বাস যেখানে থামে সেটা একটা কাচের ছোট ঘর। স্থানটার নাম থিসলডাউন বুলভার্ড। নামে বেশ ভারি হলেও স্থানটা তেমন ভারি নয়। এলাকাটায় বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মার্কেট সবই আছে। কিন্তু দূরে দূরে। তেমন জমজমাটও নয়। ফুটপাথের ওপর কাচের চারকোণা ঘরটিই বাসস্টপ। স্টপে নামলেই একটা বিশাল চত্বর এবং তারপর একটি প্লাজা। থিসলডাউন প্লাজা। প্লাজার পেছনে বিশাল এলাকা জুড়ে জংলা স্থান, পতিত ভূমির মতো। বিশাল প্লাজার সামনের চত্বরে হররোজ অসংখ্য গাড়ি থামে। সকাল ন'টা থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত প্লাজা-চত্বর কর্মচঞ্চল থাকে। সাতটার পর সব নীরব হতে থাকে। রাত দশটা নাগাদ এলাকাটা রীতিমতো ভুতুড়ে রূপ ধারণ করে। প্লাজার সামনের বিশাল সড়কের ওপারেও আছে সারিসারি দোকানপাট আর কটেজের মতো দেখতে বাড়িগুলো। রাতের একটা বিশেষ প্রহরে সব যখন নীরব হয়ে যায় তখন শুধু সামনের বিশাল সড়ক দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে যায় গাড়িগুলো। প্লাজার পেছনের বিশাল সাব গাছের মাথায় অপার্থিব শব্দ তুলে বয়ে যায় কনকনে হাওয়া।
কাচঘেরা স্টপে মহিব সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা বা পৌনে সাতটায় বাস থেকে নামে। সে আসে সেই ভিক্টোরিয়া সাবওয়ে থেকে। সাবওয়ের কাছেই একটি অ্যাপার্টমেন্টে ও থাকে। টরোন্টোর সাবওয়ে মূলত পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত। ভিক্টোরিয়া থেকে মহিব পশ্চিমগামী ট্রেন ধরে। পশ্চিমে এর শেষ গন্তব্য কিপলিং। তার এক স্টেশন আগের রয়ালইয়র্ক স্টেশনে নামে মহিব। টরোন্টো সাবওয়ের পুরোটাই প্রায় ভ্রমণ করে ফেলে মহিব কর্মস্থলে যেতে আসতে। ভিক্টোরিয়ার আগে পুবে মাত্র দু'টি স্টেশন-ওয়ার্ডেন ও ক্যানেডি। রয়ালইয়র্কে নেমে আবার বাস ধরতে হয়। ট্রেন-বাস মিলিয়ে সময় লাগে পৌনে দুই ঘন্টা। এই সময়টাতে সে প্রায় শত মাইল পাড়ি দিয়ে দেয়।
থিসলডাউন প্লাজাই ওর কর্মক্ষেত্র। বারোঘন্টার নাইট ডিউটি। টানা তিনচার দিন ডিউটি পড়লে মহিব ছটফট করে, ব্যাকুল হয়ে থাকে ডে-অফের জন্য। আসা যাওয়ার সাড়ে তিনঘন্টা আর বারোঘন্টা ডিউটি সময় বাদ দিয়ে যে সময়টার জন্য সে বাড়ি ফেরে, তাতে কোনো কাজেই মনোসংযোগ করা যায়না। ঠিকমতো ঘুমটাও হয়না। সুতরাং মহিব যে প্রকারের সময় পার করছে, তা নির্মম। কাজের ধরণটাও কষ্টদায়ক এবং মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। মহিব পাহারাদার। যদিও এরা বলে সিকিউরিটি অফিসার। ওরা অনেককিছুই বলে কিন্তু মহিব পাহারাদার ছাড়া অন্য কিছু বলে না। এই 'পাহারাদার' বলার মধ্যে যে একটা প্রহসন লুকিয়ে আছে, মহিব সেটা প্রকাশ করতে চায়। ওর পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর পাহারাদারের কাজ করার যে নেতিবাচক দিকগুলো আছে তা এককথায় প্রকাশ করার জন্য মহিব 'পাহারাদার' ছাড়াও অন্য কোনো যথাযথ শব্দ খুঁজছে যাতে কেউ 'আপনি কী করছেন' প্রশ্ন করলে জবাবে যেন একইসাথে নিজের পদ ও ভোগান্তি প্রশ্নকর্তার কাছে চটপট তুলে ধরতে পারে। এবং প্রশ্নকর্তাকে আর কোনো ধরনের প্রশ্ন থেকে যেন বিরত রাখতে পারে।
সেই রাতে মহিব ডিউটি করছিল। আসলে ভাবছিল। খানিকটা চোখের জলও ফেলেছিল। কিন্তু যেহেতু সে স্টেশনে পোস্টেড থেকেই ভেবেছিল বা অশ্রুজল ঝরিয়েছিল তাই অশ্রু ঝরানোর কাজটাও ডিউটির মধ্যেই পড়ে। সামনের খোলা চত্বরে আর কোনো গাড়ি থেমে নেই। শেষ গাড়িটা চলে গেছে রাত পৌনে দু'টোয়। চত্বর ছাড়িয়ে ফুটপাথের দিকে তাকিয়ে ছিল মহিব। ঝাপসা হয়ে আসছিল দুই চোখ। এসময় দৃশ্যটা চোখে পড়ল। কালো মতো কী একটা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে আসছিল। সচকিত হয় মহিব, চোখ রগড়ে ভালো করে তাকায়। কোনো জন্তু ছিল না সেটি। মানুষই। কালো প্যান্ট আর সুয়েটার পরা বেঁটে একটা লোক। ফুটপাথের ওপর সে একবার উবু হচ্ছিল, ফের দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। কিছুটা হেঁটে এগিয়ে গিয়ে আবার সে আগের দৃশ্যেরই অবতারণা করছিল লোকটা। মহিবের ঝাপসা চোখে মনে হচ্ছিল লোকটা যেন লাফাচ্ছিল। কিন্তু কী করছে সে! লোকটা তারপর চত্বরে নামল ফুটপাথ ছাড়িয়ে। মহিব চেয়ার ছেড়ে বাইরে এসে সারি সারি দোকানের সামনে দাঁড়াল। লোকটা কাছে এগিয়ে এল। মহিব জানতে চাইল সে কী করছে। ফর্সা, বেঁটে লোকটা মহিবের প্রশ্নে তাকাল ওর দিকে। জবাব দিল না। উবু হয়ে কী যেন খুঁজতে লাগল। মহিব এবার নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী খুঁজছ তুমি?
কয়েন। কয়েন খুঁজছি।
কয়েন খুঁজছ মানে?
আমি কয়েন খুঁজে বেড়াই। আমার নাম গিলবার্ট। সবাই চেনে আমাকে। তুমি চিনতে পারছ না। লোকটা হাতের তালুতে রাখা কয়েকটি কানাডিয় কয়েন দেখাল মহিবকে।
তুমি তবে রাস্তায় কয়েন টুকিয়ে বেড়াও, কত পাও ডেইলি?
গতরাতে কুড়ি ডলার পেয়েছি। আজ এখনো তেমন কিছু পাইনি।
গুড, মহিব বলল, এখন অনেকরাত। বাসায় যাও। তোমার বাসা কোথায়?
কাছেই।
তবে যাও। সামনে তুমি যেন আরো বেশি কয়েন কুড়িয়ে পাও, সে প্রার্থনা করছি।
কোনো কথা না বলে লোকটা বিচিত্র কায়দায় কয়েন খুঁজতে খুঁজতে একসময় দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। ভাল, আপনমনে বলল মহিব, কাজটা তো মন্দ নয়! আচ্ছা, আমি তো টহল দেবার কাজ করি, আমি কেন মাটির দিকেও একটু নজর দিই না? দুয়েকটি ডলার তো পেয়েও যেতে পারি। সে রাতে মহিব দশ সেন্টের একটি কয়েন কুড়িয়ে পেল। পোস্টে ফিরে এসে ভাবল : কুড়ি ডলার! গড়পরতায় প্রতিদিন মানে প্রতিরাতে কুড়ি ডলার পেলে তো বেশ ভারিক্কি চালেই দিন চলে যাবার কথা। কুড়ি ডলার মানে বাংলাদেশের চোদ্দশ টাকা।
কেবল টহল আর টহল। অর্থহীন মনে হয়। অনেকদিন ভান করেছে মহিব। নিজেকে বলেছে: বেশ এনজয় করছি কাজটা। কিন্তু মনকে তো আর ফাঁকি দেয়া যায় না। প্লাজার দক্ষিণ দিকের সর্বশেষ একতলা একটি লম্বাটে কক্ষ মহিবের ফ্রন্টডেস্ক অফিস। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় রাতভর তাকে টহল দিয়ে বেড়াতে হয়। ঠাণ্ডা, ঝুঁকি আর রাতজাগা। রাত্রিজাগরণ এককভাবে বহুমুখী সমস্যার জন্ম দেয়। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হল বাসা থেকে কর্মস্থলের দূরত্ব। এই দূরত্ব যদি বাংলাদেশে কোনো স্থানে হত তাহলে আর দেখতে হত না। এত লম্বা পথ মসৃণভাবেই পাড়ি দেয় মহিব। তাই কিছুটা রক্ষা।
চেকপোস্টের কামরাটা লম্বাটে। ফ্রন্টডোরটা কাচের ও স্টিলের পাত বসানো। ভেতরে বিশাল একটি হলঘর, তারপর ছোট্ট একটা রুম আর সবশেষে ওয়াশরুম। এই চেকপোস্টটা অক্সি টেকনোলজির অস্থায়ী কার্যালয়। মহিবের মূল চাকরিটা এখানে না, যে সিকিউরিটি কোম্পানিতে সে চাকরি করে, তারা ওকে নিয়োগ দিয়েছে এখানে। কাজ শুরু হয়ে গেছে অক্সির। বিশাল একটা জায়গা জুড়ে বসানো হয়েছে লোহার ফেন্স। সাইটের পশ্চিমদিকে গ্রিল ঘেরা স্থানে রাখা হয়েছে আজদাহা যান্ত্রিক দানবগুলো-ববক্যাট, অ্যাক্সকেভেটর, পিকআপ ভ্যান, টন টন ওজনের গারবেজ রিসাইকল মেশিন। লিফটার এবং আরো নানা যন্ত্রপাতি। এতদিন মহিব জানত না কী কাজ হবে এখানে। প্লাজার কয়েন ওয়াশ লণ্ড্রির কর্মচারি ফিলিপিনো রবার্ট যেন ঘাপটি মেরে ছিল। মহিবের কাছে এসে একরাতে বলল, অ্যাশফল্টের কাজই তো হবে, নাকি?
কী বলবে মহিব? একটু সময় নিয়ে মাঝামাঝি ধরনের একটা উত্তর দিল। বলল, সেটা তো হবেই। আরো অনেক গণ্ডগোল হয়ে গেছে। দেখছ না মাটির কালার কেমন বিবর্ণ? প্রবলভাবে সম্মতির ঘাড় নাড়ল রবার্ট। যেন মহিবের এই একটি উত্তরে সমস্ত কিছু সে বুঝে নিল। রবার্ট বৃদ্ধ, রিটায়ারমেন্টের পর এখন লণ্ড্রিতে পার্টতাইম কাজ করছে। কোনো সূত্র থেকে বা সাইট দেখার পরও মহিব বুঝতে পারছিল না প্রকৃত কী কাজ হবে এখানে। ওর চেকপোস্ট ঘেঁষে দক্ষিণ পশ্চিমের বাইরোড এবং প্লাজার পুরো চত্বরই অ্য্যাশফল্টের তৈরি। কিন্তু তা স্থানে স্থানে ক্ষয়ে গিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায় পুরো প্লাজা এবং বাইরোডে অ্যাশফল্টের কাজই হবে।
কিন্তু অক্সির রকমসকম তো তেমন মনে হচ্ছে না। অ্যাশফল্টের কাজ করতে বা সড়ক সংস্কার করতে যেসব ম্যাটেরিয়ালস আর মেশিন দরকার, সেসব তো এখানে দেখা যাচ্ছে না। আরেকটি বিষয় ভাবিয়ে তুলেছে মহিবকে- আশপাশের দোকানিরা জানতে চাইছে কতদিন লাগবে কাজ শেষ হতে। এরকম প্রশ্ন করার যুক্তিও আছে। কাজটাকে ওরা উটকো ঝামেলা মনে করছে। ফেন্স দেবার কারণে তাদের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে। এরা চাইছে পাশের বাইরোড বা প্লাজার চত্বর দ্রুত পাকা হয়ে উঠুক। কিন্তু এত সময় লাগছে কেন? রাস্তা বা চত্বর পাকা করতে হলে করে ফেলো না। এত দহরম মহরম কেন?
বিষয়টা ভাবনায় ফেলার মতো। কাজটা যে সাধারণ কোনো কিছু না সেটা ঠাওর করা যাচ্ছে। বড়সড় কোনো ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু মাত্র দু'জন লোক কাজ করছে। জন আর রাজমা। দু'জনেই জন্মসূত্রে কানাডিয়। জন প্রজেক্ট সুপারভাইজার আর রাসমা হেলথ ও সেফটি অফিসার। জন ওয়াকিটকি হাতে ছুটে বেড়াচ্ছে আর রাজমা যা করে বা করছে, তা দেখার মতো। বেঁটে মোটা ও মাঝারি বয়সের এই মহিলা সব কাজ একাই সারছে। চেকপোস্টের বিশাল ঘর ঝাঁট দিচ্ছে নিজে। ছুটাছুটি করছে কনস্ট্রাকশনজনিত দুর্ঘটনা বা অসুস্থতা নিয়ন্ত্রণে সার্বিক ব্যবস্থা নিতে। গত কয়দিনের ডিউটির সুবাদে মহিব দেখল মহিলা চেকপোস্টটাকে একটা হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছে। অনটারিও প্রদেশের স্বাস্থ্য নীতিমালা, মিউনিসিপ্যালের স্বাস্থ্যবিষয়ক আদেশ-নির্দেশ, ফায়ার সেফটির যাবতীয় নোটিস সে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ফার্স্ট এইড বক্স, ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার, এমার্জেন্সি আই ওয়াশ প্রভৃতি স্থাপন করেছে সে রুমটায়। হেলমেট পরার, মাক্স লাগানোর নির্দেশনা স্থানে স্থানে ঝুলিয়ে দিয়েছে। কাজকারবার দেখে মনে হচ্ছে এটি ভূমিকম্প পরবর্তী কোনো মেডিক্যাল টিমের তৎপরতা। সাইটের লোহার ফেন্সের যত্রতত্র ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে : CONSTRUCTION SITE. MUST BE WORN : HARD CAPS, SAFETY SHOES. মহিব মহিলার এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা দেখে মহিলার হয়ে চেকপোস্টটা ঝাঁট দিয়ে দিল। আমাদের দেশে এরকম একজন পদস্থ মহিলার একজন কম্পিউটার অপারেটর, একজন পিওন, একজন ম্যাসেঞ্জার ও একজন ক্লিনার লাগত। তারপরও সেই পদস্থ অফিসার লোকবল বাড়ানোর জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে হয়তো পত্র দিত। রাজমা ও জনের কাণ্ডকীর্তি যে হেলার নয়, তা স্পষ্ট করে দিল অক্সির জিওলজিস্ট টেড। সে ভোরে মনোগ্রাম লেখা পিকআপ চালিয়ে সাইটে আসে। এক ভোরে গাড়ির ভেতরে বসে কাগজপত্র দেখছিল সে। মহিব গিয়ে বলল, তুমি অফিসঘরে এসে বসতে পারো। লোকটা বড় ও দামি ব্যক্তি। কিন্তু মহিবের আমন্ত্রণকে সে আদেশ মান্য করে লাফ দিয়ে পিকআপ থেকে নেমে অফিসে ঢুকল। বিনয়ের সাথে বলল, ওয়াশরুমটা ব্যবহার করতে পারি?
ওয়াশরুমের কাজ সেরে টেড ফিরে এসে চেয়ারে বসল। মহিব জিজ্ঞেস করল, তোমরা কী কাজ করছ জানতে পারি কি? নিশ্চয়ই, লাফ দিয়ে উঠে টেড বলল, এদিকে এসো। ওর আহ্বানে মহিব লোকটার নির্দেশিত নোটিসবোর্ডের দিকে তাকাল। টেড ম্যাপে আঙুল রেখে বলল, প্লাজার এই সার্কেলকৃত স্থানটার তলদেশের মাটি দূষিত হয়ে পড়েছে। আগে এখানে গ্যাস স্টেশন ছিল। ওদের পল্যুশন মাটিকে দারুণভাবে কলুষিত করেছে। আমরা যন্ত্রপাতি আর ক্যামিকেলস দিয়ে মাটি দূষণমুক্ত করব।
এইখানে, এই কক্ষে এরকম একটা ম্যাপ আছে, কী কাজ হবে তার ইঙ্গিত দেয়া আছে - সেটা মহিবের নজরে পড়েনি। মহিব মিনমিনে সুরে বলল, তাহলে তো বেশ বড় কাজই তোমরা করছ।
টেড চলে গেলে মহিব ম্যাপে মনোনিবেশ করল। ম্যাপে দেখানো হয়েছে এই প্লাজা ও আশেপাশের কিছু এলাকার মাটি পিএইচসি (পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বন) দূষণে আক্রান্ত হয়েছে। আরো দেখানো হয়েছে কোন স্থানে এক্সকেভেশন করা হবে। প্রথমে এরা ডিওয়াটারিং-এর কাজ করবে। মহিব এখানকার চৌকিদার। সুতরাং আদার বেপারি হয়ে জাহাজের খবর নেয়া তার সাজে না। কিন্তু মন মানছিল না। কেউ যদি প্রশ্ন করে, কী কাজ হচ্ছে? তখন একটা জুতসই জবাব সে দিতে পারবে।
টেড খাস কানাডিয়, দেখতে সুপুরুষ আর বয়স সামান্য যুবা-উত্তর। রাজমাও কানাডিয়, কিন্তু তার ভেতরের ভালোমানুষির জন্য তাকে দেশি ভাবতে ভালো লাগে মহিবের। প্রকাণ্ড একটা ভুঁড়ি নিয়ে মহিলা যেভাবে দৌড়াচ্ছে, দেখে মনে হয় আস্ত একটা মিষ্টি কুমড়া গড়িয়ে চলছে। এরা যে পরিশ্রমী ও কাজেকর্মে আন্তরিক কানাডা আসবার আগে মহিব তা জানত, এখন স্বচক্ষে দেখছে। তবে সে ঝক্কিবিহীন একটা চাকরি চেয়েছিল। আসা অব্দি হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে চাকরি পাওয়া এখানে রীতিমতো দ্বিতীয় জন্মপ্রাপ্তির মতো। আর পছন্দমতো চাকরিপ্রাপ্তি তো দুঃস্বপ্নকে অতিক্রম করে স্বর্ণমৃগের দেখা পাওয়া। এখানে আগমন ইস্তক এরকম স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে ঠেলেঠুলে চলছে দিনগুলো। আবেদন করে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ায় খুব দ্রুত উতরে যাবার মতো ভাগ্যবানদের একজন মহিব। আরো একটি বিষয়ে সে ভাগ্যবান। বিয়েথা করেনি বলে দেশে সে চাকরির টাকাগুলো জমাতে পেরেছিল। ঢাকায় সে মেসে থাকত। খরচাপাতি তেমন ছিল না। মদ-মেয়েমানুষের অভ্যাস হয়নি, বাড়িতে টাকাপয়সা পাঠাবার কোনো গুরুভার ছিলনা। এরকম অনেক বিষয়ে সে ভাগ্যবান ছিল। কেবল একটা বিষয়ে ঘাটতি আছে তার - বউ নেই, কোনোকালে ছিলও না। একে একে বিয়াল্লিশটি বসন্ত পার করে দিয়ে এখন বিয়ের কথা শুনলে তার হাসি পায়। মা-বাবা বহু আগেই গত হয়েছেন, তাদের একমাত্র সন্তান সে। আগে ছিল বন্ধু পরিবেষ্টিত, এখন নিঃসঙ্গ।
কয়েকরাত আগে সে টহল দিয়ে পোষ্টে ফিরে এসে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের আগে তন্দ্রায় উঁকি দিয়ে গেল একটা মুখ। এক তরুণীর আদল। সাধারণত ঘুমঘোরে বা তন্দ্রায় কোনো তরুণীর মুখ দেখে না মহিব। দেখে কালো বিশাল নিগ্রোগুলোর চেহারা। টহলের সময় এদেরকে দেখে মহিব তটস্থ থাকে। এই নিগ্রোগুলোর চেহারা ভেসে আসে ঘুমের অতলে, দুঃস্বপ্ন তাড়া করে মহিবকে। একটা সময় শুয়ে শুয়ে কোনো তরুণীর সুশ্রী মুখাবয়ব দেখার চর্চা করত সে। একসময় তা থেমে যায়। ততদিনে সে বুঝে গেছে বিয়ে তার ভাগ্যে সহসাই ঘটছে না। ভাল চাকরি পেলে বিয়ে করবে, এমন ভেবেছিল প্রথমে। ভালো চাকরি তার হয়েছিল কিন্তু অনেক সময় নিয়ে। তারপর ভাবল, চাকরিটা পোক্ত হোক। কিছু পয়সা জমুক। যখন ভালো একটা পুঁজি দাঁড় করালো তখন সে পাড়ি দিল দূরদেশে। সুতরাং বিয়ে নামের বিষয়টি অনিষ্পত্তিকৃত দীর্ঘসূত্রীয় মামলার মতো আজও ঝুলে আছে। কিন্তু হঠাৎ ওর মনের কোণে কোনো এক তরুণী কেন উঁকি দিয়ে গেল? অস্পষ্ট, কুয়াশাচ্ছন্ন একটি মুখ। মহিব চেষ্টা করল মুখটিকে মন থেকে সরাতে। কিন্তু পারল না। অতএব কোনো এক তরুণীর মুখদর্শন পর্ব চলতে থাকল।
রাতভোর বৃষ্টি ও কনকনে হাওয়া। অক্টোবরের শুরু। ক'দিন পরেই নামবে আসল ঠাণ্ডা। শুরু হবে স্নোফল। জমবে বরফ, অ্যান্টার্কটিকার মতো রূপ ধারণ করবে দেশটি। উত্তর গোলার্ধের এই দেশটিকে অনেকেই এই একটি কারণে পছন্দ করে না। বছরের সাতমাসই বরফে ঢেকে, ঠাণ্ডায় কাহিল হয়ে কাতরাতে থাকে।
কনকনে ঠাণ্ডায় আর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে টহল সারছিল মহিব। পা চলছিল না। মনে হলো বাসায় গিয়ে ব্ল্যাঙ্কেটের উষ্ণতায় টানা ঘুম দেয়। একটুখানি উষ্ণতা যে ওর কাছে কোহিনূর হীরকখণ্ডের মতোই অধরা, সেটা মহিবের চাইতে বেশি আর কে জানে। একটা নয়া উৎপাত দেখা দিল। চত্বরে একটা গাড়ি থেমেছে। গাড়িটার গায়ে সিলছাপ্পর দেখে বুঝতে পারে তার কোম্পানির গাড়ি। তার মানে সুপারভাইজার এসেছে প্রহরার তদারকি করতে। মহিব দূর থেকে চান্দি আশফাককে নামতে দেখল। গায়ের রং ফর্সা, দশাসই শরীর। ব্যাটা আদতে পাকিস্তানি, এখানে এসে কানাডিয় বনে গেছে। কোম্পানির সিকিউরিটি ড্রেসটা স্বাস্থ্যের প্রাচূর্যের কারণে মানিয়ে গেছে তাকে। ওপরে গরম কাপড় লাগায়নি - গাড়ির হিটের ভেতরেই কাটে রাতদিন। আশফাক নাকিসুরে 'হাই মহিব' বলে এগিয়ে এল। মহিব যৎসামান্য হিন্দি আর উর্দু বলতে পারে। কিন্তু আশফাকের সাথে সে কখনো উর্দু বলে না। এরা আশা করে, সব বাঙালিই উর্দু জানবে এবং ওদের সাথে মোলাকাত হলে যেচে পড়ে উর্দু বলা শুরু করবে। মহিব যে কোনো পাকিস্তানির সাথে ইংরেজিতে কথা বলে। আশফাক মহিবের ড্রেসের দিকে তাকাল। দেখল মহিব কোম্পানির দেয়া প্যান্ট-শার্ট-টাই ঠিকমতো পরেছে কিনা। মহিবের পোশাকের কোনো ত্রুটি না পেয়ে আশফাক বলল, চলো অফিসে তোমার মেমোবুক আর ট্যুর অভ ডিউটি ফরম দেখি।
শালা মাওড়া। মহিব মনে মনে উচ্চারণ করল। টেবিলে ছড়ানো ছিটানো অকারেন্স ফরম আর টিওডি। মেমোবুক লেখাটা কিছু বাকি ছিল। আশফাক সেটাই আগে হাতে নিল। দেখেশুনে, চান্দিতে আলোর রশ্মি ছড়িয়ে আশফাক বলল, মেমোবুক সবসময় আপডেট করে রাখবে। আর লেখার মাঝখানে কোনো ফাঁকফোকর রাখবে না। ঠাসাঠাসি করে লিখবে।
পুরনো কথা। মহিব আবার উচ্চারণ করল মনে মনে।
আশফাক সুপারভাইজরি ফরমে বিবরণ লিখল। একটা কপি নিজ পকেটে রাখল আর অন্যটা বাইণ্ডিং নথির ক্লিপে আটকে বলল, গুডনাইট। সি ইয়্যূ লেটার।
তোমার কুমড়ার মতো মুখখানা আর তেলে-চান্দি সহসা আর দেখতে চাইনা। মহিব মনে মনে উচ্চারণ করল। আশফাক ফাঁকা চত্বরে গাড়ি এত দ্রুত টার্ণ করল যে চাকার ঘ্যাঁচ শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেল। চাকার শব্দে মহিবের মনে পড়ে গেল একটা দুর্ঘটনার কথা। এইদেশে আসবাব দিনকয়েকের মধ্যেই ওর বাসার কাছে ড্যানফোর্থে একটা গাড়ি ব্রেক কষেছিল। ব্রেক করার কারণ হলো পথচারি পারাপারের আগমুহূর্ত পর্যন্ত গাড়িটার প্রচণ্ড গতি ছিল। ব্রেক করলেও গাড়িটা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সামনের একটা গাড়িকে ধাক্কা মারল। ব্যস, শুরু হয়ে গেল তুলকালাম কাণ্ড। সামনের গাড়ির চালক বেরিয়ে এসে গগনবিদারী চিৎকার শুরু করল। আঘাতকারি তরুণী গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। তরুণীটি নার্ভাসভঙ্গিতে এগিয়ে এল সামনের গাড়ির দিকে। তেমন কিছু হয়নি, একটু টেপ খেয়ে গেছে। ইতোমধ্যে পুলিশ এসে গেছে। মেয়েটা বারবার 'সরি' করছিল পুলিশের কাছে, লোকটার কাছে। মেয়েটাকে ভারতীয় বা শ্রীলংকান মনে হয়েছিল মহিবের কাছে। চাপা রং, সুশ্রী মুখ। একটু আগের চাকা ঘষটানোর শব্দে বহুদিন আগের সেই দৃশ্যটা ফের জেগে উঠল মনে। তারপর কী হয়েছিল? কত ডলার জরিমানা হয়েছিল মেয়েটির?
মেইন রাস্তা থেকে গাড়ির চাকা ঘষটাবার শব্দে সচকিত হয় মহিব। আজ রাতটা বুঝি চাকা ঘষাঘষির রাত? মহিব ঘড়ি দেখে - তিনটা কুড়ি। ওর পোস্টের পাশেই ই। জেড লুব। গাড়ি সার্ভিসিং করা হয়। তার একপ্রান্তে একচিলতে স্থানে একটা কনভেনিয়েন্স স্টোর, মানে মুদির দোকান। অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে দোকানটা। বাইরে নিয়নের লালবাতিতে OPEN লেখাটা জ্বলজ্বল করে। দোকানটা চালায় জেইয়া। তামিল ভাষায় কথা বলে। কালো, শাদামাটা নিরীহগোছের চল্লিশোর্ধ ব্যক্তি। ডিউটির প্রথমদিন থেকেই জেইয়ার সাথে পরিচয়।
জেইয়াকে মাঝেমধ্যে বাইরে এসে সিগারেট খেতে দেখা যায়। কিন্তু সে রাতে তাকে একবারও দেখা গেল না। দোকানে যথারীতি OPEN লেখাটা জ্বলছিল। হয়তো জেইয়া ভেতরে বসে কম্পিউটারে কাজ করছে। মহিব দোকানের ভেতরে ঢুকল। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। সেই মেয়েটি না! মহিবকে 'হাই' বলল মেয়েটি। মহিবকে সে চেনেনি। একজন খদ্দের হিসেবে হাই করেছে। মহিব বলল, জেইয়া নেই?
না, তবে চলে আসবে। তুমি চেন তাকে?
হ্যাঁ, চিনি।
তুমি বুঝি এখানকার সিকিউরিটি অফিসার? মেয়েটা মহিবের ড্রেসের দিকে একনজর চোখ বুলিয়ে বলল।
হ্যাঁ।
হাই দেয়ার - বলে জেইয়া ঢুকল। বলল, সি ইজ মাই ওয়াইফ।
ইয়োর ওয়াইফ! মহিবের মুখনিঃসৃত বাক্যটি বিস্ময়সূচক। ওর এরকম বিস্ময় দেখে জেইয়া অবাক হয়ে তাকাল। মহিব বলল, তোমার ওয়াইফ কি একবার একটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল? মানে তার গাড়ি দিয়ে সামনের একটা গাড়িকে ধাক্কা মেরেছিল?
