• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৫ | এপ্রিল ২০১০ | প্রবন্ধ
    Share
  • `অবনী বাড়ি আছো' : অহনা বিশ্বাস

    শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা একটি অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা `অবনী বাড়ি আছো' । কবি বিভিন্ন সময়ে মঞ্চে এই কবিতাটি আবৃত্তি করতে ভালোবাসতেন । `ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো' কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটির প্রতি যে তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল, এর থেকে তা স্পষ্ট ।

    এই `অবনী বাড়ি আছো' নামে শক্তি একটি উপন্যাসও লেখেন । বিষয়টা কি এইরকম যে - কবিতাটি বা `অবনী বাড়ি আছো' নামে বাক্যবন্ধটি পছন্দ বলেই নামকরণের এই মোহ থেকে কবি বের হতে পারেননি ? এই ধারণা থেকে উপন্যাসটি পড়তে শুরু করি । আর তখনই যেন কবিতাটির পশ্চাত্পটটি স্পষ্ট হয় ।

    এই উপন্যাসের নায়ক নিরুপম । শক্তির অনেক উপন্যাসের নায়কের নামই নিরুপম । এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, শক্তি যেমন স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা লিখতেন, তেমনই তাঁর উপন্যাসও আত্মজীবনীমূলক । তাঁর কবিতা আর উপন্যাস প্রায়ই হাত ধরাধরি করে চলে । একে অপরের পরিপূরক । তাঁর সমকালীন যে সব লেখক কবিতা এবং উপন্যাস দুই মাধ্যমেই নিজেদের প্রকাশ করেছেন, তাঁদের কাছে দুটি পৃথক পৃথক ভাববস্তুকে বহন করেছে । যেমন সুনীল গঙ্গোপাশ্যায়, তেমনটি শক্তি নন । তাই `অবনী বাড়ি আছো' উপন্যাস পড়াও অসম্পূর্ণ থেকে যায় কবিতাটি পড়া না থাকলে ।

    এই উপন্যাসে দেখি নিরুপমের এক সম্পর্কিত দাদু অবনী, যে কাবুলিওয়ালার কাছে ধার করে গাইবাছুর কেনে, সে একদিন ধার শোধ না করে উধাও হয়ে যায় । ঘরে পড়ে রইলো তার স্ত্রী ও পুত্র । দাদু বিবাগী হয়, কিন্তু কাবুলিওয়ালার আসা থামল না । "সে মাসের মধ্যে একবার আসবেই । প্রথম প্রথম বিশ্বাস না করে করে শেষদিকে ওটা তার অভ্যাসেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল । আসতো, ভিটের মধ্যে ঢুকতো না । রাস্তা থেকেই হেঁড়ে গলায় হাঁক পাড়তো, বড় দাদুর নাম করে । দাদুর নাম অবনী । কাবলিঅলা তার ধরা গলায় ভাঙা বাংলায় শুধু তো এই অবনবাবু বাড়ি হ্যায় ? বাড়ি আছে ? তো কাঁহা গিয়েছে সে ? উহাঁর বন্ধু আছে ? বলিয়ে আমি রহমৎ খাঁ আসছে ।"

    এই ঘটনাকে যদি সত্য বলে ভেবে নিই, ভেবে নিই যে বালকবয়সে এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শক্তিকে যেতে হয়েছিল, তাহলে তার ছাপ, স্মৃতিকে তিনি নিয়ে এসেছেন কবিতায় । যে কোনও বড় কবির স্মৃতিলোক খুব সমৃদ্ধ হয় । আর শক্তিকে তো বারবার স্মৃতির মধ্যে ডুবতে দেখি । আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিপ্রেক্ষিত সমেত পাড়া-গাঁ । `এখানে মেঘ গাভীর মত চরে' - এখানে গ্রামের মাঠে গরু চরার স্মৃতিই উজ্জ্বল । বর্ষার ছবি, মেঘের ছবি, নালিঘাস আর গাভী - সব মিলে মিশে এই চিত্রকল্প তৈরী হয়েছে ।

    বহড়ু গ্রামে দাদু ও বালবিধবা মাসির সঙ্গে যে বালক শক্তি থাকত, দাদুর মৃত্যুর পর সেও একদিন চলে আসে কলকাতায় । বাড়িটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে । পরে সে বাড়িই যেন দেখতে পান কবি । যার দুয়ার নালিঘাসে ঢেকে আছে । অনেকদিন যার দরজা খোলাই হয়নি । পোড়ো বাড়ির স্মৃতি বোধহয় কবির এখান থেকেই এসেছে ।

