মানুষ দুতিন বছর ধরে কালরোগের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে, ছোট বাচ্চা ও সংসার ফেলে চলে যাবার ডাক আসতে পারে যে কোন দিন । এই অবস্থায় সে স্বামীকে নিয়ে সুখী ছিল কি না আর তা ভাববার অবসর তার ছিল কিনা তা আমি একজন একলা মানুষ স্পিনস্টার হয়ে তা জানব কি করে ? তাছাড়া সেটা জেনেই বা এখন কি হবে ।
রাহুল জানে তা । মাথা নাড়ে ।
মাধবী তখনো কিছু ভাবছে--রাহুল টেল য়ু সামথিং সামটাইমস ইটস জাস্ট ওকে টু ফিল ভালনারেবল । ট্রাস্ট মি ।
রাহুল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় । ওয়াশ রুমের দিকে যায় । ভ্যানিটির আয়নায় নিজেকে দেখে । উত্তর চল্লিশের ভাবলেশহীন মুখখানি কোন তোলপাড়ের হদিশ দেয় না । যবে থেকে রুনার অসুখ ধরা পড়েছে তখন থেকেই যেন যোদ্ধার মত বর্ম-চর্মে নিজেকে মুড়ে নিয়েছে আপাদমস্তক । অনেক সময় রুনা বিছানায় বসে তাকে লক্ষ করে যেত টুবলাকে স্নান করাচ্ছে রাহুল । ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছে রাহুল । তার জন্য ওষুধ বের করে রাখছে রাহুল কথা নেই মুখে । একবার রুনা তাকে বলেছিল তুমি সব কিছু কেমন ম্যানেজ করে নিচ্ছ, আমার কোন চিন্তাই নেই । রাহুলের মনে হয়েছিল রুনা তাকে কি কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছে ? আজকে তার মনে হল কাজ নয় শেষ সময়ে তার হয়ত রুনাকে অন্তত: একবার জানানো উচিত ছিল সে রুনাকে কতটা মিস করবে চোখের জল ফেললে কি টারমিনাল রোগির শুধু কষ্টই হয় ? আয়নায় নিজের মুখ তার কসাই এর মত লাগে । যা এতদিনে হয়নি তাই আজ হল । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রাহুল বাচ্চা ছেলের মত কাঁদে । বন্ধ টয়লেটে ।
কাজেই রাহুল কখন সটকে পড়ল কেউই খেয়াল করেনি । মনে হয় মাতাল হয়ে গেলে কে আছে, আর কেই বা নেই গোছের একটা তুরীয় ব্যাপার ঘটে যায় ।
মিসেস ডি কুনহার সঙ্গে বসে সাস-বহু দেখছিল টুবলা । বাবাকে অসময়ে দেখে অবাক হল । যখন রাহুল তাকে বলল, টুবলা চল আজকেই তারে জমীন পর্ দেখে নিই, তখন তার মুখটা উজ্জ্বল হল আরেকটু । বাড়ি ফিরে রাহুলের আরো একটা কাজ আছে আজ, বিপাশা-যুধাজিত্কে অনেকদিন পর আবার ফোন করা । যেটুকু-যা তার আছে সেটুকু যেন কোথাও না হারায় ।
***ব্যবহৃত কবিতাংশটি শ্রদ্ধেয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে উদ্ধৃত ।
(পরবাস-৪২, ডিসেম্বর, ২০০৮)