বড়ো বাড়ির ছোট স্মৃতি; স্মৃতি মিত্র; প্রকাশনালয়ঃ থীমা, কলকাতা-২৬। প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০০৮, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১১
ঐ দেখুন প্রচ্ছদখানিঃ কী চমৎকার, না? ঐটি দেখেই বইমেলার লক্ষ বইয়ের ভিড়ে এ’খানিকে হাতে তুলে নেওয়া ও অনুভব, ‘পার্মানেন্ট ব্ল্যাক’ বা ‘পেঙ্গুইন’ নয়, এটির নির্মাতা দক্ষিণ-কলকেতার ‘থীমা’! অসাধারণ প্রচ্ছদটির শিল্পী লেখিকার দৌহিত্রি। লেখিকা যদিও নন সে-অর্থে কোনো প্রতিষ্ঠিতা, কিন্তু কী অবলীলায় শুনিয়েছেন পাথুরেঘাটার ঘোষ ও ঝামাপুকুর/শ্যামপুকুর দিগম্বর মিত্তিরের বংশের গপ্প, মূলতঃ ১৯৩০-‘৪০-এর দশকের আশেপাশে---তাঁর বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির কথা। পড়তে পড়তে স্বনামধন্যা লেখিকা ‘বঙ্গজননী’ সুফিয়া কামালের (১৯১১ -১৯৯৯) সাতাত্তর বছর বয়সে লেখা “শিশুবেলা”(১৯৮৮) মনে পড়ে যাচ্ছিল বারংবার। কারণ উচ্চরুচি, শিক্ষাদীক্ষা, পর্দাপ্রথা থেকে ‘দীয়তাং ভূজ্যতাং’-এ শায়েস্তাবাদের (বরিশাল) নওয়াববাড়ির সঙ্গে পাথুরেঘাটার ঘোষেদের ফারাক নেই বিশেষ, যদিও দুই-ই বাপদাদাদের রেখে যাওয়া সম্পদেরই ক্ষয় তিনচার পুরুষ ধরে, নতুন করে নিজেদের রোজগার বড় একটা নেই। ক্লাইভ-হেস্টিংসের তাঁবেদারি করে তাহলে সে-যুগে নবকৃষ্ণ (শোভাবাজার), কান্তবাবু (কাশিমবাজার) বা রামলোচন ঘোষ (পাথুরেঘাটা) কত কত কামিয়েছিলেন চিন্তা করুন, এক শতাব্দি পেরিয়েও ছয় পুরুষ ধরে তাতেই বাবুয়ানি চলেছে!
১৯২৬ কোনো সুপ্রাচীন কাল নয়। কলকাতার রমরমা বজায় থাকলেও রাজধানী ততদিনে দিল্লিতে চলে গেছে। শিল্ডজয়ের সুখস্মৃতি পেরিয়ে তখন ময়দানে গোষ্ঠ পাল দাপাচ্ছেন। গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন পুরোদমে চলছে, পাশাপাশি শুরু হয়ে গেছে কম্যুনিস্ট আন্দোলনও। এই সময়ে কলকাতার এক প্রধান ধনীগৃহে এক শিশু জন্মায়, ‘রূপো’, থুড়ি, ‘সোনার চামচ মুখে নিয়ে’। ধন ছিল, আত্মীয়জনের স্নেহও ছিল, কিন্তু সঙ্গে দুর্ভাগ্যও ছিল যে! জন্মমুহূর্তে হারান মা-কে, শৈশবে পিতাকে। তবে, বাড়িটা পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ি কিনা, তাই শিক্ষাদীক্ষার অভাব হয়নিঃ গৃহশিক্ষিকা ছিলেন ডাঃ কাদম্বিনী বসুর এক কন্যা (কারণ, ভাবা যায়, সেই ১৯৩০-দশকেও এই ‘অতি ধনী’ বাড়ির মেয়ের পক্ষে বাড়ির বাইরের স্কুলে পড়তে যাওয়াটা মানহানিকর ছিল?!), গান শিখেছেন জ্ঞান গোঁসাইয়ের কাছে। প্রপিতামহ খেলাতচন্দ্রের নামাঙ্কিত স্কুলের শিক্ষক ছিলেন বিভূতিভূষণ, আর সেই সূত্রে তাঁর দাদাদের গৃহশিক্ষক। অতএব তাঁর কোলে চড়ে গল্প শোনা ছোট্ট মেয়েটির। কম কথা নয়, তাঁর পিতামহের জীবতকালে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পদধূলি পড়েছিল এ’বাড়িতে; বাবার ঠাকুমার ‘দানসাগর শ্রাদ্ধে’ ব্রাহ্মণবিদায় নিয়েছিলেন স্বয়ং স্যর আশুতোষ; আর ‘অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সের’ প্রাণপুরুষ জ্যাঠামশায় ভূপেন ঘোষের গৃহে নিত্যবাস ছিল রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী থেকে ডি ভি পালুস্করের মত ভারত-কাঁপানো গাইয়েদের। এই পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই অনাথ শিশুটির।
নৈর্ব্যক্তিক বর্ণনা তন্বী গ্রন্থখানির সম্পদ। আর কী সে বর্ণনা? বারবাড়ি-ভিতরবাড়ির পালকিঘর, পানঘর, ........থেকে ধামা ধামা সবজি বাজার, গোয়ালাদলের দুধদোওয়া, পুকুরঘাটে বৌ-ঝিদের ঝগড়াঝাঁটি। মনে হয়, ‘ছেলেবেলা’ পড়ছি। অপূর্ব বর্ণনা সেকালের দোল-দুর্গোৎসবের, এবং আজ প্রায়-হারিয়ে যাওয়া আনুষাঙ্গিক উৎসব চাঁচর, কলাবৌস্নান, রাস-চড়ক-ঝুলন-স্নানযাত্রা; শেতলষষ্ঠী, জয়মঙ্গলবার, ইতুপুজো, পিঠেপাব্বণের বাউনি-বাঁধা। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার চিত্রঃ-- কয়লা নয়, কাঠের আঁচে রান্না; টুথপেস্ট অজানা, তাই খড়িগুঁড়োয় দন্তমার্জন; মেয়েদের পক্ষে চা-পান নিন্দনীয়; সেকালের কলকাতার ঘরে ঘরে সন্ধ্যেয় ঢুকে পড়া গন্ধগোকুল ইত্যাদি ইত্যাদি। কত কত হারিয়ে যাওয়া পেশার লোকের বাস, আনাগোনাঃ ভিস্তি, মেম-তাঁতিনী, আলতাপরানো নাপিতনী, ধুতিকোঁচানোওলা! আর কত প্রায়-হারিয়ে যাওয়া খাওয়া-দাওয়াঃ গোটাসেদ্ধ, বিউলির ডাল, কুলের অম্বল, রসবড়া, কমলালেবুর পায়েস!! আফসোস হয়, এ’সব আর ফিরে আসবে না।
বিয়ে হয়ে স্মৃতি এসে পড়লেন উত্তর কলকাতার আরেক বনেদি ঘরেঃ রাজা দিগম্বর মিত্রের বংশে, যিনি ছিলেন কলকাতার প্রথম বাঙালি শেরিফ (১৮৭৪)। তাঁর পৌত্রের পৌত্র ডাঃ মিহির মিত্রও কলকাতার শেরিফ হয়েছিলেন, যাঁর সঙ্গে ১৬ বছরের কিশোরী স্মৃতির বিবাহ ১৯৪৩-এ। আর এঁদের কন্যারই গৃহশিক্ষক ছিলেন সদ্য গ্রাজুয়েট কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়!
না, চারপাশের রাজনৈতিক ও অন্যান্য ঘটনাবলী থেকেও পুরো মুখ ঘুরিয়ে ছিলেন না এই ধনী-ধনি অন্তঃপুরিকা। তাঁর লেখা এই স্মৃতিকথায় এসেছে সুভাষের মহানিষ্ক্রমণের প্রসঙ্গ, রবীন্দ্রপ্রয়াণে নিমতলা শ্মশানের গাছে চড়ে বীরেন ভদ্রের ধারাবিবরণী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে কলকাতার ইভাকুয়েশন, তিরিশের দশকে উত্তরভারতে ট্রেনভ্রমণ।
চমৎকার স্মৃতি-উস্কোনো লেখা। এমন কিছু উত্তর-কলকাত্তাইয়া কথ্যভাষা ব্যবহার করা হয়েছে যেগুলো বাল্যে ঠাকুমা-দিদিমার মুখে শোনা গিয়েছিল, তারপরে আর নয় (উদা. ‘বর্তায়’ না বলে ‘অর্শায়’। ‘আড়ানি পাখা’। ‘পালাপালি’ করে চামর দোলানো। ‘কোথায় গেস্লি?’)। চমৎকার কিছু সাদাকালো ছবি, দু’টি উপযোগী বংশলতিকা। এতকিছু করেও বইখানি স্থূলাঙ্গিনী হয়নি, বরং দু’ঘন্টার দ্রুতপাঠে শেষ করে মনে হয়, এতো শিগগির ফুরিয়ে গেল? মনে হয়, ইনি আরও কিছু লিখে গেলে সেকালের অন্তঃপুরের আরও কিছু ‘ফার্স্টহ্যান্ড রিপোর্ট’ পাওয়া যেত, প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকেরা যেসব কথা লেখেন না।
স্মৃতিদেবী যেহেতু পেশাদার লেখিকা নন, গ্রন্থসম্পাদকের আরও কিছুটা যত্নবান হওয়া উচিত ছিলঃ যেমন ‘স্বল্পায়ু’ বোঝাতে ‘ক্ষণজন্মা’ লেখা হয়েছে (পৃঃ ১২); ‘অভ্যস্থ’ ও ‘মাতৃপিতৃহারা’ (পৃঃ ১৯), ‘১৯৫২-এ বিভূতিভূষণের মৃত্যু’ (ওটা ১৯৫০ হবে) ইত্যাদি ইত্যাদি। বহু পুরনোকালের সালতারিখ লিখতে লেখিকার স্মৃতিবিভ্রম হয়ে থাকতে পারে। কারণ, তাঁর পিতামহ রামনাথ ও প্রপিতামহ খেলাতচন্দ্র দু’জনেই নিজ নিজ ছেচল্লিশ বছর বয়সে প্রয়াত হয়ে থাকলে রামনাথের ১৯১১-র দিল্লি-দরবারে হাজির হওয়ার হিসেব মিলছে না। ওনার বাল্যে জ্যেঠামশায় ভূপেন ঘোষের আশ্রয়ে বিষ্ণু দিগম্বর পালুস্করকে (১৮৭২-১৯৩১) দেখতে পাবার চেয়ে, তৎপুত্র ডি ভি পালুস্করকে (দত্তাত্রেয় বিষ্ণু পালুস্কর ১৯২১-১৯৫৫) দেখতে পাওয়াই বেশি যুক্তিসঙ্গত। এ’সব শুধরোতে হবে।
তবে, এ’দিকের পাল্লাটা কম ভারি। তাই, ভালোলাগাটাই মনে থেকে যাবে। আর, বইয়ের তাকে মোটাসোটা বইয়ের চাপে চিপ্টে গেলে মাঝে মাঝে ধুলো ঝেড়ে এ’তন্বীকে পেড়ে ভালোলাগাটাকে উস্কে নোব পরে আবার কখনও, বা বারংবার।
বাংলা সাহিত্যে মুসলমান; আবদুল মান্নান সৈয়দ। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা। প্রথম প্রকাশঃ জুন ১৯৯৮, তৃতীয় সংস্করণ মে ২০০৯
"আজি, পুণ্য প্রেমের পুণ্য পরশে হাসিছে জগৎ অমিয়-হাসি।
আজি, কুঞ্জকাননে সৌরভ বিলায়ে ফুটেছে অযুত কুসুমরাশি।
আজি, কাননে গাইছে পাপিয়া গাইছে কোকিল মধুর স্বরে।
আজি আসিবে সে-জন এ’ সৌরজগৎ বাঁধা আছে যার প্রেমের ডোরে।”[‘অশ্রুমালা’, কবিঃ মুন্সী কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১)]
"বঙ্গবাসী মুসলমানদের দেশ-ভাষা ও মাতৃভাষা বাঙ্গালা। মাতৃভাষায় যাহার আস্থা নাই, সে মানুষ নহে।” লিখেছিলেন মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১)।
“আমার দেশের মৃত্যু নাই। আমার দেশের আত্মা যে জনগণ, তাহারও মৃত্যু নাই। তেমনই অমর আমার এই বাঙলা ভাষা।” ---আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩)।
এই তিনজন ছিলেন প্রাক্নজরুলযুগের প্রতিনিধিস্থানীয় সৃষ্টিশীল আধুনিক বাঙালী-মুসলমান সাহিত্যিক। এবং ছিলেন মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক শান্তিপুরী (১৮৬০-১৯৩৩)। কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবাঙলার সাহিত্যজগত এঁদের প্রায় চেনেইনা। এ’পারের বহুলপ্রচারিত ‘সংসদ বাঙালী চরিতাভিধানে’ মহাকবি কায়কোবাদের নামও নেই, যাঁর ‘মহাশ্মশান’ ও ‘অশ্রুমালা’ কাব্য ছাড়া বাঙলা সাহিত্যের আলোচনা কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে না (যদিও ঢাকা বাংলা একাডেমীর ‘চরিতাভিধান’টিতে উনি সসম্মান আলোচিত)-নজরুল কায়কোবাদ সাহেবের পদস্পর্শ করে কদমবুসি করতেন ও ‘আমাদের সকলের গুরু’ বলে মানতেন। প্রমথ বিশী-বিজিত দত্ত সম্পাদিত ‘বাঙলা গদ্যের পদাঙ্ক’, বা অসিতকুমার বন্দ্যোপাধায়ের ‘বাঙলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্তে’ এ’হেন মূলতঃ পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্যিকগণ একেবারেই স্থান পাননি। এতে এনাদের মান ঘাটেনি, সংকলনগুলিই পঙ্গু হয়েছে। আসলে, এ’সব হল ঊনবিংশ শতাব্দীর তথাকথিত ‘নবজাগরণ’-এর কুফল, যেটা আবদ্ধ ছিল মুষ্টিমেয় কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চবর্ণীয় হিন্দুপুরুষের মধ্যেই। নারীদের এরা যেমন কোটরাগত করে রেখেছিল, তেমনই নিম্নবর্ণীয় হিন্দু ও মুসলমানগণ ছিলেন সম্পূর্ণ ব্রাত্য। কলকাতার চৌহুদ্দি ডিঙোলেই তো পাড়াগাঁ--- দখ্নে-নেড়ে-বাঙাল-উড়ে-খোট্টা বলে সকলকে অবজ্ঞা করা! অসহ্য!
এতে অবশ্য বাঙলাসাহিত্যের এই ধারাটি রুদ্ধ হয়নি, বরং দিনে দিনে ভাষাকে পুষ্ট করে চলেছে। ‘এই ধারা’ কেন বলতে হল? এটা কি অন্য কোনো ধাঁচের বাঙলা লেখা, আটলান্টিকের এ’পার-ও’পারে যেমন ইংরিজির দুই ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছিল অষ্টাদশ শতক থেকে? একদমই তা নয়। ছিল একই অখণ্ড বাঙলাদেশ, ভাষা-বানান-অভিজ্ঞতা সবই এক। তবুও সামান্য ব্যতিক্রম সত্ত্বেও ‘ভারতবর্ষ’,‘প্রবাসী’, ‘সবুজপত্র’ মূলতঃ হিন্দুদের, ও ‘সাওগাত’ ‘মোহম্মদি’ ‘মোসলেম ভারত’ মূলতঃ মুসলমানদের পত্রিকাই থেকে গিয়েছিল। দেশবিভাগের মূলটি কত গভীরে ছিল তা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই নামী প্রাবন্ধিক আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহেবকে “বাংলা সাহিত্যে মুসলমান” লিখতে কলম ধরতে হবে এতে আর আশ্চর্য কী? যদিও ভাষা ও সাহিত্যের এই ধর্মভিত্তিক বিভাজন বেদনাদায়ক। তবু, নৈর্ব্যক্তিক আলোচনার জন্য এর দরকার আছে। নৈলে দুই মলাটের মধ্যে এ’সব কোথায় পেতুম বা জানতে পারতুম......?
১. চতুর্দশ শতকের প্রথম বাঙালী-মুসলমান কবি শাহ্মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জুলেখা’ কাব্যের নমুনা।
২. প্রথম বাঙালী-মুসলমান গদ্যকার খোন্দকার শামসুদ্দীন মোহম্মদ সিদ্দিকি (১৮০৮-১৮৭০)-র গদ্যগ্রন্থ ‘উচিত শ্রবণ’ (১৮৬০)। [একটু গদ্যনমুনা থাকলে বেশ হত।]
৩. আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বিপুল পুঁথিসংগ্রহের প্রতি ক্ষিতিমোহন সেনের সশ্রদ্ধ উক্তি, “উনি কোনো ব্যক্তি নহেন, একটি প্রতিষ্ঠান!” দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর গবেষণায় আবদুল করিমসাহেবের কাছে ঋণী ছিলেন।
৪. সেই কবে ১৯১৯-এ মোজাম্মেল হক (শান্তিপুর) সাহেবের গদ্য পড়ে মুগ্ধ স্যর আশুতোষ তাঁকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশনের বাঙলা-পরীক্ষক নিযুক্ত করেন। হকসাহেব পরে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকা সম্পাদনা করে ও ‘জোহ্রা’ (১৯৩৫) উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হন।
৫. বাঙলায় মুসলিম নবজাগরণের পুরোধাপুরুষ ছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ্(১৮৭৩-১৯৬৫)—প্রথম মুসলিম আই.ই.এস. (ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস)। তাঁর ‘ইছলামের বাণী ও পরমহংসের উক্তি’ (১৯৫৬) গ্রন্থের আলোচনা অতি মনোজ্ঞ ও শিরোধার্য।
বাঙালী মুসলিম সাহিত্যিকগণের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের স্থান সর্বোচ্চে। তাই তাঁর ওপর তিনটি অধ্যায় রাখা যথোপযুক্ত হয়েছে; তার মধ্যে শেষের দুটি ‘আল্লাহ্কে নিবেদিত গীতিগুচ্ছ’ ও ‘ রসুল (সা.) নিবেদিত গীতিগুচ্ছ’ ---পশ্চিমে যার পরিচিতি কম।
এ’হেন মণিমুক্তো ছড়ানো এ’গ্রন্থের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। আধুনিক বাঙলাসাহিত্যের সম্যক পরিচয় পেতে এ’হেন গ্রন্থের তাই কোনো বিকল্প নেই। তুলনা নেই আঁটোসাটো ভূমিকাখানির। মান্নান সাহেব আমাদের ধন্যবাদার্হ হলেন। বইখানি সুধীপাঠকের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে স্থায়ী ঠাঁই পাক।
কয়েকটি প্রাসঙ্গিক কথা এই ধরা থাক্ঃ
১. কায়কোবাদ থেকে শুরু করে কবি আবদুস সাত্তারে (জ.১৯২৭) শেষ এই গ্রন্থের আলোচনা---মাত্র ১৪ জন মুসলিম সাহিত্যিককে নিয়ে, ২৬৬ পৃষ্ঠাব্যাপী। আবু ইসহাক (‘সূর্যদীঘল বাড়ি’), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্(‘লালসালু’) বা মুনীর চৌধুরী (‘মানুষের জন্য’)-র মত প্রতিনিধিস্থানীয় লেখকগণ কোন্যুক্তিতে বাদ গেলেন বা সামান্যমাত্র আলোচিত হলেন তার কোনো মানদণ্ড বা উল্লেখ কোথাও নেই।পেপারব্যাক বইটির ছাপাই-বাধাঁই চমৎকার। কোনো মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েনি (এনারা কি কোনো বাঙলা স্পেলচেকার ব্যবহার করেন?)
২. পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম লেখকগণ প্রায়-সম্পূর্ণই উপেক্ষিত থেকে গেছেন, সে সেকালের এস্. ওয়াজেদ আলী সাহেব হোন্ বা অতুলনীয় সৈয়দ মুজতবা আলী (সিলেটি হলেও ওনার প্রতিষ্ঠা তো পশ্চিমেই), আবু সয়ীদ আইয়ুব, বা একালের সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বা আফসার আহমেদ। এর কারণ কী?
৩. রাসসুন্দরী দেবীর পরেপরে লেখনী ধরেছিলেন কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী (১৮৩৪-১৯০৩), তারও পরে নূরুন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী (১৮৯৪-১৯৭৫), সৈয়দা খাতুন আখতারমহল (১৯০০-১৯২৮), নজরুলশিষ্যা সৈয়দা মোতাহেরা বানু (১৯১১-১৯৭৩) প্রমুখ। বাঙলাসাহিত্যে মুসলিম-লেখিকাগণ সাধারণতঃ উপেক্ষিতাই থেকে যান।মান্নানসাহেবের এই বইয়েও তাঁরা তা-ই থাকবেন? বিশেষতঃ, বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামালের প্রায়-অনুল্লেখ মানা গেল না। মুসলিম লেখিকাদের ওপর এক সম্পূর্ণ অধ্যায় থাকলে আশা পূরতো।
এ’হেন পুস্তককে স্বাগত জানাই ও শিরোপরি রাখি।
ফকিরনামা; সুরজিৎ সেন। প্রকাশনালয়ঃ গাঙচিল, কলকাতা-১১১। প্রথম প্রকাশঃ ২০০৯.
কিছু প্রান্তিক মানুষ। প্রান্তিক---আর্থিক প্রান্তের,প্রতিষ্ঠিত ধর্মাচরণেরও প্রান্তে। বেশ আছেন তাঁরা তাঁদের জগতে---গান নিয়ে, নিজ নিজ বিশ্বাস আঁকড়ে। এই বিশ্বাস কখনও আচারে উদ্ভট রূপ ধারণ করতে পারে। উদ্ভট তাঁদের কাছে নয়, সে-বৃত্তের বাইরের জনের কাছে। উদ্ভট, তাই প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা-অনুসন্ধিৎসা। আর সেই জিজ্ঞাসা খুঁড়ে বেরিয়ে আসা এক গহন অন্তরের অন্তঃস্থলের কিছু সহজ ভাবনা। সহজ, অতি সহজ। তাই তার নাগাল পাওয়া অতি কঠিন। এ-ই তাঁদের ঐশভাবনা---নামটা ভগবান বা আল্লাহ্ যা-ই হোক না কেন। আর সে-এবাদতের পন্থা সঙ্গীত--- মূল ধর্মের ধ্বজাধারীরা যাকে হারাম বলে শাসিয়ে রেখেছে। বেদাআ’ত (শাস্ত্রে-বলা-নেই এমন রীতি পালন) ও শের্ক (আল্লাহ্র সঙ্গে অন্য কারোকে শরিককরণ) শরিয়তি ইসলামে মস্ত গুণাহ্, আর এই প্রান্তিক ধর্মাচরণীদের সেটাই রীত! তাঁরা গুরু মানেন ও মাটি থেকে উৎসারিত আচারাদির পালন করে থাকেন। কারণ এ’মরমিয়ারা (‘মারফতি’) আনুমানিক- ধর্মের মোক্ষ,পরকাল ইত্যাদি মানেন না; পরমাত্মাকে অন্তরে অনুভূত করাই (‘তরিকত’) এনাদের লক্ষ্য। এ’সব ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে আরব থেকে পারস্য হয়ে পূর্বভারতেও এই সহজিয়া ধর্মের বাড়বাড়ন্ত এর অন্দরের তাকতটাই প্রমাণ করে। পারস্যে যা ছিল সুফিবাদ, তারই বহিরাবরণ বদলে গিয়ে এখানে ফকিরিতত্ত্ব--- সহজ কথা সহজে বলার ধর্ম। যা অপ্রমাণ্য, অলীক, তার সঙ্গে এ’সহজিয়া ধর্মের বনিবনা নেই। এ’ধর্ম মাটির কাছাকাছি, পৌঁছ্ যদিও তার সর্বোচ্চে!
কে ফকির? আর কে-ই বা বাউল। সহজিয়া গান কোনো মুসলমান গাইলে সে ফকির আর হিন্দু গাইলেই বাউল? কেন এই ভেদ, যখন মূল কথাটা এক-ই? বাউলরা তো আজকাল প্লেনে চড়ে ইয়ুরোপ-আমেরিকা করে বেড়াচ্ছেন, ফকিররা ততটা নন (পবনদাস বাউল তো প্যারিসেই থাকেন)। তাহলে এঁরা কি আরও প্রান্তিক? এই দ্যাখো, সহজিয়া ধর্মের মধ্যেও আবার প্রভেদ?! বস্তুতঃ, এ’তত্ত্ব বুঝে যাওয়া বড় সহজ কাম নাঃ কত তাপস-তপস্বিনী সারা জীবন লেগে রয়েছেন!
আর রয়েছে তাঁদের গোপন আচার! এ’এক মস্ত প্রশ্নচিহ্ন। চারচন্দ্রভেদে# কী হয়? যাঁরা এ’ আচরণে অভ্যস্ত তাঁরা সাধনার কোন্ উচ্চমার্গে উন্নীত হয়েছেন? অন্যভাবে শুধোলে, নানক-কবীর-চৈতন্যদেব থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ--- যাঁরা কায়াসাধনার বিরোধী ছিলেন, তাঁরা কী সর্বোচ্চ মার্গে পৌঁছুতে পারেন নি? তাতে কী ক্ষতি হয়েছে? এ’ বড় জটিল প্রশ্ন। কে বলে দেবে এর উত্তর? না, তরুণ লেখক সুরজিৎ এ’সব প্রশ্নের উত্তর দিতে কলম ধরেননি। ওঁর ধাঁচটি ভাষ্যকারের, টীকাকারের নয়। এবং এটি ভালো লেগেছে। যদিও এরই মধ্যে থেকে কত খাঁটি কথা কত সুন্দর কথা উঠে এসেছে।
দু’একটি, আসুন, ভাগ করে নিইঃ
পৃঃ ৩০: ফকিররা পরলোক, মোক্ষ বা মুক্তিতে বিশ্বাস করেন না তাঁরা বর্তমানপন্থী। তাঁরা বিশ্বাস করেন, মানুষের শরীর থেকেই যখন মানুষের জন্ম, তখন তার পিছনে ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা নেই। আর যদি থাকে, তাহলে সে-ঈশ্বর মানুষের শরীরের ভিতরেই থাকেন।
পৃঃ ১৩৩: লালন বলেছেন, ‘মিলন হবে কতদিনে, আমার মনের মানুষের সনে’। এই মনের মানুষ তো প্রকৃতি। তাই প্রকৃতিকে না চিনে রসুল চেনা যায় না। এ’ সাধনা করলে শরীরে নূর জ্বলে ওঠে! ....লালনের গান সমাজের অপর কণ্ঠস্বর। যে কণ্ঠস্বর সমাজের মূলস্রোতের যাবতীয় কোলাহলের বিরুদ্ধে টিঁকে আছে। (পৃ.৩১.)।
পৃঃ ১৩৯: বস্তু বা বীর্যরক্ষার সাধনাই ফকিরদের মূল সাধনা। যে ওটা পারে, সে ফকির বা বাউল হতে পারে। এটা প্রাথমিক স্তর, এটা যে অর্জন করতে পারবে সে আরও এগিয়ে যাবে।
পৃঃ ১৪২: ইসলামের মর্মকথা যে সৎ মানুষ হওয়া এবং শান্তির বাণী প্রচার করা ফকিররা তো এটাই অনুসরণ করেন। অর্থাৎ ইসলামের দার্শনিক দিকটাই ফকিররা উজ্জ্বল করে তুলেছেন। শরিয়তিরা তা মানতে রাজি নয়। তাই তাঁরা নানাভাবে উত্যক্ত করেন ফকিরদের।
পৃঃ ১৪৯: আপনি যদি গাদা গাদা কোরান হাদিস রামায়ণ মহাভারত গীতা তত্ত্ব পড়েন, তাহলেও আপনি কিছুই বুঝতে পারবেন না, যতক্ষণ না মানুষতত্ত্বে আসছেন।
পৃঃ ২৭০: ......মক্কায় গিয়ে ইব্রাহিমের হাতে পানি-জল দিয়ে তৈরি খালিঘর দর্শন করে হাজি খেতাব নিয়ে দেশে ফিরে এলে। কিন্তু যার ঘর, তার সাক্ষাৎ পেলে না। হজের আসল মানে হল সাক্ষাৎ। সাক্ষাৎ হল না, আর হাজি হয়ে গেলে? তাই মারফৎ বলছে, দেলকাবাকে উদ্দেশ্য করো। আপন দেলকে যে এখতিয়ার করেছে তার হজ আকবরি হয়েছে। এই দেলকাবা আল্লাহ্র নিজের হাতে তৈরি আর তিনি নিজে সেখানে বাস করেন। তাই জন্য হাজার বার কাবায় তওফ করে যত নেকি হবে, তা চেয়ে একটি দেল খুশি করলে হাজার গুণ নেকি হবে।
পৃঃ ২২০: শরিয়ত মানে সৎ হওয়া, ইমানদার হওয়া। তিন রকম নামাজ আছে। একরাও সালাত---নামাজ পড়ো; ওয়াকিম সালাত--- নামাজ প্রতিষ্ঠা করো; আর দায়েম সালাত--- নামাজ কায়েম করো। শুধু প্রথমটিতে থেমে থাকলে বাকী দুটি আর হাসিল হবে না, নামাজের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
পৃঃ ৩২৯: ......... পূর্ব পারস্যের বৌদ্ধধর্মত্যাগী মুসলমানদের মধ্যে পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের অনুষঙ্গগুলি ফিরে আসায় পিরবাদ পারস্যে জন্ম নেয়। পারসি পির ও বৌদ্ধ থের শব্দ দুটিরই মানে বৃদ্ধ ব্যক্তি। বৌদ্ধদের চৈত্য বা স্তূপপূজার প্রথা অর্থাৎ থেরের সমাধিপূজা প্রথার হুবহু অনুকরণ পীরের সমাধিপূজা বা উরসের অনুষ্ঠান।
সেকালের হোরেস উইলসন-অক্ষয় দত্ত থেকে শুরু। একালের সুধীর চক্রবর্তী-শক্তিনাথ ঝা-মশায়ের লেখায় কর্তাভজা-বলাহাড়ি-সাহেবধনী সম্প্রদায়ের পাশাপাশি মারফতি ফকিরিতন্ত্রের আলোচনা এসেছে। কিন্তু কেবলমাত্র ফকিরিতন্ত্র নিয়ে প্রায় চারশ’ পাতার এক গ্রন্থের শেষ পর্যন্ত পাঠককে টেনে নিয়ে যেতে সুরজিৎ সফল হয়েছেন তাঁর মাটির কাছাকাছি থাকার কারণে। শুধু বই পড়া বিদ্যে (এ’নিবন্ধকারের মত) বা এর-ওর কাছে শুনে লিখে দেওয়া যে নয়, এ’ বই পাঠে তা প্রতীত হয়। এবং এ’ কোনো সাময়িক হুজুগও নয়, যে-রকম লোকজন মেলায়-টেলায় হামেশা নজরে আসে।
পথের গল্পই তো সব। বৌদ্ধধর্মও এককালে প্রতিবাদী ধর্ম হিসেবেই শুরু হয়েছিল। মূর্তিপূজক রোমকদের হাতেও কৃশ্চানদের কম নিগৃহীত হতে হয়নি। যেমন, মূলস্রোত মুসলমানদের হাতে এই প্রান্তিক ফকিরদের আজও নিগৃহীত হতে হচ্ছে। সেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে হাজি শরীয়তুল্লাহ্ ও কেরামত আলী (জৌনপুরী)-সাহেবদের হাতে এই বাঙলাদেশে ইসলামের মূলে ফেরার আন্দোলন তো কম হয়নি। মীর মশাররফ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ – এঁদের ছিছিক্কার করেননি কে ? তবু কোন্শক্তিতে মূলস্রোতের বাইরের এই ধারা ক্রমে ক্রমে আরও পুষ্ট হয়ে চলেছে? কে ঠিক---সময় বলেছে, আরও বলবে। কিন্তু নিজ নিজ মতে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা সক্কলের আছে। সেখানে বাধা এলে রাষ্ট্রের কর্তব্য হয় তা সুনিশ্চিত করা।
একটি বই পড়ে কোনো মত বা পথ সম্বন্ধে পুরো ধারণা হয়ে যায় না। বর্তমান লেখকের উদ্দেশ্যও তা নয়। তবু অসাধারণ প্রোডাকশনটি হাতে তুলে নিলে মন ভালো হয়ে যায়। ছাপাই, বাধাঁই, ‘চলমান’-প্রচ্ছদ মন টানে। গাঙচিলের কাজ, চমৎকার! ভেতরের সাদাকালো ছবিগুলি একেকটি শিল্পের স্তরে উন্নীত। চারটির বেশি মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েনিঃ ‘কর্মব্যাস্ত’ (পৃ.৭৯), ‘সাংগাঠনিক’ (পৃ.১৮৬), ‘শেষে নিঃশ্বাস’ (পৃ.১৯০) এবং ‘একদশ’ (পৃ.৩২২)। পৃ.৩৩১-তে মুসা-কে হজরত মহম্মদ (সা.)-এর চেয়ে “ছ’ হাজার বছর পূর্বের” নবী বলা হয়েছে। কিন্তু মোজেসের সময়কালটা তো খৃ.পূ. দ্বাদশ শতাব্দী। অতএব এটা “দু’ হাজার বছর পূর্বের” হবে।
বাউল-ফকিরদের ভাববিনিময়ের ভাষা ‘সন্ধা’---ভিতর ও বাহিরের এক আব্ছা সন্ধি সেখানে। বাইরে তার এক রূপ, মধ্যে আরেকঃ কুমির মানে কাম, অমাবস্যা হল নারীর ঋতুকাল, স্ত্রী-যোনি না বলে বলবে বাঁকানদী, লতা মানে সন্তান। তা, সুরজিৎবাবু ফকিরি কথায় আব্ছা ‘সন্ধা’ কিছু রাখেন নি, সাধারণ পাঠকের বোধগম্য করেই বলতে পেরেছেন, তা তাঁর নিজের অনুভব গভীর বলেই। এনার পরবর্তী বইখানি, তাই, পড়ার ইচ্ছে জেগে রইল। উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
বহুরূপী বাংলা বানান; নীলাদ্রিশেখর দাশ। ‘দক্ষভারতী’, কলকাতা-৯। প্রথম প্রকাশঃ জুন ২০০৬
কলকাতার ইন্ডিয়ান স্টাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটে রাশিবিজ্ঞান, অর্থনীতি, গ্রন্থাগারবিজ্ঞানের পাশাপাশি সেই প্রশান্তচন্দ্রের আমল থেকে এক ভাষাবিজ্ঞান কেন্দ্রও আছে এবং সেখানে মূলতঃ বঙ্গভাষার চর্চা হয়---কোনো সূত্রে এটা জানার পর থেকে এ’বিষয়ে বিশদতর জানবার আগ্রহ ছিল। সম্প্রতি একখানি বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেল যার লেখক এই কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। অতএব গ্রন্থখানির সাগ্রহ পাঠ ও....... ও....কী? আশাভঙ্গ বলবো? নয়তো কী? এক জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়ের আলোচনায় যে স্বচ্ছচিন্তার প্রয়োজন ছিল, তার অভাবে সমগ্র প্রচেষ্টাটি তালগোল পাকিয়ে গেছে।
প্রায় ১২০ পৃষ্ঠার এক গোটা বইয়ে বাঙলা বানানের সমস্যা নিয়ে অর্থপূর্ণ আলোচনা করা যায় না---মানতে পারলাম না। বরঞ্চ এর চেয়ে অনেক কম পরিসরে পবিত্র সরকার-সুভাষ ভট্টাচার্য মশায়দের চিন্তনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া গেছে ওনাদের ’৮০-’৯০-এর দশকের লেখায়---যেগুলো আজও মনে আছে, মানিনি বলে আক্ষেপ আছে। সে-সব প্রস্তাব কতখানি মানা হয়েছে বা হয়নি সেটা অন্য কথা। মানলে হয়ত আজ এই বইয়ের প্রয়োজন হতো না। বর্তমান লেখকের প্রচেষ্টাখানি আশা জাগিয়েও কোথাও পৌঁছতে পারলো না, এটাই আক্ষেপের।
যেকোনো জীবন্ত ভাষারই সমস্যা থাকবে, থাকবেই। সেটাই তার জীবনের লক্ষণ। কতটা মুন্সীয়ানায় সেটাকে সামলে সর্বজনগ্রাহ্য সমাধানে পৌঁছনো যায়---সেটাই লক্ষ্য। কারণ, কোনো এক সর্বরোগহর বড়ি নেই যা গিলিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে এ’সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এটা মেনে নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে কি বাঙলা বানান নিয়ে অরাজকতা চলতেই থাকবে? সর্বজনমান্য একটি রূপ কি এর থাকবে না? মূলতঃ এই প্রশ্ন নিয়েই শুরু করেছিলেন লেখক।
রাজশেখর বসুর নেতৃত্বে ১৯৩৬-এ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ‘বানান কমিটি’-র মান্য সদস্যবর্গ যে যৌক্তিক গতিপথে বেঁধে দিয়েছিলেন তা ছিল সঠিক দিশারী। তৎসম শব্দাবলীকে মাথায় রেখেও সেই প্রথম বাঙলাভাষা সংস্কৃতের অনাবশ্যক নিগড় কেটে বেরলোঃ উদা. সূর্য্য হল সূর্য, সর্ব্ব হল সর্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। এই প্রস্তাবাবলী কঠিনলভ্য নয়,অনেক চালু বাঙলা অভিধানের পরিশিষ্টে উপলব্ধ। পরবর্তীতে এই পথ থেকে সরে এসে যে বানান-অরাজকতার কাল শুরু হল, যা আজও চলছে, তার পেছনে এই এই কারণগুলো আছে বলে মনে হয়ঃ
১. প্রথম আঘাত এলো ধর্মের লাইনে। কোনো ভাষার সঙ্গে ধর্মের সরাসরি সম্পর্ক থাকতে পারেনাঃ উর্দু কেবল মুসলমানের ভাষা নয়, বাঙলাও কক্ষনোই কেবল এক বিশেষ ধর্মের মানুষের ভাষা নয়। তবু, দেশবিভাগের পরে পশ্চিমি প্রভুদের ইঙ্গিতে পূর্ব পাকিস্তানে তৎসম-তদ্ভব-রবীন্দ্রনাথকে ঝেঁটিয়ে বিদায়ের যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিলে তার ধাক্কা বাঙলা বানানের ওপরও পড়েছিল। সেই ধর্মীয় নিগড় কাটিয়ে ‘বাংলা একাডেমি,ঢাকা’-র নেতৃত্বে আজ বাংলাদেশ যে এক মান্য ও স্বীকৃত বাঙলা বানানের কালে উপনীত হয়েছে, তার পেছনে অনেক ঘাম-রক্ত আছে, যা সম্মানের দাবি রাখে। লেখক নীলাদ্রিশেখর এই বানান পশ্চিমে অমান্য বলে ফতোয়া দিয়েছেন, তা কেবল পুবে বানানো বলেই! এই আমিত্ব বর্জনীয়। বস্তুতঃ আজকের বানান-অরাজকতার শুরু এই আমিত্ব থেকেই। কে বড়? কার কথা মানবো? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বড়, না ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’ বড়, না সেই বহুলপ্রচারিত প্রকাশনালয়? বানান নিয়ে শেষ ফতোয়া দেবার দাবিদার কে? ‘বাংলা একাডেমি,ঢাকা’র বানানবিধি মানলে কি আমার জাত যাবে, যেমন নাকি জল না বলে পানি বললে যায়?
২. দ্বিতীয়, ১৯৮৬তে কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভাষা-দাদাগিরির আরেক রূপ দেখা গেল। ওপারে ফেজটুপি তো এ’পারে নস্যপীড়িত পার্টিভাষ্য। ধর্মদাস থেকে দলদাস। এতে বাঙলা বানানসমস্যা আরও ঘুলিয়ে গেল। লেখক এতো চাঁচাছোলাভাবে না হলেও এই পর্যায়ের আলোচনাটা মন্দ করেননি।
৩. তৃতীয়, ভাষা-দাদাগিরির সবচেয়ে কদর্য রূপ এখনও দেখাচ্ছে এক আর্থিক বলে বলীয়ান বাঙলা প্রকাশনালয়। আমার প্রচার সর্বোচ্চ, অতএব ডেঙ্গি-পটনা-গাওস্কর-জয়সিংহ (ক্রিকেটার জয়সিমা) চলছে, চলবে। পাঠক তা গিলতে বাধ্য। সম্প্রতি এনারা দৈনিকে ‘ক্ষীরের পুতুল’-কে ‘খিরের পুতুল’ লিখে রেকট করেছেন! অবন ঠাকুর সগ্গ থেকে এনাদের মাফ করুন। আবাল্য দৈনিকে ‘স্মৃতির উদ্দেশ্যে’ পড়ে আসছি। ইদানীং সেটা ‘উদ্দেশে’ হয়ে গেল। এনাদের বানানলেখার প্রেসক্রিপশন-বইটি পড়ে জানা গেল উদ্দেশ্য ও উদ্দেশ—অর্থ দুটি নাকি সম্পূর্ণ আলাদা। যদিও চলন্তিকা-সংসদ বা ঢা.বা.এ. তা বলেন না। নৈরাজ্যের আগল খুলে যাওয়ার আর বাকি কী? সবাই বলে আমারটা মানো। এই আমিত্বই সর্বনাশ করলো। ওর মতটা মানতে আমি যত আপত্তি করছি, ততই কিন্তু দূরে সরে যাচ্ছি। এইটে না বুঝলেই যত অশান্তি ও বিভ্রান্তি। বসওয়েলের “লাইফ অব্ জনসন” বইখানা ফের একবার পড়ে দেখার অনুরোধ করি এঁদের।
লেখক নীলাদ্রিশেখর আলোচনা তো করেছেন প্রচুর। আরও ভালোভাবে বললে, কোন্আলোচনাটা না করেছেন? বানানকে উচ্চারণানুগ করতে অতি-কে ওতি, ছবি-কে ছোবি লিখতে হবে কিনা---সে-আলোচনাও আছে। কে বা কারা এমন পরিবর্তন চান জানিনা। ণ-ত্ব বিধান ষ-ত্ব বিধান বাঙলা বানানের একটি প্রতিষ্ঠিত নিয়ম। তা সত্ত্বেও এ’নিয়ে তির্যক আলোচনার কোনো প্রয়োজন আছে কী? বিদেশি অভিধার (যেমন, ব্যক্তি বা স্থাননাম) বাঙলা লিপ্যান্তর এক জ্বলন্ত সমস্যা। এ’বিষয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আলোচনা রয়েছে, দানা বাঁধেনি। দুটোব থাকলেও ওয়া লিখতে হবে কেন (উদা. নওয়াব, ওয়াজির)। হিন্দির মত পেটকাটা ও না-কাটা দুটি ‘ব’ লিখে সমস্যাটা কেন মেটাই না? খেলা-র উচ্চারণ খ্যালা, মেশা কিন্তু মেশা-ই। পবিত্রবাবু বহুকাল পূর্বে পেটকাটা এ’-কারের কথা বলেছিলেন। মানিনি। সমস্যাটা সমস্যাই থেকে গেছে।
সবচেয়ে আপত্তিকর লেগেছে নীলাদ্রিবাবুর ভাষা। ভাষাসমস্যা নিয়ে লিখতে বসেছি বলে গুরুগম্ভীর ভাষাতেই তা লিখতে হবে---মানিনা। ঠিক আছে। কিন্তু এমন ভাষা? উদা..
১. "আমার এক মালখোর বখাটে কবিবন্ধু গড়চার ঠেকে বাংলা টানতে টানতে বলেছিল, দূর শালা, লিঙ্গুইস্টিক্স পড়াই ছেড়ে দেবো” বা,
২. "আসলে কচি মাথা চিবিয়ে খেতে সবারই সুবিধে, সে পাড়ার দাদাই হোক্বা পাড়াতুতো বৌদি...” বা,
৩. “আমাদের বানানটাই কেবল দড়কচা মারা কাঙালিনী থেকে গেল” ইত্যাদি ইত্যাদি।
এমন ভাষায় প্রবন্ধ? আলালি ভাষা নাকি? টেকচাঁদ কবরে থাকলে পাশ ফিরে শুতেন। কঠিন কথা সহজ করে বলতে গেলেই ছ্যাবলামি করতে হবে? এর একটা সীমা থাকা উচিত।
মুখবন্ধে লেখক কপট দুঃখু করেছেন যে তাঁর শিশুকন্যা মানে তার স্কুলের মিস্রাই কেবল সঠিক বাঙলা বানান জানে, বাবা কিস্যু জানে না।
শিশুকন্যার কী অমোঘ উক্তি!!