“লোকগানের চেহারা আর উপাদানের ক্ষেত্রে গোটা বাঙলা জুড়েই সুদীর্ঘ সময় ধরে যে সৃষ্টিধর্মী আদানপ্রদানের ধারা চলে আসছে তার বেশ কিছু উদাহরণ ও বিশ্লেষণ আমি আমার গবেষণাপত্রে রেখেছি। এই ভাষায় ধর্ম, প্রেম ও দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতাসম্পৃক্ত লোকসঙ্গীতের ধারাটি গোটা বাঙলার সংস্কৃতিক্ষেত্রকেই স্পর্শ করে একটি ধীরগতি নদীর মতই প্রবহমান। এবং একটি মহান নদীর মতই তার স্রোতে এসে প্রতিনিয়ত মিশে চলেছে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব পশ্চিমের বিবিধ সুর ও বর্ণের সঙ্গীতধারা, আবার সেই স্রোত থেকেই প্রতিনিয়ত উৎসারিত হয়ে চলেছে নতুন নতুন গীতশৈলি। লোকসঙ্গীত একটা জীবন্ত জিনিস। তা চলেফিরে বেড়ায়। স্থানভেদে বহিরঙ্গের রূপ বদলায় তার। এবারে লোকসঙ্গীতের এই চলনের একটা আকর্ষণীয় উদাহরণ দিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করব। বৈষ্ণব পদাবলীর সেই বিখ্যাত পদটি স্মরণ করুনঃ
সই, কেমনে ধরিব হিয়া ?
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়
আমার আঙ্গিনা দিয়া!
সে বঁধু কালিয়া না চায় ফিরিয়া,
এমতি করিল কে ?
আমার অন্তর যেমন করিছে
তেমনি হউক সে!
বাঙলার পশ্চিমভাগে মালভূমি এলাকার কবি চণ্ডীদাসের এই অমর পদটি বহু শতাব্দি ধরেই রসিক এবং ভক্ত পাঠকের তৃপ্তিবিধান করে এসেছে। ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে সাঁওতাল বিদ্রোহের পর বাংলার মালভূমি এলাকার বহু মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন চারিদিকে। সঙ্গে করে নিয়ে চলেছিলেন তাঁদের ধর্ম, আচার, বিশ্বাসতন্ত্র ও লোকসংস্কৃতির ধারাকে। নতুন নতুন জায়গায় শেকড়বাকড় ছড়িয়ে সেই মাটির রসের সঙ্গে নিজেদের এলাকার সঙ্গীতের ধারাকে মিশিয়ে দিয়ে গড়ে তুলছিলেন নতুন লোকসঙ্গীতের ধারা। এই উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া গানের সঙ্গে তাঁদের সঙ্গীতধারা মিশে গিয়ে ভাওয়াইয়ার প্যাথোসকে মুছে দিয়ে এইভাবেই গড়ে উঠেছিল চটুল চটকা সঙ্গীতের ধারা। আর তার মধ্যেই অন্য রূপে ও রসে নবজন্ম পেয়েছিল চণ্ডীদাসের এই পদটি। এই চটকা গানটা শুনুন। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের রেকর্ড করা গান-
বলতে বলতে টেবিলে রাখা টেপরেকর্ডারটি অন করে দিল শোভন। জলপাইগুড়ি ফোকলোর রিসার্চ ইন্সটিট্যুট তার আজকের পেপার প্রেজেন্টেশানের জন্য নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটির একটা সেমিনার হলকে বেছে নিয়েছে। ইন্সটিট্যুটের নির্বাচক কমিটির প্রধান ডঃ সোনারাম দিউ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মূলত তাঁরই উৎসাহে আজকের অনুষ্ঠানটা সরিয়ে আনা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। শোভনের কাজটা পড়বার পর ডঃ দিউ তাঁর ছাত্রছাত্রীদেরও তার বক্তব্য শোনাতে চেয়েছিলেন।
টেপরেকর্ডার থেকে ঘস ঘস শব্দ উঠছিলো একটা। শোভন একবার উদ্বিগ্ন চোখে সেটার দিকে চেয়ে দেখল। শব্দটা বাড়ছেই। একটু বাদে, সেই ঘস ঘস শব্দের মধ্যে দিয়ে সারিন্দা আর দোতারার মিশ্র সুর উঠে আসতে সে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। চটুল চালের চকিতগমন সুর, পুরোন যন্ত্রের দুর্বলতা সত্ত্বেও তার মায়াজাল ছড়িয়ে চলেছে ঠিকই।
মুখরার বাজনাটা শেষ হয়ে কথা আসবার ঠিক আগের মুহূর্তে হঠাৎ একেবারে থেমে গিয়ে খট করে শব্দ করে প্লে সুইচটা ওপরের দিকে উঠে এল যন্ত্রটার। মাইকওয়ালা ছেলেটা তাড়াতাড়ি এসে টেপরেকর্ডারের ঢাকনাটা সরিয়ে ক্যাসেটটা টেনে বের করে আনবার চেষ্টা করল একবার। কিন্তু তার ফিতে জড়িয়ে গিয়েছে একেবারে। মাথা নেড়ে ছেলেটা বলল, “এ আর এখন হবার নয় সার। বর্ষা তো, ড্যাম্প লেগে গেছে--”
শোভন হতাশ চোখে একবার তাকিয়ে দেখল যন্ত্রটার দিকে। যে গানটা সে শোনাতে চাইছিল এখানে, তার বুলি তার মুখস্থ, কিন্তু এ অঞ্চলের গানের যে বিশিষ্ট উচ্চারণবিধিটি ও স্বরক্ষেপণের বৈশিষ্ট্য রয়েছে সেটি তার অধিগত নয়। একা একা খালি গলায় চেষ্টা করতে গেলে সুরবিকৃতি ঘটতে পারে। মাথাটা নাড়িয়ে সে ফের মাইক্রোফোনের দিকে ফিরতে যাবে তখন মঞ্চে বসা সাবিত্রী বর্মন তাকে ইশারা করে কাছে ডাকলেন।
মানুষটি বয়সে প্রবীণ। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মোটা কাচের চশমা, কাঁচাপাকা চুলে তাঁর চেহারাটি মলিন ঠেকে। এককালে ভাওয়াইয়া আর চটকা নিয়ে অনেক কাজ করেছেন এই এলাকায়। ‘উত্তরবঙ্গ গীতমালা’ নামে এই এলাকার গানের ওপর একটি বিদগ্ধ আকরগ্রন্থও রয়েছে তাঁর। আজকের প্রেজেন্টেশনে বিশেষ অতিথি হিসেবে নিমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে তাঁকে।
“গানটি তুমি কী বাজাতে চাইছিলা তা আমি বুঝতে পেরে গেছি বাপু। তোমার যন্তর যখন ফেল পড়ল , তখন আমিই না হয় শোনাই, কী বল? দাও মাইকটা এগিয়ে দাও দেখি একবার--”
তাঁর কথাগুলো চালু মাইক্রোফোন বেয়ে শ্রোতাদের মধ্যেও গিয়ে পৌঁছেছিলো। সেখান থেকে বেশ কয়েকটি প্রৌঢ় কন্ঠ ভেসে এল একসঙ্গে। “ধরেন সাবিত্রীদিদি—ধরেন—”
কথাবার্তা চলতে চলতেই মাইকওয়ালা ছেলেটি একটা দোতারা এনে ধরিয়ে দিয়ে গেছে সাবিত্রীর হাতে। পরম মমতায় সেটির তারে বয়োজীর্ণ আঙুল দিয়ে মৃদু মৃদু ঘা মারছিলেন তিনি। গাঢ় ও সুমিষ্ট ‘ডোলাডং’ ‘ডোলাডং’ শব্দ উঠছিল তারে। খানিক বাদে ধীরে ধীরে সেই লক্ষ্যহীন সুরখণ্ডগুলি সুনির্দিষ্ট চাল ধরল একটি। একটু আগে টেপরেকর্ডারে ভেসে ওঠা সুরটিরই নিখুঁত অবয়ব নিচ্ছিল তা ক্রমশ। তারপর তার সঙ্গে খাদে বাঁধা সুরে মৃদু কথোপকথন শুরু হল মানুষটির। জরাক্লিষ্ট কন্ঠটি তাঁর বয়সের খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসছে ধীর ধীরে। বয়সের ভারকে অতিক্রম করে তাতে এসে ভর করছে যেন উত্তরবঙ্গের কোন রাজবংশি কিশোরীর বিরহী আত্মাটি। তারপর হঠাৎ আলোচনাসভার পাণ্ডিত্যপূর্ণ গম্ভীর আবহাওয়াটিকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে উঠে এল চড়া সুরের গানটি—
কিসের মোর রান্ধন
কিসের মোর বাড়ন
কিসের মোর হলুদ বাটা
মোর প্রাণনাথ
অন্যের বাড়ি যায়
মোর আঙিনা দিয়া হাঁটা
মালভূমি বাঙলার বিদগ্ধ পরিমণ্ডলে সৃষ্ট চণ্ডীদাসের পদটি সুদূর পথ বেয়ে উত্তরের পাহাড়ি উঠোনে এসে, পরমপুরুষ ও তাঁর হ্লাদিনী শক্তির অতিলৌকিক প্রেমের ঈশ্বরীয় খোলস ছেড়ে একেবারেই দেশজ প্রেমগীতির রূপ ধরেছে। তার শরীরে মানবিক রক্তমাংসের স্পর্শ। শোভনের রক্তে দোলা লাগছিল। পাণ্ডিত্যের মুখোশটি খসে পড়েছে তার। কাঁচাপাকা ভ্রুর তলা থেকে সাবিত্রীর উজ্জ্বল চোখদুটি বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল তাকে। কখন যেন নিজেরই অজ্ঞাতে সে গলা মেলাল তাঁর সঙ্গে—
ও প্রাণ সজনি
কার সঙ্গে কব দুস্কের কথা
আর যদি দ্যাখোং,
আর যদি শোনং
অন্য জনের কথা
এহেন যৈবন সাগরে ভাসাব
পাষাণে ভাঙিব মাথা-
“গানের গলাটি তোমার তো বেশ ভালো বাবা। শিখেছো কার কাছে?” চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সাবিত্রী বর্মন প্রশ্ন করলেন। বিকেল পড়ে এসেছে। প্রশ্নোত্তরপর্বের পর চায়ের আসর ছিল একটা। সেসব পাট চুকে একে একে অতিথিরা বিদায় হয়েছেন। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল তারা। সাবিত্রীও জলপাইগুড়িতেই ফিরবেন। একসঙ্গেই যাবে তারা দুজন।
শোভন মাথা নেড়ে বলল, “বাবা-মায়ের কাছে। আমার বাবা নিজে পদকর্তা ছিলেন।”
“তাই বলো। তার ওপর, তোমার তো দেখলাম বাবা লোকসঙ্গীতের ওপরে অগাধ পড়াশোনা। কেতাবি জ্ঞান জুটিয়েও গানটাকে যে ছাড়োনি সে খুব বড় ব্যাপার। ভালো। তা এই গান নিয়েই পড়ে আছো, নাকি আর কিছু করো টরো?”
শোভন হেসে ফেলল। শিল্পীর আবরণের ভেতর থেকে পরিচিত মা মাসীর মুখটা বের হয়ে আসছে এবার। বলল, “আমি আর আমার বউ মিলে একটা ইশকুল চালাই আমাদের গ্রামে। তাছাড়া এই এখানে সেখানে বলেটলে কিছু রোজগারপাতি হয়। চলে যায় আর কি।”
“বুঝলাম। বউটাকেও পাগল জুটিয়েছ। ভালো। আছো তো কদিন এখানে?”
“দেখি। দিন দু তিন আছি। আজকের কাজটা মিটে গেল, কাল একটু এদিক সেদিক ঘুরে নেব ভাবছি। পরশু ছত্তিশগঢ় ইনস্টিটিউট অফ ফোক কালচার থেকে প্রফেসর মালহি এই ইন্সটিট্যুটে আসছেন তিজ জাগরের গান নিয়ে বলতে। ওঁর সঙ্গে একটা গবেষণাপত্র লিখছি একসঙ্গে। একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে। কিছু প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে নিয়ে তার পরদিন সকালের ট্রেন ধরব।”
“এই দেখো। একেবারে ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছো দেখছি। নতুন জায়গায় এলে। কদিন নাহয় থেকেই গেলে গো। গানের জায়গা আছে অনেক। সেসব দেখিয়ে শুনিয়ে দেবো’খন। বিষহরির গান শুনেছো এই এলাকার?”
“না। এই এলাকায় যাতায়াত বেশি হয় নি তো আগে। তবে মালদায় শুনেছি।”
“থেকে যাও কদিন। কোচবিহার নিয়ে যাবো’খন আসছে সপ্তাহে। সাউদপাড়ায় মদন কোচ-এর বাড়িতে বিষহরির গান শুনে দেখো। মুখা বাঁশির সঙ্গে ও গান একবার শুনলে ভুলবে না।”
শোভন মাথা নাড়ল, “লোভ হচ্ছে খুব, কিন্তু আমার থাকবার উপায় নেই ম্যাডাম।”
সাবিত্রী বর্মন ভুরু কুঁচকে তার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “ওসব ম্যাডাম ট্যাডাম আর নাই বা বললে। আমায় মাসীমা বললেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করব। আমি তোমার মা মাসীর বয়েসিই হবো।”
শোভন একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে মাসীমা। তাই হবে। পরের বার এসে নাহয়-”
“তোমার তাড়াটা কীসের বলো তো? ইশকুলের জন্য? নাকি বউকে একা ফেলে এসেছো—”
“কোনটাই নয় মাসীমা। ইশকুল কয়েকদিন সামলে দেবার মত লোকজন রেখে এসেছি ওদিকে। আর, বউ আমার সঙ্গেই এসেছে। শরীর ভালো নেই তার। একা রেখে আসতে সাহস পাইনি।”
“শরীর ভালো নেই মানে? কী হয়েছে?” বলতে বলতেই শোভনের মুখ দেখে সঠিক ব্যাপারটা বুঝে নিতে অসুবিধে হলনা সংসার-অভিজ্ঞ প্রৌঢ়ার। ভুরু কুঁচকে বললেন, “কিছু মনে করোনা বাবা। কিন্তু এ ভারী বে-আক্কেলে কাজ করেছো। এ অবস্থায় অচেনা অজানা জায়গায় মেয়েমানুষকে এতদূরের পথ এভাবে আনতে হয়?”
শোভনের ভারী অস্বস্তি হচ্ছিল। ফরিদাকে এই অ্যাডভান্স স্টেজে এভাবে সঙ্গে করে আনতে সে একেবারেই চায়নি। কিন্তু ফরিদা কিছুতেই একলা থাকতে রাজি হল না। ওরকম সাহসী, তেজি মেয়েটা কেমন যেন বদলে গেছে হঠাৎ। আসবার কয়েকদিন আগে রাত্রে বলল, “আমি একলা থাকতে পারবো না। পেটের ভেতরে একটা আর হাতে একটা, দুটো বাচ্চাকে নিয়ে আমি একা একা কিছুতেই পারব না গো।”
শোভন একটু ইতস্তত করে বলেছিলো, “ভুবনদাকে বলে দেখি, যদি কটা দিন এখানে এসে থেকে যায়--”
“এতে ভুবনদা এসে কী করবে? বুড়ো মানুষকে শুধু শুধু বিব্রত করা,” বিরক্ত মুখে মাথা নেড়েছিল ফরিদা।
শোভন অসহিষ্ণু গলায় বলেছিলো, “তাহলে কী করতে বলছো? টিকিটটা ক্যানসেল করে দেবো?”
“না। সে তুমি করতে পারবে না,” মাথা নেড়েছিলো ফরিদা, “রেমুনারেশনটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর, কিন্তু তার চেয়েও বড় হল, এক্সপোজারটা। এতদিন ধরে লোকসঙ্গীত নিয়ে যে কাজগুলো করে চলেছো তুমি, এই প্রথম সেটা একটা বড় প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরবার সুযোগ এসেছে। এটাকে তুমি কোন মূল্যেই হাতছাড়া করতে পারো না। তাছাড়া প্রফেসর মালহি আসছেন, আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্টও করে রেখেছো। ওঁর সঙ্গে মিটিংটা মিস করাটা তোমার ঠিক হবে না। শোনো, তুমি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলো। এখানে একা থাকবার বদলে ওতেই আমি বেশি ভালো থাকবো।”
“তুমি, এই অবস্থায় এতটা রাস্তা যেতে পারবে?”
ক্লান্ত গলায় একটু হেসে ফরিদা জবাব দিয়েছিল, “গরিব মুসলমান ঘরের মেয়ে আমি। আমাদের ঘরের মেয়েরা বছর বছর ন’মাসের পেট নিয়েও ঘরে বাইরে দিনে আঠেরো ঘন্টা গতর খাটায়। ও আমাদের রক্তে আছে। তুমি ভেবো না। তিনচারটে দিনের তো মামলা। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। ব্রতীনদার ওখানেই নাহয়--” “ব্রতীন শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে এখন কলকাতায় এসেছে,” মাথা নেড়ে শোভন বলেছিলো, “ফিরবে একেবারে আঠারো তারিখে। আমার সেমিনারের তিনদিন বাদে। ওর বাড়ি তালাবন্ধ এখন। তবে ওতে সমস্যা হবে না। সমাদৃতা আছে--”
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই হঠাৎ তীব্র গলায় ফরিদা বলে উঠেছিলো, “না। সমাদৃতাদির কাছে আমি কিছুতেই এ অবস্থায় গিয়ে উঠতে পারবো না। বলা নেই কওয়া নেই নিজের বোঝা ওর ঘাড়ে নিয়ে ফেলতে তোমার লজ্জা না করতে পারে, আমার করবে। তুমি অন্য ব্যবস্থা করো।”
ফরিদার জেদের সামনে একরকম বাধ্য হয়েই মাথা নোয়াতে হয়েছিল সেদিন শোভনকে। মনস্তত্ত্বের যে গভীর খাদ থেকে অর্থহীন এই বিকর্ষণের বোধ উঠে আসে তার তল পাবার ক্ষমতা শোভনের ছিল না। সে চেষ্টাও সে করে নি। পরদিন গিয়ে ফরিদার জন্যও টিকিট কেটে এনেছিলো একটা। সমাদৃতা বা ব্রতীনকে যাবার কোন খবরও সে দেয় নি। দিলে এভাবে ফরিদাকে নিয়ে অন্য জায়গায় ওঠাটা কঠিন হতে পারত।
এতসব কথা এই স্বল্প পরিচিত মহিলার কাছে খুলে বলা সম্ভব নয়। সে তাই জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। তার পেমেন্টটা এখানেই মিটিয়ে দিয়ে গেছেন সেন্টারের কর্তৃপক্ষ। বুকপকেটের মধ্যে টাকার খামটায় একবার হাত ছুঁইয়ে দেখে নিল সে।
“উঠেছো কোথায়?”
“রুবি বোর্ডিঙ-এ।”
“তাহলে এত তাড়া কীসের? কদিন থেকে ঘুরে ঘেরে নাও। মেয়েটাও একটু বিশ্রাম করে ট্রেনজার্নির ধকলটা কাটিয়ে নিক। রাস্তা তো আর কমটা নয়!”
“সে করলে তো ভালো হত মাসীমা, কিন্তু বড় কাজ পড়ে আছে যে ওদিকে। গত বছর থেকে আমি আমাদের ওখানে একটা লোকসঙ্গীতের মেলা শুরু করেছি কার্তিক মাসে। তার তোড়জোড় শুরু করে এসেছি। হাতে তো আর সময় নেই বেশি! এ যাত্রা তাই তাড়াতাড়িই ফিরতে হবে।”
“গানের মেলা? ভালো। তা এপাশের লোকজনকে ডাকো না নাকি?”
“ডাকি তো। গতবারই তো মাধবী দিউ নামে এক মহিলা ভাওয়াইয়া গেয়ে এলেন!”
“মাধবী, মানে তুফানগঞ্জের মাধবী তো?”
“হ্যাঁ। আপনি চেনেন?”
সাবিত্রী মাথা নেড়ে বললেন, “চিনি মানে? হাতে করে তৈরি করলাম, আর ওকে চিনবো না? গাইল কেমন?”
শোভন হাসল, “বলছেন তো আপনার হাতে তৈরি। তাহলে সে কেমন গাইল সেটা আর জিজ্ঞাসা করছেন কেন? খুব ভালো গায় মেয়েটা। এবারেও দেখি, যদি পাওয়া যায়। আর, মাসীমা, আপনি যদি যেতে পারতেন এবারে--”
“না গো বাবা। এ বয়সে আর অত দৌড়োদৌড়ি ভালো লাগেনা আমার। মাধবী ছাড়াও আমার আরো কয়েকজন ছাত্রছাত্রী আছে এ এলাকায়, তাদের ফোন নম্বরটম্বর দিয়ে দেবো’খন বরং। কথা বলে নিও। ভাওয়াইয়া আর চটকার ভালো কয়েকজন লোক পেয়ে যাবে। টাকাপয়সার খুব একটা আহামরি খাঁইও নেই এদের। ভালো--”
তাঁর কথাটা শেষ হবার আগেই দরজা ঠেলে এক ভদ্রলোক ঢুকে এসে বলেন, “শোভনবাবু, একটু আসবেন একবার। আপনার একজন ভিজিটার আছেন। হেড অব দা ডিপার্টমেন্টের-এর ঘরে অপেক্ষা করছেন।”
“আমার ভিজিটর?” শোভন একটু অবাক হল। ব্রতীন? কিন্তু কী করে হবে? সে তো এখন কলকাতায়। তাছাড়া সকালে জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন থেকে ইনস্টিটিউটের গাড়িতে করে রুবি বোর্ডিঙে পৌঁছে ফরিদা আর সুরভিকে সেখানে রেখে সোজা বেরিয়ে এসেছে। কারো সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগও হয় নি। তাহলে-- চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে সাবিত্রীর দিকে ফিরে বলল, “আপনি একটু বসুন, আমি দেখে আসছি।”
|| ১১ ||
“এই যে উনি এসে গেছেন ম্যাডাম,” শোভনকে দরজা ঠেলে ঢুকতে দেখে ভূষণ আগরওয়ালা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর শোভনের দিকে ফিরে বললেন, “আরে আসুন আসুন স্যার, জলপাইগুড়ি কালেক্টরেটের প্রধান ম্যাডাম যে আপনার এত জানা পরিচিত তা তো ঘুণাক্ষরেও আমাদের জানান নি মশায়। আচ্ছা চাপা লোক তো!” ভদ্রলোকের দরবিগলিত গলা থেকে টের পাওয়া যাচ্ছিল, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর ঘনিষ্ঠতার সুবাদে শোভনের দর তাঁর কাছে এক লাফে বেশ খানিকটা বেড়ে গিয়েছে হঠাৎ করেই। শোভনের সেদিকে মনোযোগ ছিল না। সামনের চেয়ারে বসে থাকা সমাদৃতার দিকে এগিয়ে গিয়ে সে বলল, “মাদ্রি, তুই--”
“অবাক হয়ে গেছিস, না রে? ভেবেছিলি খবরটবর না দিয়ে এসে ঘুরে চলে যাবি, আমি জানতেও পারবো না। ঠিক খবর পেয়ে চলে এসেছি দেখলি? তোর প্রেজেন্টেশনটা শুধু মিস করে গেলাম মধ্যে থেকে।”
শোভন একটু অস্বস্তিভরা গলায় বলল, “তুই--তোকে খবর কে দিল?”
“তুই তো আর দিবি না! সে আশাও আমি করি না। ব্রতীনই গতমাসে বলছিল তোর এদিকে আসবার কথা আছে। ডেট টেট ঠিক জানত না। আজকেই ডি এম সাহেবের ঘরে ইনস্টিটিট্যুটের সেমিনারের নেমন্তন্নের কার্ডটা চোখে পড়ল। দেখি তোর নাম। দুপুরে একটা মিটিং ছিল। আগে থেকে জানলে হয়ত পোস্টপন করা যেত, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটা আর সম্ভব হল না রে। মিটিং শেষ হতে হতে সাড়ে তিনটে বেজে গেল। গাড়ি নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারি চলে এসেছি, কিন্তু ততক্ষণে তোর সেমিনার শেষ—”
“এ হে হে, বড় ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম,” আগরওয়ালা হাত কচলাচ্ছিলেন, “জেনারেলি ইনস্টিটিউটের কোন সেমিনার থাকলে ডি এম সাহেবকে ইনভিটেশান দেয়া হয়ে থাকে। উনি ইনস্টিটিউটের জিবি তে আছেন কিনা! ফোক কালচারে আপনার এতটা আগ্রহ আছে সেটা আমরা আন্দাজ করতে পারিনি। এরপর থেকে, নিশ্চিন্ত থাকুন, ইনস্টিটিউটের যে কোন ফোক সংক্রান্ত সেমিনারে ডি এম এর সাথে সাথে আপনার কাছেও কার্ড পৌঁছে যাবে-এ কী , উঠছেন যে? আপনার চা—”
চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সমাদৃতা বলল, “উঁহু। আজ থাক স্যার। পরের বার এসে চা খাব। এখন তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। অনেকটা পথ যাবার আছে—”
“সাহেবের গাড়ি রেডি আছে স্যার। ওই বুড়ো ম্যাডাম গাড়িতে বসে আছেন। আমায় সাহেবকে ডাকতে বললেন,” দরজা ঠেলে ঢুকে এসে প্রফেসর আগরওয়ালার সামনে দাঁড়ালেন একজন প্রৌঢ়।
“ও হ্যাঁ হ্যাঁ। শোভনবাবু, আপনার গাড়ি তৈরি। এবারে বেরোবেন তো?”
“সমাদৃতা প্রফেসর আগরওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল, “গাড়ি ছেড়ে দিতে বলুন স্যার। শোভনকে আমিই ড্রপ করে দেবো’খন।” তারপর শোভনের দিকে ফিরে ডাকল, “চল আমার সঙ্গে। চা খেয়ে ফিরবি একেবারে।”
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। কাচ তোলা জানালার বাইরে সেদিকে চেয়ে দেখতে দেখতে শোভন প্রশ্ন করল, “কেমন আছিস?”
“ভালো। দিন কেটে যাচ্ছে একরকম কাজকর্ম নিয়ে। তোর কথা বল।”
“উত্তমের--”
“তার কথা এখন থাক শোভন,” উল্টোদিকের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে সমাদৃতা জবাব দিলো। তারপর ফের বলল, “তুই কেমন আছিস তাই বল। ফরিদার শরীর ঠিক আছে তো? একা রেখে চলে এলি যে এভাবে, কোন প্রবলেম হবে না তো?”
জানালার থেকে চোখ ভেতরের দিকে ঘোরালো শোভন। প্রসঙ্গটা সে এড়িয়েই যেতে চেয়েছিল প্রথম থেকে। কিন্তু আর সেটা সম্ভব হবে না।
“ফরিদাকে সঙ্গে করে নিয়েই এসেছি রে। একা ওখানে থেকে যেতে চাইল না কিছুতেই।”
চমকে উঠে তার দিকে ফিরে তাকাল সমাদৃতা, “সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিস-মানে? তোর কাণ্ডজ্ঞানট্যান কি একেবারে লোপ পেয়ে গেছে? তুলেছিস কোথায় এনে?”
“রুবি বোর্ডিঙে।”
“সারা রাত জার্নি করিয়ে এনে সকালে ওভাবে একা একা মেয়েটাকে হোটেলে ফেলে রেখে তুই এতটা দূরে চলে এলি? আমার কাছে এনে তুললে খুব দোষ হত?”
শোভন মাথা নাড়ল, “সেটাই লজিক্যাল কাজ হত, কিন্তু ফরিদা তাতে কিছুতেই রাজি নয়। সাংঘাতিক মুড সুইং চলছে আজকাল। আগে শর্মিষ্ঠা ওখানে ছিল। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে ভালো ছিল। এখন সে-ও নেই। আমি নানান কাজে ঘুরি, সময় দিতে পারি না বিশেষ। গত প্রায় সপ্তাহতিনেক হল ইশকুলের কাজকর্মও করে উঠতে পারছে না আর।। শারীরিক অস্বস্তিটা বেড়েছে। আমার এখানে আসা ঠিক হল যখন, তখন একেবারে আড় হয়ে পড়ল। আমার সঙ্গে আসবেই, ওদিকে আবার তোর ওখানেও গিয়ে কিছুতেই উঠবেনা। কী যে করি মেয়েটাকে নিয়ে--” তার গলায় একটু অসহায়তার ছোঁয়া ছিল।
“ও। তাই বলেছে?” সমাদৃতার গলায় একটু যন্ত্রণার ছোঁয়া ছিল কি? একরকম জোর করেই সেটাকে উপেক্ষা করল শোভন। আবেগের এই টানাপোড়েনগুলোকে সে চিরকাল সযত্নে দূরেই সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তাহলে কেন তারা এভাবে আজ তাকে চারদিক থেকে পাকে পাকে জড়াতে চায়?
“চল তাহলে। আমার বাড়ি যেতে হবেনা এখন আর । তোকে নিয়ে একেবারে রুবি বোর্ডিঙেই নামিয়ে দিয়ে যাবো। তোর ফরিদাকে দেখেও আসবো একেবারে। অসুবিধে নেই তো?”
শোভন হাসল, “চল, দেখে আলাপ করে আসবি।” বলতে বলতেই একটা সুর বেজে উঠল গাড়ির মধ্যে। চেনা সুর। শোভন কান খাড়া করল। বহুদিন আগে শোনা একটা বিয়ের গীতের সুর বাজছে কোথাও—
ছোট্টিকালে পালিছি ময়না
ময়না বুকের দুগ্ধ দিয়া রে
সোনামন ময়না রে--
সমাদৃতা তাড়াতাড়ি উঁচু হয়ে সামনে ড্রাইভারের পাশে রাখা তার ব্যাগটা তুলে নিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে তার মোবাইল ফোনটা বের করে একঝলক নম্বরটা দেখে নিয়ে তার বোতাম টিপে কানের কাছে ধরল। তারপর মৃদু গলায় দু একটা কথা সেরে নিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে কিছু নির্দেশ দিয়ে শোভনের দিকে ঘুরে বলল, “যাবার পথে আমায় মিনিট পনেরো সময় দিতে হবে শোভন। অ্যাডভোকেটের ফোন ছিল। এক্ষুনি একবার দেখা করে যেতেই হবে। জরুরি। রাস্তাতেই শিল্পসমিতিপাড়ায় ওঁর বাড়ি পড়বে।”
শোভন ঘাড় নাড়ল, “ঠিক আছে। করে নে। অফিসের ব্যাপার?”
“না। পার্সোনাল,” বলতে বলতেই শোভনের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে সমাদৃতা বলল, “আমি ডিভোর্স স্যুট ফাইল করব ঠিক করেছি শোভন।”
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে শোভন বলল, “এতটা এক্সট্রিম স্টেপ কি নিতেই হবে মাদ্রি?”
“হ্যাঁ, হবে। ব্যাপারটার কিছু কিছু তুই ব্রতীনের কাছে শুনেছিস নিশ্চয়।”
“শুনেছি।”
“কিন্তু, আমার যন্ত্রণাটার কথা তুই বিন্দুমাত্রও আন্দাজ করতে পেরেছিস কি?”
কলেজে পড়া কিশোরটি সুদূর অতীতের এক বিশ্বাবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে, পরিচিত, প্রিয় গাছটির তলায় বসে সেই কিশোরী মেয়েটির মাথাটা বুকের মধ্যে বড় আদরে জড়িয়ে রেখেছিলো- “কষ্ট পাসনা মাদ্রি-কষ্ট পাস না--”
তার পাশে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসে থাকা যুবতীটি সেই আদরমাখা শব্দগুলি শুনতে পেল যেন। প্রায় তার জবাবেই যেন সে বলে উঠল, “কষ্ট সহ্য করতে আমার কোন আপত্তি ছিল না শোভন। ভেবেছিলাম, সে নিজের মত করে বাঁচতে চাইছে, বাঁচুক গে যাক। আমি আমার মত দূরে সরে থাকবো। ছেলেটার স্বার্থে অন্তত আইনকানুনের টানাপোড়েনে গিয়ে সম্পর্কের মৃত্যুটাকে আর প্রকাশ্যে টেনে আনবো না। কিন্তু সেটা সম্ভব হল না। উত্তম এখনো আমাকে ভালোবাসে। যার সঙ্গে আমি ঘর বেঁধেছিলাম, আমার সবকিছু জেনেও যে আমায় ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছিলো, সেই উত্তম মরে গেছে শোভন। আমি তার স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে বৈধব্য যাপন করে চলেছি আজ বেশ ক’বছর হয়ে গেল। সে অবস্থার সঙ্গেও মানিয়েই নিয়েছিলাম একরকম । চাকরিটা আমার একটা বড় আশ্রয়, বড় নির্ভরতা। “কিন্তু তার ভূতটা এখনো আমার পেছন ছাড়ল না। এখনো সে আমার দখল চায়, আমার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। আমাকে ধরতে না পেরে এখন আমার বাপ মা, আ -আমার ছেলেটাকে দখল করে আমায় বাগে আনবার চেষ্টা করছে। আমার আড়ালে আমার ছেলেটাকে নষ্ট করে দেয়া শুরু করেছে ও। তারপর, বিল্টুটাও যেদিন ওর বাপের হয়েও আমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলতে শুরু করল, আ -আমার আর সহ্য হয়নি। আমার ছেলেটাকে তো অন্তত বাঁচাতে হবে,নাকি?”
“শিল্পসমিতিপাড়া এসে গেছি ম্যাডাম। কোন বাড়িতে যাবেন?”
ড্রাইভারের ডাকে সম্বিত ফিরল সমাদৃতার। তাড়াতাড়ি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে মৃদু গলায় বলল, “অ্যাডভোকেট শ্যামাপদ সেন-এর বাড়ি। চেনেন তো?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ ম্যাডাম। ওই তো সামনেই তিনতলা বাড়িটা। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে।”
খানিক বাদে, কাগজপত্রের একটা ফোল্ডার হাতে সমাদৃতা নেমে গেলে শোভনও নেমে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালো। বৃষ্টি থেকে গেছে। অন্ধকার আকাশটা থমথম করছিলো। মাথার ওপর ঝুলে থাকা মেঘ যেন হাত দিয়ে ছুঁয়ে ফেলা যায়।
“বাবা কখন ফিরবে মা?”
ফরিদার শরীরে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। পেটের ভেতর পা ছুঁড়ছে তার অজাত শিশুটি। বুকের ভেতর তার পায়ের ঘনঘন আঘাতে নিঃশ্বাস আটকে আসছিল তার। মশার ভয়ে এ ঘরটার জানালার কপাটে পুরু জাল লাগানো। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে কপাটের শক্ত হয়ে আটকে থাকা ছিটকিনিটাকে আর একবার খোলবার চেষ্টা করছিল সে। শোভন কখন ফিরবে কে জানে? একটা অবুঝ রাগ তার শিরা উপশিরায় গরম সিসের মত পাকিয়ে উঠছিল। শোভনের ওপরে, সুরভির ওপরে, পেটের বাচ্চাটার ওপরে। সবাই মিলে তার সঙ্গে যেন শত্রুতা করছে। কেন মরতে আসতে গেল সে এখানে? একটা ইনসেনসিটিভ ক্ষ্যাপাটে মানুষ। সে তো জানতোই এখানে এসে তাকে ভুলে গিয়ে নিজের কাজ নিয়ে সে ডুবে যাবে এমন করে। হয়ত মনের মত মানুষজন পেয়ে গান নিয়ে তর্কবিতর্ক করছে কোথাও বসে।
“ও মা, বলো না, বাবা যে বলেছিলো বিকেলে এসে তিস্তা দেখাতে নিয়ে চলবে আমাদের? ও মা? ফোন করো না তুমি!” সুরভি পেছন পেছন এসে তার হাতটা ধরে নাড়াচ্ছিলো। একটা ঝটকা দিয়ে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ফরিদা ভ্রূকুটি করে বলল, “ওই এলেন বাবা সোহাগি একজন । সে কখন আসবে আমি তার কী জানি? পারবো না আমি ফোন করতে। নিজে করে নিতে পারছো না?”
অপ্রত্যাশিত ধমকটা খেয়ে হঠাৎ একেবারে চুপ করে গেল সুরভি। ঠোঁটদুটি ফুলে ফুলে উঠছে তার অভিমানে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে ফরিদার দিকে হ্যাণ্ডসেটটা তুলে ধরে বলল, “আমি ফোন করতে পারিনা যে!”
“কিছুই পারোনা তুমি, না? কিছুই পারো না? কেন? সর্বক্ষণ ফোন নিয়ে খেলছো, আর ফোন করবার সময় মা করে দাও। পারবো না আমি। এই- এই কাঁদবি না! একেবারে চুপ! চুপ কর বলছি মেয়ে ! নইলে এবারে কিন্তু--”
দরজার ঘন্টাটা বেজে উঠল ঠিক এই সময়। সুরভি কান্নাটান্না ভুলে গেছে। “বাবা এসেছে--” বলতে বলতে ছুটে গিয়ে দরজাটা খুলে দিয়েই একটু অপ্রতিভ মুখে দরজা ছেড়ে ভেতরে ঢুকে এসে ফরিদার একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল । খোলা দরজা দিয়ে শোভনের আগে আগে যে মহিলাটি এসে ঢুকছেন তাকে সে চেনে না।
ফরিদা সেদিকে একঝলক তাকিয়ে দেখল। উজ্জ্বলগৌরাঙ্গী এই মেয়েকে সে কখনো দেখেনি, কিন্তু তবু নারীসুলভ অনুভূতিতে মানুষটিকে চিনে নিতে তার অসুবিধে হল না কোন। শোভনের জীবনে এই মেয়েটির অদৃশ্য উপস্থিতি, এই ক’মাসের বিবাহিত জীবনে প্রতিমুহূর্তে তার অবচেতনে নাড়া দিয়েছে এসেছে, তার অধিকারবোধকে চ্যালেঞ্জ করেছে, আবার সুতীব্র একটা আকর্ষণেরও জন্ম দিয়েছে বারবার। শোভনের এই এলাকায় আসবার নিমন্ত্রণ এল যেদিন, সেদিন থেকেই নিজেরই অজান্তে সে এই মুহূর্তটার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে বহুবার।
সমাদৃতা এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখল। তারপর তার ডানহাতটি তুলে ধরে অনামিকার দিকে চোখ ফেলে বলল, “আংটিটা ঠিক লোককেই দিয়েছিলাম। ভারি চমৎকার মানিয়েছে তোমাকে। আমায় তো কখনো দেখোনি তুমি। আমি-”
“না দেখলেও চিনতে ঠিকই পারছি সমাদৃতাদি। তোমার কথা শোভন, শর্মিষ্ঠা আর ব্রতীনদের কাছে এতবার শুনেছি যে একেবারে মুখস্ত হয়ে গেছে আমার,” ফরিদা মুখে একটু হাসি টেনে এনে বলল।
“তাই যদি হবে তাহলে জলপাইগুড়িতে এসে আমার কাছে না উঠে এই হোটেলে এসে উঠলে কেন? শোভনটা তো নাহয় ক্ষ্যাপা। তাই বলে তুমিও এমন ক্ষ্যাপামি করবে?”
ফরিদার আবার শরীরের মধ্যে সারাদিন ধরে চলতে থাকা অস্বস্তিটা ফের একবার ফিরে আসছিলো। সমাদৃতার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে চৌকির ওপর শরীরটা এলিয়ে দিতে দিতে বলল, “আমি একটু শুয়ে কথা বলি সমাদৃতাদি। শরীরটা ঠিক-”
শোভন উদ্বিগ্নমুখে ফরিদার দিকে দেখছিলো। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল, “বিকেলের ওষুধটা ঠিক সময় খেয়েছিলে তো?”
ফরিদা ক্লান্ত গলায় বলল, “খেয়েছি। কিন্তু অস্বস্তিটা যায়নি। কিন্তু সেসব নিয়ে এখন চিন্তা না করে একটু চায়ের বন্দোবস্ত দেখো। সমাদৃতাদি প্রথমবার এল--”
সুরভি বড় বড় চোখ করে নতুন আসা মানুষটাকে দেখছিল। কি সুন্দর টুকটুকে গায়ের রঙ। তার দিকে খেয়াল করে নি এখনো। মায়ের দিকেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তখন থেকে। কি মনে হতে আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে এসে সমাদৃতার হাতের পাশে নিজের ফর্সা হাতটা ধরল একবার।
বলতে বলতেই সমাদৃতা পাশ ফিরে দু হাতের মধ্যে বেঁধে ফেলেছে সুরভিকে। বুকের কাছটিতে তাকে টেনে নিয়ে এসে চোখে চোখ রেখে সে বলল, “তুমি তো একটা পুতুল! আমার কিন্তু তোমার মত নীল চোখ নেই। তোমার নাম সুরভি, তাই তো?”
“তুমি কী করে জানলে?”
“ম্যাজিক।”
“তুমি ম্যাজিক জানো?”
“জানি তো। আরেকটা ম্যাজিক দেখবে?”
“কই, দেখাও?”
“আগে বলো, আমি কে?”
“তুমি তো একটা পিসি।”
“কোন পিসি?”
সুরভি ভুরু বাঁকিয়ে একটু ভেবে নিলো। এর নাম সে জানে না। কিন্তু চুপ করে যাওয়া তার স্বভাব নয়। খানিক ভেবে চিনতে সে বলল, “তুমি ফর্সাপিসি।”
সমাদৃতা খিলখিল করে হেসে উঠল। ফরিদাও শারীরিক অস্বস্তি ভুলে তাদের হাসিতে যোগ দিয়েছে। ঘরের অস্বস্তির ভারী হাওয়াটা এক মুহূর্তে হালকা হয়ে উঠল।
“কই, ম্যাজিক দেখাও আবার?” সুরভি সমাদৃতার বুকে ধাক্কা দিচ্ছিল।
“সুরভি, পিসিকে বিরক্ত করো না-” ফরিদার গলায় মৃদু শাসনের সুর ছিল। সুরভি সেটাকে গ্রাহ্যই করল না মোটে। নতুন পিসিটিকে তার বড় ভালো লেগে গেছে।
“দেখাতে পারি, কিন্তু তার আগে তোমায় একটা কাজ করতে হবে যে!”
সুরভি তার টলটলে নীল চোখদুটো সমাদৃতার চোখে রেখে বলল, “কী কাজ, বলো?”
“একটা গান শোনাতে হবে আমাকে। তুমি গান গাইতে জানো তো?”
এই একটা কাজে সুরভির কোন আপত্তি নেই। সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি দিয়ে সে গান ধরল,
“পাখি উইড়া উইড়া যায় গো,
গুলাব শা’র গান গায়”
রিনরিনে গলাটি তার ঘরের বদ্ধ হাওয়ায় এক ঝলক তীব্র সুগন্ধের মত ছড়িয়ে পড়ছিল। চড়া সুরের গান। তার অপরিপুষ্ট গলা তার ওপরের পর্দাগুলোকে ছুঁতে পারছিল না ঠিকমত। হঠাৎ ঘরের দরজার কাছ থেকে শোভনের ভারী গলাটা যেন আদর করে কোলে তুলে নিল তার পালিতা কন্যার গলাটিকে। তারপর মিহি ও মোটা দুই গলার যুগলবন্দিতে শরিফুদ্দিনের পদটি একঝলক তাজা হাওয়ার মত ছড়িয়ে গেল সেই ঘরের ভেতর—
গুলাব শার অভাবে পাখির
ঘরে থাকা দায় গো
গুলাব শার গান গায়--
পাখির সুরে হৃদয় পুড়ে
প্রেমের গুলাব দেয় অন্তরে
আমায় কেনে ফাঁকি দিয়া
উইড়া উইড়া যায় গো
গুলাব শার গান গায়--
বুকের ভেতর একটা তীব্র মোচড় লাগছিল সমাদৃতার। সুখ-দুঃখের অতীত এই অনুভূতির তীব্রতায় ভেতরটা যেন নিঙড়ে নিচ্ছিল তার। গানের কথা বা সুর, কিছুই আর তখন তার কানে ঢুকছিল না। বিছানায় শোয়া গর্ভিণী কৃষ্ণাঙ্গী নারীটি, দরজার কাছে দাঁড়ানো তার গত জীবনের ভালোবাসার মানুষ আর এই পরিচয়হীন শিশুটি মিলে যে স্বর্গখণ্ডটি তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের জন্য সেখানে তার কোন স্থান নেই। চশমাটা খোলার ভান করে চোখদুটি একবার মুছে নিল সে তাড়াতাড়ি। অহংকারী রানির মত শুয়ে আছে শোভনের স্ত্রী। হাতে ধরা ট্রেটা তার সামনে এনে নামিয়ে রেখেছে শোভন। তিন কাপ চা। কয়েকটা বিস্কুট। একমুঠো ভুজিয়া। এই সংসারে বাইরের অতিথি হিসেবে এইটুকুই তার প্রাপ্য।
নিচু হয়ে একটা কাপ তুলে নিয়ে তাতে চুমুক দিল সে। তারপর সুরভির দিকে ফিরে বলল, “এইবারে তাহলে ম্যাজিক হোক, কেমন? চোখ বোঁজো, চোখ বোঁজো-” বলতে বলতেই নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে একটা বারবি পুতুল বের করে এনে তার হাতে ধরিয়ে দিল সে। সুরভির মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠেও নিভে এল ফের। ফরিদার দিকে ঘুরে প্রশ্ন করল, “মা-”
“আরে নাও নাও ধরো। পিসি দিচ্ছে, তার আবার মাকে জিজ্ঞেস করতে হয় নাকি?”
ফরিদা সুরভির দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ঘাড় কাত করল একটু। আস্তে আস্তে মনের ওপর থেকে একটা বোঝা সরে যাচ্ছিল তার।
“তুমি এটা সত্যি সত্যি ম্যাজিক করে আনলে বুঝি?”
সমাদৃতা তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “তা নয়তো কী? শোনো, তুমি যদি আমাদের বাড়িতে যাও তাহলে দেখবে সেখানে একটা দাদা আছে, তার জন্য আমি রোজ রাত্রে জাদু করে একটা করে খেলনা এনে দি। যাবে তুমি আমাদের বাড়িতে? হ্যাঁরে শোভন, মিষ্টি মেয়েটাকে নিয়ে যাব আমার সঙ্গে করে?”
ফরিদা হেসে মাথা নাড়ল, “তাহলেই হয়েছে। ঠিক এক ঘন্টা, বুঝলে সমাদৃতাদি, তার পরেই মা মা বলে এমন বায়না জুড়বে যে সামলাতে মুশকিল হয়ে যাবে দেখো।”
“তাহলে তুমিও চলো না। আমার বাড়ি থাকতে তোমরা হোটেলে এসে উঠবে-”
ফরিদা মাথা নাড়ল, “থাক গে সমাদৃতাদি। আছি তো মোটে আর দুটো দিন! এ দুদিন শুয়েশুয়েই কাটিয়ে দেবো এখানে। শরীরটা জুত ঠেকছে না বিশেষ। বেশি নড়াচড়া করতে আর ইচ্ছে হচ্ছে না।”
সমাদৃতা উঠে এসে বিছানায় ফরিদার পাশে বসে তার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে নরম গলায় বলল, “ঠিক আছে। তাই থাকো। আমি কাল ছুটি নিচ্ছি। তোমার কাছে গল্পসল্প করে এসে দিনটা কাটিয়ে যাবো। তবে, একটা কৌতুহল আছে আমার ফরিদা। ফ্র্যাংকলি জবাব দিও। আমায় একটা খবর পর্যন্ত না দিয়ে এইভাবে এসে হোটেলে উঠলে কেন তুমি?”
ফরিদা সমাদৃতার চোখে চোখ রেখে দেখল একবার। স্বচ্ছ, উজ্জ্বল চোখদুটো তার বুকের ভেতরটা অবধি পড়ে ফেলছে যেন। তারপর চোখ নামিয়ে বলল, “আসলে তোমায় কখনো দেখিনি তো! গল্পই শুনেছি শুধু সবার কাছে। তাই আসবার কথা হল যখন, একটু সংকোচই হয়েছিল। চেনাজানা নেই। শরীরের এই অবস্থায় গিয়ে তোমার বাড়িতে উঠে--তাছাড়া তুমি নিজেও তো কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকো--”
সমাদৃতা মাথা নাড়ল, “সে অবশ্য ঠিক। তোমার জায়গায় আমি হলেও হয়ত-” বলতে বলতেই তার ব্যাগের ভেতর ফোনটা একবার বেজে উঠেই থেমে গেল ফের। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সমাদৃতা বলল, “ওই যে, আমার শ্রীমান আওয়াজ দিতে শুরু করে দিয়েছেন। যেতে হবে এবার আমায়,” তারপর সুরভির দিকে ফিরে তার গাল টিপে আদর করে দিয়ে বলল, “আজ আমি যাই মা। দাদা ডাকছে। কাল সকালে আমি আবার আসবো। তোমায় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে তিস্তা দেখিয়ে আনবো খন। দেখো শুধু তিস্তা কেমন সুন্দর নদী।”
“ঘুমোও নি?”
শোভন অন্ধকারে তার মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে প্রশ্ন করল। ফরিদা জবাব দিল না কোন। তারপর হঠাৎ তার দিকে ফিরে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতর মাথাটা গুঁজে দিয়ে বলল, “না। ঘুম আসছে না। সমাদৃতাদির কথা ভাবছিলাম শুয়ে শুয়ে। তুমি একটা পাগল। এই মেয়েকে তুমি ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলে কী করে? রূপেগুণে এমন মেয়ে দুটো দেখিনি আমি। বাইরে ভেতরে একরকম সুন্দর মানুষ। তাকে ফিরিয়ে দিয়ে তুমি আমাকে-
“--সমাদৃতাদির তুলনায় কোনটা বেশি দেখেছিলে আমার মধ্যে? নাকি- দয়া করেছিলে? সত্যি কথা বলো তো?”
নরম আঙুলে তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে শোভন বলল, “ওসব কিছু নয়। তুমি আমার কাজটার ভাগ নিতে এলে যে। পাশে দাঁড়ালে। আমার বোঝাটা নিজের কাঁধে শেয়ার করে নিলে। মাদ্রি পারতো না। ওর সঙ্গে ঘর বাঁধতে হলে আমায়--”
“জানি গো। তোমায় আমি বুঝি না? ওকে পেতে হলে তোমায় নিজের প্রিয় সবকিছু ছাড়তে হত। তোমার মিশনটাকেও ছাড়তে হত যে। তোমার ভালোবাসার কাজগুলো ছাড়া তুমি আর তুমি থাকতে না। আমি জানি, আমি তোমার কাজের ভাগ নিতে এসে দাঁড়িয়েছি বলে তুমি আমার সঙ্গে ঘর বেঁধেছো। নইলে কোনদিন হয়তো ফিরেও চাইতে না আমার দিকে। কিন্তু সেজন্য আমার কোন অভিযোগ নেই। তোমার সঙ্গে এমনভাবে থাকতে পারছি এই আমার ঢের। এখন ঘুমোও।” যুবতীটি তার শিক্ষক, বন্ধু, স্বামী, তার ঈশ্বরের ভালোবাসাটিকে একবার স্পর্শ করে পরখ করে নিতে চেয়েই যেন বা, যুবকটির বুকের কাছে ঘন হয়ে আসে। শোভনের অন্যপাশে সুরভি ঘুমের মধ্যে দেয়ালা করে উঠছিলো। শোভনকে অতিক্রম করে একটি হাত শিশুটির বুকের ওপর রেখে তাকেও ভরসা দেয় সে। রাত বহে চলে।
“এই শুনছো, ফোন বাজছে তোমার—এ-ই—”
“উঁ-” শোভন পাশ ফিরে চাদরটা ভালো করে মুড়ি দিয়ে শুলো।
ফোনটা ক্রমাগত বেজেই চলেছে। ঘুমের মধ্যে সুরভি নড়েচড়ে উঠল একবার। এখন উঠে গেলে নিজেও ঘুমোবে না, ফরিদাকেও ঘুমোতে দেবে না আর একফোঁটা। কনুইতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে মাথার কাছে টেবিলের ওপর রাখা শোভনের ফোনটা তুলে দেখল একবার ফরিদা। চেনা নম্বর। সমরেশ ফোন করছে মুরলীপুর থেকে।
সবুজ বোতামটা টিপে ফরিদা স্পিকারে ফিসফিস করে বলল, “বলো সমরেশ। এত সকালে? কোন সমস্যা হয়েছে? ইশকুলে সব--”
“ঠিক নেই ফরিদাদি। গণ্ডগোল বেঁধেছে একটা। কাল সন্ধে থেকে ট্রাই করে যাচ্ছি, বারবার রুট বিজি হচ্ছিল। আজ এতক্ষণে লাইন পেয়েছি। তুমি শোভনদাকে দাও একটু--”
“দাঁড়া, ধর একটু,” বলতে বলতে হ্যাণ্ডসেটটা ধরে রেখেই ফরিদা শোভনের গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকল, “এই ওঠো, সমরেশের ফোন, জরুরি কথা আছে বলছে--”
তাদের কথাবার্তাগুলো কানে যেতে শোভন তাড়াহুড়ো করে উঠে বসেছে তখন। ফোনটা কানে ধরে একটুক্ষণ শুনেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ছাড়িস না, ধর। বাচ্চাটা ঘুমোচ্ছে। আমি বাইরে আসছি--”
মিনিট দশেক বাদে ঘরের ভেতর ফিরে এসে ফোনটা রেখে দিয়ে শোভন চুপচাপ বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর উঠে গিয়ে কাঁপা হাতে একটা সিগারেট ধরালো। ফরিদা চোখ বুঁজে সুরভিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে ছিল। মুখ ঘুরিয়ে শোভনের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে? সিরিয়াস কিছু?”
প্রায় জোর করেই মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলল শোভন। তারপর জানালা দিয়ে শেষ না করা সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ফরিদার কাছে এসে বসে বলল, “বিশেষ কিছু না। ওই একটু-”
গলাটা একটু কেঁপে গিয়েছিল তার কথাটা বলতে গিয়ে। কাঁপুনিটা ফরিদার নজর এড়ালো না। বিছানা ছেড়ে উঠে বসে শোভনের মুখের একেবারে কাছে মুখটা নিয়ে এসে বলল, “আমাকে লুকোচ্ছ। কী হয়েছে বল। ইশকুলটা কিন্তু আমারও, সেটা ভুলে যেও না।”
তার ঘন উষ্ণ নিঃশ্বাস শোভনের মুখে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। খানিক বাদে তার তীক্ষ্ণ চোখের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “ইশকুল নয়, মেলাটা-”
“কী হয়েছে?”
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ তার হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের এদিক সেদিক উদ্দেশ্যহীনভাবে পায়চারি করতে করতে শোভন বলল, “মেলাটা নিয়ে বেশ ঝামেলা হয়ে গেছে, জানো? পরশু বিকেলবেলা সমরেশ থানায় গিয়েছিল পারমিশানের জন্য চিঠি জমা দিতে। দারোগা তাকে যা নয় তাই করে গালাগাল দিয়ে চিঠি ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেছে, আমায় ইমিডিয়েটলি থানায় গিয়ে দেখা করতে হবে।”
“দারোগা তোমাকে থানায় হাজিরা দেবার হুকুম দিয়েছে। কোন রাইটে?”
“জানি না। আর একটা ডিস্টার্বিং খবরও আছে। পার্টি অফিস থেকে গতকাল সন্ধেবেলা বাড়িতে কয়েকটা ছেলে এসে ঢুকেছিলো। ইশকুল চলছিল তখন। তারা এসে নাহক একচোট চোটপাট করে অফিসঘরের ড্রয়ার খুলে গতবারের মেলার খাতাপত্র সব উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে। বলে গেছে আমি ফিরে আসামাত্র যেন থানায় যাবার আগে প্রথমে পার্টি অফিসে গিয়ে অমরেশ বাগচির সঙ্গে কথা বলে নিয়ে তারপর থানায় যাই। বাগচি এখন কয়েকদিন বিরামনগরেই থাকবেন। ইশকুলের ছেলেমেয়েগুলো ভয় পেয়ে গেছে খুব। কী যে হচ্ছে বুঝতে পারছি না কিছু। পরশুর ঘটনার পর ওরা কেউ আর এ নিয়ে থানায় যেতেও ভরসা পাচ্ছে না।”
চুপ করে ভাবছিল ফরিদা। শোভন উত্তেজিত অবস্থায় রয়েছে এই মুহূর্তে। মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে হবে ব্যাপারটা নিয়ে। অনেক কষ্টে নিজের ভেতরকার উত্তেজনাটাকে নিয়ন্ত্রণে এনে খুব স্বাভাবিক গলায় সে বলল, “ভেবো না। সমস্যা থাকলে তার সমাধানও থাকবে। ব্রতীন কলকাতায় আছে। ওকে ফোন করো একবার। দাও, আমি ধরে দিচ্ছি-”
বারতিনেকের চেষ্টায় ব্রতীনকে ধরা গেল। ফোনের ওপাশে পরিচিত গলাটা পেয়ে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করছিল শোভন। সব কথা শুনে স্বভাবসুলভ হালকা চালের গলায় সে বলে, “ওসব মেলাটেলা নিয়ে গণ্ডগোল একটু যে হবে সে তো জানা কথাই শোভনদা। ও নিয়ে বেশি ভাববেন না। একটু ধৈর্য ধরুন, বিরামনগরে আমার জানাশনা লোক আছে অনেক। তাদের কাউকে একটা ফোন করে আমি খবরটবর একটু নিয়ে নিচ্ছি আগে। তারপর আপনাকে ফিডব্যাক দেব। তবে, প্রথমেই একটা কথা বলে নিচ্ছি আমি, এইবারে আর অতটা ঋজু থাকবেন না শোভনদা। একটু ফ্লেক্সিবল আপনাকে হতেই হবে যে! নইলে সামলাতে পারবেন না কিন্তু-”
ফোনটা রেখে দিল শোভন। বড় বিপন্ন বোধ করছিল সে। গতবারের মেলার সময় অমরেশ বাগচির সঙ্গে অশান্তির পর থেকে মনের গভীরে অস্বস্তি একটা ছিলই। ব্রতীনের ট্রান্সফারের আগে আগে যে ঘটনাটা ঘটে গেল তার পর অস্বস্তিটা বেড়েছে বই কমেনি। কিন্তু একরকম জোর করেই একটা ছদ্ম নিশ্চিন্ততার আবরণে নিজেকে মুড়ে রেখেছিল সে। এইবারে সমস্যাটা সেই আবরণ ছিঁড়ে একেবারে চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে যাবার পোশাক পরে নিল সে। ফরিদা কিছু বলবার চেষ্টা করেছিল কয়েকবার। তার কথার কোন জবাব না দিয়ে নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে গেল শোভন। কাছাকাছি বেশ ক’টা ট্র্যাভেল এজেন্সির অফিস আছে। টিকিটটা এগিয়ে আনতে হবে। ফিরে যেতে হবে তাদের। আজকেই। কাল সকালে বাড়ি পৌঁছে বিরামনগর থানায় গিয়ে এর একটা হেস্তনেস্ত না করে তার শান্তি হবে না।
বারকয়েকের চেষ্টায় সমাদৃতার নম্বরটা ধরতে পারলো ব্রতীন। উত্তরবঙ্গের টেলিযোগাযোগের অবস্থা খারাপ চলছে কিছুদিন ধরেই। খড়খড় আওয়াজের মধ্যে সমাদৃতার গলাটা ক্ষীণভাবে শোনা যাচ্ছিল। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে মাউথপিসটা কামড়ে ধরে বেশ উঁচু গলায় ব্রতীন বলল, “সমাদৃতাদি শুনতে পাচ্ছেন?”
“পাচ্ছি। বলো। এত সকাল সকাল ফোন করলে যে?”
“সরি, অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন নিশ্চয়! ডিস্টার্ব করলাম। কিন্তু ব্যাপারটা জরুরি। শোভনের ব্যাপারে।”
“কী হল আবার?” সমাদৃতা বিল্টুর চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল। হাতের চিরুনিটা কৃষ্ণার হাতে দিয়ে বিল্টুকে তার দিকে ঠেলে দিয়ে ফোনটার দিকে মনোযোগ দিল, “তুমি বলো। তাড়া নেই। আজ আমি ছুটি নিয়েছি। শোভনদের ওখানেই যাবার কথা আছে।”
“ভালো। শুনুন। সকালে শোভন ফোন করেছিল। যা ভয় করছিলাম সেটাই হয়েছে। মুরলীপুরে ওর মেলা নিয়ে অমরেশ বাগচি ঘোঁট পাকাতে আরম্ভ করেছে। পুলিশ প্রাইমারিলি মেলার পারমিশান দেয় নি। এ’রকম কিছু একটা এক্সপেকটেডই ছিল, সেটা নিয়ে কিছু রাস্তাও আমি আগে থেকে ভেবেও রেখেছিলাম। কিন্তু এইমাত্র বিরামনগর পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে আমার এক চ্যালাকে ফোন করে ইনসাইড স্টোরি যতটুকু জানলাম সেটা অ্যালার্মিং। কাল রাতে বিরামনগর পঞ্চায়েত অফিসে অমরেশ বাগচি, থানার ওসি আর বিডিওকে এক টেবিলে বসিয়ে একটা মিটিং করেছে। কী ব্যাপারে মিটিং সেটা আমার সোর্স ততটা পরিষ্কারভাবে বলতে পারেনি, কিন্তু মিটিঙে বিরামনগর গার্লসের হেডমিস্ট্রেস, শোভারাম বয়েজের হেডমাস্টার, ওখানকার জাগ্রত সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট অমলবাবু, প্রফেসর সুধন্য কুণ্ডু, মানে এককথায় শোভনের গতবারের মেলা কমিটির সবকজন মেম্বারকেই ডেকে পাঠানো হয়েছিল। সম্ভবত শোভনের মেলাটা অমরেশ বাগচি সরাসরি হাইজ্যাক করতে চাইছে। থানাতেও নাকি বেনামে কলকাতার ঠিকানা দিয়ে একটা জেনারেল ডায়েরি করা হয়েছে শোভনের নামে। কী লিখেছে জানা যায়নি। বিরামনগরের ওসিকে ফোন করেছিলাম, ফোন রিসিভ করল না। আমার নম্বরটা ওর চেনা। ঠিক বুঝতে পারছিনা সমাদৃতাদি এ অবস্থায় ঠিক কী করা উচিৎ হবে। এটা ঠিক যে এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শোভনের স্পটে ফিরে যাওয়া দরকার। নইলে ব্যাপারটা হাত থেকে একেবারে বেরিয়ে যাবার ভয় আছে। কিন্তু ওর এগেনস্টে ডায়েরিটা কী ব্যাপারে করা হয়েছে, প্যাঁচটা ঠিক কতখানি মেরেছে অমরেশ বাগচি সেটা ধরতে পারছি না বলে টেনশনও আছে সে ব্যাপারে একটা।”
“বুঝলাম। কিন্তু এ কথাগুলো তো শোভনকে বলাটাই বেশি ঠিক হত। আমায় বলে লাভ কী বলো? এ ব্যাপারে আমি মতামত দেবার কে? তাছাড়া, কখন কী করবে, কীভাবে চলবে সে ব্যাপারে ও কারো পরামর্শ নিয়ে চলেছে কখনো?”
“সরি সমাদৃতাদি। ফোনটা আপনাকে আমি সেজন্য করিনি। শোভন অলরেডি তার ডিসিশনটা নিয়েই নিয়েছে। এইমাত্র ওকে ফোন করেছিলাম। ও এখন ট্র্যাভেল এজেন্সিতে গিয়ে বসে আছে টিকিটের জন্য। আমি আপনাকে ব্যাকগ্রাউণ্ডটা দিচ্ছিলাম একটা বিশেষ কারণে। নদিয়ার ডি এম সাহেবের কাছে তো একসময় আপনি কাজ করেছেন। আপনার সঙ্গে জানাশোনা থাকবার কথা। ব্যাপারটা ওঁকে বলে যদি একবার ইন্টারভেন করবার জন্য রিকোয়েস্ট করতেন--”
সমাদৃতা মাথা নাড়ল, “ভুল করছ ব্রতীন। কোন লাভ হবে না ওতে। এ রাজ্যের অবস্থা তুমি আমার চাইতে বেশি ভালো করে জানো। সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশান বহুকাল আগে থেকেই রুলিং পার্টির বিনিপয়সার গোলাম হয় গেছে এ রাজ্যে। আর এ লোকটা তো এ ডি এম ছিল যখন তখনই এম এল এ-র ফোন এলে নিজের অফিসের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কথা বলত। তার ওপর ভিন রাজ্যের লোক। এ রাজ্যে এসে চাকরি করে খায়। তার কি দায় পড়েছে এখানকার ইন্টারনাল পলিটিকসে নাক গলিয়ে রুলিং পার্টির লোকজনের সঙ্গে খামোকা লড়াইয়ে যাবার? আমি বলে দিচ্ছি ও এ ব্যাপারে একটা আঙুলও নাড়াবে না। পারলে উলটে অমরেশ বাগচির কাছে গিয়ে তাকে উৎসাহ দিয়ে চলে আসবে। হিতে বিপরীত হবে তাতে।”
“ও,” একটু অপ্রতিভ হয়ে গেল ব্রতীন, তারপর সামলে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে দিদি। আমি দেখছি। পার্টিতে যদি কোন কন্ট্যাক্ট টন্ট্যাক্ট খুঁজে পাই। ছুটিটা দিনসাতেক বাড়িয়ে নিই তাহলে। অ্যাপ্লিকেশনটা আপনার মেল এ পাঠিয়ে দেবো। আপনি ডি এমকে একটু সেটা দিয়ে কথা বলে নিলে-”
“পাঠিয়ে দাও। কোন সমস্যা হবে না। আমি সামলে নেব। তুমি ওদিকটা দেখো। পার্টি লেভেলে চেষ্টা করলে তাও কিছু কাজ হলেও হতে পারে। তবে সত্যি বলব, ওতেও আমার বিশেষ ভরসা নেই। বিধানসভার ইলেকশন আসছে। পার্টি তার নিচুতলার নেতাকর্মীদের খুশি রাখতেই এখন ব্যস্ত থাকবে। তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন লিডারও কিছু করতে চাইবে কিনা তাতে আমার ঘোর সন্দেহ আছে।”
“ও মা, চলো, দেরি করছো কেন?” বাইরে থেকে বিল্টু চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিয়েছিল। ফোনটা বন্ধ করে ব্যাগে পুরে সমাদৃতা ঘর থেকে বের হয়ে এল। মনে মনে একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে সে। কৃষ্ণা বসবার ঘরে সোফা মুছছিল। তাকে ডেকে বলল, “বেশি করে চাল নাও। আরো দুজন খাবে আজ এখানে দুপুরে। এক ফাঁকে বেরিয়ে প্রমোদের দোকান থেকে একটু চিকেন নিয়ে এসে পাতলা করে ঝোল করে রাখো। আর, গেস্টরুমের বিছানার চাদরটাদর পালটে তৈরি রেখো। আমি কয়েক ঘন্টার মধ্যে ফিরছি। সঙ্গে লোক থাকবে।”
দরজা খুলে দিয়েই সুরভি চিৎকার জুড়ে দিল, “ও মা দেখো, ফর্সামাসী এসে গেছে। এবার আমি তিস্তা দেখতে যাবো। নিয়ে যাবে তো? ও মাসী?”
তার হাত ধরে ঝুলতে থাকা মেয়েটাকে অন্য হাতে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিল সমাদৃতা, তারপর বলল, “শোনো সুরভি, আমার সঙ্গে তোমার দাদাও এসেছে। বাইরে দোলনায় বসে আছে দেখো গে। একটা রেলগাড়িও নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে। তুমি গিয়ে ওর সঙ্গে একটু খেলা করো, আমি দু মিনিটে মায়ের সঙ্গে কথা বলেই চলে আসছি, কেমন?” বলতে বলতেই ঘরের ভেতর জিনিসপত্র গোছগাছ করতে থাকা ফরিদার দিকে তাকিয়ে সে বলল, “বাইরে আমার ড্রাইভার সুবোধবাবু রয়েছেন। দায়িত্ববান মানুষ। উনি খানিকক্ষণ বাচ্চাদের দেখবেন। ততক্ষণ তোমার সঙ্গে আমার কিছু দরকারি কথা আছে ফরিদা।”
“বলো,” হাতের বাক্সটাকে খোলা অবস্থাতেই রেখে ফরিদা এসে বিছানায় বসল। মৃদু হাঁফাচ্ছে। সামান্য পরিশ্রমেই তার মুখটা ঘামে চকচক করছিল।
“শোভন ফেরেনি এখনো?”
“না। ফোন করেছিলাম। বলল এখুনি পৌঁছোচ্ছে। আমরা আজকেই ফিরে যাচ্ছি সমাদৃতাদি। ওদিকে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে হঠাৎ। আড়াইটেয় ট্রেন। আমি বাক্সটা গোছাতে গোছাতে তোমার সঙ্গে কথা বলি বরং। মানে হাতে সময় তো-” বলতে বলতে উঠে দাঁড়াতে গিয়েছিল ফরিদা, সমাদৃতা তার হাত ধরে ফের বসিয়ে দিয়ে বলল, “না ফরিদা। উঠো না। মুরলিপুরের খবর আমি সমস্তটাই পেয়েছি। এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে প্রথমে কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই। ঠাণ্ডা মাথায় সমস্ত ইমোশন দূরে সরিয়ে রেখে শুনে তারপর যা ডিসিশান নেবার নেবে। কথাগুলো জরুরি।”
সমাদৃতার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। ফরিদা ঘুরে বসল তার দিকে।
“শোন। ব্রতীন আমায় এইমাত্র ফোন করেছিল কলকাতা থেকে। সব বলল। ও শোভনের ফোন পাবার পর কিছু খোঁজখবর নিয়েছে। ওখানে গণ্ডগোল যেটা বেঁধেছে সেটা শুধু মেলার পারমিশান পাওয়া নিয়ে নয়। তার চেয়েও সিরিয়াস কিছু একটা পাকিয়ে উঠছে ওখানে। রিস্ক যাই থাক শোভনের এই মুহূর্তে ওখানে ফিরে সামনে গিয়ে দাঁড়ানোটা প্রয়োজন। ব্রতীন ওখানে আরো কদিন থেকে যাচ্ছে। শোভনের সাপোর্ট হয়ে যাবে একটা। তুমি বরং-”
“আমি বরং—” কী বলতে চাইছো সমাদৃতাদি?”
তার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নিচু করল সমাদৃতা। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, “জানি তোমার আপত্তি আছে, কিন্তু তবু বলছি, শোভনের সঙ্গে এক্ষুণি ওখানে না গিয়ে ক’টা দিন সুরভিকে নিয়ে তুমি আমার কাছে থেকে গেলে কিন্তু ভালো হয়।”
“কিছু মনে কোরো না সমাদৃতাদি,” ফরিদার গলায় তীব্র ঝাঁঝের স্পর্শ ছিল, “বিপদের প্রথম সম্ভাবনাটা দেখা দিতেই তাকে একা রেখে নিজের নিরাপত্তার খোঁজ করব সেজন্য তো শোভনকে আমি বিয়ে করিনি। আমি সাধারণ মেয়ে সমাদৃতাদি। যাকে ভালোবাসি তাকে ছেড়ে আমি নিজেকে বাঁচিয়ে পালাতে শিখিনি।”
তীক্ষ্ণ খোঁচাটা নীরবে হজম করে নিল সমাদৃতা। তারপর ফের বলল, “আমি বয়সে তোমার চেয়ে অনেকটাই বড় ফরিদা। যা বললে তার প্রত্যুত্তর দেয়া আমায় শোভা দেবে না। তাছাড়া, কথাটা তুমি এক অর্থে সত্যিও বলেছ। দিতে চাইলেও কী-ই বা প্রত্যুত্তর দেব আমি এর? কিন্তু বয়সে আর অভিজ্ঞতায় বড় হবার দৌলতে আমি তোমাকে একটা কথাই জিজ্ঞাসা করব, যে সমস্যাটার মুখোমুখি হবার জন্য শোভন ওখানে যাচ্ছে। সেখানে শরীরের এই অবস্থা নিয়ে, একটা অবোধ শিশুকে সাথে করে তার সঙ্গে তুমি গেলে তাতে তোমার ইগোটা হয়ত তৃপ্ত হবে যে বিপদের দিনে তুমি তোমার স্বামীর পাশে থেকেছ, কিন্তু তার আসল কাজটাতেই বড় একটা বাধা আসবেনা কি? তার লড়াইটাই যাতে সে আরো ভালোভাবে লড়তে পারে সেটা এনশিওর করাই এখন তোমার কর্তব্য বলে আমার মনে হচ্ছে। কখনো কখনো, সঙ্গে থেকে পিছুটান তৈরি করবার বদলে দূরে সরে গিয়েই একটা মানুষকে বেশি সাহায্য করা যায় ফরিদা। সঠিক সময়ে সে সিদ্ধান্তটা নিতে পারাটা সবার সাধ্যের মধ্যে থাকে না। তোমার কথা যা শুনেছি তাতে তোমার সে মনের জোরটা আছে বলেই মনে হয়েছে আমার। তাছাড়া ব্রতীন এখন ওখানে রয়েছে। ছুটি কদিন বাড়িয়ে নিয়েছে বলল। ওখানে বড় কোন সমস্যা এলে তার মোকাবিলা করতে সে তোমার চেয়ে অনেক ভালোভাবেই পারবে। তাই এ প্রস্তাবটা আমি তোমাকে দিয়েছি। আমার কাছে তোমাকে রেখে যেতে পারলে ও অনেক নিশ্চিন্ত থাকবে। তোমার বা ওর তো কাছের মানুষ বলতে আর বিশেষ কেউ নেই! আর বিশ্বাস কর, আমি তোমার কোন অযত্ন বা অসম্মান করব না। তুমি শোভনের আপনজন । এইটুকুই আমার বলার ছিল। রেখেঢেকে পলিটিকালি কারেক্ট কথাবার্তা আমি বলতে শিখিনি কখনো। যা ঠিক মনে হয় বলেছি। এবারে সিদ্ধান্তটা তোমার একার। সেখানে জোর খাটাবার কোন অধিকার বা ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই।”
চুপ করে বসে ছিল ফরিদা। সমাদৃতার কথার যুক্তিগুলো অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু তবু এইভাবে সমাদৃতার কাছে গিয়ে উঠতে তার মনের ভেতর থেকে সায় মিলছিল না। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে সমাদৃতা ফের বলল, “শোন ফরিদা,এইভাবে আমার কাছে গিয়ে উঠতে হবে ভেবে তোমার অস্বস্তি হচ্ছে জানি। তোমার জায়গায় আমি হলে আমারও তাই হত। আমি বলি কি, দিনকয়েক পরেই ব্রতীনরা ফিরছে। কটা দিন আমার ওখানে থেকে ওরা ফিরলে পরে নয় তুমি শর্মিষ্ঠার কাছে চলে যেও! কী বল?”
“মাদ্রি কখন এলি রে?” দরজা ঠেলে শোভন ঘরে ঢুকে এল হঠাৎ। তার হাত ধরে ঝুলতে ঝুলতে সুরভিও ফিরে এসেছে। তার দাবি, এইবারে বাবাও এসে গেছে, ফর্সাপিসিও রয়েছে যখন, তাহলে এক্ষুণি তাকে আর তার দাদাটিকে নিয়ে তিস্তার চরে যেতে হবে সবাইকে একবার। দাদার মুখে এতক্ষণ তিস্তার চরের বর্ণনা শুনে তার আর তর সইছে না একেবারে। শোভন কোনমতে তাকে নিরস্ত করতে না পেরে শেষে গলাটা একটু গম্ভীর করে বলল, “কথা শুনতে হয় সুরভি। দেখছো না এখন একেবারে সময় নেই। আর একটু পরেই তো আমরা বাড়ি ফিরে যাব।”
তারপর ফরিদার দিকে ঘুরে বলল, “তোমার গোছগাছ হয়ে গেছে?”
মাদ্রি নিঃশব্দে মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। তারদিকে একনজর দেখে নিয়ে ফরিদা বলল, “একটা কথা বলি। সমাদৃতাদি বলছিল, আমি কয়েকটা দিন যদি সুরভিকে নিয়ে এখানেই থেকে যাই-”
শোভন একটু অবাক হয়েই ঘুরে তাকাল ফরিদার দিকে। ফরিদা একটু অপ্রস্তুত মুখে ফের বলল, “তোমার একা একা ফিরে গিয়ে কোন অসুবিধে হবে না তো?” শোভন মাথা নাড়ল। ফিরে গিয়ে একা একা কতদিক সামলাবে সে সে চিন্তাটা তার মাথাতে ছিলই। ফরিদার মতবদলের পেছনের কারণটা সে অনুমান করে নিতে পারছিল। সমাদৃতার দিকে একবার কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়ে সে বলল, “না, মানে তোমাদের মিস করব তা ঠিক, কিন্তু সে আর ক’দিনের ব্যাপার। সব সামলে রেখেই এসে নিয়ে চলে যাব’খন। তবে এখানে হসপিটাল টসপিটাল—মানে ওখানে একটা জায়গায় নিয়মিত চেক আপ হচ্ছিল তো?”
“সে নিয়ে তুই আর নাই বা মাথা ঘামালি। সে আমরা দেখেশুনে নেবো। আমি রইলাম। ব্রতীন শর্মিষ্ঠাও ফিরে আসবে কয়েকদিনের মধ্যে। কয়েকটা দিনেরই তো মামলা। তোকে নিয়মিত খবর দিয়ে রাখবো।”
“আমিও ওই ব্রতীনের সঙ্গেই একসঙ্গে ফিরে এসে ওদের নিয়ে যাবো তাহলে। মানে এই অবস্থায় বেশিদিন তো—”
“সে তুই কাজ মিটিয়ে যত তাড়াতাড়ি হোক এসে নিয়ে চলে যাস। আটকাবো না। উপস্থিত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে তোল। আমার বাড়িতে রান্না করতে বলে এসেছি। ওখান থেকে খাওয়াদাওয়া সেরে একবারে এই গাড়িতেই স্টেশনে ড্রপ নিয়ে নিস,” বলতে বলতে সমাদৃতা উঠে দাঁড়ালো, “আধঘন্টা সময় দিলাম। ওর মধ্যে বাচ্চাদুটোকে নিয়ে একচক্কর তিস্তার চরে ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরে আসছি। আসার সময় একটা জিনিস নিয়ে আসবো। যাযাবর হোটেলের চিতল মাছের পেটি। দুপুরে খেয়ে দেখিস। সারাজীবন ভুলবি না। চলো সুরভি আমরা তিস্তা দেখে আসি-”
আকাশে বর্ষার মেঘ নীল হয়ে জমে ছিল। কালেক্টরেটের এলাকা ছাড়িয়ে এসে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে কিছুদূর এগোতেই মেঘের ছায়ামলিন বালির চর গিয়েছে খানিক দূর অবধি। শুকনোর সময়ে এর বিস্তার হয় অনেকটাই। এখন মধ্য বর্ষায় এসে ধাবমান জলের নিচে তার অধিকাংশটাই ঢেকে গেছে। কালচে নীল রঙের জলের ধারা একেক সময় ঝলসে উঠছে মেঘ ফেটে বের হয়ে আসা ক্ষণিকের রোদের ঝলকে। নদীর দিগন্ত পর্যন্ত ছড়ানো চর এখন ধাবমান জলের স্রোতে ঢাকা। শিশু দুটি খুশি হয়ে ছুটোছুটি করছিল। খোলা আকাশ আর ধাবমান জলের ধারা ওদের মগ্ন করে রেখেছে। সবে জীবন শুরু করেছে তারা। এখনো কোন দীর্ঘ অতীতের স্মৃতি ওদের ভারাক্রান্ত করে না।
খানিক বাদে সমাদৃতা হাঁক দিয়ে বলল, “বেশি দূরে যাস না কিন্তু। এখানে বাঘ আছে বলে দিলাম।” সুরভি একটু থমকে দাঁড়িয়েছিল কথাটা শুনে। বিল্টু তাকে অভয় দিল, “মা’রা ওরকম বলে। এখানে কত লোকজন, গাড়িঘোড়া, বাঘ আসবে কোত্থেকে, বল?”
