• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৬ | মার্চ ২০১৪ | গল্প
    Share
  • দিঘির গভীরে : দেবর্ষি সারগী


    মাঝরাতে মাধবী ও আমি ঘোড়ায় চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা মাঠে। আমাদের দু'জনের মনই ভাল নেই। দু'জনেই বেশ প্রৌঢ় হয়েছি এবং এই সময় অন্য সকলের মতো আমরাও প্রায়ই আসন্ন মৃত্যুর কথা ভাবি। বিমর্ষ থাকি। আমাদের একমাত্র ছেলে বিদেশে। আমরা এই গ্রামটাতেই জীবন কাটিয়ে দিলাম।

    শ্রাবণের নরম আকাশে চাঁদ স্থির হয়ে আছে, আশপাশে মেঘ ভেসে চলেছে, আর ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে ঝিরঝির করে। কথা না বলে দুটো প্রকাণ্ড ঘোড়ায় বসে আমরা কখনও সামনে পেছনে, কখনও পাশাপাশি ঘোরাঘুরি করছি বিশাল মাঠটার ওপর দিয়ে। এই মাঠ আমাদের শৈশব থেকেই চেনা। আমি আর মাধবী এই গ্রামেই জন্মেছি, এখানেই বড় হয়েছি, একই স্কুলে পড়েছি — এখানে সবই আমার চেনা। কথা বলছিলাম না কেউই। মাধবী তো অস্বাভাবিক রকম চুপ। বিমর্ষতায় পুরোপুরি ডুবে আছে। দূর থেকে ওর সাদা সালোয়ার-কুর্তা ও বসার নিথর ভঙ্গি দেখলে মনে হতে পারে কোনও পাথরের মূর্তিকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে ঘোড়াকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মাঠটার কোন কোন অংশে ঘুরে বেড়াবে, ঘোড়াটাই ঠিক করছিল। আমি আধবোজা চোখে ওকে অনুসরণ করে যাচ্ছিলাম।

    মাঠ থেকে নেমে ঘোড়াটা একটা ছোট একতলা হাসপাতালের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল, তারপর একটা আমবাগানে ঢুকল। এখানে শুধু আমের গাছ। ছোটবেলায় মাধবীকে নিয়ে আমি এখানে আম কুড়িয়েছি। গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে আমরা এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কখনও কোনও গাছের নীচে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম, আর নীচের ঘাসে মুখ দিয়ে ঘোড়াদুটো চবর চবর করে ঘাস চিবোচ্ছিল। বাগান থেকে বেরিয়ে আসার সময় হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য চাঁদের উজ্জ্বল আলো পড়ে মাধবীর মুখে এবং আমার মনে হল সে যেন গভীর ঘুমে ডুবে আছে। হয়ত স্বপ্নও দেখছে। আর ঘোড়াটা নিজের ইচ্ছেমতো ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ্য আমাদের ঘোড়াদুটো খুবই অনুগত। আমরা কিছু না বললেও ওরা আমাদের মনের ইচ্ছে বুঝে নেয় এবং সেভাবে ঘুরে বেড়ায়। হাসপাতালটার পাশ দিয়ে হেঁটে মাধবীর ঘোড়াটা আবার মাঠের কাছে এল, পেছনে পেছনে আমার ঘোড়া, তারপর মাঠের পাশ কাটিয়ে এগোতে লাগল স্কুলের দিকে।

    স্কুলের গেট অনেক দিন থেকেই ভাঙা। ফলে স্কুলের ভেতর ঢুকতে কোনও বেগ ঘোড়াদুটো পেল না। গেটের সামনে থেকে হেডমাস্টারের ঘর পর্যন্ত সার সার দেবদারুর গাছ দাঁড়িয়ে। ওরা দাঁড়িয়ে সেই আমাদের শৈশব থেকে — তারও অনেক আগে থেকে — গাছেরা সত্যি প্রচুর বাঁচে। এই স্কুলেই আমি আর মাধবী পড়েছি। দেবদারু বীথির ভেতর দিয়ে এগিয়ে মাধবীর ঘোড়া হেডমাস্টারের বন্ধ অফিসটার সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকল, মাধবী চোখ বুজে আগের মতোই নিথর বসে, হয়ত জানেই না ঘোড়াটা ওকে আমাদের স্কুলের ভেতর নিয়ে এসেছে। অনেকক্ষণ ওভাবে বসে থাকার পর মাধবী হঠাৎ ঘোড়া থেকে নামল, তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে বাঁদিকের ক্লাশঘরের দিকে এগিয়ে গেল। আমি ঘোড়ার ওপরেই বসে থাকলাম। মনে পড়ল ওই সিঁড়িগুলোয় কত বসেছি। হেডমাস্টারের ঘরেও কত ঢুকেছি। কয়েকবার মাধবীর সঙ্গে। ওইখানে লাইন দিয়ে প্রার্থনা হত। ওইখানে একবার দৌড়তে গিয়ে মাধবীর গায়ে পড়ে গিয়েছিলাম এবং সেই প্রথম নাকে পেয়েছিলাম ওর চুলের গন্ধ।

