সুবোধ ঘোষের সঙ্গে আমার প্রথম চেনা যে ছোট গল্পটির হাত ধরে, সেটি কিন্তু ওঁর কোন বিখ্যাত গল্প নয় । গল্পটির নাম `মা হিংসী:' - একজন সাধারণ মাপের মানুষ, একজন খুনের আসামীর এলোমেলো অর্থহীন জীবনের কাহিনী । ছোট ছোট অনেকগুলো নিপুণ মুহূর্ত ... দায়রা জজ, অ্যাসেসর, আসামী গিরধারী গোপ, কাঠের খাঁচায় আসামীর ডক, আদালতকক্ষের ঝালর-লাগানো প্রকাণ্ড পাখা... কোমরে দড়ি, হাতে হাতকড়া, আগুপিছু প্রহরী... ফাঁসির আসামী গিরধারী গোপের মুক্তির দূত হয়ে আসবে স্ত্রী রাধিয়া... সে স্বামীকে ফাঁসির দড়ি থেকে মুক্তি দেবে.. বিষের হালুয়া নিয়ে এসে... ফাঁসির মৃত্যুর অসম্মান থেকে গিরধারীর অন্তরাত্মাকে উদ্ধার করাই রাধিয়ার একমাত্র ইচ্ছে । অতি নগণ্য সে খাবার রাধিয়া স্বামীর কাছে পৌঁছে দিতে অপারগ হল.. সেই মুহূর্তেই গিরধারীর অন্তরাত্মার মৃত্যু হল । ফাঁসি হবার আগেই । গল্পের নামে হিংসা, গল্পের বুনটে খুন-আসামী-কয়েদ-ফাঁসি, তবু শেষ পর্যন্ত এ এক অপরূপ সুন্দর ভালোবাসার গল্প । আমার পাঠক মন তৃপ্ত .. বিষণ্ণ .. অপার্থিব এক মুক্তির আলোয় আলোকিত ।
সেই থেকে আমি সুবোধ ঘোষের লেখার ভক্ত, মুগ্ধ পাঠক । বারবার পড়ি । প্রতিবারের পঠনে মুক্তির নতুন দিগন্ত খুঁজে পাই । বাংলা ছোটগল্পের জগতে বিস্ময়ের অন্য নাম সুবোধ ঘোষ ।
তাঁর দুটি বিখ্যাত গল্প `অযান্ত্রিক' এবং `ফসিল' নিয়ে বাঙালি-অবাঙালি উভয় পাঠকমহলেই চরম আগ্রহ, সে দুটির আলোচনার পুনরাবৃত্তি না করেই আরও অনেক ছোটগল্পের নাম করা যায়, যারা একে অন্যকে ছাপিয়ে উঠেছে । প্রত্যেকটি যেন উত্তাল সমুদ্রের নতুন ঢেউ । `সুন্দরম্', `পরশুরামের কুঠার', `গোত্রান্তর', `জতুগৃহ', `বারবধূ', `অলীক', `ঠগিনী', `শ্মশানচাঁপা' .. জীবন ও জীবিকার বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ের ছবি ।
`তিন অধ্যায়'-এর অহিভূষণ... লেখাপড়ায় ফোর্থ ক্লাসের চৌকাঠ পার হয়নি, মিউনিসিপ্যালিটির সর্দার স্ক্যাভেঞ্জার হয়ে নোংরা খাকি হাফপ্যান্ট পরনে শ্মশানের চড়ায় নেমে চিতা গুনে আসে, ময়লা ময়দানের মাঝে দাঁড়িয়ে ট্রেঞ্চ কাটায়, শহরের সব নালা নর্দমার পাশে বসে মেরামত করে । সেই অহিভূষণের ভদ্রলোক হবার প্রবল আকাঙ্খায় মজা পায় তার এককালের বন্ধুরাই, তারা আজ পেশাগতভাবে সমাজের প্রতিষ্ঠিত কৃতি মানুষ । আছেন পুলিনবাবু আর তাঁর মেয়ে বন্দনা । বন্দনা হাসপাতালে কি একটা কাজ করে, ভদ্রলোকের সংস্কার অমান্য করে জীবিকা অর্জন করে । আর তার বাবা পুলিনবাবু পেশার কারণে সমাজের ভদ্রলোকদের কাছে শুধুই একজন `চামার' ।
একজন ভদ্রলোক স্কুলমাস্টারের মেয়ের সঙ্গে অহিভূষণের বিয়ে ভেঙে দিতে বাধ্য হন ভদ্রলোক বন্ধুরা, সমাজকে অনিয়ম থেকে রক্ষার দায়ে ... তেমন করেই `হাসপাতালের জমাদারনী' মেয়ে বন্দনার ভদ্র পরিবারে বিয়ের সম্বন্ধটাও সমাজ ক্ষমা করতে পারে না, শীল আর আচারের প্রশ্নে । সর্দার স্ক্যাভেঞ্জার অহিভূষণ, চামার পুলিনবাবু, জমাদারনী বন্দনার সমাজের ভদ্রলোকদের রুচিশীল জীবনের আসরে ও বাসরে আর জায়গা হয় না । সমাজের ভদ্রলোকরা নিজেদের পিঠ চাপড়ে বলেন, `কোনো অন্যায় করি নি আমরা, ওদের কোনো ক্ষতি করি নি, ওদের জীবিকাই ওদের কালচার নষ্ট করেছে । ওরা যা ওরা তাই । আমরা শুধু নিজেদের বাঁচিয়েছি ।'
বাস্তব সমাজের এমন নিপুণ ছবি দেখে বুকের মধ্যে টনটন করে, পাঠক আমি নিজেকে অসহায়তার ঘেরাটোপে বন্ধ করে ফেলি, ঠিক যেমন করে চোখ বন্ধ করি সমাজের অন্য অত্যাচারগুলো দেখে ।
গল্পের তৃতীয় অধ্যায়ে অদ্ভূত অপরূপ এক আলো । অহিভূষণের সঙ্গে বন্দনার বিয়ে । আর সে নরম আলো আকাশ বাতাস হয়ে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে, যখন দেখি সে বিয়ের আসরে সব পুরোনো বন্ধুরাই হাজির... যারা ভদ্রলোক হওয়ার তাগিদে অন্যায় করতে বাধ্য হয়েছিল, আজ এ বিয়ের আসরে উপস্থিত হয়ে নিজেদের অপরাধী ভূমিকার মুখোমুখি হয়ে উত্তরণের পথের যাত্রী ।
আমার বুকের মধ্যে টলটল করে ওঠে, এ আবেগ আমাকে চিনিয়ে দেন যে লেখক, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় নত হই ।
উত্তরণের এই মন্ত্র সব গল্পে । প্রতিটি গল্পের উপাদান মানুষ; যথা অর্থের `মানুষ' । প্রতিটি গল্প উত্তরণের গল্প ; মনুষ্যত্বে উত্তরণের বার্তা । সে `পরিপূর্ণার' জয়ন্তী হোক, `খদ্যোত'-এর নীরজা কিংবা `সায়ন্তনীর' অনিরুদ্ধ । চোখ দিয়ে আমরা যেটুকু দেখি, সেই দেখাটাই সব নয় যে । `তাকানো' আর `দেখা' দুটি পৃথক শব্দ । অন্তরের দৃষ্টিতে প্রতিটি মানুষ অসামান্য, অপূর্ব, বিশিষ্ট ; সুবোধ ঘোষের লেখায় আমরা `দেখা' শিখি, অনুভব করতে শিখি, নিজেকে চিনতেও শিখি ।
`সাধ না মিটিল'-র কালীচরণ আর সনাতনীর ঘর, চিরকালের ঝগড়ার ঘর সংসার । বেশি কিছু নয়, সনাতনীর দাবী সামান্য, শুধু সোনার একজোড়া দুল । এই দাবীর বয়সটাও কম নয়, প্রায় কুড়ি বছর । দিতে পারেনি কালীচরণ । অনেক চেষ্টায়, অনেক খেটে আর ভাত-কাপড়ের দাবী অনেক কাটাছাঁটা করে মাঝে মাঝে বড় জোর দশ বারো টাকা জমেছে, তারপরেই একটা না একটা অঘটন, একটা অসুখ, অথবা ভাঙাঘরের চালা সারাতেই সে