• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৮ | নভেম্বর ২০১৪ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • 'ধূমল চলচ্চিত্রের চির-উজ্জ্বল আধারগুলি' : ঈশিতা চক্রবর্তী


    ছায়াময় অতীত; মহাদেবী বর্মা; (অনুবাদ : মলিনা রায়) প্রথম প্রকাশ: ২০১৪, সাত সমুদ্র, কলকাতা; পৃষ্ঠাঃ ১২৮
    স্মৃতির রেখা; মহাদেবী বর্মা; (অনুবাদ : মলিনা রায়) প্রথম প্রকাশ: ২০১৪, সাত সমুদ্র, কলকাতা

    সামাজিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে হীনবল মানুষজনের জীবনকথা তাঁদের নিজেদের লেখায় জানার সুযোগ ভারতীয় ভাষাগুলিতে আজও নেহাতই কম। ফরাসি বিপ্লবের সমসাময়িক গৃহসেবিকার আত্মকথা অথবা শিল্পবিপ্লবের পরে ইংল্যাণ্ডের কারখানা-শ্রমিকের স্মৃতিকথার তুলনা এদেশে বিরল। দু'একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদ দিলে 'নীচের তলা'-র মানুষের জীবন প্রকাশ্যে এসেছে 'উপর তলা'-র কলমে। হিন্দী সাহিত্যের খ্যাতনামা কবি মহাদেবী বর্মার (১৯০৭-১৯৮৭) স্মৃতিকথার দুটি খণ্ড (বাংলা অনুবাদে পুনর্মুদ্রণ) এই নীচের তলার জগৎকে মধ্যবিত্তের আঙিনায় হাজির করার এক সার্থক প্রয়াস।

    'ছায়াময় অতীত' ('অতীত কে চলচ্চিত্র') ও 'স্মৃতির রেখা' ('স্মৃতিকি কি রেখায়েঁ') শিরোনামে দুটি খণ্ডে যাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা মহাদেবী লিখেছেন তাঁরা সকলেই মার-খাওয়া মানুষ, অনেকেই হতদরিদ্র। বিভিন্ন সময়ে, লেখিকার জীবনের বিভিন্ন বাঁকে এঁদের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। যেমন 'ছায়াময় অতীত'-এর প্রথম চরিত্র রামা, মহাদেবীর শৈশবের গৃহভৃত্য। রামা-র স্নেহচ্ছায়া কী ভাবে তাঁদের ভাইবোনেদের ঘিরে রেখেছিল সে কথা মহাদেবী অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রেখেছেন। মনে রেখেছেন একবার অসুস্থ অবস্থায় তাঁর পরিচর্যা করতে গিয়ে রামার আক্রান্ত হওয়ার কথা: "দু-দিন দু-রাত আমার বিছানার পাশ থেকে নড়লই না। তৃতীয় দিনে আমার কানের ফোলা কমে গেল কিন্তু রামার খুব জ্বর এল। সঙ্গে সঙ্গে ওর কানের পাশটাও ফুলে উঠল। সেটা পরে কাটতে হয়েছিল। কিন্তু ও এই ভেবেই খুশি ছিল যে আমি তো সব কষ্ট থেকে বেঁচে গেছি।" ('রামা', ছায়াময় অতীত, পৃ. ১৫)

    সাবিত্রী নামের অপভ্রংশ সাবিয়া এসেছিল লেখিকার কাছে জমাদারনির চাকরি করতে। ওর স্বামী ওকে ছেড়ে চলে যায় দু-তিনটি বাচ্চা আর নিজের বৃদ্ধা মার ভরণ-পোষণের ভার ওর উপর চাপিয়ে। আর একটি বিয়ে করে সেই স্বামী যখন নতুন বউ নিয়ে ফিরে আসে তাদের খাওয়াবার ভারও সাবিয়াই নেয়: "দু বেলা থালায় ভাত-রুটি, আর ঘটি ভরে ডাল নিয়ে ওকে যেতে দেখতাম। অবুঝ বাচ্চাদের উৎপাত ও যেভাবে সহ্য করে ঠিক সেই ভাবে ওর স্বামীর হৃদয়হীন কৃতঘ্নতা, সপত্নীর অনুচিত ব্যঙ্গ, শাশুড়ির অকারণ ভর্ৎসনা &mmdash; সবই অগ্রাহ্য করে।" এ নিয়ে কেউ ওকে কিছু বললে সাবিয়া পালটা যুক্তি দেয়: "ধর আমার স্বামী যদি পাগল হত কি পীড়িত হত তাহলে লোকে আমায় কি করার পরামর্শ দিত?" ('সাবিয়া', ছায়াময় অতীত, পৃ. ৪৬) মহাদেবীর চোখে সাবিয়া নিতান্ত এক বোধবুদ্ধিহীন, সর্বংসহা করুণার পাত্রী নয়, অসামান্য হৃদয়ের অধিকারী: "ও তো সবরকমে নিকৃষ্টতম প্রাণী। তবু ওর মধ্যে যে এই পরশমণির অবস্থিতি, যা সব লোহাকে সোনা করে দেয় — তা কি করে সম্ভব ভেবে পাই না।" (পৃ. ৪৬-৪৭)