    ভাবনাগুলো আমাকে গভীর বিমর্ষতায় ডুবিয়ে দিচ্ছিল। আমার নড়তে ইচ্ছে করছিল না। ভাল করে চোখ খুলতে ইচ্ছে করছিল না। অনেকক্ষণ পর, চারপাশের গভীর স্তব্ধতা ছিঁড়ে, কানের ভেতর স্কুলের কোনও বহু পুরনো, অস্পষ্ট ঘন্টাধ্বনির মতো ভেসে আসতে লাগল কিছু ক্ষীণ কণ্ঠস্বর, উচ্ছ্বাসের, আনন্দের, অভিযোগের — হয়ত শ্যামলের, হয়ত অনুপের, অজয়ের, রাধার, শ্যামলীর, বিকাশের ....। শ্যামল অনুপ অজয় রাধা শ্যামলী বিকাশ — ওরা সব কোথায় আছে? কে কে টিঁকে আছে এখনও? ঝিরঝির বাতাসে দেবদারুর পাতা কাঁপছিল। চাঁদের নরম আকাশে। সিঁড়িগুলোর চুন বেরিয়ে কিছু কিছু জায়গা ধবধবে সাদা হয়ে গিয়েছিল। ঘোড়াটার লাগামে টান দিয়ে নড়ালাম ওখান থেকে, তারপর এলোমেলোভাবে স্কুলের প্রাঙ্গনে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

    মন আরও বিমর্ষতায় ডুবে যাচ্ছিল।

    অনেকক্ষণ পর মাধবীর কথা মনে পড়ল। বাঁদিকের ক্লাশঘরগুলোর দিকে এবার আমিও এগিয়ে গেলাম। ওই বাড়ির দোতলাতেই আমাদের টেন-ইলেভেনের ক্লাশ হত। ক্লাশঘরে বড় বড় জানলা, তার ভেতর দিয়ে নীচে দেখা যেত পেয়ারা, কুল, বুনো লতাপাতার আকুলিবিকুলি, আর মাঝে মাঝে গরুর খুর থেকে উঠে আসা শব্দ মড়মড় করে পাতা মাড়ানোর। সামনে একটা প্রকাণ্ড পাথরের মতো দাঁড়িয়ে মাধবীর ঘোড়া। পিঠে মাধবী নেই। হয়ত দোতলায় উঠেছে।

    ঘোড়া থেকে নেমে আমিও দোতলায় উঠলাম। একটা দীর্ঘ বারান্দা এল। মাধবীকে চোখে পড়ল না। পরপর ক্লাশগুলোয় তালা মারা। ডানদিকে একেবারে শেষ ঘরটার সামনে দেখি মাধবী দাঁড়িয়ে, বন্ধ দরজার গায়ে মাথা ঠেকিয়ে, যেন ওভাবে দাঁড়িয়ে সে ঘুমোচ্ছে বা আরও গভীর বিমর্ষতায় ডুবে গিয়েছে। কিছু না বলে একটু দূরে আমিও দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার খুব মন খারাপ করছিল। স্যার না আসা পর্যন্ত এই বারান্দায় ছেলেমেয়েরা জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকত। মেয়েরা মেয়েদের সঙ্গে, ছেলেরা ছেলেদের সঙ্গে। তারই ভেতর মাধবী হঠাৎ চোরাদৃষ্টিতে একপলক তাকাত আমার দিকে। আমার বুক ঢিপ ঢিপ করত।

    অনেকক্ষণ মাধবী একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। আমিও। হঠাৎ দেখি মাধবী বন্ধ দরজাটা ঠেলার চেষ্টা করছে। কাছে গিয়ে দেখি ওটাতেও তালা মারা। তবে টান দিলে লোহার বালা অনেক সময় বেরিয়ে আসে। এখানেও বেরিয়ে আসে কিনা দেখতে একটা বালায় টান দিলাম এবং দরজার ভেতর দিয়ে ওটা বেরিয়ে এল। দরজা ঠেলে আমরা ভেতরে ঢুকলাম।

    বড় বড় জানলা, যা খোলাই পড়েছিল। ওগুলো দিয়ে যে আলোর আভাস আসছিল তাতে ঘরটার ভেতর আবছা দেখা যাচ্ছিল। ব্ল্যাকবোর্ড। ওইখানে মাধবী বসত, এইখানে আমি। মেয়েরা মেয়েদের জায়গায়, ছেলেরা ছেলেদের। মাধবী সব সময় বসত প্রথম বেঞ্চের মাঝখানে, ঘরটার বাঁদিকে। আর আমি ডানদিকের দ্বিতীয় বেঞ্চের কোণে। মাঝখানে ব্ল্যাকবোর্ড এবং স্যার। ফলে ব্ল্যাক বোর্ডের দিকে বা স্যারের দিকে তাকাবার সময় আমাদের প্রায়ই চোখাচোখি হত। আর প্রতিবারই আমার বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করত, যেন নাগরদোলায় চেপে নীচের দিকে নামছি, যেন অনেকদিন পর বাড়ি ফিরে আমাদের রেলস্টেশনে পা রাখলাম, বা কোনও হারানো জিনিস হঠাৎ খুঁজে পেলাম।

