অর্কিডের স্কুলিং, কলেজ, ইউনিভার্সিটি সব হায়দ্রাবাদেই ; এইচ.আর.এ এম.বি.এ. করে ও একটা কনসাল্টিং ফার্মে চাকরিও করে এই হায়দ্রাবাদেই । বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছেন-------রেলে চাকরি করতেন; মা কলেজে পড়াতেন এখন রিটায়ার্ড; অর্কিড প্রথম থেকেই কনভেন্টে পড়াশোনা করেছে । যেখানে বাংলার নামগন্ধও ছিলো না, কিন্তু চিরদিনই ওর মা ওকে বাংলার সঙ্গ ছাড়তে দেয়নি । সেজন্য ওর বয়স যত বেড়েছে বাংলার সাহিত্য, সিনেমা, গান এসব নিয়ে ওর আগ্রহ উত্তরোত্তর বেড়েছে । প্রবাসী বাঙালি হিসেবে ওর এই জেনুইন বাঙালিয়ানা হায়দ্রাবাদের বাঙালিদের তো বটেই এমনকি ওর কোলকাতার বাঙালি আত্মীয়দেরও অবাক করতো । বা: এই লেখাটা বেশ চমত্কার ভাবে শুরু করেছে তো ! বাঙালির সেকাল, বাঙলার-মানসিক আবহাওয়া-------বা: বা: বেশ সুন্দর সাজিয়েছে তো টপিকগুলো, তার অ্যানালিসিসও বেশ ভাবনার উপাদান । থামতে পারছে না অর্কিড ------- তরতর করে এগিয়ে চলেছে লেখাটার সাথে সাথে...এরকম লেখাই তো ও চেয়েছিল । যার মধ্যে একটা নিউট্রাল ভাবনা থাকবে, যে পাতি ভাটাবে না । না হলে এই অরকুটে ও দেখেছে ভাটাবার লোকের অভাব নেই । যে যা নয় তাই নিয়ে ভাটিয়ে যায় বিন্দাস । ও মোটেই চায়নি এরকম একটা খেলো কমিউনিটি । ও সবসময় চায় একটা লেখা যেখানে ভাবনা আর তথ্য একে অপরের পরিপূরক হবে । এ লেখাটা পড়ে সত্যিই ওর খুব ভালো লাগলো ।
লেখকের নামটা দেখলো । অভিজিৎ । লেখাটা পড়ে অর্কিড এতটাই ইমপ্রেসড্ হয়েছিলো যে ওনার সম্বন্ধে একটু জানার কৌতূহলে ওনার অরকুট প্রোফাইলে ঢুকে পড়লো । অদ্ভুত প্রোফাইল তো ! প্রোফাইল দেখে বোঝার উপায়ই নেই ভদ্রলোক কে ? কেমন ? মিনিমাম কিছু ইনফরমেশন আছে, তাও ধোঁয়াশায় ভরা ! নামের জায়গায় -- নামে কিইবা আসে যায় ! বয়স - হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি ! জায়গা -- এই একলা ঘর আমার দেশ ! রিলেশনসিপ স্ট্যাটাস -- একলা থাকার অভ্যেস ! এইরকম সব বিচিত্র কথা । আবার অ্যালবামে কতগুলো ছবিও আছে । তার মধ্যেও যেন একটা ব্যঙ্গ । একটা রাস্তার কুকুর আর একজন ভিখিরি একপাতে খাবার খাচ্ছে, নীচে লেখা যৌথ খামার ! একটা পাগলি ঝোপের ধারে কাপড় তুলছে সকালবেলায় । নীচে লেখা -- পাগলি তোমার সাথে চার অক্ষরের ঘর বানাবো ! রাস্তার পাশে ট্যাপকলের জলে মগ নিয়ে চান করছে ভুঁড়িওয়ালা এক জন লোক । ছবির ক্যাপশন এক মুঠো শান্তি ! ভদ্রলোক যেন খুঁজে খুঁজে সমাজের ধামাচাপা দেওয়া এপিসোড গুলোকে দেখাতে চাইছেন । না: ভদ্রলোক যেই হোন ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না । আমার একটা প্রিয় থ্রেড কে উনি অ্যাটলিস্ট সার্থক করলেন । একটা জম্পেশ স্ক্র্যাপ লিখে ফেললো ও ভদ্রলোককে থ্যাঙ্কস জানিয়ে । তারপর একটা ছোট্ট ই-মেইলও করে দিলো ওনাকে । ও লিখলো ------- লিখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে । আর চিঠি লিখতে তো বটেই, আর লেখা পড়তে ভীষণ ভালো লাগে । ভাবনার লেখা পড়তে । কিন্তু আজকাল তো দেখি ভাবনার মানুষ ভীষণ কমে যাচ্ছে । আপনার লেখাটা, অরকুট প্রোফাইল পড়ে ভেবে আমার মনে হলো আপনি বোধহয় সেই ভাবুকদের দলেই আছেন এই অবেলায়ও ! তাই আপনার সাথে কমিউনিকেট করতে ইচ্ছে করলো । তাই এই চিঠিটা লিখে ফেললাম । ভালো থাকবেন ।
ভিয়েনার শান্ত ছবির মতো ফ্রেম, কয়্যারের সুরেলা মিউজিক, সিম্ফনির ঝংকার, অপেরার নাটকীয়তা আর অফিস------- এসব নিয়েই বেঁচে ছিল ও । এ-শহরে কেউ কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা ঘামায় না বলে ওর ডিভোর্স, তারপর এই আটত্রিশেও ওর ঘর না-বাঁধা নিয়ে কারো কোনো কৌতূহল কখনো অনুভব করেনি । ফলে দিনগুলো বয়ে যাচ্ছিলো ড্যানিউব নদীর জলের মতোই । অরকুটে ওর আসা বেশিদিন নয় । এই পুরো ব্যাপারটা বেশ ভালো লেগেছিলো । কত মানুষ, কত ভাবনা, কত কথা আর সবচেয়ে বড় কথা কলেজজীবনে হারিয়ে যাওয়া লেখার ইচ্ছেটা আবার যেন ফিরে আসছিলো । অর্কিডের এই কমিউনিটিটায় জয়েন করেছিলো, নামটা বেশ ভালো লেগেছিলো থ্রেডটার । আর তারপরই এই স্ক্র্যাপটা লিখে ফেলেছিলো । আর সঙ্গে সঙ্গেই অর্কিডের এই উচ্ছ্বাস ভরা মেইল । অভিজিৎ আগে কোনোদিন এতো প্রশংসা পায়নি ওর লুকোনো প্যাশন লেখালেখির জন্য------- স্পেশালি কোনো মহিলার কাজ থেকে, কাজেই বেশ একটা খুশি খুশি লাগছিলো । বহুদিন কাউকে চিঠি লেখা হয়নি । মেইলটা টাইপ করতে শুরু করলো । লিখতে লিখতে ওর হাতে উঠে এলো এই মুহূর্তটা । আর গতানুগতিকতার প্রবাহে বয়ে চলা জীবনের নানা ভাবনা । মেইলটা সেণ্ড করার আগে একটা থ্যাঙ্কস দিতে ভুললো না ; কেন কে জানে...
কখনো বা ড্যানিউব নদীর ধারে বসে কথা বলছে নিজের সাথে, নদীর গান শুনতে শুনতে । আর কখনো বা প্রবল শৈত্যে জমে সাদা হয়ে যাওয়া নদীর একেবারে মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে অবিশ্বাস্য লাগছে ; একি লাবণ্য পূর্ণ প্রাণে । বিস্ময়ে জাগে আমার প্রাণ । নিজের মধ্যে হারিয়ে গেছে অর্কিড । অভিজিতের চিঠি পড়তে পড়তে, হায়দ্রাবাদের হুসেন সাগরের জল কখন যেন মিশে গেছে ড্যানিউবের জলে । ভিয়েনার রয়ম্যানপ্লাটজ্ স্টেশন থেকে উ-বান্ ট্রেন ছুটেছে হায়দ্রাবাদের লক্ড়ী কাপুল স্টেশনে ধোঁয়া উড়িয়ে । হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির সাথে এক প্লেট কড়কড়ে ভিয়েনিজ্ স্নিত্জেলের জিভে জল আনা গন্ধ অর্কিডের নাকে ঢুকছে ভুরভুর করে ।
ল্যাণ্ডলাইনটা বেজে উঠতেই অর্কিড আবার কিউবিকল্ এর বাস্তবতায় ফিরে এল ; এক্সটেনসন নাম্বার দেখে বুঝলো ক্যান্টিনের ফোন । মানে লাঞ্চ প্যাকেট চলে এসেছে । আগরওয়াল এর কিচেন থেকে । ও লাঞ্চ প্যাকেটটা ওর কিউবিকলেই আনিয়ে নিলো । অ্যাডমিনের সুষমা দেখলে আবার ঝাড় দেবে । কিউবিকল নোংরা করা নিয়ে ও ভীষণ বকবক করে । যদিও অর্কিডের টিম-লিড মনোহর ওদের বলে দিয়েছে চাপ থাকলে কিউবিকল নোংরা না করে খেয়ে নিতে । লাঞ্চ প্যাকেটের ফয়েলটা খুলতেই হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির সেই চেনা মশলার একটা গন্ধ নাকে এলো । আ: মনটা ভরে গেলো ওর । একটুকরো চিকেনের পিস্ মুখে ফেলে সামান্য রায়তা ঠোঁটে চেটে অর্কিড ভাবছিলো কি লিখবে অভিজিত্কে । কেন জানি না ওর মনে হচ্ছিলো ওরও অনেক কথা জমে আছে বুকের ভেতরে । অভিজিতের এই চিঠিটা ওর মনের ভেতর জমে থাকা ভাবনার কথাগুলোকে ছিঁড়ে এনে এই ফাঁকা মেইলটার পাতায় জমা করতে চাইছে । চিঠি হয়ে ইন্টারনেটের স্রোতে যেটা পৌঁছে যাবে । ইউরোপের একটা সুন্দর শহরে । ভিয়েনায় বসে থাকা নতুন পরিচিত হয়েও ভাবনার সঙ্গী হওয়া ওই নতুন মানুষটার কাছে ।
অভিজিত্,আপনার এত সুন্দর একটা চিঠির জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ । চিঠিটার মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি, কেন জানেন ? কারণ এরকম চিঠি আমি কখনো কারো কাছ থেকে পাইনি । অবাক হচ্ছেন ? কিন্তু এটা একশ' পারসেন্ট ট্রুথ । আমার জীবনে ভাবনা শেয়ার করার মতো, বিশেষত ভাবনাকে আমার প্রিয় ভাষা বাংলায় লেখার মতো মানুষের সংখ্যা বড়ই দুষ্প্রাপ্য । আমি হায়দ্রাবাদে মানুষ, এই শহরটাকে নিয়ে আমার গর্বের শেষ নেই । চারমিনারের পেছনে ওল্ড-সিটির ফুটপাথিয়া বাজারে আমার মেয়েবেলা কেটেছে । ভরদুপুরে এম.জে. মার্কেটের নানা দোকানের নানা স্বাদের শরবত খেয়ে মনে খুশির ঝড় তুলে আমি আর আস্মা চারমিনার চলে যেতাম । তারপর দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে গলদঘর্ম হয়ে চারমিনারের ওপরতলায় উঠে ------- আ: কি হাওয়া । পুরোনো এই ইমারতটায় উঠলেই আমার মনে হতো যেন ইতিহাসকে আমি ছুঁয়ে আছি । আমার ছোটবেলায় এত দোকানপাট ছিলো না হায়দ্রাবাদে । এত ঝকঝকেও ছিলো না আমার হায়দ্রাবাদ । বাবা অফিস যাওয়ার সময় আমাকে আলমচাচার কাছে রেখে দিয়ে যেতো । আর মা তার আগেই কলেজে পড়াতে চলে যেতো । আলমচাচা আমার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বোম্বে-হোটেলে নিয়ে আসতেন, তারপর ইরানী-চা আর ওসমানিয়া-বিস্কুট খেতে খেতে উর্দূ পেপার পড়তেন আর আমাকে মানে বোঝানোর চেষ্টা করতেন । তারপর রানিগঞ্জের সামনের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে আসতাম হুসেনসাগরের ধারে । ট্যাঙ্ক-বান্দের ধারে সবুজ সারি সারি গাছের ছায়ায় দুই অসমবয়স্ক মানুষের কত সে কথার দিন । হায়দ্রাবাদ তো তখনও এত আধুনিক হয়নি । এত ইণ্ডাস্ট্রিই হয়নি তখন । রাস্তায় এতো গাড়ি, এতো লোকের ভিড় ছিলো না তখন । আমি আর বাবা-মা নিয়ম করে বড়ে গোলাম আলির গজল শুনতে যেতাম গোলকোণ্ডা ফোর্টে । আর মাঝে মাঝেই রবীন্দ্রভবনে ভালো উর্দু থিয়েটার আর মন পাগল করা শের-শায়েরী । এভাবেই বেড়ে উঠেছি আমি । আর বেড়ে ওঠার সাথে সাথে মায়ের হাত ধরে বাংলা শিখেছি, ভালোবেসে ফেলেছি মনপ্রাণ ঢেলে । তারপর রাত জেগে লুকিয়ে লুকিয়ে বুদ্ধদেব বসুর `রাত-ভোরে বৃষ্টি' থেকে নবোকভের `লোলিটা' । তারপর বন্ধুত্ব করে ফেললাম রবিঠাকুর, বিভূতিভূষণ, শংকর, বুদ্ধদেব গুহ এঁদের সাথে । ওঁদের সৃষ্টির হাত ধরে । বই এর প্যাটার্ন এভাবেই আমার মনের সঙ্গে এক্কা-দোক্কা খেলছিলো আমার বেড়ে ওঠার সময়ের সাথে সাথে । তারপর কাফকা, কামু, টলস্টয় ছুঁয়ে, হেমিংওয়ে; মেটারমরফোসিসের যন্ত্রণা আর রেজারেকশনের আত্মপোলব্ধি আমার হৃদয়কুঠুরিকে রীতিমতো বিদ্ধ করলো । হুসেন সাগরের ধারে দশতলা অফিসের সাত তলায় আমাদের অফিসে । যখন রোজকার এই সফিস্টিকেটেড কেরানিগিরি থেকে মনটা বেরিয়ে আসতে চায় তখন ফাউন্টেন মেশিন থেকে এক কাপ কোক নিয়ে দাঁড়াই কাঁচের সাটারিং এর জানালার পাশে । চোখ চলে যায় ভারত-সেবাশ্রম সংঘের পেছনের গলিতে । ঝুপড়ির সামনের রাস্তায় তেল চিটচিটে ময়লা হাফপ্যান্ট পরা বাচ্চা ছেলেটা একটা সাইকেলের টায়ারকে লাঠি দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে ঢালু রাস্তা বেয়ে নীচে নেমে আসছে দৌড়ে । আর পেছন পেছন ওর মা, হাতের ভাতের থালা নিয়ে । ছোটোবেলার কথা ভেসে আসে তখন চোখে, মনে পড়ে যায় বাবার হাত ধরে ঈদ এর সময় পিস্তা-হাউসে হালিম খাবার গল্প । লেবু টেপা ঝাল ঝাল হালিম খেতে খেতে বাবার তারিয়ে তারিয়ে উপলব্ধি করার ছবিটা আজো চোখে ভাসে আমার । মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি বড্ড বেশি অতীতে পড়ে আছি । সময়টা পালটে গেলো এই গত চার-পাঁচ বছরে । এখন এতো এতো বাঙালি ছেলে-মেয়েকে দেখি কল করতে করতে রাস্তা পার হচ্ছে । আই. টি. আর বায়োটেক এর দৌলতে এই শহরটা ভারতের, এমনকি পৃথিবীরও একটা ভবিষ্যত ডেসটিনেশন্ হয়ে উঠছে । কিন্তু আমি কেন অতীতে পড়ে থাকি বলতে পারেন ? কেনই বা ক্লায়েন্ট প্রেসেন্টেশন বা বসের পিঞ্চিংও আমার অনুভূতিশূন্য লাগে ? কেন বোর হই না আমি বলতে পারেন ? আপনার লেখার সাথেও আমার এই ভাবনাটার মিল পেলাম । আপনিও লিখেছেন আপনি বোর হন না... হতাশাতেও । তবে আমরা কি ? নিরাশাবাদী না প্রকৃত অর্থেই আশাবাদী কি আমরা ? কেনই বা আমরা ? বলতে পারেন ? ভালো থাকবেন ...
ইতি...অর্কিড
-------অর্কিড, এই অর্কিড ।
-------এই তো আমি । আওয়াজ শুনে চমকে পেছন ঘুরে তাকায় অভিজিৎ ।
-------ওমা তুমি আবার কে ? তবে চেনা চেনা লাগছে যে বড় ! আরে তুমিই তো অর্কিড । কত বড় হয়ে গেলে তুমি ।
-------বাবা: এমন করে কথা বলো না, যেন কত চেনো আমায় ?
-------তাতো চিনিই । আচ্ছা উনি কে ?
-------তুমি একে চেনো না ? আরে এ হলো আমার সানিভাই ।
-------সে আবার কে ? আমায় বলোনি তো কখনো ?
-------ও বলিনি বুঝি, তা হবে । ভুলেই গেছি হয়তো । যত বড় হব হয়তো আরো ভুলে যাবো । জানো আমার সানিভাই গোলকোণ্ডা ফোর্টের গাইড । ফোর্টের পাশেই থাকে । নিজামের আস্তাবলে আগে ঘোড়া থাকতো । এখন সানিভাই আর আরো অনেকে থাকে । জানো সানিভাই এর আম্মি খুব ভালো ফলুদা বানায় ।
-------ও তাই ?------- অর্কিডের কথা শুনে বেশ মজা লাগে অভিজিতের । আর সানিভাইও হাসছে মিটিমিটি ওর কথা শুনে ।
-------হ্যাঁ, আর জানোতো ফলুদা খাওয়ার পর ঠোঁটের ওপরে যে গোঁফটা তৈরি হয়, সানিভাই এর আম্মি হাত দিয়ে পুঁছে দেয় । জানো অভিজিৎ চারমিনারের পাশের ঈদের সন্ধেটা আমার খুউউব ভালো লাগে । হাত ধরে টানতে টানতে অর্কিড নিয়ে আসে ওকে চারমিনারের নীচে ।
-------ওই দেখো অভিজিত্, ওই আলো ঝলমলে দোকানগুলো দেখো । ওগুলোতে রতি রতি মুক্তো বিক্রি হচ্ছে । খাঁটি মুক্তো তুমি চেনো অভিজিৎ ? আমি সব চিনি ।
-------হ্যাঁ, তুমি তো সব চেনো । পাকা বুড়ি একটা------- অভিজিৎ হেসে বললো ।
-------সত্যি গো, আলমচাচা চিনিয়ে দিয়েছিলো । আর ওই বাড়িগুলো দেখো কী সুন্দর উঁচু উঁচু বাড়ি । দেওয়ালে ফুল, লতা, পাতার নানা নক্সা কাটা । আর উর্দু শায়েরি লেখা আছে দেওয়ালে, দরজায় । রাস্তার ধারের ওই ছোট ছোট দোকানগুলো দেখো । ওগুলোতে কাবানি-কা-মিঠা, ফলুদা, সিমাই সঅঅব পাওয়া যায় । আর কান পাতো অভিজিৎ শোন ভালো করে । এ হলো সুফি সুর । এমন পরিবেশ আর কোথাও দেখেছো কখনো তুমি ? হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না তোমার ।
কেমন যেন ধোঁয়ায় ভরে যায় চারিদিক । একি অর্কিড কোথায় গেলো । অর্কিড... অর্কিড... এই অর্কিড ।
-------এই তো আমি, আমাকে দেখতে পাচ্ছো না অভিজিৎ ? এই তো আমি, এদিকে তাকাও । কোথায় তুমি ? আমি তোমাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না । এমন কোরো না লক্ষ্মীটি । এসো আমার কাছে ।
-------অর্কিড অর্কিড কথা বলছো না কেন তুমি ? কি হলো তোমার ? অর্কিড ... ।
ঝট করে তন্দ্রাটা ভেঙে যায় অভিজিতের । চিঠিটা পড়তে পড়তে চোখটা লেগে এসেছিলো ওর । দেখলে ঠিক সামনে বসে থাকা বয়স্ক লোকটা একগাল ঝুলো দাড়ি আর একটা মোটা গোঁফের আড়ালে মিটি হাসছে ওকে দেখে । আর গীটার বাজাচ্ছে । কী ভাবছে কে জানে ? ইউ-বান্ আণ্ডারগ্রাউণ্ড দিয়ে ট্রেন ছুটছে হু হু করে । রয়ম্যানপ্লাটজ্ স্টেশন পৌঁছতে এখনও দুটো স্টেশন বাকি ।
-------ইস্স্ আপনাকে দেখে আমার না ভীষণ হিংসে হচ্ছে জানেন ? ইউরোপের অনেক প্রান্তই আমি দেখে ফেললাম এ-ক'বছরে । কিন্তু ভারতবর্ষই আমার দেখা হোল না এখনো ঠিক করে; বর্ধমানের গ্রাম থেকে যাদবপুর হয়ে সোজা পৌঁছে গেলাম এই ইউরোপে । জানেন এক এক সময় আমার মনে প্রশ্ন জাগে আমি কি সত্যিই তৃপ্ত, তাই বোর হই না ? নাকি ক্লান্ত হতে হতে বোর হওয়ার অনুভূতিই হারিয়ে ফেলেছি একা একা চলতে চলতে ? -------আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে ? ব্যক্তিগত হলে প্লিজ মাফ করবেন । আপনি লিখেছিলেন আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার মিল হয়নি; তা আপনি আর কারো সাথে ঘর বাঁধলেন না কেন ?
-------
-------
-------কি হলো ? ব্যক্তিগত বলে ফেললাম মনে হচ্ছে । স্যরি প্লিজ বাদ দিন এই প্রসঙ্গটা ।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পরে ঝড় বয়ে গেলো অভিজিতের কথায়, আর অর্কিডের মনে । অভিজিৎ জানালো ওকে, ওর জীবনের সব লুকোনো অতীতগুলো । আন্তর্জালের তরঙ্গে অভিজিতের ভুলে থাকা অতীত ভাসিয়ে নিয়ে গেলো সেই মুহুর্তের সব ভাবনা আর লুকোনো চেপে রাখা আবেগফোঁটাগুলো ।
-------অর্কিড, নিতান্ত ছাপোষা মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে আমি । জীবনে কিছু একটা হয়ে ওঠার সংজ্ঞাও তাই আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই ছিলো । ভালো একটা সিকিওরড্ চাকরি, একটা গুছোনো সংসার, সুখী বিবাহিত জীবন । আর বয়স্ক বাবা-মা কে দেখাশোনা করা ; ব্যস্ । কিন্তু ভাগ্যের হাতে আমার জীবনের ম্যাপিং বোধহয় আলাদাই ছিলো । আমার মতো করে হয়ে ওঠা হলো না । এতদিন পরে আপনার সাথে এসব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজেকে আর বশে রাখতে পারলাম না । জানিনা সেটা আপনার গুণ, নাকি দুর্বলতা আমার মনের । কিন্তু এত বছরের জমে রাখা গুমোট অনুভূতিগুলো আপনার সামনে সব বলে ফেললাম । আর একটা সত্যি কথা আমি কনফেস করছি এখন ; আমার মন এখন একবারের জন্য আপনাকে দেখতে চাইছে, জানেন ? ছবিতে যেমন দেখেছি তেমন নয় । একেবারে জলজ্যান্ত । জীবনটাকেও আরেকবার দেখে ফেলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে ; মনে হচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে আপনার সাথে ঘুরে বেড়াই । যেমন করে আপনি চেখে বেড়ান এদিক ওদিক দিকশূন্য ভাবে । কেন নিজেকে এমন দুর্বল করে দিলেন অর্কিড -------আমার ঘুমিয়ে থাকা অতীতকে টেনে এনে ? কেন আমি নির্লিপ্ত হতে পারছি না আমার রোজকার নিয়মবদ্ধ জীবনের মতো ? কেন আমার এমন হচ্ছে ? হয়তো আমি পাগলের প্রলাপ বকছি । কিছু মনে করবেন না । আর ভাববেন না যেন আমি নেশা করে আছি । কিন্তু জীবনের নেশা যে সাংঘাতিক । এ নেশায় মাতাল হলে নিজেকে সামলানো দায় । একথা যে আগে বুঝিনি আমি অর্কিড । আচ্ছা অর্কিড আমি কি একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন আপনাকে করবো ? আপনাকেও বলা রইলো সীমা ছাড়িয়ে গেলে মাফ করে দেবেন প্লিজ ।
-------বলুন ।