    সমাজের কাছে মার-খাওয়া, হার মানতে না-চাওয়া যে মানুষদের কথা দুই খণ্ডে বলেছেন মহাদেবী তারা কেউই অবশ্য নিছক করুণার পাত্র নয়। যেমন জোলার ছেলে ন' বছরের ঘীসা, যাকে তার গ্রামে গিয়ে মাঝে মাঝে পড়াতেন লেখিকা। পেট ভরে সে খেতে পেত না, কিন্তু কিছু খাবার তাকে দেওয়া হলে পোষা কুকুর ছানাটার সঙ্গে ভাগ করে খেত। ওই গ্রামের হতদরিদ্র শিশুদের পরিচ্ছন্নতার মাহাত্ম্য, পোশাক বদলের প্রয়োজনীয়তা শেখাতে গিয়ে তাদের রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে লেখিকার পরিচয়: "ঘীসা যখন স্নান করে ভেজা গামছা জড়িয়ে আর আধভেজা কুর্তা পরে অপরাধীর মতো আমার সামনে এসে দাঁড়াল, তখন আমার চোখ দুটিই নয় শুধু, প্রতি রোমকূপ স্নেহে সিক্ত হয়ে উঠল। সে-সময় বুঝলাম, দ্রোণাচার্য তাঁর ভীল শিষ্যের কাছ থেকে বুড়ো আঙুল কাটিয়ে নিয়েছিলেন কি করে।" ('ঘীসা', ছায়াময় অতীত, পৃ. ৬৮)

    কেবল বিত্ত আর জাতপাতের নিরিখে প্রান্তিক মানুষরাই নয়, মহাদেবীর স্মৃতিকথায় অনেকখানি জুড়ে আছে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, উচ্চবর্ণ সমাজের মেয়েরা। যেমন তাঁর শৈশবের প্রতিবেশী কিশোরী বধূটি যে ষোল বছর বয়সে বিধবা হয়ে সাদা কাপড়, একবেলা খাওয়া আর শ্বশুরের সেবা জীবনের একমাত্র অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছিল। বালিকা মহাদেবী একদিন শখ করে প্রতিবেশী 'বৌদি'-কে একটি রঙিন ওড়না জড়িয়ে দিয়েছিল। শ্বশুর আর ননদের তা চোখে পড়ে যাওয়ার বধূটির নির্মম প্রহার জোটে যার পরিণামে সে সংজ্ঞা হারায়। মহাদেবী লিখছেন: "রঙিন কাপড়ের প্রতি আমার বিরাগ দেখে আজো যখন অনেকে কৌতুকভরা প্রশ্ন করেন, তখন সেই অতীত আবার আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রঙিন কাপড়ে ঢাকা, যে মুখ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে — সে চেহারা কি করুণ, কি শুষ্ক! কখনো কখনো সেই মুখের আভাস — আমার সামনে যত করুণ ক্লান্ত মুখ আসে, তাদের মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয়ে ওদের সঙ্গে আমাকে এক অটুট বন্ধনে বেঁধে দেয়।" ('বৌদি', ছায়াময় অতীত, পৃ. ৩০) ছায়াময় অতীত গ্রন্থের 'ক্লান্ত, করুণ মুখগুলির' মধ্যে আরও রয়েছে লেখিকার দুই বাল্যসখী বিন্দা আর বিট্টো, তরকারি বিক্রেতা দৃষ্টিহীন অলোপীদীন, কুমোর দম্পতি বদলু রাধিয়া। এই খণ্ডের শেষ চরিত্রটি পর্বতকন্যা নির্ভীক লছমা। লছমা শ্বশুরবাড়ির মার সয়ে বেঁচে ফিরে আসে, আর সেখানে ফিরতে রাজি হয় না কিন্তু অপরিণতবুদ্ধি স্বামীকে নিজের কাছে রেখে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে চায়। এই বিদ্রোহে শ্বশুরবাড়ির লোক, গ্রামের লোক সবাই ওর বিরুদ্ধে: "কারণ যে মেয়েমানুষ মরেও বেঁচে যায় সেই মায়াবিনী বউয়ের সততার ওপর ওরা বিশ্বাস রাখতে পারে না।" ('লছমা', ছায়াময় অতীত, পৃ. ১১৭) মেয়েদের ব্যাপারে পুরুষের বিচার। বিচার যে শ্রেণী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একইরকম, লছমা-র অভিজ্ঞতা থেকে সেই উপলব্ধি: "... সমাজের মনোবৃত্তির যে পরিচয় আমরা সমতলক্ষেত্রে পাই ঠিক সেই জিনিসই পর্বতের বিষম ক্ষেত্রেও দেখা যায়। একটি পুরুষের প্রতি অন্যায় হয়েছে এই কল্পনাতেই সারা পুরুষ সমাজ সেই স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে কৃতসংকল্প। আর একটি স্ত্রীর প্রতি ক্রূরতম অনায়ের প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও সব স্ত্রীলোকরা ওর অকারণ দণ্ডকে আরো ভারী করার চেষ্টা না করে পারবে না।" ('লছমা', পৃ. ১১৭)


    'স্মৃতির রেখা' খণ্ডটির অন্যতম আকর্ষণীয় চরিত্র চীনা ফেরিওয়ালা, ছিটের কাপড় ফেরি করতে এসে যে মহাদেবীকে সিস্টার বলে ডাকে আর শোনায় তার অনাথ শৈশবের কাহিনী — পেটের দায়ে একমাত্র দিদির বিক্রি হওয়া ও শেষে একদিন হারিয়ে যাওয়া, নিজের পকেটমারদের দলে যোগ দেওয়া, অবশেষে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় এসে পৌঁছনো। জন্মদুঃখী এই মানুষটিকেও আমরা সমবেদনা জানাতে পারি, করুণা নয়। হঠাৎ একদিন এসে সে লেখিকাকে জানায়, তার দেশে ফেরার ডাক এসেছে, যুদ্ধ করতে চীনে যাবে। মহাদেবী জানতে চান, সে তো বলেছিল দেশে তার কেউ নেই, তবে ডাক পাঠাল কে? চীনা ফেরিওয়ালা অবাক হয়ে উত্তর দেয়: "আমি কবে আবার বলেছি আমার চায়না নেই — কখন তোমাকে একথা বলেছি সিস্তর?" ('চীনা ফেরিওয়ালা', স্মৃতির রেখা, পৃ. ৩১)

    নীচের তলার মানুষের জীবন বিশেষত বাড়ির কাজের লোকেদের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কের খতিয়ান গত শতকের ভারতীয়দের অনেকের লেখাতেই সুলভ। এ দিক থেকে মহাদেবী ব্যতিক্রম নন। মহাদেবীর সঙ্গে তাঁর সমকালীন লেখকদের মূল তাফাতটা দৃষ্টিভঙ্গির। সমাজ বদলের দায় নয়, আত্মগরিমা প্রচার নয় — মহাদেবী ঘীসা - লছমা - রামার 'অন্য জগৎ'-কে দেখেন সশ্রদ্ধ মমতায়। সাবিয়া বা ভক্তিন-এর জীবনবোধ থেকে শিক্ষিত হতে চান।

    পেটের দায়ে গ্রাম থেকে শহরে লোকের বাড়ি খাটতে আসা মেয়েদের মিছিলের একটি মুখ ভক্তিন — 'স্মৃতির রেখা' খণ্ডের প্রথম চরিত্র। মহাদেবীর কথায়: "ভক্তিনকে চাকর বলা ততখানি অসঙ্গত - যতখানি অসঙ্গত ঘরের মধ্যে বারবার আসা-যাওয়া করে যে আলো-ছায়া, তাকে আর প্রাঙ্গণের গোলাপ আর জাম গাছকে সেবক বলে মনে করা। ওদের যেমন একরকম অস্তিত্ব আছে যাকে সার্থকতা দেবার জন্য ওরা আমাদের সুখদুঃখ দেয়, সেরকম ভক্তিনেরও একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব আছে যা নিজের বিকাশের পরিচয় দেবার জন্যই আমার জীবনকে ঘিরে রেখেছে।" (ভক্তিন, স্মৃতির রেখা, পৃ. ১৬)। এই খণ্ডের অন্য চরিত্রগুলি হল ধোপানি বিবিয়া, দুটি পাহাড়ি ছেলে মুটের কাজ করা জঙ্গিয়া আর ধনিয়া, ঠাকুরীবাবা, গুঙ্গিয়া আর মুন্নুর মা। ঠাকুরীবারা এক কবি ও গায়ক যিনি "কোথাও বিরহের গান গাইবার সুযোগ পেলে কোনো মাচায় বসে রাতভর ক্ষেত পাহারা দিতেন। কখনো বারমাস্যা শুনতে চায় এমন রসিক শ্রোতা পেলে তার বলদগুলোকে দানাপানি খাওয়ানোকেও ছোট কাজ মনে করতেন না। ... কোথাও হোলির উৎসব থাকলে কবীরের দোহাঁ শোনানোয় খিদে তেষ্টা ভুলে যেতেন।" ('ঠাকুরীবাবা', স্মৃতির রেখা, পৃ. ১১০) ধোপানি বিবিয়া এক তেজি মেয়ে যে বার বার সমাজের মার খেয়েও মাথা তুলে দাঁড়ায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত হেরে যায়, বেছে নেয় আত্মহননের পথ। গুঙ্গিয়া এক বাক্‌শক্তিহীন নিরক্ষর মেয়ে যে আরও বহু নিরক্ষর গ্রামের মানুষের সঙ্গে লেখিকার দরবারে চিঠি লেখাতে হাজিরা দিত।

    শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কলমে 'অন্য' জগৎ সাধারণত আসে নিজেদের অভিজ্ঞতার অনুষঙ্গ হিসেবে। আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথায় কাজের লোকেদের নিয়ে বাঙালি 'ভদ্রলোক' - 'ভদ্রমহিলা'রা এককালে বহু রোমন্থন করে গেছেন। কিন্তু সে-স-ব স্মৃতিকথার প্রধান চরিত্র কখনোই ওই প্রান্তিক মানুষেরা নন। তাঁরা আসেন লেখকের প্রয়োজনে বক্তব্যের পরিপূরক হিসেবে। মহাদেবীর স্মৃতিকথা এদিক থেকেও ব্যতিক্রম। প্রান্তিক মানুষেরাই তাঁর বর্ণনার প্রধান চরিত্র, নিজের কথা এসেছে সেই প্রধান চরিত্রগুলির অনুষঙ্গে। তবে যাদের কথা তিনি বলেন তাদের সঙ্গে নিজে খুব বেশিরকম জড়িয়ে। ভক্তিন অথবা ঘীসার স্মৃতিচারণ মাঝে মাঝে মহাদেবীর আত্মকথা বলেও মনে হয়। নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকা, নৈর্ব্যক্তিক সমাজ বিশ্লেষণের চেষ্টা এই লেখাগুলিতে নেই। প্রায় একশো বছর আগে উত্তর ভারতের এক বর্ণহিন্দু পরিবারের মেয়ে তাঁর সমাজকে কত প্রসারিত চেহারায়, কত আন্তরিক মমতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখেছিলেন তার দলিল এই লেখাগুলি। সেই কারণে এগুলির গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি।

    মূল হিন্দী থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন মলিনা রায়, এতটাই সাবলীল যে অনুবাদ নয়, খণ্ড দুটি মৌলিক রচনা বলেই মনে হয়। ভূমিকা থেকে জানতে পারছি বাংলা অনুবাদের প্রথম প্রকাশেরও বয়স হয়ে গেল চার দশক। এতকাল পরে এই বিস্মৃত রত্ন উদ্ধার করে বাংলা ভাষার পাঠকের অশেষ উপকার করলেন বর্তমান প্রকাশক। যত্নে সম্পাদিত, সুমুদ্রিত এই খণ্ড দুটি যথাযোগ্য সমাদর পাবে বলে আশা করা যায়।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments