আজ বেশ অনেকক্ষণ মোবাইল ফোনে কথা বলছে ইন্দ্র। অবশ্যই ভালো খবর একটা আসছে। নীল গাউনের ওপর সাদা হাউসকোট পরে নিল মিঠি। বাইরের ঘরে যাবে। সকালের চায়ের ব্যবস্থা বাইরের ঘরে। পূরবী চায়ের সরঞ্জাম গুছিয়ে রেখে বাড়ি চলে যাবে।
আগে রান্নার লোকও ছিল। মাস তিনেক হল, মিঠি নিজেই রান্না করে নিচ্ছে। এই করতে গিয়ে সুন্দর ম্যানিকিওর করা নখ ভেঙেছে। হলুদ-লঙ্কায় হাত রাঙা। আগুনের তাপে চাঁপার কলির মত আঙুলে কালচে আভা।
‘আমি আর তোমার কষ্ট দেখতে পারছি না মিঠাই’, রোজ একবার করে বলছে ইন্দ্র, ‘কতদিন হয়ে গেল একটা ঠিকঠাক লোক পাচ্ছি না।‘
মিঠির কষ্টে ইন্দ্রের চোখ দিয়ে জল গড়ায়। ইন্দ্র আঘাত পেলে মিঠির বুকে সে ব্যথা দ্বিগুণ হয়ে বাজে।
ইন্দ্র আর মিঠি। রাজযোটক জুটি। প্রথম আলাপে যে কেউ মুগ্ধ। ভারি সুন্দর দুজনেই। সাদা চান্দেরি সিল্কের শাড়ি আর খোঁপায় সাদা একটা চন্দ্রমল্লিকা। প্রোমোটার শীতলবাবুর পার্টিতে মিঠিকে দেখে কালেক্টর সাহেব নিজে এসে আলাপ করেছিলেন।
ইন্দ্রও কিছু কম নয়। ক্লাবের নিউ ইয়ার’স পার্টিতে দামী স্যুট। রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসরে কাঁথার কাজের পাঞ্জাবী আর কালো ধুতি। লায়নস ক্লাবের সঙ্গে কুষ্ঠরোগীদের কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানে খদ্দরের পাঞ্জাবী আর সাদা পায়জামা। যখন যেমন।
চায়ের কাপে এক টুকরো সুগার কিউব দিল মিঠি। 'কার সঙ্গে কথা বলছিলে এত?'
ইন্দ্র হাসল, 'কৌশল্যাকে একবার ডেকে নাও আজ। ফেসিয়াল করাও নি তো অনেকদিন।'
চুলে ডিমের সাদা। হাতের কনুই, পায়ের গোড়ালিতে দামী ক্রিম। চাকা চাকা করে কাটা শসা বন্ধ চোখের পাতায়। ফালি ফালি করে কাটা লাল টমাটো মুখে আর দু’হাতে। কমলালেবুর শুকনো খোসা বেটে নিয়ে দুধের সরের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে মুখে, গলায়, ঘাড়ে। এসব নিয়ে ইন্দ্রের ভারি উদ্বেগ। মিঠির চেয়েও বেশি।
মিঠি হাসল। তৃপ্তির হাসি। 'অনেকদিন পর, না গো?'
হাসলে মিঠিকে আরো সুন্দর দেখায়। মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল ইন্দ্র। 'আমি তো ভাবছিলাম পাঁচ বছরের আগেই এ শহরের পাট ওঠাতে হবে। এমনভাবে চলে? বলো? তিন মাস হয়ে গেল ..'
কথা শেষ না করেই মিঠির হাতটা টেনে নিয়ে যত্নে হাত বুলিয়ে দেয় ইন্দ্র, 'আজ কৌশল্যাকে বলবে যেন হাতের জন্যে আলাদা করে সময় দেয় তোমায়। আর পূরবীকে বলবে, কাল যেন রান্নার লোকটাকে ডেকে আনে।'
পাঁচ বছর। পাঁচ বছরের বেশি কোনো শহরেই থাকে না ওরা।
এ শহরে মাত্র দেড় বছর হয়েছে। শিল্পশহর। বড় বড় বাংলো। বাংলোর বাগানে ঝাউবন। লম্বা লম্বা কালো কালো রাস্তার পাশে সার দেওয়া সবুজ গাছ। মিঠি বলেছিল, 'কি সুন্দর! এখানে বেশ কিছুদিন থাকলে হয়।'
না, তা হয় না। সব জায়গাতেই বছর তিনেক পর থেকেই সংসার গোটানোর প্ল্যান ঠিক করতে হয়। মিঠি জানে। তবু বলেছিল। এ শহরের আকাশে ঘন আকাশী নীল, বাতাসে বাঁশির সুর। বড্ড মায়া।
'আমি একবার বেরোব। গাড়িটায় .. ' ইন্দ্র বলল।
'তুমি কেন? সুরথকে খবর দাও। তুমি নিজে গাড়ি চালাবে কেন?'
মিঠির একটুও ইচ্ছে নয়, ইন্দ্র নিজের হাতে কোনো কাজ করুক। চেহারায় ওই আভিজাত্য, আচরণে রাজকীয়তা, ওকে কী সাধারণের কাজে মানায়!
