বেশ অনেকক্ষণ একলা বসে আছে অদিতি। এই নদীর ধারে এমন একা একা বসে থাকতে আজকাল ভালই লাগে। চোখ তুলে তাকালেই অসংখ্য নারকোল আর দেবদারু গাছ। গাছে গাছে অসংখ্য পাখি। টিয়া, চড়াই, ময়না, ঘুঘু, মুনিয়া, শালিখ। নদীর জলে নানা রকমের মাছরাঙা, বেলে হাঁস, বুনো রাজহাঁস, বক। দৃষ্টিনন্দন সবুজ রাজকীয় পায়রা। সাদা-লাল-হলুদ রংয়ের বক। আরো আছে। বুলবুল, শ্যামা, কোকিল। ছোট বড় নানা আকৃতির পেঁচা। বড় বড় দেবদারু গাছের ডালে ডালে পাখির বাসা। গাছের ওপর নিশ্চিন্তে রাত কাটায় পাখি।
নদীতে বাঁধ দিয়ে বিশাল যে জলাশয়, তার পাড় ঘেঁষে বসে থাকে বিশাল আকৃতির হাড়গিলে, মদনটাক। আকাশ জুড়ে নানা রকমের চিল। বসে থাকতে থাকতে রোজই মনে হয় অদিতির, তাহলে কি আমাদের দেশের পাখিরা সব এই দ্বীপে এসে ঘর বেঁধেছে!
পক্ষী বিশারদ হবার কথা নয়, অদিতি অত পাখি চেনেও না। গৌতম চিনিয়ে দিয়েছে। এখানে থাকতে থাকতে বুনো জারোয়াদের মতই হয়ে গেছে ও। কলেজের সেই উচ্ছল উজ্জ্বল ছেলেটা, কলেজ সোশাল মাতিয়ে রাখা ছেলেটা, রাতভর পার্টি মস্তি হৈহৈ। এখানে এসে নীল নদী, নীলচে সবুজ পাহাড় আর ঘন সবুজ জঙ্গলে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। উচ্ছলতা না-ই থাক, উজ্জ্বলতাটা অবশ্য আছে। সারাদিন পর কাজ থেকে ফিরে এসে সেই উজ্জ্বল চোখ মেলে রোজই জিজ্ঞেস করবে, ‘কি দিতি, দারুণ লাগছে কিনা। কি বলেছিলাম?’
প্রথম প্রথম বোঝাবার চেষ্টা করেছে অদিতি। না, ভালো লাগছে না। একঘেয়ে নিস্তরঙ্গ জীবন। ভালো লাগছে না অদিতির। গৌতমেরই কি ভালো লাগার কথা! বন্ধুরা কেউ আর দেশে পড়ে নেই। পৃথিবী এখন গ্লোবাল ভিলেজ। আলো আলো মুখে উজ্জ্বল হেসেছে গৌতম, ‘তাই তো। এক্কেবারে মানানসই ব্যবস্থা। এমন ভিলেজ আর কোথায় পাবে তুমি! আর .. নিস্তরঙ্গ বলছ! রোজ নদীর ধারে চলো একবার।‘
অভিমানও করেছে, ‘একদিনও অফিসে এলে না তুমি। একবার যদি ইনস্ট্রুমেন্টেশন দেখতে এখানের! তোমার তো খুব ইন্টারেস্ট ছিল দিতি। কিভাবে সফটওয়্যার ডেভেলপ করেছি, তুমি তো জানো।' ছিল। ইন্টারেস্ট তো ছিলই।
‘দু’বছর দিতি। হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রোজেক্ট। সফটওয়্যার ডেভেলপ করব এক্কেবারে একা হাতে। চিফ সার্কুলারে বলে দিয়েছেন সবাইকে। এমন একটা রেকগনিশন। এমন একটা কাজ। ছেড়ে চলে যাব! এখনই চলে যাব বাইরে! বিদেশ যাবার অফার তো আবার আসবে। যে কোনো অফিস থেকেই আসবে।'
‘আর আমি! আমি যে গোটা এক বছরের জন্যে প্রাগ চললাম এখন। তাহলে কি ছেড়ে দেব চাকরিটা?’
‘কেন? তুমি চাকরি ছাড়বে কেন? ঘুরে এসো। সুমি আর তিমিরও তো যাচ্ছে। আমার এখনই বিদেশ যাবার ইচ্ছে নেই। আমি তো আর গোটা জীবনের জন্যে আন্দামানে নির্বাসনে যাচ্ছি না।'
খুব হেসেছিল দুজনেই। দুই বাড়িতেও তেমন আপত্তি হয় নি। আজকের দুনিয়ায় এমন লং-ডিসটেন্স দাম্পত্যের ছবি চোখে সয়ে এসেছে। মনেও।
ডেইলি অপারেশন থেকে ইন্সট্রুমেন্টেশন। ব্রেক-ডাউন মেন্টেনেন্স থেকে প্রিভেন্টিভ মেন্টেনেন্স। কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট থেকে নলেজ ম্যানেজমেন্ট। একের পর এক সফটওয়্যার ডেভেলপ করেছে গৌতম। কোম্পানি খুশি। গৌতম আরো খুশি।
‘ক্রিয়েটিভ চ্যালেঞ্জটা নিতে পেরে বেশ লাগছে দিতি।‘
অদিতির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে কতবার। কখনো নতুন আইডিয়া। কখনো একটা আইডিয়া বদলে ফেলা। কখনো ডিজাইন ক্যালকুলেশন। কখনো ফেলিওর মোডে অ্যানালিসিস। ফোনে। স্কাইপে। ছুটিতে কলকাতার বাড়িতে এসে। ইন্টারেস্ট তো ছিলই। সহপাঠী গৌতমের ওপর গভীর আস্থাও। যে আস্থা আর বিশ্বাসের জোরে একদিন যুগল জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত। ইন্টারেস্ট ছিলই।
কিন্তু আজ সত্যিই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে অদিতি।
বড্ড বদলে গেছে গৌতম। এই গৌতমকে ও চেনে না। মজা করে বলেছিল একদিন, আন্দামানে নির্বাসনে যাচ্ছি না। কোন কথাটা যে কোথায় কিভাবে লেগে যায়! এখন মনে হয়, সত্যি সত্যি এক নির্জন নি:শব্দ তন্ময়তায় স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়েছে ও। আর সেইজন্যেই আন্দামানের সেলুলার জেলের অসংখ্য বন্দীদের মত কারাবাস চলছে অদিতিরও।
প্রথম প্রথম কম ঝগড়া হয় নি। ‘এমন করে সব বদলে দিচ্ছ কেন? সব স্বপ্ন, সব আশা, জীবনের গতিপথের চেনা ছক। কেন গৌতম? কেন?’
‘বদলে যাওয়া তো ভালো, না দিতি? পরিবর্তনই জীবনের নিয়ম।’ গৌতম তর্ক করেছে।
‘বদল যদি উত্তরণের জন্যে হয়, সেটা ভালো। তুমি তো তা করছ না। কি ব্রাইট কেরিয়ার ছিল তোমার। এইখানে এসে সব নষ্ট করে দিচ্ছ! নিজের জন্যে না হোক, আমার কথা ভেবেও তো ...’ কথা শেষ করতে পারে নি অদিতি। কান্না এসে গেছে।
তাতে অবশ্য হেলদোল হয় নি গৌতমের। বদলে গেছে ও। দিতি হেঁটে গেলেও পদ্মফুল ফুটে ওঠা দেখত যে, আজ দিতির চোখের জলে আস্ত একটা পদ্মপুকুর হয়ে উঠলেও দেখতে পায় না সে। পুকুরে আর মন নেই গৌতমের, মনপ্রাণ জুড়ে আছে অন্য একটা নদী। আর সেই নদীতে একটা প্রোজেক্ট।
‘কেমন মনে হয় জানো? নদীটা যেন রূপকথার রাজকন্যা। ঘুমিয়ে ছিল এতদিন। কত যে সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল। রূপোর কাঠি ছুঁইয়ে ওর ঘুম ভাঙানো হয়েছে। জেগে উঠে আর তর সইছে না। নিত্যি নতুন সাজ চাই এখন ওর। নিত্যি নতুন রূপকথা। ভাবতেই ভালো লাগে, জানো দিতি? এই রূপকথার সাক্ষী আমি। এই নদীটার কর্মযজ্ঞে আমারও একটু ক্রিয়েটিভ অবদান রইল।'
‘কি এমন ক্রিয়েটিভ কাজ। আর নতুন কি ক্রিয়েটিভ কাজ করবে তুমি আর! এই তো হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রোজেক্ট। কিই বা স্কোপ আছে এ কাজে। থার্মাল প্রোজেক্ট হলেও বুঝতাম।’ অদিতি তর্ক করেছে।
ঠাণ্ডা মনজুড়োনো হাওয়া। মস্ত একটা বাঁধ দেওয়া হয়েছে নদীতে। বাঁধ দেবার জন্যে কাপলং নদীর গতিপথ খাল কেটে বদলে দেওয়া হয়েছে। দূরের সেই শাখানদীটার বুকে সকালের সূর্যের সোনালী আলো। চোখ তুলে সেইদিকে তাকালো গৌতম। আর অমনি আলোটা ঝিলিক দিয়ে উঠল গৌতমের চোখ জুড়ে। আর তর্ক করে নি গৌতম।
দু’পাশে পলিমাটি ছড়িয়ে পাথুরে শিরদাঁড়া শিথিল করে এঁকেবেঁকে চলছে নদী। আপন মনে। তবে আপন বেগে পাগলপারা নয়। মানুষ ওকে বেঁধে ফেলেছে। নদী নয়, ও যেন এক বন্দিনী রাজকন্যা। স্থির, শান্ত, ম্লান, বিষন্ন। কে মুক্তি দেবে ওকে?
চুপ করে গেল অদিতিও। কেমন মনে হল, শান্ত নদীটা অপলকে চেয়ে আছে অদিতির একান্ত নিজের মানুষটার দিকে। এক গভীর আকুতি নিয়ে। গৌতম যেন অনেকখানি দূরে, অনেকখানি উঁচুতে, অদিতির পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। শহরের ব্যস্ত কোলাহল, কর্পোরেট অফিসের রাজনীতি, বিদেশের চাকরির লোভ, নিতান্ত আটপৌরে চাওয়া পাওয়া ওকে আর টানে না। কাপলং ওকে বেঁধে ফেলেছে।
এখানে সব বড্ড অলীক অলীক।
আবার জোর করে সেই অলীক মায়া ধরে টান দিয়েছে অদিতি, ‘তুমি বুনো হয়ে গেছ। বনজঙ্গলে থাকতে থাকতে এক্কেবারে জংলী হয়ে গেছ তুমি। ভয় পাও, আর অন্য চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে কিনা। তিমির একটা কোম্পানির সিইও হবার জন্যে লড়ছে, পার্থ অস্ট্রেলিয়ায় একটা কোম্পানির মাথা হয়ে গেল, শ্রাবণী ইউকে চলে গেল, রুবন-সুমি আমেরিকায়। আর তুমি! এই নিশ্চিন্দিপুরে বসে জল ঘাঁটাঘাঁটি করছ। তোমার জন্যে আমার কেরিয়ারটা পর্যন্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে।'
খোলা গলায় হেসে উঠেছে গৌতম, ‘কি বললে দিতি? নিশ্চিন্দিপুর! ঠিক বলেছ তুমি। এই জন্যে তোমায় এত ভালোবাসি! তুমি সব বুঝতে পারো, না দিতি?’
রাগ করে উঠে পড়েছে অদিতি। আর কথা বলার ইচ্ছে হয় নি।
প্রথমবার এসে অবশ্য বেশ লেগেছিল। পোর্টব্লেয়ার থেকে পুরো রাস্তাটাই আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড। সংক্ষেপে ‘এটিআর’। ঝিরকাটাং থেকে বারাটাং। ঘন সবুজ ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট। এই জঙ্গলেই জারোয়াদের আস্তানা। বারাটাং জেটি থেকে স্পিডবোটে জঙ্গল। সেখান থেকে আরও আধ ঘন্টা হেঁটে লাইন-স্টোন। মাড-ভলক্যানো, আমকুঞ্জ বিচ।
মায়াবন্দর। কালারা জংশন থেকে মূল রাস্তা ছেড়ে বেশ কিছুটা ভেতরে রামনগর সৈকত। নিঝুম নিরালা অর্ধচন্দ্রাকৃতি সৈকত। পাহাড়, নারকেল গাছ। সোনালি বালির দৃষ্টিনন্দন কারমাটাং সৈকত। সমুদ্রের ধারে সুন্দর বসার জায়গা। নিরিবিলি। সাজানো-গোছানো ইকো পার্ক। ‘টার্টল নেস্টিং সাইট।’ ডিসেম্বর থেকে মার্চ ডিম পাড়তে আসে কচ্ছপের দল। হ্যাচারিতে সেই ডিমগুলি বালির নীচে রেখে তার থেকে কচ্ছপ জন্মানো পর্যন্ত পুরো পদ্ধতিটাই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন।
বারাটাং, রঙ্গত, মায়াবন্দর থেকে উত্তর আন্দামানে প্রবেশ। সমুদ্রের খাঁড়ির উপর তৈরি করা চেঙ্গাপ্পা ব্রিজ পার হয়ে আরও প্রায় দেড় ঘন্টা জঙ্গল, উপত্যকা। একদিকে সবুজ পাহাড়, আর একদিকে নীল সমুদ্র। ভারি সুন্দর।
তারপর এই জায়গাটা। ডিগলিপুর। সবুজ খেত আর নীলচে সবুজ পাহাড়। ছোট্ট ছিমছাম শহর। প্রচুর ধান হয়ে বলে জায়গাটাকে ‘গ্রেনারি অব আন্দামান’ বলা হয়। নারকোল, কলা, কমলালেবুও হয় প্রচুর। প্রথমবার এসে মনে হয়েছিল, বাংলার কোন এক মফস্বল শহর। একসঙ্গে এত বাঙালি এখানে!
ছোট্ট টিলার উপর এপিডব্লিউডি-র গেস্টহাউস। দু’চারটে দোকানপাট। এই ডিগলিপুরেই আন্দামানের একমাত্র নদী কাপলং এবং পাহাড়চূড়া স্যাডেল পিক। যে নদী ঘিরে এত কর্মকাণ্ড। বেড়াতে আসার জন্যে জায়গাটা বেশ।
কিন্তু তা বলে বছরের পর বছর থাকা! প্রথম আলাপেই বলেছেন কেউ কেউ, ‘কিচ্ছু নেই এখানে। উপায় নেই, তাই পড়ে আছি!’ বাঙালি ক্লাব, পয়লা বৈশাখ থেকে দুর্গাপুজো, ঘরোয়া আড্ডা থেকে গানের জলসা। নিস্তরঙ্গ জীবন জুড়ে একটুকু ঢেউ তোলার চেষ্টা।
‘আপনি কেন থাকবেন এখানে এসে? নিজে এত বড় চাকরি করেন, মিস্টার সান্যালই বা এখানে পড়ে থাকবেন কেন?’ করবীদি বলেছিলেন প্রথম আলাপে। করবীদি, মিসেস বিপুল মিত্র। প্রোজেক্টের শুরুর দিকে কাপলং নদীর প্রকৃতি, বিগত কুড়ি বছরের চরিত্র নিয়ে স্টাডি করার জন্যে এসেছিলেন বিপুল মিত্র। করবীদি তখনও মিসেস মিত্র হন নি।
‘বিয়ে হয়ে এলাম এই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে। আর ফেরা হল না।‘ গল্প করেছিলেন করবীদি, ‘এখন যা দেখছেন, সেসব কিছুই ছিল না। সারাদিনে দশটা লোকের মুখ দেখার উপায় নেই। মেয়ে হবার পর আমি আর থাকি নি। মেয়েকে বড় করতে হবে না? বলুন?'
