আইডিয়াটা গোগলের মাথায় বায়োলজি পরীক্ষার পড়া তৈরি করতে করতে এলো। আসলে গোগলের তখন পড়তে একটুও ইচ্ছা করছিল না – এদিকে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের ওয়ান ডে ম্যাচ চলছে আর ওকে কিনা বসে বসে পড়া মুখস্থ করতে হবে? পরের দিনই পরীক্ষা বলে মা ওকে কিছুতেই টিভি দেখতে দেবে না। পড়তে পড়তে গোগলের মনে হল ওর যদি একটা ডুপ্লিকেট ক্লোন থাকত তাহলে বেশ ভাল হত। যত সব আজে বাজে কাজ – পড়াশোনা করা, ঘর গোছান, মুদির দোকানে যাওয়া ক্লোনটা করবে আর গোগোলের কাজ হবে টিভিতে খেলা বা অন্য প্রোগ্রাম দেখা, ভালো ভালো সব জিনিস খাওয়া, বেড়াতে যাওয়া এই সব।
ব্যাস আইডিয়াটা মাথায় আসতেই সঙ্গে সঙ্গে মামাকে ফোন করল গোগোল। ওর মামা বৈজ্ঞানিক। মামার সাথে গোগলের খুব ভাব। মামা ফোন ধরতেই গোগোল বলল, “মামা তুমি আমার একটা ক্লোন তৈরি করে দিতে পারবে? টিভিতে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের ওয়ান ডে ম্যাচ চলছে আর আমি কিনা বসে বসে পড়া মুখস্থ করছি – তুমিই বলো মামা কার ভালো লাগে?”
মামা তো সঙ্গে সঙ্গে রাজি, বলল, “গ্রেট আইডিয়া! দাঁড়া এক্ষুনি কাজে লেগে পড়ি। তোর সাথে পরে কথা হবে!”
মামা ফোন রেখে দিল। ডাইজেস্টিভ সিস্টেমের চ্যাপ্টারটা পড়া শেষ হতে না হতেই ফোনটা বেজে উঠল – মামা!
হ্যাঁ মামাই!
মামা বলল, “হয়ে গেছে। তুই তোর কম্পিঊটারটা খুলে দেখ। ডেস্কটপে দেখবি একটা নতুন আইকন রয়েছে, নাম গোগল-টু। ওটাতে ক্লিক করলেই দেখবি তোর ক্লোনটা বেরিয়ে আসবে কম্পিউটার থেকে। দুবার যদি ক্লিক করিস তাহলে সে আবার আইকন হয়ে কম্পিউটারে ঢুকে যাবে। কিরে ঠিক আছে তো?”
গোগল তো একেবারে থ! মামাকে বলল, “এত তাড়াতাড়ি কী করে করলে মামা? আমি তো ভেবেছিলাম ক্লোন তৈরি করতে কম সে কম তিন চার বছর লেগে যাবে! যখন ইলেভেন টুয়েল্ভে উঠব তখন সেটা আমার কাজে লাগবে!”
“আরে আমাদের ল্যাবে ফর্মুলাটা ছিল তাই এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। কিন্তু একটা শর্ত আছে – ক্লোনের কথা কাউকে বলা চলবে না। আর তোদের দুজনকে কেউ যেন একসাথে না দেখতে পায় কখনও, বুঝলি? নম্বর টু-কে কম্পিউটারে ঢুকিয়ে তারপর তুই ঘর থেকে বেরবি, বুঝেছিস? এটা টপ সিক্রেট, জানাজানি হয়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে! ঠিক আছে গুড লাক! দেখ তোর ক্লোনটা কেমন কাজ করছে, তারপর না হয় আমি নিজের জন্যে একটা বানিয়ে নেবো!”
