• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪২ | ডিসেম্বর ২০০৮ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • নাম বদল : অনন্যা দাস

    ইদানীং অভিলাসার একটা সমস্যা হয়েছে । নিজের নামটা ওর আর তেমন পছন্দ হচ্ছে না !

    অভিলাসা পেনসিলভানিয়ার হ্যারিসবার্গ শহরে সেন্ট্রাল ডৌফিন প্রাইমারি স্কুলে ফোর্থ গ্রেড এ পড়ে । কিছু মাস হল মা-বাবার সাথে ভারত থেকে আমেরিকায় এসেছে ও । প্রথম প্রথম থার্ড গ্রেড এর ক্লাসে বেশ অসুবিধে হত কিন্তু এখন আর হয় না । আগে যেভাবে বলা কথাগুলো ওর বুঝতে অসুবিধে হত এখন ও নিজেই সেইভাবে কথা বলে । অনেক বন্ধুও হয়ে গেছে ওর । ওর সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু নর্মা । তার সাথেই ওর যত প্রাণের কথা । তাই নর্মাকেই প্রথম কথাটা জানালো অভিলাসা ।

    "নর্মা, আমি ঠিক করেছি আমার নামটা পাল্টে ফেলবো !"

    "সত্যি ! কিন্তু কেন ?"

    "আমার নামটাকে কেউ এখানে ঠিক করে বলতে পারে না, উল্টে খেপায় । কালকে সারাদিন ধরে বিল আমাকে লাসা লাসা বলেছে । যে নামকে ওই রকম খারাপ করে দেওয়া যায় সেই নাম রেখে কোনও লাভ নেই !"

    "তাহলে কি নামে ডাকবো তোমায় ?" নর্মা জিজ্ঞেস করল ।

    "সেটাই ভাবছি । তুমি সাহায্য করবে ?"

    "সিওর ! আমার মাসির নাম রবিন, সেটা চলবে ?"

    "নামটা ভালোই, তবে মাসির নাম আর বন্ধুর নাম এক হলে তোমার কনফিউসন হবে । অন্য নাম বলো ।"

    "বেথ, মেগান বা শারলি কি রকম ?"

    "উঁহু, চলবে না । ওই নামগুলো আমাদের ক্লাসে অলরেডি রয়েছে । মেগান তো আবার দুখানা ! না একই নাম এক গাদা করে লাভ নেই । আরো ভাবতে হবে ।"

    এমনি করে জ্যানিস, ট্যামি, পাম সব-ই কোন না কোন কারণে বাতিল হয়ে গেল ।

    হঠাৎ অভিলাসা লাফিয়ে উট:লো, "পেয়েছি !"

    নর্মা বই থেকে নাম খুঁজতে খুঁজতে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, চিত্কার শুনে ধড়াম করে উঠে জিজ্ঞেস করল, "কি ?"

    "সিয়েনা ! নামটা সুন্দর না ?"

    "আমাদের থার্ড গ্রেডের টিচার এরই তো নাম ছিল সিয়েনা উইলসন, তাই না ?"

    "হ্যাঁ, কিন্তু উনি তো আমাদের স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে টেক্সাস চলে গেছেন, তাই ওনার নাম নিতে কোনও আপত্তি নেই, কি বলো ?"

    নর্মা একটু ভেবে বললো, "না, তা নেই । তাহলে কি আজ থেকে আমি তোমায় সিয়েনা বলে ডাকব ?"

    অভিলাসার চোখ মুখ খুশিতে চকচক করছে, বললো, "হ্যাঁ ।"

    তারপরের দুদিনে মোটামুটি ক্লাসের সকলে জেনে গেল যে অভিলাসার নতুন নাম সিয়েনা । টিচারদের কানে কথা যেতেই বাড়িতে ফোন গেল ।

    স্কুল থেকে ফিরে অভি দেখলো মা'র মুখ আঁধার । ও যখন খাচ্ছে তখন মা বললো, "শুনলাম তুমি নাকি নাম বদল করেছো ?"

    অভি খেতে খেতে শুধু বললো, "হ্যাঁ ।"

    "কিন্তু কেন ? অভিলাসা নামটা তোমার ঠাকুমা কত শখ করে দিয়েছিলেন !"

    "ওই অত বড় কমপ্লিকেটেড নাম আমার গ্রেডের কেউ বলতে পারে না, উল্টোপাল্টা নামে ডাকে, বাজে শোনায় তাই আমি এখন থেকে `সিয়েনা' ।"

    "সিয়েনা !" মা যেন আকাশ থেকে পড়ল, "সিয়েনা তো গাড়ির একটা মডেল ! এডেল-এর বাবা টয়োটা সিয়েনা চালায় না ?"

    এই যা ! সেটা তো মনে ছিল না ! যাকগে কি আর হবে ? নামটা তো সবাইকে বলে দেওয়া হয়ে গেছে । বার বার নাম পাল্টালে আবার লোকে হাসাহাসি করবে । তাই মাকে বলল, "গাড়ির নাম তো কি হয়েছে ? গাড়ির নাম বলে কি আর মানুষের নাম হতে পারে না ? ওই নামটা তো আর লোকে বিকৃত করে বলছে না তাই নিতে আপত্তি কোথায় ?"

