'অযাত্রা'
'একেবারে অযাত্রা'।
— বাবার মুখে বহুবার শোনা এই কথাটা মনে হয়েছিল রওনা হওয়ার শুরুতেই। কারণ বাসটা ছাড়ার সাথেসাথেই থেমে গেল দুহাত গড়িয়ে। কি ব্যাপার?
কিছুই না। ড্রাইভার বদল হোলো। যে চালাতে শুরু করেছিল সে নেমে গেল কেন কে জানে। ড্রাইভারের সীটে উঠে এলো অন্য আরেকজন। অর্থাৎ শুরুতেই বাধা। বাবার ভাষায় 'অযাত্রা'।
আসলে হঠাৎই উঠে বসেছিলাম এই দূরপাল্লার বাসটায়। এইভাবে হুট করে বেরিয়ে পড়াটা আমার অনেকদিনেরই অভ্যাস। কয়েকটা খবরের কাগজ কিনে প্রথম যাত্রী হিসেবে বাসটায় উঠেছিলাম। বসেছিলাম সামনের দিকে জানালার ধার দেখে একটা সীটে। খবরের কাগজে এতটাই ডুবেছিলাম যে খেয়ালই করিনি কখন বাসটা চলতে শুরু করেছে হু হু করে।
বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাঁ সাঁ করে পিছিয়ে যাচ্ছে ঘন সবুজ মাঠ—গাছের সারি—বিস্তীর্ণ ক্ষেত এইভাবে বাসটা এক অদ্ভূত জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলতে শুরু করলো।
সেখানে চারিদিকে ঘন সবুজের মধ্যে ছিটিয়ে থাকা কমলা হলুদ ফুলের থোকা। তার উপর এসে পড়েছে সকালের ধারালো রোদ্দুর। সব মিলিয়ে যেন ভ্যানগগের ছবি। একটানা তাকিয়ে থাকলে মাথা ঝিমঝিম করে। তবুও চোখ ফেরাতে পারছিলাম না কিছুতেই।
হঠাৎ মুহূর্তের মধ্যেই চাপচাপ কালো অন্ধকারে বদলে গেল আমার চোখের সামনের সমস্ত সবুজ হলুদ কমলা রঙের দৃশ্যগুলি। গুমগুম করে একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল ঠিক সেইসময়। বুঝলাম বাসটা কোনো সুড়ঙ্গে ঢুকেছে।
এইসব সুড়ঙ্গ টুড়ঙ্গ আমার একাবারেই পোষায় না। অর্থাৎ ঐ দমবন্ধ করা অন্ধকার। আর ওই একটানা আওয়াজ—আমার কাছে অতি ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়। তাই প্রবল অস্বস্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। কিন্তু নিলে কি হবে? বাসের মধ্যেও তো সেই একইরকম নিরেট অন্ধকার।
সেই অন্ধকারেই যেন মনে হল কনডাকটরদাদাটি সামনেই রয়েছে। তার উদ্দেশ্যে বললাম—'কি হল দাদা?' উত্তর এল—'টানেলে ঢুকলো'। ফের জিজ্ঞাসা করলাম—তা কতক্ষণের ব্যাপার? কোনো উত্তর এল না। মনে হল আমার কথাগুলো গ্রাহ্য না করেই চলে গেল সে।
গুমগুম করে আওয়াজ চলতেই থাকলো। আর অন্ধকারটা যেন ক্রমশ চেপে ধরতে থাকলো আমাকে। আমার দম আটকে আসতে লাগলো। প্রত্যেক মুহূর্তকে প্রকাণ্ড বলে মনে হতে লাগল। আর কতক্ষণ দাদা কাতরভাবে ফের জিজ্ঞাসা করলাম ওই অন্ধকারে। যথারীতি কোনো উত্তর এল না। ওই অন্ধকারেই কোনোক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে উঁকি মারলাম। বাইরেও সেই নিরেট অন্ধকার। হতাশ হয়ে বসে পড়লাম নিজের সীটটায়।
এবার বাসের ভিতরটায় তাকানোর চেষ্টা করলাম। কিছুই দেখতে পেলাম না। চোখদুটো যেন কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা আছে আমার বলে মনে হোলো। সীটে বসে ছটফট করতে করতে ভাবতে লাগলাম—'কেন? কেন শুধু আমারই এতো কষ্ট হচ্ছে? অন্যেরা—আমার অন্যান্য সহযাত্রীরা তো আমার মতো হাঁকপাঁক করছে না—বলছে না আর কতক্ষণ? আর কতক্ষণ? তাহলে এতো আমার নিজের কষ্ট—শুধুমাত্র নিজের যন্ত্রণা। নাকি এটা আমার এক ধরনের অসুস্থতা?
মাথা নীচু করে ভাবতে লাগলাম আমি। হাতড়াতে লাগলাম আমার পুরোনো দিনগুলিকে। কিন্তু ওই দমবন্ধ করা অবস্থায় স্থির হতে পারলাম না কিছুতেই। মাথা তুলে তাকালাম সামনের দিকে। অন্ধকার যেন একটু পাতলা হয়েছে বলে মনে হল। হয়তো চোখ সয়ে গেছে বলে। ঠিক তখনই কনডাকটর দাদাকে যেন দেখতে পেলাম আবার সামনে দিয়ে চলে যেতে। কিন্তু কি নির্বিকারভাবে। যেন কোত্থাও কিছু হয় নি।
খুব সন্তর্পণে সীট ছেড়ে উঠলাম। এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। 'কদ্দূর আছে আর?'—জিজ্ঞাসা করলাম আস্তে করে। কোনো উত্তর এল না। 'আর কতক্ষণ লাগবে দাদা?'—ফের জিজ্ঞাসা করতেই সে ধমকে উত্তর দিল—'চুপ। নিজের জায়গায় গিয়ে বসুন'। থতমত খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজে বার করতে চেষ্টা করলাম আমার নির্দিষ্ট জায়গাটা।
এইবার একটু একটু করে দেখতে পাচ্ছিলাম অন্যান্য যাত্রীদের। কিন্তু কি আশ্চর্য! ওরা--ওরা সবাই কি নিশ্চিন্তে নিজেদের মধ্যে বসে আছে। কেউ গান গাইছে। কেউ তুড়ি মেরে হাই তুলছে। কেউ আবার গভীর ঘুমে অচেতন।
এইসময় একটু নজর দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম আমার আশপাশে। বাঁদিকে দেখলাম কোনো স্বামী স্ত্রী চাপা গলায় ঝগড়া করছে নিজেদের মধ্যে। আর তাদের পিছনের সীটে দুটি অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ে কি নির্লজ্জের মতো জাপটা-জাপটি করছে। মুখ ঘুরিয়ে ডানদিকে তাকালাম। দেখলাম একটি মোটাসোটা মহিলা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে পাশে বসা অল্পবয়েসী ছেলেটির উপর।
অসহ্য লাগলো—একেবারে অসহ্য লাগলো—এরা কি মানুষ? না পাগলের দল? নিজেদের নিয়ে এইভাবে সময় কাটাচ্ছে? আর কোন্ অন্ধকারের মধ্য দিয়ে চলেছে এই বাস—সেদিকে কোনো হুঁস নেই—কোনো উদ্বেগ নেই কোনো বিকার নেই এদের! মনে হল চিৎকার করে বলি—'ওরে হতভাগারা, নিজেদের নিয়ে তোদের এত ব্যস্ততা যে তোরা বুঝছিস না কোথায় চলেছিস কিসের ভিতর দিয়ে চলেছিস—ভাবছিস না কোথায় আর কখন এর শেষ।'
নাহ। ঠিক করলাম এভাবে হবে না। কিছুতেই হবে না। ওই কনডাকটারটাকে ধাক্কা মেরে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। অর্থাৎ ড্রাইভারের সীটের দিকে। ওকেই ধরতে হবে। জিজ্ঞেস করতে হবে—'কোথায় চলেছো এভাবে?' তাই অন্ধকারে ধাক্কা খেতে খেতে সামনের দিকে এগোতে থাকলাম। কারণ ড্রাইভারের কাছে আমাকে আসতে হবেই। এইভাবে কোনোক্রমে ড্রাইভারের সীটের পিছনে এসে খুব নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলাম—'পাইলট ভাই! ও পাইলট ভাই! কোথায় যাচ্ছে বাসটা?'
কোনো উত্তর এল না। অন্ধকারে আগের মতোই হু হু করে চলতে থাকল বাসটা। শিউরে উঠলাম সামনের দিকে তাকিয়ে। যেন পিচ ঢালা অন্ধকার। কিভাবে চালাচ্ছে বাসটা? আরেকবার বলার চেষ্টা করলাম—'বাসটা কোথায় যাবে এভাবে?' সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে অদ্ভূত ঠাণ্ডা গলায় সে উত্তর দিল—'জাহান্নামে'।
এই কথার সাথেসাথেই বাসের গতিটা যেন হঠাৎ বেড়ে গেল অনেকটা। টাল খেয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। কোনোক্রমে ফিরে যেতে চেষ্টা করলাম আমার নির্দিষ্ট আসনে। যে সীটের হাতলটা ধরে টাল সামলালাম, সে দিকে তাকিয়ে মনে হল যে বসে আছে ওই সীটে তাকে যেন চেনাচেনা মনে হচ্ছে।
ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম—আরে! এতো শুভময়! আমার অফিসের জুনিয়ার স্টাফ। আমাকে প্রায় পড়ে যেতে দেখেও কি নির্বিকারভাবে বসে রইল। সীটের কাছে গিয়ে বললাম--'শুভময়! তোমার থেকে এটা আশা করিনি। দেখছো পড়ে যাচ্ছি, অথচ ...' শুভময় যেন শুনতেই পেল না। নাকি দেখতেই পেল না। কিংবা গ্রাহ্যই করল না আমায়। মনে হল কি আস্পদ্দা! অফিসে পাই ব্যাটাকে..' ভাবতে ভাবতেই একটা হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম মুখ থুবড়ে সামনের দিকে।
এবার খুব সাবধানে পা টিপে টিপে এগোতে লাগলাম—সামনের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম—আরে! বাসের অনেককেই যেন চেনা চেনা বলে মনে হচ্ছে! নিজেকেই প্রশ্ন করলাম—'তাহলে এতক্ষণ নজরে পড়েনি কেন?' খুব অন্যমনস্ক ছিলাম বলে? সবার আগে উঠেছিলাম—আর উঠেই কাগজ পড়ছিলাম খুব মন দিয়ে—তাই আশেপাশের কিছুই খেয়াল করিনি একেবারেই। নাকি অন্ধকার এত গাঢ় ছিল বলে কিছুই ঠাহর হয়নি?
আস্তে আস্তে আমার চোখের সামনের অন্ধকারটা একটু একটু করে পাতলা হচ্ছিল—মনে হল আমার সামনের বাঁদিকের সীটটায় বসে রয়েছে আমাদের উল্টোদিকের বাড়ির সুধীনদা—আর তার পিছনের সীটটায় আমার পিসতুতো ভাই রন্টু—তার পাশের সীটে আমার স্ত্রী রমলা—ডানদিকে আমার ছোটোবেলার বন্ধু অনিমেষ—তার পাশে আমার মহাশত্তুর বিজন রায়! সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
কিন্তু কি আশ্চর্য এতগুলো লোক এত চেনাজানা আত্মীয়স্বজন—কখন উঠলো—কোথায় ছিল ঠাহরই করিনি! আর ওরাও কি দেখতে পাচ্ছে না আমায়? নাকি সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করে আমায় এত অবজ্ঞা করছে? কিন্তু কেন? কেন তাদের এই ব্যবহার?
একথা মনে হতেই যেন একটা চরম আত্মগ্লানিতে মাথাটা নীচু হয়ে গেল। মুখ নামিয়েই এক পা এক পা করে এগোতে লাগলাম—সামনের দিকের সীটগুলোর মাথা ধরে ধরে। বাসটা হঠাৎ একটা বিরাট ঝাঁকুনি খেলো।—বাঁদিকের সীটের মাথাটা ধরতে গিয়ে ফস্কে গেল। আমার হাতটা গিয়ে পড়লো একটি মেয়ের নরম হাতে। ভীষণ অপ্রস্তুতে পড়ে তার দিকে তাকালাম। দেখলাম—হ্যাঁ নিজের চোখকে বিশ্বাস না করতে পেরেও দেখলাম সে আমারই মেয়ে—আমার একমাত্র সন্তান তিতির!
দেখলাম আমাকে গ্রাহ্য না করেই সে বেহায়ার মতো বসে রয়েছে তার বন্ধু সায়নের কাঁধে মাথা রেখে! আমি চিৎকার করে বললাম 'তিতির! এই তিতির! দেখতে পাচ্ছিস না তোর বাবা পড়ে যাচ্ছে, আর তুই এভাবে বসে আছিস নির্লজ্জের মতো?' কিন্তু ও যেন আমার কোনো কথাই শুনতে পেল না—আমার উপস্থিতিটাই যেন গ্রাহ্য করল না। আর ঐ হতচ্ছাড়া সায়ন আমার সামনেই ...'। গা রিরি করে জ্বলে উঠল আমার। মুখ নামিয়ে নিলাম লজ্জায়, ঘেন্নায়।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমার স্ত্রীর দিকে এগিয়ে গেলাম। চিৎকার করে বললাম—'দ্যাখো দ্যাখো—তোমার মেয়ে তোমার আস্কারায় কিভাবে উচ্ছন্নে গেছে দ্যাখো'। দেখলাম সেও যেন আমার কথা শুনতেই পাচ্ছে না। হতচ্ছাড়া রন্টুটার সঙ্গে কথা বলতে বলতে যেন গলে পড়ছে আমারই সামনে।
ভয়ানক অপমানে আর লজ্জায় আমার শরীরের ভিতরটা দাউদাউ করে জ্বলে যাচ্ছিল। আর তখনই দেখতে পেলাম অনিমেষকে—আমার সেই ছোটোবেলার বন্ধু অনিমেষকে। বললাম—'অনি! অনি রে! আমায় দেখতে পাচ্ছিস? দেখতে পাচ্ছিস আমায়? আমার শরীরটা কেমন করছে। একটু আয় না রে। একটু ধর না আমায়।' দেখলাম অনি কেমন নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে আছে বাসের সিলিঙের দিকে!
মনে হল এ এক অসম্ভব অসহ্য ঘটনা ঘটছে আমার সঙ্গে। গোটা বাসসুদ্ধু লোক যেন ষড়যন্ত্র করছে আমার বিরুদ্ধে। কিংবা আমি বোধহয় সত্যিই পাগল হয়ে গেছি। ভাবতে ভাবতে ধপ্ করে বসে পড়লাম সামনের ফাঁকা সীটটায়। তখনই বুঝলাম যে ওটাই ছিল আমার নির্দিষ্ট জায়গা। বসে পড়েই ভীষণভাবে হাঁফাতে লাগলাম আমি। মনে হল এ কোন ভুতুড়ে বাসে উঠলাম রে বাবা। তারপর মনে হল আমার মাথাটাই বোধহয় একেবারে খারাপ হয়ে গেছে এই জমাট অন্ধকারে।
কিন্তু তখনই মনে হল—'নাহ্। এভাবে ভেবে কিছু হবে না। বরং একটু স্থির হয়ে বসি। চিন্তা করে দেখি কি ঘটলো এতক্ষণ ধরে। সবকিছু সাজিয়ে দেখি পরপর করে।'
টার্মিনাল থেকে বাসটায় উঠে পড়েছিলাম হঠাৎ করেই। আমিই ছিলাম বাসটার প্রথম যাত্রী। পছন্দমতো সীটে জানালার ধারে বসে একমনে কাগজ পড়ছিলাম। কারা কখন উঠলো খেয়ালই করিনি। তারপর বেশ খানিকক্ষণ বাদে বাইরে তাকিয়ে দেখি চারিদিক ছেয়ে আছে কমলা হলুদ থোকা থোকা ফুলে। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওইদিকে হঠাৎ করে কালো পিচের মতো অন্ধকারে ঢেকে গেল সবকিছু।
অর্থাৎ বাসটা একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকলো এটা তো ঘটনা। তাই এই অন্ধকারটাও একটা ভয়ঙ্কর বাস্তব। আর এইভাবে অনেকক্ষণ কেটে গেল সেটাও তো সত্যি। তাহলে? তাহলে কোথায় যাচ্ছি আমরা? কোন পথে যাচ্ছি আর পৌঁছোবই বা কোথায় তা জানার চেষ্টা করব না? বিশেষত এইরকম দুর্বিষহ যাত্রায়?