টাকা শেষ হয়ে গেছে । সে দিনটা সনাতনীর মুখে হাসি ফুটবার দিন । ময়দানে মশলামুড়ি বিক্রী করতে গিয়ে সবুজ ঘাসের ওপর সত্যি সোনার একটা দুল পেয়েছিল কালীচরণ । একজোড়া নয়, একটা দুল । স্বপ্ন দেখে স্বামী-স্ত্রী, আর গোটা পনেরো টাকা জোগাড় হলেই মাধব স্যাকরাকে দিয়ে আর একটা দুল গড়িয়ে নেওয়া যাবে । কিন্তু সে সাধ মেটে না সনাতনীর । কারণ মোক্ষম সময়ে জানতে পারা গেল যে, রমেশ মিস্ত্রীর মা-মরা মেয়েটার হারিয়ে যাওয়া দুল সেটা - সেই মেয়েটার আজ বিয়ে, মায়ের দুলজোড়া কানে দিয়ে বিয়ে হোক, এইটুকু চেয়েছিল রমেশ - ময়দানে মনের ভুলে সে দুল হারিয়ে এসেছে । অভাবী নির্ধন, অথচ অন্তরের ঐশ্বর্যে ধনী কালীচরণ সে দুল ফেরত দিয়ে আসতে দ্বিধা করে না, সনাতনী কেঁদে আকুল হয়, কিন্তু তারপর সুন্দর শান্ত হয়ে সাধ না মেটার কষ্ট মেনে নিয়ে রমেশ মিস্ত্রীর মেয়ের মুখখানা দেখার জন্যে ব্যস্ত হয় ।
অপরূপ ব্যঞ্জনা, পড়তে পড়তে পাঠক আমিও `মানুষ' হয়ে উঠি ।
`দণ্ডমুণ্ড'-এর অনুকূল গোঁসাইও এই মন্ত্রেই বুঝি জাতপাতের অনেক ওপর উঠে `মানুষ' হয়ে উত্তীর্ণ হয় । `পক্ষিতত্ত্বে'র মহেশবাবুর আবার মানুষজন্মে স্পৃহা নেই । তাঁর সিদ্ধান্ত, `পাখিরাই সুখী, কারণ পাখিদের মেয়ের বিয়ের জন্যে চিন্তা করতে হয় না' ... একটি মুখের কথায় সামাজিক একটি সমস্যার করুণ প্রকাশ । মানুষ জন্ম হলেই `মানুষ' হয়ে উঠতে পারলে সমাজের ছবিটাই বদলে যেত ।
`শুক্লাভিসার'-এর দেবল ত্রিপাঠী... কলের চিম্কি কলোনি, বোম্বাইয়ের দাদার.. আর বরুত্রী । নরনারীর মিলন প্রণয়ের নতুন রাখী - `সঙ্কল্প' । সংসারে মানুষই মহাপুরুষ হয়ে ওঠে, সেই গল্প । আবার এ এক গভীর ভালোবাসার গল্পও । সমস্ত লেখকজীবন ধরে কত ভালোবাসার ছবিই না এঁকেছেন লেখক ।
ছোট ছোট অসংখ্য গল্প, ছোট ছোট অসংখ্য চরিত্র । জীবনপথের নানা বাঁকে আমাদের সঙ্গেও দেখা হয় এমন কত মানুষের । নিপুণ পর্যবেক্ষণে সেই সব মানুষকে মনে রাখেন কথাশিল্পী সুবোধ ঘোষ, গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে সমৃদ্ধি হয় পাঠকমনের ।
লেখকের বর্ণময় জীবনকথা টানটান গল্পের মতই আকর্ষক । জন্ম হাজারিবাগে, পড়াশোনা শেষ করে জীবিকা-উপার্জন শুরু করেন বাস-কণ্ডাক্টর হয়ে । এক সার্কাস কোম্পানিতে ক্লাউন হিসেবে চাকরি করেন কিছুদিন । মুম্বই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের জমাদার হিসেবেও কাজ করেন কিছুদিন । তারপর পাড়ি দেন পূর্ব-আফ্রিকায়, ঠিকাদারি শ্রমিক হিসেবে । মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এ সময়ই । এই সূত্র ধরে হাজতবাসের অভিজ্ঞতা । মহাত্মার সঙ্গী হয়ে নোয়াখালির দাঙ্গার সাক্ষী হন, চীন-ভারত যুদ্ধের সাক্ষী থাকেন উত্তরপূর্ব ফ্রন্টিয়ার এজেন্সির করেসপণ্ডেন্ট হয়ে । তিরিশের দশকের শেষদিকে আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ত্রক্রমে রবিবাসরীয় বিভাগের সিনিয়র সম্পাদক হন । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে `জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করা হয় ।
গল্প লেখার শুরুটা হঠাতি । একটি ঘরোয়া সাহিত্যবাসরে বন্ধুরা স্বরচিত গল্প পড়ার অনুরোধ জানান । এই উপলক্ষে জীবনের প্রথম গল্পটি লেখা । `অযান্ত্রিক'; একজন ট্যাক্সিচালক ও তার বাতিল হয়ে যাওয়া ট্যাক্সির প্রতি ভালোবাসার গল্প । স্বনামধন্য চিত্র-পরিচালক ঋত্বিক ঘটক এই গল্পটি নিয়ে কালজয়ী সিনেমা তৈরি করে গল্পটিকে অমর করে রেখে গেছেন । বিখ্যাত চিত্রপরিচালকদের মধ্যে বিমল রায়, গুলজার, তপন সিন্হাও সুবোধ ঘোষের গল্প নিয়ে কালজয়ী সিনেমার ছবি তৈরি করেছেন ।
এর পরের গল্পটিই `ফসিল' । রাতারাতি বিখ্যাত সুবোধ ঘোষ । ছোটগল্পের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিলেন তিনি । বিষয় ও বৈচিত্র্যে নিত্য নতুন গল্প । পাঠকরা তাঁকে ভালবেসে বরণ করলেন, সমালোচকরা বন্দনা জানালেন, অনুজ লেখকরা প্রেরণার আসনে বসালেন । অনেকেই লেখেন, কিন্তু পাঠকপ্রিয় হয়ে থাকার পাশাপাশি লেখকদের লেখক হয়ে থাকার দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী এই সাহিত্যিক ।
বাঙালি পাঠকের কাছে সুবোধ ঘোষ আর `ভারত প্রেমকথা' প্রায় সমার্থক শব্দ । পৃথিবীর অমর প্রেমকথাগুলোকে এক অনবদ্য ক্লাসিক সুরে গেয়েছেন তিনি, পড়তে পড়তে পাঠক তন্ময় হয়ে ওঠেন । মহাভারতের চরিত্ররা তাঁর কলমে জীবন্ত হয়ে ওঠে ।
তাঁর `কিংবদন্তীর দেশে' সেইরকমই লোককথা ও উপকথা থেকে নেওয়া গল্পের সঙ্কলন । আদিবাসী জীবনের অন্তরঙ্গ ছবি পাই তাঁর লেখায় । একইসঙ্গে লিখেছেন `ভারতীয় ফৌজের ইতিহাস' বা `অমৃতপথযাত্রী'-র মতো গবেষণাধর্মী লেখাও । ছোটগল্পের সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলেছেন একের পর এক উপন্যাস : `তিলাঞ্জলি', `গঙ্গোত্রী', `ত্রিযামা', `সুজাতা', `শুন বরনারী', `বসন্ততিলক', `জিয়া ভরলি', `বাগদত্তা', `রূপসাগর', `বর্ণালী', `বন্ধু গোলাপ', `এসো পথিক' - এমন অনেক উপন্যাস ।
গল্পকে গল্প করে বলা, সেইসঙ্গে শিল্পের স্বচ্ছতম গুণটিকে ধরে রাখা - এই অনায়াস সিদ্ধিতে সুবোধ ঘোষ কথার জাদুকর । বস্তুত, বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে সুবোধ ঘোষের আসনটি সুচিহ্নিত । লেখকজীবনের সুচনাকাল থেকেই তিনি স্বমহিম । লেখক সারাজীবন তাঁর নিজের রচনার ভিতর দিয়ে পরোক্ষে প্রত্যক্ষে নিজের কথাই বলেন । কখনও স্ববেশে, কখনও ছদ্মবেশের তাঁর রচনার মধ্যে তিনি উপস্থিত থাকেন । সুবোধ ঘোষের ছোটগল্পগুলো পড়তে গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির বিপুল ঐশ্বর্য দেখে বারবার মুগ্ধ হই । এমন পাঠপরিক্রমায় আনন্দ আছে, সে আনন্দ বুকের গভীরে বাজে ।
নরেন্দ্রনাথ মিত্র একবার লিখেছিলেন, `কয়েকটি নরনারীর ক্ষণিকের সুখদু:খ হাসিকান্নায় গড়া একেকটি গল্প যেন একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ । এক গল্পের সঙ্গে আর এক গল্পের পাত্রপাত্রীর কোনো মিল নেই, আলাপ-পরিচয় নেই, তারা কেউ কাউকে চেনে না । প্রত্যেকটি গল্প লেখকের একই মনোভূমির ফসল বটে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর । তারা লেখকের ভিন্ন ভিন্ন মুহূর্তের অভিজ্ঞতা উপলব্ধির প্রকাশ । মিল নেই যেমন, তেমনি মিল আছেও । তারা একই ক্ষুদ্র অপরিসর পরিচিত পৃথিবীর বাসিন্দা । একই ধরনের সুখ-দু:খ আশা-নিরাশা নিন্দা-খ্যাতিতে আন্দোলিত । তারা একই তরঙ্গসূত্রে বাঁধা ।' (`বিনি সুতোর মালা' - নরেন্দ্রনাথ মিত্র)
সুবোধ ঘোষ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এ কথাগুলো মনে এল । কখনও স্ববেশে কখনও ছদ্মবেশে এমন কত উপলব্ধির কথাই না লিখেছেন তিনি । প্রীতির কথা, বন্ধুত্বের কথা, ভালোবাসার কথার সঙ্গে সঙ্গে দ্বেষ-বিদ্বেষ-ক্ষুদ্রতা-বিফলতার কথা, জাতে প্রকৃতিতে গাঢ়তায় গভীরতায় মানবমনের নানা স্তরের নানা উপলব্ধির কথা । অমর এই কথাশিল্পী বাকসিদ্ধ মহাপুরুষের মতো সব ছবি থেকে উত্তরণের ছবি এঁকেছেন ।
`কালাগুরু' গল্পের ইণ্ডোলজিস্ট টেনব্রুক সাহেবের অগাধ পাণ্ডিত্য, ভারত নামে দেশটার সংস্কৃতির নিগুঢ় তত্ত্বের জ্ঞান আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হবার গর্ব । সেই গর্ব অস্তগামী সূর্যের মতই নিষ্প্রভ হয়ে ওঠে নয়া জমানার সূর্যরশ্মির সঙ্গে সঙ্গে, সমস্ত `হিন্দুস্থানী ভাইবোনেরা' যেদিন নবজাগরণের মন্ত্রে জেগে ওঠে, সেদিন টেনব্রুক সাহেবকে হার মানতে হয় ভারতের আত্মার ছবি বলাইয়ের কাছে । এই সেই বলাই যে ছোট থেকে তোতাপাখির মত আবৃত্তি করতে শিখেছে, `আমি যীশুর ছোট মেষ', টেনব্রুক সাহেবেরই রচিত গান । এক `অশান্ত দুষ্টু ফকির গান্ধী'-র কথা জেনেছেন টেনব্রুক সাহেব, বলাইদের জেগে ওঠা যে আটকানো যাবে না তা বুঝেছেন । মাথায় ব্যাণ্ডেজ কোমরে দড়ি হাতে হাতকড়া বলাই প্রভাত-সূর্যের সব আলোটুকু ধারণ করে উঠে দাঁড়ায় - এই ছবিটায় আমরা সাক্ষী হই সেই দুর্লভ পরম মুহূর্তের - ভারতের আত্মার জাগরণের, ভারতমাতার মুক্তির লড়াইয়ের সেই ক্ষণটির ।
`দেবতারে প্রিয় করি' গল্পের সনাতনবাবু সংসার যেন মন কেড়ে না নেয় এই ভাবনা থেকেই মায়া-উদ্বেগ-চিন্তার আবেগ থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে নারায়ণের পূজায় সমর্পণ করেছেন । ফুলের মতো কচি টুকটুকে নাতির দুষ্টুমি ও চাঞ্চল্যে বিরক্তি আসে, সংসারের দিকে আকর্ষণের ভয়ে জোর করে অবহেলা করেন তাকে । তিনবছরের নাতি ধুলো মুঠি করে খেলা করে, সনাতনবাবু বিরক্ত হন - এ কি উপদ্রব ! বিধাতার অকরুণ মায়ায় অবোধ শিশু একদিন অসময়ে অচিন পথের যাত্রী হয় । কি যে হল তারপর ! সনাতনবাবু উপদ্রব থেকে মুক্তি পেয়েও শান্ত হন না যে । `নারায়ণ' ডাকের সঙ্গে সঙ্গেই দেখেন বকুলগাছের নিচে ধুলোমুঠি এক শিশু, সেই শিশুর মুখে দেবতার মূর্তি ফুটে ওঠে । শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মে, বৈজয়ন্তী মালা-কৌস্তভ মণিতে শোভিত দেবতা ।
মনের কারবারী লেখক, মন নিয়েই কত গল্প । ভাবনায় পড়ি, মানুষ যে ঠিক কি চায় । যা পাই তা ভুল করে পাই, যা পাই তা চাই না ।
`সুজাতা' - আলাদাভাবে বাংলা ও হিন্দিতে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল । ছোটগল্প `আত্মজা' নামে লেখা গল্পটি উপন্যাসের নাম `সুজাতা' ; জাতপাতের ওপরে ওঠা মানবমনের জয়ের গল্প ।
`কান্তিধারা'য় অবনীশ আর শীলা, `বন্ধু গোলাপ'-এর সুধা আর মণীশ, `দুই গন্ধর্ব'-এর রানু আর মানিক ভালোবাসার সেই সুরটি শোনায় বারবার, যে সুরে শালবন ঝরনা পাহাড়ে বাতাস বয় আর ফুলের সুবাসে রাক্ষুসে উপকথাগুলো রূপকথা হয়ে ওঠে ।
`এসো পথিক'-এর লোকনাথ রায়ের হাত ধরে মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাস ফিরে আসে, `বসন্ততিলক'-এর আত্রেয়ী-হেমন্তের হাত ধরে সেই মূল্যবোধ আর আদর্শ সঙ্গীত হয়ে মরমে পরশ দেয় ।
`জিয়া ভরলি' - ভারত-চীন সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে নেফা ও আসামের জীবন ও কাল নিয়ে লেখা অপরূপ উপন্যাস ।
`রূপসাগর'-এর পিছল ঘাটের কথা গান গেয়ে শুনিয়ে যায় নন্দাবাউল, সেই পিছল ঘাটে নেমে পড়েও নিশীথ আর প্রতিভা উঠে আসে, হাত ধরে তুলে আনে নীরাজিতা আর বিভূতিকেও । রাজপোখরা, মানভূমের লালমাটির প্রকৃতি আর মানুষের গল্প ।
`বর্ণালী'র অশেষের হাত ধরে অলকা একদিন অনুভব করে, স্বাতী-তারকা রাগ করে চোখের জল ফেলে কিন্তু সেই জল ঝিনুকের বুকের ভেতরে গিয়ে মুক্তো হয়ে যায় । সেই অনুভবে আমার মনটিও নাড়া দেয় । সংসারে জীবনে যাই ঘটুক না কেন, যত অসম্মান যত আশঙ্কা, সবই স্থিতধী হয়ে গ্রহণ করার মন্ত্র উচ্চারণ করি আমি - এই বিশ্বাসে যে তা একদিন বুকের মধ্যে মুক্তো হয়ে উঠবে ।
মাত্র দু-চারটি ছোটগল্প বা উপন্যাসের নাম লেখা হল । কেতকী কুশারী ডাইসন একটি রুশ কবিতার অনুবাদে লিখেছিলেন, `একই বইয়ের মধ্যে কি দুবার পা ফেলেছে কেউ ?' সুবোধ ঘোষের গল্প-উপন্যাস সম্পর্কে এই কথাটি চমত্কারভাবে প্রযোজ্য । (`ভাবনার ভাস্কর্য' - কেতকী কুশারী ডাইসন)
সুবোধ ঘোষের গল্পগুলো এমনই জীবন্ত যে সর্বদাই ভয় হয় যে-সময়ে বইটাকে পড়া হচ্ছে না সেই ফাঁকে সেটা বদলে গেছে, সরে গেছে নদীর মতো ; যখন পাঠক তার জীবন নিয়ে ব্যস্ত তখন এই গল্প-উপন্যাসগুলোও তাদের নিজেদের জীবন নিয়ে নদীর মতো করেই এগিয়ে যায় । অনেকদিন পর আবার যখন তাদের নিয়ে বসি, পলকে তারা জীবন্ত হয়ে উঠে আমার সযত্ন-লালিত আবেগ আর উপলব্ধি ধরে নাড়া দেয় । পাঠক-আমি বারবার একই নদীতে পা ফেলতে ফিরে ফিরে আসি । মাত্র দু-চারটি গল্প-উপন্যাসের উল্লেখে কি সে অনুভূতি প্রকাশ করা যায় ?
পড়তে পড়তে বারবার দেখি, সৃষ্টির কাজে তিনি কখনও পাঁকে নামেন, কখনও খাদে, দাগী-পাপী-পতিত-পীড়িত মানুষের জীবনসঙ্গী হন কখনও বা । কখনও যুদ্ধ-আন্দোলনের রক্ততরল আবর্তে ঘোরেন, কখনও বেচাকেনার চতুর বাজারে হাজির থাকেন, কখনও হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর খেলার সাক্ষী হন, কখনও বা রাজনীতির নোংরা সভায় উপস্থিত থাকেন । যেখানে মানুষ, সেখানেই লেখক সুবোধ ঘোষ উপস্থিত ।
আবার দেখি, প্রতি লেখায় মানুষের কোলাহলেও প্রকৃতি তাঁর সঙ্গিনী - লেখায় তিনি মানুষকেও এড়িয়ে চলেন না, এড়িয়ে চলেন না প্রকৃতিকেও । নিপুণ বুনটে গ্রন্থির পর গ্রন্থিতে বাধা পড়ে সত্য, জিজ্ঞাসা, জীবনতৃষ্ণা, সৌন্দর্য । তিনি যে ভাষায় কথা বলেন, তা রূপকের ভাষা, রূপকথার ভাষা । রূপ রস গন্ধের জগত, তথ্য ও যুক্তির জগত, ঘটনার পর ঘটনার জগত, বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যেই ভাষা তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেই ভাষায় অন্দরমহলের আর অন্তরমহলের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয় সুবোধ ঘোষের নিপুণ শব্দবন্ধে, সুনিপুণ বাক্যবিন্যাসে ।
অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, `সত্যকে উপলব্ধি করতে হয় । যে লিখবে সেও উপলব্ধি করবে ; যে পড়বে সেও । উপলব্ধির অভাব আর কিছু দিয়ে ভরে না । এর জন্যে ডুব দিতে হয় জীবনযমুনায় । ... জীবন একেবারেই সহজ ব্যাপার নয়, তার পদে পদে দু:খ দৈন্য দ্বন্দ্ব । পদে পদে স্নেহ প্রীতি করুণাও আছে । নইলে চলা কবে থেমে যেত ! .. মানুষকে বাদ দিয়ে ভাবলে দু:খ দৈন্য স্নেহ প্রীতি ইত্যাদির অর্থ হয় না । মানুষিক ভাবনার ঊর্দ্ধে উঠলে এ সকলের প্রকৃত অর্থ জানা যায় ।' (`অন্ত:সার' - অন্নদাশঙ্কর রায়)
এ কথাগুলো সুবোধ ঘোষের লেখা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সত্য হয়ে বাজে । জীবনযমুনায় ডুব দিয়ে নান্দনিক সঙ্গীতে শ্রবণ তৃপ্ত করা শুধু শিল্পীর কাজ নয়, এ কাজ দার্শনিকের ।
সৃষ্টির ভাবনা জীবনবোধের ভাবনা । জীবনসত্য এবং দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরের ভাবনাও বটে । সফল সাহিত্যিক মনে মনে একটা বিবাদ মিটিয়ে ফেলেন । তিনি সত্য বলেন, সুন্দর করে বলেন । শৈলী সুন্দর । আঙ্গিক সুন্দর । কিন্তু বলার কথাটা হয়তো অসুন্দর । অসুন্দর সত্য । এই মেলবন্ধন তখনই সম্ভব যখন লেখকের ভেতরে থাকে একটি সুন্দর মন, সুন্দর আত্মা । সেই অন্তরের সৌন্দর্য রচনায় ফুটে ওঠে ।
সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের সৃষ্টির সঙ্গে বিশ্বসৃষ্টি একাকার হয়ে উঠেছে । একাধারে সাহিত্যিক এবং দার্শনিক হয়ে তিনি তাঁর লেখার জগতকে এক উচ্চতায় তুলে নিয়েছেন, অনায়াস সাবলীলতায় পাঠকের মননসঙ্গী হয়ে উত্তরণের মন্ত্র শিখিয়েছেন । আকাশের তারার প্রাচুর্যের মতোই তাঁর লেখায় আছে এমন সব রূপকল্প, যেগুলো তাঁর শিল্পী-সত্তাকে উদ্ভাসিত করে, তাঁর সত্তার যন্ত্রণাকে প্রকাশ করে, তাঁকে দেয় বৈশ্বিকতার মাত্রা । এই অকৃত্রিম আত্মকরুণাবর্জিত প্রকাশ কোন কেতাদুরস্ত অভিনয় নয়, এ তাঁর অদম্য শিল্পী-সত্তা । পৃথিবীর প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি তাঁর মমতা আর ভালোবাসার রূপ । তাঁর প্রবল ইচ্ছাশক্তি, যে ইচ্ছাশক্তির জমিতে তিনি গড়ে তোলেন মানুষের ভবিষ্যৎ । অন্ধ, কপট, নির্মম সময় ও পরিপার্শ্বে বিশেষভাবে মূর্ত বিবেক, সংবেদনশীলতা, অনুসন্ধিত্সা ও আত্মবিশ্লেষণ । একাধারে লক্ষ্যভেদী ও ব্যঞ্জনাময় এই বর্ণনা সৃষ্টি করে সেই আবহকে যা জীবনের প্রয়োজনীয় পটভূমি ।
(পরবাস-৪৩, জুলাই, ২০০৯)