স্যার, আমার নাম মহম্মদ কুদ্দুস।
আমি কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম। গায়ের রঙ কালো। মামুলি চেহারা। বগলে ক্রাচ। এই গরমেও গলায় একটা কম্ফর্টার জড়ানো। লোকটার বয়স আন্দাজ করবার চেষ্টা করলাম। গ্রামের লোকের বয়স আন্দাজ করা কঠিন। গাদ সমেত তাড়ি খেয়ে পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলের চেহারা পাকিয়ে যায়। মনে হল লোকটার বয়স চল্লিশের বেশি হবে না। মাথার চুলে অবশ্য পাক ধরেছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, শরীরে প্রতিবন্ধকতা থাকলেও কণ্ঠস্বরে তার জের নেই।
লোকটা আবার বলল, 'স্যার আমি কুদ্দুস, প্রতিবন্ধী।'
গম্ভীর গলায় বললাম, 'আপনি কি জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী?'
'না স্যার। গুলি লেগেছিল।'
আগ্নেয়াস্ত্রের ফলশ্রুতি, একটু চমকিয়ে উঠলাম। এই সোলাদানা-বাগণ্ডি গাঁয়ে মস্তান নেই। কুখ্যাত কোন গুণ্ডাই নাকি বসিরহাট মহকুমায় নেই। আছে শুধু ডাকাত। বললাম, 'আমার কাছে এসেছেন কেন?'
'আপনি জ্ঞানী-গুণী শহুরে মানুষ। আমি মূর্খ। মূর্খরাও এক ধরনের প্রতিবন্ধী স্যার। যদি অনুমতি করেন আপনার পায়ের কাছে একটু বসি।
আমি অপ্রতিভ হলাম। শহুরে বিদ্বৎজন বলে মনে একটু অহং ভাব ছিল। লোকটার বিনয় দেখে তা উবে গেল। বললাম, 'আরে বসুন বসুন। অনুমতি আবার কিসের। আপনি কি কোনো বিশেষ কাজে এসেছেন?'
'না, এমনি। গল্পগুজব করতে এসেছি। তবে গল্প শেষে আপনার একটা দস্তখত চাই।'
'গল্প করার তো আমার সময় নেই। দেখছেন তো বই নিয়ে বসেছি। এই সময়টা আমি পড়ি। তাছাড়া আমি সামান্য লেখক। আমার সিগনেচার নিয়ে আপনার কোন কাজ হবে না।'
অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে সে বলে, 'আপনার মূল্যবান সময় আমি নষ্ট করব না। তবে হলপ করে বলতে পারি, আপনার ছাপানো বইতে এই গল্প নেই।'
আমি বিস্মিত হলাম। বগলে ক্রাচ নেওয়া প্রতিবন্ধী মানুষ, কিন্তু কী সুন্দর কথা বলে। ভাষার দক্ষতা আছে। গ্রামে বেড়াতে আসলে এ-ধরণের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হয়। অচিন্ত্যর সঙ্গে ভোরের বাসে মধ্যমগ্রাম, বারাসাত, বেড়াচাঁপা, খোলাপোতা, ধান্যকুড়িয়া ছুঁয়ে এই বাগুণ্ডি গ্রামে এসেছি। জায়গাটা আমার পছন্দের। এর আগেও কয়েকবার এসেছি। আমি ঘরকুনো প্রকৃতির মানুষ নই। তবে কোথাও বেড়াতে যাবার আগে প্রচুর বই সঙ্গে নিয়ে যাই। নতুন পরিবেশে আরামদায়ক আলস্যে বই পড়ার মতো মজা আর কিছুতে নেই। অজ পাড়াগাঁয়ে সুবিধা এই যে, এখানে টেলিফোনের টাওয়ার কাজ করে না। এখানে যখনই আসি, অচিন্ত্য আমাকে দোতালা দালানের একটা ঘর ছেড়ে দেয়। বারান্দায় দাঁড়ালেই সামনে প্রশস্ত ইছামতী। এপারে টাকি-হাসনাবাদ-বসিরহাট। ওপারে সাতক্ষীরা, বাংলাদেশের পরশ। অচিন্ত্যর পূর্বপুরুষ একসময় এই তল্লাটের জমিদার ছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে সে এখন এই বাড়ির মালিক। বসিরহাট ও তৎসংলগ্ন জমিদারদের নিয়ে একটা প্রবাদ একসময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল,
"টাকির লাঠি
সাতক্ষীরার মাটি
গোবরডাঙ্গার হাতি।"
টাকির জমিদারদের সেইসময় প্রজাবিদ্রোহ সামাল দেওয়ার জন্য দক্ষ লাঠিয়াল দরকার হয়েছিল। অচিন্ত্যর লাঠিতে বিশ্বাস নেই। টাকা-পয়সা, ভূ-সম্পত্তি এইসব জিনিস বেশি থাকলে মানুষের স্বভাব চরিত্র ঠিক থাকে না। অচিন্ত্যর ঠিক আছে। বিশ্বাস তার বন্ধুত্বে। এই ভাটি এলাকায় সবাই তাকে চেনে। সেই সুবাদে বেশ কিছু লোকের এই বাড়িতে আনাগোনা। গতকাল এসেছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। ভদ্রলোক এলেন সন্ধ্যাবেলায়। গ্রামের লোকেরা প্রাথমিক ইনহিবিশন কেটে গেলে প্রচুর কথা বলে। প্রয়োজনের কথা বাদ দিয়ে অপ্রয়োজনের কথাই বেশি বলে। আমি কিছু বলতে গেলেই, উনি হাত তুলে বলেন, 'একমিনিট'। ওনার কথা যখন ফুরালো তখন রাত্তির এগারোটা।
পরদিন খুব সকালে অচিন্ত্য গেল তার মামার বাড়ি, রায়মঙ্গল। একটা নদী পার হলেই তার মামার বাড়ি। আমাকে বলে গেল, 'ঘাটে পানসি নৌকা বাঁধা আছে। ছৈ-এর উপর ভারতের পতাকা। যখন ইচ্ছে নৌকা চড়ে নদীর বুকে কিছুটা ঘুরে আসতে পারিস। কেউ বাধা দেবে না। রান্নার ব্যবস্থা করে গেলাম, যখন ইচ্ছে খেয়েও নিতে পারিস।'
মোটামুটি লোভনীয় একটা দিন। এমন একটা স্বাধীন দিনের কথা দালান-কোঠার শহরে বসে কল্পনা করা সম্ভব নয়। চেনা জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার অন্যরকম আনন্দ আছে। এমন দিনে আমি বই পড়ি। শুধু বই। টমাস হার্ডির 'ফার ফ্রম দ্য মাডিং ক্রাউড'- এ মগ্ন ছিলাম। এমন সময়ই কুদ্দুস এলেন। আমার প্রথমে মনে হয়েছিল, লোকটা টাকার জন্য এসেছে। ওর প্রত্যাশাও হয়ত অল্প। আমি মানিব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকা বার করলাম। সাধারণত এই ধরনের লোক টাকা পেলে মহা খুশি হয়। কুদ্দুস কিন্তু হল না। বলল, 'স্যার, আপনি বিশিষ্ট ভদ্রলোক, গাঁয়ের মেহমান, আপনাকে আমার গল্প শোনাতে চাই।'
বই ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালাম। লোকটা ডাকাতও নয়, ভিখারিও নয়। কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করলে ও যদি খুশি হয় তবে তাই হোক। বারান্দায় এসে বসলাম। কুদ্দুস-কেও আহ্বান জানালাম। প্রকৃতি এখানে প্রবল। মানুষ তুচ্ছ। বিশাল নদী, বিশালতর প্রান্তর, বাধাহীন আকাশ। আর বয়ে যাওয়া অঢেল জলরাশি। এখানে প্রকৃতি এমন অভিভূত করে রাখে যে মানুষের ক্ষুদ্রতা, নীচতা, দৈন্য, দুঃখ কোন অলক্ষ্যে পড়ে থাকে। কুদ্দুস ক্রাচ দেওয়ালে ঠেকান দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল।
'আপনি তাহলে কুদ্দুস মিঞাঁ?'
'জি স্যার। আমাকে মিঞাঁ বলবেন না স্যার। ওই নামে আমার স্ত্রী আমাকে ডাকতো। আর আমাকে তুমি সম্বোধন করলে বেশ লাগবে।'
'বেশ তাই হবে। তুমি তাহলে কুদ্দুস।'
'জি স্যার। আপনি কোনদিন সাতক্ষীরায় গেছেন?'
'না যাইনি। ওটা তো বাংলাদেশ।'
'না যাওয়াই ভালো। বাংলাদেশ যেতে গেলে পাশপোর্ট, ভিসা আরো কত কী লাগে।'
'তুমি গিয়েছো?'
'জি স্যার। পাশপোর্ট ছাড়াই গেছি। আর যাব না।'
'কেন যাবে না?'
'তখন মন টানল। মনের ওপর তো কোন হাত নাই। কী বলেন? আছে?'
'বাংলাদেশে তোমার কে আছে?'
'বউ আছে। হয়তো ছেলেমেয়েও আছে।'
'বউ দেখতে কেমন?'
'বেশ দেখতে। খহুবসুরত।'
'তোমার বউ-এর নাম কী?'
'এইটা বলব না। পরপুরুষের সামনে পরিবারের নাম বলতে নাই। জমানা বহুত খারাপ। এই জমানা হল অবিশ্বাসের জমানা। তবে আপনি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। মেহমান। আপনাকে বলতে বাধা নাই।'
'বেশ বোলো না। ধরে নিলাম তোমার পরিবারের নাম নূরবানু।'
'আপনি তো খুব কাছ দিয়ে গেলেন। কিন্তু ধরতে পারলেন না। আমার পরিবারের নাম পরীবানু। পরীবানু বেশ সুন্দর। তার জন্য সবসময় আমার বুক ধড়ধড় করে। সারা দিন ইছামতীর পারে বসে থাকি। দৃষ্টি ওই পাড়ে। যদি তারে একটু দেখতে পাই।'
'নদী পার হয়ে যেতে অসুবিধা কোথায়?'
কুদ্দুস গম্ভীর হয়ে যায়। এই বিষয়ে দেখলাম জ্ঞান তার বেশ টনটনে। বলে, 'অসুবিধা আছে। এইদিকে ভারতের সৈন্য, ওইপাড়ে বাংলাদেশ রাইফেল। ইছামতীর মাঝবরাবর দড়ি-কাছি ফেলা। দড়ি পার হলেই - গুড়ুম গুড়ুম। তবে হ্যাঁ, শুধু একটা দিন দড়ি-কাছি সব হ্যাপিস। মা-দুর্গার ভাসান। নৌকায় নৌকায় নদীর দুই কূল এক হয়ে যায়। নৌকার মিছিল তখন কোথায় বি.এস.এফ., আর কোথায় বি.ডি।আর.। এই নৌকার বৈঠায় পা দিয়ে, ওই নৌকার ছই-এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ চলে যাও, কেউ কিছু বলবার নেই। তবে রাতে রাতে ফিরতে হবে। সকাল হলেই নদী আগের মতন। তখন আপনি ধরা পড়বেন।'
'আচ্ছা, তুমি কি এইভাবেই সাতক্ষীরায় গিয়েছিলে?'
কুদ্দুস মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। তার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হল, এই বেআইনি অনুপ্রবেশটাই তার গল্পের আসল প্রতিপাদ্য। ঠোঁটের কোণে হাসিও দেখা যাচ্ছে।
'কবে গিয়েছিলে কুদ্দুস?'
'সে বছর দশ আগের কথা। আমার বাড়ি ছিল হাড়োয়া খাল। যেখানে গোড়াই গাজীর সমাধিতে প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে একটা বড় মেলা হয়।'
'গোড়াই গাজী কে?'
'তিনি ছিলেন দরবেশ। অদ্ভুত সব ক্ষমতা ছিল তাঁর। জনৈক হিন্দু তাকে ওখানে এনে কবর দেন। পীরের হাড় থেকে জায়গার নাম হাড়োয়া।'
'বেশ, তুমি হাড়োয়ার মানুষ। কিন্তু তোমার সাথে পরীবানুর আলাপ হল কিভাবে?'
'স্যার, আমি মুসলমানের ছেলে। কিন্তু হিন্দুদের দেবদেবীর প্রতি আমার ছোটবেলা থেকে অগাধ শ্রদ্ধা। বিশেষ করে ঢাক বাজলে আমি আর থাকতে পারি না। আমার কোমর দুলতে থাকে। প্রতিবছর মা-দুর্গার ভাসানের দিন আমি হাড়োয়া থেকে টাকি চলে আসতাম। ইছামতীর এপার ওপার। ঢাক বেজে চলেছে। নৌকায় নৌকায় ছয়লাপ। বেশির ভাগ নৌকাই এই দেশের। কুড়ি ভাগ ধরেন বাংলাদেশের। আমি নাচতে নাচতে এক নৌকায় উঠি, কিছুক্ষণ পর আরেক নৌকায়। এরপর লাফ দিয়ে আরেক নৌকায়। রাত শেষে দেখি আমি পারের খুব কাছে। একটা লোনা জলের খাল সাতক্ষীরার মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের দিকে গিয়েছে। খালে জোয়ার-ভাঁটা খ্যালে। ঠাকুর ভাসান দিয়ে একটা পাঁচমাল্লাই বড় নৌকা শহরের দিকে ফিরছিল। আমি তাতেই চড়ে বসলাম।'
কুদ্দুসের গল্প আমার বেশ ভাল লাগছিল। উৎসাহ দেওয়ার জন্য বললাম, 'কেমন সে শহর সাতক্ষীরা?'
'সাতক্ষীরায় আমি এক বছর ছিলাম স্যার। সারাদিন সে শহরে ঘুরে বেড়াতাম। শহর হলেও তার সারা গায়ে ছিল গ্রামের ছোঁয়া। বড় রাস্তাগুলোর দুধারে জমিদারি আমলের উঁচু উঁচু বকুল গাছের সারি, পাঁচিল ঘেরা ইস্কুলের বিশাল উঠোনে বড় বড় দেবদারু গাছের সারি, দেবদারুর ডালে ডালে বাদুর ঝুলে থাকত, সারাদিন কিচ কিচ করত। একটা সাদা পদ্মের দিঘিও দেখেছিলাম। ভারি সুন্দর। খাল দিয়ে মোটর লঞ্চ যেত জল কাঁপিয়ে। রাতে সেখানেই ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি জ্বলতো।'
মানুষটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমার সামনে মেঝেতে যে বসে আছে সে সাধারণ মানুষ নয়, সে বিরাট প্রকৃতিপ্রেমিক। আমি যেন মানসচোখে সাতক্ষীরা দেখছিলাম। বললাম,
'খাওয়া-দাওয়া? তোমার কাছে তো টাকা-পয়সা তেমন ছিল না?'
'খাওয়া-দাওয়া কোনো সমস্যা নয়। সাতক্ষীরা বাজারের পাশেই 'ঢাকা বিরিয়ানী হাউস'। গভীর রাতে বিরিয়ানী হাউসের সামনে দাঁড়াতাম। তখনও ফুল ভল্যুমে সাবনাই ইয়াসমিনের গান চলছে। কিছু বলতে হত না। আমাকে দেখা মাত্র হোটেলের মালিক বলত, 'আইছে রে, ইণ্ডিয়া থেইক্যা পলাই আইছে।' একটা বড় এনামেলের গামলায় আধা-গামলা খাবার - আধ-খাওয়া রুটি, শিক-কাবাব, খানিকটা ছেঁড়া পরোটা, মুর্গীর মাংস দিত। কাস্টমাররা প্রচুর খাবার নষ্ট করে, তার একটা অংশ পেতাম।'
'এমনিতেই খেতে দিত? কাজ করাত না?'
'সেই গল্পটা পরে। হোটেল মালিকরা পাগল ও ভিখারি পছন্দ করে। এদের খাওয়ালে নাকি বিক্রি ভাল হয়। হোটেল চালু থাকে। আয়-উন্নতি বাড়ে।'
'তা তুমি তো পাগলও নও, ভিখারিও নও।'
'আমার তখন মহা বিপদ। পরনের পায়জামা ফালা ফালা। একবেলা পানি খেয়ে থাকি, আর এক বেলা উচ্ছিষ্ট। চোখদুটো ছোটছোট, ঠোঁট কালচে। হোটেলের মালিক একদিন আমার সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে শুরু করলেন,'
'নাম কি?'
'মহম্মদ কুদ্দুস।'
'ইণ্ডিয়া থেইক্যা পলাইছ? খুব-টুক করস নাকি?'
'না, এমনি এসেছি। দেশ দেখতে।'
'দেশে আছে কে?'
'কেউ না।'
'পড়াশুনা কি জান?'
'আলেম-ফাজেল পাস করেছি।'
'মাদ্রাসা পাস করা লোক, পুলাপান পড়াইতে পারবা?'
'পারব।'
'রাইতে ঘুমাও কোনখানে?'
'হাসপাতালের বারান্দায়।'
'একটা কাম কর। রাইতটা হাসপাতালেই থাক। কাল হকালে আমার বাড়ি আসো।'
গেলাম ঢাকা বিরিয়ানীর বাড়ি। বাংলাঘরের এককোণে আমার থাকার ব্যবস্থা হল। মালিকের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে বাল্যবিধবা। 'মাসাল্লা', মেয়েটা পরীর মতো সুন্দর। নামও পরীবানু। ছোট মেয়েটা আট-নয় বছরের তারে আমি পড়াই। আবার বাজার-সদাই করে দেই। ইঁদারা থেকে বালতি বালতি পানি তুলি। চাকর-বাকরের কাজ। তবে বড় মেয়েটা আমাকে সম্মান করে। মাস্টার বলে ডাকে। আমার সামনে পর্দা করে না। আনন্দে আমার মন ভরে যায়।
আমি উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
'তারপর? পরদিন এল পরীবানু?'
'স্যার, আপনার কাছে আমার লুকানোর কিছু নাই। পরদিন প্রথম রাতে আমার ঘুম এল না। কোনো একটা শব্দ হলেই আমি উঠে বসি। আপনাকে বলতে আমার লজ্জা করছে, আমিও মনে মনে চাইছিলাম, সে আসুক। সারারাত ছটফট করে সবে ঘুমিয়েছি। ঘুমের মধ্যে মনে হল কে যেন আমার বিছানায় শুয়ে আছে। স্যার শুনেছিলাম সাতক্ষীরার মাটি নাকি খুব উর্বর। এই মাটিতে লাঙল দিলেই ভাল ফসল। আমি ভবঘুরে কুদ্দুস, প্রথম লাঙল ধরলাম। কৃষিজীবী হলাম।'
'এরপর?'
'এরপর একদিন, দুদিন, তিনদিন চলে গেল। বাংলা ঘরের এক কোনায় থাকি সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করি। ইদারা থেকে বালতি বালতি পানি তুলে জালায় ভরে রাখি। বাড়িঘর সাফ করি। আবার ছোটমেয়েটাকে মন দিয়ে পড়াই। মালিকের সঙ্গে মাঝেমাঝে দেখা হয়। আমি বড়ই লজ্জিত বোধ করি। যার বাড়িতে অন্নদাস, তারই ক্ষতি করলাম? মনটা খারাপ হয়ে যায়। অন্যত্র চাকরির সন্ধান করি। ছোট শহর কোন চেনা পরিচয় নাই। কে দেবে আমায় চাকরি।
মালিক একদিন আমায় ডাকলেন। আমি সেলাম দিলাম। স্লামালেকুম ভাইজান। উনি খুব খুশী হলেন। বললেন, 'তোমাকে তিন মাস ধরে দেখতেছি। তুমি সৎ-স্বভাবের মানুষ। তুমি আসার পরই পরীর বিয়ের প্রস্তাব আইসে - ছেলে পূবালী ব্যাঙ্কের অফিসার। ঢাকায় নিজের বাড়ি। চেহারাসুরত ভালো। ছেলে নিজে আইসা মাইয়া দেইখ্যা গেছে। অহন জানাইছে, মাইয়া তার পসন্দ হইসে। বিয়া একরকম ঠিকঠাক। শ্রাবণ মাসেই বিয়া। কত কামকাজ, ঠিকমত কাজ করো। বেতন........।
শেষ কথাটা শোনাই হল না। কিন্তু যা শুনলাম মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কোথায় পরীবানু আর কোথায় আমি। ইণ্ডিয়া থেকে পালিয়ে আসা ভবঘুরে শ্রেণীর একজন লোক। স্যার, আমি নিজের অদৃষ্ট নিয়ে কোনদিনই অসন্তুষ্ট ছিলাম না। কিন্তু সেদিন পরীবানুর বিয়ের কথা শুনে খুব কষ্ট হল। সারাদিন শহরের পথে পথে ঘুরলাম। গোসল করলাম না। খাওয়া দাওয়ার ইচ্ছাও রইল না। রাত শেষে ইছামতীর ঘাটে পৌঁছালাম। তখন নদীর পাড় ভাঙছে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে। এতদিন পরে আমার বলতে লজ্জা লাগছে আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে গিয়েছিল।'
আমি বললাম, 'আচ্ছা কুদ্দুস, এই যে তুমি এতদিন বাড়ির বাইরে থাকলে, তোমার আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী কেউ তোমার খোঁজ করল না?'
'আমার নিজের বলতে কেউ নেই স্যার। আমার মুসলমানের গাঁ দাদা। মানুষজন রোজা করে, আর নামাজ পড়ে। কোন মহম্মদ কুদ্দুস হিন্দুদের পুজোয় লাচতে গিয়ে (??) হল, তা নিয়ে কারো মাথাব্যাথা নেই। শালা কাফের জালিম। তা কাফের বলুক নয়তো শয়তানের দোসরই বলুক, আল্লা হরি সব বেটাই এক।'
'তাহলে তো তোমার কোন পিছুটানই নেই, কুদ্দুস।'
'আছে স্যার। দেশের বাইরে থাকলে দেশের জন্য অন্যরকমের একটা মমতা হয়। ঠিক করলাম যে করেই হোক আর রাতে আমাকে বসিরহাট পৌঁছাতেই হবে। কিন্তু একটা নৌকা অন্তত চাই।'
'অত রাতে নৌকা পেলে?'
'না স্যার, নৌকা তো দূরের কথা, একটা মানুষজনও নেই। ঠিক করলাম সাঁতরে পার হব। আর থাকা যাবে না। প্রথমে হাঁটু জল, এরপর গলা জল। শেষে গভীর জল। ছোটবেলায়, যখন মাদ্রাসায় সবে ভর্তি হয়েছি, তখন বসিরহাটে মিলন সিনেমার গায়ে ইছামতীর ঘাটে কুমির শুয়ে থাকতে দেখেছি। কিন্তু ভাসানের দিন কত লোক জলে নামে, কাউকে কুমির কোনদিন কামড়ায়নি। জলে নেমে সেই কুমির গুলোর কথাই বেশি মনে পড়ছিল। কিন্তু আক্রমণ আসল অন্যদিক থেকে। তখনও মাঝনদীতে আসেনি সার্চলাইটের তীব্র আলোয় সমস্ত এলাকাটা ভরে গেল। তার সাথে মোটরবোটের ভট্ভট্ আওয়াজ। উজানে সাঁতরাতে লাগলাম। কালো কাচের মতো ইছামতীর জল ঝকমক করছে। অপরদিকটায় নিশ্ছেদ অন্ধকার। কালো কুটিল রাত্রি ছড়িয়ে পড়েছে দিগ্দিগন্ত। আবছা অন্ধকার, ভট্ভটির আওয়াজ সব একাকার হয়ে একটা ভয়ানক অশুভ ইঙ্গিত চারিদিক থেকে ঘনিয়ে আসছিল। নদীর অতল থেকে শতশত ইবলিশ উঠে এসে দিগন্ত জুড়ে অট্টহাসি শুরু করে দিল। কেমন যেন ভয় ঢুকে গেল মনে। কোনরকমে পাড়ে উঠলাম। পায়ের তলায় চিট্চিটে কাদা। ঠিক সেই সময় বি.ডি.আর গুলি চালাল। অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ। শিরা-স্নায়ু-মজ্জা ফুঁড়ে গুলিটা আমার হাঁটুতে বিঁধে গেল। যন্ত্রণায় পা চেপে আমি সেখানেই শুয়ে পড়লাম।'
'এরপর কুদ্দুস?'
'একসময় কালো কুটিল রাত্রির শেষ হল। পূব আকাশে এক আস্তর ছায়াছায়া আলোর যখন ছোপ ধরল ঠিক সেই সময় ওরা আমাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সাতক্ষীরার সেই হাসপাতাল যার চওড়া বারান্দায় কেটেছে আমার অনেক রাত।'
'তোমার মালিককে খবর করলে না?'
'না, স্যার। খবর দিইনি। খবর দেবার উপায় ছিল না। অসাবধানে আর হাসপাতালের গাফিলতিতে, সেই ক্ষত হাঁটুর উপর থেকে বিষিয়ে উঠল। শেষমেষ বাদ দিতে হল হাঁটু থেকে পায়ের পাতা অবধি। ভরসা এখন ক্রাচ।'
'তোমার এই পরিণতিতে আমার খুব খারাপ লাগছে কুদ্দুস। তবে এই পরিণতির জন্য তুমিই কিছুটা দায়ী। ওরা যে তোমায় হাজত-বাস করায়নি, তোমার নসিব।'
'হ্যাঁ স্যার। হাজত বাসের ব্যবস্থাও হচ্ছিল। মাঝে মাঝে পুলিশ আসত, খোঁজ খবর করত। ওদের চোখে তো আমি তখন স্মাগলার। তবে ডাক্তাররা ছাড়ত না।'
'ফিরলে কি করে কুদ্দুস?'
'সেটাই তো আপনাকে বলব। আপনার মূল্যবান সময় অনেকটা নষ্ট করেছি। আর করব না।'
'না। বল কুদ্দুস, শেষ কর।'
'সাতক্ষীরা হাসপাতালে চারমাস ছিলাম। পায়ের ব্যাণ্ডেজ খুলে দিয়েছে। ক্রাচ নিয়ে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করি। কিন্তু শরীর খুব দুর্বল। একদিন রাতে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি। হঠাৎ কারা যেন ঢাক বাজাল। আওয়াজটা বাড়ছে। আমার বুকের মধ্যেও সহস্র ঢাক একসাথে বেজে উঠল। ক্রাচ বগলে বেরিয়ে এলাম। আকাশে নক্ষত্রমালার ফাঁকে পরীবানুর মুখটা খুঁজছিলাম। খুঁজে পেলাম না। পরমুহূর্তেই মনে হল পালাবার এইতো সুযোগ। হাসপাতালের সদর গেট খোলা।'
'তারপর?'
'তারপর অনেক কষ্টে পৌঁছে গেলাম ফেরীঘাটে। নদীতে তখন নৌকার মিছিল। সম্ভবত রাত্রির প্রথম প্রহর। শেষ সওয়ারির ক্ষেপ দিয়ে এইমাত্র একমাল্লাই কেরায়া নৌকাটা এসে ভিড়ল ফেরীঘাটে।'
'মাঝি, কেরায়া যাবে নাকি?'
'কই যাইবেন মিঞাঁ?'
'ইণ্ডিয়া।'
'অহন, এত রাতে, আপনি খোঁড়া মানুষ।'
ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। নৌকার গলুইটা চেপে ধরে বললাম, 'রাত করে কেউ যেতে চায় মাঝি? আজ দশমী, মা-দুর্গার ভাসান। আমার যে বড় ঠেকা। আজ না যেতে পারলে আরও একটি বছর আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।'
মাঝি কি একটা ভাবল। এরপর নির্লিপ্ত সুরে বলল, 'পাঁচশ টাকা দিতে হইব। দিতে পারলে নায়ে ওঠেন, নইলে গলুই ছাড়েন।'
আমার প্রথম মাসের বেতনের পাঁচশ টাকা। তখনও আমার গেঁজে। পরীবানুকে টাঙ্গাইল শাড়ি দেওয়া হয়নি। সেই টাকাই হল আমার পারানির টাকা। মাঝিকে বললাম, 'চিন্তা করবেন না। পাঁচশই দেব, কিন্তু আর দেরি করবেন না।'
বৈঠা দিয়ে খোঁচা মেরে নৌকাটাকে নদীর মাঝখানে নিয়ে এল মাঝি। ইছামতীর অন্তহীন খরধারায় নৌকার মিছিল, ঢাকের বোল, জামকাঠের নৌকার গায়ে ছপ্ছপ্ শব্দে ঢেউয়ের আঘাত। আকাশে ঘোলাটে চাঁদ। হালের বৈঠাটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে সাতক্ষীরার মাঝি। সেই উৎসবের রাতে নিঃসঙ্গ আমি, হাড়োয়ার মহম্মদ কুদ্দুস, পরীবানুর স্বপ্ন দেখতে দেখতে সোলাদানা-বাগণ্ডির ঘাটে পৌঁছে গেলাম।'
গল্প শেষ করে কুদ্দুস ক্রাচে হাত বাড়াল। শান্ত গলায় বলল, উঠলাম স্যার। আপনাকে আর বিরক্ত করব না।
'বসুন, আরেকটু'।
'জি না। আপনি অচিন্ত্যর বন্ধু, তাকে আমার কথা বলবেন। বললেই সে চিনবে। স্লামালিকুম।'
কুদ্দুস আমাকে দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ না দিয়ে এগিয়ে গেল। কংক্রীটের মেঝেতে কাঠের পায়ের খট্খট্ শব্দ উঠল। আমি অনেকক্ষণ ধরে তার চলে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মানুষটির প্রতি এক ধরনের মমত্ব বোধ করলাম।
সেদিন বিকেলে রায়মঙ্গল থেকে অচিন্ত্য ফিরে এল। তাকে কুদ্দুসের কথা বলতেই সে বলল, ভুল কাজে জীবন উৎসর্গ করার ঘটনা এদেশে বিরল নয়। কুদ্দুসও তেমন একজন। এই গল্প ও সবাইকে বলেছে। দিনরাত শরীর পাত করে সিগনেচার জোগাড় করে। ওর ধারণা দুই দেশের মধ্যে একটা সেতু তৈরি হলে বৈষম্য আর থাকবে না। একপ্রস্থ সিগনেচার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট অফিসে জমাও করেছে। কলকাতায় ফেরার আগে তোকে একদিন নিয়ে যাব কুদ্দুসের কাছে।
গেলাম একদিন কুদ্দুসের সঙ্গে দেখা করতে। আমাকে দেখে খুব খুশি। খুব আগ্রহ সহকারে সিগনেচারের খাতা দেখাল। কে নেই সেই খাতায় - লেখক, শিল্পী, চিত্রাভিনেতা থেকে বিদেশী পর্যটক। সিগনেচারের পাশে বর্তমান ঠিকানা। খুব গোছানো কাজ। আমি সেই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্বদের নিচে আমার দস্তখত করলাম। নিচু গলায় বললাম, তোমাকে নিয়ে একটা গল্প লেখা শুরু করেছি। নাম রেখেছি - অনুপ্রবেশ। কিন্তু শেষটায় কি লিখব ঠিক করতে পারিনি।
আনন্দে ওর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। বলল, গল্পের নাম দিন সেতু। শেষটায় কিছু লিখবেন না স্যার। একটু দোয়া করবেন যাতে সেতুটা তৈরি হয়। সেতু তৈরি হলে কাউকে আর অনুপ্রবেশ করতে হবে না।