গ্যারির সঙ্গে আমার দেখাটা হয়েছিল বেশ অদ্ভুত ভাবে। আমি কোনদিন তেমন ম্যাকডোনাল্ডে খেতে যাই না কিন্তু সেদিন কাজ থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। যার সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করি সেই শ্রীনিবাস ছুটি নিয়ে দেশে গেছে তাই বাড়িতে রান্নাবান্না করারও কেউ নেই। নাহলে শ্রীনিবাস অন্তত আর কিছু না হোক সম্বর ডালটা বানিয়ে রাখে! ওর ল্যাবে কাজের চাপ একটু কম তাই ও প্রায়ই তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে পারে। এদিকে আমার বসটা রাজ্যের কাজ আমার ঘাড়েই চাপাবে সব সময়! আজ এই জার্নালে পেপার দিতে হবে কাল ওই গ্রান্ট, লেগেই আছে ওনার সব সময়! উনি নিজেও ছুটছেন আর আমাকেও ক্রমাগত ছুটিয়ে চলেছেন! কী আর করা যাবে, কাজ করতে যখন এসেছি তখন।
তাই সেদিন রাতে কলেজ পাড়ার ম্যাকডোনাল্ডটায় ঢুকেছিলামকয়েকটা চিকেন স্যান্ডউইচ কিনে নিয়ে যাব বলে। এখানকার স্যান্ডউইচগুলো মোটেই দেশের গুলোর মত খেতে নয়। বেশ বাজে খেতে, তাই তো বেশি খাই না, কিন্তু উপায় না থাকলে যা হয়, কিছু খেয়ে বাঁচতে হবে তো! সেই ভেবেই কয়েকটা চিকেন স্যান্ডউইচ অর্ডার দিলাম। এখানে বিকেল পাঁচটা থেকে সাতটার মধ্যে সবার ডিনার হয়ে যায় তাই দোকানে ভিড় নেই মোটেই। কাউন্টারের ছেলেটা তিনবার হোঁচট খেল আমার অর্ডারটা নিতে গিয়ে! তারপর আমাকে অনেক বেশি টাকা ফেরত দিল!
আমি চট করে গুনে ফেলে ওকে বললাম, “তুমি তো আমাকে আনেক বেশি ফেরত দিয়েছো! আমি তো তোমাকে কুড়ি ডলারের নোট দিয়েছিলাম, পঞ্চাশ ডলার তো নয়!”
তাই শুনে ছেলেটা আরো যেন ঘাবড়ে গেল। কী করবে আর বুঝতে পারছে না! হবি তো হ দোকানের ম্যানেজার আমার কথা শুনতে পেয়ে হাঁ হাঁ করে ছুটে এল! তারপর শুরু হল তার ছেলেটাকে প্রচণ্ড বকুনি! আর আমার সামনেই ছেলেটার চাকরি চলে গেল! কী যে খারাপ লাগছিল আমার কী বলব! মিছিমিছি একজনের পেটে লাথি মারলাম! আমি যদি না বলতাম তাহলে হয় তো...কিন্তু তারপর মনে হল ক্যাশবাক্সে পয়সা কম হলে তো ভুলটা ধরা পড়তই! তাও মনটা বেশ খারাপ লাগছিল। সেই জন্যেই বোধহয় গাড়িতে উঠতে গিয়েও উঠলাম না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এটা সেটা ভাবতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল ছেলেটাকে একবার দেখতে পেলে সরি বলব, কিন্তু দোকানে আর ঢোকার সাহসও হচ্ছিল না।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হল, একটু পরেই ছেলেটা বেরিয়ে এল। বয়স কুড়ির বেশি হবে না। রোগা পাতলা চেহারা, মাথার চুল অবিন্যস্ত। আগে দোকানের জামা পরে ছিল এখন গায়ে একটা টি শার্ট তাতে সাদা দিয়ে লেখা রয়েছে সেভ দা ডলফিন্স।
মাথা নিচু করে হাঁটছিল ছেলেটা। আমি এগিয়ে ওর সামনে গিয়ে বললাম, “সরি! আমি বুঝতে পারিনি আমার কথাতে তোমাকে বিপদে পড়তে হবে! এই রকম হবে জানলে আমি আরেকটু সাবধান হয়ে আস্তে আস্তে বলতাম!”
ছেলেটা একটা শুকনো হাসি হেসে বলল, “না না, তুমি ও নিয়ে কিছু ভেব না। আজ না হোক কাল চাকরি আমার এমনিতেই যেত! আমার মাথায় না ওই সব ডলার সেন্টের হিশেবনিকেষ ঢোকে না একেবারেই! দুদিন হল চাকরি করছি তার মধ্যে অসংখ্য ভুল করেছি। ম্যানেজার চার্লি মুখিয়ে ছিল আমাকে বার করে দেওয়ার জন্যে! শুধু দুঃখটা এই যে সারাদিন কাজ করার পর রাতের খাবারটা আমার ফ্রিতে পাওয়ার কথা কিন্তু লোকটা এত খেপে গেছে যে খাবারটুকুও নিতে দিল না!”
