“স্যান্টা ক্লস আছে!”
“দুর তুই একটা হাঁদা! স্যান্টা ক্লস বলে কেউ নেই!”
“আছে, আছে, আছে!” বলে জ্যাঠতুতো দিদির সাথে তর্কে না পেরে উঠে ঝুমঝুমি হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসল।
ঝুমঝুমি শীতের ছুটিতে আমেরিকা থেকে ভারতে দাদু, ঠাম্মা, জ্যেঠুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। ওদের মার্কিন মুলুকের বাড়িতে প্রতি বছর ক্রিসমাসের সময় সুন্দর করে সাজান ক্রিসমাস ট্রি-টার তলায় স্যান্টা ক্লস ওর জন্যে উপহার রেখে যায়। আর শুধু কি ওর জন্যে, ওর ক্লাসের সব ছেলে মেয়েদের জন্যেই তো স্যান্টা কিছু না কিছু নিয়ে আসে। অনেক সময় সেটা ওরা স্যান্টার কাছে যা চেয়েছে তাইই হয় অনেক সময় হয় না। আর কে না জানে শীতের সময় নর্থ পোল বা উত্তর মেরু থেকে রেইনডিয়ারে টানা স্লেজ গাড়িতে চেপে ঝুড়ি ঝুড়ি খেলনা নিয়ে স্যান্টা ক্লস আসে! কিন্তু সমস্যাটা হল জ্যাঠতুতো দিদি বার্বি কিছুতেই ওর কথা বিশ্বাস করছে না! ওকে ‘বোকা বোকা’ বলে খেপাচ্ছে, হেসে কুটিকুটি হচ্ছে আর বলছে, “তুই এখনও খুব ছোট তাই ওই সব আজগুবি গল্পে বিশ্বাস করিস! আমার মতন বড় হলে আর করবি না! কই আমাকে তো স্যান্টা ক্লস কোনদিন কিছু দেয় না! সে যদি সত্যি সত্যি থাকত তাহলে তো সারা পৃথিবীর বাচ্চাদেরই উপহার দিত। শুধু বেছে বেছে ইংল্যাণ্ড আর আমেরিকার বাচ্চাদেরই কেন দেয়? খেলনা পুতুল এই সব বুঝি শুধু তাদেরই ভাল লাগে? আসলে স্যান্টা ক্লস বলে কেউ নেই। মা বাবা আর প্রিয় জনেরা ওই সব খেলনা টেলনা রেখে দেয় আর তোর মতন বোকা সোকা ছেলে মেয়েরা ভাবে স্যান্টা ক্লস এসেছিল, তাও কিনা আবার চিমনি দিয়ে! যত্ত সব!”
ঝুমঝুমির মন খারাপ হয়ে গেল। বার্বি দিদিকে ও কি ভাবে বোঝাবে যে স্যান্টা ক্লস সত্যিই আছে? গতবার তো ঝুমঝুমি স্যান্টার জন্যে দুধ আর বিস্কুটও রেখেছিল। সকালবেলা উঠে দেখেছিল দুধের গেলাস খালি, বিস্কুটগুলো হাওয়া! স্যান্টা যদি সেগুলো না খেয়ে থাকে তাহলে কে খেল? আর তাছাড়া বাবা মা যদি খেলনা দিয়েও থাকেন ওরাই তো বলছেন স্যান্টা ক্লস দিয়েছে, ওদের কথা কি তাহলে মিথ্যে?
একটু পরেই ঝুমঝুমির দুঃখ আরো দ্বিগুণ হয়ে গেল কা্রণ পিসি আর পিসেমশাই মুনিয়াকে নিয়ে বেড়াতে এলেন। মুনিয়া ঠিক বার্বির বয়সী আর এবার ওরা দুজনে মিলে ঝুমঝুমিকে নিয়ে ঠাট্টা জুড়ে দিল।
“স্যান্টা ক্লস! হি হি! গত বছর মলে লাল জামাকাপড় পরা সাদা ধবধবে দাড়ি গোঁফ লাগান এক জনের সাথে তোলা তোর ছবি দেখেছিলাম বটে! সেই কি স্যান্টা ক্লস নাকি? হি হি সব মলে একটা করে স্যান্টা থাকে নাকি তোদের? সবাই দলে দলে নর্থ পোল থেকে নেমে এসেছে! আর তার আবার নাকি একটা বাহিনি আছে! এলফ না কি যেন বলে তাদের, তুইও সেই দলে বুঝি? তোর হাইট দেখে তো সেটাই মনে হচ্ছে!” বলে দুজনে হেসে গড়াগড়ি!
পিসি ওর জন্যে একটা সুন্দর জামা এনেছেন। আর সাথে একটা পুতুলও। সেগুলোকে ভাল করে দেখতেও পায়নি ঝুমঝুমি বার্বি আর মুনিয়ার তাড়নায়! জ্যেঠিমা লুচি ভেজেছেন। সবাই যখন খেতে ব্যস্ত সেই ফাঁকে ছাদে পালাল ঝুমঝুমি। ছাদের এক দিকে কাজ হচ্ছে। লোকজন যাতায়াত করছে বালি সিমেন্ট নিয়ে। ওকে দেখে অনেকেই বলল, “খুকুমনি সাবধান, ওদিকে যেও না। পায়ে পেরেক ফুটে যাবে!”
ঝুমঝুমি ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে জামা আর পুতুলটা ভাল করে দেখল। পুতুলটা আবার চোখ খোলে বন্ধ করে! জামাটা ওর প্রিয় গোলাপী রঙের! মনটা খুশিতে ভরে গেল ঝুমঝুমির। ওরা স্যান্টা ক্লসকে নিয়ে যা বলে বলুক ঝুমঝুমি আর ওদের কিছু বলবে না! হঠাৎ ওর মনে হল ওকে যেন কেউ দেখছে। ফিরে তাকিয়ে দেখল, ওর চেয়ে কিছুটা ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে। তার পরনে একটা ছেঁড়া ময়লা জামা, হাতে পায়ে ধুলো মাখা, চুলে জট আর হাতে একটা প্লাস্টিকের বোতল। ঝুমঝুমির পুতুলটার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে রয়েছে!
বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে ঝুমঝুমির খুব মায়া হল। সে মেয়েটার কাছে গিয়ে বলল, “আমার তো অনেক আছে, এগুলো যখন তোমার ভাল লেগেছে তখন তুমিই নাও!”
বলে আশ্চর্যে মুখ হাঁ হয়ে যাওয়া মেয়েটার হাতে জামা আর পুতুলটা গুঁজে দিল ঝুমঝুমি! মেয়েটার মা কাছেই কাজ করছিল, দেখতে পেয়ে হাঁ, হাঁ করে ছুটে এলো।
“খুকুমনি, তোমার জিনিস তুমি নিয়ে নাও গো, নোংরা হয়ে যাবে!”
“আমার নাম খুকুমনি নয়, ঝুমঝুমি-- আর জিনিসগুলো আমি ওকে দিয়ে দিয়েছি!”
“না, না তুমি নিয়ে নাও। তোমার মা দেখতে পেলে বকবেন!”
“কিচ্ছু বকবেন না! আমার জিনিস আমি যা খুশি করব! ওর কোন পুতুল নেই! একটা প্লাস্টিকের বোতল নিয়ে খেলছে!” বলে সিঁড়ি দিয়ে নিচের তলায় নেমে গেল ঝুমঝুমি। পিছন ফিরে একবার তাকিয়ে দেখল মেয়েটা পুতুলটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, মুখ চোখ ভরে গেছে আনন্দে!
“এই যে, এসে গেছো দেখছি! কোথায় ঘুরছিলে এতক্ষণ টো টো করে? নাও জ্যেঠিমা লুচি করেছেন, দয়া করে একটা দুটো খাও!” মার কথায় ঝুমঝুমি লুচি খেতে বসল।
মা জিজ্ঞেস করলেন “আচ্ছা, পিসিমা যে জিনিসগুলো দিলেন সেগুলো তো একবার দেখালেও না, কোথায় রেখেছ?”
“ওগুলো তো আমি ছাদের মেয়েটাকে দিয়ে দিয়েছি!”
ঝুমঝুমির কথা শুনে ঘরের সবাই অবাক, “সে কি! অমন সুন্দর জামা আর পুতুল দিয়ে দিলি! তুই কি রে!” “পিসি কত আদর করে এনেছিল” ইত্যাদি ইত্যাদি!
মার কাছে প্রচণ্ড বকুনি খেল ঝুমঝুমি। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমার তো আলমারি ভর্তি খেলনা আর জামা আছে! যখন এই জামা পরব না, সেই জামা পরব না করে বায়না করি তখন তো তুমিই বল এত বেশি জামা কাপড় পেয়ে গেছো বলে এই রকম করছ, না থাকলে তখন বুঝতে! ওই ছাদের মেয়েটার তো একটাও ভাল জামা নেই, ছেঁড়া জামা পরে রয়েছে! পুতুলও নেই, বোতল নিয়ে খেলছে!”
পিসির আনা জিনিস গুলো দান করে দিয়েছে বলে পিসি বেশ রেগেছেন, ওর সাথে কথা বলছেন না। বার্বি আর মুনিয়া মুখ টিপে টিপে হাসছে আর ওকে বোকা হাঁদা বলছে! ঝুমঝুমির কিন্তু মনে কোন দুঃখ নেই। দাদু ওকে চুপি চুপি বলে গেছেন, “তুমি ঠিকই বলছিলে ঝুমঝুম দিদি, স্যান্টা ক্লস আছে! সে বাচ্চাদের দুঃখ দেখতে পারে না! তাদের মুখে এক টুকরো হাসি দেখার জন্যে অনেক দূর থেকে আসে সে! আর কেউ না মানলেও আমি মানি! তাকে যে কোথায় কখন কোন বেশে দেখা যায় শুধু সেটাই কেউ জানে না!”