'পুরুলিয়ার লালমাটি, রূপে-গুণে পরিপাটি........ মঞ্চে তখন কোনো এক ঝুমুরশিল্পী বড় দরদ দিয়ে গাইছেন এ গান। এ কলি শুনে আপনার বুকটা আনচান করবেই। হৃদয় যদি খুব রুখা-শুখা, টুটা-ফুটা হয়, সেথায় একটা ছলাৎ ছল্ ঢেউ উঠবেই! সৃজনভূমিতে তখন যে দামামা বেজেছে। কাড়া-আকাড়া বাজিয়ে, ধামসা-মাদলের দম্দমাদম আর ভেঁপুতে পোঁ তুলে ঘোষণা হচ্ছে, শুরু হল 'সৃজন উৎসব'। তিনদিনের এক মহতী উদ্যোগ। মানুষে মানুষে মিলনের এক মহাসংগম। অপরূপ এক নৈসর্গিক পরিবেশে প্রকৃতির উদার উন্মুক্ত এক আঙিনায় এ এক যথার্থ ভারতীয়তার উৎসব — সৃজন উৎসব!
তিথি ধরে প্রতিবছর তিনদিনের এই উৎসব শুরু হয় রাসপূর্ণিমায় (কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমার ঠিক পরের পূর্ণিমায়)। এই মেলা ১৮ বছর পার করে এ বছর রাসপূর্ণিমায় (১৭-১৯ নভেম্বর, ২০১৩) উনিশে পা ফেলবে। 'পুরুলিয়া আদিবাসী লোকসংস্কৃতি কেন্দ্র'র উদ্যোগে প্রতিবছর আয়োজন করা হয় বাংলার এই বৃহত্তম পার্বত্যমেলা সৃজন উৎসব। এ মেলার প্রাণপুরুষ তথা উৎসব সম্পাদক সৈকত রক্ষিত। সৃজনমেলা মূলত লোকসংস্কৃতির মেলা। লোকসংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার এর অন্যতম উদ্দেশ্য। পুরুলিয়ার ছৌ, ঝুমুর, টুসু, ভাদু, করম থেকে শুরু করে আমাদের দেশজ-গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির বাউল-ফকির, পদাবলী কীর্তন, মনসামঙ্গলের পালাগান, ভাওয়াইয়া-চটকা-জারিসারি গান, মারফতি গান, হাসনরাজার গান, লালনের গান, জীবন-উজ্জীবনের গান, আদিবাসীদের নাচ-গান-যাত্রাপালা এবং প্রতিবেশী ভিন্ রাজ্য (আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, নাগাল্যাণ্ড, গুজরাট, রাজস্থান) থেকে আসা হরেকরকম চোখ ঝলসানো লোকসংস্কৃতির অনুষ্ঠান তো আছেই। তাই পুরুলিয়া শহরে তখন পা ফেললেই আপনার চোখে পড়বে মেলার তোরণ, মেলার পোস্টার। সেখানে ঝলমল করছে এমন সব কথার ঝিকিমিকি, 'আসিল সৃজন হিক্কিড় গিদিং বাজিছে মাদল! ঝমর ঝমর বাজে করতাল' কিংবা কোথাও উঁকি মারছে, 'পাহাড়ে পাহাড়ে দুন্দুভি, হৃদয়ে তার প্রতিধ্বনি! সৃজন উৎসব মানেই শৃঙ্গ বিজয়!' এসব দেখে-পড়ে মন তো পুলকিত হবে। উড়ু উড়ু হবে তো এবার আপনি ঝপাং করে বাসস্ট্যাণ্ড থেকে মানবাজারগামী একটা বাসে লাফ মেরে উঠে পড়ুন দেখি। ওমা! সেখানেও গুন গুন করছে এক দুষ্টু রসিক, 'বঁধু, তুমার সঙে সৃজনমেলায় রঙিলা লাচ লাচিব! টুঙুল টুঙুল বাজনা বাজিবেক! টুঙুল বাজনা বাজিবেক!.... বাসে লাফ মেরে তো উঠলেন। 'ছিট' কি পেলেন? জানলার ধারে যদি বসতে পেলেন তো জয় দুগ্গা! অই শোনঅ কে আবার গুন গুন করে, 'বাস তো ছাড়িলো, কনডাকটার উঠিলো। চলো এবার সৃজনমেলায় যাই, তুমি-আমি একসাথেতে গাই ..... মাঠ-ঘাট-পথ-প্রান্তর, লালমাটির ধুলো উড়িয়ে বাস তো ছুটছে। পথের দু'পাশে কত না নয়ানজুলি। ছোট্ট ডোবা। গভীর দীঘি। সেখানে লাল শালুকের ফুল। জল ফড়িং-এর ওড়াওড়ি। আর অঘ্রাণের পাকা ফসলে ক্ষেত ভরে আছে। এসব দেখতে দেখতে এ যাত্রায় আপনার চোখ জুড়োবে। মন ভরবে। বাস এসে একসময় থামবে মানবাজার। এখানে সে ক্ষণিক জিরোবে। আপনি তো মেলার মানুষ। এই ফাঁকে টুকুস করে নেমে পড়ুন দেখি। 'এ-গাড়ি যাবে না, আমি অন্যগাড়ি নেব, হেই রোখও....' মনে পড়ছে এক নাগরিক কবিয়ালের এই গান। পড়ছে না? আরে সলিল কবিয়াল গো! তুমাদের সলিল চৌধুরী। 'আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা, আর কতকাল আমি রব দিশাহারা.....' না, না রসিক, হেথায় তুমায় কেউ প্রশ্ন করার নেই, কুথা হোতে আসিছো? কেন আসিছো? কুনও মতলব আছ্যে নাকি গো? এখানে সবাই স্বাগত। মোস্ট ওয়েলকাম! এসো হে, বসো হে। পান-সুপারি খাও হে। দুটো নাচ-গান দেখো হে.... এ হামাদের সৃজনমেলা গো। বন্ধু, তোমাকেও চাই! ওই দ্যাখঅ আবার কানা বাউল কেমুন গাইছে, 'হামি নাই জানি নাই জানি সখি, কথায় বৃন্দাবন গো / যেথায় দেখি বাগালছ্যেলা সেথায় ঘুরে মন / হামার এই ত বৃন্দাবন গো, সৃজন বৃন্দাবন!' তা বাপু, এবার তো এক অন্যগাড়িতে চড়তে হবে। চলো হে পথিক, আগে চলো। ওই শুনঅ আবার, বাতাসে গান ভাসছে, 'চলো মন ভ্রমণে, কৃষ্ণ অনুরাগীর বাগানে'। এবার তুমি বান্দোয়ানগামী কোনো একটা বাসে উঠে পড়। কাঁধের ঝোলা-ঝুলি সামলে হয়তো একটু হুটাপুটি করে উঠতি হতি পারে। মানুষে-মানুষে গা ঘষাঘষি হবে। চোখে-চোখে চাউনি হবে। ঝিলিক হবে! তা এট্টু হউক। তোমরা দুজনাই যে মেলার মানুষ। ধুলো মাখতে বেরিয়েছো। বাস তো ছুটছে। গ্রাম, নদী, জঙ্গল, প্রান্তর পেরিয়ে ছুটছে। রাস্তার দু'পাশে সব গ্রাম। রাঙানো উঠোন। ঘরের দেওয়ালে কত চিত্রকলা। আদিবাসী গ্রাম গো সব। দু'পাশের প্রকৃতিও বড় সুন্দর। পলাশের জঙ্গল। উদার মাঠ। ধূ-ধূ প্রান্তর। আকাশটাও যেন বড় বেশী নীল। একদম পলিউশন ফ্রি! ওই শুনঅ আবারও গান, 'পাগলের সঙ্গে যাব, পাগল হব সৃজনমেলায়.....' বাস তো এসে থামল খড়িদুয়ারা-কুমারীগ্রাম। নামো। নামো শিগ্গির। এই তো মোদের সৃজনভূমি। টিলা-ডুংরি-মাঠ-জঙ্গল দিয়ে ঘেরা আমাদের মেলা সৃজনমেলা। ওই তো পাতা দিয়ে বানানো তোরণ দেখা যাচ্ছে, 'বন্ধু, এসো হে, আসিল সৃজন! হিক্কিড় গিদিং বাজিছে মাদল.....' লাজুক লাজুক পায়ে আগে ঢুকে তো পড়অ মেলায়। এবার চোখজোড়া দাও ছড়িয়ে চারপাশে। ওই দেখ, টিলার চূড়ায় চূড়ায় মঞ্চ! ওই আমাদের শৃঙ্গবিজয়! আহা, কি সব নাম এক একটা মঞ্চের। সবার উপরে ওই দেখা যায় একদম চাঁদের কাছাকাছি যে মূল মঞ্চ তার নাম - 'মহেন্দ্র শিল্পপীঠ'। আর একটু দূরে পলাশের জঙ্গলে যে মঞ্চ তার নাম 'কিষ্কিন্ধ্যা শিল্পপীঠ'। একদম নীচে, টিলার পাদদেশে ধুলোমাখা ভূমিতে মুক্তমঞ্চ 'চিত্রকূট শিল্পপীঠ'। তুমি দেখো না কত দেখবে মেলা। এ মেলা এক সব পেয়েছির মেলা। তিন মঞ্চে তিনরকম অনুষ্ঠান একই সঙ্গে হচ্ছে। তুমি যদি ছুটতে পারো, দৌড়ে দৌড়ে টিলায় উঠতে পারো, বুকে হাঁপ না ধরে, দমে যদি ঘাটতি না থাকে, ছোটও, দ্যাখঅ, হৃদয় জুড়াও। চোখ সার্থক হবে। দিল দিওয়ানা হবে! নিজেকেই নিজে গুণ গুণ করে বলবে, 'এমন মানব জনম আর কি হবে? মন যা কর ত্বরা কর এই ভবে!....' তিনরাত্রির এই মেলায় প্রায় তিনলক্ষাধিক লোকের মিলনমেলা হয়ে ওঠে এই সৃজনভূমি। আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা হবে আপনার। চোখকে বিশ্বাস করাতে হলে আপনাকে একবার আসতেই হবে। এ মেলা দিনে শুনশান, রাতে হাজারো গান। সারারাত ধরে চলছে উৎসব। আসছে মানুষ। আসছে গাড়ি। মেলার একমাত্র পাহারাদার মাথার ওপরের মস্ত বড় ওই চাঁদটা। রাসপূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদ তো নয় যেন এক পাঁচকেজি চিনির গোল বাতাসা। তার জোছনা কি মিষ্টি কি মিষ্টি! হামাগুড়ি দিয়ে যেন পিঁপড়ের মতো হেঁটে যায় কত কত মানুষের ঢল সে চাঁদের দিকে। চাঁদের আলোয় ধুয়ে যায় সারা সৃজনভূমি। আলোয় মেতে যায় মানুষজনেরা। 'আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবনভরা' এ হল সেই আলো! গ্রাম-গ্রামান্তর, মাঠ-ঘাট-প্রান্তর পেরিয়ে মানুষ ক্ষেত-খামারে ধান ফেলে রেখে ঘরে আসা কুটুমকেও সঙ্গে নিয়ে আসে তিনদিন ধরে। কত কত শিল্পী। কত বিচিত্র নাচ-গান-বাদ্যবাজনা। হেথায় রবিঠাকুরও থাকেন! তাঁর কীর্তনাঙ্গের গান মোহিত করে দেয় হেটো-মেঠো মানুষগুলোকেও!