"তুই প্রদীপকে মোটা হাতি বললি কেন ?" গাবলু চোখ পাকিয়ে তেড়ে এলো ।
"বলব না ? মোটা থপথপে কোথাকার, সব সময় শুধু খাই খাই !" টুম্পিও ছাড়বে না ।
"তা বলে ওই রকম বলবি ? ওর মনে কত দু:খ হয়েছে জানিস্ ?"
"ও আচ্ছা এখন বুঝি দু:খ হলো আর তুই আর ও মিলে যখন অনুপমাকে শাঁখচুন্নি বলেছিলি তখন কি হয়েছিল ? তখন অনুপমার বুঝি দু:খ হয়নি ?"
"হঁংউ, অনুপমা আমাদের নামে মিছিমিছি টিচারকে নালিশ করেছিল কেন ?"
"ও মিছিমিছি ? তোরা দুজনে মিলে অন্নর লাঞ্চ খেয়ে নিসনি ?"
"কি হয়েছে টুম্পিদিদিমণি গাবলুদাদুভাই ? তোমরা ঝগড়া করছো কেন ?" ঠাকুমা জিজ্ঞেস করলেন । ঠাকুমা কিছুদিন হল ওদের বাড়িতে এসে রয়েছেন ।
টুম্পি আর গাবলু দুজনে হাঁউমাঁউ করে ঠাকুমাকে বলতে শুরু করল কি হয়েছে । টুম্পি আর গাবলু যমজ ভাইবোন । দুজনে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে । ইদানীং ওদের দুষ্টুমির জ্বালায় স্কুল পাড়া বাড়ি সব জায়গায় লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে । ওরা নাকি অন্য ছেলেমেয়েদেরও বাজে হতে শেখাচ্ছে ! দুজনের মধ্যে তো ঝগড়া লেগেই আছে মাঝেমাঝে হাতাহাতিও যে হয়না তা নয় । ঠাকুমা দু তরফের সবকিছু শুনে বললেন, "গাবলুদাদুভাই তোমার কি মনে হয় ? তুমি ওই মেয়েটার টিফিন খেয়ে নিয়ে ভাল কাজ করেছো ? কাল যদি কেউ তোমার খাবার খেয়ে নেয় তোমার ভাল লাগবে ?"
গাবলু মাথা নিচু করে বলল, "না, ওটা ভাল কাজ হয়নি ।" পরক্ষণেই আবার সামলে নিয়ে বলল, "কিন্তু টিচারের কাছে তো ওটা নিয়ে বকা খেয়ে নিয়েছিলাম তাহলে কেন টুম্পি প্রদীপকে ওই সব বলল ? ঠাকুমা বললেন, "না, টুম্পিরও ওটা বলা ঠিক হয়নি । টুম্পিরানি তুমি কালকে প্রদীপের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে, কেমন ?"
টুম্পি মুখ গোঁজ করে বলল, "আচ্ছা ..."
"শোনো তোমাদের একটা গল্প বলি !" গল্পের গন্ধ পেয়ে টুম্পি আর গাবলু ঠাকুমার গা ঘেঁসে বসল
"একটা ছোট মেয়ে ছিল, তোমাদেরই বয়সী । ধরে নেওয়া যাক তার নাম মিনু । একদিন সেই মিনু তার মা বাবা দাদা আর দিদির সাথে তার মাসির বাড়ি বেড়াতে গেল । মাসির মেয়ে বেবির একটা তোতাপাখি ছিল । সুন্দর কথা বলতে পারতো পাখিটা - খিদে পেয়েছে খেতে দাও, বেবি এসেছে, বেবি ভাল মেয়ে এইসব । বেবির খুব প্রিয় ছিল পাখিটা । মিনুর পাখিটাকে দেখে ভারি ভাল লাগল । সে অনেকক্ষণ ধরে পাখিটাকে বলল, "বল মিনু এসেছে, মিনু ভাল মেয়ে" কিন্তু পাখিটা কিছুতেই ওই কথাগুলো বলল না । তখন ভারি রাগ হল মিনুর । হিংসেও হল খুব । রাতের বেলা কেউ যখন দেখছে না, খেয়াল করছে না তখন সে চুপি চুপি গিয়ে তোতাপাখির খাঁচার দরজাটা খুলে দিয়ে এলো । মিনু ভেবেছিল পাখিটা উড়ে পালিয়ে যাবে কিন্তু অনেকদিন খাঁচায় থেকে থেকে পাখিটা ওড়া ভুলে গিয়েছিল । পরদিন সকালে উঠে দেখা গেল উঠানে পাখিটা মরে পড়ে রয়েছে । বিড়ালে মেরে ফেলেছে তাকে । বেবি তো মনের দু:খে কেঁদে কেঁদে জ্বর করে ফেলল । মিনুরও ভীষণ খারাপ লাগল । সে তো পাখিটাকে মারতে চায়নি, চেয়েছিল উড়িয়ে দিতে ! মিনুর মা কিন্তু ঠিক বুঝলেন যে মিনু বা ওর দাদা দিদির মধ্যে কেউ কাজটা করেছে । তাই বাড়ি ফিরে উনি প্রত্যেককে একটা করে ঝাঁপি দিলেন । বললেন, "এই হল তোমাদের দুষ্টুমির ঝাঁপি । যে যা দুষ্টুমি করবে বা অন্যকে দু:খ দেবে একেবারে সত্যি সত্যি লিখে ক্ষমা চেয়ে ঝাঁপিতে ফেলে দেবে । ঝাঁপিতে যাদু আছে । একই দুষ্টুমি বারবার করলে ঝাঁপির রঙ বদলে যাবে আর তখনই সবাই বুঝতে পারবে কে একই দুষ্টুমি বারবার করছে ! আর কেউ যদি দুষ্টুমি করেও ঝাঁপিতে লিখে না ফেলে তাহলে ঝাঁপির রঙ কালো হয়ে যাবে । তার মানে সে আর বাড়িতে থাকতে পারবে না । তাকে দূরে কোথাও চলে যেতে হবে যেখানে সে মা বাবা ভাই বোনেদের আর দেখতে পাবে না । ঝাঁপি তোমাদের কাছেই থাকবে কেউ কারো ঝাঁপি খুলে দেখবে না ।" মিনু সেদিন ভয়ে ভয়ে পাখির ঘটনাটা লিখে আর কোনদিন করব না লিখে ঝাঁপিতে ফেলেছিল । মা বাবাকে ফেলে দূরে যাওয়ার তার মোটেই ইচ্ছে ছিল না । মিনুর দাদা মৃদুলের ঝাঁপির রঙ একদিন দেখা গেল সাদা হয়ে গেছে ! মা দেখে শুধু বললেন মৃদুল তুমি একই দুষ্টুমি বারবার করছো মনে হচ্ছে !"
সেই ঘটনাটার পর ওরা সবাই সাবধান হয়ে গেল । আর কখনও ঝাঁপির রঙ বদল হয়নি । এতটা বলে ঠাকুমা থামলেন ।
"তারপর কি হল ?"
"একটু দাঁড়াও আমি আসছি," বলে ঠাকুমা কোথা থেকে হাতে করে দুটো ঝাঁপি নিয়ে এলেন । বললেন, "এই সেই ঝাঁপি । তোমাদের দুজনকে দিলাম । যদি কোনো দুষ্টুমি করো, কাউকে দু:খ দাও তাহলে আর করবে না কথা দিয়ে এতে ফেলবে । আর মনে থাকে যেন একই দুষ্টুমি দুবার করলে ঝাঁপির রঙ বদলে যায় আর দুষ্টুমি করে না লিখলে ঝাঁপি কালো হয়ে যাবে - মানে মা বাবাকে ছেড়ে হোস্টেলে যেতে হবে, বুঝেছো ? নিজেদের মধ্যে ঝগড়া মারামারিও কিন্তু দুষ্টুমির পর্যায়ে পড়ে !"
ওদের দুজনকে দুটো ঝাঁপি দিয়ে ঠাকুমা রান্নাঘরে চলে গেলেন । গাবলু টুম্পিকে বলল, "তোর জন্যেই এটা হলো !"
টুম্পি গম্ভীর মুখে বলল, "ঠাকুমা বলেছেন নিজেদের মধ্যে ঝগড়াও দুষ্টুমি বলে ধরা হবে !"
"ঝাঁপি দুটো ঠিক ওই রকমই রয়েছে তাই না গাবলু ?"
ডাক্তার সায়ন্তন ঘোষ চমকে ফিরে তাকালেন । নি:শব্দে কখন টুম্পি মানে অনামিকা ওনার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে ।
"হ্যাঁ, যদিও আমার ঝাঁপির রঙ কালো হলে আশ্চর্য হতাম না । মা বাবা বোনকে ছেড়ে অনেকদূরে রয়েছি । সত্যি যখনই ঝাঁপিগুলোর কথা ভাবি তখনই মনে হয় ঠাকুমা স্কুল পাসও করেননি কিন্তু কি অসাধারণ বুদ্ধি ধরতেন, তাই না ? বদমাইশি করে করে আমরা স্কুল পাড়া বাড়ি সবার নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিলাম আর উনি আমাদের সব দুষ্টুমি এক নিমেষে ঝাঁপির মধ্যে বন্ধ করে দিয়েছিলেন । কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ আমাদের নিজেদেরই বেছে নিতে শিখিয়েছিলেন !"
"যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এলাম । আমি কলকাতায় বদলি নিচ্ছি । দিল্লির পাট চুকিয়ে দেবো । বাড়িটা বিক্রি করতে হবে না, আমিই থাকবো এখানে । মা বাবারও দিল্লিতে মন বসছে না আর । তোর বিক্রির প্রস্তাবে ওনারা ভয়ঙ্কর দু:খী হয়ে পড়েছিলেন । মুখ ফুটে তেমন কিছু বলছিলেন না বটে কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম !"
"যাক্ বাঁচালি বাবা টুম্পি ! ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল এটাকে বিক্রি করতে । ভাবছিলাম কাগজে লিখে বুঝি ঝাঁপিতে রাখতে হবে -- আজ আমি মা বাবাকে চরম দু:খ দিয়ে তাদের অমতে বাড়িটা বিক্রি করতে চেয়েছি -- আমি লজ্জিত, ক্ষমা চাইছি আর করব না !"
(পরবাস-৪৪, ডিসেম্বর, ২০০৯ )