অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকেই বেশ শীত পড়ে যায় এখানে। এমনিও এখানে তেমন গরম নেই। সারা বছরই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। পুজোর পর থেকে বাতাসে হিমেল আমেজ। পাতার রঙ ক্রমশ কালচে সবুজ। বেনিয়মেই সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত মাঝে মাঝেই দু’ পশলা বৃষ্টি হয়ে যায়। সেই বৃষ্টির আমেজ মেখে হেমন্তের অরণ্য এ সময় গম্ভীর।
সন্ধের পর থেকে একেবারেই নিঝুম গা-ছমছম। রহস্যময় সুদূর। হাত বাড়ালেও ছোঁয়া যায় না। পাহাড়ের চূড়ায়, গাছের মাথায় এখনো রোদের আলো, নিচের অরণ্যে কিন্তু আঁধার নেমেছে। দিনের প্রথম অন্ধকার। মায়াবী আদিম পৃথিবী। নির্জন নি:শব্দ। এদিক ওদিক থেকে বুনো শেয়ালের পলায়মান ডাক। মৌটুসি, টিয়া, চন্দনা, শালিখ, বুলবুল। চেনা অচেনা কতরকম শিস। ঘন গাছের ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশটা ধূসর হয়ে আসছে।
অনেকক্ষণ ধরে টিলার ওপর বসে আছে শমিত। বসে থাকতে থাকতে কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে। বাতাসের শব্দে সমুদ্রের তরঙ্গ। অথচ আজ কিন্তু হাওয়া চলছে না। আজ নিচের জঙ্গল খুব গম্ভীর, খুব শান্ত। আশেপাশে অসংখ্য রঙিন প্রজাপতি। হলুদ, সবুজ, পাটকিলে, খয়েরী। বাসায় ফেরার টানে আকাশে পাখির ঝাঁক। লাল নীল মুনিয়া, সবুজ টিয়া। একঝাঁক চন্দনা।
শমিত উঠে পড়ল। এবার ফিরতে হবে। এখনই অন্ধকার হয়ে যাবে চারদিক। চেনা রাস্তাটাও একলা হয়ে বুকের মধ্যে ঢুকে পড়বে। এই সন্ধে নামার সময়টা বড্ড মনখারাপ করে দেয়। নাহ, আর বসা চলবে না।
পায়ের পাশ দিয়ে ছুটে গেল দুটো বুনো কাঠবেড়ালী। পাহাড়ের দিকে মুখ করে টিলার ওপর এসে বসল একটা একলা মদনটাক পাখি, বিশাল সারসের মতো পাখি।
পায়ের আওয়াজে একবার মুখ ফেরালো পাখি। কিন্তু উড়ে গেল না। ওর ডানা বুঝি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে? নাকি আর উড়ে যাবার ইচ্ছে নেই? কে জানে কতদূরে ওর বাড়ি।
না, বাড়ি নয়। বাসা। পাখিরা জানে, জীবনের মতই বাসস্থানও অনিত্য। একটা ঠিকানার খোঁজে, একটা পাকা বাড়ির তাগিদে জীবনপাত করে না পাখি। আকাশের অনেক ওপরে উড়ে, আকাশটাকে কাছ থেকে দেখে, অনেকটা নিচের পৃথিবীর সব জিনিস ওদের কাছে খেলাঘর। এক টুকরো জমির জন্যে মানুষে মানুষে কতই না লড়াই। আকাশের পাখির চোখে নেহাত মামুলি কারণ।
কেমন মনখারাপ করে বসে আছে পাখিটা। ওর বুঝি ঘরে ফেরার তাড়া নেই?
টুরি চিনিয়েছিল পাখিটাকে। মদনটাক। মদনটাক, দুধরাজ, দোয়েল, দুর্গাটুনটুনি। পাখি। বাঁদরলাঠি, কুসুম, বহেড়া, অমলতাস। গাছ। চিহরলতা, হেলাঞ্চি। লতা। শাক পাতা। ক্ষেত থেকে তুলে আনা বুনো আলু, বুনো শেকড়। টুরি চিনিয়েছে। এই পাখিটাকেও চিনিয়েছিল টুরিই।
ডমন সেদিন আট কিলোমিটার দূরের হাট থেকে শমিতেরই জন্যে মুরগি, পেঁয়াজ, ছোট মাছ আনতে গিয়েছিল। টুরি রোজকার মতই এসেছে। ঘর পরিষ্কার করে, মাটির উনুনে কাঠ পাতা রেখে অপেক্ষা। ডমনের জন্যে। বড্ড ছটফট করে মেয়েটা। বসে থাকা ওর ধাতে নেই। উঠোনের সামনের শাল গাছের পাশ থেকেই যে মহুয়ার বন শুরু হযেছে, সেখানে একদিন রাতের দিকে মস্ত ভালুক এসেছিল। উঠোন ঘেঁষে বাঁশের বেড়া দিয়ে দিয়েছিল ডমন।
সেই বেড়ার নিচে লম্বা লতার আলপনা দিতে বসল টুরি। সাদা পদ্মফুলের পাশে সাদা একটা শঙ্খ। সাদা চক্র।
সেইসময় এসে বসেছিল পাখিটা। শঙ্খ আর চক্রের ঠিক ওপরে বেড়ার লম্বা বাঁশটার ওপর। অমনি একটা চমত্কার ছবি হয়ে গেল।
‘এটা কি পাখি টুরি? ভারি সুন্দর তো!’ শমিত বলেছিল।
‘ইটা মদনটাক পাখি। সারসের মত লম্বা গলা। তু ছবি তুললি না?’
পাখির সৌন্দর্যে মুগ্ধ শমিত ক্যামেরা বার করতেও ভুলে গেছিল। টুরি ঠিক খেয়াল করেছে।
এমন সুন্দরের দেখা অবশ্য বারবার।
একদল বুনো চড়াই আর ডাহুক খেলা করছে। এখানে চড়াই খুব সুন্দর। আকারে একটু বড়, একটু ঘন খয়েরী। চড়াই আর ডাহুকের খেলাঘরের ঠিক মধ্যিখানে এসে বসল বড় ঝোলা লেজ সাদা একটা পাখি। সময় বুঝেই কোনাকুনি এসে বসল দুটো বুলবুল কিংবা দুটো অচেনা কালচে খয়েরী পাখি। অমনি কি সুন্দর একটা আলপনা।
এক ঝাঁক দুধ-সাদা বক উড়ে যাচ্ছে, মধ্যিখানে আনমনে একটা নীল পাখি। আকাশের গায়ে রঙিন আলপনা।
টুরিকে অবশ্য এসব ছবি টানে না। ওর বেশি আগ্রহ পাথর নিয়ে।
‘তু এত্ত পাথর জমাস কেন বাবু? ইগুলা কি শহরে বিক্রী করবি?’
টুরিকে আগে থেকেই চেনে শমিত। এখানে পাকাপাকি এসে থাকার আগে থেকেই চেনে। ডমনের বউ টুরি। ডমনই বলেছিল, ‘তু মোদের ঘরকে থাকতে যদি নাই পারিস, তুর জন্যে ঘর বানাই দিব আমি। টুরি তুর রান্ধা করে দেবে। ভাবিস নাই।'
ভূতত্ত্বে কৃতিত্বের সঙ্গে পোস্ট-গ্র্যাজ্যুয়েশন। কোরবার দামী চাকরিটা তবু নেয় নি শমিত। ময়ুরভঞ্জের খনিতে পাথর চিনতে চলে গিয়েছিল। বাবা চেয়েছিলেন, সব বাবাদের মতই, শমিত ডাক্তার হোক। কিংবা ইঞ্জিনিয়ার। সায়েন্স না পড়ে কমার্স পড়লেও আপত্তি ছিল না। চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হয়ে ব্যবসায় সাহায্য করুক। নইলে বরং ল’ পড়ুক। শমিত জিওলজি পড়তে চায় শুনে বাবা খুব অবাক হয়েছিল।
‘জিওগ্রাফি? ভূগোল? ভূগোল নিয়ে পড়ে কি লাভ হবে?’
অথচ ছোটবেলা থেকে বাবার কাজের জগৎ দেখে, আর বৃন্দাবনকাকার কাছে থেকে শুনে শুনে এই নিয়ে আগ্রহ হয়েছিল শমিতের। পিতৃপুরুষের ধারায় উড়িষ্যা অন্ধ্রপ্রদেশ মধ্যপ্রদেশ ছত্তিসগড় উত্তরপ্রদেশ জুড়ে ব্যবসা বাবার। খনির ইজারা। কোথাও কয়লা, কোথাও খনিজ।
‘জিওগ্রাফি নয়, জিওলজি। ভূতত্ত্ব।' মা বুঝিয়ে বলেছিল বাবাকে। মা অধ্যাপিকা। মায়ের অধ্যাপনা আর পড়াশোনার ক্ষেত্রটাও শমিতের বেশ লাগে। অ্যানথ্রোপলজি। নৃতত্ত্ব।
মায়ের খুব আফসোস, ইচ্ছে থাকলেও নানা জায়গায় যাওয়া হয় নি। পুরুষ সহকর্মীরা ইচ্ছে হলেই যেতে পেরেছেন। বিজন বিভুইঁ জায়গায় মেয়েকে ছেড়ে দিতে পারেন নি মায়ের বাবা-মা। বিয়ের পরে তো আরো অসম্ভব ছিল। বাবা ব্যস্ত, মাসের মধ্যে কুড়ি বাইশ দিন বাইরে বাইরে। ছোট্ট শমিত, কলেজের চাকরি, সংসার, আত্মীয়-পরিজনের আসা-যাওয়া।
মুখ ফুটে কোনোদিন বলে নি, কিন্তু মা হয়ত চেয়েছিল শমিত অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে পড়ুক। মাঝে মাঝেই বলত, ‘আমার যা আছে, সব তোকে দিয়ে দেব রে ঋষি। তোকে বেশি খাটতে হবে না।'
কলেজে শমিত জিওলজি নিল যখন, মা-ই অবশ্য সহায় হয়েছিল। আর কোনোদিন অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে কিছু বলে নি। নিজের রিসার্চ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। পড়াশোনা, গবেষণা, ছাত্রছাত্রী। এই মায়ের জীবন।
কথাটা টাকা রোজগার নিয়ে নয়। শমিতের উপার্জনের আশায় বাবা-মা কেউ অপেক্ষায় নেই। বাবা চেয়েছে, সব বাবাদের মত করেই চেয়েছে, ছেলে ব্যবসার ধারায় যুক্ত থাকুক। উত্তরাধিকার বহন করুক চার-পুরুষের ব্যবসার। বাবার এই বিশাল কর্মকাণ্ড। ছেলে হাল ধরলে নিশ্চিন্ত হতে পারত বাবা।
মা চেয়েছে, চেয়েছে কিনা তা অবশ্য ঠিক জানে না শমিত, তবে মায়ের জগতের উত্তরাধিকারের ভারও কম নয়। শমিত জিওলজি বেছে নেবার পর যদিও মা-ই বাবাকে বুঝিয়েছিল, কিন্তু একটু হলেও আশাভঙ্গ কি হয় নি মায়ের? নইলে ইন্দ্রনীল বা সুকন্যা, মাযের দুই পছন্দের ছাত্রছাত্রীকে গবেষণার কাজে ডেকে পাঠাল কেন? সুকন্যা বিদেশ চলে যেতে অমন ভেঙে পড়েছিলই বা কেন? তবু মা সহায় থেকেছে সব সময়, এ শমিতের প্রাপ্তি।
পাশ করার পর বাবা বলেছিল, চাকরি না করে শমিত যদি গবেষণা করতে চায় করুক। কিন্তু সে সময়টা ব্যবসার কাজেও একটু জড়িয়ে থাকুক।
‘আমি একা আর কতদিক সামলাব রে ঋষি? বয়সও তো হচ্ছে।'
একটু খারাপ লাগা হয়েছিল শমিতেরও। বাবা-মায়ের প্রতি, সংসারের প্রতি একমাত্র ছেলের দায়িত্ব তো আছেই। মা কিন্তু বলেছিল, ‘তোর ইচ্ছে না হলে কোনো কাজ করিস না ঋষি। তাতে কাজটাও ভাল করে হয় না, নিজেও ভালো থাকা হয় না।'
মা চেয়েছে, ছেলে নিজের ভালোবাসার বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করুক, নিজের পছন্দের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুক। বাবাকে মা-ই বুঝিয়েছিল, বাবা আর জোর করে নি। নোয়ামুণ্ডি মাইনসের চাকরিটা পাওয়ার পর অবশ্য বাবা খুব খুশি হয়েছিল। নিশ্চিন্ত হয়েছিল। জীবনের প্রথম চাকরিতেই একটা প্রেস্টিজিয়াস প্রোজেক্টের সর্বময় কর্তা। এতটা ভাবে নি বাবা। এমনিও মাইনস কোলিয়ারী বাবার ভালোবাসার জগত।
দু’ বছরের মধ্যেই এত ভালো চাকরিটা ছেড়ে দিল শমিত। বাবাকে আবার চিন্তিত দেখিয়েছিল। কি চায় ঋষি! কেরিয়ার নিয়ে, জীবন নিয়ে কোনোদিনই কি সিরিয়াস হবে না ছেলেটা! এত সাবজেক্ট থাকতে পড়াশোনা করল জিওলজি নিয়ে। এত ভালো রেজাল্ট করে বিদেশ না গিয়ে চাকরি নিল। আবার কথা নেই বার্তা নেই, চাকরিটা ছেড়েও দিল!