ম্লান হাসল ইন্দ্র। আর কিছু বলে দিতে হল না। ইন্দ্র হয়ত গাড়িতে পাঁচশ’ টাকার পেট্রল ভরিয়ে আনবে। সুরথকে তা বলা যায় না। সবসময় ট্যাঙ্ক ভর্তি করে তেল ভরাতে হয় এ বাড়িতে, এই তো জানে সুরথ।
বাড়ি গাড়ি, মালী ড্রাইভার, তিনটে কাজের লোক, রান্নার লোক। এই ঠাটবাট বজায় রাখতে কম খরচ! ঘরবাড়ি সাজিয়ে রাখা সস্তায় হয় না। এই বসার ঘরটা দেখেই তো পাখি ধরা দেয়।
এ শহরে এসে প্রথম পার্টিটা এই বসার ঘরেই দিয়েছিল ইন্দ্র। মিসেস নীলা গান্ধী খুব প্রশংসা করেছিলেন। শোকেসের কিউরিও, ঘরের দেয়ালের অরিজিনাল যামিনী রায়, দরজার পাশে সালভাদর দালি। মিঠির রুচির প্রশংসা করেছিলেন খুব।
ডক্টর সোম প্রশংসা করেছিলেন ইন্দ্রর। মার্জিত ব্রিটিশ উচ্চারণ, আবার বাংলা বলার সময় শুদ্ধ বাংলা। প্রফেসর সেনগুপ্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ইন্দ্রর পড়াশোনা দেখে। সেই ইন্দ্রই যখন আলাপ করে রাজনীতি সমাজনীতি নিয়ে, মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে ডিসি মিস্টার কার্লেকার থেকে এলাকার বিধায়ক অমিত সান্যাল সকলের মনে।
যে কোনো বিষয়ের ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য। দেশী বিদেশী সাহিত্য, নাটক, চিত্রকলা, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি। মিঠিও তো মুগ্ধ হয়েছিল প্রথম আলাপেই। যদিও মিঠি এখন জানে, পাণ্ডিত্য কথাটা ঠিক নয়। বইপত্র জার্নাল ইন্টারনেট ঘেঁটে নিজেকে 'ওয়েল ইনফর্মড' রাখে ইন্দ্র। সেই তথ্যনির্ভর জ্ঞানকে পাণ্ডিত্য হিসেবে উপস্থাপনা করাটা ইন্দ্রর ক্ষমতা। শ্রোতাকে আকর্ষণ করার অপরূপ ক্ষমতা।
মিঠিও কথা বলে। সাহিত্য নিয়ে, আর্ট নিয়ে। শিল্পী সাহিত্যিকদের জীবনচর্যার সঙ্গে তাঁদের সৃষ্টির যোগাযোগের নিপুণ বিশ্লেষণ করে। ক’দিন আগে আর্ট গ্যালারিতে হয়ে যাওয়া শিবকুমারের ছবির স্টাইল নিয়ে কথা বলে। অ্যাকাডেমিক ন্যাচারলিজম শৈলী। সেজানেস্ক এবং কিউবিস্টিক শৈলী। শ্রোতা বিবশ এবং মুগ্ধ।
'কালচার কাকে বলে, তা এ বাড়িতে এলেই বোঝা যায়', একবাক্যে বলেন সবাই।
'চমৎকার সন্ধে কাটল', যাবার আগে বলেন অতিথিরা সবাই।
সার্কিট হাউসের কর্ণেল সরকার, কর্পোরেট অধীশ্বর মিস্টার বেদী, ফরচুন গ্রুপের প্রধান মিস্টার নায়ার, ডিএসপি জনার্দন ত্রিবেদী। ইনকামট্যাক্সের মিস্টার গুপ্তা থেকে ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর মিস্টার ফিরদৌস আলম। বারবার আসেন সবাই। কালচারের টানই আলাদা।
তারপর এককভাবে নিমন্ত্রিত হন কেউ কেউ।
গাঢ় বেগুনী কাঞ্জীভরম শাড়ি, আলগা খোঁপার নিচে হলুদ গোলাপ। কিংবা কালচে লাল সিল্কের শাড়িতে সোনালি বুটি, সোনালি ব্লাউজ। লম্বা বেণী জড়িয়ে সাদা বেলফুলের একগোছা মালা।
মিঠি নিজের হাতে চা ঢেলে দেয়। নোনতা কাজু। মাছের চপ। নারকোলের সন্দেশ। তার ওপর লাল চেরী। ঝকঝকে রূপোর বাটিতে সুবাসিত পায়েস। 'আপনার জন্যে নিজে হাতে তৈরি করেছে মিঠি। সারা দুপুর ধরে।'
হঠাৎ একটা জরুরী কাজ এসে পড়েছে, তাই ইন্দ্রকে চলে যেতে হচ্ছে। করজোড়ে মার্জনা চেয়ে নেয় অতিথির কাছে, 'মিঠি রইল। সারা দিন ধরে আপনার জন্যেই তৈরি করেছে সব। প্লিজ কোনো সঙ্কোচ করবেন না কর্ণেল সরকার।' কিংবা মিস্টার সান্যাল। ডক্টর সোম। মিস্টার বেদী।
পাখির মতো মিষ্টি গানের সুরে গল্প করে মিঠি। সাহিত্য, আর্ট। পায়েসের গন্ধ নাকি মিঠির শরীরী সুগন্ধ। যত্নে মুখের কাছে খাবার এগিয়ে দিতে গিয়ে মিঠিকেও অতিথির কাছটিতে এসে বসতে হয়েছে যে। সে সুগন্ধে অতিথির মন পুলকিত। অপরূপা স্বর্গভ্রষ্টা কিন্নরীর সান্নিধ্যে চারদিক আলোকিত। মধুরভাষিণীর গলার স্বরে মন মাতাল।
তারপর সে আলাপন এসে পড়ে ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার গল্পে। মিঠির স্বপ্নের গল্পে। অতিথির মনে দোলা লাগে। মিঠির স্বপ্নটা যে ভারি সুন্দর আর পবিত্র।
গ্রামের ধারে সবুজ একটুকরো স্বপ্ন। আদিবাসীদের জন্যে স্কুল, মডেল ভিলেজ। অবসর নেবার পর সেটাই হবে ইন্দ্র-মিঠির ঠিকানা। নেহাত কেজো লোকের ভিড়ে থাকতে চায় না ওরা। স্বপ্ন সত্যি করার জন্যেই এতখানি পথ চলা। জমি নেওয়া হয়ে গেছে। স্কুল বিল্ডিং তৈরি প্রায়। অনেকগুলো আদিবাসী শিশু সেই স্কুলের দিকে তাকিয়ে আছে। সামান্য টাকার জন্যে আটকে আছে কাজ।
অপরূপা মিঠির জন্যে আজ অন্যরকম সম্ভ্রম জাগে অতিথির মনে।
মিঠির স্বপ্ন সত্যি করার জন্যে চঞ্চল হয় মন। একটা ভালো কাজে জড়াতে পেরে মন তৃপ্ত হয়।
পাঁচ হাজার। দশ হাজার। কুড়ি, পঁচিশ, পঞ্চাশ হাজার। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট মোহিত ভাটিয়া এক লাখ টাকার চেক দিয়ে গেলেন।
পরপর কয়েকবার এমন হবার পর মোহিত ভাটিয়া আসা বন্ধ করলেন। ডক্টর সোম, কর্ণেল সরকার, মিস্টার বেদীও আসেন না আর। কি একটা অস্বস্তি। কিভাবে যে অবশ মনের ওপর থেকে সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় এখানে এলে!
তা ওঁরা না-ই আসুন, শহরে লোকের অভাব নেই। কালেক্টর সাহেব একবারই এসেছিলেন, আরেকবার নিমন্ত্রণ করতে অসুবিধে নেই। ডিএসপি ত্রিবেদী একদিন এসপি সাহেবকে নিয়ে আস্তে পারেন। ঠিকাদার থেকে ক্লাবের সেক্রেটারি। ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট থেকে স্কুলের প্রিন্সিপাল। অনেক লোক আছে এ শহরে। সবার সঙ্গে চেনাশোনা মেলামেশা হবার আগেই শহর ছেড়ে চলে যাবার সময় হয়ে যাবে।
কেননা একদিন বিধায়ক সান্যাল বলবেন, ইন্দ্র-মিঠির স্বপ্নের মডেল ভিলেজ দেখতে যাবেন এবার। ডক্টর সোম এই সুন্দর কাজটির সঙ্গে যুক্ত হবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন ইতিমধ্যেই। প্রোফেসর অমিত শর্মা চাইছেন আগামী মাসেই মিঠির স্বপ্নের স্কুল নিয়ে দিল্লীতে দরবার করবেন।
প্রবল উত্সাহে মিঠি প্ল্যান করবে, রবিবার সবাই মিলে স্বপ্নের গ্রামে বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে। তারপর রবিবারের আগেই হঠাৎ একদিন শহর ছেড়ে কোথায় চলে যাবে ওরা।
এসপি খান্নাসাহেব বলবেন, সন্দেহ আগেই হয়েছিল। কর্ণেল সরকার স্বীকার করবেন যে মিঠির স্বপ্নে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে ফেলেছেন। স্বীকার করবেন আরো কেউ কেউ। বেশিরভাগ লোকই স্বীকার করবেন না। মোহিত ভাটিয়া বোকামির কথাটা মুখ ফুটে বলতেও লজ্জা পাবেন।
এসব নিয়ে অনেক গল্প করেছে মিঠি আর ইন্দ্র। হাতে সময় নেই আর। এ শহরের পাট ওঠানোর আগে এই শেষ।
শহরের ব্যাঙ্কে নতুন ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন মিস্টার বক্সী। তিনিই আজকের অতিথি। নতুন এসেছেন, শহরের সব লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে দেরি আছে। দেরি আছে মিঠি-ইন্দ্র সম্পর্কে অস্বস্তির কথা শোনার। এই সুযোগ।
অতিথি বললে কিছুই বলা হয় না, মিস্টার বক্সী একজন বিশেষ অতিথি। পাঁচ দশ হাজার নয়, ম্যানেজার বক্সী অন্তত পাঁচ দশ লাখ টাকার যোগান দেবেন। এমনটাই পরিকল্পনা ইন্দ্রর।
এর আগে আগে দুই শহরে এই ব্যাঙ্কেরই দুই কর্তা এইভাবেই এসেছিলেন ইন্দ্র-মিঠির সংসারে। একবার গিরিডি, আরেকবার শিলিগুড়ি। এ পর্যন্ত সরকারি বেসরকারি ব্যাঙ্ক নিয়ে আটটা ব্যাঙ্ক। পার্সোনাল লোন। একবারে বেশি নয়। পাঁচ থেকে সাত লাখ।
সব মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ লাখ। সুদ মিলিয়ে আশি পঁচাশি লাখ হবেই।
কি দেখে ব্যাঙ্কগুলো পাঁচ সাত লাখের লোন দিতে রাজি হয় কে জানে। টকটকে রঙ, কাটা কাটা নাক মুখ, আকর্ণ বিস্তৃত চোখ। একটু ঢেউ খেলানো রূপোলি চুল। এমন সুপুরুষ সচরাচর দেখা যায় না। শুধু তো রূপ নয়, গুণের সমাহার। নামী কলেজের ডিগ্রী সার্টিফিকেট, এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা, সম্মোহক বাচিক শিল্প, অভিজাত ব্যবহার।
স্ত্রীটিও তেমন। চাঁদের আলোর মতো গায়ের রঙ, কপালে লাল টিপ। ঘরে এসে ঢুকল, ঠিক যেন একটা লম্বা সাদা মোমবাতি। স্নিগ্ধ সুন্দর মায়া-মায়া আলো। মধুর আপ্যায়ন, সুরেলা গলায় আন্তরিকতা।
এমনি এমনিই বিশ্বাস তৈরি হয়ে যায়।
ইন্দ্র অবশ্য এ নিয়ে রীতিমতো হোম-ওয়ার্ক করে কাজে নামে। একই ব্যাঙ্কে বারবার নয়। অন্তত চার পাঁচ বছরের মধ্যে নয়।
সন্ধেটা বেশ জমল।
একটাই ভুল হয়ে গেছে। প্ল্যানমাফিক রাতের খাওয়া দাওয়ার পর ইন্দ্রের শরীরটা একটু খারাপ করল, অতিথির কাছে মার্জনা চেয়ে বিশ্রাম নিতে উঠে গেল। অগত্যাই সুগত বক্সীকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হল মিঠিকে। কাজের লোক, কুক, ড্রাইভার কাউকেই সে সময় দেখা গেল না।
গাড়িতে ওঠার সময় লম্বা ড্রাইভওয়েটার দিকে তাকিয়ে ঝাউগাছের ছায়ায় অপরূপা মিঠির দিকে তাকিয়ে ভুল হয়ে গেল বক্সীর। বললেন, 'ভারি সুন্দর সময় কাটল মিসেস রায়।'
মিঠি বলল, একটু গলা নামিয়ে, একটু নির্জন হয়ে, অনেক সাধনায় গলার এ স্বর তৈরি করেছে মিঠি, 'আবার কবে আসবেন?' এটা ভুল নয়। ঠিকঠাক প্ল্যানমাফিক।
সুগত বক্সী অপলকে তাকালেন এবার, 'আসতেই হবে। খুব তাড়াতাড়ি। না এসে উপায় নেই আমার।'
বাহ! প্রথম রাতেই বিড়াল ধরা পড়েছে।
পুলকটা অবশ্য চোখে মুখে ফুটে উঠতে দেয় নি মিঠি। পাখির মত সুরেলা গলায়, অনেক সাধনায় এ গলার স্বরটাও তৈরি, ভারি সরল লাগে এ গলায় কথা বললে, মিঠি বলেছে, 'তাই? সত্যি এমন মনে হয়েছে আপনার? সত্যি?'
'সত্যি। আপনাকে দেখে সুবর্ণরেখা নদীর কথা মনে হচ্ছে। কেন কে জানে। অন্তত এইজন্যেই আর একবার আসতে হবে আমায়।'
সেইসময়ই ভুল হয়ে গেছে মিঠির। মারাত্মক ভুল।
মিঠি বলে ফেলেছে, 'আমার নাম যে সুবর্ণা। সুবর্ণরেখা নদীর নামে নাম রেখেছিলেন আমার বাবা।'
'তাই? বাবা সুবর্ণরেখার নামে নাম রেখেছিলেন আপনার? সুবর্ণরেখা দেখেছেন আপনি?'
ততক্ষণে সাবধান হয়েছে মিঠি। এবার বাবার কথা, ছোটবেলার কথা জিজ্ঞেস করবেন বক্সী। তাই হয়েছে। তবে এবার আর ভুল করে নি মিঠি। বহুবার বলা গল্পগুলো বলে নিশ্চিন্ত হয়েছে।
কিন্তু কি যে হল কে জানে। এই ছোট্ট ভুলের কথাটা কিছুতেই ইন্দ্রকে বলতে পারল না মিঠি। আর কেন কে জানে, আজ রাতে মিঠির ঘুম এল না।
অনেকদিন পর একটা ছোট্ট বাড়ি, আর হাওয়ায় ওড়া ধবধবে সাদা পরদাগুলো মন জুড়ে এল। কি হাওয়াই না দিত সত্যি! ছোট ছোট তিনটে মেয়ে সেই হাওয়ায় ভেসে ভেসে ঘর ছেড়ে বারান্দায়, বারান্দা ছেড়ে উঠোনে, উঠোন ছেড়ে বাগানে ছুটোছুটি করত। ঠাকুমা মাকে ডেকে ডেকে বলতেন, 'ও বৌমা, বাতাস লেগে শরীর খারাপ হবে যে। ওদের গায়ে আলোয়ান নেই কেন?'
আলোয়ান। কতদিন পর এই শব্দটা মনে পড়ল।
কেমন আছে ঠাকুমা, কে জানে। বেঁচে আছে কিনা, তা-ই বা কে জানে। ইন্দ্রর সঙ্গে বিয়ের কথায় ঠাকুমা আপত্তি করেছিলেন, 'চালচুলো নেই, বাপমা নেই, ঘরবাড়ির খোঁজ নেই .. এমন সম্বন্ধ তুমি আনলে কি করে পারুল?'
পারুলমাসী, পাড়ার সব মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ পারুলমাসীই করত। মিঠির দুই পিসির সম্বন্ধও করেছিল। খরখরিয়ে জবাব দিয়েছিল, 'তোমার না পোষায়, বলে দাও। আমার হাতে আরো পাত্রী আছে। এত বড় চাকরি করে, কোম্পানী কি খোঁজ খবর না নিয়ে চাকরি দিয়েছে নাকি? কত বড় বড় অফিসারদের সঙ্গে নিত্যি ওঠাবসা, জানো? এমন ছেলের চালচুলো নিয়ে প্রশ্ন ওঠে?'
আরো অনেক কথা হয়েছিল। লাখ কথা না হলে তো বিয়ে হয় না। রূপবান পাত্র, অপরূপ বাচনভঙ্গী। বাবা পাত্রের অফিসেও খবর নিয়েছিল।
'খুব বুদ্ধিমান, অনেক উন্নতি করবে জীবনে .. '
'ম্যানেজমেণ্টের চোখের মণি, দারুণ শার্প ..'
'যেমন সুন্দর চেহারা, তেমনই ভদ্র আর মিষ্টি ব্যবহার ..'
এমন পাত্র কেউ হাতছাড়া করে? ঠাকুমার প্রধান আপত্তি, পাত্রের বাবা-মা নেই, আত্মীয়-স্বজনের কোনো খোঁজ নেই .. ততদিনে ফিকে হতে শুরু করেছে। অল্পবয়সে বাপ-মা হারানো অনাথ ছেলে, আত্মীয়-স্বজনের দোরে দোরে ঠোকর খেতে খেতে বড় হয়েছে। সে এখন কৃতী হয়ে কারো সঙ্গে যদি সম্পর্ক না-ই রাখে, সে হক তার আছে।
'এই ভালো হল বরং। শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা নেই, আত্মীয়স্বজনের বায়নাক্কা নেই। আপনি আর কোপনির সংসার। মিঠি ভালো থাকবে।' পারুলমাসী ঠাকুমাকে বুঝিয়েছিল।
সুদর্শন সুবক্তা ইন্দ্র ততদিনে বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছে। পাত্র পাত্রী দুজনেই মন দিয়ে ফেলেছে, বাবা আর আপত্তি করে নি। বিয়ের পর মেয়ে হারিয়ে যাবে, এমন কি কোনো বাবা ভাবতে পারে? মিঠিই কি ভাবতে পেরেছিল? আস্তে আস্তে চেনা ভুবন থেকে হারিয়ে যাবে এমন?
কি করে, কোন জাদুমন্ত্রে এমন হল, তাই-ই মনে পড়ে না আর। প্রথমদিকের ছটফটানিটাও আর মনে পড়ে না। শেকলবন্দী পাখির যন্ত্রণা চেনার অভিজ্ঞতা ভুলে গেছে মিঠি।
শুধু মনে পড়ে, যেদিন ইন্দ্র বলেছিল শুধু মিঠি নয়, বাড়িতে তিন তিনটে রূপসী সুন্দর মেয়ে দেখে এবাড়িতে বিয়ের সাধ জেগেছিল তার। কোঠাবাড়ির ঊর্মিলা, কলগার্ল সেলিনা কিংবা উচ্চবিত্ত উপোসী গৃহিণী মৃদুলাদের দিয়ে কাজ করানোর ঝামেলা কম নয়। নিজের ঘরে রূপের যোগান থাকা বেশি কাজের।
সেদিন সত্যিই সবাইকে মুক্তি দিয়ে হারিয়ে যেতে সাধ হয়েছিল মিঠির। রূপসা আর কঙ্কণা, ফুলের মতো দুই বোনের জীবনে আঁধার আসতে দেবে না মিঠি। না, কিছুতেই আর কারো জীবন নষ্ট হতে দেবে না। তার চেয়ে নিজে হারিয়ে যাওয়া ভালো।
কবে শান্ত হয়ে সব মেনে নিয়েছে, ইন্দ্রর সুযোগ্যা সঙ্গিনী হয়ে উঠেছে, আজ আর মনে পড়ে না। তৃপ্ত নিশ্চিন্ত ইন্দ্রও আর রূপসা বা কঙ্কণার কথা মনে করে নি। মিঠিই একাধারে পদ্মিনী আর শঙ্খিনী হয়ে সব দাবি পূরণ করেছে।
মিঠিও তৃপ্ত নিশ্চয়। নইলে দিনে দিনে এমন চাঁদের মতো রূপ বেড়ে ওঠে!
পুরোনো কথা যদি ভুল করে মনেই পড়ে যায়, এই আজ যেমন হল, মনখারাপটা বুঝে ওঠার আগেই ভালোবাসার একগোছা লাল গোলাপ এনে দেবে ইন্দ্র। 'মিঠি, মিঠি, আমার মিঠাই ..' কি সোহাগই না করতে পারে!
'এই বেশ আছি', নিজেকেই জোরে জোরে শোনায় মিঠি। বেশ অভ্যেস হয়ে গেছে। এই আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য, এই মনোযোগ। এই অভিনয়ের জীবন। পুরোনো কথা মনে এলে মনে হয় আর কারো জীবনের ছবি দেখছে বুঝি। এই বেশ। তবু .. কি হল কে জানে .. ছোট্ট ভুলের কথাটা আজ ইন্দ্রকে বলার ইচ্ছে হল না।
বরং একটা উল্টোপাল্টা কাজ করে ফেলল।
এই সময় ধৈর্য ধরে বসে থাকার কথা। চার ফেলা হয়ে গেছে, গন্ধে গন্ধে কতক্ষণে মাছ বাবাজীবন এসে পড়ে। এ তো যে সে মাছ নয়, পাঁচ সাত লাখের লাভ দেবে। কিন্তু ভেতর থেকে কেমন একটা তাগিদ। সুবর্ণরেখা ডাক দিয়েছে বুকের মধ্যে থেকে।
সুগত বক্সী ফোন পেয়ে খুব অবাক।
'আচ্ছা, সেদিন সুবর্ণরেখা নদী নিয়ে কি বলছিলেন?'
'এইজন্যে ফোন করেছেন আমায়?' ফোনের মধ্যে দিয়ে বক্সীর হাসি ভেসে এল, 'আপনাকে চিনতে ভুল হয় নি আমার। আপনি ..' কথা শেষ না করেই থেমে গেলেন বক্সী।
'কি? আমি কি?'
'থাক সে কথা। সুবর্ণরেখার কথা কি বলছিলেন?'
'বলছিলাম যে, আপনি সুবর্ণরেখা দেখেছেন? আপনার কেন মনে হল, তার সঙ্গে আমার মিল আছে?'
কেনই বা বাবার মনে হয়েছিল এমন? পৃথিবীতে কত নামই তো ছিল। কেন সুবর্ণা? সুবর্ণরেখা?
বাবা বলত, 'কি সুন্দর যে নদীটা। সারাদিন কাজ শেষ করে বিকেলের ট্রেনে ফিরব .. প্রণব বলল, চলুন, সুবর্ণরেখা দেখে আসি। হাতে তিন ঘণ্টা সময়। চলে গেলাম। কি যে সুন্দর। তখনই ভেবে রেখেছি, আমার মেয়ের নাম হবে এ নদীর নামে।'
কেন মনে হয়েছিল বাবার? ভবিতব্য? সুবর্ণরেখাও কি হারিয়ে গেছে? তার কি সমুদ্রে মেশা হয় নি? তাই কি মিঠির জীবনটা এমন দিশেহারা? দিশাহীন? উত্তরটা জানতেই হবে মিঠিকে।
আজকাল রোজ আসেন বক্সী। ইন্দ্র নিশ্চিন্ত। অন্তত পাঁচ লাখ নিশ্চিন্ত। বিশ বছরের সঙ্গিনী মিঠির চেয়েও বিশ্বস্ত সঙ্গী, ভাগলপুরের অ্যাডভোকেট শান্তনু বিশ্বাস। আশ্বাস দিয়েছেন, কাগজপত্র সব রেডি। পাক্কা ডকুমেন্ট। কোনো ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সাধ্য নেই, একটাও ভুল ধরে। কাগজপত্র দেখাতে শান্তনু বিশ্বাস ছাড়া অন্য কাউকে বিশ্বাস করে না ইন্দ্র। ভাগলপুর ঘুরে এসে তাই ইন্দ্র নিশ্চিন্ত।
ভাগলপুর বাসের সময় ইন্দ্রর আন্তরিক অনুরোধে গত দুই সন্ধে বক্সী এ বাড়িতে এসে নি:সঙ্গ মিঠিকে সঙ্গ দিয়েছেন। আরো নিশ্চিন্ত হয়েছে ইন্দ্র।
'মিঠি আজ নিজের হাতে তন্দুরী চিকেন রাঁধছে। আপনার নেমন্তন্ন', সুগত বক্সীকে ফোনে বলেছে।
'আজ কথাটা বলবে, কেমন?' মিঠির আলতো খোঁপা খুলে রাজহাঁসের মতো লম্বা গলা জড়িয়ে ধরেছে ইন্দ্র। এই ঠিক ঠিক সময়। তন্দুরী চিকেনের মতই মিঠির নরম আঁচে নরম হয়ে আছেন বক্সী। লোনের কথা ফেলতে পারবেন না।
উত্তরে বক্সী কি বলবেন, তা-ও জানা আছে, 'সাত লাখ না হলেও পাঁচ লাখের পার্সোনাল লোন পেতেই পারেন আপনি। এই কাগজগুলো সাইন করে রাখবেন। আর ডকুমেন্ট সব জেরক্স কপি একটা ফাইলে রেডি রাখবেন। হায়ার ম্যানেজমেণ্টের কাছে নোট পুট-আপ করার আগে একবার দেখে নেব আমি।'
সেইজন্যেই আগেভাগে কাগজপত্র রেডি রাখা। ইন্দ্রর নিখুঁত পরিকল্পনায় কোনো ভুল হয় না।
খোঁপা খুলে গিয়ে কালো চুলের ঢাল মিঠির পিঠ ঢেকেছে। মুখের আধখানাও ঢাকা পড়েছে। মিঠির মুখ দেখতে পেল না ইন্দ্র।
'আজই?' এ গলার স্বর কি মিঠির? এমন আকুল, এমন জলভরা আর্তি। মিঠির গলা?
'কেন? আজ নয় কেন মিঠি?' খোলা গলায় গোলাপী মুক্তোর হার পরিয়ে দেয় ইন্দ্র, 'এই তো ঠিক ঠিক সময়।'
'আজই? আজ যে সুবর্ণরেখার ছবি দেখাবে সুগত।'
'ওহ! সেই সুবর্ণরেখা! একটা অবসেশন হয়ে যাচ্ছে তোমার। তুমি তো এইরকম ছিলে না মিঠি।'
ইন্দ্র কি বিরক্ত হল? ইন্দ্র কি রাগ করল? নাকি মনখারাপ হল ইন্দ্রর?
কি যেন বলল ইন্দ্র? 'তুমি তো এইরকম ছিলে না মিঠি ..'
কিরকম ছিল মিঠি? সেই মিঠি, যাকে ভালোবেসে পছন্দ করেছিল ইন্দ্র? সেই মিঠি, যাকে ভালোবেসে নিজে হাতে তৈরি করেছে ইন্দ্র? কোন মিঠিটা আসল মিঠি? কোন মিঠির কথা বলছে ইন্দ্র?
