• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৬ | মার্চ ২০১৪ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • অসম্পূর্ণ চেনার বেদনা : শংকর চট্টোপাধ্যায়


    দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর : জীবন ও সৃজন; সুভাষ চৌধুরী; প্রথম প্রকাশ : ২০১৩, প্রতিভাস - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ; ISBN :

    আলোচ্য বইটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম অংশে দিনেন্দ্রনাথের জীবনকথা আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে দিনেন্দ্রনাথের সৃজন। শেষ পর্বে পরিশিষ্ট রূপে সংকলিত হয়েছে দিনেন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিপত্র। লেখকদের মধ্যে আছেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ। দ্বিজেন্দ্রনাথের লেখা চিঠি কবিতাকারে দিনেন্দ্রনাথের জন্মদিনে লেখা আশীর্বচন এবং একটি নিমন্ত্রণপত্র। এই বইটির শেষ কবিতাটি কবি জসীমউদ্‌দীনের। দিনেন্দ্রনাথের স্মৃতিবাসরে কবিতাটি পঠিত হয়। দিনেন্দ্রনাথের সৃজন অংশে ১৯১২ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'বীণ'-এর কবিতাগুলি, তার পরবর্তীকালে রচিত কয়েকটি কবিতা এবং চোদ্দটি গান (স্বরলিপি-সহ) মুদ্রিত হয়েছে । তাঁর কবিতাকারে লেখা কিছু চিঠিও এই পর্বে সংকলিত। দিনেন্দ্রনাথের দুটি প্রবন্ধ সৃজন পর্বে মুদ্রিত না করে লেখক দিনেন্দ্রনাথের জীবনকথা অংশে ব্যবহার করেছেন। এই নিবন্ধ দুটির মূল্য অপরিসীম। কারণ রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ভাণ্ডারী দিনেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে কি ভাবছেন তা তাঁর লেখা থেকে জানা আমাদের পক্ষে জরুরি। অসংখ্য গানের প্রায় সৃষ্টিলগ্ন থেকেই জড়িত থাকার এই দুর্লভ সৌভাগ্য দিনেন্দ্রনাথের মতো আর কেউ অর্জন করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তাই দিনেন্দ্রনাথের সৃষ্টিপর্বে এই নিবন্ধ মুদ্রিত হওয়াই সঙ্গত ছিল।

    জীবনকথা হিসেবে প্রথম অংশটি পুনর্মুদ্রণ। ১৯৮২তে দিনেন্দ্রনাথের শতবর্ষের বছরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসাবে এই নিবন্ধ দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। দীর্ঘকাল পরে তা গ্রন্থিত হল। এবং গ্রন্থ যখন প্রকাশিত হল লেখক তখন প্রয়াত। তাঁর জীবৎকালে প্রকাশিত হলে আমাদের সকলেরই আনন্দের কারণ হত।

    দিনেন্দ্রনাথের জন্ম ১৬ ডিসেম্বর ১৮৮২। শিক্ষা সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। সেখানে পিয়ানো বাদনে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে পুরস্কার লাভ করেন। অতি অল্প বয়স থেকেই সংগীতে তাঁর আগ্রহ। চার বছর বয়স থেকেই তাঁর সাবালক গান পরিবারস্থ সকলেরই কৌতুকের কারণ হয় এবং সেই বয়সে প্রেমের গান গাইবার জন্য পিতামহ কর্তৃক তিরস্কৃত হন। পরে তিনি গানের শিক্ষাগ্রহণ করেন সংগীতাচার্য রাধিকা গোস্বামী ও শ্যামসুন্দর মিশ্রের কাছে। শাস্ত্রীয় গান ছাড়াও অন্যান্য গানের উপর তাঁর দখল ছিল। সতেরো বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয়। স্ত্রী বীণাপাণি বিবাহের কিছুদিনের মধ্যেই প্রয়াত হন। দিনেন্দ্রনাথের আগ্রহে প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর মাত্র চারমাস পরে কমলা দেবীর সঙ্গে তাঁর পরিণয় ঘটে। ব্যাপারটি একটু অস্বাভাবিক ও অশোভন মনে হয় এই কারণেই যে পরবর্তী কালে তিনি প্রথমা স্ত্রীর স্মৃতিতে নিবেদন করেন তাঁর কাব্যগ্রন্থ যার নাম 'বীণ'। তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ ১৯০২এ। এ বছরই তিনি সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে আসেন। এ বছর থেকেই শান্তিনিকেতনে তাঁর সাংগীতিক কার্যকলাপ শুরু হয়। কিন্তু পাকাপাকিভাবে শান্তিনিকেতনে বাস শুরু করেন ১৯০৮এ। তিনি সাহিত্য ও সংগীতের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ইতিমধ্যে তিনি দুবার বিলেত গেছেন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্যে। কিন্তু ব্যারিস্টার না হয়ে ফিরে এলেন পাশ্চাত্য সংগীত ও সাহিত্যে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি নিয়ে। তাঁর অর্জিত সকল বিদ্যা 'রবিদা'র শান্তিনিকেতনে নিবেদন শুরু হল। এরই সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতের একটি পরিসর উন্মোচিত হল। যা ছিল ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের দ্বারা গীত মূলত মাঘোৎসবের গান তা ছড়িয়ে পড়ল শান্তিনিকেতনে। আর শান্তিনিকেতন তো রবীন্দ্রসংগীতের নিজস্ব নিকেতন। দিনেন্দ্রনাথের নিঃস্বার্থ আত্মনিবেদনের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রসংগীতের ইমারত। প্রশিক্ষক হিসেবে দিনেন্দ্রনাথের মূল্যায়ন করতে গিয়ে লেখক রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আমরা সেই অংশটিকে পুনরুদ্ধৃত করছি—"আমার সুরগুলিকে রক্ষা করা এবং যোগ্য এমনকি অযোগ্য পাত্রকেও সমর্পণ করা তার যেন একাগ্র সাধনার বিষয় ছিল। তাতে তার কোনো দিন ক্লান্তি বা ধৈর্যচ্যুতি হতে দেখিনি।" বস্তুত নিজের সমস্তটুকু দিয়ে তিনি শান্তিনিকেতনকে সংগীতের আনন্দনিকেতনের রূপ দিয়েছিলেন। গান, অভিনয়, আড্ডা, মজলিস সবেতেই তিনি ছিলেন অগ্রসাধক। ১৯০৮এ শান্তিনিকেতনে আসার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি শান্তিনিকেতনের জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠলেন। রবীন্দ্রনাথ গান লিখছেন, সুর করছেন, সুরটি ভুলে যাওয়ার আগেই দিনেন্দ্রনাথের ডাক পড়ছে আর অবলীলায় সেই নির্মীয়মাণ গানের স্বরলিপি করে রাখছেন দিনেন্দ্রনাথ। দিনেন্দ্রনাথ 'রবীন্দ্রসংগীত' এই অভিধার প্রথম প্রযোক্তা। তার আগে রবিবাবুর গান বা রবি ঠাকুরের গান বলেই অভিহিত ছিল রবীন্দ্রসংগীত। রবীন্দ্রনাথ গানের সুর দিয়ে ভুলে যেতেন। তাই একজন দিনেন্দ্রনাথকে আমাদের বড়োই প্রয়োজন ছিল। আমরা তাঁকে পেলাম এক অপরিহার্য সংরক্ষক হিসাবে। প্রায় সাড়ে সাত'শ গানের স্বরলিপি করে সেই উত্তরাধিকার আমাদের দিয়ে গেলেন তিনি। প্রকাশিত রবীন্দ্রসংগীত স্বরলিপির প্রায় একতৃতীয়াংশই দিনেন্দ্রনাথের করা। দিনেন্দ্রনাথের এই সহযোগিতা না থাকলে হয়তো আজ অনেক রবীন্দ্রসংগীতই হারিয়ে যেত। দিনেন্দ্রনাথের আগের স্বরলিপিকাররা সবাই ছিলেন ঠাকুরবাড়িরই মেয়ে। তাঁরা ইতিমধ্যে দূরে সরে গেছেন। কেউ বিবাহসূত্রে, কেউ বা মৃত্যুর কারণে। তার পর থেকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো রবীন্দ্রসংগীতের রাজ্যটি রক্ষা করে গেছেন তিনিই। তাই দেখি ১৯১৬তে প্রকাশিত 'ফাল্‌গুনী' গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করলেন দিনেন্দ্রনাথকেই এবং সেই আবহমান সুখ্যাত অভিধা "সকল নাটের কাণ্ডারী আমার সকল গানের ভাণ্ডারী" জড়িয়ে ধরল দিনেন্দ্রনাথকে।

    কিন্তু দিনেন্দ্রনাথের জীবনে এই নিবিড় রবীন্দ্রানুষঙ্গ স্থায়ী হয়নি এবং এই জোড়ভাঙায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরবর্তী প্রজন্ম যাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি দিনেন্দ্রনাথের স্বরলিপির সজীব সতেজ ভাণ্ডার। কারণ এই 'ভাণ্ডারী' অনেক বঞ্চনা ও অবিচারের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত জুলাই ১৯৩৪এ শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেন। তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি তাঁর আজীবন সেবার। গীতবিতানে তাঁর নামটি পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি। জোড়াসাঁকোয় বাস করাকালীন তিনি শান্তিনিকেতন থেকে 'রবিদা'র ডাক পাওয়ার জন্য ব্যর্থ অপেক্ষা করে ১৯৩৫ এর ২১ জুলাই প্রয়াত হন। তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথমদিককার অন্তরঙ্গতা এবং শেষের দিককার রহস্যময় শীতলতা আমাদের বিস্মিত করে। শোভন সোম তাঁর গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ দিনেন্দ্রনাথ সম্পর্কের এই টানাপোড়েন কিছুটা আমাদের সামনে তুলে ধরেন। তাই আলোচ্য গ্রন্থটিতে প্রকাশকের নিবেদন থেকে একটি বাক্য উদ্ধার করে এই নিবন্ধ শেষ করি:

    'দুঃখের বিষয় দিনেন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ জীবনী বুঝি আজ পর্যন্ত অরচিত।'

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments