সেও এক সময় ছিল হে, বড়ই আদেখলা। উই সদরের বেপথু সন্ধেগুলো পথ ভুলে তখন হাঁদিক পানেই আসত জানতুম। নামেই গেরাম ছিল তখন, আসলে ছিল গঞ্জেরও বাড়া। মা কালির দিব্যি গেলে মানুষ মিথ্যে বলত ঠাকুরের নাম নিয়ে, মদ খেয়ে বউও পেটাত, আর গলায় তুলসীর মালা পরে বেবুশ্যেদের কাছেও যেত। দু-আনা চার-আনার সম্পক্ক ছিল কিছু। কিন্তু সে সব তো লোটপোট উকিলের কোট।
হুঁই মরা নদী তখন ছিল ভরা যুবতী। ফি বর্ষায় বরাদ্দ ছিল একখান জোয়ান মদ্দ। হাঁ করে গিলে খেত রাক্ষুসি। কখনো বেশি রাগ হলে নদী এসে ঢুকত ঘরে। সামন্তদের পাকা বাড়িতে ঠাঁই পেত মেয়েরা। নদী ছুটত সব ভাসিয়ে, ওদিকে ইজ্জত ভাসত ক’জনার। তারপর জল নেমে গেলে নতুন পলির মতই ঢাকা পড়ে যেত সব। মানুষের পো সহ্য করতে পারে ভাল। সবই ভগমানের ইচ্ছা হে।
নদীর পারে ছিল হপ্তার হাট। পসরা আর পসরা। সাত কোশ দূরের জিনিষ আসত ক্যাঁচরম্যাচর গরুর গাড়িতে। হাঁড়িয়া, মহুল কী যে ছিল না। যদু ময়রার লাল হলুদ বোঁদে পাওয়া যেত শালপাতার খালাতে। আর পাওয়া যেত খোলা হাওয়া, আনখা যত ধুলো, পরান বাউলের গান, আঁধার নামলে বটগাছের পিছে জঙ্গলে করা পাপ। একটা কথা কয়ে যাই, পাপ চাপলে লোকে সাপ আর বাপ দুয়েরই ভয় ভুলে যায় হে।
গাঁয়ের পুব মাথায় ছিল চৌধুরীবাড়ি। মাঠে কাশফুল ফুটলে দুগগাপুজো হত নাটমন্দিরে। এত্ত বড় মা দুগগা সিংহে চড়ে, ছানাপোনাদের সাথে আসত হোথা ফি বচ্ছর। পাঁচুকুমোর ঠাকুর বানাত। সে এক বিদ্যে শিখেছিল বটে। কোত্থেকে কে জানে? কত কুমোরই তো ছিল। তবু পাঁচুর মত সুন্দর পোতিমে এই তল্লাটে আর কেউ বানাবে সাধ্য ছিল? কুড় কুড় করে ঢাক বাজলেই সকলের মন উচাটন। চৌধুরীবাড়ির বউ-ঝিয়েরা লাল পাড় গরদের শাড়ি পরে শাঁখ বাজাত, উলু দিত আর ঝুপুস ঝুপুস পেন্নাম করত মাকে গলায় আঁচল দিয়ে। বাবুদের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নতুন পাটভাঙা জামা কাপড়ে বেরিয়ে পড়ত রাস্তায় ভেঁপু বাজিয়ে। গরীবের ন্যাংটোপুটোগুলো, নাকের সিগনি পুঁছে কোমরের ঘুনশি সামলাতে সামলাতে চোখ বড় করে দেখত আর দু-হাত পেতে প্রসাদ খেত। ভাবত প্রতিদিন হয় না কেন গা এমন পুজো?
বড় মন খারাপের সময় ছিল সে সব। বন্যা এলে মন খারাপ। কালবোশেখিতে ঘর ভাঙলে মন খারাপ, অসুখ বিসুখে মন খারাপ। কেউ দুনিয়া ছেড়ে ওপরে গেলে তো কথাই নেই। আর তাছাড়া ভর দুপুরে অশথ বা বট গাছের ছায়ায় বসলে এমনি এমনি মন খারাপ। মনের হদিশ পাওয়া বড় দায় হে।
তবে সব চে’ বেশি মন খারাপ হত চাষপাড়াতে গেলে। কেন কে জানে? সোনালী রঙের পাকা ধানের শিষ দোল খেত হাওয়ায়, আল বাঁধা খেতে। খেতের জলে খেলে বেড়াত চ্যাং মাছ, ব্যাঙাচির দল আর কত্ত রকমের জলপোকা। পায়ের তলায় সবুজ ঘাস। পাশেই তির তির করে বয়ে যাওয়া নালি যেটা নদীতে গিয়ে পড়েছে। আলের নীচে গর্তে লুকিয়ে থাকত চকচকে জলঢোঁড়া সাপ। পাশের শালবনে জংলা লতাপাতার আঁট বিনুনি জাল। রঙিন পাখির কিচমিচ আর ফুড়ুৎ করে উড়ান দেওয়া। সে সব দেখে লজ্জাবতী লতার মতই মনটা যেন গুটিয়ে যেত আলগোছে। মন খারাপ হত হে, বড় মন খারাপ হত।
তবে শুধুই কি মন খারাপ? আনন্দও কি ছিল না একেবারে? সেই যে একবার জাদুওয়ালা এল এক। চোখে সুরমা দেওয়া, মাথায় পাগড়ি গায়ে রঙচঙে জোব্বা, রাজার বেটার মত চেহারা। আকাশ থেকে পায়রা ধরত খপাত, পলক ফেলতেই আবার গায়েব। জাদুওয়ালা হওয়ার আগে সে নাকি দর্জি ছিল। কাপড় সেলাই করত, জুড়ত ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো। তা এখেনেও সে জুড়েছিল, খোয়াব জুড়েছিল এই ছন্নছাড়া জায়গায়। মানুষের মনে অসম্ভব জুড়েছিল, স্বপন জুড়েছিল ছেলেমেয়েগুলোর চোখে, জাদুর সাথে নিজেকে জুড়েছিল এই হদ্দ গেরামে। ওর হাতে একটা লাঠি থাকত। বেশ কালো কুচকুচে হাত খানেক লম্বা, দুদিকে দুটো টুপি মতন ছিল লাঠিটায়। বলত এই লাঠি দিয়ে আমি টাকাপয়সা ছাড়া সব বশ করতে পারি। করেও ছিল তাই। চৌধুরী বাড়ি জাদু দেখাতে গিয়ে।
লোকটা যখন মানুষ হত, জাদুকর থাকত না মোট্টেও, সেই অনাথ সকালগুলোতে একটা ছেঁড়া নীল গেঞ্জি আর ডোরাকাটা লুঙ্গি পরে ওর সাকরেদদের সাথে রান্নাবান্না করত। কাঠের উনুনে চোঙা দিয়ে ফুঁ দিতে দিতে বড় বড় চোখগুলো ধোঁয়ায় হয়ে উঠত লাল টকটকে। এইসা চওড়া ছাতি ফুঁয়ের তালে হাপরের মত বাড়ত আর কমত। বাঁশ গাছের পারা লম্বা, এত্ত মোটা কবজি।
একবার আলীচাচা মাংস বেচার সময় বলেছিল, “হ্যাঁ গা জাদুওয়ালা, তোমার এই চেহারা, অন্য কোন কাজ করে খেলে তোমার তো জমিদারি হত!” জাদুওয়ালা বলেছিল “চাচা, আমি যদি চাষ করি, তাহলে জাদু দেখাবে কে? কে খাঁচার থেকে জন্তু গায়েব করবে, কে তাসের পাতাদের আঙুলে নাচাবে? কে এফোঁড়-ওফোঁড় করে তলোয়ার ঢোকাবে মানুষকে আস্ত রেখেও। এই যে আমি পোতিজ্ঞে করেছি তোমাদের আমীর করব, এই গেরামের পাশে, হুঁই পানে একটা শহর বসাব, নদীতে ভাসাব তিনমহলা ময়ূরপঙ্খী, গেরাম জুড়ে রাস্তা হবে, ঘোড়ার গাড়ি ছুটবে টগবগ টগবগ। গরুর বাঁটে ক্ষীর বইবে, গাছের ডালে মণ্ডা মিঠাই, চাষের খেতে সোনা রুপো ফলবে। তোমাদের আয়নার সামনে বসিয়ে ঘুরিয়ে আনব দূর বিদেশ। চাষবাস তো যে কেউ পারে চাচা, জাদু কে পারে বলো তো?”
সে অবিশ্যি ন্যায্য কথাই বলেছিল তখন। সকলে কইত হ্যাঁ, জাদুওয়ালা বটে একখানা। ভুত পেরেত ভগমান সবাইকে বশ করেছে। তখন কি আর কেউ জানত, সবাই একদিন না একদিন বশ হয় অন্য কারো কাছে?
জাদুওয়ালার নোংরা তাঁবুতে, চৌধুরী বাড়ির ঝি-বউরা কী করে আসবে জাদু দেখতে! তাই তো বড়-চৌধুরীর আদেশে জাদুওয়ালা গেল চৌধুরীবাড়িতে জাদু দেখাতে। সে অনেক হাঙ্গামা। কতকগুলান কালো কালো বাক্স গরুর গাড়ি চাপিয়ে নিয়ে ফেলা ওখেনে। তারপর মঞ্চ তৈরি রে, কালো কাপড়ে ঘেরো রে। জাদুওয়ালা বলত জল মাটি ছাড়া যেমন গাছ হয় না তেমনি ওর বাক্সে বন্দী ভূত পেরেত আর আঁধার জায়গা ছাড়াও নাকি জাদু হয় না। সফেদ দেখলে ভয় পায় নাকি ভূত পেরেতরা। বোঝ…
তারপর হল জাদু। একদিন নয়--সবার ইচ্ছায় বেশ কয়েকদিন হল চৌধুরীবাড়িতে। বড়-চৌধুরী খুশি হয়ে বুকে জড়িয়েছিল জাদুওয়ালাকে। জাদুওয়ালাও দেখিয়েছিল ওর জানা সমস্ত বিদ্যে। কিছুই বাদ দেয়নি। সবাইকার মন কেড়েছিল সে। বশ করেছিল। হ্যাঁ বশই করেছিল বটে, তবে আরেকজনকে। চৌধুরীবাড়ির ছোট বউ।
ছোট-চৌধুরী ছিল কুলাঙ্গার। ঘরে অমন লক্ষীমন্ত বউ রেখে ফস্টিনস্টি করে বেড়াত যত নরকখানায়। বেহেড মাতাল হয়ে রাতবিরেতে ঘরে ফিরত মোসাহেবের কাঁধে ভর দিয়ে। এ নাকি পুরুষ মানুষের লক্ষণ। জুতো মারো অমন পুরুষের মুখে।
ছোট বউ আসত জাদুওয়ালার কাছে চা জলখাবার দিতে। জাদুওয়ালার কাছে না ওই ছেঁড়া নীল গেঞ্জি পরা চওড়া ছাতির মানুষটার কাছে, কে জানে। কে জানে লোকটা ছোট বউকেও স্বপ্ন দেখিয়েছিল কিনা। বীজ বুনেছিল কিনা ছোট বউয়ের শুকনো পড়ে থাকা অনাবাদী মনে। খায়েশ জুড়েছিল কিনা উড়ান দেয়ার, নীল আকাশে সোনালি ডানার পাখি হয়ে, নদীর বুকে ভেসে পড়ার তিনমহলা ময়ূরপঙ্খী নাওয়ে চেপে। বসিয়েছিল কিনা কোন জাদু আয়নার সামনে। কে জানে, এখন আর কে জানে।
মোদ্দা কথা হল, জাদু করেছিল জাদুওয়ালা। সারা গেরামের জাদু দেখা শেষ হয়ে গেলেও জাদুওয়ালা আর গেরাম ছাড়ল কই। গেরামের পাশে না তৈরি হল শহর। না ছুটল ঘোড়াগাড়ি টগবগ টগবগ। জাদুগুলো হল পুরোনো। কেউ আর অবাক হয় না। ভাবে এমনটা তো হয়ই। এদিকে তাঁবুতে লোক না এলে উনুন জ্বলবে কী করে। শাকরেদরা গুরুকে বলে কয়েও যখন নড়াতে পারল না, তখন বাধ্য হয়ে দল ছাড়ল। গাঁয়ের লোকেরা জানল ভুখা পেটে তো জাদুও হয় না। ইতিমধ্যে গেরামে ফিস ফিস, গুঞ্জন, বউ-ঝিদের নদীতে চানের সময়ের কানে কানে কথা। ছোট বউ নাকি…
জাদুওয়ালা তখন কষ্টে, জাদুওয়ালা তখন ভালোবাসায়, জাদুওয়ালা তখন বিপদে। কানাঘুষোয় ছোট-চৌধুরীর কানে গেছে সব। জাদুওয়ালা চলে গেলেই পারত রাতারাতি পাততাড়ি গুটিয়ে। অন্য কোথাও, অন্য কোন গেরামে। গিয়ে আবার স্বপ্ন দেখাত। মানুষদের মনে কল্পনার চাষ-আবাদ করত। কিন্তু ওই যে, জাদুওয়ালা ভাবলে, আমি শেষ জাদু দেখাব এই গেরামে। গায়েব হয়ে যাওয়ার জাদু। একা নয় দোকা।
গায়েব সে হয়েছিল অবিশ্যি শেষ পর্যন্ত। তবে দোকা নয় একা। এক রাতে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল ওই তাঁবু। শেষ হয়ে গিয়েছিল যত স্বপ্ন, যত ভোজবাজি, যত কালো বাক্স, ভুত-পেরেত কালো কাপড়, যত অবাস্তব, যত কল্পনা। সকালে সবাই দেখেছিল শুধু কিছু ছাই পড়ে আছে। তাই তো হয় সব কল্পনার শেষে। ছাইই থাকে। সেটাই তো ভবিতব্য।
তবে জাদুওয়ালাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি সেই পোড়া তাঁবুর ধ্বংসাবশেষে। লোকে বলে একদিন পরে পাঁচ ক্রোশ দূরে নদীতে ভেসে উঠেছিল একটা লাশ, সেই নীল রঙের ছেঁড়া গেঞ্জি পরা। কে জানে সেটা ওই লোকটা ছিল না জাদুওয়ালা না অন্য কেউ। জাদুওয়ালারা কি কখনো মরে? মরে না।
ছোট বউ কিছুদিন পরে মরল সাপের কামড়ে। ওরা বলে সাপের কামড়, লোকে বলে ইঁদুর মারার সেঁকো বিষ। দাহ হয়নি তার, নদীর জলে ভাসিয়েছিল তাকেও। হয়ত জলের স্রোতেই মিলেছিল গিয়ে ছোট বউ আর ওই চওড়া ছাতি বড় বড় চোখওয়ালা লোকটা। হয়ত হাত ধরেছিল জলের তলায়। হয়ত দু-দণ্ড জিরিয়েছিল। হয়ত কোন কথা বলেনি কেউ, শুধু তাকিয়েছিল একে অপরের দিকে। হয়ত বলেছিল চল ঘর বাঁধি, চল স্বপ্ন দেখি, একা নয়—দু’জনে মিলে। স্বপ্ন দেখি একটা লাল টুকটুকে নতুন সূর্য হুঁই পুবাকাশে। স্বপ্ন দেখি একটা গেরামের যেখানে পুরুষমানুষ থাকে না, শুধুই মানুষ আর মানুষী থাকে। হয়ত…
সেও এক সময় ছিল হে, বড়ই আদেখলা…