তুমি কেমন করে জানো?
সেদিন সেখানে ছিলাম। তোমার ওয়াইফ খুব নার্ভাস ছিল।
ঘটনাটা মনে পড়লে এখনো শিউরে উঠি, এবার তরুণী বলল, যদি বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেত। গ্ল্যাড টু মিট য়্যূ মি. - ।
মহিব, নামটা বল সে।
আমার নাম শ্রীরাধা।
তুমিও কি তামিল?
হ্যাঁ, আমরা দু'জনেই। জেইয়া উত্তর দিল।
এই তরুণীই তবে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল মনে! টেলিপ্যাথির বিষয়টি কি ওর ক্ষেত্রে ঘটে গেল নাকি! এই চেহারাটাই তো ওর মানসপটে ভাসছিল।
মজ্জা ভেদ করা ঠাণ্ডা। বাচ্চা ছেলের টানা ঘ্যানঘ্যানে কান্নার মতো বৃষ্টি চলছে। মহিব কাতর চোখে তাকায় প্রকৃতির দিকে। এরকম শীতার্ত ম্যাড়ম্যাড়ে রাত্তিরে ওকে টহল দিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ভেতরে হিটের মধ্যে বসে বাইরের ভেজা প্রকৃতিটাকে বাংলাদেশের মতো লাগে - বাইরে বেরুলেই বুঝি বাংলাদেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহকে ছুঁয়ে দেখা যাবে। মহিব চেয়ে থাকে উতলা চোখ মেলে। কেউ নেই দেশে, স্ত্রী প্রতীক্ষায় থাকে না, জননী পথের দিকে চেয়ে চোখ ভাসায় না, পিতা আকুল হয়ে থাকে না, একটি ভাই বা বোন সাগ্রহে দিন গোনে না। তবু ফিরে যেতে মন চায় সেই দেশে।
শ্রীরাধার সাথে দেখা হল আবার। দোকানে ছিল। দারুণ লাগছিল ওকে। মেয়েটার গায়ের রং চাপা, কালোর দিকেই। কিন্তু এই কালোর সর্বত্র শ্রী লুকিয়ে আছে। চোখেমুখে, এমনকি হাতে পায়ে কথা বলে যাচ্ছিল শ্রীরাধা। ওর ইংরেজি খুব ভালো না। মহিবের মনে হল ইংরেজি না বলে শ্রীরাধা যদি তামিল বা সিংহলজি ভাষায় কথা বলে যায়, মহিব তা-ও বুঝতে পারবে।
এরমধ্যে একটা অপয়া ব্যাপার ঘটে গেল। অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। কর্তৃপক্ষ ওকে বদলি করে দিয়েছে অন্য সাইটে। একটা কণ্ডোমিনিয়ামে, সংক্ষেপে কণ্ডো। থিসলডাউন থেকে তিন কি.মি. দূরে বার্গামট অ্যাভেনিউতে। ভাঙা মন নিয়ে মহিব নতুন সাইটে এল। এখানে সিসি টিভি, ওয়াকিটকি, অটোমেটিক ডোর-সবই আছে। কিন্তু তবু পছন্দ হল না মহিবের। থিসলডাউনের জন্য কেমন করে উঠল মনটা। জায়গাটা বেশ ছিল। খবরদারি ছিল না তেমন। নিজের মতো করে সে ডিউটি করতে পারত। কিন্তু বর্তমান দৃশ্যপট ভিন্ন, এক অর্থে ভয়াবহ। এটা ওয়াইডব্লিউসি পরিচালিত কণ্ডো। থাকে অবসরপ্রাপ্ত বুড়ি, চাকরিজীবি জোয়ান মেয়েসহ সব ধরনের মহিলা। ব্রিফিং-এর সময় ওকে বলা হয়েছে যে, এখানে যারা ভিজিটরস, তারা মহিবের কাছে রাখা রেজিস্টারে সাইন-ইন ও সাইন-আউট করবে। কাজটা কণ্ডোর সুপারভাইজার করে। রাতে তার ডিউটি থাকে না বলে বিষয়টা মহিবের ঘাড়ে চেপেছে। যে মেয়ে বা মহিলার কাছে গেস্ট আসবে সে নিজ দায়িত্বে বাজারের মাধ্যমে ফ্রন্ট গেট খুলে দেবে। গেস্ট তখন আসতে পারবে মহিবের কক্ষে। এখানে সাইন-ইন করার পর প্যাসেজের দরজা খুলে দেবে হোস্ট। সন্ধ্যেয়, গভীররাতে এরকম গেস্ট আসতে দেখছে মহিব। ফ্রন্ট এন্ট্রান্স ড্রাইভওয়ে থেকে বেসমেন্ট, প্রতি ফ্লোরের প্যাসেজ, সারি সারি কক্ষে ঢোকার দরজা-সব সিসিটিভিতে দেখা যায়। দেখে দেখে ঘেন্না ধরে গেছে। সিসিটিভির প্রতি ঘেন্না নয়, ডিউটির প্রতিও না। ঘেন্নাটা অন্য জায়গায়। এরা বলে এখানে ভদ্রগোছের স্বয়ংসম্পূর্ণা নারীরা বসবাস করে। কিন্তু প্রতিরাতে মহিব যা দেখে তা বিচ্ছিরি। নোংরা। ড্রাগ আসক্ত ও মদ্যপ যুবকেরা আসে। তারা ঢুকে যায় নিজ নিজ প্রণয়িণীদের কক্ষে। প্রায় রাতেই প্যাসেজে মহিব দেখতে পায় কোনো মাতাল ঢুকছে কোনো কক্ষে। সারারাত অবস্থান করে। ভোরের আলো ফোটার আগেই বের হয় আলুথালু ব্যসনে। সংক্ষিপ্ত পোশাক গায়ে কোনো মেয়ে বা মহিলা প্যাসেজের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয় মাতাল প্রেমিককে।
এদেরকে পাহারা দিচ্ছে মহিব, এদের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি ন্যস্ত হয়েছে ওর ওপর। এক নিগ্রো মেয়ের কক্ষে প্রায় রোজরাতেই আসে এক যুবক। সে-ও কালো। ভোররাতে মেয়েটি যুবকটিকে এগিয়ে দিতে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আসে প্যাসেজের দরজা পর্যন্ত। মহিবের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে একটা তালিকা। এতে ক'জন মহিলা ও যুবতীর নাম আছে। তাদের প্রতি এক্সট্রা কেয়ার নিতে হবে। এরা শারীরিক প্রতিবন্ধী। তারা কোনো হেল্প চাইলে হেল্প করতে হবে! ঘেন্না, ঘেন্না! এই নিগ্রো মেয়েগুলো পাছার অনেক নিচে জিন্স পরে, পাছার খাঁজ দেখা যায়। বুকে যে টেপ লাগায় তা এমনি সংক্ষেপিত যে না লাগালেও চলে।
সাইট বদল হবার পর শ্রীরাধার কথা ক'দিন খুব খেলল মাথায়। এরপর স্তিমিত হয়ে গেল। এই বিদঘুটে কালো মেয়েগুলোর পাশে শ্রীরাধাকে দাঁড় করালে মনে হবে আফ্রিকার গহিন জঙ্গলে জংলি পরিবেষ্টিত হয়ে শ্রীরাধা 'বাঁচাও, বাঁচাও' বলে আর্তনাদ করছে। এইসব চূর্ণকুন্তল ভাবনাগুলো মহিবকে একদিন টেনে নিয়ে এল পুরনো সাইটে। এক ডে-অফে মহিব হাজির হল থিসলডাউনে। বেলা তিনটা, প্রখর সূর্য। কনস্ট্রাকশন সাইটের একপ্রান্তে দুইজন লোক একমনে কাজ করে যাচ্ছে। দেখা হয়ে গেল আইভান ডাইলালোভের সাথে। তরুণ, ফর্সা ও লম্বা। সুদর্শন। ইউক্রেনিয়। আইভান ওকে দেখে যুগপৎ উচ্ছ্বসিত ও বিস্মিত হল। ইতিহাসের কুখ্যাত 'আইভান দ্য টেরিবল' নামেই মহিব ওকে ডাকত। শিফটিং-এর সময় ওদের দেখা হত। একরাতে দু'জনের একইসাথে ডিউটি পড়েছিল। সেরাতে ওরা গল্প করে কাটিয়েছিল। আইভান বলল, কী ব্যাপার মহিব, কোনো কাজ পড়ল নাকি এখানে?
না, কোনো কাজ নয়। সাইটটার প্রতি মায়া পড়ে গেছে।
চা খাবে?
খাওয়া যায়। তবে তার আগে জেইয়ার সাথে একটু দেখা করে আসি।
জেইয়া, ইউ মিন...।
ওই যে কনভেনিয়েন্সটা চালায় যে লোকটা।
তাই বলো। কিন্তু সে তো দোকান চালায় না আর। দোকান তো অনেকদিন যাবৎ বন্ধ দেখছি।
কেন! ওর কোনো বিপদ?
শুনেছি ওর ওয়াইফ..।
শ্রীরাধা। নামটা বেরিয়ে আসে মহিবের মুখ দিয়ে।
তুমি দেখছি ওর ওয়াইফের নাম জানো!
এই আরকি। মানে জেইয়া আমার বন্ধু তো, তাছাড়া আমরা সাউথ এশিয়ান। কিন্তু কী হয়েছে ওর ওয়াইফের?
শুনেছি ওয়াইফ নাকি সিংহলে চলে গেছে।
চলে গেছে মানে!
পোস্টে ফিরে চা বানাতে বানাতে আইভান বলল, আমি বেশি কিছু জানি না। শুনেছি চলে গেছে। আইভান চা বাড়িয়ে দিল মহিবের দিকে। দু-এক চুমুক দিয়ে উঠে পড়ল মহিব। নিজে একজন সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে জানে আইভানের সীমাবদ্ধতা। বন্ধুকে পেয়ে বাইরের ডিউটি ছেড়ে পোস্টে এসে চা বানিয়েছে আইভান। মহিব বলল, সেলফোনে যোগাযোগ রেখো আইভান।
রাখব। হঠাৎ এমন অফ হয়ে গেলে যে মহিব? আমার কিন্তু সময় আছে হাতে আরো কিছুক্ষণ কথা বলা যেত।
না, থাক। আজ আর না। মহিব নিজের অবস্থাটা আরো মেলে দিল।
তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিল আইভান। বলল, মহিব তোমাকে আনমনা দেখাচ্ছে। মহিব হাসল। বলল, তেমন কিছু না। আসলে সিকিউরিটির কাজ করে বোর্ড হয়ে গেছি। জানোই তো একা থাকি এদেশে। মাঝেমধ্যে দমে যায় মনটা।
আইভানের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা, তার চোখ আরো শাণিত হল। বলল, ইয়্যূ নিড আ ওয়াইফ।
ওয়াইফ! মহিব আকাশ থেকে পড়ল। তারপর হেসে উঠল, ও ওয়াইফ।
তোমাকে রিড করতে পারছি মহিব। এভাবে চললে আর কিছুদিন পর মরে যাবে তুমি। তুমিই তো বলেছ পৃথিবীতে তোমার কেউ নেই।
ধন্যবাদ আইভান। কিন্তু...।
ওকে মহিব, ইয়্যূ ডিসাইড।
ফেরার সময় আইভানের কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে। থিসলডাউনের সেই কাচঘেরা বাসস্টপ পার হচ্ছিল মহিব, এসময় ডাকটা শুনতে পেল। এক তরুণী দাঁড়িয়ে ছিল কাচঘেরা ঘরে। এই তরুণীর ওকে ডাকবার কথা না। ভুল শুনেছে ভেবে চলে যাচ্ছিল মহিব। আবার ডাক শুনতে পেল। তাকাল মহিব, জোব্বাজাব্বা গায়ে তরুণী কাছিয়ে আসতেই মহিব চিনতে পারল। শ্রীরাধা! মিষ্টি মুখটা গরম টুপিতে প্রায় ঢাকা। ওর ঘন পাঁপড়ি ছাওয়া চোখে কৌতুকমেশানো বিস্ময়, মহিব তুমি এখানে! তুমি না বদলি হয়ে গেছ?
পুরনো স্থানটা দেখতে মন চাইল। তাই এসেছিলাম। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?
এখানকার নো-ফ্রিল্সে কাজ নিয়েছি। ডিউটি শেষ, বাসের জন্য অপেক্ষা করছি।
তোমার গাড়ি?
গাড়িটা এখন নেই।
তোমার সময় হবে শ্রীরাধা? কফিটাইমে একটু বসতে চাই তোমার সাথে। যদি...।
শ্রীরাধা ঘড়ি দেখল। তারপর বলল, বসা যায়। আমার তো ডিউটি শেষ। একটু পরেই না হয় ফিরব বাসায়।
শ্রীরাধাকে সাথে নিয়ে কফিটাইমে ঢুকল মহিব। শ্রীরাধার জন্য ডাবল-ডাবল আর নিজের জন্য ব্ল্যাক কফি নিয়ে শ্রীরাধার মুখোমুখি বসল মহিব। শ্রীরাধাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মহিব কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবল কীভাবে কথা শুরু করবে। শ্রীরাধা কফিতে চুমুক দিল না। কফি আগলে বসে রইল। শ্রীরাধা বলল, তুমি তো জেইয়ার স্টোর বন্ধ পেয়েছো, কেন তা জানো?
কলিগ আইভান বলেছে দোকানটা বন্ধ, কিন্তু কেন বন্ধ তা জানিনা।
আইভান বলেনি তোমাকে?
বলেছে, যা বলেছে সেটা আমার কাছে গোলমেলে মনে হচ্ছে। তোমাদের মধ্যে কি কিছু ঘটে গেছে?
হ্যাঁ মহিব। আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আরো আগে হলে ভাল হত। ভাবছ কেন ছাড়াছাড়ি হল?
তা ভাবছি বৈকি, তোমাদেরকে দেখে কখনো মনে হয়নি তোমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে।
সে অনেক লম্বা কাহিনি। জেইয়া তোমার বন্ধু। সবকিছু বললে তোমার মন বিগড়ে যাবে। তারচেয়ে সে তোমার বন্ধু, বন্ধু হয়েই থাকুক।
তুমিও তো আমার বন্ধু। জেইয়ার সাথে পরিচয়ের পর্বে তোমার সাথেও তো পরিচয় হয়েছে আমার। জেইয়া স্টোরে ব্যস্ত থাকত। কথা তো বেশি হত তোমার সাথেই।
তা ঠিক, তাহলে সামান্য বলি তোমাকে। জেইয়া ড্রাগ নিত। যত রকমের ড্রাগ আছে, সে নিত। বহুবার বারণ করেছি, শোনেনি। কনভেনিয়েন্সটাকে ঘিরে ওর যত বন্ধু তুমি দেখেছ, তারা সবাই অ্যাডিক্টেড। তোমার সাইটের পেছনের জংলাস্থানটা ছিল ওদের আড্ডাখানা। কয়েকবারই পুলিস সেখানে হানা দিয়েছিল। একবার জেইয়াকে ধরেও নিয়ে যায়। আজেবাজে বন্ধুদের কারণে ওর স্টোর ভাল চলছিল না। আমি কয়েন ওয়াশ লণ্ড্রিতে কাজ করে সংসার চালাতাম। বহুবার বলেছি, দোকান বিক্রি করে তুমি কোনো কাজে ঢুকে পড়। সে শুনলই না। ওর বন্ধুরাই দোকান থেকে এটাসেটা সরিয়ে ফেলত। পাশের সেলুনের ক্রিস্টোফার নিজ চোখে দেখে এসব জানাত আমাকে। জেইয়াকে এসব বললে সে খেপে যেত। ওর ড্রাগ অ্যাডিক্ট বন্ধুরা ওর কাছে রীতিমতো সাধুপুরুষ। সে গাড়িটা বিক্রি করে দিল। কিছুদিন পর নজর পড়ল আমার গাড়ির দিকে। আমাকে বলল যে কিছু চালু আইটেম দোকানে তুলবে। দোকানটাকে নতুনভাবে সাজাবে। রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। তারপর তো সে আমার গাড়িও বিক্রি করল। কিন্তু দোকানের কোনো উন্নতি দেখলাম না। এরমধ্যে এক বৃষ্টির রাতে দোকানে ডাকাতি হয়ে গেল। দু'জন কালো নাকি খরিদ্দারের বেশে দোকানে ঢুকে, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে জেইয়ার বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে সব নিয়ে গেছে। ছোট্ট দোকানের ভেতরে বৃষ্টির জনশূন্য রাতে এমনভাবে ব্যাপারটা ঘটে গেল যে কেউ টের পেল না। শুনে কেঁদে ফেললাম। জেইয়ার চোখ লাল হয়ে ছিল সে রাতে। ড্রাগের প্রভাবে ওকে দেখাচ্ছিল দানবের মতো।
তুমি আমার সব শেষ করে দিয়েছ - এসব বলে আমি দেয়ালে মাথা ঠুকতে লাগলাম। জেইয়া আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে থাকল। বললাম, দোকানে ডাকাতি হল, পুলিস এল, চলেও গেল। আর তুমি তোমার জানের দোস্তদের নিয়ে গাঁজায় দম দিলে। আজ রাতে এই কাজটা তুমি না করলে পারতে না? বিশ্বাস করবে না মহিব, জেইয়া স্পেনদেশিয় ষাঁড়ের মতো ছুটে এল আমার দিকে। তারপর... তারপর সে আমাকে পেটাল!
মহিব মাথা নত করে শুনে যাচ্ছিল। এবার তাকাল শ্রীরাধার দিকে। মেয়েটার দুই গণ্ড বেয়ে অশ্রু ঝরছিল। মহিব বলল, তাহলে এই! একটু ভেবে মহিব আবার বলল, কী জানি হয়তো এটাই সমাধান। গড নোজ। তুমি এখন কোথায় যাবে? এগিয়ে দেবো তোমাকে?
না। বাস এখান থেকে সোজা বার্গামট অ্যাভিনিউর ওয়াইডব্লিউসিএ'র সামনে থামবে। ওখানেই উঠেছি আপাতত।
বার্গামট অ্যভিনিউর ওয়াইডব্লিউসি'এ! সেখানেই তো আমার পোস্টিং। ওখানে কীভাবে আছো, আই মীন ওটা তো বার্গামট অ্যাভিনিউর ওয়াইডব্লিউসিএ। বেশ এক্সপেনসিভ। তাছাড়া ক্রিশ্চান...।
আমার বান্ধবী রোজমেরি সেখানে একটা স্যুইটে একা থাকে। আপাতত ওর সাথে শেয়ার করছি। পরে অন্য কোথাও উঠে যাব।
তোমার কোনো কাজে লাগতে পারলে খুশি হব।
তোমার ডিউটি কি রাতে?
হ্যাঁ, সারারাত।
তাহলে আর কী, তোমাকে জানাব তেমন কোনো দরকার পড়লে।
অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসতে আসতে মহিব ভাবল, শ্রীরাধাকেও তবে পাহারা দিতে হবে। সেই শ্রীরাধা! অ্যাক্সিডেন্ট। নার্ভাস শ্রীরাধা। তারপর হাস্যোজ্জ্বল শ্রীরাধা। এখন কক্ষচ্যুত!
ঘুম ভেঙে অবাক হল মহিব। দুইটি কারণে। ঘরটা ফর্সা লাগছে। বাইরে তাকিয়ে দেখল সূর্য সোনা ঝরাচ্ছে প্রকৃতিতে। জমাট শাদা বরফের ওপর সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে অজস্র রঙে। ওর অবাক হবার দ্বিতীয় কারণটি হল রাতে বিরতিহীন তৃপ্তিকর নিদ্রা হয়েছে। এমন আরামদায়ক নিদ্রা কি শ্রীরাধার সাথে শিহরণ জাগানিয়া সঙ্গলাভের কারণে?
দীর্ঘক্ষণ ধরে শাওয়ার নিল মহিব। ডিউটিতে রওনা দিতে হবে পাঁচতায়। সন্ধ্যে সাতটা থেকে কাজ শুরু। ঠাণ্ডা তাড়াতে দ্রুত হেঁটে সাবওয়ে স্টেশনে যাবে। ট্রেনে উঠে রয়ালিয়র্ক পর্যন্ত নিশ্চিন্ত বসে থাকা। রয়ালিয়র্কে নেমে স্টেশনের ভেতরেই অবস্থান করে কাচের ভেতর দিয়ে ইপ্সিত বাসটা আসতে দেখতে পেলে এক দৌড়ে বাইরে এসে বাসে উঠে যাবে। চল্লিশ মিনিটের বাসভ্রমণের সময়টায় ঠাসা গরম কাপড়ে ঘেমে নেয়ে উঠতে হয়। বাসের ভেতরটা উষ্ণ থাকে হিটিং-এর কারণে। বাসে উঠে মহিব সাধারণত কানের উলের টুপি খুলে ফেলে। কিন্তু ডাবল মোজায় জুতোর ভেতরে পা দু'ট গরম হয়ে অস্থির করে তোলে। সমস্যাগুলো থেকে কী করে যে উত্তরণ ঘটবে সে বুঝে উঠতে পারে না।
শাওয়ার সেরে মহিব দুপুরের খাবার খেয়ে কম্পিউটারে বসল মেইল চেক করার জন্য। নতুন কোনো মেইল নেই। শ্রীরাধা নামটা লিখে গুগলে সার্চ দিল। যে ক'টি শ্রীরাধা এল তারা কেউ ওর চেনা শ্রীরাধা নয়। বুঝতে পারে কোনো বিষয়ে সে অস্থির। বিষয়টা কী, কেনই বা অস্থির সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।
ওয়েবক্যামে কথা বলার সময় দুইপ্রান্তের ছবি যেমন স্লো মোশনে দেখা যায়, সিসিটিভির দৃশ্যগুলো অনেকটা তেমন। এ এক মজার খেলা। বিশাল লম্বাটে ষষ্ঠতলা ভবনের কোথায় কী হচ্ছে সব সে দেখতে পাচ্ছে এই ক্ষুদ্র কক্ষে বসে। ভাগ্যিস ওয়াশরুম আর বসবাসের কক্ষগুলোতে ক্যামেরা লাগানো নেই! রাত এগারোটায় মহিব মনিটরে সেকেণ্ড ফ্লোরের ২০৩ নম্বর কক্ষের দরজার দৃশ্য ফুলস্ক্রিনে আনল। এই কক্ষটিকে বা গোটা সেকেণ্ড ফ্লোরটাকে এভাবে মনোযোগ দিয়ে আগে কখনো দেখেনি সে। প্রতিটি ফ্লোরের প্যাসেজ একনজর দেখার পর আর খুঁটিয়ে না দেখলেও চলে। একটু আগে ফ্রন্ট ড্রাইভওয়ে দিয়ে এক যুবককে ঢুকতে দেখেছে মহিব। কোনো মহিলা বা তরুণীর সাক্ষাৎপ্রার্থী। মহিব একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল স্ক্রিনের দিকে। কক্ষের দরজাটা একটু নড়ে উঠল বলে মনে হল। দরজাটা এমনভাবে নড়ছে মনে হল ঘরের ভেতর থেকে কেউ বের হবে কিনা, সে বিষয়ে যেন দ্বিধাগ্রস্ত।
এ আবার কোন্ আজব খেলা! মহিব সেকেণ্ড ফ্লোরের দৃশ্যটা সরিয়ে এবার ফ্রন্ট ড্রাইভওয়েতে এল। যুবকটি ড্রাইভওয়েতে নেই। দৃশ্য পরিবর্তন করল মহিব। যুবক ইতিমধ্যে ভেতরে ঢুকে প্যাসেজের অটোলক দরজায় এসে অপেক্ষা করছে। মহিব ফের সেকেণ্ড ফ্লোর নিয়ে এল স্ক্রিনে। ২০৩ কক্ষের দরজা দিয়ে বের হচ্ছে শ্রীরাধা! সাথে ওর বান্ধবী, যার নাম রোজমেরি বলে জানিয়েছে শ্রীরাধা। যুবকটি তবে ২০৩ নম্বর কক্ষের বাসিন্দার সাক্ষাৎপ্রার্থী! কিন্তু কার? রোজমেরি না শ্রীরাধার? মহিবের কাছে এই সাইট হচ্ছে স্রেফ কামকেলী কেন্দ্র। আর এই কেন্দ্রের যুবতী ও প্রৌঢ়াগণ নির্বিবাদে যেন বহিরাগতদের সাথে কামলীলা সারতে পারে, তার নিষচয়তা বিধানের সার্বিক দায়িত্ব বর্তেছে মহিবের ওপর। থিসলডাউনে চোর-ছ্যাঁচড়ের উৎপাত ছিল, ঝুঁকি ছিল। তবুও সেটা এই কামকলা চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের চাইতে শতগুণ উৎকৃষ্ট অ মানসম্মত ছিল, মহিবের তাতে কোনো সন্দেহে নেই। স্ক্রিনে একটা পরিবর্তন দেখে নড়েচড়ে বস এমহিব। শ্রীরাধা আর রোজমেরি সেই যুবককে নিয়ে তাদের কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ঘেন্না, ঘেন্না। মহিবের শরীরজুড়ে খেলে গেল বিবমিষার স্রোত। মহিব সিসিটিভির সামনে থেকে সরে গিয়ে টহল দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল এবং ইচ্ছে করেই সেকেণ্ড ফ্লোর থেকে শুরু করল টহল। একটা সময় খুলে গেল ২০৩ কক্ষের দরজা। তিনটি প্রাণীকে দেখা গেল - সেই যুবক, শ্রীরাধা আর রোজমেরি। আড়চোখে একবার হাতের ঘড়িটা দেখে নিল মহিব - মাত্র সোয়া বারোটা! দোলায়মানচিত্তে ভাবল, এর মধ্যেই কাজ সারা গেল! মহিব প্যাসেজের বাঁক অতিক্রম করে অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। শ্রীরাধা ওকে ডাকল। মহিব এগিয়ে আসতে শ্রীরাধা পরিচয় করিয়ে দিল - আমার বান্ধবী রোজমেরি। আর ও হচ্ছে ডেভিড। রোজমেরির ছোটভাই। রায়ারসন য়্যূনিভার্সিটিতে পড়ে। খুব ব্রিলিয়্যান্ট। রোজমেরি বলল, শ্রীরাধার কাছে তোমার কথা অনেক শুনেছি।
ধন্যবাদ রোজমেরি, বলে মহিব হাত বাড়ায় ডেভিডের দিকে, নাইস মিটিং ইয়্যূ। ডেভিডও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তুমি এখানে সিকিউরিটি অফিসার? প্রত্যুত্তরে হাসল এবং ঘাড় নাড়ল মহিব।
মহিব একটু কফি খেয়ে যাবে? কাল আমার ডিউটি নেই। শ্রীরাধা বলল।
এই কাজটি পারব না। মহিব বলল, আমি সিকিউরিটি গার্ড। প্রটোকলের মধ্যে পড়েনা।
একবার এলে কিছু আসে যাবে না, রোজমেরি বলল।
সরি রোজমেরি, সম্ভব না। বলে মহিব সেকেণ্ড ফ্লোরের অন্যপ্রান্তে চলল। শুনতে পেল রোজমেরি বলছে - রাত জাগবে না ডেভিড। শরীরের প্রতি খেয়াল রেখো।
শ্রীরাধাকে ঘিরে মহিবের ভাবনাগুলো ফের ডানা মেলল। সেদিন হঠাৎ শ্রীরাধা এসে মহিবের কক্ষে হাজিরা দিল। মহিব বলল, এনিথিং রং শ্রীরাধা?
নো। তোমার সাথে দেখা করতে আসতে পারি না? চলো আজ একসাথে কফি খাব। একটু আগেই বের হব, তোমার সাথে কথা বলে তারপর কাজে চলে যাব আমি আর তুমি চলে যাবে বাসায়।
শ্রীরাধার কথা শুনে মহিব স্বস্তি পেলেও বিভ্রান্তও হল কিছুটা। শ্রীরাধা জানাল, দিনগুলো ভালই কাটছে তার। সে এখন অভিশাপমুক্ত। আসছে মাসে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেবে। জেইয়া নামের অচ্ছুতের ছায়াও আর মাড়াবেনা এজীবনে। মহিব ভাবছিল, শ্রীরাধার এরকম র্যাডিকেল পরিবর্তন। স্বপ্নভঙ্গের পিঠেপিঠি আবার বড় স্বপ্ন দেখতে সময় লাগে। মানসিক স্থিতাবস্থায় পৌঁছুতেও তো সময় লাগে!
এখনকার চাকরিতে পয়সা একটু বেশি পাচ্ছি। শ্রীরাধা বলে যাচ্ছে, আওয়ার্সও বেশি দিচ্ছে। রেন্ট দিয়ে, খেয়েপরে সঞ্চয় ভালই হবে। ভবিষ্যতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার স্বপ্ন দেখছি। কিছু বলছ না যে!
ভাল শ্রীরাধা, মহিব হেসে বলল, কিন্তু তুমি কি আর বিয়ে করবে না? আই মীন বাচ্চাকাচ্চা?
আগে নিজে বাঁচি, তারপর বাচ্চা।
তুমি নিজ দেশে, আই মীন শ্রীলংকায় ফিরে যাচ্ছ না কেন?
কার কাছে? আমার বাবা-মা বেঁচে নেই। শুধুমাত্র একবোন আছে আমার, সে স্বামীর সাথে জেদ্দায় থাকে। স্বামী সেখানে একটা কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার। সারাক্ষণ তো কেবল আমার কথাই বললাম। তোমার কথা তো কখনো শুনলাম না মহিব।
আমার কথা নেই। রসকষহীন জীবনের কথা থাকতে পারে না।
জীবন জীবনই। এর অনেক কথা থাকে। বলে হেসে ফেলল শ্রীরাধা, দার্শনিকের মতো কথা বললাম না!