শুনে আমার খুব খারাপ লাগল। সত্যিই না বুঝে ওর পেটে লাথি মেরে ফেলেছি!
বললাম, “শোনো, আমি অনেকগুলো স্যান্ডউইচ কিনেছি, তুমি নাহয় আমার সঙ্গে ডিনার করো আজকে।”
আমার কথা শুনে ছেলেটার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে আমাকে?”
সেটা নিয়ে আমার একটু খুঁতখুঁত ছিল কিন্তু তারপর মনে হল চুরি করার মতন কিই বা আছে আমাদের ঘরে? একটা মান্ধাতার আমলের পুরোনো ধুমসো টিভি আর ডিভিডি প্লেয়ার যেগুলোকে শ্রীনিবাস কোন এক গ্যারেজ সেল থেকে জোগাড় করেছিল। ওগুলোতে আমরা মাঝে মাঝে হিন্দি বা তেলেগু সিনেমা দেখি। আর আছে আমাদের কিছু জামাকাপড়, আমার কিছু বাংলা বই আর একটা ল্যাপটপ যেটা প্লেনে আসতে গিয়ে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু নতুন এখনও কেনা হয়নি! ব্যাস ওই টুকুনিই তো সম্বল, তাই কিই বা চুরি করবে?
সেই ভেবে ছেলেটাকে গাড়িতে বসিয়ে বাড়ি নিয়ে গেলাম। পথে যেতে যেতে জানতে পারলাম ওর নাম গ্যারি। ওর মা বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। এক মামা মামিমার কাছে থাকত। আঠেরো বছর বয়স হতেই ওকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে তারা। খুব ছোট্ট বেলায় পড়ে গিয়ে মাথায় ভয়ানক চোট লেগেছিল সেই থেকে অঙ্ক টঙ্ক একদম করতে পারে না। সেই কারণেই পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি ওর। হাতের কাজও তেমন কিছু শেখেনি তাই কিছু চাকরি পাওয়াটাই ভয়ানক কঠিন হয়ে ওঠে ওর।
আমাদের একটা বাক্সের ওপর চাদর পাতা টেবিলে বসে খুব তৃপ্তির সঙ্গে স্যান্ডউইচগুলো খেল গ্যারি। আমার পরের দিনের জন্যে কোন খাবার থাকল না কিন্তু তাতে কী? একটা দুঃখী মানুষকে যে একটু আনন্দ দিতে পেরেছি সেটা ভেবেই ভাল লাগছিল। ফ্রিজারে আইসক্রিম ছিল সেটাও পরমানন্দে খেয়ে গ্যারি বলল, “অনেকদিন এত আরাম করে খাইনি!”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বাড়ি যাবে কী করে?”
ঝকঝকে দাঁত বার করে হেসে গ্যারি বলল, “হেঁটে!”
অথচ ও যেখানে থাকে সেটা একটা ট্রেলার পার্ক, সেখানে প্রচুর কুঁড়ে ঘরের মতন বাড়ি। সেগুলোকে চাইলে ট্রাকে টেনে অন্যত্রও নিয়ে যাওয়া যায়। এদেশে গরিবরা ওই ভাবে থাকে। আমাদের ওখান থেকে সেই জায়গাটা প্রায় এক ঘন্টার হাঁটা পথ আর এত রাতে এখানে বাস টাস চলে না! আমি শুনে আঁতকে উঠে ওকে গাড়ি করে পৌঁছে দিলাম।
তারপর থেকেই গ্যারি প্রায়ই চলে আসে আমাদের বাড়িতে। শ্রীনিবাসের সম্বর ডাল আর আমার রাঁধা ডিমের ডালনা বা চিকেন কারি খায় মনের সুখে তৃপ্তি করে! ও যে ওই ঝাল মশলা দেওয়া খাবার খেতে পারবে আমি ভাবতেই পারিনি! আর সব সময় আমাদের জিগ্যেস করবে আমরা কী করি। ক্যান্সার নিয়ে রিসার্চ করছি শুনে বলে, “ম্যান, তুমি ক্যান্সার সারিয়ে ফেলার ওষুধ বার করে ফেলবে!” (মনতোষ বলতে গেলে দাঁত ভেঙ্গে যাওয়ার অবস্থা তাই আমি ম্যান আর শ্রীনিবাস শ্রী)।
আমি ওকে যত বোঝাতে চাই যে ব্যাপারটা অত সহজ নয়, আমার ক্ষমতা খুবই সীমিত, কিন্তু কে শোনে কার কথা! ওর কথায় মনে হয় আমি ক্যান্সারের ওষুধ আর শ্রীনিবাস ডায়াবিটিসের ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলব যে-কোন দিন!
খালি বলে, “তোমাদের এখানে আসতে আমার খুব ভাল লাগে। তোমরা কত ভাল কাজ করছ। তাতে কত লোকের উপকার হবে! আমি ছাই কোন কাজই করতে পারি না! সব কাজেতেই আমি কেমন যেন অসফল হই! আমার খুব ইচ্ছে করে এমন কোন কাজ করতে যাতে লোককে একটু আনন্দ দিতে পারি কিন্তু সেই রকম কাজ খুঁজেই পাই না!”
ওর কথা শুনে ওর ওপর মায়া জন্মে গেছে আমাদের তাই আমি আর শ্রীনিবাস ওকে মাঝে মাঝে টাকাও দি। তার বদলে ও আমাদের ঘর দোর ভ্যাকিউম করে পরিষ্কার করে দেয়, মেশিনে জামাকাপড় কেচে দেয়। ভারি ভাল ছেলেটা।
সেই সিনটা আমার মনে থাকবে। দিনটা ছিল পয়লা বৈশাখ। আমি মাকে ফোন করে করে রেসিপি নিয়ে কয়েকটা রান্না রেঁধেছিলাম। শ্রীনিবাসদেরও নতুন বছর দুয়েক দিনের মধ্যেই তাই ওও রেঁধেছিল কিছু পদ। গ্যারিকে ডেকেছিলাম আমরা। সে যখন এল তখন তার ফুর্তি দেখে কে!
আমি বললাম, “কী ব্যাপার গ্যারি? এত খুশি?”
ও বলল, “ম্যান, আমি চাকরি পেয়েছি! দারুণ চাকরি! আমি ভীষণ খুশি!”
আমি আর শ্রীনিবাস ওর খুশিতে আহ্লাদিত হয়ে বললাম, “বাহ, সে তো দারুণ খবর! কী চাকরি করছ? কোথায়?”
গ্যারি মাথা নেড়ে বলল, “না, ওই রকম করে বললে মজাটা নষ্ট হয়ে যাবে! তোমরা কাল দুপুর দুটোর সময় হোলি ফ্যামিলি চিল্ড্রেন্স হাসপাতালে চলে এসো তাহলে নিজেরাই দেখতে পাবে!”
আমরা ভাবলাম বাবা! গ্যারি হাসপাতালে চাকরি পেয়েছে! ভাল তো!
প্রচুর খাওয়া দাওয়ার পর গ্যারিকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে এলাম। ও আবার মনে করিয়ে দিল, “কাল দুপুর দুটোর সময়, ভুলো না যেন!”
এক্সপেরিমেন্টটা চাপিয়ে দিয়ে একটা কুড়িতে বেরিয়ে পড়লাম আমি আর শ্রীনিবাস। কাজটা শেষ হতে ঘন্টা তিনেক লাগবে তাই ততক্ষণ নিশ্চিন্ত।
চিলড্রেন্স হাসপাতালের সামনে ওর সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল কিন্তু সেখানে পৌঁছে আমরা ওকে দেখতে পেলাম না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আমরা ফিরে যাব কিনা ভাবছি এমন সময় হঠৎ শুনলাম গ্যারি আমাদের নাম ধরে ডাকছে। শব্দটা ওপর থেকে আসছে! ওপরে তাকিয়ে দেখি দড়ি দিয়ে বানানো একটা দোলনায় চড়ে দুলে দুলে হাসপাতালের কাচের জানালা পরিষ্কার করছে একজন। এবং কাজটা যে করছে সে মোটেই যে সে লোক নয়, স্বয়ং সুপারম্যান! জানালার ভিতর থেকে উৎসাহিত বাচ্চাদের মুখ দেখা যাচ্ছে আর আমাদের আশপাশেও বেশ কিছু খুদে উত্তেজিত হয়ে লাফাচ্ছে! সুপারম্যানের পোষাক পরে যে জানালার কাচ পরিষ্কার করছে সে আর কেউ নয় স্বয়ং গ্যারি! সেও পরমানন্দে বাচ্চাদের দেখে সুপারম্যানের মতন হাত পা নাড়ছে মাঝে মাঝেই!
আনন্দে আমি আর শ্রীনিবাস প্রায় চিৎকার করে উঠছিলাম! এতদিনে গ্যারি একটা মনের মতন কাজ পেয়েছে! অসুস্থ বাচ্চাদের আনন্দ দেওয়ার সাথে সাথে হাসপাতালের জানালাগুলোও পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুপারহিরোর নেমে আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম। গ্যারিকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন না জানিয়ে ফিরে যেতে মন চাইছিল না!