দুর্গাপূজা। চারিদিকে মেলা বসেছে। তবে এখনও বেশি ভীড় নেই।
আমরা চারজন যাব বলে ঠিক করেছি। তালিম, কেসর, দন্তিন আর আমি। আমরা ছোটবেলার বন্ধু। যদিও আগে একই স্কুলে পড়তাম, কিন্তু এখন আলাদা-আলাদা স্কুলে পড়ি।
যেদিন মেলায় যাব, তার আগের দিন আমার বাড়িতে চারবন্ধু রাত্রে একসাথে বসে খাওয়ার সময় শুরু হল পূর্বপুরুষের দেখা পাওয়া নিয়ে আলোচনা। আমি এ ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নই। তিন বন্ধুতে কিন্তু ভালোমতো আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। একসময় আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, 'দুত্তোর। পূর্বপুরুষদের দেখা পাওয়া যায় নাকি? বন্ধ কর তোদের এইসব অর্থহীন আলোচনা।'
— 'Your কথার meaning?' বলল কেসর।
— রেগে গিয়ে বললাম — 'আঃ! কেসর, হয় বাংলা বল, নয় ইংরাজী। আমার আর ভালো লাগছে না।'
পরদিন। মেলায় যাবার জন্য তৈরি হলাম। মেলা কাছেই। যেমন ভেবেছিলাম, ভীড় নেই।
এক ভদ্রলোক, আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেখানেই যাচ্ছেন। 'টয় ট্রেন'-এ চড়বো, হঠাৎ টিকিট কাটার জায়গা থেকে একটা শোরগোল শোনা গেল। যে ভদ্রলোকের কথা বলছিলাম, তিনিও ট্রেনে চাপবেন। কিন্তু কোনও কারণে একটা টাকা কম পড়েছে। তাঁর কাছে আর খুচরো টাকা নেই। শুধুমাত্র একটি পঞ্চাশ পয়সা আছে। আমি তাড়াতাড়ি এসে এক টাকা দিয়ে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম। ভদ্রলোক ভারি স্নেহের সঙ্গে আমার মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন।
এবার আমার তাঁর দিকে বিশেষ করে নজর গেল। ভদ্রলোক আমাদের থেকে বয়সে অনেক বড়। দীর্ঘ দেহ, গৌরবর্ণ, ঘন কালো বাবরি চুল কাঁধের উপর ঝরণার মতো এসে পড়েছে। পরনে ধুতি আর চাদর। তবে, আমার মনে হল সে ধুতি পরার ধরন কয়েক যুগ আগেকার। এখনকার চলতি ধরনের সঙ্গে তার মিল নেই।
তিনি আর আমি প্রথমবার চড়ে ঘুরে এলাম। তারপর আমার বন্ধুরা গেল। আমরা দুজন এগোলাম অন্যদিকে।
— 'আপনার নাম?' জিজ্ঞেস করলাম আমি। ভদ্রলোক সে কথার উত্তর না দিয়ে বললেন— 'আশ্চর্য! এত বছর হয়ে গেল, অথচ মেলায় এসে এগুলি চড়বার শখ আজও আমার মেটেনি।'
আমি চমকে উঠলাম। ভদ্রলোকের গলা যে খুব চেনা! কিন্তু সেই চেনা গলাটি কার?!
—'আপনি থাকেন কোথায়?' জিজ্ঞাসা করলাম।
—'নাও। মিষ্টি খাও।' বলে মিষ্টির একটি বাক্স এগিয়ে দিলেন।
আশ্চর্য! যতবার তাঁর সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করছি, ততবারই অন্য কথা দিয়ে সেটিকে তিনি চাপা দিচ্ছেন। তবে তিনি যে মিষ্টি দিলেন, তাতে আমি অবাক হলাম। সেইসময় আমার মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল।
ঘুরন্ত চাকিতে চড়ার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। কিন্তু সেটিকে যেভাবে ঘুরতে দেখেছি, তাতে আমি ভয়ে সেটাতে চড়তাম না। কিন্তু এবারে তাঁর সাথে সেটাতে নির্ভয়ে চড়তে পারলাম। আমার মনে হল, আমি যেন স্বপ্ন দেখছি। এবারেও আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে বললেন, 'না। তুমি সত্যিই মেলায় আছো।' যেন তিনি আমার মনের কথা বুঝতে পারলেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস হল না। হাতে চিমটি কেটে বুঝলাম, তিনি ঠিক বলছেন।
—'কিন্তু সবকিছু এরকভাবে ...' - আর বলা হল না। নিজের উপর থেকে তাঁর দিকে নজর সরাতেই দেখতে পেলাম, তিনি কাছে-পিঠে কোথাও নেই। তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা। তাদের এইসব কথা বলতে বুঝতে পারলাম, তারা আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে সন্দেহ করছে।
—'কী বলছ তুমি?' - বললো দন্তিন - 'তুমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছিল।'
আমার কিন্তু তা মনে হল না। আমার মনে হল - তিনি যেন শূন্য থেকে এসেছিলেন, শূন্যতেই তাঁর অস্তিত্ব ছিল, আবার শূন্যতেই তিনি মিলিয়ে গিয়েছেন।
পূর্বপুরুষ!! —বিদ্যুতের মতো কথাটি আমার মাথায় খেলে গেল। এই কথাই না আমি বিশ্বাস করছিলাম না কাল রাত্রে?