মা কিছু বলে নি, বাবা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল। ‘ঠিক করে বল তো ঋষি, ঠিক কি করতে চাস তুই। একটা প্রপার কেরিয়ার প্ল্যানিং তো চাই।' দেরাদুনের ভূতত্ত্ব গবেষণাগারের চাকরির চিঠিটা তখন দেখিয়েছিল শমিত। এটা আরো বড় চাকরি। বিশাল ব্যাপার স্যাপার। প্রয়োজনে বছরে একবার বিদেশে বসবাস ও গবেষণার সুযোগ। বাবা খুব খুশি। মাও। মা খুশি হয়েছিল শমিত রিসার্চের কাজ নিয়েছে জেনে। জ্ঞানভিক্ষুণী মা শমিতের কতখানি প্রেরণা, মা নিজেই তা জানে না।
চাকরিটা বেশ ভালোই করছিল শমিত। বাবামাকে নিশ্চিন্ত করতে পেরে ভালো লাগছিল। দেরাদুন ভালো লেগে যাচ্ছিল। সমমনস্ক বেশ কিছু বন্ধু হয়েছিল। ল্যাবে নিজের মতো কাজ করার স্বাধীনতা। ল্যাবটা দারুণ। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা দারুণ। বড় সুন্দর বাংলো বাড়ি। কাজের লোক, রান্নার লোক। সব ব্যবস্থা গুছিয়ে দিয়েছিল মা। রোজ সকালে চায়ের প্রথম কাপ নিয়ে সে বাড়ির বারান্দায় বসাও বেশ অভ্যেস হয়ে যাচ্ছিল।
বাড়ির সামনের দিকে সবুজ লন। লন ঘিরে সবুজ গাছপালা। রঙিন ফুল। সারা বছর জুড়েই ফুল ফুটত। বাড়ির ঠিক পাশেই একটা টিলা। তার পাশ দিয়ে সুন্দর কালো পাহাড়ী রাস্তা। মাঝে মাঝেই সেই রাস্তা দিয়ে একা একা হেঁটে টিলা পাহাড় ছাড়িয়ে জঙ্গলে চলে যাওয়া হত। অগোছালো জঙ্গল, খুব একটা ঘন নয়। কিন্তু মহুয়া পলাশ অর্জুন বহেড়া কুসুম বট অশ্বত্থ, কত গাছই না ছিল।
খুব ছোটবেলায় বাবা পাতা শুঁকে শুঁকে গাছ চেনা শিখিয়েছিল। এখানে এসে সেই বিদ্যেটা কাজে লেগেছিল বেশ। বাগানের কাজ করার জন্যে মালী ছিল একজন, বিষ্ণু। সেই বিষ্ণুর সঙ্গে গাছ চেনার খেলাটা বেশ জমেছিল। জঙ্গল আর জঙ্গলের গন্ধ।
ছুটির দিনের সকালে কিংবা বিকেলে একা একাই ছোট্ট টিলা পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া। সেখানে কোনো বড় গাছ ছিল না। ছোট ছোট নানারকম গাছ। আগাছা। একরকম কাঁটা কাঁটা গাছ, বিষ্ণু নাম বলতে পারে নি। নোয়ামুণ্ডিতে আদিবাসীরা ওগুলোকে ‘খারাং’ বলত। সেই খারাং গাছে ফুটত একরকম হলুদ প্রজাপতির মত উজ্জ্বল ফুল। ফুলের বিশেষত্বই ওই আলগা আলগা রেশম কোমল উজ্জ্বল হলুদ পাপড়ি। বিষ্ণু একদিন দেখিয়েছিল, সেই পাপড়ি ঠোঁটে লাগিয়ে জোরে ফুঁ দিলেই বাঁশির মত আওয়াজ। গান্ধারে ধৈবতে মন্দ্রে। শমিত গাছের নাম দিয়েছিল, ‘বাঁশিফুলের গাছ।' বেশ কাটছিল দেরাদুনে।
কিন্তু শেষরক্ষা হল না। দেরাদুনের চাকরি আটকে রাখতে পারল না। আসলে নোয়ামুণ্ডির চাকরি ছেড়ে এলেও জঙ্গলটা বুকের মধ্যেই বাসা বেঁধে থেকে গিয়েছে। গাছপালা পশুপাখি জঙ্গল। জঙ্গলের নুড়িপাথরগুলো পর্যন্ত টানছিল শমিতকে। প্রবল টান।
‘চাইলে তুই ন্যাচারালিস্ট হতেই পারিস ঋষি’, বাবা বলেছিল, ‘কিন্তু সেজন্যে এত ভালো চাকরিটা ছাড়তে হবে কেন?’ পৃথিবীজোড়া নানা ন্যাচারালিস্ট অরণ্যপ্রেমী মানুষের কথা বলেছিল।
মা তখন শমিতের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। মাসি পিসি কাকিমা জ্যেঠিমা। কত সম্বন্ধ আসছে। দেরাদুনে পিয়ালীবৌদি, সোমাবৌদি, মিঠুকাকিমা। শমিত যে একজন দুর্দান্ত এলিজিবল ব্যাচেলর।
মা জোরের গলায় বলেছিল, ‘ও দু’ চারদিনের জন্যেই অরণ্যজীবন ভালো লাগবে রে ঋষি। চিরকাল শহরে থেকেছিস, তুই কি অমন জঙ্গলের গ্রামে থাকতে পারবি? কত অসুবিধে। জল নেই, ইলেক্ট্রিসিটি নেই, হাইজিন বলে কোনো বোধ নেই। তাছাড়া শহরের জীবনটাই কি এমন খারাপ? ভালো থাকতে চাইলে যে কোনো জায়গাতেই ভালো থাকা যায়। ভালো থাকাটা, ভালো থাকতে পারাটা একটা অভ্যেস রে ঋষি।'
কি করে যে বোঝায় শমিত! সবুজ পাতা, গাছপালা, বুনো জন্তু জানোয়ার, পাখি প্রজাপতি, ধূসর পাটকিলে কালো পাথর, কালো কালো সহজ সরল মানুষ। পুঞ্জীভূত অপার্থিব রস। এ অনির্বচনীয় গন্ধ, রূপ, স্বাদ যে পেয়েছে, তাকে কি ঘরপোষা শহরপোষা নিয়ন্ত্রিত সুখ টানে? কি করে যে বোঝায়!
নোয়ামুণ্ডিতে থাকার সময় একবার টেবো পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল। নোয়ামুণ্ডির নতুন বন্ধু আশিস দুলাল, কলকাতা থেকে সুবিমান অলক প্রণব এসেছিল, জিপ ভাড়া করে দশদিন ধরে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরা। নোয়ামুণ্ডির গাঙ্গুলিদাও সঙ্গে ছিলেন। অরণ্যপ্রেমিক গাঙ্গুলিদা। নোয়ামুণ্ডি মাইনসের বড়কর্তা থেকে কুলি কামিনরা, সবার প্রিয় গাঙ্গুলিদা। ব্যাঙ্কের চাকরিতে বদলি হয়ে এসেছিলেন এখানে, জায়গাটা পছন্দ হয়ে গেল। জঙ্গলের গন্ধ, জঙ্গলের নেশা।
খুব ঘোরা হয়েছিল সেবার। গাঙ্গুলিদা কিন্তু খুশি হচ্ছিলেন না।
মাতাল অবশ্য গাঙ্গুলিদাও। বনমাতাল। জঙ্গলে এসে থেকেই কেমন বেভুল অন্যমনস্ক। হৈ হৈ হাসি, হুল্লোড়ে গাঙ্গুলিদাকে চেনাই যাচ্ছে না।
তবে কথাটা নাড়া দিয়েছিল খুব। ভেতর থেকে অনুভব করেছে শমিত তারপর।
দীর্ঘ অরণ্যযাত্রায় মনের ভেতরে যেন অনন্তযাত্রার প্রস্তুতি। মায়া মায়া নির্জনতায় নিজেকে ফিরে ফিরে দেখার অনুভূতি। নিঃসীম আকাশে জীবন-অন্বেষণের প্রস্তুতি। এই সব নেশার হুল্লোড় শমিতকে যেন সপাটে মাটিতে আছড়ে ফেলছে।
এপ্রিলমাসের জঙ্গল। গাড়িতে আসতে আসতে দেখেছে শমিত... ঝোপঝাড় শুকিয়ে গিয়ে পাতা ঝরে গিয়ে মাঝে মাঝেই জঙ্গলে অনেকখানি করে খোলা জায়গা। নির্জন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এই পথ অতিক্রম, শমিতের জীবনে প্রথম। প্রতিমুহূর্তে রহস্যের পরতের পর পরত খুলে যাবার অনুভূতি।
মেঠো ধুলোর রাস্তা, অনবরত বাঁক, দু’পাশে নিবিড় গাছপালা। একটা গাছের ডাল থেকে ঝুলতে থাকা বিশাল সাপ, চমকে উঠেছিল। একজোড়া বনবিড়াল গাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। একটা সজারু কাঁটা নামিয়ে রাস্তা পেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। জঙ্গলের মধ্যে এমন গাড়ি, আওয়াজ, ধোঁয়া আশা করে নি বোধহয়।
কোথাও বড় বড় ঘাস, মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে এমন বড়। বড় বড় নাম-না জানা পাতার গাছ, অনেকটা কলাগাছের মত দেখতে। বাঁশগাছের বুনো ঝোপ।
অন্ধকার একটা একলা বাড়ি, আগে বোধহয় গ্রাম ছিল এখানে। ভেঙে পড়া মাটির দেয়াল, খোলা মাথার চাল... কে জানে একদিন এখানে কে বাসা বেঁধেছিল।
মাঝে মাঝেই ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে এসেছে শমিতরা। প্রায় ঘুমন্ত গ্রাম। লোকজন নেই বললেই চলে। নিঃশব্দ নীরব অশরীরী স্বপ্নিল আট-দশ ঘরের গ্রাম। উঠোনের গাঁদা। মাটির দেয়ালে সাদা একটা শঙ্খ কিংবা তীরধনুকের ছবি। ঘুম-ঘুম অনুভূতি। ঘুম-ঘুম কিন্তু টানটান। কেমন একটা উত্তেজনা।
কেমন হঠাত্ করে সামনে এসে পড়েছে ছোট্ট লাল ছিপছিপে একটা নদী। ডুলুং। চারদিকে অনেক সবুজ। গাঢ় সবুজ, হালকা সবুজ, কচি সবুজ, ঘাস সবুজ। এমনকি অপরের মস্ত বড় নীল আকাশেও সবুজের ছায়া। আর তার মধ্যে লাল জলের নদী। অপরূপ বুঝি একেই বলে!
গাঙ্গুলিদার কথাটা ধাক্কা দিল। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি এখন, যেন অনেকদূর থেকে বুনোরা এই সব নজর করে ফেলছে। এই উজ্জ্বল আলো, এই হুল্লোড়... সব দেখে ফেলছে তারা। এই হুল্লোড়, এই পিকনিক, এত আওয়াজ, এত নেশা... মানাচ্ছে না। এক্কেবারে মানাচ্ছে না।
ভেতর থেকে অনুভব করেছে গাঙ্গুলিদার যন্ত্রণা। বেশ কয়েকবার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে জঙ্গলে এসেছে শমিত। এমন করে ভাবায় নি তো আগে। প্রশ্ন এসেছে মনে। জঙ্গলে বেড়ানোর কায়দা নিয়ে প্রশ্ন।
সত্যিই তো। জঙ্গল মানে কি শুধুই খোলা আকাশের তলায় মত্ততা? আদিম পৃথিবীর আদিম মানুষের খোলামেলা জীবন নিয়ে, বৃত্তি নিয়ে, যাপন নিয়ে নাটক নভেল লেখা? জঙ্গলে ডাকবাংলোয় মদের আসর বসিয়ে কবিদের কবিতা পাঠ? মুভিক্যামেরা বায়নাকুলার আইপড ল্যাপটপ। জঙ্গল-ভ্রমণের ছবি।
ডিমসেদ্ধ, চিকেনফ্রাই, পটাটো চিপস, কাজুবাদাম। হুইস্কি রাম ভদকা জিন। হাঁড়িয়া মহুয়া। টইটম্বুর নেশা। নেশার পরিপূরক হিসেবে সরল আদিবাসী মেয়েদের কালো শরীর উপভোগ। আহা, কালোর মতো মাদকতা আর কোথায়!
কেউ কি পশুপাখির চরিত্র, তাদের মুভমেণ্ট জানতে চায়?
বনের মধ্যে শান্ত নদী, ভোররাতে সেখানে জল খেতে আসে সব জন্তু জানোয়ার। কেউ কি শুধু তাদের দেখার জন্যেই জঙ্গলে আসতে চায়?
কেউ কি অরণ্যের রহস্যকে ছুঁতে চায়?
পাহাড়ি পথঘাট, রাতের অচেনা আঁধার, নীল গোল আকাশ, নক্ষত্র। জংলী পোকামাকড়ের কিটকিট শব্দ, ঝিঁঝিঁর শব্দ, দোয়েল-কোকিলের মিষ্টি ডাক, ময়ূরের কর্কশ ডাক, শুকনো পাতার মর্মর, জঙ্গলের মধ্যে থেকে আসা কর্কশ আর্তনাদ।
ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি গাছ। কাছে গেলেই আলগা। সরে গিয়ে গিয়ে জায়গা করে দেয়। কিন্তু কিছুতেই সেই গভীরে পৌঁছনো হয় না। কি যেন একটা না-পাওয়া। মন কেমন করে খুব।
চাইলেই কি ধরা দেয় জঙ্গল? চাইলেই কি বোঝা যাবে অরণ্যের মন?
চাইলেই কি বোঝা যায় জঙ্গলের মানুষের মন? গাছ পাতার মতই সহজ মন?
এই যে টুরি, বছর একুশ বাইশ হবেই ওর বয়স, পরনে মোটা কাপড়ের ছেঁড়া শাড়ি। আর কোনো বসন নেই। মাথার চুল শক্ত করে টেনে বাঁধা। টুরির দিকে তাকাতে গেলেই পেছনের সবুজ পাতায় লাল ফুলের পলাশ গাছটা চোখে পড়বে। চোখের তারাগুলো লালচে বাদামী, ঠিক বুনো কাঠবেড়ালিটার মতো করে তাকাতে শিখেছে টুরি। কিন্তু ওর ওই আপাতগভীর চোখে কেবল তাকানো-ই আছে, দেখা নেই। চকচকে কালো শরীরে সমুদ্রের টান, টুরি জানে। হাসতে হাসতে বলে ‘মরদগুলার অবস্তা’র কথা। কিন্তু টুরির ‘বোধ’ নেই।
সত্যি সত্যি সমুদ্র কেমন, সাগরের ঢেউ নিয়ে শহুরে সভ্য শিক্ষিত মানুষের নেশা কেমন, টুরি বোঝে না। আদিম সরল জঙ্গলটার মতই টুরির জীবন আর বোধও নিস্তরঙ্গ নিশ্চল। এই অরণ্যের মতই টুরিও জানে না, অসীম বনভূমি আর প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্য কাকে বলে।
শুধু টুরি কেন, এখানকার সব মেয়েদের জীবনই একরকম। নিস্তরঙ্গ। নিশ্চল। গায়ে নিমতেল বা করঞ্জতেল। লঙ্কা দিয়ে পান্তাভাত। মাথায় শুকনো কাঠ পাতার বোঝা। পাঁচ দশ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে ক’টা কেঁদপাতা শালপাতা বেচবে। নইলে দশ কিলোমিটার দূরের হাট। ক’টা ডিম বেচতে যাবে, কিংবা একমুঠো লাল সবুজ লঙ্কা, বিলেতি বেগুন। হাট তো রোজ রোজ হয় না, তখন জঙ্গলে ঢুকে বুনো আলু খুঁজে আনতে হয়। বুনো আলু, বুনো শেকড় বাকড়।
ছেলেগুলোর অবস্থাও কম করুণ নয়। ডমনকে নিয়ে জঙ্গলে ঘোরে তো শমিত। কি যে সরল ছেলেটা। এই সবুজ অরণ্য, ভূমিপুত্র ডমন জানেই না, কতখানি ঐশ্বর্যের অধিকার পেয়েছে জন্মসূত্রেই। এই জঙ্গলে লুকিয়ে চুরিয়ে কাঠ কেটে এনে দু’ চার টাকায় বিক্রী করে ভয়ে ভয়ে বাঁচা, কখন পুলিশ এসে ধরে। তাও তো জঙ্গল সাফ হয়ে চলেছে। একের পর এক।
‘গাছ কাটার জন্যে লাইসেন্স লাগে। গবরমেণ্টের নজর এড়িয়ে লাইসেন্স থাক আর না থাক, কত জঙ্গল রোজ সাফ হয়ে যাচ্ছে। রাতের বেলা ট্রাক আসে, আওয়াজ পাও নি? কচি কচি কুসুম নিম, খোকা খোকা শাল করম কচড়া। এমনকি হরতুকি করঞ্জ গাছগুলাও কেটে ফেলছে। আর আদিবাসি দুটা কাঠ কাটলেই চড় থাপ্পড়, জেল হাজত।' সিন্ধু বলেছিল। ডমনের কাকার ছেলে সিন্ধু। রোজ সকাল হলেই ক্ষেতের কাজে লেগে পড়ে।
‘এইটুকু ছেলে, এখন থেকে কাজে লেগেছে, পড়াশোনা করবে না?’ শমিত বলেছিল।
সব ছোট ছেলেমেয়েগুলো একই অবস্থা। কাজকর্ম নেই, সারাদিন মাঠে ঘাটে টো টো ঘোরা, মোষের পিঠ থেকে পিঠে লাফিয়ে খেলা, সাপ ব্যাঙ ধরে ধরে মারা। কাছেপিঠে অবশ্য স্কুল নেই কোনো। বাসরাস্তা থেকে, মানে হাইওয়ে ধরে চোদ্দ-পনেরো কিলোমিটার গেলে সরকারি স্কুল আছে একটা। মিড-ডে মিলের কথা বলে বলে দু’চারজন মাত্র ছেলেকে সেই স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করতে পেরেছে শমিত। তাও বাবা রাজি হয়েছে বলেই ছেলে রোজ স্কুলে যাবে, এমন আশা করলেই ভুল।
এতদিনে শমিত এসব বেশ বুঝেছে। কাজ না করতে চাওয়া, নেশার দাসত্ব, এগুলো কি এদের স্বভাব? নাকি, অভাবের স্বভাব কে জানে।
কাজ করতে চাইলেই বা পাবে কোথায়! ঠা ঠা জলহীন টাঁড় মাটি, গাঁইতি চলে না। পাথর কাটবে কি করে? কোদাল চলে না, চাষ হবে কি করে? ক’টাই বা চাষের জমি গ্রামে? যাদের আছে, তাদেরই বা কি এমন সুখী অবস্থা? সারাদিন ক্ষেতে খাটুনি, পরিবর্তে একবেলা খাওয়া। গরু মোষ চরিয়ে তো আর পেট ভরে না।
লুকিয়ে চুরিয়ে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে দু’চার টাকায় বিক্রী করা। তাও তো জঙ্গল সাফ হয়ে চলেছে একের পর এক। জঙ্গলে নতুন গাছের নতুন আইন হয়েছে। সরকারী ব্যবস্থাতেই তো কত শালগাছ কেটে নিচ্ছে। শালের বদলে সেগুন গাছ লাগানো হচ্ছে।
হা সিংবোঙ্গা! শালের বদলে সেগুন!
ইউক্যালিপ্টাস আর সোনাঝুরি। সোনার গাছ। পাঁচবছরের মধ্যে সাইজ করে কেটে শহরের কাগজকলগুলোয় পাঠানো যায়। জঙ্গল-ব্যবসায়ীদের কাছে এ গাছগুলো ‘সোনার গাছ’। জঙ্গলের মানুষের কাছে এ গাছের কোনোই দাম নেই। এইসব গাছে মৌমাছি বসে না, পাখি বাসা বাঁধে না, পাতাগুলো থেকে ভালো করে জ্বালানিও হয় না। দ্রুত বেড়ে ওঠা ইউক্যালিপ্টাস আর সোনাঝুরি আসলে মরুভূমির গাছ। সামান্য জল পেলেই শুষে নিয়ে বড় হয়ে ওঠে, মাটির সামান্যতম আর্দ্রতাও শুষে নেয় তারা। কাছাকাছি কোনো গাছ বাঁচে না। গাছের পায়ের কাছে ঘাসও জন্মায় না।
শাল পিয়াল মহুয়া হরিতকী বহড়া আমলকি করঞ্জ নিম প্রায় শেষ।
গাছ শুধু তো গাছ নয়, প্রকৃতির সন্তানরা এসব গাছ সঙ্গে নিয়েই বাঁচে। কত কাজে লাগে। খাবার দাবার থেকে পুজোপার্বণ। ঘরের চাল ছাইতে, পোষাক হিসেবে কোমরে বাঁধতে, পাতা পেড়ে খেতে বসতে লাগে। লাগে অসুখ-বিসুখ ওষুধ-পালায়। শালপাতা, শালধুনো, শাল-দাঁতন, শাল-ফুল, শাল-ফল সবই নিত্য প্রয়োজনে লাগে। লাগে কেঁদুপাতা, কেঁদুফুল।
ডমনের কাছে রোজ এসব আক্ষেপের কথা শোনে শমিত। পাথর তোলার কাজটা পেয়ে খুব খুশি ডমন। আজকাল অনেক পাথর চিনতেও পারছে ডমন। আর্কিয়ান গ্রানাইট, আর নিস। ধারওয়ার যুগের মার্বেল আর শিস্ট। মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল থেকে আনা কালেকশনে আছে গণ্ডোয়ানা যুগের পলল আর ব্যাসল্ট। কাজ না থাকলেও এই ঘরে এসে পাথর নিয়ে নিয়ে নাড়াচাড়া করার নেশা হয়েছে ডমনের। গোল গোল গ্রানাইট দেখে ডমনের চোখে অবাক খুশি দেখেছে শমিত।
খুশিও হয়েছে। নেশা লেগেছে চোখে, ঘোর লেগেছে মনে। এবার ডমন সুযোগ্য সঙ্গী হয়ে উঠবে।
মোহনের মতো।
মোহন গোণ্ড। কোকামেটার মুরিয়া ছেলে মোহন। শমিতকে গোল গ্রানাইটের খোঁজ এনে দিয়েছিল মোহন। জগদলপুর থেকে নারানপুরে মাড়াই দেখতে হাজির হয়েছিল শমিত। মধ্যপ্রদেশের ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেণ্টের শশিবাবুর আমন্ত্রণে। শশিবাবুর ছেলে বিকাশ। দেরাদুনে প্রথম বন্ধু বিকাশ। ছেলের কাজের জায়গায় বেড়াতে এসেছিলেন শশিবাবু। শমিতের সঙ্গে আলাপ করে খুশি হয়েছিলেন। ‘সকলের তো এসব নিয়ে আগ্রহ থাকে না। আমার ছেলেকেই দেখুন। আজ পর্যন্ত পৌষকুলাঙ দেখে নি। আপনি আসবেন?’
পৌষমাসের কৃষ্ণপক্ষে পৌষকুলাঙ উৎসব। মাড়িয়াদের উত্সেব। কোকামেটা গ্রামে পঞ্চাশ ঘর মাড়িয়া। সেইখানে আলাপ হয়েছিল মোহনের সঙ্গে। মোহন অবশ্য মাড়িয়া নয়। ও মুরিয়া। মোহনের কাছে শুনে শুনে দণ্ডকারণ্যের আদিবাসীদের চেনা। মাড়িয়া আবুজমাড়িয়া মুরিয়া ভাত্রা পরজা ধুরওয়া ডোরলা গোণ্ড কয়া হালবা গাদাভা শবর। মোহন চিনিয়েছিল দক্ষিণের মহাদেও পর্বত, বিন্ধ্যপর্বতের একদিকের ভানর রেঞ্জ, উত্তরপূর্বের কহেনজুয়া হিলস। জঙ্গল পেরোলেই নর্মদা নদীর নাম যে হিরণ, তা-ও মোহনই বলেছিল প্রথম। তারপর এ নিয়ে পড়াশোনা খোঁজখবর।
সারা ভারতে এমন অসংখ্য আদিবাসী সমাজ। সভ্য শহুরে মানুষ তাদের খোঁজ রাখে না। এই ছোটনাগপুর অঞ্চলেই প্রায় তিরিশটি জনজাতির বাস। সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুণ্ডা, হো, চিরো, খরওয়ার, বাইগা, বিরহোর, ভূমিজ, ভূইঁয়া, গোণ্ড, কারমালি, কিসান, কোরা, কোরবা, বাথুডি, বেদিয়া, মাহালি, বিরঝিয়া, বারাইক, সভর, কোঁওয়ার, খোণ্ড, গোরেইত, খড়িয়া, চিকবারিক, বারাইক, অসুর, লোহারা, পাহাড়িয়া।
সবাই যে বনবাসী, তা নয়। অনেকেই শহরের মানুষ হয়ে গেছে। কিন্তু খর্বকায় কৃষ্ণবর্ণ ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল। সহজেই চিনে ফেলা যায় এদের। যেমন চিনে ফেলা যায় ছোট ছোট পাহাড়, কালচে মাটি, আর ছমছমে জঙ্গল। নি:শব্দ জঙ্গলের মতই এ মানুষগুলো নির্জন, বেশি কথা বলতে ভালোবাসে না। শিমুল, শাল, পিয়াল, করঞ্জ, কুর্চি, চম্পা, চামেলি চেনা অচেনা নানা গাছ তিরিশরকম জনজাতির আশ্রয়। জঙ্গলে নানারকম গন্ধ, বাতাসের শব্দে বাঁশির সুর, নদীর জলে ঢেউয়ের দোলনা, গাছে গাছে পাখিদের শিস। এখানের মানুষদেরও তাই। নানা ভাষা, নানা উত্সব, নানা সংস্কৃতি।
ঘন জঙ্গল যেন কোথাও কোথাও একটু সমতলে নেমে এসে বিশ্রাম নেয়। অন্তত এমনটাই মনে হয় শমিতের। সেখানে ছোট ছোট আদিবাসি গ্রাম। হোগলাপাতার কুঁড়ে, মাটির কুঁড়ে। তকতকে নিকোনো দাওয়া-উঠোন।
পায়ের শব্দে ছুটে পালাবে একটা সজারু। কিংবা খরগোশ। চোখ তুলে তাকালেই পাহাড়ী উপত্যকার পাকদণ্ডী পথ, আর চারদিকে শুধুই সবুজ। তার মধ্যেই কোন অচেনা শিল্পীর তুলির টানে সদ্য ফোটা একটি লাল পলাশকুঁড়ি।
সন্ধেবেলা চারদিকে অসংখ্য আলোর ফুটকি। জোনাকি। সেই জ্যোতিপুঞ্জে অন্ধকারটা আরো গাঢ়, আরো কালো। আর সেই গাঢ় অন্ধকারে অরণ্য এসে ঢুকে পড়বে বুকের মধ্যে। সোঁদা গন্ধ, মনভার করা নির্জনতা, অপার্থিব চাঁদের আলো।
জঙ্গলের নেশায় মন মাতাল। জঙ্গলের গন্ধে মন অবশ।
এই জঙ্গলের গ্রামে থাকতে থাকতে বনমাতাল হয়েছে শমিতও। পনেরো ঘরের গ্রাম। গভীর জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা গাছপালা কেটে ঘর। একটা দায়সারা গোছের কুয়ো। সন্ধে হলেই ঝিঁ ঝিঁ, জোনাকি, ব্যাঙ। আর গা ছমছম অন্ধকার। বুনো পাখি, মেঠো ইঁদুর। বুনো পেঁপে, কুঁদ্রু, ঝিঙে, নেনুয়া। অল্প ধান।
অথচ ডমন না থাকলে এ গ্রামে এসে থাকাই হত না। মুণ্ডাদের সেরা শিকারী ডমন। এই জঙ্গলেই পরিচয়।
শহর থেকে একটা বাবুলোক এসেছে। সারাদিন জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে পাথর তোলে। সত্যিই পাথর তোলে? নাকি অন্য কোনো মতলব আছে? আজকাল কাউকে আর বিশ্বাস নেই। শহরের লোক যখন তখন জঙ্গলে এসে ঢুকছে। দলবল, টিভি ক্যামেরা। ফটোক তুলে নিয়ে যায়, গান টেপ করে নিয়ে যায়। আবার গাড়ি নিয়ে, হাতে মাইক নিয়ে ভোট চাইতেও আসে। নিত্য নতুন ডিজাইনের লোক।
গাড়ি ঢুকছে, বাইক ঢুকছে, জিপ ঢুকছে, বড় বড় ট্রাক ঢুকছে। পুলিশ আর ফরেস্টারের আসা যাওয়া তো আছেই। সবার আলাদা আলাদা মতলব। এ বাবুটা একলা একলা কি মতলবে ঘুরছে কে জানে।
ডমন আর তার সঙ্গীসাথী, দশ বারোজনের একটা বড় দল, তীর ধনুক টাঙ্গি নিয়ে বেশ কয়েকদিন শমিতের পেছন পেছন জঙ্গলে ঘুরেছে। পরে শুনে শমিত বেশ অবাক। খেয়াল করে নি, বুঝতেও পারে নি। জঙ্গলের গাছপাতার সঙ্গে মিশে থাকা গিরগিটি কাঠবেড়ালির মতই এ মানুষগুলোও কখন পিছু নিয়ে থেকেছে কে জানে।
‘হ বাবু, সিটাই তো। পরথমটা লতুন ডিজাইনের লক দেখে আমরাও অন্যরকম ভাবছিলাম। কিন্তু দেখলাম, তু মানুষটা ভালো বটেক। তু আমাদের মত করেই গাছের সঙ্গ সঙ্গ কথা বলিস, জঙ্গলের পাত্থর তুলি তুলি যতন করে মুছে উ ঝোলাটার মধ্যি রাখিস।'
বিশ্বাস করেছে ডমন। রোজ বিকেল হলে বাবু চৌকায় বাসরাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। সকাল থেকে বিকেল, দুবার বাস থামে। মাঝে মাঝে তাও আসে না। তখন ট্রাক থামিয়ে, ভ্যানরিক্সা থামিয়ে যেতে হয়। ডমনরা লক্ষ্য রেখেছে, ফিরে যেতে না পারলে বাবু একা একাই জঙ্গলে থেকে যায়। ভয় ডর নাই। জঙ্গল ভালবাসলে তবেই এমন। বিশ্বাস করেছে সবাই, বাবু ভালো লোক। তারপর বাবুকে সঙ্গে করে গ্রামে এনেছে ডমন।
প্রথমদিন গ্রামে এসে খুব অবাক হয়েছিল শমিত। পেছনের অযোধ্যপাহাড়ে আদিবাসীদের শিকার উত্সব দেখে গেছিল গাঙ্গুলিদার সঙ্গে। দেরাদুন ছেড়ে এখানে আসার পর পরই। বৈশাখের ঠা ঠা রোদে গাছের ছায়ায় অযোধ্যাপাহাড়। মহুয়া হাঁড়িয়া, তীর ধনুক, শিকার করা জানোয়ারের দেহ নিয়ে উল্লাস।
ঠিক পেছনের ঢালুতে এমন একটা গ্রাম আছে! চোখে পড়ে নি তো!
বারো ঘরের গ্রাম ছিল। শমিতের ঘরখানা নিলে তেরো। আর এই কদিন হল, একজন সিস্টার এসেছিলেন। দুটো ঘর তৈরি হয়েছিল। একটায় সিস্টার থাকতেন, আরেকটায় সকাল বিকেল স্কুল। নামেই স্কুল। ধরে ধরে আনতে হয় বাচ্চাদের।
ডমনরা কেউ খুশি ছিল না। ওরা চায় নি, সিস্টার এ গ্রামে থাকুন। টুরি বা গ্রামের অন্য মেয়ে বউরাও চায় নি। তবু সিস্টার এসেছিলেন, লখন ওঁকে গ্রামে এনেছিল। বলেছিল, ‘দু’ চার মাস পরে চলে যাবে সিস্টার। উয়ার একটুখন আশ্রয় চাই।'
লায়াবুড়োর সম্মতি আদায় করেছে লখনই। যদিও গাঁয়ের মেয়ে মরদ কেউ কাছে ঘেঁষে না, ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে সিস্টারের ঘরের দিকে যেতে দেয় না, তবু লখন-বুধু-ভোলা-শামু ছেলেগুলো প্রায়ই সিস্টারের সঙ্গে ঘুরত। আশেপাশের দশ বিশটা গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন সিস্টার।
‘উ জিশুবাবার পূজার জন্যি ঘুরে। আমরা সব বুঝি। আমাদের গাঁয়ে ইসব করতে দিব নাই।' ডমনরা একদিন শমিতের ঘরের দাওয়াতেই সভা করেছিল।
সিস্টার নির্মলার সঙ্গে আলাপ হয়েছে শমিতেরও। জঙ্গলের রাস্তাতে দেখা হয়েছিল একদিন। শমিতই আগ্রহ দেখায় নি। শহরের মানুষের সঙ্গে আলাপে আর উত্সাহ নেই শমিতের। এখানের গাঁয়ের লোকজন মন জুড়ে রয়েছে।
পাহাড়, জঙ্গল, আকাশ আর সিংবোঙ্গা। এই নিয়েই জগত। সমস্ত পরব জঙ্গল নিয়ে। নাচগান, মাদল, ধামসা, কেন্দ্রি, রুতু সব জঙ্গল নিয়ে। করমপুজার জন্যে করমডাল, সরহুলের সময় শালফুল, ঘর ছাইবার জন্যে দু’চারটে কাঠ-পাতা। রান্না করার জন্যে মেয়েরা আনে দু’চারটে কাঠকুটো। রান্নাই বা কি! নুন আর ভুট্টা সেদ্ধ। বুনো আলু, মেটে আলু। খেতি হয় মেটে আলুর। ধান যব বাজরা, আর আলু।
কেউ কেউ তার মধ্যেই ফুটিয়ে তোলে দু’চারটে লাউ, ঝিঙে, নেনুয়া, বেগুন। দশ মাইল দূরের হাটে গিয়ে বেচে আসে মেয়েরা।
ছেলেগুলো হাঁড়িয়া খেয়ে পড়ে থাকে। হাঁড়িয়া খেলে বেশ ঘুম-ঘুম ঝিমুনি, কাজের ইচ্ছে হয় না। সঙ্গে কাঁচা ছোলা, ভিজিয়ে ফুলো ফুলো, নুন লেবু মাখিয়ে অমৃতের স্বাদ। দু’ তিন মাটু হাঁড়িয়া আর ছোলা সিদ্ধ। বেশ পেট ভরে থাকে। এর বেশি দরকার পড়ে না।
মাঝে মাঝে মনে বেশি ফুর্তি হলে চালভাজা, মহুলভাজা আর কালোই। কালোই, শহরের মানুষ যাকে বাদলাপোকা বলে। পরব এলে কুর্কুটের ডিম। কুর্কুট, মানে পিঁপড়ে। কুর্কুটের ডিমের নাকি বড্ড ভালো স্বাদ। কুর্কুটের ডিমের জন্যে জান লড়িয়ে দেয় এ গাঁয়ের আদিবাসি।
হয় আধপেটা, নয় খালি পেট। নাচ গান মেলা নিয়ে বিভোর। ভাল্লা শড়কি টাঙ্গি তীর-ধনুক নিয়ে শিকার খেলা। চাষের জমি নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে, তাতেও টাঁড় মাটি। একটা মাত্র ফসল। কাঁকড়ভরা পাথুরে মাটিতে সামান্য ধান লাগায় বছরে।
আশেপাশে কতগুলো কুর্চিফুল ঝরে পড়ল। তারপর ফুল ঝরার সঙ্গেই সুর মিলিয়ে ঝিরঝিরে একটু বৃষ্টি। নাহ, আজ আর কাজ হবে না। এবার ফিরলেই হয়। তেঁতুলগাছের নুয়ে পড়া একটা ভেজা ডাল গায়ে এসে পড়ল। হঠাত্ হাওয়ার ঢেউ এসেছে।
একটু চমকেই উঠেছিল শমিত। তারপর হেসে ফেলল। গাছের ডাল ধরে একটা সাপ নেমে এলেও কিচ্ছু করার নেই। এমন অন্যমনস্ক থাকলে জঙ্গলে চলে না। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল।
মুসাদের কুঁড়ের একদিকের দেওয়াল জুড়ে কিরাত-কিরাতী, ধনুর্ধর অর্জুন। একটা শঙ্খের ছবিও আছে। মুসার মা, লক্ষণের বউ মঞ্জু এঁকেছে। আরেকদিকের দেওয়াল জুড়ে শুয়োরের ছবি। একটা লাঙল, দুটো গরুর গাড়ির চাকা। লক্ষণের বুড়ো ঠাকুরদার আঁকা। শিল্পী মানুষ, ছৌনাচের দল ছিল নাকি ওঁর। এখন চোখে দৃষ্টি নেই, ঘরবন্দী জীবন। সামনেই দিগুদের মুরগী ছাগল খেলে বেড়াচ্ছে। কিসনার বুড়ো বাবা পোষা শুয়োরগুলোকে ধরে ধরে উঠোনে রাখছে। শমিতকে দেখে চওড়া করে হাসল,‘মনে লাগছে আজ অনেক পাত্থর কুড়াইছিস।'
হাসল শমিতও। তারপর ডমনকে একটা হাঁক দিয়ে নিজের একটেরে ঘরের দিকে পা বাড়াল।
পাহাড়ের উল্টোদিকে মাঝিপাড়া। আর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তিনটে বাঁশবন পেরোলেই নামোপাড়া। মাঝিপাড়ার ছেলেমেয়েগুলো যে কোনো পরবের জন্যে হাঁ করে বসে থাকে। শিকারপরবের দিন হৈ হৈ করে নেমে এসেছিল টুরিদের গাঁয়ে। এ গাঁয়ের সাবির বিয়ে হয়েছে যে ওদের গাঁয়ে।
ছেলে হতে এসে সাবি আর ফিরে যায় নি।
সাবির বর, যুগল মাঝি সদরে আদালতে কাজ করে। সরকারি চাকরি, যখন তখন ছুটি নিয়ে গাঁয়ে আসতে পারে না। এমনকি ব্যাটার মুখ দেখতেও আসতে পারে নি। সরহুলের সময় এসে সাবিকে নিয়ে যাবে। ততদিনে সাবির ছানাটা পৌষের শীতের ঠাণ্ডাটা কাটিয়ে একটু মজবুত হয়ে যাবে।
আসলে সেসব কিছু নয়। টুরি জানে। সাবির আসলে শ্বশুরঘরটা পছন্দ নয়। যুগল মাঝি গাঁয়ে থাকে না, সাবির শ্বশুর এখনো সোমত্ত বুড়ো। তবু অসুখ আর সংসারের কাজের ছুতোয় সাবিকে সদরে স্বামীর ঘরে যেতে দেয় না। বাপের ঘর আসতে দেয় না। সাবিকে অনেক সইতে হয়। ছানা হতে এসে বেশ অনেকদিন এ গাঁয়ে কাটিয়ে যেতে চায় সাবি। মাঝিপাড়ার কেউ এতদিন সাবির খোঁজ নিতে আসে নি। শিকারপরবের দিন সব এসে পড়ল।
তিন চারটে বিটিছেল্যা। পরনে রঙিন বসন। হি হি করে হাসে কেবল। নীল শাড়ি, লাল জরির ব্লাউজ। সরমালি। সাবির ননদ হয় সম্পর্কে। ‘পিঠা বানাতে উস্তাদ বটে।’ সরমালির কথা আগেই শুনেছে টুরি। বিহা বসে নি। রতন মাঝির সঙ্গে সরহুলের সময় খুব নাকি নাচে প্রতি বছর। রতনমাঝির বউ আছে, ছানাপোনা আছে। তবু যে সরমালি কেন এমন করে!
বাকি মেয়েগুলোও সরমালির মতই হি হি করে হাসে। এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে হাসে। মেয়েগুলো বলেছিল টুরিদের। এই মেলাটার কথা।
‘নামোপাড়া ছাড়িয়ে বাসরাস্তায় উঠতে হবেক। ডর লাগলে যাস নাই’, বুকে ধামসা, ঠোঁটে বাঁশি ছেলেটা বলেছিল।
‘উ ছেল্যাটা ছো দলে নাচে। গবরমেণ্ট থেকে ছো দল করেছে যে, সেই দলে নাচে। মোদের গাঁয়ে মস্ত নাম উয়ার।' সাবি বলেছিল। সেইসঙ্গে ফিসফিস করে বলে দিয়েছিল, ‘উয়ার রকম সকম ভালো না রে টুরি। দমে লিশা করে। আদাড়ে বাদাড়ে পড়ে থাকে।'
ডমনের কাছে আবদার করেছিল টুরি। মেলায় নিয়ে যাবার জন্যে। ডমন রাজি হয় নি। নামোপাড়ায় গাদিন ডাইনি থাকে, কোমরে ঝাঁটা, উল্টো হয়ে নাচে। বীরু স্বচক্ষে দেখেছে। ডমন নামোপাড়ার দিকে যাবেই না।
এমনিও গ্রামের মধ্যে ডাইনি নীলমনি এসে আছে। যদিও নীলমনির মধ্যে এখনো ‘ডান’ হবার সব লক্ষণ ফুটে ওঠে নি। তবু আকন্দ ঝোপ পেরিয়ে নীলমনির ঘরের দিকেই টুরিকে যেতে দেয় না ডমন। বিটিছানা যেন কোনদিন নীলমনি ডানের চোখে না পড়ে, পইপই করে বলে দিয়েছে। মেয়েটা নেহাত ছোট, তবু খেলতে খেলতেও যেন ওদিকপানে না যায়। এপাড়ার সব বউ মেয়েরা অবশ্য সে নিয়ে তক্কে তক্কে থাকে। যতই পবন জোর করে নীলমনিকে থাকতে দিক, এ গাঁয়ের কেউ ভুলবে না।
অবশ্য একজন এ নিয়ম মানে নি। সিস্টার। সিস্টারের ইস্কুলে সকাল বিকেল গিয়ে বসে থাকে নীলমনি। দিগুর মা স্পষ্ট দেখেছে, সিস্টার নীলমনির সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করত। মদনের নাতিটা, ওই পবনেরই ব্যাটা তখন রোজ ইস্কুলে যাচ্ছিল। একদিন দেখেছে, সিস্টার নীলমনিকে চানাচুর খাওয়াচ্ছিল। যতই লখন পবন জোর করুক, পবনের বউ আর ব্যাটাকে স্কুলে যেতে দেয় নি। ডাইনিকে ভয় করে না, এমন কেউ শুনেছে!
তবে সিস্টার তো আর গাঁয়ের লোক নয়! বেশিদিন গাঁয়ে থাকেও নি। এই এদিকের জঙ্গল পেরিয়ে বাসরাস্তা পার হলেই যে বেড়াপোতা গ্রাম, ওই গ্রামেই তো ছিল সিস্টার। ওখানে একটা জিশুবাবার মন্দির হয়েছে। লাল লাল টালি দিয়ে কেমন চমত্কার মন্দির। দাড়িবাবা একজন সাদা আলখাল্লা পরনে পাহান আছে। তাকে সবাই ফাদার বলে ডাকে।
তারপর সিস্টার এ গাঁয়ে এসেছে। লখন নিয়ে এসেছে। সবাই বলছে, এ গাঁয়েও একটা জিশুবাবার মন্দির বানাবে সিস্টার।
কে জানে, কি হবে। তবে সিস্টার আসার পর থেকে গাঁয়ে লোকজন আসা বেড়ে গেছিল। লায়াবুড়ো সবাইকে সাবধান করে দিয়েছে। কে জানে, কার মনে কি আছে। শহরের লোকগুলা তো ভালো নয়।
আগে তো পাত্থরবাবু ছাড়া বাইরের কেউ ছিল না। তবে ও বাবুটা টুরিদের ঘরের লোক হয়ে গেছে। এমনিও বাবু নিজের মনে থাকে, পাত্থর কুড়িয়ে কুড়িয়ে জমা করে। আর মাঝে মাঝেই একা একা জঙ্গলে গিয়ে বসে থাকে। আজকাল পাত্থর কুড়িয়ে ডমন কত রোজগার করছে। দিকু, শম্ভু, পুরন সব ছেলেগুলো প্রায়ই বাবুর সঙ্গ সঙ্গ ঘোরে। বাবুকে কেউ বাইরের লোক মনে করে না আর।
মাঝিপাড়ার সব বিটিছেল্যা হাঁড়িয়া মহুল নিয়ে মেলায় যাবে। সাবি বলল, ‘যাবি টুরি? জামাইদাদা তো শহরের বাবুর সঙ্গ সঙ্গ জঙ্গল চলি গেছে, জানতি পারবেক নাই। যাবি?’
জামাইদাদা। ডমন। সাবি তো টুরির দূর সম্পর্কের খুড়ার বিটি। তাই। বাবুর সঙ্গে পাথর কুড়োতে গেছে ডমন। ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে।
ডমনকে লুকিয়ে যেতে ইচ্ছে নেই টুরির। বাবুকে বলেছিল ডমন যাতে মেলায় নিয়ে যায়। বাবু হেসেছে কেবল। এ বাবুটাও ডমনেরই মতন। নিজের কাজ ছাড়া কোনদিকে মন নাই। মেলায় যেতেও ইচ্ছা নাই। শিকারপরব সরহুল সেন্দ্রা... সব পরবে যার এত উত্সাহ, সে মেলায় যেতে চায় না কেন কে জানে। এ গাঁয়ের ছেল্যাগুলার মতই হয়ে গেছে বাবু। কুনো হট্টগোলের মজায় উত্সাহ নাই।
অথচ মাঝিপাড়ার ছেল্যাগুলাকে দ্যাখো। নামোপাড়ার ছেল্যাগুলাকে দ্যাখো। বিনধা পরবের দিন কাঁড়া বলি থেকে মেলায় লিশা করে নাচ, সব রকম কাজে ওস্তাদ। ফুলমতি বলল, ‘চল না টুরি। মদনাও তো আমাকে যেতে দিচ্ছে না। সাবির শ্বশুরগাঁয়ের বিটিগুলার সঙ্গ সঙ্গ ঘুরে আসি।'
সাবি আর ফুলমতিকে নিয়ে মেলায় যাবে টুরি। ডমনকে নিয়ে শহরের বাবু জঙ্গলে চলে গেছে অনেকক্ষণ। গাঁয়ের ছেল্যাগুলা সবাই নিজের নিজের কাজ কামে চলে গেল।
এ মন্দিরে আগে মানুষ বলি হত। এখন পাঁঠা বলি হয়। কাঁড়া বলি হয়। বলির জন্যে চার পাঁচটা হাঁড়িকাঠ। তাতে সিঁদুর বেলপাতা। জানোয়ারগুলার মাথায় সিঁদুর। টুকটুক করে পাঁঠাগুলার মাথা নামবে, আর ফিনকি দিয়ে রক্ত। সেই দেখে হাততালি দিয়ে হাসবে ইচাবনী তিলাইঘাট মাঝিপাড়া আসনবনী ধিকুলডিহ থেকে আসা দলে দলে লোকজন। ‘হেই গ বাবারা, রঙ্কণমা পূজা নিলেন।'
কাঁড়া বলি আরো মজার। বড় মোষটার গলায় দু’ তিনজন সা-জোয়ান লোক ডালডা দিয়ে দলাই মলাই করবে। ততক্ষণে মোষের কষে গ্যাঁজলা। দম দমা দুম দমা দম। জোরে জোরে ধামসা বাজবে। দমা দম নাকাড়া। দূর থেকে চার পাঁচজন লোক তীর ধনুক নিয়ে টুক টুক করে তীর ছুঁড়ে মোষের দাপাদাপি বাড়িয়ে দেবে। সেই দেখে ভিড়ের হাসির হুল্লোড়। তুমুল উত্তেজনা, ‘সাবাস! দারুণ বিঁধল বটে !’
তারপর টাঙ্গি দিয়ে কাঁড়ার মোলায়েম গলায় টুক করে এক কোপে মাথা নামিয়ে দেওয়া।
‘হেই মা রঙ্কন, আমাদের শালবন ধানক্ষেত বাঁচিয়ে রাখো।'
বিনধার পর এক এক বছর এক এক গাঁয়ের মানুষ কাঁড়ার মাথা নেবে। গতবার যেমন খরসোয়ানের নাচনিরা নিয়েছিল। এক বছর আগে থেকেই ঠিক হয়ে থাকে সব। মাঝিপাড়ার লোক কাঁড়ার ধড় খানিকটা নেবেই। তারপর রাতের বেলায় কাঁড়ার মাংস আর ভাতের সঙ্গে লিশা জমবে। রাতভর নাচ। মাদলের বোল। টুরিরা চাইলে সেসব আনন্দ করে ফিরতে পারে। মাঝিপাড়ায় নেমন্তন্ন দিয়েই রেখেছে।
তবে আজ দেরি করবে না টুরিরা। মেলা দেখেই ফিরে আসবে। গাঁয়ের মরদরা ঘরে ফেরার আগেই।