সিগারেটের ধোঁয়া শূন্যে ছুঁড়ে পলাশ একঝলক দেখে নিল গাছটা। ব্লীডিং হার্ট, একদম মানুষের হার্টের মতো ফুলগুলো। গোলাপী রঙের সাথে সাদা কম্বিনেশন। যেন বৃষ্টিস্নাত কোনো রমণী তার হৃদয় মেলে দিয়েছে। অথচ এই হৃদয় ছুঁয়ে দেখবার অধিকার নেই। পলাশ একটু দূর থেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল ফুলগুলো। একদিন দীপু ছোট্ট গাছটা হাতে দিয়ে বলেছিল ভালো থেকো পুলুদা। পলাশ একবার নিজের বর্তমানকে পড়ে নিয়ে ভাবল ভালোই তো আছে। রুমিকে নিয়ে বেশ গুছিয়ে সংসার করছে। আর ভালো থাকবে নাই বা কেন! কম কষ্ট তো পায়নি। পুরুলিয়ার সেই ছোট্ট গ্রামটিকে ভালোবেসেছিল পলাশ। কোনোদিন কি ভুলতে পারবে সেইসব কথা?
রাতের নরম আলোয় ছাদের বাগানটা নতুন করে সেজে ওঠে। এইসময় পলাশের মনও ভালো হয়ে যায়। ও নিজের হাতে প্রত্যেকটা গাছ লাগিয়েছে। দুবেলা পরিচর্যা করে। রুমি সারাদিন সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওর পক্ষে দেখাশোনা করা সম্ভব হয় না।
পলাশ মোবাইলের সুইচ অন করে দেখে নিল রাত এগারোটা বাজে। রুমির ফ্রেশ হতে এখনও একঘন্টা লাগবে। ততক্ষণ স্মৃতিতে ডুব দিয়ে সময় কাটাতে ওর খারাপ লাগে না। এইসময় চোখের সামনে কত পুরোনো ঘটনা ফুটে ওঠে ছবির মতো।
ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য এম.এ. পাশ করেছে পলাশ। ইচ্ছে ছিল গবেষণা করার। কিন্তু তার আগেই বাধ সাধল এস.এস.সি। পলাশের প্রথমে স্কুলে চাকরি করার ইচ্ছে ছিল না। কিছুটা মায়ের কথা ভেবেই রাজি হতে হল। বাবা মারা যাবার পর শুধু পেনশনের ওপর ভরসা করেই এতদূর পড়াশোনা করেছে। তাই অনিচ্ছা থাকলেও স্কুলে পলাশকে জয়েন করতে হবে।
পুরুলিয়ার বড়রা হাইস্কুল শুনে প্রথমেই ঠোক্কর খেয়েছিল কিছুটা। কীভাবে সম্ভব! এই কলকাতা ছেড়ে অত দূরে থাকা। তাও আবার মায়ের মাসতুতো বোনের বাড়িতে। ছোট থেকেই কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে একটা রাতও কাটায়নি পলাশ। একবার মামাবাড়িতে বড় মামা জোর করে রাখতে চেয়েছিলেন। পলাশের সে কী কান্না, শেষপর্যন্ত সেই রাতেই গাড়ি ভাড়া করে ওকে মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন বড় মামা।
এবার মায়ের সাথে বাধ্য হয়ে নিলুমাসির বাড়ি যেতে হল পলাশকে। মাসি হেসে বললেন, "তোমার কোনো চিন্তা নেই দিদি, ও এখানে থাকুক। দু-চারদিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।"
নিলুমাসির বাড়িতে প্রথম প্রথম ভীষণ সঙ্কোচ হত পলাশের। কলকাতা ছেড়ে সমতলের রুক্ষ মাটিতে পড়ে থাকতে একদম ভালো লাগত না।
একদিন ও ঠিক করল আর চাকরি করবে না। ফিরে যাবে কলকাতায়। লিখেও ফেলল ইস্তফাপত্র।
সব ঠিক, পলাশ চাকরি ছেড়ে দেবে। আবার নতুন করে পরীক্ষায় বসে বাড়ির কাছাকাছি পাওয়ার চেষ্টা করবে। অন্তত পুরুলিয়ায় থাকবে না। জামাপ্যান্ট পরে তৈরি হয়ে নিল। প্রথমে স্কুলে যেতে হবে। সেখানে দরকারি কাজ সেরে রাতের দিকে ট্রেন ধরবে। ঠিক সেইসময় কোথা থেকে ছুটতে ছুটতে এল দীপু, নিলুমাসির মেয়ে। পথ আগলে বলল, "তোমায় কিছুতেই যেতে দেব না পুলুদা। তুমি প্লিস যেও না।" সেদিন দীপুর চোখদুটো জলে ভরে এসেছিল। পলাশ দীপুর মুখটা দুহাতে তুলে বলল, "কেন? আমায় যেতে দেবে না কেন?"
দীপু লাজুক মুখে একটা কথাই ফুটে উঠল, জানি না যাও।
একবার দীপুর সাথে চড়িদা গ্রাম ঘুরতে গিয়েছিল পলাশ। ছৌ শিল্পীরা এখানে বেশিরভাগ থাকেন। ওরা কেউ কেউ মুখোশের ব্যবসা করেন। পলাশ কলকাতা বাড়ির জন্য কয়েকটা মুখোশ কিনল। দীপু পছন্দ করে দিল। সেদিন দুজনে হাত ধরে ঘুরেছিল অনেকক্ষণ। পরে অবশ্য দীপু হেসে বলেছিল, "তুমি কী ভীতু, হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে আমার হাত কেমন শক্ত করে ধরেছিলে।" ও কী করে বুঝবে পলাশের বুকের ভেতর তখন কী হচ্ছিল। মহাশূন্যে ভেসে যাচ্ছিল পলাশ। ওর সামনে পিছনে কেউ নেই, শুধু দীপু একা। মনের কথা মনে চেপে রেখে ও বলেছিল, "হারিয়ে গেলে আমাকে খুঁজে পেতে তুমি?" দীপু হেঁয়ালি করে বলেছিল, "একবার হারিয়ে গিয়ে দেখো কেমন খুঁজে আনি।"
ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পলাশ মনে মনে বলল হারিয়েই তো গেছি দীপু। আমাকে তুমি খোঁজার চেষ্টাও করলে না।
কখন রুমি পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি পলাশ। রুমি মুখ টিপে হেসে বলল, "কোন স্মৃতির সমুদ্রে ভাসছিলে এতক্ষণ? ঘুমোতে যাবে না?" ও নিরুত্তাপ গলায় শুধু বলল, "চলো।"
বিছানায় শুয়ে রুমি বলল, "তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি, তুমি ওয়াশরুমে ছিলে তখন একটা ফোন এসেছিল নিলুমাসির ওখান থেকে।"
নিলুমাসির নাম শুনেই পলাশের বুকের মধ্যে হাজার পাওয়ারের টিউবলাইট জ্বলে উঠল। তবে কি দীপু করেছে! প্রায় দুবছর হয়ে গেল, একবার ওকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। মনের চড়াই উৎরাই পার হয়ে পলাশ বলল, "মাসি কী বললেন?"
রুমি ঘুমকাতুরে গলায় বলল, "দীপু ওর স্বামীকে নিয়ে কাল এখানে আসবে। এখান থেকে পরের দিন দিল্লীর ট্রেন ধরবে।"
সকাল থেকেই মনের মধ্যে টুংটাং সুর বাজছে। দীপু পাবদা মাছ পছন্দ করে। পলাশ বড়রা থেকে আসার পর এই প্রথম পাবদা আনল। একসময় পলাশ খুব ভালো রান্না করত। মা অসুস্থ হলে রান্নাবান্না সব ওকেই করতে হত। নিলুমাসির ওখানে পাবদার ঝাল খেয়ে দীপু আপ্লুত হয়ে বলেছিল তুমি যাকে বিয়ে করবে সে খুব সুখী হবে।
সেদিন পলাশের মনে হয়েছিল দীপুর জন্য ও সব করতে পারবে!
কাজের ফাঁকে শূন্যস্থান পূরণের মতো কিছু টুকরো স্মৃতি ঢুকে পড়ছে। দীপু যখন বলল না, পুলুদা এটা হয় না। আমি তোমার মাসতুতো বোন। সম্পর্কের বিষদাঁত ভেঙে ছিনিয়ে নিতে ইচ্ছে করেছিল। ইচ্ছে করছিল অশান্তির আগুনে পোড়া মনটা দীপুকে দেখাতে। কিন্তু পলাশ তা করেনি; হেরে যাওয়া খেলোয়াড়ের মতো মেনে নিয়েছিল সব। এমনকি দীপুর বিয়ে পর্যন্ত। বিয়ের আগেই পলাশ চলে এসেছিল কলকাতায়। মুখোমুখি হতে চায়নি দীপুর। নিলুমাসিকে বলেছিল মা মারা যাওয়ার একবছরের মধ্যে কোনো অনুষ্ঠানে যেতে নেই। কিন্তু ও তো জানত কী ভীষণ অভিমান মিশেছিল কথাগুলোয়। কম আফসোস হয়নি বিয়ের সাজে দীপুকে দেখা হল না বলে।
সেদিন দীপুর একটা কথাই কানে দপদপ করেছিল যে, "আমি একজনকে ভালোবাসি। আমি তাকেই বিয়ে করব।" গত দুবছরে তার আগুন এখনও নেভেনি।
দীপু অনেকক্ষণ এসে গেছে। পলাশের চোখ মেপে নিচ্ছে দীপুর বর প্রশান্তকে। দীপু এককথায় ফিরিয়ে দিয়েছিল পলাশকে। ভাইবোনের সম্পর্ককে শিখণ্ডী করে কেটে দিয়েছিল মনের বাঁধন। শুধু এই লোকটার জন্য দীপুকে পাওয়া হল না। কী এমন আছে প্রশান্তর যা পলাশের নেই। ভালো চাকরি? একদিন দীপুই তো বলেছিল টাকাপয়সাই সব নয়। ভালোবাসার জন্য একটা মন দরকার হয়। পলাশের সেই নিখাদ মন তো ছিল, তবু দীপু ওকে ভালোবাসেনি।
খাবার টেবিলে একদম মুখোমুখি বসল দীপু। পাশের সীটটা দেখিয়ে বসতে বলল প্রশান্তকে। পলাশের মনে হল দীপু ইচ্ছে করে পাশের সীটে প্রশান্তকে বসাল। পলাশের ভীষণ ইচ্ছে করছে দীপুকে দুচোখ ভরে দেখতে। সামনে বসেও সঙ্কোচে তাকাতে পারছে না। দীপুও বেশ চুপচাপ। আগের মতো একগাল হেসে বলছে না পুলুদা তুমি কেমন আছ? যত গল্প রুমির সাথে, যেন ওদের কতদিনের চেনা।
রুমি খুব সুন্দর সেজেছে। দীপু খেতে খেতে বলল, "তোমাকে দারুণ দেখতে লাগছে বউদি। পুলুদার পছন্দ আছে বলতে হবে।"
রুমি কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, "তোমার পুলুদা নয়, তোমার দাদার বন্ধু সব ঠিক করেছেন। তোমার দাদা তো বিয়ের আগে আমায় দেখেনি।"
কথার ফাঁকে পলাশের চোখ চলে গেল দীপুর দিকে। আবার কী তুলনা করে নিল ও। দীপু না রুমি কে বেশি সুন্দর? যদি ঠিকঠাক বিচার করা হয় রুমিই বেশি সুন্দর। দীপু কী সহজ হওয়ার জন্য কথাগুলো বলল। প্রশান্তর পাতে একটা মাছ তুলে দিল দীপু। প্রশান্তও পাবদা মাছ ভালো খায়। দীপুর সাথে সব বিষয়ে কি প্রশান্তর মিল, তাই এত ভালোবাসা? পলাশ বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে, রুমির কথায় আবার ফিরে এল বাস্তবে।
রুমি খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে হেসে হেসে বলল, "বিয়ের পর এই প্রথম তোমার দাদা রান্না করল। বোনকে নিজের হাতে খাওয়াবে বলে।"
দীপু মাথা নীচু করে শুধু হাসল। প্রশান্ত আত্মসমর্পণ করে বলল, "আমি কিন্তু একদম রান্না জানি না। তবে আমার গিন্নির পারফেক্ট স্বামী আমি। ও বলে ছেলেরা রান্না করুক এটা ওর নাকি পছন্দ নয়।"
কত বদলে গেছে দীপু। আগে পলাশের রান্না করা খাবার কত পছন্দ করত। হাতে হাতে জোগাড় করে দিয়ে বলত তুমি রান্না করো পুলুদা। পলাশের রান্নার জন্য নাকি ওর বউ অনেক সুখী হবে। এত বড় অভিনয়! পলাশের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে দীপু তুমি একটা মিথ্যেবাদী।
পলাশ প্যাকেট হাতড়ে দেখল একটা সিগারেট আছে। সেটা নিয়ে ও ছাদে চলে এল। রাতের এইসময়টুকু ও ছাদেই কাটায়। বড্ড বিধ্বস্ত লাগছে। কিছুতেই সহজ হতে পারছে না সবার সাথে।
একটু পরে দীপু এসে দাঁড়াল পিছনে। খুব কাছে এসে বলল, "কেমন আছ পুলুদা?" পলাশ মুখ ফিরিয়ে সোজাসুজি তাকাল ওর দিকে। এইটুকু নির্জনতা কি দীপু খুঁজছিল? তাই ওকে দেখে উঠে এসেছিল ছাদে। গোটা দিনে এই প্রথম ওর সাথে সরাসরি কথা বলল দীপু। আর পলাশ নিজেও তো দীপুকে আলাদা করে পেতে চাইছিল। অথচ সবার সামনে কথা বললে কেউ কিছু ভাবত না। রুমি, প্রশান্ত সবাই জানে ওরা ভাইবোন।
"কী ভাবছ পুলুদা?" দীপুর প্রশ্নে পলাশ হেসে বলল, "ভালো আছি। রুমি খুব ভালো মেয়ে। সংসারের সব কিছু ও করে। আমার কোনোদিকে তাকাতে হয় না।"
পলাশ একঢালা কথাগুলো বলে চলল।
দীপু বলল, "বউদিকে দেখেই বোঝা যায় খুব ভালো। আমি জানতাম তুমি সুখী হবে।"
ছাদের একপাশে গাছটা দেখিয়ে পলাশ বলল, "চিনতে পারছ গাছটা?"
দীপু একছুটে ফুলগুলোর কাছে গিয়ে বলল, "ব্লীডিং হার্ট।"
পলাশ দীপুর হাত ধরতে গিয়ে ধরল না। খুব কাছাকাছি এসে বলল, "দীপু ও ফুলে বিষ আছে। ওর কাছে যেও না।" দীপু পলাশের কথা না শুনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল ফুলগুলো।
এমন সময় রুমি এসে বলল, "সব তোমার পুলুদা যত্ন করে।" দীপু হেসে বলল, "বিষাক্ত জেনেও এত যত্ন করে?"
পলাশ আবার কথা হারিয়ে ফেলেছে। খুব একা পেতে ইচ্ছে করছে দীপুকে। কী করে বলবে রুমি তুমি এখন যাও, পরে এসো।
কিছুক্ষণের মধ্যে প্রশান্তও চলে এল ছাদে। একেবারে মজলিস বসে গেছে। রুমি সহজেই সবাইকে আপন করে নিতে পারে। পলাশের স্কুলের কলিগরা তাই রুমিকে খুব পছন্দ করে।
রুমি প্রশান্তকে বলল, "কে আগে বিয়ের কথা বলেছিলেন?"
প্রশান্ত হেসে বলল, "আমার মা।"
"মানে?"
রুমির কথায় প্রশান্ত বলল, "মানে আমার বাড়ি থেকে মা বিয়ে ঠিক করেছেন।"
পলাশ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। দীপু প্রসঙ্গ পাল্টে দিয়ে বলল, "চলো তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।"
ছাদ থেকে সবাই চলে গেলে পলাশ ছাদের ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। সামনে ছড়িয়ে রাখা হৃদয়কে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে। এই ইচ্ছেটুকু একান্ত নিজের। কাউকে জানতে দেবে না কোনোদিন। ও সারাজীবন ছাদে এইভাবে ফুল ফোটাবে। আর মেনে নেবে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ।