টিপুর দাদার বিয়ে। টিপুরা সেইজন্য ওদের পুনের বাড়ি থেকে সব্বাই মিলে চন্দনগরের বাড়িতে এসেছে। বাড়িটার নাম মাধবীকুঞ্জ, ঠাম্মার মায়ের নামে। ঠাম্মার মায়ের নাম ছিল মাধবীলতা। তাই ঠাম্মার প্রিয় ফুলও মাধবীলতা। সদর দরজার পাশের পাঁচিল বেয়ে উঠে দরজার ছাউনিতে সারা বছর ঝলমল করতে থাকে সে ফুলের গাছ। বাড়িতে এখন সারা বছর কেউ থাকে না, কিন্তু ভগবান কাকা নিয়মিত বাগান করে দিয়ে যায়, সুপুরি পেড়ে দিয়ে যায়, নারকোল পাড়িয়ে রেখে দেয় বাড়ির কেউ এলে গেলে দেবে বলে। তাই টিঁকে থাকে মাধবীলতা বহাল তবিয়তে।
মাধবীকুঞ্জে অবশ্য টিপুর আনন্দের কারণ ইংরেজি “L” অক্ষরের মতো রকের একদিকে দোলনা চাপা, অন্য দিকে পিসিমণির নাতি পিকুর সাথে ক্রিকেট খেলা, বাগানময় ফুল গাছের থেকে হঠাৎ হঠাৎ ফড়ফড়িয়ে উড়ে যাওয়া প্রজাপতির ঝাঁক। তাছাড়া রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে পাখির ডাক শুনে শুনে পাখিটাকে খুঁজে বার করতেও ভীষণ গোয়েন্দাগিরির আনন্দ হয় পিকু-টিপুর। টিপু ডাক শুনে পাখি চিনতে শিখেছে জেঠুবাবুর থেকে। কোনো কোনো দিন জেঠুবাবুও সঙ্গ নেন পিকু-টিপুর। সেদিন অবশ্য চকোলেট বার জুটে যায় ওদের কপালে। সেই কবে থেকে জেঠুবাবু যে ওদের ট্রেনিং দিচ্ছেন তা আর মনেও নেই টিপুর। আবার ক্লাস সেভেন থেকে ও সব পাখির সায়ান্টিফিক নেমও বলতে পারে। এতে অবশ্য পিকুকে টেক্কা দিয়েছে ও। পিকু একসময় দেখে পাখি চিনত ওর থেকেও বেশি। টিপুর দাদা টিপুকে বলেছে যে সব পাখির ছবি তুলে, বিবরণ দিয়ে কম্পিউটারে সেভ করে রাখতে, যার থেকে দাদা পরে ওকে পুনের পাখি আর চন্দননগরের পাখির ওপর দুটো অনলাইন ডিরেকটরি বানিয়ে দেবে।
কিন্তু বিয়ে বাড়ি এসে টিপু দেখল এবার যেন মাধবীকুঞ্জ অন্যরকম। দূরের আত্মীয়স্বজনরা অনেকে এসেছেন বিয়ের নেমন্তন্ন বলে। তাই সেখানে এবারে লোক বেশি, হট্টগোল বেশি, আলো বেশি, সাজগোজ বেশি। পাখিগুলো থেকে থেকে সন্ধে রাতেই ঘুম ভেঙে ভয় পেয়ে বিশ্রি ক্যাঁচম্যাচ করে। প্রজাপতিগুলো গায়েব হয়ে গেছে। কারণ বোধহয় বিয়ের যজ্ঞের মণ্ডপ করার জন্য ফুলবাগানের খানিকটা উধাও করে দিয়েছে ভগবান কাকা। তবে সবথেকে বেশি শোধ নিচ্ছে ছাতারের দল। বিয়েবাড়িতে অনেক রাত অবধি হাহাহিহি করে সবাই ঘুমোতে যায় রোজ। কিন্তু ছাতারে-বাহিনী ঘড়ি মিলিয়ে রোজ সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে পৌনে ছটায় সব জানলার কাঁচের শার্সিতে ঠোকরাতে থাকে, আর ঘুম চটিয়ে দেয় ঘরের মধ্যের লোকেদের। তার ওপর পিকু নেই বিয়েবাড়িতে, সে এখন কলেজে পড়ে, ছুটি পায়নি এসময়। টিপুর শুধুই একলা লাগতে থাকে। সে একটা বই মুখে করে শুয়ে থাকে আর থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়ে।
এই একঘেয়েমির মধ্যে দাদার বিয়ের আগের দিন একটু নিস্তার পাওয়া গেল। বাবা টিপুকে ডেকে বললেন, “টিপু, শ্রীরামপুর থেকে তোর মাসি আসবেন অনেক ব্যাগপত্র নিয়ে, একলা। ওঁকে স্টেশন থেকে সাথে করে নিয়ে আসিস আজ দুপুরে।” শুনে টিপু আহ্লাদে আটখানা। এভাবে শুয়ে বসে কাঁহাতক থাকা যায়? এদিকে বাবামায়ের কড়া হুকুম, “একলা গঙ্গার ধারে যাবে না।” যাক, স্টেশন তো যাওয়া যাবে। টিপু ব্রেকফাস্টের পরেই চান করে নিয়ে ঘড়ির সামনা সামনি বসে একটা “টিকটিকি টেকোরাম”–এর অ্যাডভেঞ্চার পড়তে শুরু করল। তারপর ঢং ঢং করে এগারোটা বাজতে বেরিয়ে পড়ল স্টেশনের দিকে।
মাধবীকুঞ্জের গলি থেকে বেরিয়ে বড়ো রাস্তায় পড়তেই দেখল একজোড়া কুকুরছানা মাথায় মাথা লাগিয়ে লেজের দিকে “V” বানিয়ে শুয়ে আছে। দেখে মনটা কেমন ঘামাচির ওপর চন্দনবাটা মাখার মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তারপর এসে গেল দুপুরে বুক ঢিপ ঢিপ করানো আমবাগান। তবে এবার আর টিপুর বুক ঢিপ ঢিপ করল না। ভাবল রাস্তা বরাবর আমবাগানটা গেছে যখন তখন তার ছায়ায় ছায়ায় যাওয়াই যায়। অমনি সে ঢুকে পড়ল আমবাগানে।
টিপুকে দেখে একটা বিরাট টিয়া উড়ে গেল উঁচুর দিকের ডালে। পাঁচটা বাঁশপাতি যেন কিছুই হয় নি এমন ভাব করে দোল খেয়ে যেতে লাগল। দুটো সোনাবৌ কোথা থেকে ধড়ফড়িয়ে ভিজে পালকে উড়ে এলো। হাঁফাতে হাঁফাতে বসন্তবৌরিগুলো সুর তুলল, “বৃষ্টি এলো বলে।” টিপু মাথার ওপর তাকিয়ে দেখল কোথা থেকে কালো কালো মেঘ রোদের দিকে ছুটে চলেছে হাঁহাঁ করে যেন এক্ষুণি গিলে খাবে সব রোদ। টিপু জোরে জোরে পা চালাল স্টেশনের দিকে।
স্টেশনে পৌঁছে দেখল সেখানে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। চারদিক রোদে চকচক করছে। স্টেশনে অনেকক্ষণ বসে বসে রোদের তাতে টিপু প্রায় ঘেমে জল হয়ে গেল। কিন্তু তবু মাসির ট্রেন এলো না। প্ল্যাটফর্ম থেকে পায়ে পায়ে বেরিয়ে এসে টিটিসাহেবকে দেখে বলল, “টিটি কাকা, বারোটা সাঁইত্রিশের শ্রীরামপুর লোকাল কি আসে নি আজ?” গম্ভীর মুখে টিটিসাহেব বললেন, “জান না তুমি? আজ বারোটা সাঁইত্রিশ বাজবে না। দেখেছ প্ল্যাটফর্মের ঘড়িতে এখন কটা বাজে?” খুব থতমত খেয়ে টিপু ফিরে গেল প্ল্যাটফর্মে। সেখানে তখন শেডের কানা বরাবর মায়ের জামদানি শাড়ির মতো ফিনফিনে লালচে কালো রঙের মেঘ জমতে শুরু করেছে। রোদের আলোটাও মরে কেমন বিকেল মতো হয়ে এসেছে। এই সময় শুরু হলো ঝড়ের মতো দমকা হাওয়া। আর মেঘগুলো অমনি উড়ে যেতে শুরু করল একদিক থেকে আরেক দিকে। ঘড়িতে তখন সোয়া চারটে।
ঘড়ি দেখে টিপুর মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। এইটুকু আসতে এতোটা সময় কেটে গেল কী করে? নাকি ও খেয়াল করল না মাসি এসে ট্রেন থেকে নেমে নিজেই রিক্সা ধরে চলে গেলেন মাধবীকুঞ্জ? নাকি টিটিসাহেবের মাথা খারাপ? মোটের ওপর অবস্থাখানা “টিকটিকি টেকোরাম”–এর কোনো অ্যাডভেঞ্চারের থেকে কম নয়। এই সময় হঠাৎই উড়তে থাকা মেঘের পাল ফুরিয়ে গিয়ে ঝকঝকে দিনের আকাশ জেগে উঠল। টিপু প্ল্যাটফর্মের বাইরে পা বাড়াল। দেখল রিক্সা নিয়ে কিশোরিকাকা দাঁড়িয়ে। কিশোরিকাকাকে টিপু জিজ্ঞেস করল, “মাসি কী এসে গেছে?” কিশোরিকাকা বলল, “না, মাসি তো আজ আসবেন না। আজ গ্রহণ ভি হোবে, ভূকম্প ভি হোবে। টাইমে সোব গোলমাল হয়ে যাবে। টিরেন ঠিক টেইম মতো চলতে পারবে না। তুমি ইস্কুলে যাও আর সে কথা জানো না?” টিপুর খুব রাগ হলো। ইস্কুলে কী খবরের কাগজ পড়ায় যে কবে ভূকম্প হবে তা ইস্কুলে গেলে জানা যাবে। তাছাড়া মাধবীকুঞ্জে কেউ থাকে না বলে ইন্টারনেট কানেকশন নেই। ফলে রোজকার খবর জানার উপায় নেই। ঝলমলে রোদ দেখলে মন বেশ তরতাজা লাগে। সাহসও বেশি আসে মনে। তাই ভূকম্প আর গ্রহণের ভাবনা টিপুর মনে দাগ কাটল না। গায়ে রোদ লাগিয়ে সে গেল টেলিফোন বুথে।
দিবাকর চট্টোপাধ্যায়ের কাছে টিপু অঙ্ক শেখে। ওর দাদারও অঙ্কের মাস্টারমশাই দিবাকর। তিনি আসছেন বিয়েবাড়িতে সপরিবারে। তাঁকে টিপু ভয় করে না, কিন্তু ভীষণ ভক্তি করে, বিশ্বাস করে। টিপু ডায়াল করল দিবাকরবাবুর মোবাইল নাম্বার। বেশ খানিক্ষণ রিং হওয়ার পর দিবাকরবাবু ফোনটা যেই তুললেন পিকু অমনি প্রশ্ন করল, “স্যর, আজ কি গ্রহণ? তার সাথে ভূমিকম্পের কী যোগাযোগ? আজকাল কি ভূমিকম্পের কথাও আগে থেকে জানানো যায়?” শুনে দিবাকর বললেন, “হ্যাঁরে টিপু, আজকাল ভূমিকম্পের কথাও খানিকটা আগে থেকে টের পাওয়া যায় বটে, তবে আজকের ব্যাপারটা একদম আলাদা। আজ সূর্য তার নিজের চারদিকে যে তলে ঘোরে আর পৃথিবী সূর্যের চারদিকে যে তলে ঘোরে তাদের মধ্যের তল কমতে কমতে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রির কম হয়ে গেছে। এবার চাঁদ যেই পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যে এসে একটা সরলরেখা তৈরি করবে অমনি সূর্যের গ্রহণ হবে। এই অবস্থায় সূর্যের সাথে পৃথিবীর দূরত্ব কম থাকায় মাধ্যাকর্ষণ তো বেড়েই ছিল, তার সাথে আবার চাঁদ এসে যোগ দিলে মাধ্যাকর্ষণ এতো বেড়ে যাবে যে গ্রহণের সময় পৃথিবীর মাটিও সেই মাধ্যাকর্ষণের টানে ফুলে ফেঁপে উঠবে। আবার এর প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবীর অভিকর্ষ এতো বাড়বে যে ফেটে যাওয়া মাটি দিয়ে আকাশের মেঘ পৃথিবীর পেটে ঢুকে যাবে।”
সব শুনে টিপুর মাথা ঘুরতে লাগল, কান ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। সেইসময় আবার মায়ের জামদানি কিংবা সিফন শাড়ির মতো দেখতে একরাশ লালচে কালো মেঘ সব আলো শুষে নিতে লাগল। টিপু কোনো মতে “রাখছি স্যর” বলে ফোনটা রেখে দিল। মেঘটা ততক্ষণে ঢালু হয়ে নামতে শুরু করেছে আকাশ থেকে মাটির দিকে। টিপু সব ভুলে দৌড়োতে লাগল মেঘের পিছনে। খানিকটা দৌড়োতেই টের পেল যে পায়ের নিচে মাটি কাঁপছে। মেঘটা যেন আরও হুড়মুড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে নিচে নামতে লাগল। এই সময় টিপু মাথার ওপর দিয়ে নেমে আসা মেঘের শরীর হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে ফেলল। মেঘটাকে তার একটা মোটা হড়হড়ে কাপড়ের মতো লাগল, অথচ ওর আঙুল, হাতের চেটো ভিজে গেল, তাতে গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলো, কাদা, কিরকিরে বালি লেগে গেল। এইবার টিপুর নজরে এলো যে ও যেখানে দাঁড়িয়ে তার থেকে গজ-খানেক দূরে যেন মেঘটা রাস্তার ওপরে মাটিকে ছুঁয়ে আছে। আর দুপা এগোতেই ও আরও দেখতে পেল যে মেঘটা আসলে রাস্তার ওপর যেখানে মাটিকে ছুঁয়েছে সেখানে মাটি ফেটে একটা চওড়া গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে; আর মেঘটা সেই গর্তের মধ্যে সড়সড় করে ঢুকে যাচ্ছে।
টিপু মাথা পিছনে ফিরিয়ে দেখল লালচে কালো মেঘের শেষ দেখা যাচ্ছে। তার পিছনে আবার দিনের আলো। মেঘটা মাটির পেটে পুরোপুরি সেঁধিয়ে যেতে টিপু আবার দিনের ঝলমলানো আলোয় মাধবীকুঞ্জের দিকে হাঁটা দিল। ও ভাবছিল যে হিসেব মতো দিবাকরের এখন এরোপ্লেনে থাকার কথা; কিন্তু তিনি সেলফোনে কথা বললেন কি করে টিপুর সঙ্গে! কে জানে সবই সূর্যের ঘূর্ণনের তল আর পৃথিবীর আবর্তন তলের ট্যারাব্যাঁকা কারসাজি কিনা। এসব ভাবতে ভাবতে ও পৌঁছে গেল লাহিড়িবাড়ির সামনে। সেখানে ভূমিকম্পে রাস্তার একদিক নিচে নেমে গেছে, আর আধখানা উঠে গেছে পাঁচ ইঞ্চিটাক। রাস্তার মতই ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেছে ইউহলের একটা ট্রাক। তার ভেতরের সব জিনিস ভীষণ ঝাঁকুনিতে বালিশে ঠাসা তুলোর মতো দলা দলা ভসভসে হয়ে গেছে। হেলমেট পরা দুজন লোক সেই তুলো তুলো ধ্বংসাবশেষ ঠেসে ঠেসে পোরার চেষ্টা করে চলেছেন গাড়িটার মধ্যে। রাস্তায় হাঁটার মতো একচুলও জায়গা নেই। তবু টিপুকে সেই লোক দুজন সাহায্য করলেন। গাড়ির নীচে নেমে যাওয়া অংশটাকে কোনো রকমে ঠেলে উঁচু করে রাস্তার ভালো অংশে ঠেলে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। কিন্তু গাড়ির ভাঙা অংশটা সরাতেই রাস্তাটা আরও নীচে বসে গেল। তখন ওঁরা টিপুর কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তার উঁচু হয়ে যাওয়া অংশে যে আধ ইঞ্চিটাক জায়গা ছিল পা রেখে চলার মতো সেই জায়গা বরাবর টিপুকে ধরে ধরে এনে ভালো রাস্তায় তুলে দিলেন।
মাধবীকুঞ্জের রাস্তায় আর তেমন কোনো বড়োসড়ো ভাঙচুর ভূমিকম্পে হয় নি। এইবার টিপুর খুব অভিমান হতে লাগল যে বাবা কেন তাঁকে এমন একটা বিপদের দিকে ঠেলে দিলেন। কিন্তু তারপরই ওর মনে পড়ল যে বাবাও তো মাধবীকুঞ্জে কয়েকদিন খবরের কাগজ কিংবা ইন্টারনেট পান নি। নিশ্চয়ই বাবাও জানতেন না এমন ওলোটপালোট হতে চলেছে।
মাধবীকুঞ্জে পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ সন্ধের অন্ধকার হয়ে গেল। ওখানে পৌঁছতেই পিকু এসে টিপুর হাত ধরে টেনে ছাদে নিয়ে গেলো। বাড়ির ছাদ থেকে ছোট সিঁড়ি নেমে গেছে রান্নাঘরের ছাদে। তার খোলা মাথাটা এর মধ্যেই কি করে কখন যেন কাচের ছাদে ঢাকা হয়ে গেছে। সেই ছাদের তলায় বসে ওরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল আকাশের বুক চিরে আলো অন্ধকারের সীমানা। অন্ধকার দিকে তারা চকমক করছে। আর তার সাথে আলোর সীমানা বরাবর দেখা যাচ্ছে সূর্যের ছটা, নীল আকাশে সাদা মেঘ। দুজনে কতক্ষণ হাঁ করে বসে এসব দেখছিল তার ঠিক নেই, হঠাৎ দিবাকরের উদাত্ত গলা শোনা গেল, “কই রে টিপু কোথায় গেলি?” টিপু অমনি লাফাতে লাফাতে হাজির হলো দিবাকরের সামনে। হৈ হৈ করে বলতে গেল যে দিবাকর যা যা বলেছিলেন সব কথা কেমন করে টিপু সত্যি হতে দেখেছে। কিন্তু দিবাকর ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “জলখাবার হতে এখন ঢের দেরি, চল বেনারস ঘুরে আসি, এখান থেকে এতো কাছে যখন।” টিপু জিজ্ঞেস করল, “কিসে যাবেন?” দিবাকর বললেন, “আমার গাড়িটায়। ওটা এনেছি যে। ওটায় প্রীতম আর আমাদের আরেক বন্ধু বসে আছেন। চল চল দেরি করিস না।” টিপুও অমনি মাধবীকুঞ্জের গেটে দাঁড়ানো দিবাকরের গাড়িতে উঠে বসল।
প্রীতম আর দিবাকর অনেক কথা বলাবলি করছিলেন। টিপু রাস্তা দেখছিল জানলা দিয়ে, ড্রাইভারের পাশে বসে। এই সময় দিবাকরের নাম-না-জানা বন্ধু হঠাৎ টিপুকে পিছমোড়া করে ধরে ওর সিটের ব্যাকটা ওর পিঠের সাথে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে বললেন, “এইবার কেমন লাগছে?” টিপু বলল, “আহ! ছেড়ে দিন। ছেড়ে দিন।” টিপু খুব বিরক্ত হতে লাগল, রেগে যেতে লাগল এই ভেবে যে তার চেঁচামেচি শুনেও প্রীতমদা আর দিবাকরদা কেন কিছু বলছেন না। টিপু শেষমেষ দিবাকর বা প্রীতম কি ভাববেন না ভেবে আঙুল পেঁচিয়ে আক্রমণকারির উরুর নিচে খিমচে দিল। অমনি “বাপরে! বাপরে!” বলে টিপুকে তিনি ছেড়ে দিলেন। ড্রাইভার অমিত-দাও গাড়িটা থামালেন। দিবাকর টিপুকে নিয়ে নেমে পড়লেন। আর প্রীতমদা সেই বন্ধুকে নিয়ে কোথায় ভিড়ে মিলিয়ে গেলেন। হাতের ব্যথা ছাড়াতে ছাড়াতে টিপু দিবাকরকে বলল, “ইনি আপনার কেমন বন্ধু স্যর?” দিবাকর বললেন, “ও একদম বাজে লোক, বাদ দে ওর কথা।”
ততক্ষণে গঙ্গার ধার ছেড়ে টিপুরা একটা গলিতে ঢুকে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখল একটা ছাউনিবিহীন টাঙ্গা রয়েছে গলির একপাশে। তার থেকে কয়েক হাত দূরে একটা রামছাগল কারুর ফেলে যাওয়া ফুলকপির ডাঁটা খাচ্ছে একমনে। দিবাকর হাঁকলেন, “কোই হৈ?” একজন দাড়িওয়ালা পাগড়িপরা বুড়ো মানুষ গলির ওপরের একটা দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। খুব যত্ন করে টিপুদের দুজনকে বসালেন টাঙ্গায়। তারপর সেই রামছাগলটাকে এনে টাঙ্গায় জুতে দিলেন। অমনি সে দৌড়তে কি লাফাতে শুরু করল ঠিক বুঝতে পারল না টিপু। শুধু কখনও রাস্তার ডানদিক দিয়ে তো তার পরমূহুর্তেই বাঁদিক দিয়ে ছুটে চলল টিপু, সঙ্গে দিবাকর। কখনও সে ভয়ে চোখ বন্ধ করে তো কখনও টাঙ্গার সিটখানা খামচে ধরে আড়চোখে চেয়ে দেখে দিবাকরের দিকে। দিবাকরের মুখে কিন্তু একটা প্রশান্ত হাসি লেগে আছে সারাক্ষণ। এই ভয়ানক গন্তব্যহীন যাত্রাতেও তিনি নিরুদ্বেগ। অদ্ভুত ব্যাপার রাস্তার গাড়িঘোড়ার ওলোটপালোট খেয়ে উল্টে পড়া দেখেও তিনি ভয় বা দুঃখ পাচ্ছেন না। রাস্তার লোকে রেরে করে তেড়ে এসে যাতা বলে যাচ্ছে, ইটপাটকেল ছুঁড়ছে তাতেও দিবাকর অবিচলিত চিত্ত। ছাগলের দোষ তো দূর ছাগলই কেউ দেখতে পাচ্ছে না, যত রাগ লোকে টিপুদের ওপরই দেখিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো একটা ইটপাটকেলও টিপুর গায়ে লাগছে না, একটা গালিও ও শুনতে পাচ্ছে না, কিন্তু টিপু নিশ্চিত জানে ইটপাটকেলের সাথে ছুঁড়ে দেওয়া শব্দ, বাক্য, বাক্যাংশগুলোয় কেউ আশীর্বাদ করে নি।
দুম করে ছাগলটা বাঁয়ে মোড় নিয়ে একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। টিপুর কেবল ভয় করতে লাগল এই বোধ হয় মাথাটা তার দেওয়ালে ঠুকে গেল; এই বোধ হয় হাতপা ছড়ে গেল। তারপর ছাগলটা দাঁড়িয়ে গেল। অমনি দিবাকর এক লাফ দিলেন আর খুব মৃদু স্বরে বললেন, “লাফা, টিপু।” টিপুও লাফাল। ততক্ষণে দিবাকরের কড়া নাড়ানাড়িতে গলির একটা দরজা খুলে গেছে। দরজার ওপর উপছে পড়ছে কয়েকজন হলদেটে তেলচিটে ধরে যাওয়া কোরা থান পরা ফোকলা বুড়িমানুষের মুখ। তাঁরা হেসে হেসে থুতনি নেড়ে নেড়ে বলছেন, “এখানে তো আজ কচুরি হয় নি, কেন এলে? বাড়ি যাও। আজ বাড়িতে কচুরি হয়েছে।” টিপু একটু ধাঁধায় পড়ল। কার বাড়িতে কচুরি হয়েছে? টিপুদের না দিবাকরের। কিন্তু দিবাকর কোনো মন্তব্য করলেন না। শুধু টিপুর হাত ধরে বললেন, “বাড়ি চল।” তারপর হাঁটতে হাঁটতে সেই গলির অন্য মুখেই এসে গেল মাধবীকুঞ্জ। L-এর মতো রকে পেতে রাখা খাবার টেবিলে টিপু আর দিবাকর বসে পড়তেই পাতে গরম গরম লুচি এসে গেল।
তখনই দিবাকরের ছেলে রিংগো এসে বায়না ধরল, “বাবা, আমাকে আজকের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বল।” তার পিছনে এসে পড়লেন দিবাকরের স্ত্রী, টিপুর মণিকাকি। তিনি দিবাকরকে খুব বকাবকি করতে লাগলেন কাউকে না বলে টিপুকে নিয়ে বিয়েবাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার জন্য। তার মধ্যে রিংগোর দিদি রিঙ্কি এসে টিপুকে বলল, “এই দেখ আমার পোষা মশা রক্তচোষা।” টিপু পাত্তাই দিল না। তখন রিঙ্কি আবার বলল, “আমাকে বাদ দিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করে এলে, রক্তচোষা তার প্রতিশোধ নেবে।” অমনি রক্তচোষা পুটুস পুটুস করে টিপুকে কামড়াতে লাগল। টিপুও কয়েকবারের চেষ্টায় রক্তচোষাকে মেরেই ফেলল। ফলে তার নিজের গালেই পড়ল এক বিরাশি শিক্কা চড়। রিঙ্কি ভ্যাঁ করে কাঁদছে কিনা শুনতে পেল না। সেটা ঢং ঢং করে ঘড়িতে নটার ঘন্টা পড়ার শব্দে বোধ হয় চাপা পড়ে গেল। চড়ের ঘোর কাটতে টিপু দেখল যে ও ঘড়ির সামনে বসেই আছে, সারা বাড়ি আলোয় ঝলমল করছে আর লুচি-ফুলকপির চচ্চড়ির গন্ধে ম-ম করছে। ও আরও টের পেল যে ওর চারপাশে অনেক মশা ভিড় করে ভনভন করছে। তার মধ্যে থেকে মার গলা পেল টিপু, “এবার এক্কেবারে খেয়ে নিয়ে ঘুমোতে যা।”