পলির দিদি মলি যখন তাকে গোপন কথাটা বলেছিল তখন বারবার করে বলে দিয়েছিল, “গোপন কথাটা তোকে বললাম বটে কিন্তু কাউকে বলিস না যেন, তাহলে সব আনন্দ মাটি হয়ে যাবে!”
মলি তো আর জানত না যে পলি কোন কিছুই চেপে রাখতে পারে না! প্রথম দিনটা পলি চুপ করেই ছিল। তারপরের দিন থেকেই ওর মনে হতে লাগল কথাটা কাউকে না বলতে পারলে ওর মাথা আর পেট দুটোই ফেটে যাবে! কী করা যায়, কী করা যায় ভেবে পলি ঠিক করল যে সে তুলতুলিকে বলবে কথাটা।
তুলতুলি আর পলি একই স্কুলে পড়ে কিন্তু গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করার সময় ওদের সাথে আরো এক গাদা মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাই তখন কিছুই বলা গেল না। এদিকে পলির তো মাথা কিলবিল, পেট সুরসুর! ক্লাসেও সর্বত্র গাদা গাদা মেয়ে, কোথাও আর তুলতুলিকে একা পাওয়া যায় না! শেষে টিফিনের সময় ওকে একা পেয়ে হুড়মুড় করে সব বলে দিয়ে শান্তি পেল পলি!
শুনে তুলতুলির চোখ গোলগোল হয়ে গেল, সে বলল, “তাই নাকি! দারুণ ব্যাপার তো!”
পলির মুখ আনন্দে চকচক, হেসে বলল, “হ্যাঁ খুব মজা, তাই না? কিন্তু কাউকে বলিস না যেন। দাদাকে চমকে দেওয়ার পরিকল্পনা আমাদের। সারপ্রাইজ দেওয়া হবে ওকে।"
“হ্যাঁ, গোগোলদা বেদম চমকে যাবে। তা তোর দাদার জন্মদিনটা কবে?”
“এই মাসের পঁচিশ তারিখ।”
“ও আচ্ছা!”
তুলতুলি দুদিন কথাটা কাউকে বলল না। তারপর তার মনে হল দিদিকে বললে কিছু হবে না। সেদিন রাতে দুজনে যখন পড়তে বসেছে তখন তুলতুলি তার দিদি বুলবুলিকে বলল, “দিদি তোকে একটা গোপন কথা বলব?”
বুলবুলি চোখ বড়ো করে বলল, “গোপন কথা তুই কোথা থেকে জানলি?”
“পলি বলেছে!”
বুলবুলি উৎসুক হয়ে বলল, “তোকে যখন বলে দিয়েছে তখন আর গোপন থাকল কোথায়? কী বলেছে বল?”
তুলতুলি বেশ রসিয়ে রসিয়ে দিদিকে গোপন কথাটা বলে দিল।
“ওমা তাই নাকি! বেশ মজা তো!”
“তুই কিন্তু কাউকে বলিস না, তাহলে পলি ভয়ানক রাগ করবে!”
“গোগোলের জন্মদিনটা কবে?”
“এই মাসের পঁচিশ তারিখ।”
তুলতুলি-বুলবুলির মা ঠিক তখনই ঘরে এসে ঢুকলেন। শেষের কথাটা শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী আছে এই মাসের পঁচিশ তারিখে?”
অগত্যা পুরো ব্যাপারটা মাকেও বলতে হল। মাও শুনে ভারি খুশি। তুলিতুলি বারবার করে বলে দিল, “ব্যাপারটা কিন্তু ‘টপ সিক্রেট’ কাউকে বল না!”
কিন্তু তা বললে কি হয়? তুলতুলির মার প্রিয় বন্ধু সুমিতামাসি। মার সাথে সুমিতামাসির রোজ দুপুরের আড্ডায় যত প্রাণের কথা হয়। মা সুমিতামাসিকে বলবেন না এমনটা হতেই পারে না, তাই মা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বুলবুলি বলল, “নে এবার হল তো? সুমিতামাসিও জেনে যাবেন এবার। আর সুমিতামাসি জানলে পাড়ায় আর কারো জানতে বাকি থাকবে না! উনি তো পাড়ার খবরের কাগজ, টিভি, এফ এম রেডিও সব কিছু একসাথে!”
তুলতুলি ভয় কাঁদকাঁদ হয়ে বলল, “কী হবে এবার?”
“অত ভয় পাস না, দেখা যাক না ব্যাপারটা কত দূর গড়ায়!”
জন্মদিনের দুদিন আগে সোনার আলো এসে পলিকে বলল, “জানিস পরশু দিন গোগোলদার জন্মদিন আর সেদিন না...!”
পলি আঁতকে উঠে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “অ্যাঁ! তোকে কে বলল?”
“কেন, আমার দাদু!”
“তোর দাদু জানলেন কী করে?”
“দাদুকে ঘোষদাদু বলেছেন! তুই শুনতে চাস না কী বলেছেন?”
“গোগোলদা তো আমার খুড়তুত দাদা রে! আমি জানি ঘোষদাদু কী বলেছেন!”
সোনার আলো ব্যাজার মুখ করে বলল, “দুর তোকে বলে একদম মজাই হল না! যাই গিয়ে দিয়াকে বলে আসি!”
পলি এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিল যে ‘না বলিস না’-টুকু বলতেও ভুলে গেল। ওর আর বুঝতে বাকি রইল না কার কাজ এটা!
তুলতুলি দরজা খুলে দেখল পলি এসেছে। সে হেসে বলল, “কী রে পলি, এখন হঠাৎ কী মনে করে?”
পলি রাগত ভাবে বলল, “তুই ভাল করেই জানিস কেন! আমি তোকে বলতে বারণ করেছিলাম না? তাও তুই সবাইকে বলে দিয়েছিস! ছি ছি!”
তুলতুলি শুকনো মুখ করে বলল, “না রে, আমি শুধু দিদি আর মাকে বলেছিলাম। তারপর একে একে সবাই যেন কী ভাবে জেনে গেল!”
“তোকে আমি বলেছিলাম না কাউকে বলিস না তাও তুই কেন প্রমিস ভাঙলি?” চিৎকার করে বলতে লাগল পলি।
ওর চিৎকার শুনতে পেয়ে বুলুবুলি এসে হাজির হল। পলির দিকে তাকিয়ে সে বলল, “ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে একটা কথা বল পলি, তোকে কথাটা কে বলেছিল?”
“আমার দিদি মলি।”
“সাথে আর কী বলেছিল?”
লজ্জিত মুখে পলি বলল, “বলেছিল কাউকে বলিস না!”
“তাহলে প্রমিসটা আগে কে ভেঙেছে?”
পলির মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে গেল।
“তোর তো খুশি হওয়া উচিত যে এত লোক জানা সত্বেও গোগোলকে কেউ কিছু বলেনি বা সারপ্রাইজটা নষ্ট হয়নি! এখন আর ঝগড়া তর্ক করে এর ওর ঘাড়ে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কীভাবে ব্যাপারটাকে সামলানো যায় সেটা নিয়েই ভাবতে হবে।”
তিনজনে মিলে ভাবতে বসল।
একটু ভেবেই তুলতুলি বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে!”
“কী?”
“এবার রটিয়ে দি যে গোগোলদার চিকেন পক্স হয়েছে! তাহলে আর কেউ ওমুখো হবে না!”
বুলবুলি বলল, “ছি ছি! জন্মদিনের সময় ওর নামে ওই কথা রটাবি? সেটা মোটেই ভাল হবে না!”
অনেক ভেবে তিনজনে একটা ফন্দি বার করল।
গোগোলদা প্রতিবারই বলল, “ওমা আপনি কী করে জানলেন? ওটা তো সারপ্রাইজ ছিল তাই আমি কিছুই জানতাম না! এই তো সবে ওগুলো পেলাম!”
আর সবাই উত্তর দিল, “ফ্ল্যাটে নতুন ল্যাপটপ আর আইপড ন্যানো আসবে আর আমরা জানব না?”
ভাগ্য ভাল পলি, তুলতুলি আর বুলবুলির বুদ্ধিতে সেদিন সাত সকালেই পলির মা দুখানা, তুলতুলির মা দুখানা আর সুমিতামাসি একখানা কেক বানিয়ে গোগোলদার মাকে দিয়ে এসেছিলেন, নাহলে কাকিমা মুশকিলে পড়ে যেতেন।
জন্মদিনের দিন যারা শুভেচ্ছা জানাতে আসছে তাদের অন্তত কেকটা তো খাওয়াতেই হয়!
শুধু মলি রাগ করে পলিকে বলেছিল, “তোকে আর আমি কোনদিনও কোন গোপন কথা বলব না!”