'জীবনী' কাকে বলে? 'জীবনী' নামক সংরূপটির কি কোনো নির্বিকল্প রচনা-তত্ত্ব গড়ে ওঠা সম্ভব? এ কথা ঠিকই যে, গ্রেস ফ্লেমিং (১)-এর মতো কেউ কেউ হয়তো তেমন একটা প্রয়াসই করে যেতে চান। হারমিয়োন লী-র (২) মতো পশ্চিমের কোনো কোনো আলোচক হয়তো 'জীবনী'-এর নন্দন সূত্রের সন্ধানে ব্যাপৃত থাকবেন এও খুব স্বাভাবিক। তার চেয়েও জরুরি কথা বোধহয় এই যে আধুনিক ইতিহাস বিদ্যাচর্চার একটি ক্ষেত্র হিসেবে জীবনী এবং জীবনী-রচনার প্রক্রিয়া ও প্রকরণ বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে সাম্প্রতিক কালে বিবেচিত হতে থাকবে। লয়েড. ই. অ্যামব্রোসিয়াসের 'Writing Biography' বইতে একাধিক ইতিহাস-তাত্ত্বিক ইতিহাস আর 'জীবনী'-র সম্পর্কের সমীকরণে আধুনিক ইতিহাস-বিদ্যাচর্চার (Historiography) অধুনাতন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ-সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তর ভাবনা-চিন্তা করেছেন। উপনিবেশক আর উপনিবেশিত জাতির জীবনী রচনার প্রকার ও প্রকরণে কি রয়ে যায় না ইতিহাসের তাত্পর্যবাহী গূঢ় কোনো মাত্রান্তর? ইংরাজিতে লেখা কয়েকটি 'রবীন্দ্র-জীবনী' সূত্রে এই প্রশ্নটিকেই আমরা উথ্থাপন করতে চাই এই সংক্ষিপ্ত সন্দর্ভে। বাংলা রবীন্দ্রজীবনী আমাদের আলোচনা বলয়ের বহির্ভূত, যেহেতু বাঙালির জন্য বাংলায় লেখা 'জীবনী'-র রবীন্দ্র-অন্বেষণে আর যাই থাক না কেন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সম্পর্কের অন্ত:স্রোত ও তার নিভৃত টানাপোড়েনের নাট্য-উপাদান সেখানে মূলত অনুপস্থিত। ইংরেজি-বাংলা ব্যতীত প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের অন্য ভাষাগুলি আমাদের আয়ত্তাতীত না-হলে এই প্রকল্পে যে ঢের লাভ হত তা বুঝতে পারি মার্টিন কেম্পশেনের 'জার্মানিতে রবীন্দ্র-বীক্ষা'-র (৩) মতো বই পড়ে। আপাতত শুধু এটুকু বলে নেওয়া ভালো, ইংরাজিতে প্রকাশিত যাবতীয় 'রবীন্দ্র-জীবনী' নিয়ে আমরা এখানে কথা বলছি না; এবং সেইসব জীবনীর তথ্যভ্রান্তি, অসম্পূর্ণতা, অধ্যায় বিন্যাস ইত্যাদিও আমাদের মুখ্য বিবেচনাস্থল নয়।(৪) 'Writing Biography'-র ভাষায় 'How do biographical studies relate to other forms of history' - তারই একটা রূপরেখামাত্র পেশ করতে চাইছি ইংরাজি-রবীন্দ্রজীবনীর নির্বাচিত উল্লেখে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল-পুরস্কৃত হওয়ার ফলে পশ্চিম গোলার্ধের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হলেন এও যেমন অনেকাংশে ঠিক, তেমনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে তাঁকে কেন্দ্র করেই প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সম্পর্কের বোঝাপড়া একটা নতুন মাত্রা পেল এ কথাও অনস্বীকার্য। উপনিবেশের ইতিহাসও সেখানে নিতান্ত গরহাজির নয়!
ইংরাজিতে লেখা বিদেশি জীবনীকারদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় আর্নেষ্ট রীজের (Ernest Rhys) নাম। ১৯১৫ সালে নিউইয়র্কের 'দ্য ম্যাকমিলান কোম্পানি' থেকে প্রকাশিত তাঁর রবীন্দ্রজীবনী গ্রন্থটির নাম 'Rabindranath Tagore : A Biographical Study' । ১২টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত রীজের বইটি আসলে যুগপৎ রবীন্দ্র-জীবন ও সাহিত্যের আলোচনা। রবীন্দ্র-জীবনের আলোচনায় সাহিত্যের আলোচনা আবশ্যিক এবং সব রবীন্দ্র-জীবনীতেই এই শর্ত সংগতভাবেই গুরুত্ব পেয়েছে। মনে রাখতে হবে, ইংরেজি গীতাঞ্জলিই শুধু নয়, ইংরাজি জীবনী-রচনার সময়ে জীবনস্মৃতি, রাজা, সাধনা, 'The Gradener' ইত্যাদি ততদিনে ইংরাজি-জানা মানুষের হাতে পৌঁছে গেছে; যদিও সমসময় পর্যন্ত প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের বাংলার তুলনায় তা নিতান্তই সামান্য। রচনার ভিন্দেশি এবং ভিন্ভাষী সমালোচকদের এই বাস্তব প্রতিবন্ধকতাটুকু আমাদের মেনে নিতেই হবে। তথ্যের ক্ষেত্রে রীজ বিশেষভাবে নির্ভর করেছেন 'জীবনস্মৃতি'-র উপর; আর তথ্যের জন্য 'জীবনস্মৃতি' যে সর্বাংশে নির্ভরযোগ্য নয়, সেকথা রীজের সময়ে বুঝতে পারা খুব সহজ ছিল না। অনেকক্ষেত্রেই সময়-অনুক্রমে রীজ বিভ্রাট ঘটিয়েছেন। কিন্তু রীজের বইয়ের বৈশিষ্ট্য অন্যত্র। একজন পাশ্চাত্যের মানুষ কিভাবে ভারতীয় সংস্কৃতিকে বুঝতে চাইছেন এবং সেইসূত্রে রবীন্দ্রনাথকে পরিগ্রহণ করতে চাইছেন সেই দিকটিই বিশেষভাবে নজর করার! প্রাচ্যের এক সন্তপ্রতিম কবিকে কিভাবে প্রতীচ্য গ্রহণ করেছিল আর সদাব্যস্ত প্রতীচ্য-নগর সম্পর্কেই বা কোন ধারণা নিয়ে কবি স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন - রীজের কাছে সেই জিজ্ঞাসা বিশেষ গুরুত্ব পায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলন-ভাবনাও রীজের ভাবনা জগতের অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে।
রীজ তাঁর বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় শুরু করেন চৈতন্যচরিতামৃত, উপনিষদ কিংবা হাফিজের মতো প্রাচ্যের কোনো প্রখ্যাত কাব্য বা শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে। আর তাঁর চেতনায় বৈষ্ণব পদাবলিই যে সবচেয়ে উজ্জ্বল তা 'Some Indian Poets' অধ্যায়ে খুব স্পষ্ট হয়ে যায়। দীনেশচন্দ্র সেনের উল্লেখ তিনি বারবারই করেছেন তাঁর বইতে; এ তারই প্রভাব কিনা বলা মুশকিল। তবে অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে এ কথা অবশ্য বলাই যায়, রীজ তাঁর বইতে গীতাঞ্জলি The Gardener ইত্যাদি কাব্যের আলোচনাসূত্রে আসলে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য নন্দনের একটা তুলনা-প্রস্তাব পেশ করতে চেয়েছেন। তাঁর মনে হয়, একজন প্রাচ্য কবি তাঁর মিষ্টিক চেতনায় যেভাবে প্রকৃতি আর অতিপ্রকৃতির সীমানা বিলোপ করে দিতে পারেন পাশ্চাত্যের জ্ঞানমার্গে তা কিছুতেই হওয়ার নয়। প্রকৃতির সঙ্গে একজন ভারতীয়ের যোগ আজন্ম; এবং জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত সে যোগ থাকে অটুট। একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে ব্যাখ্যা করছেন কথাটা এইভাবে রীজ, 'Water means so much in India; ' - মৃত্যুর আগে এক ফোঁটা গঙ্গাজল প্রত্যাশা করে একজন হিন্দু ভারতবাসী। 'Fancy an Englishman languishing for a drop of Thames water on his death bed!' (p 26-27)
একইভাবে রীজ বোঝাতে চান রবীন্দ্রনাথের মতো কবি যখন আকাশের নীলিমার সৌন্দর্যের ছবি আঁকেন কবিতায় তখন তাঁর সে চেতনার মূলে থাকে বৈষ্ণব পদাবলি থেকে প্রাপ্ত আজন্মের এক সাংস্কৃতিক সংস্কারের উত্তরাধিকার। 'It is with a sky like that whose blue radiance filled Radha with ecstasy stretched over its trees and pools and cows' pastures' (p.27) আধুনিক পরিভাষায় অনুবাদ করে নিলে রীজ যা বলতে চাইছেন তার বীজগর্ভ বাক্যটি হতে পারে 'রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি চেতনার মধ্যেও রয়ে গেছে বৈষ্ণব পদাবলি ও নন্দনের যৌথ মগ্নচৈতন্যের (collective unconscious) প্রতিভাস।' বলাই বাহুল্য, রীজের সঙ্গে তর্কে অনেকে ভিন্ন মত পোষণ করতেই পারেন; কিন্তু প্রাচ্য অনুসন্ধানে কিভাবে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করছেন সেই দিকটিই তাতে প্রকাশ পায়। রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, বিবেকানন্দের প্রতি পর্যায়ক্রমিক এষণায় যেমন রম্যাঁ রলাঁ আসলে নির্মাণ করে বলতেন কল্পনায় আদর্শায়িত ভারতবর্ষকে;(৫) এবং সমকালীন বিশ্ব পরিস্থিতির জন্য তা যেমন ছিল প্রতাপী রাজনীতির প্রতিবয়ান - তেমনভাবেই, লিখন-রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে রীজের বা এডওয়ার্ড থমসনের রবীন্দ্র-জীবনী রচনার একটা পাঠ গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে হয়।
কিটস্, ব্রাউনিং প্রমুখ থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অধমর্ণ একথা বলেও থমসন ১৯২১ সালেই স্বীকার করে নিচ্ছেন মোটের উপর পাশ্চাত্যের কোনো লেখকই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনীয় নন। 'Author's Preface'-এ একথা বলেই থমসনের আক্ষেপ 'the poet is misunderstood in the West - is underpraised, by some over praised.' হতে পারে, বাংলা দেশের জল-হাওয়ার সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল বলেই থমসন পশ্চিমের রবীন্দ্র মূল্যায়নের ফাঁক-ফোকর গুলো খানিকটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
নামে থমসনের বইটি 'Rabindranath Tagore : His life and work' (YMCA Publishing House, 1921) হলেও 'জীবনী'-কথা এ ক্ষেত্রেও যত্কিঞ্চিৎ এবং তাও আবার প্রমাদ আকীর্ণ! তথ্যের দিকে তাঁর এতটাই অমনোযোগ যে পুনর্মুদ্রণের সময় 'Author's Preface' -এর বয়ানে নতুন প্রসঙ্গ যোগ হয়েছে কিন্তু তারিখ রয়ে গেছে পুরনো। ১৯২১ সালে যে ১৯৩১ সালের কথা বলা কতটা অসংগত তাও খেয়াল করেননি থমসন! কিন্তু থমসনের মুন্সিয়ানা হল রবীন্দ্র-সাহিত্যের মূল্যায়নে। এ ব্যাপারে তাঁর প্রধান অবলম্বন হয়েছেন অজিতকুমার চক্রবর্তী। রীজ পাঁচহাজার বছরের একটা বিরাট প্রেক্ষাপট হাজির করেছিলেন কিন্তু থমসন আলাদাভাবে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন (??)এর তাত্পর্য ও বিশেষত্ব বোঝবার চেষ্টা করেছেন। 'ক্ষণিকা' যে লঘুকথার মোড়কে গহন হৃদয়বেদনার কাব্য এবং এ কাব্য অনুধাবনে স্বরভঙ্গির বিশেষত্বটি লক্ষ্যে রাখতে হয়, এ কথা ১৯২১ সালে ক'জন রবীন্দ্রভক্ত বুঝতে পেরেছিলেন? কিংবা উনিশ বিশ শতকের সন্ধিকালে রবীন্দ্রনাথের হিন্দুত্ব-গর্বী, প্রাচীন ভারত-ধন্য মানসিকতাকে তাঁর পূর্ববর্তী শিলাইদহ পর্বের 'real' জগৎ থেকে 'temporary eclipse' বলে যখন উল্লেখ করেন তিনি, তখন বোঝা যায় থমসন রীজের মতো আবেগ-ব্যাকুল নন; তুলনায় থমসন অনেক বেশি 'ক্রিটিকাল'। ১৮৯৭ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত রবীন্দ্র-জীবনের এই 'রাহুগ্রস্ত' পর্ব সম্পর্কে থমসনের ব্যাখ্যা হল : রবীন্দ্রনাথের জীবনের এই সাময়িক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবোধের অতিশয়িতা রিচার্ড জেফারিসের সঙ্গে তুল্য। জেফারিসের 'story of my heart'-এর মতোই এও নিতান্ত কবিজনোচিত! শিল্প কখনো ধর্মের জায়গা নিতে পারেনা এবং এই দুইয়ের অবস্থান ভিন্নকোটিতে এ কথাটা থমসন স্বীকার করে নিচ্ছেন এবং সেই নিরিখেই রবীন্দ্রনাথকে পড়বার চেষ্টা করেছেন তিনি। 'Art can never take the place of spiritual life' (p. 24) - এই কথাটার একটা অন্য ঐতিহাসিক তাত্পর্য আছে ঔপনিবেশিক পর্বের ভারতীয় শিল্প-ইতিহাসের নিরিখে। উনিশ শতকের শেষ দুটি দশক এবং বিশ শতকের গোড়ার দুটি দশক জুড়ে 'ভারতীয় শিল্প মানে আধ্যাত্মিকতা' - এমন একটা ভাবনা চারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছিল। কুমারস্বামী, ওকাকুরা, নিবেদিতা, শ্রীঅরবিন্দ প্রমুখ অনেকেই কোনো না কোনো দিক থেকে এই ভাবনার শরিক হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এবং বাগেশ্বরী পর্বের অবনীন্দ্রনাথ শিল্পের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার অভেদত্ব অবশ্য মেনে নিতে পারেননি; কিন্তু রবীন্দ্র-কাব্যে, সাহিত্যে এই আধ্যাত্মিকতার অনুপস্থিতি বিশ শতকের প্রথম প্রহর পর্যন্ত নানা মহলে বিশেষ নিন্দিত হয়। থমসন কি শিল্প আর আধ্যাত্মিকতার প্রসঙ্গ তোলবার সময় এই গোটা প্রেক্ষাপটটিকে স্মরণে রাখছিলেন? তা-ই যদি রেখেই থাকেন তাহলে বলতেই হয় বইয়ের অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে তিনিও একই রকম বিচার বিভ্রাট ঘটিয়েছেন! রবীন্দ্রনাথের 'যাবে গো দিন যাবে' গানটিকে রামপ্রসাদের 'The day will surely pass, mother..' (থমসন-কৃত অনুবাদ) থেকে 'চুরি' ('The super theft of Rabindranath') বলে তা নইলে কেনই বা মনে হবে তাঁর। রামপ্রসাদ আর রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর অনুরক্তি যে এক জাতের নয় তা তো থমসনের না জানার কথা নয়।(৬) রবীন্দ্রনাথের 'জীবন দেবতা' যে 'not god, but simply as the revelation of god' এবং তার সঙ্গে সক্রেটিসের 'daemon', প্লেটোর 'idea', কোয়ার্কারের 'Inner Light'-এর তুলনা চলে তা তো আগেই বলে এসেছেন থমসন! আমাদের মনে হয়, নোবেল-উত্তর পর্বে স্বদেশে এবং বিদেশে রবীন্দ্রনাথের যে প্রতিমূর্তি গড়ে উঠছিল থমসন সেই জায়গাটায় একটা আঘাত করার প্রয়োজন অনুভব করছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথকে বাস্তবোচিত ভাবে উন্মোচন করার জন্য। থমসনের প্রয়োজন ছিল আধুনিক সময়ের 'বাণীবিনোদ'(৭) এক কবি রবীন্দ্রনাথের; সন্ত রবীন্দ্রনাথের নয়। থমসনের লেখা জীবনী গ্রন্থটি থেকে অবশ্য নিশ্চিতভাবে এ কথা বলবার যথেষ্ট উপাদান পাওয়া যায় না; এবং উপনিবেশের রাজনীতির কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু তাঁর সান্নিধ্য-ধন্য এবং এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ (নাকি পুনর্মুদ্রণ?)-এর গ্রন্থপঞ্জিকার কালিদাস নাগের একটি টীকা মন্তব্য থেকে বোঝা যায় (p. 90) অন্য ব্রিটিশ রবীন্দ্র-অনুরাগী অতিথিদের মতো থমসন সাহেবও রবীন্দ্রনাথকে উপলক্ষ করে আদতে 'helped the cause of Indo - British understanding in the most critical period of Indian History.' কালিদাস নাগ এ কথা লিখছেন ১৯৩১ সালে। রবীন্দ্র-থমসন সম্পর্কের উচ্চাবচতার অনেক কথা এর মধ্যে জমা হয়েছে,(৮) সে আলোচনা ভিন্ন। আসলে রবীন্দ্র-থমসন সম্পর্কের একটি অধ্যায় মাত্র আমাদের আলোচ্য জীবনী গ্রন্থটি, তার বেশি প্রত্যাশা এর থেকে করাও চলে না।
এই দুই বিদেশির পাশে প্রায় সমকালে (১৯১৫) প্রকাশিত একজন প্রবাসী বাঙালির লেখা রবীন্দ্র-জীবনী রেখে দেখা যেতে পারে জীবনী রচনার ক্ষেত্রেও ঔপনিবেশিক চেতনা উপনিবেশিতের মনে কিভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। বসন্তকুমার রায়ের 'Rabindranath Tagore : The Man and his Poetry' বইটি হ্যামিলটন ডব্লু. ম্যাবল্-এর ভূমিকাসহ নিউইয়র্ক থেকে (Dodd, Mead & Co.) প্রকাশিত হয়। বসন্তকুমারের বইটি এককথায় প্রতীচ্যের কাছে রবীন্দ্রনাথকে প্রাচ্যের প্রতিভূ হিসেবে উপস্থাপন, যে উপস্থাপনায় মিশে থাকে অনেকখানি গৌরব এবং আত্মশ্লাঘা। নোবেল পুরস্কার-জয়ী রবীন্দ্রনাথের জন্য বসন্তকুমারের পুলকিত উদ্দীপনা গোটা বইতে ছড়িয়ে আছে। সেই সময় পশ্চিমের কাব্যজগতে যে অবক্ষয়ের পালা শুরু হয়েছে সে কথাও 'Prefatory Note'-এ উল্লেখ করতে হয়তো এজন্যই উত্সাহ বোধ করেছেন বসন্তকুমার। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের উপর জুলাই ১৯১৩-তে তিনিই প্রথম ইংরাজি ভাষায় নিবন্ধ লিখে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় তাঁর পরিচায়ন পর্ব শুরু করেছিলেন এমন দাবিও জানিয়ে রাখেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ইংরাজি ভাষায় তাঁর লেখা বেশি বেশি অনুবাদ করুন এই আর্জিও তিনি নাকি পেশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে; এমনকি এও তিনি বলে রেখেছিলেন, 'I feel absolutely certain that you will sooner or later win the Nobel Prize for poetry. ... will be a step forward for international brotherhood and world peace.' (p. 191) বসন্তকুমারের বয়ানে রবীন্দ্রনাথের জন্য গর্ববোধ যেমন আছে তেমনি সেই ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বশান্তির জন্য সদিচ্ছাও রয়েছে। যেন রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজয়ের মাধ্যমে হয়ে উঠতে পারে ঈপ্সিত কোনো সেতুবন্ধন! বসন্তকুমার মনে করতেন, 'When the West discovers the East, and the East discovers the West humanity will discover itself automatically.' (p.194) এই সমন্বয় ভাবনার ক্ষেত্রে প্রাগুক্ত দুই পশ্চিমি রবীন্দ্র অনুরাগী, এমনকি রম্যাঁ রলাঁর মতো আরো কোনো কোনো মানব-হিতৈষীর সঙ্গে বসন্তকুমারের ভাবনার একটা ঐকতান উপলব্ধি করা যায়। যদি বসন্তকুমারের বয়ান যথার্থ হয় তাহলে বসন্তকুমারের প্রস্তাবের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন তাও বিশেষভাবে উল্লেখ্য। কিপলিঙের পুরস্কার-প্রাপ্তি আর জগদীশচন্দ্র বসুর অপ্রাপ্তির প্রসঙ্গ নাকি রবীন্দ্রনাথ প্রত্যুত্তরে উথ্থাপন করেছিলেন। বসন্তকুমারের প্রতি-প্রত্যুত্তর ছিল 'The continantal Europeans have no prejudice.' (p.192) বাকি ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি আর ব্রিটেনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে তফাত আছে। বসন্তকুমারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কৃষ্ণ কৃপালনি রবীন্দ্রনাথের 'সংশয়'-এর বাস্তব ভিত্তি বিচার করেছেন তাঁর 'Rabindranath Tagore : A Biography' (Visva-Bharati) বইয়ের দ্বিতীয় পরিমার্জিত সংস্করণ-এ (১৯৮০)। কৃপালনি লিখেছেন, 'perhaps the doubt was not so naire after all, for when the prize did come, there were rumblings of protest in many quarters of the West that an Asian had received it.' (p.235) মার্টিন কেম্পশেনের পূর্বোল্লিখিত বইতেও এ বিষয়ে জার্মানির মিশ্র প্রতিক্রিয়ার পরিচয় পাওয়া যায়। সে যাইহোক, রবীন্দ্রনাথ বসন্তকুমার নিভৃত দ্বিরালাপের তথ্যমূল্য যদি নাও থাকে তবু উপনিবেশিত জাতির অন্তর্বেদনার সত্যমূল্য তাতে অনভিব্যক্ত থাকে না। বসন্তকুমারের বইয়ের ভূমিকা লেখক হ্যামিলটন সাহেবের কথার মধ্যে ঔপনিবেশিক পর্বের পুরস্কার-রাজনীতির সমালোচনা আছে পরোক্ষে। প্রাচ্যানুরাগী হ্যামিলটন লিখেছেন, 'The West has exploited the East too long...' (p.18) ভূমিকায় ব্যক্ত হ্যামিলটনের এই প্রাচ্য-ভাবনা গ্রন্থকার বসন্তকুমারেরই পরিপূরক বক্তব্য বলে মনে হয়। তিনি লিখছেন, 'Tagore's work is deeply rooted in the soil of oriental religion and civilisation ... therefore uncompromisingly oriental.' (p.19) বোধকরি, এও একরমের 'orientalism' - হয়তো এডওয়ার্ড সাইদের 'orientalism' নামক ডিসকোর্সের সমান্তরাল এক প্রাচ্য বয়ান!
বসন্তকুমারের রবীন্দ্র প্রকল্প বোঝবার জন্য তাঁর বইটির অধ্যায় বিন্যাসের দিকেও দৃকপাত আবশ্যক। এমনিতে তাঁর বইয়ের প্রস্তাবিত ৯টি অধ্যায়ের মধ্যে খুব সুস্পষ্ট কালক্রম রক্ষিত হয়নি। দ্বিতীয় অধ্যায় যদি হয় 'Romantic Youth - Realistic poems; ' তবে পঞ্চম অধ্যায়ের নাম হয় - খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই 'Tagore the Feminist.' আমাদের বিবেচনায় অধ্যায়ের এই জাতীয় নামকরণ বিশেষ তাত্পর্যবাহী। আসলে, রবীন্দ্রনাথ যে একজন 'Realistic Poet' ও - এবং তাঁর 'Feminism' যে সেই সময়ে পাশ্চাত্যে ঘনিয়ে ওঠা সাফ্রোজিট আন্দোলনের ঢের আগে প্রাচ্য মূল্যবোধের আধারে গড়ে উঠেছে, এই বার্তাগুলোই পশ্চিমের কাছে সগর্বে তুলে ধরতে চান বসন্তকুমার। নারীবাদী আন্দোলনের সামাজিক জিজ্ঞাসা এক সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধানে উপনীত হতে পারে রবীন্দ্রনাথের প্রজ্ঞাময় দৃষ্টিভঙ্গির অনুসরণে, বসন্তকুমার ঠারেঠোরে একথাটাই যেন বোঝাতে চান। নইলে তথ্যের জন্য কেই বা পড়তে যাবেন বসন্তকুমার? তাঁর তথ্যভ্রান্তি অতুলনীয়। যাঁরাই দেখি রবীন্দ্রনাথকে কোনো না কোনো আইডিয়ার দিক থেকে 'নির্মাণ' করে নিতে চান, তাঁদেরই তথ্যভ্রান্তি বিস্তর।(৯) এ কথা ঠিকই সে সময় পর্যাপ্ত তথ্যের তেমন সূত্রই বা কোথায়? সে কথা নয়, আসলে তথ্য যে তেমন অগ্রাধিকারই পাচ্ছে না এই সব জীবনীতে, পড়তে পড়তে সেরকম একটা উপলব্ধি হয়। আর এক্ষেত্রে সত্যিই পূর্ব-পশ্চিমে কোনো তফাত নেই! ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের 'Tagore - A Study' (Padma Publication Ltd., Bombay, 2nd ed. 1944) বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়। ধূর্জটিপ্রসাদের বইটির আলোচনার গুরুত্ব অবশ্য অন্য দিক থেকে।
নোবেল-পর্বে যেমন ইংরাজি রবীন্দ্র-জীবনী রচনার একট তরঙ্গ এসেছিল তেমনি খুব সংগত কারণেই কবির প্রয়াণ পর্বেও তেমন একটা আগ্রহ সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু ১৯১৩-১৫ আর ১৯৪১-৪৪ এর ঐতিহাসিক বাস্তবতা ভারত তথা গোটা বিশ্বেই বদলে গিয়েছে অনেকখানি। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ততদিনে সাধারণ্যে একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছে। স্বদেশবাসীর মনে নোবেল-উচ্ছ্বাস তখন অনেকটাই স্তিমিত। বাংলা দেশের শিল্প সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রগতি-আন্দোলনের সূত্রে একরকম বুদ্ধিবাদী চর্চার পরিসর ততদিনে গড়ে উঠেছে। আধুনিকতার প্রশ্নেও রবীন্দ্রনাথকে পুনর্বিচার করার একটা প্রক্রিয়া চলেছে তখন। ঠিক সেই প্রেক্ষিতে একজন বাঙালি বুদ্ধিজীবী শিরোমণি কিভাবে প্রয়াণ-উত্তর রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন করছেন সেই দিকটিই আমাদের অভিনিবেশ দাবি করে। ধরে নেওয়া যেতে পারে এ বইয়ের target reader মূলত অবাঙালি ভারতীয়রা। তাঁদের সামনে ধূর্জটিপ্রসাদ রবীন্দ্রনাথের একটা 'synoptic view' তুলে ধরতে চান। ১৬১ পৃষ্ঠার ত্রক্রাউন সাইজের এই বইটিতে জীবনীর জন্য বরাদ্দ হয়েছে মাত্রই ১৩-৬৬ পৃষ্ঠা। সুতরাং জীবনী হিসেবে বইটি অকিঞ্চিত্কর কিন্তু বিশ্লেষণে এমন কতকগুলি দিকে লেখক অঙ্গুলি-সংকেত করেছেন যা আমাদের প্রতিপাদ্যের নিকটবর্তী।
মার্কস-তাত্ত্বিক ধূর্জটিপ্রসাদ প্রথমেই সাব্যস্ত করে নেন 'রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময় এবং প্রতিবেশের সৃষ্টি'। স্বকীয় প্রজ্ঞার আলোকে এবং অন্তর্জীবনের বিশিষ্ট বোধে তিনি আধুনিক ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের স্বয়ম্প্রভ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। উপনিষদ নিশ্চয়ই তাঁর জীবনের ভিত্তিভূমি; আর সে জন্যই তাঁর জীবনে কোনো 'নাটকীয়তা' নেই। উপনিষদ যাঁর মর্মে তিনি হয়ে উঠতে পারেন না - যাকে বলে 'চরিত্র'; হতে পারেন না প্রচলিত অর্থে যাকে বলে 'দেশপ্রেমিক'। কেননা, উপনিষদের চিন্তা-চেতনা জুড়ে বিরাজ করে একরকম বৈশ্বিক সংগতি-বোধ। ধূর্জটিপ্রসাদ উপনিষদের সন্তান এই রবীন্দ্রনাথকে খুঁজতে চান তাঁর জীবন-ভাষ্যে। তিনি এও বিশ্বাস করেন যে, 'Tagore's life-history is mainly the biography of ideas and artistic creations...' (p. 15) পাশ্চাত্যের জীবনী রচনার আদর্শে যে রবীন্দ্রনাথের আত্মময়তা (Subjectivity)-র স্বরূপ বোঝা যায় না এবং এজন্য প্রয়োজন ভিন্ন এক জীবনী রচনার 'model'- এ কথাও বলতে ভোলেন না ধূর্জটিপ্রসাদ। ধরে নেওয়া যায়, ধূর্জটিপ্রসাদ এই বইতে জীবনী রচনার পশ্চিমী আদলের একটি বিকল্প প্রতিমানই হাজির করছেন। কেমন সেই প্রতিমান? সংগীত-তাত্ত্বিক ধূর্জটিপ্রসাদ সংগীতের উপমান নিয়ে বলছেন, 'Tagore's life-pattern is essentially melodic, with numerous improvisations indeed, but it was built round the regiant notes.' (p. 15) প্রতিতুলনায় আনছেন জার্মানির বহুকর্মা ব্যক্তিত্ব গ্যেটের জীবনকথা। গ্যেটের জীবন হল 'symphonic pattern'-এর। সকৌতুকে লক্ষ্য করি, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য জীবনধারার মূল কাঠামো নিয়েই এখানে প্রকারান্তরে প্রশ্ন তুলছেন ধূর্জটিপ্রসাদ আর তাতে 'আমরা ও তাঁহারা'-র একরকম মেরুকরণ ঘটে যাচ্ছে। এ তো গেল আঙ্গিক-প্রকরণের দিক থেকে ধূর্জটিপ্রসাদের ব্যাখ্যান, অন্য আর এক দিক থেকেও অর্থশাস্ত্রী এই পণ্ডিত-লেখক প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের তুলনা এনেছেন তাঁর বইতে।
সবাই জানেন ঔপনিবেশিক শোষণের প্রতিরোধে একরকম বিকল্প অর্থনীতির ভাবনা ছিল রবীন্দ্রনাথের। 'স্বদেশী সমাজ' সেই ভাবনারই ফসল। এই বিষয়ে ধূর্জটিপ্রসাদের বক্তব্য হল, 'Tagore's economics were mainly confined to consumption; they did not, could not, extend to production and its relation; therefore, they excluded the history of production and distribution. And here again was his Indianness. But the Indians wanted him to be an Indian in another way, and so did the West; only the two ways did not meet. How could they? (p. 45-46) ধূর্জটিপ্রসাদের এই ব্যাখ্যা কতদূর গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের রবীন্দ্র-নির্মাণ ও রবীন্দ্র-পরিগ্রহণের প্রশ্নে অর্থনীতিও যে একটা সম্ভাব্য সূত্র হয়ে উঠতে পারে সেকথা সম্ভবত তাঁর আগে আর কেউ বলেননি। স্থান-কাল চেতনার রবীন্দ্রীয় প্রতীতি প্রসঙ্গেও একইভাবে ধূর্জটিপ্রসাদ প্রাচ্য-পাশ্চাত্য চিন্তন-কাঠামোর একরকম তুল্যতা বিচার করেন। তিনি মনে করেন, 'Tagore's notion of space was not exactly romantic in the European sense; but it was rather classical in its correspondence with the ultimate peace, Shanti. Space was built into the structure of his soul; his soul's urge was for spaciousness - ঢচ্ণ্ণস্ছ. ঝত্র ংঈছবঞ, যৃছবং ংঋণ্ণযচ্ংয ঢছবূ ঞঠস্ং ঠত্র মছভধশং.' (ংঋ. ২৪) ধূর্জটিপ্রসাদের রবীন্দ্র-ব্যাখ্যানে এরকম স্থানে স্থানে তর্ক-সম্ভব উক্তির ছড়াছড়ি; যা একই সঙ্গে চিন্তা-উদ্দীপকও বটে।
সে আলোচনা অন্যত্র হতে পারে। আমরা আলোচনা শেষ করব গত শতকের নব্বইয়ের দশকের একটি বহু চর্চিত, বহু পঠিত রবীন্দ্র-জীবনী প্রসঙ্গে দু-চার কথা বলে। সময়ের এত বড় উল্লম্ফন কেন - সে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। আসলে আমরা বোঝবার চেষ্টা করছিলাম রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর বাদে ইংরাজিতে রবীন্দ্র-জীবনীর নমুনা ঠিক কী রকম হতে পারে? অথবা, বলা ভালো, উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে আমাদের চিন্তাসূত্র গুলি আর একবার মেলে ধরলে কেমন দেখায়? বইটি হল কৃষ্ণা দত্ত ও অ্যাণ্ড্রু রবিনসন কৃত 'Rabindranath Tagore - The Myriad-minded man.'। লেখকদের একজন প্রবাসী বাঙালিনী অধ্যাপক আর একজন পশ্চিমের টেলিভিশন জার্নালিস্ট ও বহু গ্রন্থের প্রণেতা। শেষোক্ত জনের আর একটি বিশেষ 'দুর্বলতা' - তিনি বাঙালি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রবল অনুরাগী। সে যাইহোক, এই বইটির আবির্ভাব মাত্রে আমাদের এই প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে পাশ্চাত্যের নথিখানায় রক্ষিত এখনো পর্যন্ত অনুদ্ঘাটিত তথ্যে আমাদের রবীন্দ্র-চর্চা আলোকিত হয়ে উঠবে হয়তো। সে প্রত্যাশা একেবারেই পূরণ হয়নি একথা বলাও খুব সংগত হবে না। Rupa & Co. থেকে প্রকাশিত পেপারব্যাক সংস্করণের যে বইটি (Fifth Impression 2006) এই মুহূর্তে আমি ব্যবহার করছি, বহিরঙ্গে তা যথেষ্ট সম্ভ্রম জাগায়। বিশেষত, Research methodology -র আধুনিক সব রীতি-কানুন আপাতভাবে এখানে মেনে চলার অঙ্গীকারই উপলব্ধি করা যায়। আর ঠিক তারই গর্ভে কিভাবে প্রশ্রয় পেতে পারে গল্পগাছা (fiction) তারও চমত্কার দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে এই বইটিই। সে কথায় আসার আগে দেখা যাক, এই দুই লেখক কোন্দিক থেকে রবীন্দ্র-জীবনে আলো ফেলতে চাইছেন?
ভূমিকাতেই লেখক-দ্বয় স্পষ্ট করে দিচ্ছেন, 'Our primary focus in the man, not the oeuvre.'। কেননা, রবীন্দ্রনাথের জীবনে যত 'reputation' এবং 'ramification' আছে তার একটা তন্নিষ্ঠ আলোচনা জরুরি। তাঁদের অভিযোগ কৃষ্ণ কৃপালনির মতো রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় এবং অনুগত ('too loyal') জীবনীকার কবির জীবনকে তাঁর কাব্যের মতো 'মহৎ ও ছন্দোময়' বলে সরলীকৃত করেছেন। তা একইসঙ্গে 'misleading and grotesque.' (p. 15)। তাহলে আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি, দত্ত-রবিনসন আমাদের সামনে তুলে ধরবেন এক সংঘাতময়, সংক্ষুব্ধ রবীন্দ্র-জীবনকে। সে চেষ্টার অবশ্য কসুর করেননি তাঁরা, কিন্তু যে-ভাবে তাঁরা পৌঁছেছেন তাঁদের 'ঈপ্সিত' সিদ্ধান্তে প্রশ্ন তাই নিয়ে। দু-একটি নমুনা পেশ করা যাক। সবাই জানেন 'গোরা' চরিত্র পরিকল্পনায় সিস্টার নিবেদিতার ছায়াপাত হয়ে থাকতেও পারে। এও সবাই জানেন 'গোরা'-র ট্রাজিক পরিসমাপ্তিই ঘটিয়েছিলেন প্রথমে রবীন্দ্রনাথ; নিবেদিতার অনুরোধে-উপরোধে শেষ পর্যন্ত তা মিলনান্তক হয়। বনফুলের 'রবীন্দ্রস্মৃতি' পড়লে গোটা ব্যাপারটাকে মোটেই তত serious মনে হয় না। কিন্তু দত্ত-রবিনসন বিষয়টিকে উপস্থাপন করছেন এইভাবে : 'Tagore admired Sister Nivedita's devotion to India and her love for Indians, but found her narrow-minded. She, for her part, was angry with his story, telling him that he did wrong to Hindu women.' (p. 154)। বনফুলের স্মৃতিকথা না-হয় বাদই দিলাম, পিয়রসনকে লেখা ১৯২২ সালের এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ কী লিখলেন তা তো একবার দেখা যেত এই সূত্রে! লেখকদ্বয় 'angry' শব্দটির কাছাকাছি 'request' শব্দটাও সেখানে দেখতে পেতেন। (না কি দেখেও দেখেননি!)। এর পর রয়ে গেল ঐ 'narrow-minded' শব্দটা। এডওয়ার্ড থমসনের বিতর্কিত ডায়েরি এবং সেইসূত্রে রবীন্দ্র-নিবেদিতা সম্পর্কের চর্চার ইতিহাস যাঁদের জানা আছে, তাঁরাই বুঝতে পারবেন কোথা থেকে ঐ শব্দবন্ধটি নেওয়া হয়েছে। অথচ এমন একটা 'methodical' বইতে এসব প্রসঙ্গে কোনো তথ্যসূত্র নেই! এভাবেই তথ্যকে সুবিধামতো বাঁকিয়ে-চুরিয়ে 'গল্প' বানানোর খেলা বহু পুরনো; কিন্তু এক্ষেত্রে গোটা ব্যাপারটাই সাজানো হয়েছে গবেষণার সুদৃশ্য মোড়কে। এরকম লোকলোভন মন্তব্য অসংখ্য ছড়িয়ে আছে গোটা বই জুড়ে! যেমন, 'Rabindranath did not nurse Mrinalini for two months day and night, as loyally claimed by his biographer Kripalani, he remained absorbed in the running of school.'... (p. 137) এ কথার কী উত্তর হয়? 'নার্সিং' বলতে ঠিক কী বোঝাতে চান তাঁরা জানিনা তবে পত্নীর নিদারুণ অসুস্থতার মধ্যে ২৭ কার্তিক, ১৩০৯ (মৃণালিনীর মৃত্যুর দু-সপ্তাহ আগে) তারিখে কুঞ্জলাল ঘোষকে লেখা চিঠিটি পড়েও যদি কেউ এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছন তাহলে বলার কিছু থাকে না। শুধু তাই নয়, লেখকদ্বয় বিস্মিত হয়েছেন এই দেখেও যে 'After she [Mrinalini] died on 23 November, he [Rabindranath] showed no visible emotion and soon returned to Shantiniketan.' (p. 137) রবীন্দ্র-দর্শনে নিদারুণ অজ্ঞতার জন্যই কি এই সরল মন্তব্য? না, অতটা শিশু ভাবার কারণ নেই তাঁদের। তাঁরা আসলে জীবনীর তলে তলে একটা গল্পের প্লট বুনে চলেছেন, এ হল তারই কার্য-কারণে সূত্রান্বিত। কেননা তাঁদের দাম্পত্য যে 'miss-matched' এ কথাই যে বড় করে দেখাতে হবে! কেন দেখাতে হবে? কারণ, এ বইয়ের উদ্দেশ্যই যে দশ বছরের গবেষণায় রবীন্দ্র-চরিত্রের 'contradictions' দেখানো এবং সেইসূত্রে রবীন্দ্রনাথের ভিতর এক অযুতমনা (myriad-minded) রবীন্দ্রনাথকে উন্মোচন করা। কিন্তু মনের ভিতর মনের খোঁজ তাঁরা পাননি, কিংবা পেতে চানওনি। রবীন্দ্রনাথ '৩৬ সালে; - শুধু বিশ্বভারতীর মুখ চেয়ে নাটকের দল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নাকি - তার ভিতরে তাঁর শিল্পীমনের একটা প্রণোদনাও কাজ করছে, দত্ত-রবিনসন সে দিকটা খোঁজ নেবার প্রয়োজনও বোধ করেননি। পরিবর্তে বিড়লাদের কবিকে ষাটহাজার টাকা সাহায্য প্রসঙ্গে রসিকতা করে বলেছেন, "This was roughly the same amount Tagore had raised in just one meeting in 1905 for the National Fund, much less than that in real terms. If only Tagore had permitted himself to become a 'patriot'!" (p. 320). ছেলেমানুষি চূড়ান্ত সীমা ছাড়িয়ে যায় যখন বলা হয়, 'Tagore is reminiscent of the big-hearted Apu Trilogy (1955-59); the older Tagore of Ray's last film, Agantuk (The Stranger, 1991), with its sublime synthesis of wit and profundity.' (p. 354)। দু:সাধ্য গবেষণা বোধহয় একেই বলে? শ্রদ্ধেয় সত্যজিৎ রায় কিংবা নীরদ সি. চৌধুরীর একরকম রবীন্দ্র-পাঠ থাকতে পারে কিন্তু তাঁদের চশমায় দেখলেই যে সে দেখাটা 'চূড়ান্ত দেখা' - তাইবা মনে হবে কেন? ঠিক এই জায়গাতেই বিশ শতকের গোড়ার তিন দশকের পাশ্চাত্যের ভারত প্রকল্পনার সঙ্গে এই সময়ের আশ্চর্য একটা মিল দেখতে পাই। আজও ভারতবর্ষকে চিনতে চাওয়া হবে সত্যজিত্-নীরদচন্দ্রের মতো দু-একজন ইংরেজি-নবিশ বাঙালির দৌত্যে? রবীন্দ্রনাথের 'মল্লিনাথ' কেবলই এঁরা - কতিপয় কেতাদুরস্ত রবীন্দ্র-গবেষকের বিবেচনায়? উপনিবেশের ভূত কি একেবারেই নামবার নয়? জীবনীতে ইতিহাসের পাশে কাহিনি সহাবস্থান প্রায়শই করে থাকে হয়তো, কিন্তু সবকিছুর ঊর্দ্ধে যেন প্রকাশ পায় উদ্দিষ্ট ব্যক্তির 'ব্যক্তিত্ব'। হারমিয়োন লী-ও বলেছেন 'Whether we think of biography as more like history or more like fiction, what we want from it is a vivid sense of person.' আক্ষেপ এই, 'myriad-minded' রবীন্দ্রনাথ এ বইতে অধরাই থেকে গেলেন। লেখকদ্বয়ের সগর্ব আয়োজন হয়ে উঠল নিতান্তই একটা 'ফ্যাশান'; দুর্ভাগ্যক্রমে হয়ে উঠতে পারল না - যাকে বলে 'স্টাইল'।
এর মূল যে শুধু পশ্চিমের মাটিতেই প্রোথিত এ কথা মনে করলে ভুল হবে। দীনেশচন্দ্র সেনের মতো ব্যক্তি যখন ১৯২২ সালে 'ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য' নামের আত্মজীবনী লেখেন তখন বাঙালি পাঠকের দরবারে তাঁর রবীন্দ্রভক্তির চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন অথচ ইনিই ১৯২১ সালে এডওয়ার্ড থমসনকে চুপি চুপি বলে আসেন উপনিষদের ভাবধারাটুকু ছাড়া রবীন্দ্রনাথ তো আসলে ইউরোপিয়ই! পাছে একথা রবীন্দ্রনাথের কানে যায় সেজন্যও সতর্কতা অবলম্বন করতে ভোলেন না দীনেশচন্দ্র। কিন্তু থমসন তা গোপন রাখেননি। এও বোধহয় একরকম উপনিবেশের রসায়ন। রবীন্দ্রনাথ ১৯২১ সালের অক্টোবরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে লেখা একটা চিঠিতে ঘরে বাইরে সংঘটিত অবমূল্যায়নের জন্য গভীর বেদনা ব্যক্ত করেছিলেন। প্রশান্তচন্দ্র সম্ভবত প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন থমসনের। কিন্তু ২৭ অক্টোবর ১৯২১ (১০ কার্তিক ১৩২৮)-এর একটি চিঠিতে সর্বংসহা রবীন্দ্রনাথ লেখেন, 'না, তুমি Thomson-এর মতের কোনও প্রতিবাদ কোরো না। সে তার নিজের বুদ্ধি অনুসারে যা বলেচে সে তার নিজেরই জিনিস - তার কাজ হচ্ছে নানা Source থেকে তথ্য ও মতামত সংগ্রহ করে সেগুলোকে তার আপনমনের ছাঁচে ঢালাই করে একটা মূর্তি খাড়া করে তোলা। ... টমসন আমার প্রতি অশ্রদ্ধার ভাব থেকে কিছু লেখেনি - ... আমার সঙ্গে আমার চারিদিকের যে সম্বন্ধ, সে সম্বন্ধে সম্প্রদায়গত, ব্যক্তিগত বা জাতিগত কারণে ও যদি ভুল বুঝে থাকে সে ভুলের জন্য ছট্ফট্ করবার দরকার নেই।' (১০)
আমরা রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের বিভা লক্ষ করি বরং এইখানে। History আর Fiction-এর ঊর্ধ্বে কবে আমরা পাব একখানি যুগপৎ তথ্য ও সত্যমূলক সম্পূর্ণ ইংরাজি রবীন্দ্র-জীবনী?