আটটা-ন'টার সূর্য; অশোককুমার মুখোপাধ্যায়; প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর ২০১৩, আশ্বিন ১৪২০ দে'জ পাবলিশিং - কলকাতা; ISBN : 978-81-295-1897-2; পৃষ্ঠাঃ ৪৬৪
"পৃথিবী তোমাদের এবং আমাদেরও, কিন্তু অবশেষে তোমাদেরই। তোমরা যুবক, সজীব ও প্রাণশক্তিতে উচ্ছল, জীবনের স্ফুটনোন্মুখ অবস্থায়, সকালবেলার ৮-৯টার সূর্যের মতো। তোমাদের উপরেই আশা রাখি।"অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক উপন্যাস 'আটটা-ন'টার সূর্য' নামের উৎস উপরিল্লিখিত উদ্ধৃতিটি। এই নামকরণ সাতের দশকের তরুণ ছেলেমেয়েরা যারা সমাজব্যবস্থাকে বদল করতে চেয়েছিল তাদের প্রতি লেখকের 'ট্রিবিউট' বলে মনে হয়। লেখকের কথা অনুযায়ী ১৯৬৩ সাল থেকে ২০১০ সাল এই সময়কাল ধরে উপন্যাসটি লেখা হয়েছে।
— মাও-সে তুঙ্
উপন্যাসটি অশোক শুরু করেন সেই সময়ের তরুণ নায়কদের একজন, দ্রোণাচার্য ঘোষের কিশোরবেলা দিয়ে। দ্রোণাচার্যর বাবা নিবারণ হিসেবের খাতায় হিসেব লিখে চলেন — সাধারণ মানুষের বিপক্ষে টাকার হিসেব বাড়তেই থাকে। ভাবেন ছোটছেলে বড় হয়ে উঠছে, পড়াশুনায় মন নেই তার। নিজেই আবার ভাবেন কী করে থাকবে রোজ ছেলেটাকে খেতে দিতে পারি না, গাছের বেল খেয়েও কাটে কোনো কোনো দিন। শিক্ষক দিতে পারি না। ছেলেটা ডানপিটে হলেও দরদী। গুলতি ছোঁড়ে আবার পাখির গায়ে লাগলে হৃদয় আর্দ্র হয়ে ওঠে, বুকে টেনে নেয় আহত পাখিকে। কী হবে ছেলেটা বড় হয়ে? বড় হতে থাকে দ্রোণাচার্য।
সুকান্তি কলকাতার লোক, উত্তর কলকাতার এক কলেজে অধ্যাপনা করেন। একা বসে থাকলেই অতীত জীবনে ফিরে যান। দাদা একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছেন। বড়ছেলের জন্য মা-ও ধর্মান্তরিত হয়েছেন। সুকান্তির মা-ই তার বাবা-মা। মায়ের কিছু গোপন কথা জানতে পারে সুকান্তি। মাকে খুব ভালবাসে সে। সুকান্তি বরাবরই কমিউনিস্ট। তেভাগা আন্দোলনের সময় রেবাকে বিয়ে করেন। মায়ের প্রতি রেবার অশ্রদ্ধা তার মনকে পীড়িত করে। কিশোর নিরুপম-চিরন্তনের সঙ্গে থাকতে তার ভাল লাগে। ওরা খেলে তিনি রেফারি হন। নিরুপমকে বড় ভালবাসেন সুকান্তি। ছেলেটির মন খুব নরম। স্কুলে নেতার ছেলে তাকে অকারণে চড় মারলে সে অপমানিত হয়ে পার্কের বেঞ্চে বসে কাঁদে। আবার জেদও আছে। দিন চলতে থাকে। খুব খারাপ সময়। খাদ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। র্যাশন পাওয়া যাচ্ছে না। কেরোসিনের আকাল। অস্থিরতা বাড়ে সুকান্তির মধ্যে, বাড়ে সকলের মধ্যে।
উপন্যাস এগোতে থাকে — চারু মজুমদার উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ৬৩ সালে দমদম জেলে। ৬৩ থেকে ৬৬ বারবার ধরা পড়ে জেলে যান। জেলে থেকে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু অসুস্থতা তুচ্ছ করে তিনি ভাবেন পার্টির কথা। তিনি ৬৩ সালেই খুব অস্থির। সবসময় তার মনে হতে থাকে পার্টি ঠিকমতো চলছে না। অবশেষে পার্টি ভাগ হল রাশিয়া আর চীন এই দুই পন্থা নিয়ে। চীনপন্থীদের পার্টির নাম হল সি পি আই (এম)। চারু মজুমদার এলেন সি পি আই (এম)-এ। এরপর ভারত-চীন যুদ্ধ। চীনপন্থীরা অনেকেই অ্যারেস্ট হলেন চারু মজুমদারও। দল হাইকোর্টের বৈধতা পেলে বন্দিরা মুক্তি পান। যুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষের অসহনীয় অবস্থা। খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু হল। খাদ্যের দাবিতে মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়-- আনন্দ হাইত, নুরুল ইসলাম সহ প্রাণ যায় ৪৫ জনের। খাদ্য আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া বন্দিরা ছাড়া পেলেন। শুরু হল নির্বাচনের তোড়জোড়।
নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হয়। শাসনক্ষমতায় এল যুক্তফ্রন্ট। চারু মজুমদারের মধ্যে অস্থিরতা। একটার পর একটা প্রবন্ধ লিখে চলেন। যুক্তফ্রন্টের শরিক সি পি আই (এম) অর্থাৎ চারু মজুমদার যার সদস্য সেই পার্টির কার্যকলাপ তার ভাল লাগছে না। কিছু লিখে রাজ্য কমিটির নেতৃত্বকে পাঠালে তারা আলোচনা তো করেনই না বরং বলেন চারু মজুমদার পার্টিবিরোধী কাজ করছে। উত্তরবঙ্গের কমরেডদের সঙ্গে আলোচনা করেন এলাকা দখলের রাজনীতি নিয়ে। দীর্ঘ আলোচনার পর কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল, খোকন মজুমদার, কদম মল্লিক সহ কৃষক ও চা-বাগানের শ্রমিকেরা এলাকা দখলের সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। অবশেষে ঘটে 'নকশালবাড়ি, নয়জন নারী ও দু-জন শিশুর রক্তদানের মধ্য দিয়ে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন জানায় এই আন্দোলনকে পিকিঙ রেডিও (অধুনা বেজিঙ রেডিও) মারফত — 'ভারতের আকাশে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ'।
অশোক একের পর এক ঘটনার এমনভাবে বর্ণনা দিয়েছেন মনে হচ্ছে যেন কোনও ঘটনা দেখতে দেখতে ধারাভাষ্য দিচ্ছেন। লেখকের মুন্সিয়ানা এখানেই--তিনি উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গের বিপ্লবীরা যে একসূত্রে বাঁধা নিপুণভাবে তা তুলে ধরতে পেরেছেন।
উপন্যাস এগিয়ে চলে। কখনও চারু মজুমদার, কখনও সুকান্তি, নিরুপম আবার কখনও বা দ্রোণাচার্য-পাঞ্চালি। কিন্তু খেই হারিয়ে যায় না। কত ঘটনার সমাহার। পাঠক ক্লান্ত হন না। অশোক একটি একটি করে সমস্ত চরিত্রের সঙ্গে পাঠকের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন।
কিশোর দ্রোণ বড় হয়ে ওঠে। আদ্যন্ত প্রেমিক মানুষ একজন। কবিতা লেখেন তার ভালবাসার মেয়েটিকে নিয়ে। মেয়েটির শরীর নিয়েও ভাবে দ্রোণ। লেখক এতটুকু ভণিতার আশ্রয় নেননি। একটি তরুণ ছেলের যা স্বাভাবিক তাই দেখিয়েছেন। দ্রোণের ভালবাসার মেয়েরা তাকে বুঝতেই পারে না। দূরে সরে যায়। তাতে তার ভালবাসা কমে না। এই ভালবাসাই তাকে নিয়ে যায় বিপ্লবের মুখোমুখি। বিপ্লবকে ভালবেসে ফেলে আর সেখানেই পাঞ্চালিকে পায়। বিপ্লব আর পাঞ্চালি তার কাছে একাকার হয়ে যায়। পালটে যায় কবিতার আগের সুর। দ্রোণ লিখে যায় —
"কেউ পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়
বিপ্লবের জন্যই ভালবাসা
আর ভালবাসার জন্যই বিপ্লব"
সুকান্তি, নিরুপম, চিরন্তন, পাঞ্চালি আরও বিপ্লবী তারা 'গভীরভাবে ভালবাসতে জানে' - তাইতো মানুষকে ভালবেসে নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য মানুষের আপনজন হয়ে ওঠে তারা। চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত পার্টি নেতৃত্ব কিন্তু সাধারণ একজন কমরেডের প্রতিও কী মমত্ববোধ! কমরেডরা প্রাণ দিচ্ছেন লড়াইয়ে তাঁদের চোখে জল। অশোক মুখোপাধ্যায় খুব সুন্দরভাবে তাঁদের উপস্থাপিত করেছেন। তাঁরা কর্মীদের শুধু লড়াইয়ে এগিয়ে দেন না, তাঁরাও সঙ্গে থাকেন এবং নিজেরা প্রাণ দিয়ে দেখান বিপ্লবী পার্টিতে শুধু সেনারা নন সেনাপতিও প্রাণ দেন।
অশোকের লেখায় আবেগ আছে কিন্তু তিনি সে আবেগকে কখনও মাত্রা ছাড়াতে দেন না। সরোজ দত্ত বা চারু মজুমদারের হত্যা নিয়ে অনেক কিছুই লিখতে পারতেন কিন্তু তিনি তার লেখনীকে সংযত রাখেন। চলে যান পরের ঘটনায়। কিংবা দ্রোণের ওইরকম নৃশংস হত্যার পর পাঞ্চালি যে ভেঙে পড়বে এটা স্বাভাবিক এবং লেখক তা জানেন তবুও লেখক শোকার্ত পাঞ্চালিকে দেখান, ভেঙে পড়া পাঞ্চালিকে নয়। তিনি পাঠকদের এটাই দেখাতে চান যে বিপ্লবীরা কাঁদেন আবার চোখের জল মুছে তারা পরবর্তী লড়াইয়ে এগিয়ে যান। কারণ তাদের স্বপ্ন দেখা তো শেষ হয়নি। যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত, দ্রোণাচার্য ঘোষ এবং শহিদ কমরেডরা।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় - ১৯৭২ সালে চারু মজুমদার শহিদ হওয়ার পর। পার্টির প্রথম সারির নেতৃত্বের প্রায় কেউই নেই। হয় পুলিশ খুন করেছে নয় জেলে। পার্টির মধ্যে নানা উপদল গড়ে উঠেছে। পার্টির মধ্যেই শুরু হয়েছে সন্দেহ অবিশ্বাস। পার্টিকে ভাঙনের মুখ থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছেন কয়েকজন। এর মধ্যে শুরু হয়েছে 'প্রো-লিন', অ্যান্টি-লিন নিয়ে পার্টির মধ্যে দ্বন্দ্ব।
সুকান্তির মধ্যেও নানা প্রশ্ন। এই ভুল কাটাতে হবে। নাহলে নিজেরাই নিজেদের মারবে তাতে শত্রুরাই লাভবান হবে। নিরুপম এই দুই লাইনের লড়াইয়ে অ্যান্টি-লিনপন্থীদের পক্ষে। পার্টির দ্বন্দ্বে একদিন নিরুপম খুন হয়ে যায়। সুকান্তিদার খুব প্রিয় এই নিরুপম। ওর মৃত্যুতে প্রচণ্ড আঘাত পান কিন্তু তিনি দ্রুত আঘাত কাটিয়ে এগিয়ে যান। তাকে চেষ্টা করতেই হবে। ভুল অনেক ভুল হয়ে যাচ্ছে। অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এই উপন্যাসের ভূমিকায় গবেষক-প্রাবন্ধিক সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, এটি 'প্রামাণিক দলিলভিত্তিক উপন্যাস' (documentary novel)। এইরকম ডকুনভেল বা তথ্য-উপন্যাসের একটি সমস্যা আছে। অনেক তথ্য হাজির করার ফলে উপন্যাসের রসহানি ঘটে থাকে প্রায়শই। কিন্তু অশোক এই কাজটি এত সুন্দরভাবে করেছেন যেখানে তথ্যগুলি পাঠকের রসাস্বাদনে কখনই বাধা সৃষ্টি করে না। উপন্যাসটি তথ্যনির্ভর কিন্তু তথ্যভারাক্রান্ত নয়। তরুণ ছেলেমেয়েরা এই উপন্যাস পাঠে শুধু নকশালবাড়ি আন্দোলন সম্পর্কে নয়, ১৯৬৬-র খাদ্য আন্দোলন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে কিছুটা অবগত হবেন।
লেখক চারু মজুমদার থেকে শুরু করে বিপ্লবী চরিত্রগুলি এত দরদ দিয়ে উপস্থাপিত করেছেন যে পাঠকও তাঁদের ভালবেসে ফেলেন। পুলিশের চরিত্র একেবারেই ঠিকঠাকভাবে এনেছেন। অত্যাচারী, ঠাণ্ডা মাথার খুনী ও অনুতাপহীন। এরপর ভারতের বুকে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। লেখক পর পর তুলে ধরেছেন। ১৯৭৭ সালে কেন্দ্র ও রাজ্যে পালা বদল। নকশাল আন্দোলনের প্রচুর ছেলেমেয়ে জেলে বন্দি। বয়স্করাও আছেন। নির্বাচনের আগে জনতাদল ও বামদলগুলি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বন্দিমুক্তির। ধীরে ধীরে মুক্তি পায় বন্দিরা।
উপন্যাসটি এখানেই শেষ হতে পারত। ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হওয়ার সময় অনেকে একথা বলেও ছিলেন। কিন্তু অশোক মুখোপাধ্যায় খুব সঠিকভাবেই এটি করেন নি। রূপকথার কাহিনীর মতো মুক্তি পেয়ে তারা ঘরে ফিরে গেল এবং সুখে শান্তিতে ঘর করতে লাগল। কিন্তু ইতিহাস তো তা বলে না। ইতিহাস এগিয়ে চলে। লেখক খুঁজতে থাকেন সেদিনের সেই 'আটটা-ন'টার সূর্য'-রা যাঁরা বেঁচে আছেন আজ কোথায় তারা। খুঁজে পান পাঞ্চালিকে, সুকান্তিদাকে।
লেখক এটা বিশ্বাস করেন যতদিন অন্যায়, বৈষম্য আর অত্যাচার থাকবে সমাজে, তার প্রতিকারে বার বার লড়াইয়ে নামবে পাঞ্চালি, সুকান্তিদারা। অশোক তাই উপন্যাসের শেষে পাঠকদের হাজির করেন লালগড়ে। যেখানে প্রান্তিক মানুষ পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন। সেখানে সাতের দশকের আটটা-নটা'র সূর্য পাঞ্চালি আজকের আটটা-ন'টার সূর্যদের সঙ্গে চলেছে মানুষের আন্দোলনের পাশে থাকতে। ওখানেই দেখা হয় সুকান্তিদার সঙ্গে। বিপ্লব শেষ হয় না। স্বপ্নও মরে না। দুজনেই স্বপ্ন দেখেন 'একদিন সূর্যের ভোর আসবেই'।
অশোককুমার মুখোপাধ্যায় এই উপন্যাসে তার মতামত বা পক্ষপাতিত্ব কখনই গোপন করতে চাননি। এমনকি উপন্যাসের শেষ লাইনটিও বলান সুকান্তিদা আর পাঞ্চালিকে দিয়ে "স্বপ্ন মরে না"। অশোককে ধন্যবাদ এইরকম একটি উপন্যাস আমাদের কাছে উপস্থিত করার জন্য। শান্তনু দে-র প্রচ্ছদ ও অলংকরণ চমৎকার। উপন্যাসের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, কতগুলি রেখায় এমন কিছু অবয়ব এনেছেন মনে হয় যেন উপন্যাসের চরিত্রগুলিই দাঁড়িয়ে আছে। বইটি পাঠকদের কাছে আদরণীয় হবে, এটি আমার বিশ্বাস।