অথচ বাসের অন্য লোকগুলো? দেখা গেল তারা আমার ভাই বৌ মেয়ে বন্ধু আরো সব কাছের মানুষজন। তারা বড়ো ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। তাই তারা ভ্রুক্ষেপই করলো না আমায়। এটাও ঘটনা।
'তার সঙ্গসুখে মগ্ন হয়ে আমি পরবর্তী জীবন কাটাইনি। যদিও জ্ঞান হওয়ার খানিক পরেই ওর সাথে আমি মিলিত হয়েছিলাম এক ঘোরের মধ্যে।' আমি বলতে যাচ্ছিলাম—'সে কি? ঘোরের মধ্যে?' কিন্তু আমার বলার আগেই তিনি বলতে শুরু করলেন—'অজ্ঞান অন্ধকারে কতকাল যে তলিয়েছিলাম কে জানে। জ্ঞান আসার পর দেখলাম এক রমণীর মুখ—আমার মুখের খুব কাছে কিন্তু যেন কতদূর থেকে বলছে—'কেমন আছেন কুমার?' তারপর স্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম—
চুলোয় যাক আমাকে তোরা চিনলি কি চিনলি না সেই কথা। কিন্তু একবারটির জন্য বাইরে তাকিয়ে দ্যাখ—অন্ধকারে এইভাবে কোথায় চলেছি আমরা। বাসটা যদি উল্টে পড়ে বা ধাক্কা খায় এই অন্ধকারে—তাহলে কি ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে আমাদের সবার! আর যদি তা নাও ঘটে—তাহলেও এভাবে এই যাত্রার শেষ কোথায় আর কিভাবে তা একবারও ভাবছো না তোমরা?
গাড়ির কনডাকটারটার তো কোনো হেলদোল নেই দেখছি। আর ড্রাইভার তো বলেই দিল—'জাহান্নামে'। তাহলে? তাহলে লাফিয়ে নেমে যাই ওই দরজা দিয়ে—বাইরের অন্ধকারে—তারপর যা হয় হবে।
ভাবতে ভাবতে বাইরের দিকে তাকালাম। আবার সেই চাপচাপ অন্ধকার। আর সেই একটানা গুমগুম শব্দ। শব্দটা যেন একটু একটু করে আস্তে হয়ে এলো। বাসের স্পীডটাও মনে হল ক্রমশ কমে আসছে কিন্তু অন্ধকারটা—অন্ধকারটা আরো ঘন হয়ে এল। হঠাৎ যেন শ্বাস নিতে পারছিলাম না। দমটা যেন গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছিল। প্রাণপণে বলতে চেষ্টা করছিলাম—'বাঁচাও —আমাকে বাঁচাও তোমরা—তোমরা তো আমারই আপনজন—আমার এত কাছেই রয়েছো—আর আমি ..'। রমলা, তিতির, অনিমেষ ... মুখগুলো হাতড়াতে লাগলাম অন্ধকারে।
কিন্তু কিছুই পেলাম না। শুধু আরো গাঢ় অন্ধকার ছাড়া। সমস্ত শরীর যেন হঠাৎ ঝিমঝিম করতে শুরু করলো। হাত-পাগুলো যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে মনে হল। যেন ক্রমশ স্থির হয়ে গেলাম এক গভীর শীতল অন্ধকারে।
সময়ের কোনো হিসেব নেই—ওই গাঢ় অন্ধকার থেকে কিভাবে কখন ভেসে উঠলাম ধীরে ধীরে এক হাল্কা আলোয়—চোখ মেলে দেখলাম মাথার উপরে টানটান নীল আকাশ—চারিদিকে ঘন সবুজ মাঠ আর আমি পড়ে আছি ওই মাটিতেই। টের পেলাম মাটির সোঁদা গন্ধ—ঘাসের নরম স্পর্শ—চোখেমুখে ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়া।
উঠে বসতে গেলাম—পারলাম না—গড়িয়ে পড়লাম ওই মাটিতেই—ডান হাত দিয়ে টাল সামলাতে গেলাম প্রচণ্ড টনটন করে উঠলো ডান হাতের কব্জিটা—এইবার টের পেলাম সারা শরীরেই কি অসহ্য ব্যথা। পায়ের তলায় হঠাৎ কি একটা বিঁধলো মনে হল। অতিকষ্টে পা'টা টেনে এনে দেখলাম পায়ের পাতায় লেগে রয়েছে একটা বিষাক্ত লাল পোকা।
ঠিক তখনই মনে হল—তাহলে? তাহলে তো আমি বেঁচে আছি। হ্যাঁ! নিশ্চিতভাবেই বেঁচে আছি। তবে এভাবে কেন? এভাবে পড়ে থাকব কেন? প্রাণপণ চেষ্টায় উঠে বসলাম। দেখলাম চারিদিকে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। কোনো জনপ্রাণি নেই কোথাও। বাতাস বইছে হু হু করে। দূরের মেঘে সোনালী আভা ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। তার মানে দিনের শেষে কোথাও আমি পড়ে আছি এইভাবে একা —সম্পূর্ণ একা।
হঠাৎ যেন মনে হল কেউ এসে দাঁড়ালো আমার পিছনে। ঘুরে তাকিয়ে দেখি ঠিক তাই। সেই কনডাকটারটা আমার একেবারে পিছনটায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি সেই বাসটাও দাঁড়িয়ে রয়েছে তারই পিছনে।
জিজ্ঞাসা করলাম—'এ কোন জায়গা? কোথায় এলাম দাদা?' ও কোনো উত্তর করল না। নির্বিকার মুখে খৈনী টিপতে লাগলো সমানে। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা বাসের বাকিরা কোথায়? খৈনী টিপতে টিপতে ও উত্তর দিল—'নেমে গেছে—যে যার জায়গা মতো নেমে গেছে'। তারপর একটু থেমে ফের বলল—'তুমি ছাড়া'।
জিজ্ঞাসা করলাম—'সেকি? কেন? তাহলে আমি কেন—' আমার কথার মাঝেই ও বলে উঠলো—'তুমি শালা কখন গড়িয়ে পড়েছো এখানে কে জানে'। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলাম—'এ জায়গাটা কোথায়? কোথায় এলাম তাহলে?' 'এটা টার্মিনাস'—উত্তর দিল সে। 'মানে?'—জিজ্ঞাসা করতেই 'স্বর্গের শেষ স্টেশন'—বলে মুচকি হেসে উল্টোদিকে হাঁটতে লাগল লোকটি।
আমি চেঁচিয়ে বললাম—'আরে যাচ্ছো কোথায়? শোনো শোনো!' ও উত্তর দিল—'গাড়ি স্টার্ট দিতে হবে না? ফিরতে হবে না? উজবুক কোথাকার।' তারপর কি মনে করে পাদানিতে একটা পা রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো—'যাবে নাকি? না পড়ে থাকবে এখানে?'
সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম—'না না। যাব যাব। দাঁড়াও দাঁড়াও।' সে কোনো উত্তর না দিয়ে বাসের ভিতর ঢুকে পড়লো। একটু হকচকিয়ে গেলাম তার ব্যবহারে। ভাবলাম চেঁচিয়ে বলি—'কি হোলো? কিছু বললে না যে।' ঠিক সেই সময়েই সে মুখ বাড়িয়ে উত্তর দিল—'না না। থাক থাক। তুমি যা মাল। আসার সময় যা কাণ্ড করলে'। বলেই থুঃ করে এক থাবড়া থুতু ফেললো মাটিতে।
তখনই মনে পড়ে গেল সেই ভয়ঙ্কর সুড়ঙ্গের কথা—সেই বীভৎস অন্ধকারের কথা। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম —'ফেরার সময়ও কি সেই একই পথ দিয়ে--' আমায় মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সে বলে উঠলো--'হ্যাঁ হ্যাঁ সেই সুড়ঙ্গ'। চমকে উঠে বললাম—'না-না-আর নয়'। 'যত্তো বাজে পাবলিক'—বলে ও সেঁধিয়ে গেল বাসের ভিতর। আর বাসটাও স্টার্ট দিল সাথেসাথেই। আমি দৌড়ে উঠবো ভাবলাম কিন্তু অশক্ত শরীর আর সেই সুড়ঙ্গের চিন্তা আমায় স্থির বসিয়ে রাখলো ঐ ঘাসজমির উপর।
বাসটা আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করলো—আর তখনই মনে হল--'তাহলে? তাহলে কি হবে এবার? এই জনমানবহীন ধূ ধূ মাঠে একা পড়ে থাকব এইভাবে? তারপরেই মনে হোলো—'এ তাও ভালো—ওই বাসে ওঠার চেয়ে—ওই সুড়ঙ্গে ঢোকার চেয়ে—আর ওই মানুষগুলোকে দেখার চেয়ে।'
ভাবতে ভাবতেই যেন চারিদিকের আলো অতি দ্রুত কমে আসতে থাকলো মাথার উপরের আকাশ কালচে নীল হয়ে গেল। ওই আধো অন্ধকারে দূর থেকে কে যেন হেঁটে আসছে বলে মনে হল। শরীরের আদলটা ঠাহর করতে পারছি বলে মনে হল ওই আবছায়াতেই।
আরে এতো ওই বাসের ড্রাইভার বলে মনে হচ্ছে! লোকটি আরো এগিয়ে এলে নিশ্চিত হয়ে বলে ফেললাম—'আপনার বাস তো চলে গেছে একটু আগেই।' কথাটা শুনেই দাঁড়িয়ে পড়লো লোকটা। মনে হল আমার কথা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না সে। একটু থেমে আমি বললাম—'হ্যাঁ আমি নিজে দেখেছি। একটু আগে আমার সামনে দিয়ে চলে গেল বাসটা।' অন্ধকারেও বুঝতে পারলাম লোকটি যেন পাথর হয়ে গেছে আমার কথায়।
আমি দু'চারটে কথা বলে ব্যাপারটাকে একটু হালকা করতে চেষ্টা করলাম।
'আমারও তো খুব অবাক লাগলো...'
'কনডাক্টর দাদার সঙ্গেও তো কথা হলো...'
'আমায় উঠতে বলেছিলো বাসটায়...'
'কিন্তু আমি নিজেই রয়ে গেলাম...'
'আসলে আবার সেই রুট মানে সেই সুড়ঙ্গ...'
'মানে অন্ধকার আমি সহ্য করতে পারি না বলে...'
'তাই ভাবলাম বরং এখানেই থাকি...'
'আর তখনই আমার চোখের সামনে দিয়ে...'
দেখলাম লোকটি হঠাৎ দূরে কিছু একটার দিকে তাকালো—তারপর প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল সেই দিকে।
লক্ষ্য করে দেখলাম—দূরে যেদিকে দৌড় লাগালো লোকটা, সেদিকে দেখা যাচ্ছে দুটো আলোর বিন্দু যেন ক্রমশ বড়ো হয়ে সামনে এগিয়ে আসছে। আরে! তার মানে একটা চলন্ত গাড়ী—বোধহয় বাস—আর তার জন্যই মনে হয় দৌড় লাগালো লোকটা—বাসটাকে ধরবে বলে। তাহলে তাহলে আমি কি করি? আমিও কি দৌড়বো নাকি বাসটাকে ধরতে? এদিকেই তো আসছে বাসটা—যদি হাত নেড়ে থামাতে পারি—
আলো দুটি দ্রুত বড়ো হয়ে এগিয়ে এসে আমার চোখ ধাঁধিয়ে চলে গেল হু হু করে। বুঝলাম আমার অনুমানই ঠিক। হুবহু একই রকমের দেখতে একটি বাস—নিশ্চয়ই একই রুটের। সেই বুঝেই ড্রাইভারটা পড়িমরি করে দৌড় লাগিয়েছিলো। আগেরটা মিস করে গেছে—এবার যা হোক করে ওকে রুটে ফিরতেই হবে।
তারপরেই মনে হলো—'কিন্তু ওকে নিয়ে আমার এতো ভাবার কি আছে? আমি বরং আমার কি হবে এখন তাই ভাবি।' এদিকে অন্ধকারটাও যেন হঠাৎ বেড়ে গেল বহুগুণ। মাথা নীচু করে বসে পড়লাম। ভাবলাম আমি কি বিরাট ভুল করলাম? যেতে তো পারতাম আমিও। ওই ড্রাইভারটার মতো অনায়াসে। কিন্তু আবার সেই রুট—সেই সুড়ঙ্গ— সেই অন্ধকার! শুধু অন্ধকার নয়, আবার যদি সেই মর্মান্তিক দৃশ্যগুলো আমায় সহ্য করতে হয় দেখতে হয় সেইসব লোকগুলোকে? তার চেয়ে এই আকাশের নীচে যা ঘটে ঘটুক সে অনেক ভালো।
সেই সাথে এও মনে হলো যে এই জনমানবহীন ধূ ধূ মাঠে ভয়াবহ অন্ধকারে এভাবে কতক্ষণ একা থাকতে পারবো? তার চেয়ে যেদিকে দু'চোখ যায় চলে যাই। ভাবতে ভাবতে উঠে পড়লাম।—এক পা এক পা করে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম— মনে হলো কেউ যেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে—টলমল করতে করতে।
তারপর বুঝলাম এতো সেই ড্রাইভারটা। বললাম— 'কি হলো গেলেন না?' কোনো উত্তর এলো না। লোকটি দাঁড়িয়ে পড়লো— পাথরের মূর্তির মতো। আমার থেকে হাত খানেক দূরে নিঃশব্দে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। বললাম— 'কি? থামলো না? বেরিয়ে গেল?' কোনো উত্তর এলো না।
ওই গভীর অন্ধকারে তার মুখের ভাব কি চোখের ভাষা কিছুই বুঝতে পারলাম না। কেন জানি না হঠাৎ মনে হলো এই লোকটি আমার আপনজন। বহুকাল আগে কোথায় যেন দেখেছি একে।
'এখন কোথায় যাই বলতো খোকা?'
—এই কথার সাথে সাথে ওই যৎসামান্য আলোতেও বুঝতে পারলাম আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে বছর তিরিশ আগে হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া আমার সেই পিতৃদেব—
অর্থাৎ সেই মুহূর্তে চুয়াল্লিশ বছরের আমি আর আমার সমবয়সী পিতা এইভাবে এক হীন জ্যোৎস্নায় মুখোমুখি হলাম—পৃথিবীর প্রান্তে এই অবধারিত অযাত্রার শেষে।
(বিখ্যাত নাট্যকার ফ্রেড্রিখ ড্যুরেনমাট—এর ছোটোগল্প 'দি টানেল' এর দ্বারা প্রাণিত)