ছোট্ট নদী সুবর্ণরেখা। এমন কত ছোট নদীই তো আছে। যাদের নাম কেউ জানে না, নদীর ধারের কিছু গ্রাম গঞ্জ ছাড়া। কোনো পাহাড়ী উত্স থেকে জন্ম, এমন অভিজাত্যও নেই।
পিস্কা নামের একটা অখ্যাত গ্রামের ধারে জন্ম। সেই গ্রামের কাছে নাকি সোনার খনি ছিল। সুবর্ণরেখার চরে সোনা মেলে। এইরকম বিশ্বাসে গ্রামের মানুষরা সুবর্ণরেখাকে দেবীর সম্মান দিয়েছে। 'সবরনেখা'র নামে ঝুড়ি ঝুড়ি মন্ত্র, পুজোর গান। টুসুঘাটের মেলায়, কোঁচাঘাটের থানে সুবর্ণরেখার জয়জয়কার।
সত্যি সোনার খনি থাকলে কি আর মানুষ ভিড় করত না? সভ্যতার আক্রমণ হত না? কোনো খনির সন্ধান পেলে, সে মাটির বুকের খনি হোক, কি মানুষের রূপ ঐশ্বর্য .. লোভ আর লালসার আক্রমণ হয় না?
কেমন মায়ার স্বরে বলে সুগত, 'সুবর্ণরেখার সঙ্গে তোমার খুব মিল, জানো মিঠি?'
কবে থেকে যেন 'তুমি' বলা শুরু হয়েছে দুজনের।
'জানো, কত নদী এসে মিশেছে .. দাঁড়াও, মনে করে করে বলি। খরকাই, রারু, কাঞ্চী, ডামরা, কারো, চিংগুরু, কারাকারি, গুরমা, সিংডুবা, গাররা, কোডাই, ডুলুং, খাইজোরি। তাদের নাম কেউ মনে রাখে নি, কিন্তু সুবর্ণরেখাকে মনে রেখেছে।'
'এই তো তুমি বেশ মনে রেখেছ', খিলখিল হাসিটা, যেটা অনেক সাধনায় রপ্ত করেছে মিঠি, সেই হাসিটা হাসতে চেয়েছে।
সুগত হাসে নি। কেমন নির্জন মায়ার গলায় বলেছে, 'না মিঠি। লোকে যদি ওদের মনে রেখেও থাকে, তা সুবর্ণরেখার জন্যেই। ওরা সুবর্ণরেখার শাখানদী। ওরা হারিয়ে যায় সুবর্ণরেখার মধ্যে। কিন্তু সুবর্ণরেখা কখনো হারায় না।'
'কি বললে তুমি? কি বললে?' উত্তেজিত মিঠির গলার স্বরটা সাজানো সম্ভ্রম ভুলে উত্তাল বাঁশির সুরের মতো ঘরের দেয়ালে গিয়ে লাগে। সেই আওয়াজে ঘরের ঈশানকোণে ঝোলানো উইন্ডচাইমটায় ঘন্টার মতো সুর বেজে ওঠে। সেই সুর তারপর ঘর ছাড়িয়ে বারান্দা, বারান্দা ছাড়িয়ে সবুজ বাগানে গিয়ে আনন্দে লুটোপুটি খেতে থাকে।
বাতাস মেখে আবার ফেরে মিঠির গলায়, 'কি বললে সুগত? সুবর্ণরেখা হারায় না? কেন বললে অমন কথা?'
সুরের আঘাতেই বুঝি ইন্দ্রও এসে দাঁড়ায় বাইরের ঘরে। এতক্ষণ মিঠি-সুগতকে আলাপনের অবকাশ দিতে ঘরের মধ্যে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
'তুমি শুনলে ইন্দ্র?' কেন যে হাহাকারের মতো শোনাল মিঠির গলা, 'সুবর্ণরেখা হারায় না কখনো? শুনছ তুমি?'
ইন্দ্রর সুন্দর ভ্রূযুগল বিরক্তিতে কুঁচকে উঠল। পরমুহুর্তেই গভীর মমতায় মিঠির দিকে চাইল ইন্দ্র, 'কি হল মিঠি? এত আপসেট কেন তুমি? মিস্টার বক্সী বুঝি বলেছিলেন সুবর্ণরেখা হারিয়ে গেছে?'
পরিপাটি গুছিয়ে বসে পাইপ ধরালো তারপর, মার্জিত ধীর স্বরে বলল, 'ঝাড়খণ্ড ছাড়িয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর, তারপর উড়িষ্যার বালাশোর। সেইখান থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার। এতখানি পথ পেরিয়ে তারপর তালসারি। সেইখানে সাগরের সঙ্গে মেশে তোমার নদী। বে অফ বেঙ্গল। হারাবে কেন?'
ইন্দ্র সব জানে। ইন্দ্রের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিশ্লেষণক্ষমতার ওপর অশেষ ভরসা মিঠির। তবু কেমন অগোছালো স্বরে বলে ওঠে, 'তালসারি! কত দূর গেলে তালসারি পৌঁছনো যাবে? আর কত দূর?'
