শীতের দুপুর। মা'র পাশে শুয়ে ছোট্ট তিত্লি ছটফট করছে, কিছুতেই ঘুম আসছে না তার। মা শুয়ে শুয়ে কাগজ পড়ছিলেন। মাঝে মাঝেই বলছেন, 'অনেক দস্যিপনা হয়েছে তিত্লি, এবার একটু ঘুমিয়ে নাও।' সে কোনো কথা বলে না, চুপটি করে থাকে।
কিছুক্ষণ বাদে মা'র হাত থেকে কাগজটা পড়ে গেল। জোরে জোরে নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পেল সে। অনেকক্ষণ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিশ্চিন্ত হল - নাঃ, মা এখন গভীর ঘুমে। আস্তে আস্তে দরজা খুলে সে পা টিপে টিপে বেরোল। পাশের ঘরে ঠাম্মা মণ দিয়ে রামায়ণ পড়ছেন। ঠাম্মার ঘর ধীরে ধীরে পেরিয়ে এসে থামল তিত্লি। ছাদের সিঁড়ির কাছে রোদে মাদুর বিছিয়ে শুয়েছিল বাসন্তীমাসি। সিঁড়িতে পা দিতে গিয়ে বাসন্তীমাসির গায়ে পা লেগে গেল, 'কে রে' বলে চিৎকার করে উঠল বাসন্তীমাসি। দৌড়ে সিঁড়িগুলো পার হয়ে ছাদে এসে হাঁপাতে লাগল তিত্লি। ওঃ, আরেকটু হলেই হয়েছিল আর কি!
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। তিত্লির এবার ক্লাস ফোর হবে। এখন অনেক অবসর তার। ইস্কুল ছুটি, কিন্তু বড়রা যেন কেমন! একটুও ছোটদের বুঝতে চায় না। সকাল থেকেই তিত্লির মন খারাপ, রাগ দুঃখ অভিমান মিলে মিশে একাকার। ওর ইচ্ছে করে বন্ধুদের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে খেলা করতে, ইস্কুল থাকলে সেটা হয় না। সামনের মাঠে অনেকগুলো গাছ - কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, কাঠগোলাপ, দেবদারু। অজস্র পাখি কিচিরমিচির করে গাছগুলোতে, সন্ধেবেলা তাদের কলরবে কান পাতা যায় না। বেশির ভাগ পাখিরই নাম জানে না তিত্লি, দাদু বলেছেন বলে দেবেন। দাদু ওকে রাত্রির আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখান, ছায়াপথ চেনান, ধ্রুবতারা কোথায় বলে দেন। দাদুকে ওর খুব ভালো লাগে। দাদু খুব ছোটদের বুঝতে পারেন। সবাই কেন দাদুর মতো হয় না, তিত্লি ভাবে। কাঠবেড়ালি ছুটতে ছুটতে গাছে গিয়ে ওঠে, আবার নেমে এসে অন্য গাছে ওঠে। ওরা নাকি মাটিতে যত জোরে দৌড়োতে পারে তার চেয়েও তাড়াতাড়ি গাছে চড়তে পারে। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে থাকে তিত্লি। শীতের নরম রোদে রঙবেরঙের প্রজাপতি ঘুরে বেড়ায়। ওর ইচ্ছে করে ওদের পেছনে ছুটতে, আর ইচ্ছে করে মাঠের সবুজ ঘাসে রোদের মধ্যে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে। কিন্তু তিত্লি জানে এসব ইচ্ছে ওর পূরণ হবার নয়। মা দেখতে পেলেই হয়েছে আর কি! পিঠের ওপরে গুম্গুম্ পড়বে। কোথায় সে এখন খেলে বেড়াবে তা নয় - ইস্কুল ছুটি - তাতে কী, অঙ্ক কর, হাতের লেখা ভালো কর। বাংলা রীডিং তোমার একদম ভালো হয় না, সেটাও ঠিক করা দরকার। মা-বাবার কথা। তিত্লির কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
ছাদের একদিকে আচারের বয়ামগুলো রোদে দেওয়া আছে; সেদিকে নজর গেল তার। আরে, এই জন্যেই তো ছাদে আসা! সকালে ঠাম্মা বাসন্তীমাসিকে বয়ামগুলো রোদে দিতে বলেছিলেন। তখন থেকে তিত্লি ভাবছে, সবাই দুপুরবেলা ঘুমিয়ে পড়লে আচার খাবে। এখন সুযোগ সামনে। বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু হাসি ফুটল তার মুখে। কত রকমের আচার - আমতেল, আমের মিষ্টি আচার, জলপাইয়ের মিষ্টি আচার, কুলের আচার, তেলের মধ্যে গোটা গোটা জলপাই, আম কাসুন্দি, তেঁতুল। তিত্লির জিভে জল এসে গেল। টক আচার ভালো লাগে না তিত্লির, সে মিষ্টি আচারের বয়াম খুলে অনেকটা করে আচার ও তেঁতুল নিয়ে ছাদে ঘুরে ঘুরে খেতে লাগল আর তৃপ্তিতে জিভ দিয়ে টকাস টকাস করে শব্দ করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর ওর নজর গেল বড় রাস্তায়। ভোলাকাকু মানে ভোলা ময়রা দইমিষ্টির বাঁক নিয়ে বেরিয়েছে। তিত্লি ফ্রকের কোনায় আচারের হাত মুছে দৌড়ে নিচে নেমে এল - গেট খুলে সোজা ভোলা ময়রার কাছে। বললো, 'কাকু আমাকে দই দাও, চারটে রসগোল্লা দাও, সন্দেশও দাও দুটো।' ভোলা বলল, 'সে কী কথা, তিত্লি বুড়ি! বাড়ি চল, রাস্তায় কেন? বাড়ি গিয়ে মিষ্টি দিয়ে আসি, নইলে গিন্নিমা রাগ করবেন।' 'কিচ্ছু হবে না, তুমি দাও দিকিনি। মা'র কাছ থেকে পয়সা নিয়ে নিও, কাল।'
দইমিষ্টি খেল সে রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে একটু পেছন করে, যাতে চেনা কেউ দেখতে না পায়। খাওয়া শেষ করে সে নির্জন রাস্তা দিয়ে চলতে আরম্ভ করল। শীতের দুপুর। মফস্বল সহর - রাস্তাঘাটে লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। কিছুদূর যাবার পর যজ্ঞেশ্বরকে দেখতে পেল। পথের ধারে ইটালিয়ান সেলুনে দাড়ি কামাবার জিনিসপত্র সাজিয়ে খদ্দেরের আশায় বসে আছে। শীতের রোদে বসে বসে একটু ঝিমুনিও এসেছে তার। তিত্লির হঠাৎ মনে হল চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে মা প্রায়ই বলে 'চুল নয়তো যেন ঝাঁটার কাঠি।' কোমর পর্যন্ত সোজা লম্বা একঢাল চুল তার। 'চুলটা কেটে ফেলি', ভাবল তিত্লি। তাহলে মাকে আর রোজ রোজ তার চুল নিয়ে বিরক্ত হতে হবে না। তিত্লির ডাকে যজ্ঞেশ্বরের ঝিমুনি কাটল। 'কিছু বলছ মামনি?' জানতে চাইল সে। তিত্লি চুল কাটতে চায় শুনে যজ্ঞেশ্বর কিছুতেই রাজি হয় না প্রথমে। মা বলেছে বলাতে অগত্যা রাজি হল। ঘাড় অবধি চুল কেটে দিতে বলল সে যজ্ঞেশ্বরকে।
ছোট আয়নায় নিজের মুখ দেখে প্রথমে একটু চমকাল তিত্লি। পরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে যজ্ঞেশ্বরকে বলল, 'কাল বাড়ি গিয়ে পয়সা নিয়ে এস, কেমন?' বলে আবার রাস্তায় নামল সে। একটু যেতেই তিত্লির মামাবাড়ি। এই রে দিদিমণি দেখলেই হয়েছে আর কি! স্বাধীনতার দফা রফা। কানাইমামাকে দিয়ে এক্ষুনি বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। তিত্লি চুপি চুপি এগিয়ে যেতে লাগল। মামাবাড়ির পরেই বিশাল ধানক্ষেত। হাওয়ায় ধানক্ষেতে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে দেখল তিত্লি খানিকক্ষণ। খুব ভালো লাগছিল তার। ধানক্ষেতের পরেই শিবতলীর ঘন জঙ্গল। একটা বড় বটগাছের তলায় শিবলিঙ্গ। কবে থেকে আছে কেউ জানে না, বাচ্চারা সবাই জানে শিবতলীতে আসতে নেই, একা তো নয়ই। এখানে নাকি তাঁরা থাকেন। গভীর জঙ্গল। ছায়া ছায়া অন্ধকার, পথ দেখা যায় না। বড় বড় গাছের ওপর থেকে বনধুঁধুলের লতা দুলছে। জঙ্গলের মধ্যে সূর্যের আলো পড়ে না কখনো, আকাশ দেখা যায় না। কিছুদূর যাবার পর তিত্লির গা-টা শিরশির করে উঠল। বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস। শরীরটা কেমন ভারি মনে হচ্ছে। পা দুটো সরছে না।
একা একা পড়ন্ত দুপুরে জঙ্গলের সামনে দাঁড়িয়ে তিত্লির খুব কান্না পেল। গলার কাছে ব্যথা ব্যথা করছে। গা গুলিয়ে উঠছে। বমি পাচ্ছে। মা'র জন্য মন কেমন করে উঠল তিত্লির। মরিয়া হয়ে সে ছুটতে আরম্ভ করল। ছুটতে ছুটতে বাড়ি পৌঁছল যখন ঠাম্মা তুলসীতলায় প্রদীপ দিচ্ছেন। মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তিত্লিকে দেখে আর্ত চিৎকার করে উঠলেন - এ কী করেছিস তুই, সব চুল কেটে এলি? কোথায় ছিলি সারা দুপুর? হতভাগা মেয়ে, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন -
অনেক রাত। তিত্লি মায়ের কোলের কাছে শুয়ে আছে। মায়ের গায়ের গন্ধে ওর সারা মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে। খুব ভালো লাগছে ওর। এখন আর কোনো রাগ নেই, অভিমান নেই তিত্লির। মা'র আরো কাছে ঘেঁষে এসে সে ফিসফিস করে বলল, 'আমি আর দুষ্টুমি করব না মা।'