হ্যাঁ, বলেছ।
বলছ বলেছি! বেশ, এখন থেকে আমি দার্শনিক।
আর আমি একটা কাঠখোট্টা বেরসিক আদমসন্তান।
মোটেও না। তুমি বেশ লাইভলি, আর অবশ্যই হ্যাণ্ডসাম। শ্রীরাধার গালে এক ঝলক রক্তিম আভা খেলে মিলিয়ে গেল আবার। বলল, মহিব। তোমার গল্প কিন্তু একদিন শুনব। আজ তবে উঠা যাক।
শ্রীরাধার শিফটিং ডিউটি, মহিবেরও তাই। সুতরাং দু'জনরেই সহসা আর দেখা হয়নি। সেদিন মহিব সিসিটিভির সামনে বসে ছিল। দুই চোখের পাতা বন্ধ। না, ঘুমোচ্ছে না সে। সিসিটিভির পর্দা তার অসহ্য লাগে ইদানিং। মনে হয় এর মতো একঘেয়ে কাজ দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টি নেই। একটা ফোন এল। চোখ বুজেই ফোন ধরল সে - আলফা টেন। হোটেল সেভেন্টি ফোর। মহিব স্পিকিং, হাউ মে আই হেল্প ইয়্যূ?
স্ক্যুজুলিং কোর্ডিনেটর হ্যালকন বলছি। তোমার নতুন স্কেজ্যুল করতে হয়েছে আমাকে। কাল তোমার রেস্ট। পরশু থেকে নতুন স্থানে জয়েন করবে তুমি। ইয়র্ক ক্যাম্পাস। নতুন স্কেজ্যুল তোমার ইমেইল অ্যাড্রেসে পাঠিয়ে দিয়েছি।
ঠাস করে রিসিভার রাখে মহিব। এই ঠাণ্ডার মধ্যে তোরা আমাকে ক্যাম্পাসে হাওয়া খেতে পাঠাবি!
কার সাথে কথা বলছ মহিব! তুমি ঠিক আছো তো?
আরে দেখো না, আবার বদলি করে দিয়েছে। মহিব অনির্দিষ্টভাবে কথাটা বলে মুহূর্তেই সচকিত হল, আরে তুমি!
ওর নিঃশব্দ উপস্থিতি, মহিবের স্লো রিফ্লেকশন - এসবের মধ্যে শ্রীরাধা মহিবের অসহায় সত্তাকে আবিষ্কার করে ফেলল এক লহমায়। শ্রীরাধার চোখ ছলছল করছে। মহিব বলল, বলো তো তোমাকে কোথায় বসতে দিই। এই দেখনা ব্যাটাদের কাজকারবার। খালি বদলি আর বদলি। সে যাক, বল কী উদ্দেশ্যে আগমন? কোনো সমস্যা হয়নি তো?
হয়েছে। তোমার সাথে দেখা হয়না এটাই সমস্যা। শ্রীরাধা বলল, আই লাভ ইয়্যূ মহিব। শ্রীরাধা হঠাৎ নিচু হয়ে মহিবের গালে চুমু খেল। চেয়ার ছেড়ে উঠল মহিব। কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। যেন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে। ভদ্রতার মাপকাঠিতে কেউ কিছু উপহার দিলে, প্রতিদানে তো কিছু দিতে হয়। সেরকম একটা সাদাসিধে হিসেব করে মহিবও প্রলম্বিত চুমু বসাল শ্রীরাধার ঠোঁটে। শ্রীরাধার মুখমণ্ডলজুড়ে খেলে গেল এশিয়, বিশেষত দক্ষিণ এশিয় নারীর শতসহস্র বছরের লজ্জার স্রোত। চলে গেল শ্রীরাধা। মহিব নিজের গালে, ঠোঁটে হাত বুলিয়ে শ্রীরাধার উষ্ণ স্পর্শ বারবার অনুভব করতে থাকে।
দুইটি দিন বড় অস্থিরতায় কাটল। নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়ে কাজশেষে সে এল ওয়াইডব্লিওসিএতে। ওর স্থানে যে ছেলেটি এসেছে, তার সাথে চাকরির ইন্টারভিউর সময় পরিচয় হয়েছিল। ছেলেটি বেশ, নাম লেসলি। ওয়েস্ট ইণ্ডিজের। অল্পক্ষণের মধ্যেই দু'জনের খুব ভাব হয়ে গেল। মহিব বলল, আমার এক বন্ধু থাকে সেকেণ্ড ফ্লোরে। ওর সাথে দেখা করতে এসেছি। পুরোটা ভাল করে শোনেওনি লেসলি, রীতিমতো দৌড়ে এসে প্যাসেজের অটোলক খুলে দিয়ে মহিবকে ভেতরে ঢোকাল।
মহিব ২০৩ কক্ষে নক করল। দরজা খুলল রোজমেরি। চোখে ঘুম ঘুম ভাব। মহিব বলল, হাই রোজমেরি। তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালাম নাকি?
না, উঠেছি আগেই। কিন্তু রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি, তাই এখন আবার ঘুম পাচ্ছে। তুমি কি ভেতরে বসবে?
হ্যাঁ, আজ বসতে পারি। কারণ এখন আমি ডিউটিতে নেই। আর এখান থেকেও বদলি হয়ে গেছি।
শ্রীরাধা কি ডিউটিতে চলে গেছে? মহিব জিজ্ঞেস করল।
না। দিনে ওর ডিউটি থাকে না। কোথায় যেন একটা দরকারে বেরিয়েছে। এই হপ্তা ওর নাইট ডিউটি চলবে।
কখন ফিরবে শ্রীরাধা?
ফিরবে না। যেখানে গেছে সেখান থেকে নাকি সোজা ডিউটিতে চলে যাবে।
তবে তো আর দেখা হল না, বল আমি এসেছিলাম। দেখি সেলফোনে কথা বলব। আজ উঠি।
ঠিক আছে, বলব। রোজমেরি এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল।
অফ-ডে গুলো ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। দুইদিন ঘরে বসে থেকে মহিবের মনে হল ভেরেণ্ডা ভেজেছে সে। বেশ ক'বার কল করেও শ্রীরাধাকে যখন সেলফোনে পাওয়া গেল না, তখন চট করে আরেকবার ওয়াইডব্লিওসিএ ঘুরে এলে কী হত। শেষমুহূর্তে মানে, রাত সাড়ে দশটায় মহিব সিদ্ধান্তে এল ওয়াইডব্লিওসিতে যাবে। অথচ কাল ভোরে আবার ডিউটি।
স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মহিবকে দেখে কিছুটা অবাক হল লেসলি। মহিব বলল, জরুরি কাজ আছে। বন্ধুকে সেলফোনে পাচ্ছি না। সেকেণ্ড ফ্লোরের সেই কক্ষে এল আবার। নক করে করে ক্লান্ত হয়ে গেল মহিব। কেউ দরজা খুলল না। উদ্বিগ্ন হল - শ্রীরাধাকে সেলফোনে পাওয়া যাচ্ছে না, রোজমেরিকে কক্ষে পাওয়া যাচ্ছে না - এ যে বড় মুশকিলের কথা। ভুল হয়ে গেছে রোজমেরির সেল নাম্বারটা না নিয়ে।
অ্যাপার্টমেন্টের আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে অ-আরামপ্রদ চিন্তাগুলো আসছিল। মেয়েটা একদম গায়েব হয়ে গেল! মরেটরে যায়নি তো? রোজমেরিই বা কোন্ জাহান্নমে উধাও হল? দুইটাই কি একসাথে মরল? অভিমান জমল মহিবের মাঝে। শখের বিছানায় বেশিক্ষণ শুয়ে থাকা যাবে না। ভোর চারটায় উঠে যেতে হবে। মহিবের সেলফোন বেজে উঠল। রাত একটায় কে ফোন করল? সেলফোনটা হাতে নিয়ে দেখল নাম্বারটা অপরিচিত। একটু ইতস্তত করে শেষ মুহূর্তে রিসিভ করল মহিব। অন্যপ্রান্ত থেকে একটা নারীকণ্ঠ বলল, রোজমেরি বলছি।
রোজমেরি! শোয়া থেকে উঠে বসে মহিব। তারপর গড়গড় করে বলে গেল - তোমার স্যুইটে গিয়েছিলাম বিকেলে। তোমাকে পেলাম না। শ্রীরাধাকে তো সেলফনে পাচ্ছি না, ব্যাপারটা কী বল তো!
কোনোরকম গৌরচন্দ্রিকা না করে বলে ফেলি, মহিব। রোজমেরি ভারী গলায় বলল, শ্রীরাধা মারা গেছে। ও আত্মহত্যা করেছে।
কী বললে তুমি! কবে? কীভাবে?
তিনদিন হয়ে গেল। তোমাকে জানাতে পারছিলাম না। শেষে সিকিউরিটি অফিসার লেসলির কাছে তোমার সেল নাম্বার পেলাম।
আমি আসছি এখুনি রোজমেরি।
কোথায়!
তোমার স্যুইটে।
না, মহিব। আমার ভাল লাগছে না। গত তিনদিন পুলিস-হাসপাতাল করে আমি খুব ক্লান্ত।
কিন্তু রোজমেরি, আমি যে অন্ধকারে ডুবে আছি। কিছুই জানতে পারলাম না!
ইস্টইয়র্ক হাসপাতালের মর্গে এখনো লাশ আছে। পুলিস আর হাসপাতাল লাশ নিয়ে আরো কয়েকদিন নাকি গবেষণা করবে। শ্রীরাধা ২৭ তলা থেকে পড়েছে। লাশ দেখে একজন কনস্টেবল অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেই লাশ আমাকে দেখতে হয়েছে সনাক্ত করার জন্য।
শ্রীরাধা এখন এমনই বীভৎস! মহিবের কণ্ঠটা ধরে এল। না, রোজমেরি। শ্রীরাধা এরকম নারকীয়ভাবে মরতে পারে না। ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। তুমি বুঝতে পারছ রোজমেরি কী বলছি আমি?