-------আগের চিঠিতে আপনি তো আপনার বয়সটা জানিয়েছিলেন আমায় । কিন্তু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মনে, এই মধ্য ত্রিশেও আপনি বিয়ে করেননি কেন ? কাউকে মনে ধরেনি ? নাকি আঘাত পেয়েছেন ? নাকি আমার মতো ছাপোষা মানসিকতার একেবারে ঊর্ধে আপনি ? মানে একাই জীবনের পথ চলতে
ভালোবাসেন । যেমনভাবে ঘুরে ঘুরে আপনি সারা ভারতবর্ষকে চষেছেন একা একাই নিজের মতো করে । আমাকে বলবেন অর্কিড ? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে এসব কথা; হ্যালো ? অর্কিড... অর্কিড আছেন ? অর্কিড ? শুনতে পাচ্ছেন আমার কথাগুলো ? নাকি আঘাত দিয়ে ফেললাম অজান্তেই । অর্কিড প্লিজ চুপ করে থাকবেন না হ্যালো অর্কিড ?
-------
-------
-------
প্রিয় অভিজিত্,
আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি কাল ওরকম চুপ করে রইলাম বলে । আমি কিছু ভাবতে পারছিলাম না ওই সময়টায় । আমার কিছু করারও ছিলো না, আর বলারও কিছু ছিলো না । আমি নির্বাক থেকে আমার মনের সাথে লড়াই করছিলাম-------আপনার প্রশ্নটার বিহ্বলতায় । আপনি আমায় ডেকে চলেছিলেন-------অর্কিড... হ্যালো... অনেকক্ষণ ধরে, আর আমি চুপ করে ডুক্রে উঠছিলাম কান্নায় । শব্দ করতে পারিনি, পাছে আপনি আমায় জেনে ফেলেন । কালকে আপনার নিজের অনুভূতি, জীবনে লুকোনো পচাগলা কষ্টগুলো আমাকে নিশ্চুপ করে দিয়েছিলো । আর আমার কাছে আপনার করা প্রশ্নের উত্তর আদৌ আমি দিতে পারবো কিনা-------সেই উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমি সারারাত আমার মনের সাথে লড়াই করেছি । এখন ভোর পাঁচটা বেজে কিছুক্ষণ, বিছানাতে বসেই ল্যাপটপটা অন করেছি আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবো বলে । আর আপনার না জানা অর্কিডের জীবনের অব্যক্ত কিছু গভীর সত্য আপনাকে লিখে ফেলতে ।আমি আপনাকে অনেক মিথ্যে কথা বলেছি অভিজিৎ । আমি আপনাকে বলেছি আমার নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর গল্প । আমার দেশের নানা জায়গায় ; আবার আপনাকে আমি শুনিয়েছি হায়দ্রাবাদের অলিতে গলিতে ছুটে বেড়ানো, আমার বেড়ে ওঠার গল্প । আমি সব মিথ্যে বলেছি ! হ্যাঁ মিথ্যে... মিথ্যে... মিথ্যে আবার সত্যিও ! অবাক হচ্ছেন, না ? ভাবছেন সাতসকালে পাগলের প্রলাপ; কিন্তু না অভিজিৎ এ সব সত্যি । জীবন আমায় ছোটবেলা থেকে কতগুলো রুথলেস ট্রুথ এর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে । জন্ম থেকেই যে-রোগটি আমার চিরসঙ্গী তার পোশাকী নাম ভেন্ট্রিকিউলার-সেপ্টাল-ডিফেক্ট আর অ্যাট্রিয়াল-সেপ্টাল-ডিফেক্ট । সোজা বাংলায়, আমার হার্টে ছোটবেলা থেকেই একটি ছিদ্র আছে । ছোট থেকেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিশ্রম করা আমার এক্কেবারে বারণ । স্কুলের ছুটিতে কোলকাতা যেতাম । আমাদের বেক্বাগানের বাডির বিশাল ছাদে আমার বয়সী সবাই হুটোপাটি করে খেলাধুলা করতো । ছাদময় ধুড়ুম ধাড়াম, পড়ে যাওয়ার শব্দ, হৈ হৈ, হা হা ক্যাঁচর ম্যাঁচর, আর আমাকে কখনো খেলতে দেওয়া হয়নি ওদের সাথে । বারণ করতো ওদের সাথে খেলতে । কেন জিজ্ঞেস করলে বাবা বকতো আর মা শোবার ঘরে গিয়ে কাঁদতো । আর হায়দ্রাবাদেও আমি বাড়ি থেকে বেরোইনি কোনোদিন একা একা । আসমা আমাদের বাড়িতে আসতো, চারমিনারের ওল্ড-সিটি বাজার থেকে ঈদের জন্য কি কি বাজার করেছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ গল্প করতো । আমি শুনতে শুনতেই পৌঁছে যেতাম চারমিনার আর তার আশেপাশের অলিতে গলিতে । বাবা একবার গাড়ি করে আমায় চারমিনার দেখাতে গিয়েছিলেন । বাকি কখনো কখনো গোলকোণ্ডা । ব্যস, ওইটুকুই । বাকি সব আমার কল্পনা । আমি হায়দ্রাবাদ কেন ভারতবর্ষের কোথ্থাও যাইনি । যাওয়ার অনুমতিই ছিলো না ডাক্তারের । একবার কেরলের হিলস্টেশন মুনার-এ বেড়াতে গিয়ে একদিন পরেই আমাদের চলে আসতে হয়েছিলো । কারণ আমার হাঁফ ধরছিলো । সবকিছু আমি দেখেছি মনের চোখ দিয়ে । ছোটবেলা থেকেই ঘরে থাকতে থাকতে বই, বই, আর বই-এর সাম্রাজ্যে ডুবে যাই । ঘুরে বেড়ানো ছিল আমার স্বপ্ন । কিন্তু আমার সে স্বপ্ন যে সার্থক হবার নয় সেটা একটু বড় হয়েই বুঝতে পেরেছিলাম । মা সব বলেছিলো আমায় ; বাবা অন্য দিকে তাকিয়ে বসেছিলো । কেঁদেছিলাম খুব সেদিন । বাবা ঘর থেকে উঠে গেছিলো । মা আমাকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলো অনেকক্ষণ । তারপর গ্রহণ করার চেষ্টা করলাম সবকিছু আস্তে আস্তে । বই-এর নেশা, মা-ই আমার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো । বই এর মধ্যেই আমার আমিকে খুঁজতে আরম্ভ করলাম । ভারতবর্ষের নানা জায়গার গল্প, তার মানুষ, সংস্কৃতি, তার রাস্তাঘাট, তার ছবি সব পড়তে লাগলাম গোগ্রাসে । কল্পনায় পৌঁছে যেতাম সে-সব জায়গায়, মাঠে ঘাটে, নদীর ধারে, মানুষের সাথে বসে গল্প জুড়ে দিতাম । এমনি করে মনের আঙিনায় ঘুরে ফেললাম আমার দেশের নানা জায়গা । আলমচাচা আমাদের বাড়িতে আসতেন আমার সাথে গল্প করতে । আলমচাচার মুখে পুরোনো হায়দ্রাবাদের আশ্চর্য সব গল্প শুনতাম । সেইসময়ে আমি যেন রবিঠাকুরের অমল আর আলমচাচা সেই ঠাকুরদা । এভাবেই বেশ বড় হয়ে উঠছিলাম আমি কিন্তু এটুকু সুখও আমার কপালে ছিলো না । যখন এম.বি.এ. পড়ি তখন আমার পালমোনারি-হাইপারটেনশন ধরা পড়লো । আমার মনে আছে সে দিনটা, বাবা হাউহাউ করে কাঁদছিলো ভেতরঘরে মায়ের শাড়িতে মুখ গুঁজে । আর মা পাথর হয়ে দাঁড়িয়েছিলো । ডাক্তার বলেছিলেন পাঁচ, কি ছয় বছর আমার আয়ু । আর বিয়ের তো কোনো প্রশ্নই নেই, কারণ কোনো উত্তেজনাই দেহে সইবে না । সেদিন থেকে মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে আমি যেন সেই শেষ মুহূর্তের অপেক্ষা করছি । আগে চেন্নাই-এর এক ডাক্তার বলেছিলেন আমি আরও বেশ কিছুদিন বেশি বেঁচে যেতেও পারি । মানে দশ,-পনেরো, কি কুড়ি । এভাবেই প্রোবাবিলিটি আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়েই আমার একটা দিনের শুরু হয় আর দুশ্চিন্তা দিয়ে শেষ । আমার উত্তর নিশ্চয়ই পেয়ে গেছেন এবার । আর একটা কথা-------আমার জন্য প্লিজ স্যরি ফিল করবেন না । আমি কিন্তু সহানুভূতি একদম চাই না । জীবনকে এভাবেই অ্যাক্সেপ্ট করে নিয়েছি । সকালে গাড়ি করে অফিসে আসা, লিফট্-এ চড়ে অফিসে ওঠা, তারপর কিউবিকলেই সারাটা দিন । মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে দূর অনেক দূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে ভাবনার আকাশে খানিকক্ষনের মুক্তি । আর তারপর, রাতে বাড়ি ফিরে গিয়ে নতুন কিছু একটা, বা পুরনো বইগুলো উল্টেপাল্টে পড়ে ফেলা আর কল্পনায় ডুবে যাওয়া । এই চলছিলো আমার অবিশ্রান্ত জীবন । তারপর আপনি এলেন আমার জীবনে । হয়তো আশার ভীষণ দরকারও ছিলো । কে জানে ? ভাবি না এসব নিয়ে-------আমার এক একটা দিন তো মৃত্যুরই প্রতীক্ষায় বাঁধা ।
আর কি ? ভালো থাকবেন ।
ইতি...
অর্কিড
অভিজিতের মনে এখন যেন কে একজন দামামা বাজাচ্ছে । হৃত্পিণ্ডটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে ওর । জীবন ওকে এ কী সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলো ? উত্তপ্ত হৃদ্পিণ্ডে কে যেন পাহাড়ি ঝর্ণার শীতল জলের ধারা ছিটিয়ে দিচ্ছে । শিহরিত হয়ে উঠছে সারা শরীর । যেমন করে উত্তপ্ত ইস্পাতের ওপর থেকে শিহরিত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে, কালো পিঠের ঘর্মাক্ত কামারের হাতের ছেটানো জলে উত্তেজিত হয়ে । কোথায় যেন অর্কিডের জীবনের সাথে ওর জীবনের একটা অদৃশ্য চাপা কষ্টের সেতু আছে । কোথায় যেন মিলে যাচ্ছে ওদের জীবন । কী ভীষণ অসহায় ওরা । অথচ জীবনের কী ভীষণ চাহিদা ওদের । বেঁচে থাকার কী ভীষণ স্বপ্ন । আচ্ছা ওরা একসাথে একটু জায়গা খুঁজে নিতে পারেনা এই সুবিশাল পৃথিবীতে ? অর্কিডের ক্ষণজীবী জীবনের মুহূর্তগুলো ও ভরিয়ে দিতে পারে না দুজনের স্বপ্নের রঙে ? ও কি আর একবার স্বপ্ন দেখতে পারে না অনেকদিন আগেই হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের সংসারের ? নাই বা হলো সামাজিক স্বাভাবিকতা । ওদের অসহায়তাও কি একটা নতুন মাত্রা দিতে পারে না এই সম্পর্ককে ? অভিজিতের মনে কেমন একটা মন উদাস করা নেশা ছড়িয়ে পড়ছে নতুন করে বাঁচার জন্য । অর্কিড, তুমি নিশ্চয়ই এখন অফিসে ? তুমি কী ভাবছো অর্কিড ? তুমি কি আমার মতো করে একটুও ভাবছো ? ভাববে অর্কিড ? আমার মতো করে ? আরেকটা নতুন জীবনের আশায় ?
অভিজিতের ভাবনা-------গাছপালা, পথঘাট, নদী, সমুদ্র পেরিয়ে পৌঁছলো অর্কিডের মনে । অর্কিড তখন কাঁদছে, ওর কিউবিকলে বসে সবার চোখ এড়িয়ে । দু'চোখ জুড়ে জলের বন্যা, ওর সাজানো কিউবিকলে । ওর মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে আজ । ও জীবন্ত নির্বাক হয়ে গেছে এই মুহূর্তে । ও কি নিজেই জানে কেন ? কে জানে ? ও কেবল এটুকু বুঝতে পারছে, এই অনুভূতিটার কোনো সংজ্ঞা নেই । একেই ভালোবাসা বলে কিনা তা সে জানে না । এটুকু বুঝছে, মৃত্যুর গরম নি:শ্বাসকে উপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে ওর । যেন মনে হচ্ছে জীবনে আশার কোনো মাত্রা নেই । সম্পর্কের কোনো গণিত নেই । ভালোবাসার কোনো উপপাদ্য নেই । আর এটা উপলব্ধি করেই ওর দুচোখ ভরে জলের ধারা আজ যেন আর থামতেই চাইছে না ।
( পরবাস ৪৫, এপ্রিল, ২০১০)