চেয়ারম্যান আসবেন আজ। ব্যাঙ্কের কর্তারা সবাই, জি-এম, সি-জি-এম, ডি-জি-এম, সবাই আসবেন। এ বছরের সেরা পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন স্পেশাল রিকভারি অফিসার শ্রী সুগত বক্সী। ব্যাঙ্কের বেশ কয়েক লক্ষ টাকার এন-পি-এ লোন, নন-পারফর্মিং-অ্যাসেট, যা উদ্ধারের আশাই ছিল না, সুগত রিকভার করেছেন। দশ বছর ধরে নানা ব্যাঙ্কে প্রতারণা করে চলা এক মহাজনের কাছ থেকে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকার রিকভারি। কম্প্রোমাইজ সেটলমেন্ট। বিশাল অ্যাচিভমেন্ট।
অ্যাওয়ার্ড দেবার সময় চেয়ারম্যান বেশ আন্তরিকভাবে পিঠ চাপড়ে দিলেন। কি মন্ত্রে এমন অসাধ্য সাধন হল, তা জানতে উত্সুক সবাই।
উজ্জ্বল আলোটা চোখের ওপর পড়েছে। সেই আলোর সমুদ্রে দাঁড়িয়ে সুগত কেমন অন্যমনস্ক। এই আলো, এই সম্মান, এই অ্যাওয়ার্ড কি সত্যিই প্রাপ্য সুগতর? প্রতারক মহাজনের কাছ থেকে ব্যাঙ্কের প্রাপ্য উদ্ধার করতে সুগতও কি প্রতারণার পথই বেছে নেয় নি?
মিঠির মুখটা মনে পড়ল। উজ্জ্বল একজোড়া চোখ, আলো আলো মুখ। সুবর্ণরেখার হদিশ দেওয়া প্রতারক সুগতকে দেবদূত মনে করেছিল মিঠি। 'সুবর্ণা' নাম, খবর নিয়ে জেনেছিল সুগত। বুদ্ধি করে সেই নাম নিয়ে খেলায় নেমেছিল। খেলাটা আর খেলা রইল না কেন? মিঠির কাছে জীবন নিয়ে বাজি হয়ে উঠল কেন?
জানে না সুগত।
কিছু না বুঝেই সুগত মিঠিকে তালসারির পথের দিশা দেখিয়ে ফেলেছে। রূপকথার গল্পের মতো সোনার কাঠি আর রূপোর কাঠি স্পর্শ করে ফেলেছিল সুগত। আনমনে। কিছুই না জেনে। সেই ছোঁয়ায় ঘুমন্ত সুবর্ণরেখা জেগেছে।
শৈশব, কৈশোর, বাবার দেওয়া নাম, পরিবারের দেওয়া আবাল্য সংস্কার। মিঠির ঘুম তো ভাঙতই একদিন। সুগত নিমিত্ত মাত্র। এই অ্যাওয়ার্ড কি প্রাপ্য সত্যিই?
আহা মিঠি! সুবর্ণরেখার মতো করেই সাগরে মেশার ইচ্ছেয় অধীর হয়েছে বলে আজ সুগতরও এত সম্মান, এমন অ্যাওয়ার্ড। মিঠির কাছে বড্ড ঋণ। মিঠির জন্যেই তো সব।
একদিন মিঠি গোপন লকারের হদিশ দিয়েছে সুগতকে। উজ্জ্বল আলো-আলো মুখে, চিকচিকে চোখে চেয়ে অকপটে বলেছে সব গোপন খবর। কম্প্রোমাইজ সেটলমেন্ট-এর জন্যে ইন্দ্রকে রাজি করিয়েছিল মিঠিই, সুগত নয়। সেই গোপন বোঝাপড়ার মূহুর্তে কি অমনই আলো-আলো ছিল মিঠির চোখ মুখ?
জানে না সুগত।
মিঠি নাহয় ভুল করে ফেলেছে। কেন যে ইন্দ্রের মতো মানুষও ভুল করল, সত্যিই জানে না সুগত। মিঠির জন্যেই সব। মিঠির জন্যেই একদিন ইন্দ্রর জীবননদীও দিশা পাবে নিশ্চয়।
সুবর্ণরেখা। কত পথ পেরিয়ে একা একা পথ চলা তার। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, মানুষের ঘন দঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। কোথাও রুক্ষ বালিয়াড়ি, কোথাও স্নিগ্ধ শ্যামল বনানী। কোথাও শান্ত শীতল নদী এসে মেশে, কোথাও জাদুবলে হুড্রু হয়ে প্রবল জলপ্রপাত।
সুবর্ণরেখার চর। ছোট ছোট গ্রাম। বন্যা। প্রাকৃতিক উচ্ছেদ। খড়কুটোর মতো ভেসে যায় মানুষ, তাদের সম্ভ্রম।
আবার সেই চরেই মানুষের বসতি। সবুজ ক্ষেত। সুরক্ষার জীবন। চলার পথে ছোট ছোট নাম-না-জানা গাছ, কালচে সবুজ শ্যাওলা, কত শত জলজ প্রাণ। সবার পাওনা মিটিয়ে অকূলে ভেসে যায় নদী। নদীর শুধু দেবার কথা। সমুদ্রে মেশার আগে সুবর্ণরেখার শুধুই নি:শেষে দিয়ে যাবার কথা।
মানুষ সুবর্ণরেখাকে ব্যবহার করে বারবার। ড্যাম, ব্যারেজ। খাল, পুকুর, নালা।
মিঠিকে যেমন ব্যবহার করেছে সুগত। যেমন ব্যবহার করেছে ইন্দ্র। সুবর্ণরেখার মতই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে মিঠি। বারবার।
আহা মিঠি! তালসারি আর কত দূর!
উজ্জ্বল আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে মনে মনে বলল সুগত, 'সুবর্ণরেখা। সুবর্ণরেখার জন্যেই সব।'
মনে পড়ল, শহর ছেড়ে যাবার আগের রাতে ফোন করেছিল মিঠি, 'আর হয়ত দেখা হবে না। অনেক ঋণ জমা রইল। যদি তালসারি পৌঁছতে পারি, তোমায় খবর দেব। আসবে তো?'
হ্যাঁ, এবারও শহর ছেড়ে চলে গেছে ইন্দ্র-মিঠি।