পারছি। ওর হাজব্যাণ্ডকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিস।
শ্রীরাধা মরবার পর মহিব সিকিউরিটির চাকরি ছেড়ে দিল। প্রস্তুতি নিচ্ছিল দেশে ফিরে যাবার। নিষ্ঠুর নিয়তির টানে এভাবেই হয়তো বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে নিস্ফলতায় আর আত্মদাহে। এইসময় নিঃসঙ্গ মনের আকাশে উঁকি দিল যূঁথি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে হাতপায়ে যখন খিল ধরে যাচ্ছিল, তখন একটা ভলান্টারি কাজে যোগ দেয় মহিব। একটা শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠানের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফাণ্ড তোলার কাজ। সেখানে কাজ করত যূঁথি ও জেবা। দুই বান্ধবী। ওরিয়েন্টেশনে ওদের সাথে পরিচয়। যূঁথি সেন্টেনিয়্যাল কলেজে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল সরকারি অর্থায়নে। টরোন্টোতে খুব বেশি দিন হয়নি। এসেছে নিজের প্রচেষ্টায়। বাংলাদেশে সে একটা এনজিওতে চাকরি করত। আর জেবা অনেকবছর যাবৎ এই দেশে আছে। বাংলাদেশে ওরা দু'জন একই স্কুলে পড়ত।
প্রস্তাবটা এল জেবার কাছ থেকে, অনেকটা চমকে দেবার মতো। যূঁথি একাকী জীবন যাপনে হাঁপিয়ে উঠেছে। জেবার কথায় - দু'জনেই যখন একাকী, তখন পরস্পরের সঙ্গী হলে দোষ কী? সুতরাং যূঁথি মহিবের একাকী জীবনের সঙ্গী হল, আর মহিবও যূঁথির অনুর্বর জীবনটাকে রাঙিয়ে দিল প্রত্যাশার বর্ণিল প্রচ্ছায়ায়।
মাঝেমাধ্যেই শ্রীরাধার সুশ্রী অবয়ব উঁকি দিয়ে যায় মনে, তার কাচভাঙা হাসি কর্ণে সুধাবর্ষণ করে মহিবের শয়নে স্বপনে। মহিব কখনো কখনো আনমনা হয়ে যায়। এই দিকটা চোখ এড়াল না যূঁথির। মহিবকে সতর্ক করে এবং জোর করে চাকরির সন্ধানে পাঠায়। মহিব জোগাড় করে ফেলল ঠিকই একটা সুপারস্টোরে সেলস অ্যাসিস্ট্যান্ট রূপে। খুশি হয় যূঁথি। ওর শিক্ষাকালীন অনুদানের টাকা আর মহিবের চাকরির টাকায় বেশ ভাল চলে যাবে ওদের। ড্রাইভিং লাইসেন্স হল দুই জনেরই। গাড়িও কিনল দুইজন একসাথে। ভাল অ্যাপার্টমেন্টে উঠে গেল ওরা। কেটে গেল তিনটি বছর। কিন্তু অভাগা যেদিকে...। কে অভাগা? মহিব নাকি যূঁথি? ভাগ্যটা আসলে কী? দু'জনেই তো ভাবতে পারে - আমার ভাগ্যটাই মন্দ। কেন এমন হল? কেন এমন হয়?
দুই জনেরই বয়স হয়েছে। বাচ্চা নেবার তাড়া ও আকুলতা দু'জনারই। কিন্তু বাচ্চা হচ্ছিলনা ওদের। খিটিমিটি শুরু হল। মহিব ভেঙে পড়ল বেশি। বাচ্চা নেবার আকুলতা তারও কোনো অংশে কম নয়। অথচ আহতচিত্তে সে শুনল সব ক'টা ডাক্তার ওকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করছে : ত্রুটিটা আপনার। কীসের ত্রুটি? কেন ত্রুটি! এরকম ত্রুটি না হলে হত না! ওর ক্ষেত্রে ভাগ্য এমনভাবে বেঁকে বসল কেন?
যূঁথি একদিন চলে গেল। মহিবের কলিগ জেন একদিন বলল - কেন ত্রুটি, কার ত্রুটি তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে কত কুপল এমন সন্তানবিহীন পার করে দিচ্ছে। তোমাদের ক্ষেত্রে কেন এমনটা হল ভেবে পাচ্ছি না।
মন্দ নসিব। মহিব বলল।
একটা ভেগ টার্ম মহিব, ক্ষেপে গিয়ে বুড়ি বলল, তোমাদের গণ্ডায় গণ্ডায় ছানা হলেই যে তোমরা হ্যাপি কুপল হতে পারতে তার গ্যারান্টি কী?
জেনের কথায় যুক্তি আছে। মহিব উত্তর খুঁজে পায়না। যূঁথির চলে যাওয়াটা মহিবের কাছে এমনি অস্বভাবী একটা ঘোরের মতো যে, মহিব চেষ্টা করেও সেই ঘোরের ঘেরাটোপ থেকে বেরুতে পারেনি। জেন হাতের কাজ শেষ করে মহিবের কাছে এল। মহিবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল - মন খারাপ করো না। হয়তো ত্রুটিটা তোমার। উন্নতচিকিৎসায় সেটা তো সেরেও যেতে পারে। তাছাড়া, এমনও হতে পারে যে এতদিনে তোমার মধ্যের ত্রুটি হয়তো এখন আর নেই। তুমি বরং ফের বিয়ে কর।
ধন্যবাদ, জেন। মহিব একটু হাসল। বলল, প্রার্থনা কর তেমনটিঈ যেন হয়। তোমার কথায় অনুপ্রাণিত বোধ করছি।
মহিব সুপারস্টোরের চাকরি ছেড়ে ফিরে গেল সেই পুরনো পেশায়। থিসলডাউন প্লাজায় একদিন উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরছিল সে। সেই প্রজেক্টসাইট আর নেই, কাজ সমাপ্ত। মহিব বিক্ষিপ্ত চিত্তে ঘুরাফেরা করে। সেইসময় নজরে পড়ে নোটিসটা-প্লাজার জন্য সিকিউরিটি গার্ড নেয়া হবে। মহিব প্লাজার অফিসে যোগাযোগ করল। ওর অভিজ্ঞতা, বিশেষভাবে এই চত্বরে কাজ করার সুবাদে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি হয়ে গেল। এবার কোনো সিকিউরিটি কোম্পানির মাধ্যমে না, সরাসরি প্লাজা কর্তৃপক্ষ ওকে নিয়ে নিল। এটা শুভ দিক।
টহলের সময় পরিচিত অপরিচিত অনেকের সাথেই দেখা হয়। এমনি একদিন দেখা হল জেবার সাথে। বিয়ের অনুষ্ঠান, বিয়ে পরবর্তী সংসারজীবন - সবটাতেই জেবা ছিল ওদের নিত্যসাথী। জেবা ওয়ালমার্টে কাজ করে। বিয়ে করেনি কখনো। করবেও না। নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি আর প্রাচুর্য, সব আছে তার। কিন্তু কী একটা যেন তার নেই। কী সেটা সে কখনো কাউকে বলেনি।
জেবা বলল, আপনাদের বিচ্ছেদটা আনএক্সপেক্টেড। সংসারটা টিকে থাকা উচিৎ ছিল।
আমি চেষ্টা করেছি। মহিব বলল।
জানি। জেবার কণ্ঠে সহানুভূতির সুর, আপনাকে ঠিকই চিনেছি। কী বলব? যূঁথি আমার বান্ধবী। ওকে আমি ফেরাতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। সে আবার বিয়ে করেছে জানতেন? তা-ও তো এক বছরের ওপর হয়ে গেল। আপনি জানতেন না, তাই না?
না, মহিব বলল, জানতে চাইনি। ঠিক রুচির মধ্যে পড়েনা।
রাইট, একটা বিষয় আপনাকে বলেই ফেলি। যাকে যূঁথি এবার বিয়ে করেছে তার পয়সা আছে, কিন্তু বয়সটা খুব বেশি। সেটা অবশ্যি যূঁথির একান্তই নিজস্ব বিষয়। কিন্তু পরের বিষয়টি খুব খারাপ।
কী সেটা!
আর বলবেন না। যূঁথির সন্তান এবারও হবে না। ও ভীষণ ভেঙে পড়েছে। সারাক্ষণ কেবল কাঁদে। আপনাকে আঘাত দিয়ে ও ভুল করেছে জানি, কিন্তু আফটার অল, আমার ছোটবেলার বন্ধু তো। তাই ওর জন্য কষ্ট লাগে।
সন্তান হবে না কেন?
এবার নাকি সমস্যাটা যূঁথির, ডাক্তার বলেছে, ভদ্রলোকের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা যূঁথির।
কিন্তু... মহিব কিছু বলতে গেল।
আপনাদের সময় ত্রুটি আপনার ছিল, যূঁথি ছিল সক্ষম। এখন উল্টোটা হয়েছে।
কেন! এর বেশি কিছু বলতে পারল না মহিব।
এরকম হতে পারে, কার কখন কোন্ রোগ বা সমস্যা হবে - সেটা তো আগাম বলা যায়না। তবে বিষয়টা দুঃখজনক। যাইহোক, কেমন চলছে দিনকাল? একদিন আসুন না আমার বাসায়।
আসব। মহিব বলল।
এরপর জেবা ঢুকে গেল শপারস ড্রাগ মার্টে। সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মহিব। যেন স্বপ্ন দেখছে সে, স্বপ্নটা ভাঙতে সময় লাগবে। মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় একটি নাম। এই নামটা মহিব মন থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে চায়। মহিবের মনে হয়, এবার ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার নিশ্চয়ই বলবে - শুভকাজটা শিগগির সেরে ফেলুন। আপনার বাচ্চা হবে গণ্ডায় গণ্ডায়।
তারা সব প্রহরী হবে বড় হয়ে। মহিব বিড়বিড় করে বলল। কয়েক ফোঁটা জল গড়াল ওর চিবুক বেয়ে। চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে হাঁটতে লাগল প্লাজার উত্তর প্রান্তের উদ্দেশ্যে। মহিব সগর্বে টহল দিয়ে বেড়ায় আর মনে মনে বলে - আমি থিসলডাউনের প্রহরী।