সমাদৃতার মুখে একচিলতে হাসি ফুটল। উঠে গিয়ে দুজনকে দু হাতে ধরে কাছে টেনে এনে বলল, “তিস্তার চরের বাঘের গল্প শুনবি? একবার এখানে সত্যি সত্যি কেঁদোবাঘ বেরিয়েছিল কিন্তু। আয় বলি। অনেকদিন আগের কথা। সেবার শীতের সময় তিস্তার চরে কাশবনে বাঘ বের হল। বাঘ মারতে হাতিতে চড়ে চললেন, দুর্গা রায়। খোঁজ খোঁজ,খোঁজ, বাঘের দেখা আর মেলে না। খুঁজে খুঁজে যখন সবাই হয়রান তখন হঠাৎ একজন দেখে বাঘ চলেছে দুর্গা রায়ের হাতির পেটের নিচে নিচে লুকিয়ে--”
আকাশে মেঘ ফের গাঢ় হয়ে এসেছিলো। দূরে নদীর বুকে বৃষ্টি নেমেছে। ধোঁয়াটে অন্ধকারে দূরের পাহাড়, নদী সব ঢেকে গিয়েছে। হাওয়ায় ভিজে স্পর্শ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল হঠাৎ। বিল্টুর হাতে একটা ছাতা ধরিয়ে দিয়ে সুরভিকে কোলে তুলে আঁচলের মধ্যে চাপা দিয়ে বুকের কাছে ধরে নিয়ে সমাদৃতা তাড়াতাড়ি গাড়ির দিকে এগোল। মেয়েটার কবোষ্ণ শরীর তার দেহে লেপটে রয়েছে। সৌভাগ্যবতী মেয়ে। নিজের বাপ মা’কে হারিয়েও কেমন সুস্থ স্বাভাবিক একটা পরিবারে ঠাঁই পেয়ে গেল। আগে আগে হাঁটতে থাকা তার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর একটা মোচড় লাগছিল সমাদৃতার। একক মায়ের সন্তান। কোন দোষে একটা সুস্থ পরিবারের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হতে হল ওকে?
|| ১২ ||
শান্তিহাট স্টেশনে নেমে সমরেশকে একটা ফোন করে দিয়েছিলো শোভন। ট্রেনে ভালো ঘুম হয়নি। কৃষ্ণনগরের বাসে উঠে জানালার ধারে একটা সিট পেয়ে গিয়ে বাস ছাড়তে তার চোখ ঘুম নেমে এসেছিলো। ঘুম ভাঙল একেবারে মুরলীপুর এসে কণ্ডাকটরের ডাকে। চেনা মানুষ। কাছে এসে কাঁধে নাড়া দিয়ে ডাকছিলেন, “উঠে পড়েন গো মাস্টারভাই। বাড়ি এসে গেল।”
সমরেশ বাস স্ট্যাণ্ডেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। শোভন নামতে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে তার ঝোলাটা হাত থেকে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, “ফরিদাদি কোথায়?”
“জলপাইগুড়িতেই রেখে এলাম ক’দিনের জন্য সমাদৃতার বাড়িতে,” সংক্ষেপে জবাব দিল শোভন, তারপর বলল, “এবার বল। আর কিছু ডেভেলপমেন্ট হয়েছে এর মধ্যে?”
“তুমি কিছু দেখো নি বাসে আসতে আসতে?”
“কী দেখবো?” বলতে বলতেই বিরাট ব্যানারটা চোখে পড়ল তার। রাস্তার দুপাশে দুটো বড় গাছের সঙ্গে বাঁধা। হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। তার একপাশে একটা বিরাট একতারার ছবি, আর অন্যপাশে অমরেশ বাগচির হাত জোড় করা হাসিমুখটা জ্বলজ্বল করছে। মাঝখানে সোনালী অক্ষরে বড় বড় হরফে লেখা— “আসিতেছে—মুরলীপুর লোকসংস্কৃতিমঞ্চের দ্বিতীয় বর্ষের লোকসঙ্গীত সম্মেলন—দুই বাংলার অগণিত লোকসঙ্গীতগায়কের অভূতপূর্ব মহামিলনে তিনরাত্রিব্যাপী সঙ্গীতসন্ধ্যা—”
“শান্তিহাট থেকে মুরলীপুর ছাড়িয়ে কৃষ্ণনগর অবধি রাতারাতি কমপক্ষে একশোখানা এ’রকম ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছে অমরেশ বাগচির দলবল।”
শোভন নির্বাক হয়ে তাকিয়েছিল ব্যানারটার দিকে। হাওয়ায় পতপত করে উড়তে থাকা কাপড়ের টুকরোটা থেকে অমরেশ বাগচির ঝুলন্ত মুখটা ওকে ব্যঙ্গ করছিল যেন।
“আর —তোরা কিছু বলতে পারলি না? মাত্র কয়েকটা দিন এখান থেকে গেছি, তার মধ্যেই—”
গলাটা আটকে আসছিল শোভনের। কথাগুলো সমরেশকে বলতে বলতেই সে বুঝতে পারছিল অন্যায় অভিযোগ করছে সে। যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে তার দায়িত্ব বা তাতে বাধা দেবার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা এই ছেলেটির থাকবার কথা নয়। কিন্তু তার ভেতরে জমে ওঠা সব হতাশা, সব অভিযোগ তখন তার আসল লক্ষ্যটিকে খুঁজে না পেয়ে সামনে আসা এই অনুজপ্রতিম বন্ধুটির উদ্দেশ্যেই ঝরে চলেছে। সমরেশ কোন উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে আগে আগে হাঁটছিল সে শোভনের ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে।
রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির চৌহদ্দিতে পৌঁছে ভেতরের গুণগুণ শব্দটা কানে আসতে হঠাৎ করেই মনের ভেতরটায় একটা ঠাণ্ডা স্পর্শ এসে লাগল যেন। এ বাড়ির সর্বত্র তার একাধিক প্রিয় মানুষের স্পর্শ লেগে আছে। মা, হেমলতা দিদিমণি, ফরিদা-
--ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো পড়া ছেড়ে উঠে আসছিল দল বেঁধে। শোভনের পেছনদিকে তাদের কৌতুহলী চোখ কাকে খুঁজে বেড়ায়। ওরা ফরিদাকে খুঁজছে। ক্লাস টেনের দুতিনটে ছেলে এগিয়ে এসে তার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ফরিদাদিদি কোথায় শোভনদাদা?”
শোভন মৃদু হেসে তাদের একজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল একটু। তারপর বলল, “ফরিদাদিদি কয়েকদিনের জন্য আর একটা দিদির বাড়িতে থেকে গেল যে।” মুখটা একটু মলিন হয়ে গেল ছেলেটার। মাথা নিচু করে রেখে বলল, “কবে আসবে?”
“এই তো ক’টা দিন। তারপর আমি নিজে গিয়ে আবার নিয়ে আসবো তাকে। এখন যা। ক্লাসে গিয়ে বোস দেখি। আমি আসছি। ক্লাশ টেনের একটা টেস্ট নেবো আজ। অংকের। রেডি হ গে যা!”
“অমরেশ বাগচির ওখানে আগে গিয়ে একবার দেখা-”
শোভন সমরেশকে মাঝপথে থামিয়ে দিল, “যাবো। সব করব। তার আগে এদের সঙ্গে একটু সময় কাটিয়ে নিই; প্রাণ ভরে একটু নিঃশ্বাস নিয়ে নিই আমি দাঁড়া।” তার গলায় একটা অপরিচিত অসহায়তার সুর ছিল। এতদিনের অভিজ্ঞতায় এই শোভনের সঙ্গে কখনো পরিচয় ঘটেনি এই ছেলেটির। কোথায় যেন কিছু একটা ভেঙে পড়ছে। নিজের অবচেতনায় সেই ভাঙনের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল সে।
“শোভনদা, আপনি কি পৌঁছেছেন?”
ব্রতীনের ফোন। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে ফোনটা কানে তুলল শোভন, “পৌঁছেছি। এখন পার্টি অফিসের দিকেই যাচ্ছি। অমরেশ বাগচি খবর পাঠিয়েছিল আবার খানিক আগে।”
“শোভনদা, আপনাকে একটু অ্যালার্ট করে দিচ্ছি প্রথমে। গণ্ডগোল কিছু হতে পারে। যা-ই ঘটুক না কেন, মাথা আপনি একেবারে ঠাণ্ডা রাখবেন। মুখোমুখি কোন লড়াইতে যাবেন না প্লিজ। আমি কলকাতা থেকে গোটা ঘটনাটা মনিটর করে যাব। সামনে আসছি না। যা কথাবার্তা হবে আমাকে জানাবেন। আবার বলছি-”
ফোনটা কেটে দিল শোভন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাই সেই একই কথা বলে চলেছে তাকে। কম্প্রোমাইজ করো। লড়াইতে যেও না। চলে আসবার আগে ফরিদা বলল, “সাবধানে থেকো। অনাবশ্যক রিস্ক নিতে যেও না। তোমার কিছু রেস্পনসিবিলিটি আছে আমাদের প্রতি সে কথা ভুলে যেও না।” ট্রেনে তুলে দিতে এসে সমাদৃতা হঠাৎ তার একেবারে কাছে এগিয়ে এসে একটা হাত ধরে বলে গেলো, “ফরিদার দিকে আমি নজর রাখবো। ও নিয়ে ভাবিস না শোভন। তুই নিজের খেয়ালটা রাখিস অন্তত। ওতেই আমার ঢের। সবেমাত্র নিজের কাজগুলোর জন্য রেকগনিশনটা আসা শুরু হয়েছে তোর। এ সময়ে এমন কিছু পাগলামি করে বসিস না যাতে--” ব্রতীনের গলাতেও সেই একই সুর বাজছিল এইমাত্র। এ নিয়ে আর কারো সঙ্গে সে কথা বলতে চায় না। লড়াইটা একান্তই তার নিজের। নিজের ঢঙেই সে যুদ্ধটা করতে চায়। বিপ্লব-কমপ্রোমাইজ-ইনস্টিটিউশনালাইজেশন-করাপশান এবং অবশেষে আত্মার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠালাভ, এই চেনাপথের বাঁধাগতেই তো চিরটাকাল চলেছে সচেতন মানুষ। বিপ্লবের বয়স পেরিয়ে গিয়ে এবারে তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখী, প্রতিষ্ঠিত একজন বুদ্ধিজীবি হয়ে ওঠবার সময় এসেছে। সমাজ তাই চায়। সেটাই নিয়ম। তাকে ভাঙতে গেলে যদি চড়া কোন দাম দিতে হয় সে জন্য সে তৈরি হয়েই এসেছে আজ।
পার্টি অফিসে ভিড় ছিল ভালো। অনেক লোকজন অপেক্ষা করছেন অমরেশ বাগচির সঙ্গে দেখা করবার আশায়। লম্বামতো একটা ছেলে একটা টেবিলে বসে তালিকা মিলিয়ে এক এক করে লোক পাঠাচ্ছিল ভেতরে। এই অঞ্চলের ছেলে নয়। হলে শোভন চিনতে পারতো। ভেতরে গিয়ে দাঁড়াতে তাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী চাই?”
তারপর তার নাম শুনে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে বলল, “বসুন, স্যার এখন পাবলিক মিট করছেন। সেটা মিটে গেলে স্লিপ পাঠিয়ে দেবো।”
প্রায় ঘন্টাদুয়েক বসে থাকবার পর অমরেশ বাগচির কাছে ডাক পড়ল তার। বিরাট একটা টেবিলের অন্যপাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন অমরেশ। সঙ্গে তিনচারজন লোক। উল্টোদিকে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক লোকটি বিনয়ে নুয়ে পড়ে বলছিলেন, “কাজটা হয়ে গেলে কী যে উপকার হয় স্যার। রিটায়ার করেছি আজ বছরদুয়েক হয়ে গেল। সল্টলেকের অফিসে ঘুরে ঘুরে পায়ে কড়া পড়ে গেল, কেউ কিছু বলে না। এই প্রথম কেউ একজন একটু ভরসা দিল।”
বাগচি দরাজ হেসে হাত নেড়ে জবাব দিলেন, “আরে ছি ছি! আমায় লজ্জা দেবেন না মাস্টারমশাই। পাবলিকের সেবা করবার জন্যই তো এই চেয়ারে আমায় বসিয়েছেন আপনারা। ও পেনশন আপনার এবারে ঠিক হয়ে যাবে। ছটা মাস সময় দিন। আমি নিজে ব্যাপারটা দেখব, কথা দিলাম। আপনি মাসদুয়েক পরে সল্টলেকের অফিসে একটা খোঁজ নিয়ে নেবেন।”
ভদ্রলোক ফের একটা নমস্কার করে বিদায় নিলেন। অমরেশের পাশে বসা মোটাসোটা মানুষটি চলে যাওয়া প্রৌঢ়টির দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে কিছু একটা মন্তব্য করতে যাচ্ছিল; তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে অমরেশ শোভনের দিকে ফিরে একগাল হেসে বললেন, “এই যে শোভনবাবু এসেছেন। আসুন আসুন। আপনার জন্য এই কদিন অপেক্ষায় ছিলাম মশাই।”
শোভন এগিয়ে এসে সামনের চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বলল, “ফিরে এসে বেশ কয়েকটা ব্যানার দেখলাম রাস্তায়।”
“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। ওই সব দলের ছেলেপুলেদের কাজ। বারবার বলছি, আগে শোভনবাবু আসুন, তার সঙ্গে কথাবার্তা হোক, সেসব সেরে তারপর নাহয় পাবলিসিটির দিকে যাবি, তা কে শোনে কার কথা! হই হই করে পোস্টার টোস্টার বানিয়ে ফেলেছে সব গিয়ে। বুঝতেই তো পারেন, আমাদের এই মেলাটা নিয়ে এতদঞ্চলের পাবলিকের কি ভীষণ সেন্টিমেন্ট তৈরি হয়েছে প্রথমবারের পর থেকে! সবই আপনার ক্রেডিট মশায়!”
স্থির চোখে তাকিয়ে ছিল শোভন অমরেশের দিকে। খানিক বাদে বলল, “অমরেশবাবু। এখানে বাইরের পাবলিক কেউ নেই। কাজেই ভূমিকা, ভনিতা ওসব বাদ দেয়া যাক। সরাসরি কাজের কথায় আসুন। মেলাটা তো আপনি দখল করেছেন আপনার পলিটিক্যাল প্রয়োজনে--”
“এই মুখ সামলে-” অমরেশের পাশে বসা মানুষটি হঠাৎ বাঘের মত গর্জন করে উঠল, “কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়ে সেটা শিখিয়ে দিতে কিন্তু আমার বেশি সময় লাগে না ছোকরা। আর একবার--”
অমরেশ মানুষটির পিঠে হাত দিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “আহা সুবোধ, তুমি আবার এর মধ্যে কথা বলতে এলে কেন? যা বোঝ না, তাতে মাথা গলিও না। এ ছোকরার মাথায় ঘিলু আছে। ধরেছে ঠিক,” তারপর শোভনের দিকে ঘুরে বলেন, “হ্যাঁ শোভনবাবু, বলুন, আপনি কী বলছিলেন খোলসা করে বলে ফেলুন তো?” শোভন শান্ত গলায় কেটে কেটে বলল, “যে প্রশ্নটার জবাব জানবার জন্য আমি আপনার ডাকে রেসপণ্ড করে এখানে এসেছি সেটা হল, আমায় আপনার এত প্রয়োজনটা কীসের? মেলাটা দখল করেছেন, এবারে সেটাকে নিজের স্টাইলে উদযাপন করে করে ফেললেই তো পারেন। আমাকে বারবার ডেকে পাঠাচ্ছেন কেন? আমার কিছু একটা ইউটিলিটি আছে যেটা আপনার স্বার্থে কাজে লাগতে পারে বলে আপনি বুঝেছেন। সেটা কী?”
অমরেশ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে একবার মেপে নিলেন শোভনকে। তাঁর ঘাঁটিতে এসে মুখোমুখি বসে এইভাবে কথা বলবার হিম্মত রাখে যে, সে খুব সহজ ছেলে নয়। নিচুঘরের বাউল বোষ্টমের ছেলে লেখাপড়া শিখে এখন কেউটে হয়ে ফোঁস করছে। তবে এ ছেলেটার এই এলাকার পাবলিক সেন্টিমেন্টে গভীর শেকড় রয়েছে। সেটা যে ঠিক কতটা গভীর তার একটা আন্দাজ তিনি পেয়েছেন থানায় ঘটনাটা ঘটাবার পর। শোভনের মেলার অনুমতি না দেবার জন্য ওসিকে তিনিই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন আগে থেকে। সে খবরটা পার্টির মধ্যে জানাজানি হয়ে যাবার পর থেকে পার্টির ভেতরেই একদল ছেলে উল্টোসুরে গাইতে শুরু করেছে। তাদের ছোটবেলাটাও এই শোভনের ইশকুলেই তৈরি।
কিন্তু প্রথমে একে দলে টানবার একটা চেষ্টা করে দেখবেন অমরেশ। ওতে লাভ বই লোকসান হবে না কোন। তাতে ফেল করলে তখন পরের ব্যবস্থা পরে ভাবা যাবে’খন। সে অবস্থা এলে শত্রুদমনের রাস্তা তাঁর আগে থেকেই তৈরি করেই রাখা আছে।
একটু বাদে তিনি ফের বললেন, “ব্যাপারটা আপনি একেবারেই ঠিক ধরেছেন শোভনবাবু, পলিটিক্যাল কারণেই এ মেলাটার মেন্টর হিসেবে আমার নামটা এ বছর বাজারে ফাটা দরকার। গতবার মেলা থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে ভুল করেছিলাম মশাই। মুক্তকন্ঠে স্বীকার করছি কথাটা। কিছুটা অ্যাডভার্স পাবলিসিটিও হয়ে গেছে আমার ওই নিয়ে বাজারে। আসলে আপনার ট্যালেন্টটা আমি গতবার ধরতে পারিনি। ভেবেছিলাম আপনার, আর ওই বিডিওটার কলেজে পড়া ইন্টেলেকচুয়ালিটি পাবলিক খাবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাবলিকের পালস যেভাবে বুঝে নিয়ে রাইট খাবারটা গতবার আপনি তাদের মুখে তুলে দিতে পেরেছেন তাতে পলিটিশিয়ান হিসেবে আমারই লজ্জা পাবার কথা। এ বছর থেকে কিন্তু আপনাকে আমি ছাড়ছি না মশায়। মধ্যে কিছু মন কষাকষি হয়েছে সে সত্যি, কিন্তু রাজনীতিতে ওসব অনেক হয়ে থাকে। কবে ভুল করে কী দু কথা বলেছি টলেছি সেসব মাথায় রাখবেন না। এবছরের মেলায় আমি আপনার সঙ্গে থাকতে চাই। সেইজন্যেই ব্যাপারটায় মাথা গলাতে হল আমাকে। ব্যাপারটা খুলেই বলি--আপনার অ্যাবসেন্সে আপনার দু চারটে ছোকরা থানায় গিয়েছিলো মেলার পারমিশান আনতে। সেখানে ওসি কীসব ঝামেলা করেছিল। সম্ভবত আপনার এগেন্সটে পুরোনো কোন কেসটেসের রেফারেন্সে। পুলিশের যেমন স্বভাব আর কি! দুচার পয়সা খেতে চাইছিল বোধ হয়।
“তা আপনার ছোকরারা তো আবার সাক্ষাৎ ধর্মপুত্তুর। একটি পয়সা ঠেকাবে না কাউকে। উলটে ফিরে এসে হাটেঘাটে গুজব ছড়াতে শুরু করে দিল, মেলা নাকি এবারে হবে না। ষড়যন্ত্র টন্ত্র সে কত রকম কথা মশায়! শুনে আমি বললাম, এ হতে পারে না। আমি এখানে থাকতে এমন পপুলার একটা ফাংশান হবে না সেটা আমি হতে দিতে পারবো না। আপনার ইশকুলে লোক পাঠালাম। তারা এসে বলল, আপনি নাকি কোথায় কীসব বক্তৃতা টক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন! কবে ফিরবেন টিরবেন তার ঠিক নেই। বাধ্য হয়ে তখন আমাকেই মাঠে নামতে হল। আপনার কাজটাই একটু এগিয়ে দিলাম আর কি! মেলার কাগজপত্রগুলো আপনার ওখান থেকে আনিয়ে নিয়ে থানার ওসিকে আর আপনার গতবারের মেলা কমিটির লোকজনকে ডেকে নিয়ে একটা মিটিং করে সব ঠিক করে দিয়েছি। আপনি ছিলেন না, তাই বাধ্য হয়েই বুঝলেন কিনা, নিজের দস্তখতে মেলার পারমিশানটা চেয়ে ফের একটা চিঠি দিলাম। লেটারপ্যাডে আমার নামটা দেখে সুরসুর করে আধ ঘন্টার মধ্যে পারইশানটারমিশান সব এসে গেছে গতকাল। মেলাটার ফাইনান্সে সরকারী টাকা আনবার জন্য একটা অর্গানাইজেশন বানিয়ে সেটাকে রেজিস্ট্রেশনের জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওতে অ্যাকাডেমিক মেন্টর নামে একটা পোস্ট তৈরি করে আপনার নামটা দিয়ে দিয়েছি বড় বড় করে। এই যে-এই যে দেখুন দেখি প্রোপজালটা--”
পকেট থেকে ঘামে ভেজা একটা কমপিউটার প্রিন্ট আউট বের করে এনে শোভনের সামনে এগিয়ে দিলেন অমরেশ।
কাগজটা হাতে নিয়ে একনজর চোখ বুলিয়ে নিল শোভন। মেলার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন অমরেশ স্বয়ং। সমস্ত কমিটিতে অজস্র অচেনা নাম। মেলার প্রস্তাবিত কর্মবিবরণীতে রয়েছে লোকসঙ্গীত, গণসঙ্গীত, নাট্যসঙ্গীত, “রাগা ইভনিং” নামের একটি রাগসঙ্গীতসন্ধ্যা, রক্তদান শিবির, লোকসঙ্গীতের সম্বন্ধে সেমিনার ও একটি ছোট বইমেলা। তার নামটা রাখা আছে নিচে ডানদিকের এক কোণায়। বড় বড় হরফে তার নাম আর নতুন পদমর্যাদাটা একটা পরিহাসের মত দেখাচ্ছে সেখানে। নীরবে কাগজটা পকেটে পুরে নিয়ে উঠে দাঁড়াল শোভন।
অমরেশ হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “আরে মশাই উঠছেন কোথায়? এতবড় একটা যজ্ঞের সূচনা হতে চলেছে-”
শোভন মাথা নাড়ল, “আপনার যজ্ঞ আপনি করুন অমরেশবাবু। তবে আমাকে এর থেকে বাদ দেবেন। আপনার ইন্টারেস্টে পাবলিকের পালস বুঝে ফাংশান করানোটা আমার কাজ নয়। আর, দ্বিতীয় কথা, “মুরলীপুর লোকসংস্কৃতিমঞ্চ” নামটা আপনাদের ব্যবহার করবার অনুমতি আমি দেব না। ওই নামে গতবার আমি একটা মেলা করেছি। এবারে আবার করব। আপনি আপনার মেলার অন্য যা খুশি নাম দিতে পারেন।”
শোভন মৃদু হাসল একবার, তারপর বলল, “সম্ভবত আপনিই ঠিক বলছেন অমরেশবাবু। এ দেশের যা হাল চলছে তাতে শেষপর্যন্ত আপনিই জিতবেন হয়তো। তবে একটা ক্ষীণ আশার কথা কী জানেন? এখানকার জুডিশিয়ারি এখনো পলিটিক্যাল পার্টির দাস হয়ে যায়নি একেবারেই। স্বাধীন কাজ একমাত্র ওই জায়গাটাতেই হয়ে থাকে। মুরলীপুর লোকসংস্কৃতিমঞ্চ নামটা আমার দেয়া, এবং একবার ওই নামে একটা মেলা এখানে আমি করেছি। আপনার ক্যাডাররা গিয়ে কিছু খাতাপত্র তুলে এনেছে বলেই যদি ভেবে থাকেন সমস্ত কাগজপত্র লোপাট করে দিতে পেরেছেন আমার, তাহলে ভুল করছেন। এ মেলাটা আপনি এভাবে দখল করে নিতে পারেন কি না তার একটা সুষ্ঠু জবাব আদালতই ঠিক করে দেবেন আশা করি। আমি চলি।”
শোভন বের হয়ে যেতে তার ধাক্কা খাওয়া দরজাটার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন অমরেশ। কথায় বলে পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে। এ ছোকরারও পাখা গজিয়েছে। জলে বসে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করবে ঠিক করেছে এ।
অবশ্য মামলা হলে তাঁর হারবার বেশ ভালো একটা সম্ভাবনা রয়েছে। প্যাঁচটা খেলেছে ভাল। কিন্তু এই ছোটজাতের ছোকরার মাথায় অত আইনি প্যাঁচপয়জার তো আসবার কথা নয়! ন্যালাখ্যাপা ছোকরা। ছাত্র পড়িয়ে, গান শুনে বেড়ায়। এর পেছনে ওই মুসলমান ছুঁড়ি আর ওই বিডিওটার বদবুদ্ধি কাজ করছে নিশ্চয়। মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল তাঁর। একে ব্রহ্মাস্ত্রটাই ঝাড়তে হবে শেষপর্যন্ত। তবে সামনাসামনি একে কিছু করা ঠিক হবে না। এলাকায় পাবলিক সেন্টিমেন্ট ঝাড় খেয়ে যাবে। কাজটা একটু গোপনে সারতে হবে। একবার একে শায়েস্তা করে নিয়ে তারপর ওই মুসলমান ছুকরি আর বিডিওটাকে দেখে নেবেন অমরেশ।
হাতের ইশারায় তিনি ঘরের বাকি লোকজনকে বাইরে যেতে বললেন। সবাই বের হয়ে গেলে অশেষকে ঘন্টি দিয়ে ডেকে দরজা বন্ধ করিয়ে লাল আলোটা জ্বেলে দিতে হুকুম দিয়ে, ফাঁকা ঘরে বসে ফোনে একটা নম্বর মেলালেন তিনি। ওপাশ থেকে সাড়া আসতে চাপা গলায় বললেন, “এবারে থানায় পাঠানো কমপ্লেনের কপিটা হোম মিনিস্ট্রিতে পাঠিয়ে দাও। কপি দেবে সি আই ডি আর আইবিকে। কালকের মধ্যে ডেলিভারি হয়ে যায় যেন অবশ্যই। মিনিস্ট্রিতে একটু তাড়া দিও। দু একদিনের মধ্যে কপিটা যেন ওখান থেকে থানায় অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়ে দেয়। সেটার ডেসপ্যাচ নাম্বারসহ একটা কপি তুলে আমাকে ফ্যাক্স করবে। সেটা হাতে না পাওয়া অবধি আমি এখানেই আছি। বি কুইক। দেরি হলে ছোকরা বেইজ্জত করে দিতে পারে।”