গোগল ফোন ছেড়ে তাড়াতাড়ি কম্পিউটার খুলল। কিছুদিন আগে ওর জন্মদিনে মামাই ওকে এটা কিনে দিয়েছে। কি ভাগ্যিস কম্পিউটারটা ওর পড়ার ঘরেই রাখা থাকে, আর অন্য কেউ তেমন হাত দেয় না। কম্পিউটার অন করতেই গোগোল দেখল বাচ্চা ছেলের ছবি দেওয়া একটা নতুন আইকন ডেস্কটপে এসে বসে রয়েছে। প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে গোগল আইকনটাতে ক্লিক করল। তার আগে অবশ্য ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিতে ভুলল না, মা দেখে ফেললে মুশকিল হবে! চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানির জন্যে গোগল চোখ বন্ধ করে ফেলল – ভাগ্যিস স্পিকারগুলো অন ছিল না, না হলে শব্দ হত নিশ্চয়ই খুব জোরে! চোখ খুলতেই গোগল দেখল ওর সামনে অবিকল আরেকটা গোগল দাঁড়িয়ে রয়েছে! ভীষণ আনন্দ হল গোগলের! মামা যে এত তাড়াতাড়ি এত অসাধারণ কাজটা করে ফেলবে সে ভাবতেই পারেনি!
গোগল-২ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল। গোগল তাকে বলল, “আমি গোগল।”
গোগল-২ বলল, “আমিও গোগল!”
গোগল তাড়াতাড়ি বলল, “আমি তোমাকে জি২ বলে ডাকব, কেমন?”
জি২ শুনে বলল, “সে ঠিক আছে। নামে কিছু এসে যায় না, আগে আমাদের মধ্যে শর্তগুলো আলোচনা হয়ে যাক।”
“শর্ত? কিসের শর্ত?”
“প্রতি ঘন্টা পিছু আইসক্রিম খাওয়া আর সিনেমা দেখার পয়সা দিতে হবে। মাঝে মাঝে হোটেলে খাবার পয়সাও দিতে হবে। আর একবার আমাকে ডাকলে কমসেকম দুঘন্টার আগে ফিরব না। ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে দিতে হবে। ঠিক আছে তো? আচ্ছা, তুমি এখন এখানেই বোসো, আমি একটু ঘুরে আসছি।”
গোগল কিছু বুঝে ওঠার আগেই জি২ ধাঁ করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল! গোগল গুম হয়ে বায়োলজি বই নিয়ে বসে রইল। মামাকে ফোন করার চেষ্টা করল সে কিন্তু লাইন কেবলই এনগেজড।
আধ ঘণ্টা বাদে জি২ ফিরে এসে বলল, “ঠিক আছে আমি পাশের বাড়িতে ক্রিকেট খেলা দেখতে যাচ্ছি। এখানে তো মা টিভি চালাতে দিচ্ছে না তোমার পরীক্ষা বলে।”
“কিন্তু বায়োলজি পরীক্ষার কী হবে?” গোগল মিনমিন করে বলল, “সেই জন্যেই তো তোমাকে ডাকলাম!”
“ও বায়োলজি, টায়োলজি আমি সব জানি! কালকে পরীক্ষা দিতে যেতে হবে তো? ওটা কোনো ব্যাপারই নয়! কিছু না জানলে খালি পেপার জমা দিয়ে দেব – ওসব নম্বর টম্বর নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই!”
শুনে গোগলের তো প্রায় ভিরমি লেগে যাওয়ার জোগাড়! এ তো আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল! গোগল ভয়ে ভয়ে জি২কে জিজ্ঞেস করল, “এবার তুমি কমপিউটারে ফিরে যাবে তো?”
“এখন কেন? এখন তো আমি খেলা দেখতে যাব! আমার শর্ত ছিল না একবার ডাকলে মিনিমাম দুঘন্টা বাইরে থাকতে দিতে হবে। শর্ত ভাঙলে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি!” জি২ শাসাল।
গোগলের গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। সে বেশ ভয় পেয়ে বলল, “একটু জল খেয়ে আসব?”
“ঠিক আছে যাও! এটা ফার্স্ট টাইম তাই যেতে দিচ্ছি! পরের বার জল টল নিয়ে বসবে। আমি যে সময়টা আসব তুমি ঘরেই থাকবে, বুঝলে? নাও, তাড়াতাড়ি ঘুরে এসো, খেলাটা মিস হয়ে যাচ্ছে!”
গোগল ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গেল। মাও তক্ষুনি রান্নাঘরে ঢুকল। গোগলকে দেখে বলল, “কি হল? এখানে কী করছ? পড়ায় মন নেই বুঝি?” বলতে বলতে মা আঁতকে উঠে ‘ও মা’ বলে চিৎকার করে উঠল।
গোগল চমকে উঠে বলল, “কী হয়েছে?”
মা রেগে-মেগে বলল, “কী হয়েছে! বদমাশ ছেলে! তুমি জানো না কী হয়েছে?” বলে মা দুটো খালি পাত্র হাতে নিয়ে রাগে ফেটে পড়ল, “রাতে পানুকাকু খেতে আসবে বলে চিলি চিকেন বানিয়েছিলাম আর কালকেই বাবা অতগুলো মিষ্টি আনল তুমি সেই সব খেয়ে ফেললে? খিদে পেলে অন্য কিছু খেতে পারতে – আমি তো ছাদে কাপড় তুলছিলাম আমাকে জিজ্ঞেসও করলে না! কী বেয়াক্কেলে ছেলে হয়েছে রে বাবা! তোমাকে ক্রিকেট খেলা দেখতে দিইনি – টিভি খুলে বসেছিলে তাই বকলাম বলে তুমি এই রকম করলে! অতটা চিকেন আর এতগুলো মিষ্টি – মাগো আমাকে আবার রান্নায় বসতে হবে!”
গোগলের মুখ দিয়ে একটাও কথা বেরচ্ছিল না। জি২ তাহলে টিভি খুলে বসেছিল, মার কাছে বকুনি খেয়ে রান্না ঘরে ঢুকে সব খেয়ে গেছে! কী সাংঘাতিক! গোগলের তো এটা বলারও জো নেই যে আমি করিনি!
রাগে গোগল জল খাওয়া ভুলে ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। ঢুকেই দরজা বন্ধ করে জি২কে বলল, “তোমাকে এক্ষুনি ফিরে যেতে হবে, এখানে তোমার আর থাকা চলবে না! আমি কমপিউটারে ক্লিক করতে যাচ্ছি!” বলে ও চট করে কমপিউটারটার সামনে গিয়ে বসল। জি২ অমনি লাফ দিয়ে ওর কাছে চলে এল!
চিৎকার করে বলল, “বলেছি না দুঘন্টা না হলে আমি ফিরব না! শর্ত ভাঙলে ভয়ঙ্কর কাণ্ড হবে! এবার দেখো কী হয়” বলে জি২ ক্যাঁক করে গোগলের ঘাড়টা ধরে ফেলল, তারপর দুমদুম করে ওর মাথাটা কমপিউটারে ঠুকতে লাগল। গোগল পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে, “না, না ছেড়ে দাও, কমপিউটার ভেঙে যাবে!”
জি২ হাসছে আর বলছে, “সেটাই তো আমার উদ্দেশ্য! তাহলে তো আর আমাকে ওটার মধ্যে ঢুকতে হবে না। মা এত ভাল ভাল সব রান্না করে! সব সময় খাবো!”
ভয়ে গোগল চিৎকার করতে লাগল...
প্রবল ঝাঁকুনিতে গোগলের চোখ খুলে গেল। মা ওর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে! মা-ই ওকে ঝাঁকাচ্ছিল! ও চোখ খুলতেই মা বলল, “পড়ার নাম করে ঘুমোনো হচ্ছে? শুধু তাই নয় স্বপ্ন দেখে আবার গোঁ গোঁ করা হচ্ছে! সারা বিকেলটা ঘুমিয়ে নষ্ট করলে – কাল পরীক্ষায় কী করবে কে জানে! নাও হাত মুখ ধুয়ে খেতে এসো, বাবা আর পানুকাকু এসে গেছেন,” বলে মা চলে গেল।
গোগল ভয়ে ভয়ে কমপিউটারের মাউসটা নাড়িয়ে স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে দেখল। না, কোনো বাড়তি আইকন নেই! তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল – চিলি চিকেন আর মিষ্টি দুটোই রয়েছে – যাক বাবা!
সেদিন গোগল অনেক রাত অবধি বায়োলজি পড়ল। নিজের কাজ বাবা নিজে করাই ভালো!