টুপুর ভীষণ লাজুক। এমনিতে সে ভালই মেয়ে। মা বাবার কথা শোনে। মন দিয়ে পড়াশোনা করে কিন্তু বাইরের লোক দেখলেই ওর লজ্জার আর সীমা থাকে না! ক্লাসের টিচাররা ওকে কিছু বললে বা জিজ্ঞেস করলে সে লজ্জায় লাল হয়ে যায়! পেরেন্ট টিচার মিটিং হলেই টিচাররা মা বাবার কাছে অনুযোগ করেন, “অত লাজুক হলে চলবে কেন?”
মা সেই সব শুনে টুপুরকে বকেন, “তুমি কি রকম বল তো! আজকালকার দিনে ওই রকম হলে চলে? স্মার্ট, ড্যাশিং পুশিং না হলে জীবনে কিছুই করতে পারবে না, বুঝেছ? অত লজ্জা কিসের? কে তোমাকে কি বলবে? আর লজ্জা করলে নিজেরই ক্ষতি! সেদিন মলি আন্টি যখন জিজ্ঞেস করল ‘টুপুর ললিপপ নেবে?’ তখন তুমি লজ্জায় কিছু বলতেই পারলে না আর আন্টি মনে করল তোমার বুঝি ললিপপ পছন্দ নয় তাই আর তোমাকে দিল না! ক্লাসে টিচার প্রশ্ন করলে উত্তর জানা থাকলেও তুমি হাত তোল না! আচ্ছা সমস্যায় পড়া গেল তো তোমাকে নিয়ে!”
টুপুর শুধুই চুপ করে শোনে, কিছুই বলে না!
সেদিন মা সকালে টুপুরকে বললেন, “আমি স্নান করতে যাচ্ছি। বেলা মাসি আসবে পুজোর জন্যে ফুল তুলতে তখন গেটের তালাটা খুলে দিও কেমন? আর মাসিকে বোলো মা বলেছে যত খুশি ফুল নিতে পারেন, বুঝেছ?”
টুপুর ঘাড় নাড়ছে দেখে মা বললেন, “দেখো বাপু আবার লজ্জা পেও না যেন!”
টুপুর বলল বটে না কিন্তু হল ঠিক তাই! বেলা মাসি ঝাঁপি নিয়ে ফুল তুলতে এসেই এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে শুরু করে দিলেন। মাসি ওদের তিনটে বাড়ি পরে যে অ্যাপার্টমেন্টগুলো আছে সেখানে থাকেন। আসতে যেতে সব সময় দেখা হয় তাও টুপুরের লজ্জা কাটে না! সে কোন রকমে গেটের তালা খুলে দিয়েই ভিতরে পালাল। বেলা মাসি ফুল তুলে চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যখন টুপুর গেটের তালা বন্ধ করতে গেল ততক্ষণে একটা গরু ঢুকে বাগানের বেশ কিছু গাছ মুড়িয়ে দিয়েছে! সেই নিয়ে মার কাছে আবার জোর এক চোট বকুনি খেল টুপুর।
বড় জ্যেঠু তো ওকে ‘লাজুকলতা’ বলেই ডাকেন! তাতে অবশ্য টুপুর কিছু মনে করে না, ফিক ফিক করে হাসে!
মা ভাল গান জানেন। টুপুরকেও শিখিয়েছেন কিন্তু টুপুর কিছুতেই পুজোর ফাংশানে বা অন্য কারো সামনে গাইবে না!
এই ভাবে লজ্জায় ডুবে ডুবে কাটছিল টুপুরের দিন।
ওর স্কুলটা বাড়ির কাছেই। পাশের বাড়ির পিঙ্কাদিদির সাথে হেঁটে স্কুলে আসা যাওয়া করে টুপুর।
সেদিন স্কুলে যাওয়ার পথে পিঙ্কাদিদি ওকে বলল, “আমাকে আজ বিকেলে লাইব্রেরি হয়ে ফিরতে হবে। তুই একা একা বাড়ি যেতে পারবি তো?”
টুপুর বলল, “হ্যাঁ।”
স্কুলের ছুটির পর কিছুটা পথ এসে টুপুরের খেয়াল হল যে জলের বোতলটা ক্লাসেই ফেলে এসেছে। ছুট ছুট আবার স্কুলে ফিরে ক্লাস থেকে বোতলটা নিয়ে এল সে। ততক্ষণে স্কুল প্রায় অর্ধেক ফাঁকা হয়ে গেছে। গেটের কাছে সুমেধা দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির অপেক্ষায়। সুমেধা টুপুরের ক্লাসেই পড়ে, ওর ভাল বন্ধু। ওকে দেখে বলল, “এই তুই চকোলেট খাবি?এই নে!” বলে বেশ কয়েকটা চকোলেট ধরিয়ে দিল টুপুরের হাতে। ঠিক তক্ষুনি সুমেধার গাড়ি এসে গেল বলে ‘বাই বাই’ করে চলে গেল সে।
টুপুর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটা চকোলেট খেল। এ মা! হাতটা চ্যাটচ্যাটে হয়ে গেছে, না ধুলেই নয়! মিনিট পনের দেরি হলে মা কিছু চিন্তা করবেন না। ওই রকম দেরি পিঙ্কাদিদির সাথে গেলে রোজ হয়। এক পাল বন্ধু তার। সবার সাথে বাই বাই করে প্রাণের কথা শেষ করে যেতে সময় লাগবে না?
বাথরুমে ঢুকে কলের কাছে দাঁড়িয়ে ভাল করে হাত ধুল টুপুর। ইউনিফর্মে চকোলেটের ছোপ লেগে গেলে আর রক্ষে নেই, মা ভীষণ রাগ করবেন! হঠাৎ ও পাশের বাথরুমের দরজাটা খুলে শ্বেতাদিদি বেরিয়ে এল। শ্বেতাদিদিকে খুব ভাল লাগে টুপুরের। ওদের ব্লু হাউসের ক্যাপ্টেন সে। দারুণ ভাল গান গায় আর অভিনয় করতে পারে।
টুপুরকে দেখে সে বলল, “আরে এত দেরিতে এখানে কি করছিস? বাড়ি যাবি না? তুই তো পল্লবিকার সাথে যাস তাই না?”
পল্লবিকা পিঙ্কাদিদির ভাল নাম। টুপুর মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। ঠিক তক্ষুনি ভয়ানক একটা কান্ড ঘটে গেল।
মাটিতে জল পড়ে ছিল। সেই জলে পা পিছলে শ্বেতাদিদি পড়ে গেল। শুধু তাই নয়, বেসিনের কানায় মাথা লেগে মাথা ফেটে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগল। টুপুর ভয়ে একসা হয়ে দেখল যে শ্বেতাদিদি পড়ে গিয়ে চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে গেল! এদিকে মাথার ক্ষত থেকে রক্ত বেরিয়েই চলেছে! হায় ভগবান! এবার কি করবে টুপুর? সুমেধাটা থাকলে ভাল হত। সুমেধা খুব স্মার্ট মেয়ে, সে গটগট করে টিচারদের স্টাফ রুমে বা প্রিন্সিপালের অফিসে গিয়ে সব কিছু অনায়াসেই বলতে পারত। কিন্তু ওই সব ভাবার তো সময় নেই, এখন যা করার টুপুরকেই করতে হবে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে টিচারদের স্টাফরুমের দিকে গেল টুপুর। নাহ, অনেকেই রয়েছে, বেশি প্রশ্ন হবে, সেটা ঠিক চলবে না ভেবে টুপুর প্রিন্সিপালের ঘরের দিকে চলল। ওখানে যদি উনি একা থাকেন তাহলে ওনাকে বলা যেতে পারে। প্রিন্সিপালের ঘরের সামনের ঘরটায় উঁকি মেরে দেখল সে। কেউ নেই, মন্দিরাদি, মানে যিনি ওখানে বসেন তিনি বাড়ি চলে গেছেন মনে হয়।
ঢোঁক গিলে নিজেকে তৈরি করে প্রিন্সিপালের অফিসের দরজায় আস্তে আস্তে টোকা দিল টুপুর।
ভিতর থেকে শোনা গেল, “দরজা খোলা আছে। ভিতরে এসো!”
ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকল টুপুর।
“কি চাই?” ওকে দেখে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কপালে ভাঁজ পড়ল।
“আমি চকোলেট খেয়ে বাথরুমে হাত ধুতে গিয়েছিলাম। শ্বেতাদিদিও সেখানেই ছিল। সে জলে পা পিছলে পড়ে গেছে...রক্ত বেরচ্ছে...অজ্ঞান হয়ে গেছে!” এক নিশ্বাসে সব কথা বলে থামল টুপুর।
“সে কি! কোন বাথরুমে? চলো তো দেখি আমার সঙ্গে!”
তড়িঘড়ি টিচারদের স্টাফরুম থেকে টিচারদের নিয়ে বাথরুমে গেলেন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম। শ্বেতাদিদি তখনও মেঝেতেই পড়ে রয়েছে! সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই টুপুর সুযোগ বুঝে সেখান থেকে দিল ছুট! আর থাকে ওখানে!
ছুট ছুট ছুট – এক ছুটে একেবারে বাড়ি!
মা ওকে দেখে বললেন, “কি হল? অত হাঁপাচ্ছ কেন? ছুটতে ছুটতে এসেছ বুঝি? পিঙ্কার সাথে আসনি?”
“পিঙ্কাদিদি লাইব্রেরিতে গেছে।“
“ও, তাহলে তো তোমার এত দেরি হওয়ার কথা নয়!”
“প্রথমে জলের বোতল ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর সুমেধা চকোলেট খেতে দিয়েছিল সেটা খেয়ে হাত ধুতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।”
মা একটু সন্দেহের চোখে ওর দিকে তাকালেন কিন্তু আর কিছু বললেন না।
শ্বেতাদিদির ঘটনাটা কাউকে বলল না টুপুর, এমনকি প্রাণের বন্ধু সুমেধাকেও না! এদিকে শ্বেতাদিদি স্কুলে আসছে না ঘটনাটার পর চারদিন হয়ে গেছে তাও! ওর জন্যে ভারি চিন্তা হচ্ছে টুপুরের।
পাঁচদিনের দিন বিকেলবেলা সন্ধ্যেবেলা টুপুর বসে হোমওয়ার্ক করছিল এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামল ওদের বাড়ির সামনে। বাবা সবে অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে বসেছেন এমন সময় দরজায় বেল! বাবাই গেলেন দরজা খুলতে আর টুপুর উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করতে লাগল কে এসেছে। কে একজন অপরিচিত ভদ্রলোক! আরে ভদ্রলোকের সাথে ওটা কে? শ্বেতাদিদি না?
মাথায় ইয়া বড় ব্যান্ডেজ কিন্তু শ্বেতাদিদিকে চিনতে ভুল হল না টুপুরের। তাহলে ওই ভদ্রলোক মনে হয় শ্বেতাদিদির বাবা। টুপুরের মা বাবাকে কি সব জানি বলছেন! বাইরের ঘরে এসে বসলেন ওরা, মানে শ্বেতাদিদি আর ওর মা-বাবা।
একটু পরেই বাবা ডাকলেন, “টুপুর, এঘরে এসো!”
আর কোন উপায় নেই দেখে টুপুর ধীর পায়ে বাইরের ঘরে গিয়ে ঢুকল।
ও ঘরে ঢুকতেই শ্বেতাদিদি দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল, বলল, “সেদিন তুই না থাকলে আমার যে কি হত কে জানে!”
শ্বেতাদিদির মা বাবারাও ওকে সস্নেহে কাছে টেনে নিলেন। কত গাদা গাদা উপহার এনেছেন ওনারা। মা বাবার জন্যে মিষ্টি, টুপুরের জন্যে বই, খেলনা কত কি! সেই সব দেখে আর শ্বেতাদিদির কথায় একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল! টুপুর লজ্জা পেতে ভুলে গেল!
শ্বেতাদিদিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি ভাল হয়ে উঠেছ দেখে আমার কি আনন্দই না হচ্ছে!”
পরদিন স্কুলে এল শ্বেতাদিদি। প্রার্থনার সময় প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সবার সামনে টুপুরকে ডেকে ওর প্রশংসা করলেন। ওকে স্কুলের তরফ থেকে পুরস্কার দেওয়া হবে সেটাও ঘোষণা করলেন।
আশ্চর্যের ব্যাপার টুপুর কিন্তু এবার একটুও লজ্জা পেল না! এক ঘর ভর্তি লোকের সামনে আত্মবিশ্বাসের সাথে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার যা করা উচিত ছিল আমি শুধু তাই করেছি। শ্বেতাদিদি যে সেরে উঠেছে সেটাই আমার কাছে সব চেয়ে বড় পুরস্কার!”