শচীন সেনগুপ্তের নাট্যভাবনা ও সমাজচিন্তা; শম্পা ভট্টাচার্য; প্রথম প্রকাশ : ২০০৮, সাহিত্য সঙ্গী - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ১১২ ; ISBN :
পেশায় অধ্যাপিকা ড. শম্পা ভট্টাচার্যের ভালোবাসার জায়গা নাটক। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি নানা পত্র-পত্রিকায় নাট্য বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে আসছেন। থিয়েটারপ্রেমী মানুষের কাছে তাঁর অনেক প্রবন্ধই গ্রহণীয় হয়েছে। শম্পার প্রথম গ্রন্থ 'শচীন সেনগুপ্তের নাট্যভাবনা ও সমাজ চিন্তা'। বাংলা নাট্যসাহিত্যে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত নিঃসন্দেহে এক শক্তিশালী, জনপ্রিয় নাটককার। বিশেষ করে তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সে তুলনায় তাঁর সামাজিক নাটকগুলি দর্শক - পাঠকের কাছে তেমনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তার একটি অন্যতম কারণ হল এই যে, গণনাট্যের আদর্শে বিশ্বাসী এই নাটককার পাঠক, দর্শকের মনকে জাগাতে চেয়েছিলেন তাঁর নাটকের মাধ্যমে। তাদের মনের জোগান দিতে তিনি নাটক লেখেননি। বৃহত্তর সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবেই তিনি নাট্য-আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। নাটককে হাতিয়ার করে মানুষকে সচেতন করতে চেয়েছেন। ফলে তাঁর সামাজিক নাটকগুলিতে উঠে এসেছে - কুমারী জীবনে মাতৃত্বের সমস্যা, দাম্পত্যজীবনে নারী-পুরুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দ্বন্দ্ব, নারীস্বাধীনতার সুস্পষ্ট রূপ, সমাজ জীবনের নানা ভাঙন, ভণ্ড দেশপ্রেম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সার্বিক অবক্ষয় ইত্যাদি দিকগুলি। দর্শক-পাঠক আকর্ষণের মশলাগুলিকে তিনি সযত্নে পরিহার করেছেন তাঁর নাটকে। তাঁর সামাজিক নাটকগুলি সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে বাংলা নাট্যসাহিত্যে অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়েছে।
শচীন সেনগুপ্তের সামাজিক নাটকগুলি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা চোখেই পড়ে না। এমন কি নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতারা এই ব্যতিক্রমী নাটককারের জন্য খুব অল্প পাতাই খরচ করেছেন। সেদিক থেকে বিচার করলে ড. ভট্টাচার্য একটি অসাধারণ কাজ করেছেন। গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় ড. জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সঠিকভাবেই লিখেছেন — '... শচীন সেনগুপ্তের প্রথম সার্বিক মূল্যায়ন বললে অত্যুক্তি হয় না। এ গ্রন্থ শচীন সেনগুপ্তের কৃতকর্মের বিচার করে তাঁর জীবন স্বভাবের সদ্য সচেতন প্রগতিশীল অভিমুখটিকে এমন নিপুণতায় ধরিয়ে দিয়েছে যাকে প্রায় আবিষ্কার বলা যায়।' চারটি অধ্যায়ের মধ্যে শম্পা তাঁর আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেছেন। ১৯১৪-১৯৬০ পর্যন্ত বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাধারায় সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে নাটককার শচীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের পশ্চাৎপটকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন প্রথম অধ্যায়ে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের বিষয় - শচীন সেনগুপ্তের নাট্যব্যক্তিত্ব ও তৎকালীন সাংস্কৃতিক - রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে ভাব বিনিময়ের সূত্র সন্ধান। শচীন সেনগুপ্ত তাঁর সময়ে অনেক পত্র-পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। সাংবাদিকতার সূত্রে তিনি হয়তো অনেক ঘটনাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। যেগুলি তাঁর নাট্য রচনায় রসদ যুগিয়েছে - এই দিকটিও নজর এড়ায়নি শম্পার। তৃতীয় অধ্যায়ে রঙ্গালয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। খুব সংক্ষেপে হলেও এই অধ্যায়ে শচীন সেনগুপ্তের চিন্তা-চেতনায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর সামাজিক নাটকগুলি কেন রঙ্গমঞ্চগুলিতে তেমনভাবে সাফল্য পেল না এর অনুসন্ধান জরুরি ছিল। শচীন সেনগুপ্তের সামাজিক নাটকগুলির বিভিন্ন দিক নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে চতুর্থ অধ্যায়ে। বহু জিজ্ঞাসায় ঋদ্ধ শচীন সেনগুপ্তের সামাজিক নাটকগুলি আজ ইতিহাস। আর ইতিহাসে সামাজিক নাটককার শচীন সেনগুপ্তের অবস্থান নিয়ে সামগ্রিক মূল্যায়ন করেছেন শম্পা ভট্টাচার্য আলোচ্য গ্রন্থে। গ্রন্থটি ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক ও থিয়েটারকর্মীদের অবশ্যই পাঠ্য ও সংরক্ষণযোগ্য।
থিয়েটারের রেখাচিত্র; শম্পা ভট্টাচার্য; প্রথম প্রকাশ : রবীন্দ্রজয়ন্তী, ২০১১, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ১৭৬ ; ISBN : 978-81-89827-76-2
শম্পা ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় গ্রন্থ 'থিয়েটারের রেখা চিত্র' — মোট বাইশটি নাট্য-প্রবন্ধের সংকলন। লেখিকার নিজের ভাষায় — 'বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গত তেইশ বছর ধরে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধগুলি থেকে এই সংকলনের জন্য কয়েকটি রচনা নির্বাচন করা হয়েছে।' এই নির্বাচনে পূর্বোক্ত গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ের প্রবন্ধ 'রঙ্গালয় সংযোগ ও শচীন সেনগুপ্তের নাট্যভাবনা' অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কেন করা হয়েছে, সে বিষয়ে প্রাবন্ধিক আমাদের সচেতন করেননি। তিনি নিজেও হয়তো এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন না। আমাদের মনে হয়েছে, শুধুমাত্র প্রবন্ধের সংখ্যা কিংবা গ্রন্থের বহর বাড়াতে প্রবন্ধটি নির্বাচন করা হয়েছে। না করলেও গ্রন্থের মান তাতে বিন্দুমাত্র হ্রাস পেত না। কেননা, এ গ্রন্থের অনেকগুলি প্রবন্ধই গবেষণাধর্মী ও মূল্যবান। নাট্যমঞ্চ, নাট্যকার ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সম্পর্কে অনেক অজানা কথা আমাদের শুনিয়েছেন, 'তারাসুন্দরী : বাংলা থিয়েটারের উপেক্ষিত প্রতিভা', 'বাংলা থিয়েটারে কোনও সত্যজিৎ রায় ছিলেন না' (তুলসী চক্রবর্তী সম্পর্কে বলা হয়েছে।), 'অভিনেতার ভূমিকায় অভিনেত্রী', 'স্বর্গের পাখি ঘরে ফিরে গেল' (সুশীলাবালাদেবী সম্পর্কিত), 'তৃপ্তি মিত্রের ছোটগল্প', 'অভিনয়ে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা', 'একালের স্টার থিয়েটার', 'উদভ্রান্ত সময় ও স্টার থিয়েটার', ইত্যাদি প্রবন্ধগুলি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
নাট্যব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে নানা প্রসঙ্গ, অভিনয়ের পর্যালোচনা, থিয়েটারের ভিতর ও বাইরের নানা নেপথ্য কাহিনি এ-গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। বাংলা নাট্য-ইতিহাসের নানা ক্ষেত্রে অনেক সময় সেভাবে আলো পড়ে না। নাট্য ইতিহাসের এরকম অনালোচিত দিকগুলি সম্পর্কেও তিনি আমাদের অবহিত করেছেন। যেমন আলোচ্য গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ 'শহীদের ডাক'। গণনাট্য সংঘের ছায়াভিনয় শহীদের ডাক' সম্পর্কে তিনি বিস্তৃত আলোচনা করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। ইন্দোনেশিয়ার নানা প্রান্তে ও দক্ষিণ ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই ছায়াভিনয়ের প্রচলন ছিল। গণনাট্যের প্রযোজনায় শিল্পীরা ছিল মানুষ - পুতুল নয়। এখানে সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি প্রাধান্য পেয়েছে। শম্পার অনুসন্ধানী দৃষ্টি সেদিকেই আলোকপাত করেছে। গণনাট্যের যুগান্তকারী প্রযোজনা 'রাহুমুক্তি' নিয়ে তিনি বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তৃপ্তি মিত্র অভিনেত্রী ও পরিচালিকা হিসেবে থিয়েটার জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তিনি যে অসামান্য কয়েকটি ছোটোগল্প রচনা করে আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন - এই সংবাদ আমরা ক'জন রাখি? শম্পা তৃপ্তি মিত্রের ছোটোগল্পের বই 'এই পৃথিবী রঙ্গালয়' নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। যুক্তি-তর্কের সহযোগে, তথ্যের সমাবেশে লেখিকা প্রমাণ করেছেন যে, তৃপ্তি মিত্রের জীবনের নানা ছোটোখাটো সমস্যা, ঘটনাগুলি তাঁর মনের পরতে পরতে যে রঙ ও রূপ লাভ করত, তাই তাঁর কলমে গল্পের ছোটো কুঁড়ি হয়ে ফুটে উঠতো। অমরেন্দ্রনাথ রায়ের নাট্যপত্রিকা 'রঙ্গদর্শন' ও ব্যোমকেশ রায়চৌধুরীর নাট্যপত্রিকা 'নটরাজ'-কে ঘিরে কিংবা গিরিশচন্দ্রের 'বুদ্ধদেব চরিত' নিয়ে লেখা দুটি প্রবন্ধ এবং রবীন্দ্রনাথের 'মালিনী' নাটকের গঠনকৌশল ও নাট্যপরিণতি নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলিও বেশ সুখপাঠ্য। 'বটতলার প্রহসন ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ' ও 'বটতলার সাহিত্য ও কলকাতার তৎকালীন মুসলমান পাঠক সমাজ' সুচিন্তিত ও বিষয়ভাবনার নতুনত্বে অসাধারণ। থিয়েটারের হ্যাণ্ডবিল সংক্রান্ত প্রবন্ধ 'থিয়েটারের হ্যাণ্ডবিল: স্বদেশে ও বিদেশে' খুবই উচ্চমানের প্রবন্ধ। বিদেশে ও এদেশে সেকাল ও একালের থিয়েটারের হ্যাণ্ডবিলের ইতিহাস ও বিষয়কে সুচারুরূপে পরিবেশন করা হয়েছে। তবে সেকাল ও একালের, দেশ ও বিদেশের থিয়েটারের হ্যাণ্ডবিলের কয়েকটি ছবি থাকলে প্রবন্ধটি আরও উন্নতমানের হতো। পাঠক হিসেবে আমরাও উপকৃত ও সমৃদ্ধ হতাম। সব মিলিয়ে থিয়েটারের রেখাচিত্রকে সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক করে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন শম্পা। দুটি গ্রন্থেই শম্পার থিয়েটার প্রেম ও সাধনার ছাপ স্পষ্ট। 'থিয়েটারের রেখাচিত্র' গ্রন্থের সুদেষ্ণা ব্যানার্জীর প্রচ্ছদ গ্রন্থের মান বাড়িয়েছে। আগামীদিনে শম্পা ভট্টাচার্য আরও উন্নতমানের গ্রন্থ আমাদের উপহার দেবেন - এই আশায় রইলাম।