‘করবীদির কথা আর বলবেন না। বেচারা। বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে, তাতেও কি আটকাতে পারছে কিছু? শোনেন নি আপনি? মিস্টার সান্যাল বলেন নি?’ বেঙ্গলি ক্লাবের মহিলামহলে গল্প শুনেছে অদিতি তারপর।
‘মিত্র বৌদি একজন দু:খী মানুষ’, গৌতম বলেছিল।
দু:খী মানুষ তো বটেই। নিজেকে দিয়েই বেশ বুঝতে পারছে অদিতি। থাকতে বাধ্য হওয়া মানে কি, তা তো আর অন্য কাউকে বুঝিয়ে দেবার দরকার নেই। তবু তো চাকরিটা আছে। ছুটি ছাটায় আসা। কিন্তু আর কতদিন! দুই বাড়ি থেকেই বাবা মায়েরা চাপ দিচ্ছেন। বয়স বেড়ে যাচ্ছে। একটা সিদ্ধান্ত তো নিতেই হবে। সব কিছুর জন্যেই একটা প্ল্যানিং চাই। করবীদির মতো মেয়ে মানুষ করার জন্যে একা একা থাকতে পারবে না অদিতি।
একা একা থাকতে থাকতেই কি অমন বেচারা হয়ে গেছেন করবীদি? দু:খী মানুষ? ‘একটু গোলমেলে ব্যাপার আছে।' মেয়েমহলের মজলিশে জেনেছে অদিতি।
বিপুল মিত্র লোকটা সুবিধের নয়। মেয়েঘটিত কেলেঙ্কারি। কাজের লোক নিয়ে লটঘট। নোংরামি। অফিসের কাজের নাম করে চলে গেছেন মাঝে মাঝেই। অফিস পিয়ন থেকে কেরানী, সহকর্মী থেকে প্রতিবেশী। এমনিতে দোষের কিছু দেখা যায় না। সব বাড়িতেই অবারিত দ্বার। মেয়েদের সঙ্গে, বিশেষত পরস্ত্রীদের সঙ্গে খুব মেলামেশা। তাছাড়া এখানে বুনো জংলী মায়ায় মায়াবী মেয়ে আর প্রণয়ের আড়াল দুইয়েরই অঢেল সুযোগ।
তিনবার না চারবার আত্মঘাতী হবার চেষ্টা করেছেন করবীদি। স্বামীর চারিত্রিক স্খলন অবশ্য সামলানো যায় নি। মেয়ে বড় হয়ে গেছে, কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে, এখন কী বাবার চরিত্র শোধরানোর সময়!
‘আমরা সবাই মিলে বুঝিয়েছি করবীকে। হয়ত বিপুল মিত্র তেমন খারাপ নয়। নইলে এখানে সব বাড়িতে আসা-যাওয়া হত? হয়ত একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেন, মানুষটা কিন্তু তেমন বিপজ্জনক খারাপ নয়’, সীমাদি বলছিলেন। পেনস্টকের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মৃগাঙ্ক মজুমদারের স্ত্রী সীমাদি। এখানের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করেন।
‘গতবার খুব সময়মতো হাসপাতালে আনা হয়েছিল। ফিনাইলের গোটা বোতলটা ...’ চুপ করে গেছিলেন সীমাদি।
মেয়েমহলের কিটিপার্টি। হাসি, ঠাট্টা, গল্প, ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে চুল মেরামত, মুখ মেরামত। ফিশফ্রাই, চিকেন কাটলেট। শাড়ি-গয়না, সোনার দাম, টিভির মেগাসিরিয়াল। করবীদির বাড়িতে পার্টি। করবীদি একটু আড়াল হলেই নানা গল্প।
‘মহিলার সন্দেহ বাতিক। কই, আমরা তো তেমন কিছু দেখি না। একটু হৈচৈ করেন বিপুলদা। বাড়িতে এলে জমিয়ে দেন আড্ডা। এইটুকুই। সে নিয়ে এমন লোক হাসানো কেন? অতই যদি অপছন্দ, ডিভোর্স নিয়ে আলাদা থাকলেই হয়।’ মৌসুমী, আলপনা, শর্মিলা বলেছে।
ভালো লাগে নি অদিতির। কোথায় মহিলার জন্যে মায়া করবে, ওকে নিয়েই হাসাহাসি করছে সবাই! একসঙ্গে কিটি করছে, বন্ধুই তো। এই এক জায়গায় এই নির্জন দ্বীপে শহরের ছোঁয়া। যেখানেই থাকুক, প্রকৃতির সঙ্গে যতই একাত্মবাস হোক, বাঙালি চরিত্র যাবে কোথায়!
বিপুল মিত্র লোকটিকে দর্শনের ইচ্ছে হয় নি অদিতির। পুরুষ হবার সুবিধে ভোগ করছে লোকটা। কেন যে সবাই মিলে একঘরে করে দেয় না! বরং প্রতিবেশী সহকর্মী মহলে তো বিপুল মিত্র বেশ জনপ্রিয়।
অবশ্য একঘরে হলে করবীদির আরো বিপদ। আচ্ছা, এত অপমান সহ্য করে ভদ্রমহিলা এখানে পড়েই বা আছেন কেন! স্বামী লম্পট হলে কি আর মান থাকে! পরিচিত সমাজে লোক হাসানো তো কম হয় নি।
আনমনে মাথা নাড়াল অদিতি। হয় না। চাইলেই ছেড়ে যাওয়া যায় না। মেয়ে আছে, মেয়ে বড় হয়েছে, করবীদি কি আর মুক্ত মানুষ! তাছাড়া নিজের কোনো উপার্জন নেই। চলে গেলেও তো স্বামীর মুখাপেক্ষী।
অবশ্য এগুলো কোনো কারণ নয়। যতই স্বাবলম্বী হোক, সমাজের মেয়েরা এখনো স্বামীর মুখাপেক্ষী। তা না হলেই সমাজ জুড়ে হট্টগোল। ছেলেমেয়ে না থাকলেও একই রকম। এই যে অদিতি, এত অবসাদ এত অভিমান নিয়েও তো পড়েই আছে এখানে। ছেড়ে চলে যেতে পারছে কি? এক এক সময় মনে হয়, সত্যিই ওর থাকা না-থাকায় কিছু এসে যায় না গৌতমের। নিজের কাজ, নিজের জগতে বেশ আছে। অফিস, ল্যাপটপ আর নদী। ব্যস, আর কিছু চাই না।
ফেসবুকে নতুন কিছু বন্ধু হয়েছে। নদীপ্রেমিক বন্ধু। সেখানে রোজই নদী নিয়ে চর্চা, নানান নদীর ইতিহাস ভূগোল যাত্রাপথ নিয়ে আলোচনা। দেশ বিদেশের নদীর ছবি আপলোড। গৌতমের অবশ্য সে উপায় নেই। সারা আন্দামানে ওই একটাই নদী। কাপলং। সেই নিয়েই মেতে আছে ও।
বর্ষার কূল উপচে পড়া কাপলং, শীতে শান্ত ঘুমন্ত কাপলং। গরমে শীর্ণ, বসন্তে সবুজ গাছের ছায়ায় স্নিগ্ধ। কোথায় প্রপেলার ঘুরছে, কোথায় রোটার, নদীর বুকে নাকি খুব ব্যথা, নদীর মনে নাকি সৃষ্টির বেদনা। আদিখ্যেতা!
অথচ কলেজের বন্ধুরা প্রায় সবাই ফেসবুকে আছে। আজকাল কত সহজে যোগাযোগ হয়। অনির্বাণ জাপানের কাজের খবরটা দিয়েছিল ফেসবুক মেসেজ করেই। প্রজেক্টটা পাবার পর অদিতির কম সুনাম হয়েছে ম্যানেজমেন্টের কাছে! এই সেদিনও পার্থ লিখেছে গৌতমকে, ‘চলে আয়, চলে আয়। আর কতদিন পড়ে থাকবি?’
বেশ বোঝে অদিতি, আজকাল এসব কথায় বিরক্ত হয় গৌতম। পুরোনো বন্ধুদের এড়িয়ে চলে।
ফেসবুকের খবর পেয়ে সাবধান করেছিলেন করবীদি। নিজে হাতে সর্ষে দিয়ে পুঁইডাঁটার চচ্চড়ি করে এনেছিলেন গৌতমের জন্যে। ‘মিস্টার সান্যাল এটা বেশ ভালবাসেন।'
এমন প্রায়ই হয়। নিজের হাতে তৈরি বড়ি দিয়ে শুক্তো, নারকোল আর ছোলা দিয়ে মোচা।
‘মিত্রবৌদি মানুষটাই অমন, জানো দিতি? আমাকেই একা নয়, সবার জন্যেই এমনি মায়া। এমনি এমনিই লোকজনকে ডেকে ডেকে খাওয়াতে ভালবাসেন। যার যখন দরকার, যেমন দরকার।'
দেখেছে অদিতিও। কারো দরকারে হাসপাতালে, কারো দরকারে দু’বেলা খাবার ব্যবস্থা। কার বাড়িতে কাজের লোক পালিয়েছে, কার বাড়িতে বাজার হচ্ছে না। এত ভাবনা সবার জন্যে, কিন্তু কেমন ওপর ওপর। আলগা আলগা। কাউকে নাম ধরে ডাকেন না, কাউকে নিজের কথা বলেন না। এত যে আলোচনা হয় ওঁকে নিয়ে, কিছুই কি কানে যায় না?
‘আচ্ছা, আপনি গৌতমকে নাম ধরে ডাকেন না কেন?’ অদিতি জিজ্ঞেস করেছিল একদিন।
‘না ভাই, সম্পর্কে বিশ্বাস নেই আমার। সম্পর্ক মানেই জটিলতা। এই বেশ।'
সম্পর্কে বিশ্বাস নেই করবীদির। মায়া পাতার সম্পর্ক নিয়ে অবিশ্বাস বেশ জোরালো। ‘আপনি একটু সাবধান হবেন মিসেস সান্যাল। একা একা থাকে, পুরুষ মানুষ, জড়িয়ে পড়তে কতক্ষণ? ওসব ফেসবুক টুকে শুনেছি নানা নোংরামি হয়।’
‘নোংরামি করতে হলে ফেসবুকের দরকার হয় না করবীদি’, মানসী যেচে পড়ে কথা শুনিয়েছিল। করবীদের মুখটা শুকনো দেখিয়েছিল।
না, গৌতমকে নিয়ে সেসব ভাবনা নেই অদিতির। কাজ ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। কাজ, নাকি নদী!
সকাল থেকেই কর্মযজ্ঞ। মাটি কাটার মেশিন একঘেয়ে আওয়াজ করে মাটি কেটে চলেছে। বাঁধের মেন্টেনেন্সের কাজ চলছে সারাদিন। পেনস্টকের কাজে পাহাড়ে কখনো ডিনামাইট দিয়ে বিস্ফোরণ, কখনো পাথর কাটার মেশিনের একটানা ঘড়ঘড় শব্দ। অনেকখানি ওপর থেকে পাইপলাইন এসেছে, পাহাড়ের মধ্যে টানেল দিয়ে। বেশ অনেকটা ওপর থেকে জল এসে পারবে প্রপেলারে, তবে তো! প্রপেলার ঘোরানোর জন্যে আটখানা ছ’শো টনের রোটার। যন্ত্রপাতির নকশি কাঁথায় নিত্য নতুন বুনন, নিত্য নতুন মেরামতি। সবাই ব্যস্ত।
‘এই মেঘলা দিনে একলা’ ... রিংটোন বেজে উঠল। গৌতম।
‘তুমি কোথায় দিতি? সীমাবৌদি ফোন করেছিলেন। জরুরী দরকার। আমি এক্ষুনি হাসপাতালে যাচ্ছি।'
‘কেন? হাসপাতালে কেন? কি হয়েছে?’
‘মিত্র বৌদি। আবার। খুব সিরিয়াস। দেখি গিয়ে কি ব্যাপার। এসে বলছি।’
এটা চতুর্থবার। না না, চারবার তো আগেই হয়ে গেছে। এবার নিয়ে পাঁচ বার। কি যে লোক হাসানো।
‘প্রত্যেক বার হাসতে হাসতে ফিরে আসে। তুমি চিন্তা কোরো না অদিতি।' সীমাদি বললেন।
‘হিসেব করে বেশ গোনাগুনতি ওষুধ নেয়। বিপুল মিত্রর যাতে বেশ হেনস্থা হয়, প্ল্যান করে সেইটা করে।' মানসী বলল।
মিটমিটিয়ে হাসল শর্মিলা, ‘কড়া জান করবীবৌদির। চাইলেও বিপুল মিত্র মুক্তি পাবেন না।'
মহিলামহলের সবাই এসে জড়ো হয়েছে ছোট্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কেউ তেমন সিরিয়াস নয়, এমন লোক হাসানো করবীদির স্বভাব। বিপুল মিত্রকেও দেখা গেল একবার। বিশেষ বিচলিত মনে হল না। ফিনাইলের বোতল খালি করে ফেলা, ইঁদুর মারার বিষ, নদীর জলে ঝাঁপ, শাড়িতে আগুন লাগানোর তুলনায় এবারের কাজটা বেশ নিরীহ। জ্বরজারির ক্যালপল ওষুধ, দু’পাতা। পাম্প করে স্টমাক পরিষ্কার হয়ে গেছে, বিপদ কেটে গেছে।
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর বাইরের ছোট্ট বাগানে বসেছিল গৌতমের সঙ্গে। আজ আকাশে চাঁদ নেই। কাপলংকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তামাটে জ্যোত্স্নায় নদী আরো ম্লান। সেইদিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বলছিল গৌতম, ‘বলেছি না তোমায়? মিত্র বৌদি মানুষটা খুব দু:খী? একটাই জীবন আমাদের, সেইটা বোঝেন না। ওই ওকে এত কাছে থেকে দেখেও বৌদি যে কেন তা বোঝেন না!’
‘ও’কে, গৌতমের নদীকে। মনটা ভার হয়ে ছিলই, বেশ বিরক্ত হল অদিতি। পরস্ত্রী, অন্য নারী যদি বিপুল মিত্রর নেশা হয় ... তুমিই বা কম কি গৌতম! নদী নদী করে পরিচিত সমাজ ছেড়ে, জীবন ছেড়ে এই পরবাস। অদিতির চাওয়া পাওয়া নিয়েই মাথা ঘামাও না, করবীদিকে তুমি বুঝবে কি করে! কোন শূন্যতা থেকে একজন মেয়ের বারবার আত্মঘাতী হবার ইচ্ছে হয়, তুমি কি করে বুঝবে পুরুষ! কোন গভীর অপমানে, লজ্জায়, কষ্টে পৃথিবীর বুকে আশ্রয় নিয়েছিলেন চির-দু:খিনী সীতা, তুমি বোঝো? কোন যন্ত্রণা, কোন শূন্যতায় পৃথিবীর বুকে গভীর ফাটল, তুমি জানতে চেয়েছ?
শুধু কি সীতা? জন্মে জন্মে এমন। বারবার এমন। সীবলিকুমারী হয়ে ভালোবাসা, প্রতিদানে মহাজনক সংসারত্যাগ করেছেন। প্রণয়ভিক্ষুণী মাদ্রী, তাঁর প্রিয়তম পুরুষ বিশ্বন্তর তাঁকেই দান করে দিলেন। পুরুষ মহাসত্ত্ব ত্যাগ করলেন, অসীম ভালোবাসা বুকে নিয়ে শ্যামা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। আকুল প্রতীক্ষায় রাধা, বৃহত্তর কর্মের ডাকে শ্রীকৃষ্ণ সে প্রণয়কে অবহেলা করেছেন। শাক্যপুত্র সিদ্ধার্থ বুদ্ধ হয়ে নির্বাণলাভে ব্রতী হয়েছেন, রাণী যশোধরা ভিক্ষুণী শ্রমণা হয়ে অনুসরণ করেছেন। বুদ্ধ তাঁকে ফিরে দেখেন নি। নির্লিপ্ত অহঙ্কারী সভার মাঝে পাঁচ পাঁচজন স্বামী আর গুরুজনদের চোখের সামনে একের পর এক খুলেছিল দ্রৌপদীর পরিধেয়। নারীর লজ্জা। পিতা নয়, স্বামী নয়, ভাই নয়, বোন নয়। কার কাছে আশ্রয় পাবে মেয়ে?
আত্মঘাতী হয়ে কোন গভীর দু:খে, কোন শূন্যতা থেকে মুক্তি চেয়েছেন করবীদি? আপনমনে চলা নদীর সঙ্গে কি মেয়েদের তুলনা হয়?
হঠাত্ ভেতর থেকে কিসের এক চমক। সোজা হয়ে বসল অদিতি।
আপনমনে চলা নদী! সত্যি তাই? আহা নদী! আপনমনে চলা হল কই! বাঁধ দিয়ে দিয়ে, নদীর বুকের মধ্যে গভীর ফাটল তৈরি করে করে, জোর করে তার গতিপথ বারবার বদলে দিয়ে, হয় প্রজননে নয় উত্পাদনে তাকে ব্যবহার করে করে শিকল পরিয়ে দিল মানুষ।
হায় নদী! তুমিও বুঝি অদিতির মতো পালিয়ে যেতে চাও! করবীদির মতো মুক্তির আশায় আত্মঘাতী হতে চাও!
আজ আর নদীর ধারে যায় নি অদিতি। পায়ে পায়ে হাসপাতালে এসেছে। জানলার দিকে চেয়ে বিছানায় বসেছিলেন করবীদি। একা। আজ ভালো আছেন বেশ। বিপদ কেটে গেছে। কাল বাড়ি চলে যাবেন। বিছানার পাশে রাখা টুল টেনে নিয়ে বসল অদিতি। সেইটুকু আওয়াজে মুখ ফেরালেন। উজ্জ্বল হাসলেন। তারপর আবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন।
জানলার ঠিক বাইরে একটা বকুলগাছ। ডিগলিপুরে এমন অনেক বকুলগাছ। তবু ওই গাছের দিকে এমন একমনে চেয়ে কি দেখছেন করবীদি? একঝাঁক টিয়া উড়ে গেল বকুলগাছ থেকে।
‘কেমন আছেন? কাল তো ছেড়ে দেবে বলল।'
‘হ্যাঁ, এবার সত্যিই ছেড়ে যাব সব।' খুব আস্তে আস্তে, যেন নিজের সঙ্গেই কথা বললেন।
মুখ ফিরিয়ে উজ্জ্বল হাসলেন তারপর, ‘আপনি খুব অবাক হয়েছেন, না? এখানের কেউ অবশ্য আর অবাক হয় না। আমার পরিবারের কেউ তো নয়ই। মেয়েও খুব বিরক্ত হয়েছে এবার।'
‘তা হলে? কেন এমন করেন করবীদি? যদি সত্যি সত্যি কিছু হয়ে যেত!’
‘কেন করি?’ জানলা দিয়ে বাইরে চাইলেন, ‘এদিকে একবার আসবেন মিসেস সান্যাল?’
জানলা দিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে কাপলং। এতদূর থেকে নদী বলে চেনা যাচ্ছে না। উজ্জ্বল আলোর একটা রেখা। সোনালী একটা পাত। আসলে বিকেলের রোদ্দুর পড়ে চিকচিকে জল।
‘ওই নদীটা মিসেস সান্যাল। ওই নদীর মত যদি হতে পারতাম! যারা অত্যাচার করছে, তাদের জন্যেই প্রাণপাত। জীবন দান। নদী পারে, তাই না?’
কেমন অচেনা এক আবেগ, অদিতির বুকের ভেতরটা ছলছল করে উঠল। ‘বিয়ের পর থেকে অনেক চেষ্টা করেছি। তখন তো নদীকে চিনতাম না। সব মেয়েদের মতই আঁকড়ে ধরে ভালোবাসতে চেয়েছি, দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে সংসার করতে চেয়েছি। পাড়াতুতো বৌদি, ডাকতুতো বোন, অফিসতুতো বন্ধু। বড্ড টান। একা আমি পারি নাকি? তবু ভেবেছি, সংসারে মন বসলে সব ঠিক হয়ে যাবে। মেয়ে হল। আমার মেয়েকে দেখেন নি আপনি, অদিতি।'
এই প্রথম অদিতিকে নাম ধরে ডাকলেন করবীদি, ‘নিজের মেয়ে বলে বলছি না, আমার মেয়েটা বড্ড ভালো। ভারি সুন্দর, স্বভাব ব্যবহার ম্যাচিওরিটি। মেয়ে তো নয়, আমার মা। বলত, কেন আঁকড়ে পড়ে আছ তুমি? জোর করে কি স্বভাব বদলানো যায়!’
স্বভাব। হালকা শব্দ, কিন্তু ওজনে আর ভাবে বড্ড ভারি। করবীদিরও নিজের স্বভাবেই মনে হয়েছিল, সব ঠিক হয়ে যাবে।
হয় নি।
‘বারবার ভেবেছি, একটা শিক্ষা দিয়ে যাই ওকে। আমি মরে গেলে যদি ওর শিক্ষা হয়। মরে বাঁচা যায় না, না? এইটা বুঝতে পারি নি। এই প্রথম, এইবার প্রথম কেমন অন্যরকম মনে হচ্ছে। মেয়ে আমার ওপর খুব রাগ করেছে। আচ্ছা অদিতি, আমার মেয়ে, একলা হাতে ওকে বড় করেছি, বাবা ওকে কোনদিন ফিরেও দেখে নি, ওর বাবার সব কুকীর্তি সযত্নে লুকিয়ে রেখেছি আমিই, তবু মেয়ে বাবার হয়েই কথা বলল? রাগ করল? মেয়েও আমাকে বুঝল না?’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে করবীদি। মেয়ে ছোট, এখনো সব বোঝার বয়স হয় নি।'
‘না না অদিতি, মেয়ের ওপর রাগ অভিমান কিচ্ছু নেই আমার। তোমায় বললাম না? আমার মেয়েটা বড্ড ভালো? আমার অনেক না-পাওয়ার মধ্যে ওই একখানি ওয়েসিস। আমার মেয়ে। ও রাগ করেছে বলেই আমিও যে সব ঠিক ঠিক দেখতে পেলাম। আমি চলে গেলে সবচেয়ে একলা হয়ে যাবে আমার মেয়েই। যার জন্যে এত কাণ্ড, তার কোনো বদল হবে না। তাহলে? কেন আমি নিজের জীবনটা বাজি রাখব? খুব ভাবছি কাল থেকে। সংসার স্বামী মেয়ে পরিবার। এর বাইরে বেরোনো হয় নি আমার। অথচ আমারও তো একটাই জীবন, না অদিতি?’
নদীর সোনালী আভাটা উঠে এল করবীদির চোখ জুড়ে।
‘জীবনটাই সেকেণ্ডারি করে ফেলেছি আমি। স্ত্রীর অধিকারটাই আমার কাছে আসল হয়ে থেকেছে। স্ত্রী হিসেবে অধিকার, মা হিসেবে কর্তব্য। অথচ জীবনের জন্যেই সব, না? আমি জীবনের কাছে ফিরতে চাই অদিতি। বেঁচে যখন গেছি, আর ভুল করব না।'
কথা থামিয়ে গুনগুনিয়ে উঠলেন। খুব আস্তে, যেন নিজেকেই শোনাচ্ছেন, আপনমনে গাইছেন করবীদি, ‘এই সুদূরে পরবাসে.. ওর বাঁশি... ওর বাঁশি আজ প্রাণে আসে... মোর পুরাতন দিনের পাখি... ডাক শুনে তার উঠল ডাকি...’
চেনা রবীন্দ্রসঙ্গীত। কোন গান, এই মুহূর্তে মনে পড়ল না। এই মুহূর্তের কথাগুলো একান্তভাবে করবীদির। অদিতিকে আসলে দেখতেই পাচ্ছেন না উনি। উজ্জ্বল চোখ, আলো আলো অপরূপ মুখ। অদিতির বুকের মধ্যে টলটল করে উঠল। ভাগ্যিস এল আজ। অপরূপ এক উত্তরণের ছবি দেখা হল। আস্তে আস্তে উঠে এল। করবীদি খেয়ালই করলেন না।
ভোরবেলা খবরটা এল।
করবীদি আর নেই। অচিন পথের পথিক হয়েছেন।
‘কোনো এমন সিম্পটম ছিল না, শী ওয়াজ পারফেক্টলি অলরাইট। শেষরাতে ঘুমের মধ্যে কার্ডিয়াক ফেলিওর।’ ডাক্তার বলেছেন।
‘আমি এসেছিলাম কাল রাতে। খুব খুশি ছিল করবী।’ সীমাদি বললেন, ‘এই প্রথম আমাকে বলেছে, আর এমন কাজ করব না। আমি এবার বাঁচতে চাই সীমা, বাঁচার মতো বাঁচা। আমার একটা কাজ হয় না তোমাদের এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে? আমি বললাম, নিশ্চয় হবে। এখানে না হোক, অন্য কোথাও। আর আজকেই ...'
‘আমি এসেছিলাম বিকেলে।’ আলপনা বৌদির গলাটা ধরা ধরা, ‘কি উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল করবীদিকে। গান গাইলেন ... আজি কমলমুকুলদল ফুটিল ... কি চমত্কার গাইলেন। বললেন, আর ভুল হবে না আলপনা। আমি এবার ঠিক ঠিক বাঁচব। আর আজই ...'
ঠিক যখন জীবনের অর্থ ধরতে পেরেছেন করবীদি, জীবনের কাছে ফিরতে চেয়েছেন, আর সুযোগ হল না। আহা করবীদি! ‘আমারও তো একটাই জীবন, না অদিতি?’ আকাশে বাতাসে নদীর সুরে গাছের গানে করবীদির গলার আওয়াজ। বারবার। তাই তো। একটাই জীবন। শুধুই অপ্রাপ্তির বেদনায়, ভুল বোঝার সংশয়ে তাকে এড়িয়ে থাকা! নিজের পছন্দ আর অপছন্দই সব! গৌতমের চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে অমিলটুকুই সব!
রাত্রির শেষ যাম এখন। চাঁদ ডুবেছে কাপলং-এর বুকে। স্নিগ্ধ মমতায় গাঢ় আলিঙ্গনে চাঁদের মায়া ধারণ করে বইছে নদী। আপনমনে।
ধারণ করাই কাজ ওর। যা-ই আসুক, যেমন ভাবেই আসুক জীবন, তাকে গ্রহণ করার মধ্যে দিয়েই জীবনের সার্থকতা। কেমন করে বরণ করবে তাকে, করবীদির মতো অভিমানে দান করে নাকি কাপলং-এর মতো উর্বরতায় নির্মাণে, সে একান্তভাবে নিজের ভাবনা।
জীবন একটাই। একবারই পাওয়া জীবনের সুযোগ। ঠিক ঠিক বাঁচার সময় একবারই। ভালোমন্দ সবই পাশাপাশি। যেমন দিন আর রাত, আলো আর অন্ধকার, সুখ আর দু:খ, জীবন আর মরণ। তাই বুঝি নানা অপ্রাপ্তি, নানা দু:খ, নানা অপমানের বেদনা কাটিয়েও তবু মানুষ ভালোবাসে। তবু মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। ভালোবেসে বেঁচে উঠতে চায়।
ঘুমন্ত গৌতমের কপালে হাত রেখে হাসল অদিতি। চোখ না তুলেও কাপলংকে বুকের মধ্যে দেখতে পেল। ছোট ছোট নিরভিমান ঢেউয়ের ভেলায় ভেসে এল সমাপ্তির কিনারায়।