    অভিকে অনেক বুঝিয়েও যখন কোনও ফল হল না মা তখন মধুরিমার মাসিকে ফোন করল । মধুরিমার মাসি আর্টিস্ট, দারুণ ছবি আঁকে । অভির সাথে তার খুব ভাব । মাসি প্রায়ই উইকেণ্ডে আসে, তখন খুব মজা হয় - বেড়াতে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া, গল্পগুজব । মাসি মা'র কাছে সব শুনে বললো, "ও এই ব্যাপার । ঠিক আছে আমি শুক্রবার যাচ্ছি ।"

    শুক্রবারদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে অভি দেখল মধুরিমার মাসি এসেছে । দেখে ওর ভারি আনন্দ হল । দিনটা ওর মোটেই ভাল কাটেনি ! ওকে সিয়েনা নামে ডাকতে ও বেশ কয়েকবার জবাব দেয়নি । আসলে ওটা যে ওর নাম সেটাই ও ভুলে গিয়েছিল ! আরো কয়েকদিনে নিশ্চয়ই অভ্যাস হয়ে যাবে । যাই হোক, মাসি এসেছে এবার মজা হবে ।

    মধুরিমার মাসি আবার কি একটা আঁকছে । অভি গিয়ে দেখল সারা কাগজ জুড়ে কি একটা খয়েরি মতন রঙ ।

    "এটা কি মাসি ?"

    "ওমা তাও জানো না বুঝি ? এটা সিয়েনা ।"

    চমকে উঠল অভি, "মানে ?"

    "দুর বোকা সিয়েনা তো একটা রঙ । তোর পছন্দ বলে আঁকছি । ভাল লাগছে না ?"

    অভি মাথা নেড়ে `হ্যাঁ' বলল কিন্তু ওই খয়েরি রঙটা ওর মোটেই ভাল লাগে না !

    মাসি কেক এনেছে । মা ওকে এক টুকরো দিল । অভি সেটা খাচ্ছে দেখে মাসি বলল, "ওমা তুই পিত্জাটা খাচ্ছিস দেখেছি । কেমন ? ভাল খেতে ?"

    অভি হেসে বলল, "ধ্যাৎ ! এটা আবার পিত্জা নাকি, এটা তো কেক !"

    মাসি একটা দুষ্টু হাসি হাসল, "বা রে ! তোকে যদি অভিলাসা না বলে সিয়েনা বলতে পারি তাহলে কেককে কেন পিত্জা বলতে পারবো না ? এমনিতেও ওই কেক নামটা আমার পছন্দ নয় !"

    অভি বুঝিয়ে বলল, "তুমি যদি কেককে পিত্জা বল তাহলে তো লোকে ভাববে তুমি পিত্জার কথা বলছো কেকের কথা বলছো কেউ বুঝতেই পারবে না ।"

    মাসি পাল্টা উত্তর দিল, "আর আমি যদি এখন ইণ্ডিয়াতে তোর দাদু ঠাম্মাকে ফোন করে সিয়েনার কথা বলি তারা কি বুঝবে যে আমি অভিলাসার কথা বলছি ? আর তিতির ? তিতির এর কথা ভুলে গেলি ? ও কি সিয়েনাকে চিনবে ?"

    তিতির অভিলাসার মাসতুতো বোন । দুজনের ভীষণ ভাব ছিল । তিতিরের কথা ভাবতেই অভির মনটা কেমন করে উঠলো ।

    মাসি ব্যাগ থেকে দুটো বই বার করে বলল, "এই দেখ । কে লিখেছে নামটা পড়তে পারছিস ?"

    "হ্যাঁ, ঝুম্পা লাহিড়ি !"

    "উনি একজন বিখ্যাত লেখিকা । এখানেই থাকেন কিন্তু ওই ঝুম্পা নামে পরিচিত হতে ওনার কোনও আপত্তি হয়নি । আরো দেখবি, এই নে..."

    "চিত্র বান... আর পড়তে পারছি না ।"

    "চিত্রা ব্যানার্জি দিভাকারুনি -- সব কত ভারতীয় নাম কিন্তু এদেশেই থাকেন । ওনারও বই সারা বিশ্ব জুড়ে বিক্রি হয় । বিখ্যাত হলে তুই নিজের নামেই বিখ্যাত হবি, থার্ড গ্রেডের টিচারের কাছ থেকে ধার করা নামের দরকার হবে না ! তোর ক্লাসের অন্য ছেলে মেয়েরা যদি তোর নাম বিকৃত করে তাহলে তুই শুধরে দিবি । বলবি এইভাবে বলবে । দেখবি ঠিক শিখে যাবে ।"

    সোমবারদিন স্কুলে গিয়ে অভি সবাইকে বলে দিল, "আমি অভিলাসা । আমাকে অভিলাসা বলেই ডাকবে ।"

    নর্মা শুনে বললো, "বাঁচা গেল । আমি তো অর্ধেক সময়ে সিয়েনা বলে ডাকতে ভুলেই যাচ্ছিলাম আর ভয় পাচ্ছিলাম যে তুমি রাগ করবে !"

    ক্লাসে একটা নতুন মেয়ে এসেছে । টিচার সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, "তোমাদের গ্রেডে নতুন এসেছে আজ থেকে । এভরিওয়ান মিট সিয়েনা ব্রাউন !"

    (পরবাস-৪২, ডিসেম্বর, ২০০৮ )

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments