ঠিক চুয়াত্তর বছর আগেকার কথা বলছি – জী, সময়টা ১৯৩৯ সনের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস!
আমি বরিশালের অতি প্রত্যন্ত এক গ্রামের, একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ের, ছেলে। বাবাজান বরিশাল শহরে (বর্তমান ‘নূরিয়া হাই স্কুল’ এবং তদানীন্তন ‘নূরিয়া হাই মাদ্রাসা’) শিক্ষকতা করেন। ওনার সাথে বরিশাল শহরে আমার প্রথম যাওয়া ১৯৩৭ সনে - সেটা ছিল এমনি বরিশাল দেখতে যাওয়া। রীতিমত পড়াশুনার জন্য প্রথম যাই ১৯৩৯ সনের জানুয়ারিতে - পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে।
বাবাজান যে ইংরেজি ও গণিতের শিক্ষক, তাঁকে দেখলে কারুর পক্ষে তা অনুমান করা সম্ভব ছিল না – পাজামা, লম্বা জোব্বা ও দাড়ি, সারাক্ষণ মাথায় টুপি এবং পকেটে রূপার পানের ডিব্বা। উনি খুব ধর্মপরায়ণ ছিলেন এবং নিজে ওখানকারই একজন শিক্ষক ছিলেন বিধায়, আমাকেও মাধ্যমিক পর্যন্ত ঐ (নিউ স্কীম - ঢাকা বোর্ডের অধীন) মাদ্রাসায়ই পড়তে হয়েছিল – যে পাঠ্যক্রমে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত হাইস্কুলের মতই ছিল; কিন্তু অনেক বেশি ছিল বাড়তি এক রাশ আরবীর বোঝা।
শহরে আসার কিছুদিন পরেই, দশম শ্রেণীর এক জ্যেষ্ঠ ছাত্র (আব্দুল মালেক ভাই) সাহস করে বাবাজানের কাছে আমাকে 'বায়োস্কোপ' দেখাবার প্রস্তাব করেন, “স্যার, আবুল বরিশাল এসেছে – কোনদিন ‘বায়োস্কোপ’ দেখেনি। তো, ওকে একটু ‘বায়োস্কোপ’ দেখাতে নিয়ে যাই?” বাবাজান নিজে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত (মৃত্যুঃ জানুয়ারি ১৯৮৫) সিনেমা দেখেন নাই। একটু চিন্তা করে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন সিনেমায় যেতে চাও? ‘সবাক’ ছবি তো, ‘টকি’?” মনে মনে খুব চিন্তিত হচ্ছিলাম; কিন্তু আমারতো ‘সবাক’ কী, সে সম্পর্কে কোন ধারণাই নাই। আসলে, সেকালে বেশিরভাগ ছবিই ছিল ‘নির্বাক’ অর্থাৎ শুধু জীবন্ত, গতিশীল ছবি, কিন্তু, এক্কেবারে যাকে বলে, ‘বোবা’ – কোন শব্দের বালাই নাই, কারও মুখে কোন রা নাই! সবাক ছবিকে বলা হত, ‘টকি শো’। সবাক ছবি দেখাবেন আশ্বাস দিলে, বাবাজান রাজী হয়ে গেলেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! শুধু এটা শুনে – ছবি দেখার আগেই - আমার যে ফূর্তি হয়েছিল আজও তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবনা।
বরিশালে তখন দুটো সিনেমা হল ছিলঃ ‘জগদীশ’ ও ‘দীপালী’ – অনেক পরে ১৯৪৮ সনে শুরু হয় তৃতীয় হলটি, ‘সোনালী’ হল। পরবর্তীতে ‘জগদীশ থিয়েটার’-এর মালিকানা ও নাম বদল হয় - হয়ে যায় ‘কাকলী’। মালেক ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন জগদীশ হলে, সন্ধ্যার শো-তে – ছবির নাম, ‘রুক্মিণী’। ছবি দেখে যে কী তাজ্জব ও বিমুগ্ধ হয়েছিলাম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন বুঝি যে ওটা ছিল হিন্দুদের পৌরাণিক কোন কাহিনী নিয়ে, যা আমি আগা-গোড়া কিচ্ছুই বুঝিনি; যদিও বাস্তবের মতো ছায়াছবির জীবন্ত কর্ম-কাণ্ড, আনা-গোনা, কথা-বার্তা ও গান দেখে-শুনে অবাক বিস্ময়ে মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। এর পরে দু’আনা পয়সা (সর্বনিম্ন টিকেটের খরচ) যোগাড় করার চেষ্টায় থাকতাম এবং দু’তিন মাস পরে পরে ‘ম্যাটিনী শো’ দেখতে যেতাম (মাঝে মাঝে ‘নির্বাক’ ছবিতেও), যদিও কোনো ছবিরই মর্ম বুঝতামনা – তবে চার্লি চ্যাপলীনের নির্বাক ছবিগুলি দেখে ভীষণ মজা পেতাম।
এখানে একটি কথা না বললে বোধ হয় এ বাবদে সেকালের যথাযথ চিত্রটা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠবেনা। প্রচারণা ও দর্শক আকর্ষণের জন্য প্রতিটি হলই দুটি কাজ করতেনঃ (১) সকালের দিকে ঘোড়ার গাড়িতে করে (সেকালে সারা বরিশাল শহরে হাতে গোণা কয়েক জনের গাড়ি ছিল – ঘোড়ার গাড়ি ও মানুষে-টানা রিকশা ছিল একমাত্র যানবাহন), মাইকে গান ছেড়ে রাস্তায় রাস্তায় বিলি করা হত চলতি ছবির বিজ্ঞাপন; এবং (২) সন্ধ্যা শো’র আগে ছবি শুরুর বেশ খানিক্ষণ আগে থেকে হলের বাইরে জোরালো মাইকে খুব ভাল ভাল গান বাজানো হত – যা অনেক দূর থেকেও শুনা যেত। বাসা থেকে জগদীশ হল কাছে থাকায়, ওখানেই ‘আধা পয়সা’র চিনা বাদাম খেতে খেতে অনেকক্ষণ ঐ সব চমৎকার গান শুনতাম। এখনও যেন সে সব গানের অপূর্ব সুরের রেশ কানে বাজেঃ “একাদশীর চাঁদ রে ঐ, রাঙ্গা মেঘের পাশে / যেন কাহার ভাঙ্গা কলস আকাশ গাঙ্গে ভাসে”, “মোর প্রিয়া হবে, এসো রাণী, দেবো খোঁপায় তারার ফুল…” বা “আকাশে হেলান দিয়ে, পাহাড় ঘুমায় ঐ” ইত্যাদি।
এল ১৯৪১! শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তরণ – সপ্তম শ্রেণী। আমার ব্যক্তিজীবন ও সিনেমা জগতের ক্রান্তিকাল। জগদীশ হলে নতুন সবাক ‘বই’ এসেছে, নাম “গরমিল”- নায়কের অভিনয়ে ছিলেন ‘রবীন মজুমদার’; আর কারুর নাম সঠিক মনে নেই। (খুব সম্ভব নায়িকার নাম ছিল প্রভাদেবী।) এ ছবিতে রবীন মজুমদারের নিজ কন্ঠের গান, “এই কি গো শেষ দান, বিরহ দিয়ে গেলে…” এখনও অতি জনপ্রিয় একটি গান। এ ছবি দেখেই সিনেমা জগৎ সম্পর্কে আমার প্রথম জ্ঞানের উন্মেষ! পুরাপুরি বুঝতে পারলাম কাহিনী এবং এই প্রথম প্রাণ ভরে উপভোগ করলাম একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি!
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সেযুগে নায়ক-নায়িকাদের নিজ কন্ঠে গান করতে হত – ‘ডাবিং’ এর পদ্ধতি তখনও চালু হয়নি।
ছবি দেখা হত খুবই কম – পয়সার ব্যাপার ছাড়াও এক বড় সমস্যা ছিল বাবাজানকে এড়ানোর– যেতে হত চুরি করে, ‘ম্যাটিনি’ বা বিকেলের শো তে। যাই হোক, পরের বছর, ১৯৪২ সনে এলো আর একটি মন-মাতানো, খুব আকর্ষণীয় ছবি, “শেষ উত্তর”। কাননবালা ও প্রমথেশ বড়ুয়া নায়িকা-নায়ক। এ ছবির বেশ কয়েকটি গান আজও অত্যন্ত জনপ্রিয়ঃ ‘আমি বনফুল গো”, ‘লাগুক দোলা, লাগুক দোলা! আমার গানে তোমার মনে লাগুক দোলা”, “তুফান মেল যায়…”, ‘রুমঝুম নূপুর পায়ে বাজে গো, বাজে” এবং “যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে, এঁকে থাকো কারও ছবি/ সে কথা বলিয়া যেয়ো, ভুলিয়া যাবে কি সবই”।
এ ছবির যৎকিঞ্চিৎ উপক্রমণিকাঃ বিরাট জমিদারের বেশ একটু ভুলো-মনা পুত্র (প্রমথেশ বড়ুয়া), সঙ্গে এক সহকারী নিয়ে, (বিয়ের) মেয়ে দেখতে যাচ্ছেন ট্রেনে করে। সকাল বেলা এক গ্রাম্য স্টেশনে গাড়ি থামলে, তিনি ডায়েরীতে ও সময় “প্রাতঃভ্রমণ’ লেখা দেখে, নেমে পড়েন প্রাতঃভ্রমণে! ওদিকে গাড়ি চলে যায়, আর সে সুবাদে, সেখান থেকেই শুরু হয় গল্পের। বুড়ো ষ্টেশনমাষ্টারের কাজ-কর্ম অনেক সময়ই সারে তাঁর সুন্দরী, যুবতী নাতনী (কাননবালা)। ট্রেন-হারানো যুবক তার সমস্যা নিয়ে ষ্টেশনমাষ্টারের অফিসে গিয়ে ওই নাতনীকে দেখে, তাকেই সম্বোধন করে, ‘মাষ্টারমশাই’ বলে। অতঃপর ‘নবাগন্তুক-মাষ্টারমশাই’ এর গল্প এগিয়ে চলে, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, ঈপ্সিত পরিণতির দিকে – মাঝে সুখাবহ যত সব আকর্ষণীয় বায়নক্কা, যার কিছু সংলাপ এখনও বেশ মনে আছে; কিন্তু এখানে সেসব দিতে গেলে লেখাটির কলেবর সীমা লঙ্ঘন করতে পারে। যাই হোক, আমার অবিস্মরণীয় সিনেমার তালিকায় এ ছবিটি দুই নম্বর স্থান অধিকার করে আছে!
মনের মুকুরে এ তালিকার প্রথম স্থানে যে ছায়া-ছবি আজ অবধি স্থায়ী ভাবে বিরাজ করছে, সে ছবির নাম “উদয়ের পথে”। নায়ক-নায়িকা দু’জনই একেবারে আনকোরা, অপরিচিত এবং এ ছবিতেই তাদের প্রথম অভিনয় ও আত্মপ্রকাশঃ রাধামোহন ভট্টাচার্য ও বিনতা রায়। এ ছবির আর একটি অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য ছিল, সবগুলো গানই ছিল রবীন্দ্র সংগীতঃ ‘বসন্তে ফুল গাঁথলো, আমার জয়ের মালা’, ‘ঐ মালতী লতা দোলে’, ‘চাঁদের হাঁসির বাধ ভেঙেছে’, ‘তোমার বাঁধন খুলতে লাগে, বেদন কী যে’ ইত্যাদি।
১৯৪৩ সনের আগষ্ট-সেপ্টেম্বরে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত কিছু বলার আগে - অনেকটা “শানে-নজহুলের” মত – তদানীন্তন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে দু’চারটি কথা না বললেই নয়।
১৯৪২ সনে জাপান কলকাতায় প্রথম বোমা ফেলে এবং কাজে কাজেই দেশ রক্ষার তাবৎ জোরালো কর্মকাণ্ড শুরু হয় দেশের সর্বত্র। ওদিকে, বাজার দরের অকল্পনীয় উর্দ্ধগতি। ১৯৪২ সনের জানুয়ারি মাসে চালের মণ ছিল আড়াই টাকা থেকে তিন টাকা। তিন মাসের মধ্যে, এপ্রিলে, চালের মণ ৮ টাকায় উঠলে সব্বাই মাথায় হাত দিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় – যাদের রাখী কারবার ছিল, সবাই গুদামের চাল সব বিক্রী করে অনেক লাভ করে মহা খুশী; কিন্তু, জানতেন না সামনে আরও কী আছে। ১৯৪৩ এর মাঝামাঝি সেই চালের দাম হয় মণ প্রতি ৫০ টাকা – মাত্র ১৮ মাসে বিশ গুণ (শতকরা ২০০০ভাগ) বৃদ্ধি! সারা বাংলায় চরম দুর্ভিক্ষ – ১৯৪৩ সালের প্রলয়ঙ্করী মন্বন্তর, যখন মানুষ কাক-কুকুরের সাথে একত্রে ডাষ্টবিন থেকে খাবার খুঁজে খেত। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সে সব দৃশ্য চিরস্থায়ী করে রেখেছেন তাঁর তুলির অমূল্য আঁচড়ে; এবং প্রথমতঃ এ বাবদেই তিনি বিখ্যাত হন কারুশিল্পী হিসেবে। যখন ভিক্ষুকদের আকুল আকুতি ছিল ‘ভাতের’ জন্য না, শুধু ‘একটু ফ্যান” এর জন্য - ‘ভাত’ না চেয়ে ‘ফ্যানে’র এর জন্য আর্তনাদ করত ওরা। তখনকার ‘বার্মার পথে’ নামের ছায়াছবিতে একটি গান ছিল, “মরণ শিয়রে দলাদলি করে, কেমনে বাঁচিবি বল/সোনার ভারত হল শ্মশান, এক সাথে সব চল”। এই দুর্ভিক্ষের নেপথ্যে ব্রিটিশদের কলঙ্ক-কাহিনীকে কেন্দ্র করেই গবেষণা করেন বাঙালি অমর্ত্য সেন এবং জয় করেন অর্থনীতিতে ‘নোবেল পুরস্কার’।
এই পরিপ্রেক্ষিত ও পারিপার্শ্বিকতায় তৈরি হয় আমার চিরস্মরণীয় ছায়াছবি, ‘উদয়ের পথে’ যার নামকরণও হয় রবি ঠাকুরের কবিতার একটু অংশ বিশেষ নিয়ে! এ ছায়াছবির বিমলিন, কিশোর-মনে-দাগ-কাটা কিছু ঘটনা্ – বিশেষ করে অসাধারণ সংলাপ (যতটুকু মনে পড়ে) -- সবার সাথে যৎকিঞ্চিৎ ভাগ করে নেয়ার একটা সদিচ্ছা সংবরণ করতে পারছিনাঃ
- অনুপ (রাধামোহন ভট্টাচার্য) ও বোন সুমিতা (আসল নাম মনে নেই) একটি ছোট ভাড়া বাড়িতে থাকেন। অনুপ লেখক, সুমিতা কলেজ ছাত্রী। বাড়িটার দরোজার ঠিক উপরটায়, দেয়ালে লেখাঃ “উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই, ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান, ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই!”পরের দিন থেকে কাজ শুরু। মনিব-নেতার জনসংযোগের সব রকমের পত্রালাপ ও গুরুত্বপূর্ণ সভা সমিতিতে প্রদেয় সারগর্ভ বক্তৃতা লেখাই অনুপের প্রধান কাজ। চমৎকারভাবে কাজ-কর্ম চলছে। অনুপের উঁচু মানের কাজে, মনিব, বারীনবাবু যারপরনাই পরিতুষ্ট। কয়েক দিন পরে ঘটে যায় একটা অঘটন – হ্যাঁ, অঘটনই বলতে হয়। বারীনবাবুর বিরাট বাড়ির এক অলিন্দে হঠাৎ অনুপের সাথে দেখা হয়ে যায় গোপা চৌধুরীর সাথে – গোপা, যিনি সুমিতার বন্ধু এবং যার ভাইয়ের মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে অনুপের বোন সুমিতা অপমানিত হয়েছিল। অনুপ গোপাকে বোনের বন্ধু হিসেবে চিনলেও আর কোন পরিচয় তার জানা ছিল না । এখানে তাকে দেখেই অনুপ জানতে চাইলেন, ‘আপনি এখানে?’ জবাব, ‘কারণ, এটাই আমার বাড়ি’। ‘ও, আচ্ছা! আর বারীনবাবু?’ জবাব, ‘আমার দাদা’। এ কথা শুনে, তাঁর মনে পড়ে যায়, এ বাড়িতেই বোন সুমিতার অপমানিত হবার ঘটনা, রক্ত চেপে যায় মাথায়; আর সাথে সাথে অফিস ঘরে ঢুকেই চাকুরিতে ইস্তফাপত্র লিখে মনিবের সামনে হাজির। মালিক অনেক বুঝাতে চেষ্টা করেন, বলেন, ‘দেখুন, দেশের এই দুর্দিনে এমন চাকুরিটা হঠাৎ ছেড়ে দেবেন, এটা কি ঠিক হবে? একটু ভেবে দেখুন!’ অনুপের এক কথা, যে বাড়িতে তাঁর বোন অপমানিত হয়েছে সেখানে তাঁর চাকুরি করা সম্ভব নয়। এসব কথা দূর থেকে শুনছিল গোপাও; একটু এগিয়ে এসে বলল, ‘অত তোষামোদির কী দরকার, দাদা? যেতেই চায় যখন, যেতে দাও ওঁকে; টাকা ছড়ালে অমন লোক ঢের পাওয়া যাবে।’ অনুপের জবাব, ‘ভুল করলেন, গোপা দেবী! শাড়ি, গাড়ি, কেরাণির মত এ বস্তু টাকায় মিলেনা’। ‘ভারী অহঙ্কারী তো আপনি!’ যোগ করলেন বারীনবাবু। চটপট জবাব অনুপের, ‘চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই অহঙ্কারী – কেউ প্রকাশ্যে, কেউ প্রচ্ছন্নে’। অনুপকে রাখা গেলনা, চলেই গেলেন তিনি। ওদিকে অনেক বড় এক সভায় বারীনবাবুকে ভাষণ দিতে হবে আসছে সপ্তাহে; কিন্তু শত চেষ্টায়ও ভাষণ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছেনা; দৃঢ় ইচ্ছা ও একাগ্রতা নিয়ে বহুবার বসেও, পাতার পর পাতা দু’এক লাইন লিখে লিখে ছিঁড়ে ফেলেন, ভরে যায় বর্জ্য কাগজের ঝুড়িটা। অস্থির হয়ে উঠেন বারীনবাবু, পড়লেন বোনকে নিয়ে; শাসান তাকে, ‘এর মধ্যে তুই কেন মাথা গলাতে এলি? পারবি তুই এই লোকটিকে ফিরিয়ে আনতে?’ তো, ‘আচ্ছা, দেখি’ বলে জীবন পণ করে বেরিয়ে গেল গোপা; এবং ক্ষমা চেয়ে, সুমিতার সাহায্য নিয়ে ও বহু কাকুতি-মিনতি করে অবশেষে সক্ষম হয় অনুপকে ফিরিয়ে আনতে। যথারীতি আগের মতই কাজকর্ম চলতে থাকে।- অনুপ বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ালে, বোন দেখে তার পাঞ্জাবীর পিছনটা বেশ খানিকটা ছেঁড়া। সুমিতা সুই-সূতা নিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও, দাদা, তোমার জামাটা একটু ঠিক করে দেই’। মুচকি হেসে অনুপ বলল, ‘সুইএর মতো এত ছোট যন্ত্র দিয়ে দারিদ্র্যের মতো বিরাট শত্রুর সাথে যুদ্ধ করবি?’
- অনেক বড়লোক বান্ধবীর ভাইয়ের মেয়ের জন্মদিনে সুমিতা আমন্ত্রিত। মূল্যবান উপহার দেবার সামর্থ্য নাই; ছোট একটি রুমালে খুব সুন্দর সূচিকার্যে ‘সুমিতা পিসির স্নেহ উপহার’ লিখে নিয়ে যাচ্ছে দেখে অনুপ বলল, ‘ওরা দেখবে, কোনটার কত দাম!’ এখানে বলে রাখা ভাল যে, জন্মদিন উৎসবে তার পোষাক-আশাক ও উপহার নিয়ে ওকে বেশ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল।
- লেখা-লেখি করে দুজনার সংসার চালায় অনুপ – বাড়ি ভাড়াটা নিয়মিত দেয়া হয় না। একদিন ভোর পাঁচটায় দরোজার কড়া নাড়ায় সচকিত হ’য়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে দুয়ার খুলতেই, আকর্ণ হাসি বিস্তার করে, বাড়িওয়ালা (সে কালের বিখ্যাত কমেডিয়ান, তূলসী চক্রবর্তী) বলেন, ‘আরে, কী করে যে আপনারা সব জোয়ান মানুষেরা সকাল বেলা এতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকেন, বুঝেই উঠতে পারিনা; আমি তো মশাই, ভোর বেলা উঠে একটু প্রাতঃভ্রমণ না করলে কোন স্বস্তিই পাইনা।’ অনুপের জবাব, ‘এটা এমন কোন জরুরী খবর না যে, কাউকে সকালের ঘুম ভাঙ্গিয়ে জানাতে হবে!’ রেগে-মেগে মালিক বললেন, ‘ও, শুধু তাই বুঝি? ভাড়াটা তো সেই কবে থেকে দিচ্ছি-দেব করে আর দেয়ার নাম নেই!’ তো, অনুপের উত্তর, ‘আজই দিয়ে দেব’খন’।
- সারা দিন ঘোরা-ঘুরি করে অতি কষ্টে টাকা যোগাড় করে, ভাড়া দিতে গেল রাত তিনটায়! দরোজায় ধাক্কা শুনে ভীষণ সন্ত্রস্ত ও ইতস্তত মালিক - খুলবে কি খুলবে না দরজা। মশারী থেকে একটু বের হয়, আবার ঢুকে যায় ভেতরে (দৃশ্যটা এখনও যেন চোখের সামনে ভাসছে)। শেষমেষ বের হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কে’ এবং জবাবে ‘আমি’ শুনে আবার বলেন, ‘সবাই তো আমি! আমিটা কে?’ ওদিক থেকে ‘অনুপ’ বলায় দরজা খুললে, অনুপ টাকা হাতে দিয়ে বলেন, ‘নিন ভাড়াটা’। টাকা বুঝে নিয়ে মালিকের প্রশ্নঃ ‘এটা কি ভাড়া দেয়ার সময়?’ তাৎক্ষণিক জবাব, ‘ভোর পাঁচটা কি ভাড়া চাওয়ার সময়?’ ভাড়ার টাকা পেয়ে মনের খুশীতে বাড়িওয়ালা বেশ কিছু ব্যক্তিগত গোপন কথা বলে ফেলেন ভাড়াটে অনুপকেঃ ‘আসলে কি জানেন, মশাই, বেশ কিছু চাল গোপনে গুদামজাত করে রেখেছি। তাই খুব ভয়ে ভয়ে থাকি; কখন কী হয় – বুঝতেই তো পারছেন দেশের অবস্থা!’ অনুপ বললেন, ‘তাই নাকি? আমি বলছি কী, ঐ চাল কিছুতেই বাজারে ছাড়বেন না’। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন, ‘কেন? দাম আরও বাড়বে বলে মনে হয়? কিছু শুনেছেন নাকি?’ অনুপ বললেন, ‘না, না, আমার ঘটে কি অত সব ব্যবসায়ী বুদ্ধি বা খবর আছে? তবে, আপনারা এ ভাবে চাল গুদামজাত করে রেখেছেন বলেই না উচ্ছৃংখল বাঙালির জীবনে শৃংখলা আসছে, তাঁরা ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়াতে শিখছে!’ মালিকের ‘ও, আপনি আমার সাথে রসিকতা করছেন!’ এর প্রত্যুত্তর, ‘এত বড় রসিকতার বিষয়, আর রসিকতা করবনা?’
- বিজ্ঞাপন দেখে চাকুরির দরখাস্ত করে, সাক্ষাৎকারের চিঠি পেলেন অনুপ। যথাসময়ে সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারদায়ক, হবু মনিব, একাধারে অনেক বড় শিল্প ও সমাজপতি। (কর্তার নামটা ঠিক মনে পড়ছে না – সুবিধের জন্য ওঁকে ‘বারীন চৌধুরী’ বলে উল্লেখ করব।) ওঁর প্রথম প্রশ্নঃ নাম কী? জবাব, ‘ওখানেই লিখা আছে, শ্রী অনুপ চন্দ্র লেখক’! প্রশ্নঃ ‘লেখক’ বলে কোন পদবী আছে জানতামনা তো!’ উত্তরঃ ‘পাঠক’ বলে পদবী থাকতে পারলে, লেখকে অসুবিধাটা কোথায়? প্রশ্নঃ কী করা হয়? উত্তরঃ পদবী থেকেই বুঝা যাবে, লিখে খাই। প্রশ্নঃ নামের পিছনে অত বড় করে ‘শ্রী’ লেখারও কোন তাৎপর্য আছে নাকি? উত্তরঃ ‘নিশ্চয়ই আছে, আমাদের জীবনে তো কোথাও ‘শ্রী’ নেই, আছে শুধু ঐ নামের পিছনে। তাই ওটা বড় করে লিখি এবং জোর করে উচ্চারণ করি’। অতঃপর খুশী হয়ে, সাক্ষাৎকারদায়কঃ ‘কুনগ্রাচুলেশন্স! আগামী কালই জয়েন করেন’। অনুপের প্রশ্নঃ ‘একটি নিয়োগপত্র পাব তো’? প্রশ্নঃ ‘ও, আপনি বুঝি ইংরেজি বলেননা’? জবাবঃ ‘বলবনা কেন? তবে, ইংরেজি ও বাংলা দুটোই জানি বলে, একটির সাথে আরেকটি মেশানোর প্রয়োজন বোধ করিনা’।
ওদিকে গোপা মনে মনে অনুপের প্রতি বেশ অনুরাগী হলেও, বাহ্য দৃষ্টিতে, আচারে-ব্যবহারে বেশ একটু বৈরী বৈরী ভাব। একদিন দূর থেকে গোপার পিয়ানো বাজিয়ে গাওয়া ‘ঐ মালতী লতা দোলে…’ গানটি শুনে, হাততালি দিয়ে স্বতঃস্ফুর্ত প্রশংসা করেন অনুপ; আর ‘আপনার প্রশংসা শুনার মত সময় নাই আমার’ বলে তা প্রত্যাখ্যান করে গোপা। সময়ের সাথে ক্রমে ক্রমে অবস্থার পরিবর্তন হলে, এক চাঁদনী রাতে দু’জন বের হয়েছে, গেল এক ফুলের বাগানে - বলা যেতে পারে অভিসারে। গোপা বলল, ‘কী চমৎকার, ইচ্ছে হয় যেন ওই সুদূরে স্বপ্নের দেশে চলে যাই’! অনুপের ফোড়ন কাটা, ‘হতভাগা পা দুটো কি তা পেরে উঠবে?’ একটু পরে অনুপের উক্তি, ‘স্থান ও কাল দুটোই কিন্তু গানের জন্য খুব যথাযথ’। ‘শুনবেন গান?’ বলেই, গোপা গাইল, ‘চাঁদের হাঁসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো, ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা…ঢালো’। অনুপ একেবারে চুপচাপ! তো, গোপার মন্তব্য, ‘কই, কেমন লাগল, বললেন না তো!’ ‘সে কথা অনেক আগেই বলেছিলাম, যদিও আমার প্রশংসা শুনার মত সময় তখন আপনার ছিলনা’ বললেন অনুপ।
গল্প চলতে থাকে তার নিজ গতিতে। যেমন নিয়মমত চলছে অনুপের কাজ এবং গোপার লেখাপড়া, তেমনি অবধারিতভাবে সম্পর্ক এগিয়ে চলে রাগ থেকে অনুরাগে, অনুরাগ থেকে পূর্বরাগে এবং শেষমেষ গভীর প্রেমের দিকে। কাজ ও লেখাপড়ার বাইরে দু’জন একান্ত আপন হয়ে পড়ে পরস্পরের সাথে।
ওদিকে, বারীনবাবুর শিল্প-কারখানায় দাবী-দাওয়া নিয়ে শুরু হয় শ্রমিক আন্দোলন এবং শিল্পপতি বারীনবাবুর একান্ত নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত কর্মচারী হয়েও, যুক্তিযুক্ত কারণে অনুপ তাঁর পূর্ণ সমর্থন দেন শ্রমিকদের ন্যায্য দাবীর পক্ষে এবং নিজ মনিবের বিরূদ্ধে। উভয় সঙ্কটে গোপা – ভাই না প্রেমিক? শেষের দিকে শ্রমিকদের শোভাযাত্রায় কর্তৃপক্ষের সশস্ত্র হামলা ও সহিংসতায় আহত অনুপ ভুলুন্ঠিত হয়ে যখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, ক্ষিপ্র গতিতে সেখানে হাজির গোপা – মুখে একটি মাত্র কথা, ‘অনুপ, এই দেখ, আমি সব কিছু ফেলে নেমে এসেছি’। অতি কষ্টে উঠে, অনুপ বলেন, “না, ‘নেমে আসনি’; বল, ‘উঠে এসেছি’”।
এবং, এখানেই কাহিনীর শেষ।
পরবর্তীতে বাংলা, হিন্দি, ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ অনেক ভাল ভাল ছায়াছবি দেখেছি; কিন্তু সেই বয়োঃসন্ধিক্ষণে দেখা ‘উদয়ের পথে’ ছায়াছবিটা আমার মনে গভীর ভাবে দাগ কেটেছিল, যা কোন দিন মুছে যাবার নয়!
পাদটীকাঃ ছবিটি বহুবার দেখার ৩০ বছর পরে, নভেম্বর ১৯৭৩ সনে, সুযোগ হয়েছিল শ্রীযুক্ত রাধামোহন ভট্টাচার্যের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবার – কলকাতায় ওনার ‘ওল্ড ডগ রেস কোর্স’ এর সরকারি ফ্লাটে, যেখানে, একই বিল্ডিংয়ে অন্য ফ্লাটে থাকতো বরিশালের আমার বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী (প্রয়াত) সত্যরঞ্জন সেন গুপ্ত।