    ক্লাশঘরটায় ঢুকে মাধবী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, চোখ খুলে চারপাশে ভাল করে তাকাল — এখন আর সে ঘুমোচ্ছিল না — তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে যে জায়গায় বসে সে ক্লাশ করত ঠিক সেই জায়গায় গিয়ে বসল। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

    চোখের পলক না ফেলে মাধবী চুপ করে বসে থাকল সেখানে, অনেকক্ষণ, দূরে কোনও পাখি একবার ডেকে ওঠে, যদিও ভোর হতে তখনও অনেক বাকি। এক সময় এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। এবং আবছা আলোয় লক্ষ করলাম ওর দু'চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া কোনও অস্পষ্ট ক্ষীণ নদীর মতো। বিষাদে আমারও কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না, তবু ওর কাঁধ আলতো করে ছুঁয়ে বললাম, 'এবার চলো।'

    মাধবী একইভাবে বসে থাকে। আমি আর কিছু না বলে আগের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম।

    'তুমি বসতে ওই বেঞ্চটার ওই কোণে', মাধবী হঠাৎ মুখ খোলে।

    কিছু না বলে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। মাধবীর নিথর দৃষ্টি সামনের দিকে। একপাশে ব্ল্যাকবোর্ডটা।

    'এবার চলো,' আমি বললাম।

    'তারপর তো সময় বয়ে যায়নি,' মাধবী বলল। ওর গলায় অদ্ভুত কম্পন। কিন্তু মুখটা স্থির। 'আমার যখন সব এত স্পষ্ট করে মনে পড়ছে তখন কী করে বলি সব হারিয়ে গিয়েছে? আমার মনে হচ্ছে আমি এই মুহূর্তে ক্লাশ করতেই এসেছি। একটু পরেই গঙ্গাপদবাবু অঙ্ক পড়াতে আসবেন। বা কিশোরীবাবু ইংরেজি। বা রাধারমণবাবু ইতিহাস। আমার যখন সব এত স্পষ্ট করে মনে আছে তখন কী করে বলি সময় তারপর বয়ে গিয়েছে? কী করে বলি আমি বুড়ি হয়ে গিয়েছি? এরপর হঠাৎ একদিন মারা যাব?'

    আমি চুপ করে থাকি। এ প্রশ্ন তো আমারও।

    'এবার চলো,' ধীর কণ্ঠস্বরে আমি বললাম।

    'কে বলল মাঝখান থেকে কোনও সময় বয়ে গিয়েছে?'

    'আমাদের শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে। মনের ওপর দিয়ে যায়নি। আমাদের শরীর বুড়ো হয়। মন একই রকম থাকে।'

    'অথচ শরীরটার জন্য শেষ পর্যন্ত আমাদেরও মরে যেতে হয়।'

    'হ্যাঁ, মাধবী।'

    'অথচ মনে হয় সেই শৈশবেই তো এখনও আছি। এই তো সেদিন জন্মালাম। সময় তো বয়েই যায়নি। তবে মারা যাব কেন?'

    এবার হালকা স্বরে ফুঁপিয়ে উঠল মাধবী। এক মুহূর্তের জন্য। তারপর আবার স্তব্ধতা। বাইরে এখনও ঢের রাত, ভোর হতে এখনও ঢের বাকি।

    বিমর্ষতার চাপ আমার সহ্য হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল বাড়ি গিয়ে একটু শুয়ে থাকতে পারলে ভাল হয়।

    'এবার চলো,' আমি বললাম। মাধবী উঠল না। এবং সে আর কিছুতেই উঠল না। তার ওই কৈশোরের ক্লাশ ঘরটায় ওরকম স্থির হয়ে বসে সে আর কী কী ভেবে গেল, জানি না। হয়ত একইসঙ্গে চিরন্তনতার সুখ ও বেদনা অনুভব করে যাচ্ছিল। যাই ভাবুক, শেষ পর্যন্ত কোনও কিছুই যে ওর কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল না, সেটা আমি জানতাম। কারণ আমার নিজের কাছেও কিছু স্পষ্ট হচ্ছিল না। শুধু জানলার বাইরে আলোটাই যা একটু স্পষ্ট হয়ে উঠছিল আস্তে আস্তে।

    'এবার চলো,' আমি আবার বললাম একটা বিকল যন্ত্রের মতো। এবার সে উঠল। টলতে টলতে নীচে নেমে নিজের ঘোড়াটায় চাপল। আমি আমার ঘোড়াটায়। বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। মাধবী সামনে, আমি পেছনে। ধোঁয়া মাখা লন্ঠনের কাচের মতো ভোর হচ্ছিল চারপাশে। আমাদের বাড়ির পথে একটা খুব বড় বাঁধানো দিঘি আছে। ওটায় গভীর জল। লোকেরা ছিপ ফেলে বড় বড় মাছ তোলে। মাধবীর প্রকাণ্ড ঘোড়াটা হঠাৎ এগিয়ে গেল দিঘিটার দিকে, তারপর সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত হেঁটে নিঃশব্দে জলের ভেতর কোথাও নেমে গেল।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments