রবিবার দিন দুপুরবেলা গুনগুন শোয়ার ঘরে উঁকি মেরে দেখল। মা ফোনে মাসির সাথে কথা বলছেন। গুনগুন মার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে মা ফোনটা মুখের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে বললেন, “গুনগুন, আমি মাসির সাথে কথা বলছি। খুব দরকারি কথা। এখন আমাকে বিরক্ত কোরো না! যাও অন্য ঘরে যাও। দেখো বাবা আর দিদি কী করছে। ওদের গিয়ে বিরক্ত করো!”
গুনগুন রিয়াকে বলল, “মার সময় নেই রিয়া। চল গিয়ে দেখি বাবা কী করছে।”
রিয়া গুনগুনের পুতুল। তার সাথেই গুনগুনের যত মনের কথা। বাবা কম্পিউটার ঘরে ছিলেন। গুনগুন সেই ঘরে গিয়ে ঢুকল। বাবা কম্পিটারে কী একটা টাইপ করছিলেন। ওকে দেখে বললেন, “গুনগুন আমি এখন দরকারি ইমেল করছি কম্পিউটারে। আমাকে বিরক্ত কোরো না। তুমি নিজের খেলনা নিয়ে খেলা করো।”
“খেলনা নিয়ে কতক্ষণ খেলব? সেই কখন থেকেই তো খেলছি। রিয়াও আমার সাথে খেলে খেলে বোর হয়ে গেছে! তুমি যে বলেছিলে আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যাবে?”
“আজ আর আমার সময় হবে না। কালকে নিয়ে যাবো। দেখো মা রান্নাঘরে কী করছে।”
“মা রান্নাঘরে নেই! শোওয়ার ঘরে মাসির সাথে কথা বলছে, খুব দরকারি কথা। বিরক্ত করতে বারণ করেছে।"
“ঠিক আছে যাও মুনুমুনকে বলো তোমার সাথে খেলতে।”
“আচ্ছা!” বলে গুনগুন রিয়াকে টানতে টানতে নিয়ে চলল।
দিদির ঘরের দরজায় টোকা দিল গুনগুন। গুনগুনের দিদি মুনমুন ঘরের দরজাটা অল্প খুলে মুখটা বার করে জিজ্ঞেস করল, “কী চাই?”
“আমাকে তোদের সাথে খেলতে নিবি?”
দিদির ঘরে হংসিকাদি আর শ্রেয়াদিও ছিল। তিনজনে মিলে মজা করে কিছু খেলছিল মনে হয়।
ওর কথা শুনে দিদি বলল, “না গুনগুন, তুই বড্ড ছোট! আমরা যে খেলাটা খেলছি সেটাতে ব্রেন পাওয়ার লাগে। তুই পারবি না উলটে কান্নাকাটি জুড়ে দিবি হেরে গেলে। তখন আরো ঝামেলা হবে। তুই বরং নিজে নিজে একটু খেলে নে। হংসিকা আর শ্রেয়া বাড়ি চলে গেলে না হয় আমি তোর সঙ্গে খেলব!” বলে দরজাটা গুনগুনের মুখের উপর বন্ধ করে দিল মুনমুন।
গুনগুন আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে বাইরের ঘরে গিয়ে বসল। মনটা খারাপ লাগছে ওর। কেউ ওর সাথে খেলতে রাজি নয়। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। গুনগুনকে কেউ ভালবাসে না!
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর হঠাৎ ওর মনে হল, ‘আরে কেউ তো আমাকে দেখছে না! তাহলে এই সুযোগ! যে সব কাজগুলো আমাকে করতে বারণ করা হয় সেই সব কাজ আমি তাহলে এইবেলা করে নিতে পারি! সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত; কেউ বাধা দেওয়ার নেই!’
আনন্দে ঝলমল করে উঠল গুনগুনের মুখ। রিয়াকে সে বলল, “চল রিয়া, এই সুযোগ! এবার আমরা একটু মজা করে নি!”
ব্যস, আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না গুনগুন। খাবার ঘর থেকে একটা চেয়ার টেনে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। রিয়াকে মাটিতে নামিয়ে রেখে চেয়ারে উঠে হাত বাড়িয়ে আলমারির পাল্লা খুলে ক্রিম বিস্কুটের কৌটোটা নামিয়ে ফেলল সে।
“চল রিয়া এবার পিকনিক হবে!”
মা গুনগুনকে কখনও দুটোর বেশি বিস্কুট খেতে দেন না। এবার গুনগুন কৌটো খুলে মনের সুখে বিস্কুট খেতে শুরু করল। দিদির জল রঙের বাক্স আর তুলি বাইরের ঘরেই রাখা ছিল। হংসিকাদি আর শ্রেয়াদি যখন আসল তখন দিদি ছবি আঁকছিল। দিদি ওদের নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেছে জল রঙ আর নিজের ছবিটা না তুলে রেখেই। এই রকম সুবর্ণ সুযোগ আর পাওয়া যাবে না! দিদি তার জল রঙের সেটটাতে গুনগুনকে একদম হাত দিতে দেয় না। দিদির আঁকা ছবিটাও রয়েছে। পাহাড়গুলোতে রঙ করেনি দিদি। গুনগুন জানে ওগুলো খয়েরি হবে। ঘাসটা সবুজ আর নীল আকাশে হলুদ সূর্য! গুনগুন মনের আনন্দে তুলিটাকে জলে ডুবিয়ে রঙ দিয়ে ছবিতে রঙ করতে শুরু করল। একটু পরেই সে বুঝতে পারল যতটা সহজ ভেবেছিল ততটা সহজ নয়। গায়ে, হাতে, জামায়, টেবিলে, সোফায়, দেওয়ালে চারিদিকে রঙ টং মাখিয়ে গুনগুন দেখল এবার সত্যি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে তাই রঙ করাটা ছেড়ে দিল। বিস্কুটের কৌটো থেকে আরো কয়েকটা ক্রিম বিস্কুট খেয়ে নিমোকে বিরক্ত করতে গেল।
নিমো ওদের ফাইটার মাছ। গুনগুনের অনেকদিনের ইচ্ছে জলে হাত ডুবিয়ে নিমোর সাথে হ্যান্ডশেক করার কিন্তু কেউ ওকে নিমোর জলে হাত দিতে দেয় না! টেবিলের উপর উঠে নিমোর বয়ামে হাত ডোবাল গুনগুন। নাহ নিমোকে ধরা খুবই শক্ত! হ্যান্ড শেক করে তো দুরের কথা গুনগুনের হাতটাকে দেখে পাঁইপাঁই করে চক্কর মারতে শুরু করল নিমো। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দিতে হল গুনগুনকে। হাতটা জল থেকে বার করে দেখল এই যা! জলের রঙ সবুজ হয়ে গেছে! জল রঙের সবুজ রঙ ওর হাতে লেগে ছিল সেটার জন্যে নিমোর জল সবুজ হয়ে গেছে! তবে সবুজ জলে লাল মাছ দেখতে ভালই লাগছে।
টেবিল থেকে নেমে আবার রান্নাঘরে গেল গুনগুন। ফ্রিজটা খুলল। আরে, ওই তো! কালকে বিকেলে সন্ধ্যা মাসির আনা চকোলেটগুলো রয়েছে! গুনগুন দুটো চকোলেট বার করে পুরোটা খেয়ে ফেলল। চকোলেটগুলো অবশ্য খুব একটা বড় ছিল না। মা তাও ওকে পুরোটা কখনও খেতে দেন না!
এবার গুনগুন টিভির সামনে বসে রিমোটটা হাতে নিল। আহা কী আনন্দ! ও তো আর কখনও টিভির সামনে রিমোট হাতে নিয়ে বসার সুযোগ পায় না! বড়রাই রিমোটটার উপর দখল রাখে সব সময়। মনের সুখে টুকটুক করে চ্যানেল বদলে চলল গুনগুন।
পরমানন্দে একটা কার্টুন দেখছিল সে, এমন সময় একটা ভয়ানক চিৎকার শুনে চমকে উঠল।
মা এসে ঢুকেছেন ঘরে।
“সর্বনাশ! সবাই দেখে যাও গুনগুন কী করেছে!”
ব্যস, সেই চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এল। দিদি আর তার বন্ধুরা খেলা ভুলে ছুটে এল, বাবা ইমেল লেখা ছেড়ে উঠে এলেন!
তারপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে খুব বকুনি খেল গুনগুন। রাগে দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, “কেউ আমার সাথে খেলছিল না তো আমি কী করব? আমার যা ইচ্ছে হয়েছে আমি তাই করেছি। আমি কী করছি না করছি কারো তো দেখার সময় ছিল না! এখন তাহলে তোমরা সবাই আমার ওপর রাগ করছ কেন?”
মা বাবা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন, দিদি আর ওর বন্ধুরাও। সবাই একে ওপরকে দোষ দিতে শুরু করল। দিদিও ভাল বকুনি খেলো। মা বাবা যখন ব্যস্ত ছিলেন তখন ওর উচিত ছিল গুনগুনের উপর নজর রাখা। ওকে খেলতে না নিলেও অন্তত ঘরে তো ঢুকতে দিতে পারত!
গুনগুনের কীর্তিকলাপের চিহ্ন এখনও ওদের সোফায়, ঘরের দেওয়ালে দেখতে পাওয়া যায়। ভাগ্য ভাল বয়ামের জলটা সবুজ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিমোর কিছু হয়নি! কিন্তু অত ক্রিম বিস্কুট আর চকোলেট খেয়ে গুনগুনের তো বেদম শরীর খারাপ হয়েছিল সেদিন বিকেলে। এখন অবশ্য ও সেরে উঠেছে। এখন আর গুনগুনকে কেউ খুব একটা একা থাকতে দেয় না! তবে ওরও খুব শিক্ষা হয়ে গেছে। সে বুঝতে পেরেছে বড়রা যে কাজগুলো করতে বারণ করে সেগুলো না করাই ভাল! ক্ষণিকের আনন্দের জন্যে পরে অনেক বেশি ভুগতে হয়। তাই ওই ভুল গুনগুন আর করবে না।
মা শুধু মনে পড়লে মাঝে মাঝে বলেন, “আচ্ছা গুনগুন, ঠিক করে বল তো, সেদিন তুমি মোট কটা ক্রিম বিস্কুট খেয়েছিলে? এক কৌটো বিস্কুটের মোটে কয়েকটাই পড়ে ছিল!”
গুনগুন লজ্জা পেয়ে বলে, “জানি না!”
দিদি তখন ফোড়ন কাটে, “হ্যাঁরে তুই দুটো গোটা চকোলেট খেয়ে ফেললি, তাও আবার অতগুলো ক্রিম বিস্কুটের উপর! দুষ্টুমি করতে গেলে যে এত খিদে পায় তা জানতাম না বাবা!”