    বাল্যের স্মৃতি এই পর্যন্তই, কিন্তু বাকি যে জীবন পড়ে থাকে, তার অভিজ্ঞতার ছাপও কবিতাটির পরতে পরতে থাকে । কবি বাল্যের স্মৃতি ছাড়িয়ে চলে যান যৌবনে । প্রায় প্রতিদিনই মধ্যরাত্রে তার বাড়ি ফেরা । বাড়ির দরজায় করাঘাত করা ঘুমন্ত পাড়াকে জাগিয়ে - এ কবির দীর্ঘদিনের অভ্যাস । মধ্যরাতে বাড়ি ফেরার অভিজ্ঞতা যেমন কবির নানা কবিতায় ছড়িয়ে আছে, তেমনই ছড়িয়ে আছে দুয়ারে করাঘাতের প্রসঙ্গটিও । আর যতবার ডেকেছেন কবি, ততবারই যেন মনে মনে নিজেই হয়ে উঠেছেন অবনী । তিনিই ডাকছেন, আবার যাকে ডাকছেন, সে আছে যে তার নিজেরই অস্তিত্বের ভিতরে । অবনীকে তিনিই ডাকছেন, আর তাঁর ভেতরে সচকিত হয়ে জেগে উঠছে সেই অবনীই ।

    আধেকলীন - হৃদয়ে দূরগামী
    ব্যাথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি
    সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
    `অবনী বাড়ি আছো ?'

    `সংবাদ সোনার বাংলা' পত্রিকায় ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৯৬ সংখ্যায় একটি সাক্ষাত্কারে বলা হয়েছিল তাঁকে - "`অবনী বাড়ি আছো' কবিতাটি আপনি ভুলভাবে পাঠ করেন । ভীষণ চেঁচামেচি করে ডাকেন সবাইকে, যেন একতলা থেকে তিনতলায় ডাকছেন" । তার উত্তরে শক্তি জানান, "বন্ধ বাড়ির এফেক্ট আনতে চাই আমি । অবনী যদিও আমার ভেতরেই রয়েছে কিন্তু আমি তো একটা বাড়ির মত । না চেঁচালে শুনতে পাবে না ভেতরের লোকটা ।" এই ভেতরের লোকটার দরজায় বারবার ঘা পড়ে । একই কাব্যগ্রন্থের আরেকটি কবিতা `ভিতরে আমার' এ পাই - `কে যেন আমায় ডেকেছে, দুয়ারে দিয়েছে নাড়া' ।

    `অবনী বাড়ি আছো' উপন্যাসে নায়িকা, নিরুপমের ঘরনী বিবি, তার মায়ের বাড়ি যাওয়ায়, অভিমানে বিরহে নিজেকে বয়ে যেতে দেয় নিরুপম । তার মনে হয় সে পাগল হয়ে যাচ্ছে । আর পাগল হতে হতে ভেঙে পড়ছে । আয়না ভাঙছে, আয়নার কাঁচ রক্তাক্ত হচ্ছে । তারপর বিবিকে সমগ্র কলকাতায় খুঁজে ফিরছে নিরুপম একটা ট্যাক্সি নিয়ে । কোথাও বিবিকে না পেয়ে নিজের বাড়ির সামনে এসেই `টেলিগ্রাম টেলিগ্রাম' করে চেঁচিয়েছে । আর তখনই - `বন্ধ দরজার কপাট দড়াম করে খুলে গেলো । উপরের নীল আলোয়, পাতার ফাঁকে বিবির মুখ ।

    বোগেনভিলিয়ার সঙ্গে ঝুমকোলতা জড়িয়ে ছিলো । একজনের গন্ধ নেই, কাগজফুল, অন্যজন গন্ধের খনি । তারই রোদেপোড়া ফুলের গন্ধ ভোরবেলার বাতাসে ভাসছে । নাকে গন্ধ পেলেই কান্না পায় কেমন । বিবি কী করে এলো ? কখন এলো ? তাহলে কি ওকেই বন্ধ করে আমি, বাইরে, ওকে খুঁজতে বেরিয়েছিলুম ? আশ্চর্য !'

    `কিন্তু ছায়া চলে যায় - নতুন পল্লীর পাশ বেয়ে
    ফিরিওলা উদ্যমীর মতো,

    পুরনো নতুন পাড়া ঘুরে ঘুরে দোষারোপ করে
    আমার ঘরনী কই ? তুমি তাকে লুকিয়ে রেখেছো
    হে নতুন, উচ্ছন্ন, কপট
    মোহ থেকে মুক্ত আমি, পাংশু দেয়ালের কাছে যাবো
    মাড়াবো না দেশান্তর, মন্ডূক হয়েই থাকবো যতদিন থাকি'
    - `এই ছায়া'

    বহু কবিতাতেই ঘুরে ফিরে আসছিল এইসব স্মৃতিজাত চিত্র, চিত্রকল্পগুলি । গভীররাতে দুয়ারে দুয়ারে অর্ধচেতন ঘোরার ছবি ।

    `বলা হলো, এ তোমার দরজা নয়, শোনো
    অন্য কোন দরজার সামনে এসে দুহাত পেতেছো
    এ তোমার দরজা নয় ।
    জানি আমি দুহাত পেতেছি । নিজের বাড়ির সামনে
    দুহাত পেতেছি ।
    খোলা হয়নি । এতো মদ্য । এত পদ্য চার হাত ঘুরিয়ে
    এতো পদ্য । চার হাত পাতিনি ।'
    - `বিষের মধ্যে সমস্ত শোক'

    নালিঘাসের উল্লেখ আছে `অবনী বাড়ি আছো' কবিতাটিতে । দীর্ঘদিন দুয়ার না খোলার ফলে যেখানে ঘাসেরা প্রশ্রয় পেয়েছে । `ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো' কাব্যগ্রন্থেই `কেতকী' কবিতায় তার ছায়া পাই ।

    ` বহুদিনের পরবাসে উঠান ভরে পথের ঘাসে
    পাগল দুয়ার খোলো ।
    ঘরের মধ্যে করিনি বাস তাই তো আমার এ -সর্বনাশ
    আজকে বাহির থেকে
    হৃদয়পুরের সবই ভালো সকাল-সন্ধ্যা মিলিয়ে কালো
    রয়েছি মুখ ঢেকে ।'

    গাভীর স্মৃতি প্রসঙ্গে শক্তি `পদ্যবন্ধ' পত্রিকায়, সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সংখ্যায় একটি সাক্ষাত্কারে জানান - একবার বন্ধুরা মিলে হিজাল গিয়েছিলেন, আর তারপর দুপুরের দিকে মহুয়া খেতে খেতে দেখতে পাই দূরে অপূর্ব মেঘ করে আছে । গরু ভেড়ার মতো মেঘ যেন চরে বেড়াচ্ছে । সেই থেকেই `ওখানে মেঘ গাভীর মতো চরে' এই লাইনটি চলে আসে । ওই রকম ফাঁকা, এত মেঘ, তার সঙ্গে মহুয়া, আমি অনেকটা supernatural অবস্থায় পড়ে যাই । বাড়িতে কেউ নেই, তবু মনে হচ্ছিল কেউ না কেউ আছে । হয়তো আমিই দু-টুকরো হয়ে বাইরে-ভিতরে আছি - এভাবেই পদ্যটি আসে ।' এখানেও দেখি কবি সত্তার বিভাজনের কথাই বলেছেন ।

    `অবনী বাড়ি আছো' কবিতাটিকেই যেন একটু অন্যরকম ভাবে লেখেন কবি বহুবছর বাদে আবার `দোলের দিন, দুদশক পরে' কবিতায় ।

    `অবনীর বাড়ি যেন, বাড়িখানি এই
    মধ্যমাঠে, চরের মতন, হঠাতি উঠেছে
    টিকটিকি উইপোকা এখনো আসেনি
    বাড়ির দখল নিতে, বাড়িখানি এই
    মুথা নালিঘাস চেপে গজিয়ে উঠেছে

    মেঘের মতন মোষ চর্তুদিকে চরে ।'

    অবনীকে, অবনীর মধ্যে কবিকে এইভাবে আমরা বারবার খুঁজে পেতে থাকি তাঁর সমগ্র কবিতায় । কবির একটি স্মৃতি ডাক দেয় অন্য স্মৃতিকে । তখন কাবুলিওলার ডাক মিশে যায় নিজের ডাকের সঙ্গে । উদ্দিষ্ট বাড়িটি হয়ে যায় নিজের বাড়ি । সে বাড়িও যথার্থ নিজের কিনা কে জানে । চিরভ্রাম্যমান মানুষেরও আশ্রয়ের প্রয়োজন হয় । তাঁর মনের অনিকেত চেতনাই `অবনী বাড়ি আছো'-র মধ্যে ধরা পড়েছে ।



    (পরবাস-৪৫, মার্চ, ২০১০ )

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments