কথায় বলে হাসির মার বড় মার। হাসি মস্করা, রঙ্গ রসিকতা, ব্যঙ্গকৌতুক এ সব কিছু লোক হাসানোর একটা নিরীহ পন্থা নয়। বিশেষ বিশেষ সামাজিক পরিস্থিতিতে এই আপাত-নিরীহ হাস্যকৌতুক কোনও কোনও মানুষের কাছে একটা প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হয়ে ওঠে। উনিশ শতকে কলকাতার বাঙালি নাগরিকদের কাছে হাসি ছিল এমন একটা 'মার' এর হাতিয়ার। 'Sociology of humour' নিয়ে যাঁরা পড়াশুনো করেছেন তাঁদের অনেকে বলেন ব্যঙ্গকৌতুক আসলে দুর্বলের অস্ত্র। ক্ষমতাবান শত্রুকে কথার মারপ্যাঁচে বশীভূত করা, চারপাশের পরিবেশে অস্বস্তিকর অবস্থায় মোকাবিলা করতে গিয়ে হাসিঠাট্টা আর ব্যঙ্গ বিদ্রুপে নিজেকে সপ্রমাণ করা — এসব কমিকের উৎস। এ রঙ্গময় বঙ্গদেশে উনিশ শতকে সঙের মিছিলে এবং সঙের গানে রস পরিহাস ও কৌতুকে সমাজের অসঙ্গতিকে তুলে ধরা ছিল মুখ্য কথা। হাওড়ার কাসুন্দিয়া থেকে উনিশ শতকে যে সঙ বের হত তারা ছড়া কাটত এই বলে —
সংসারেতে সাজার ওপর সাজেন যিনি যেথা,
তারি ছবি দেখাই সবে সহজ ভাষায় সোজা।
সমাজনীতি, ধর্মনীতি, শিক্ষানীতি আদি,
বলতে গিয়ে কারো প্রাণে ব্যথা দিই যদি।
ক্ষমা করবেন, সবার কাছে এই মোদের মিনতি
সত্যের ভাষণ, সত্যের গানই মোদের সঙ-এর নীতি।
এর উপর আবার প্রশ্ন উঠতে পারে সঙ তাহলে কি? বিভিন্ন পেশার নানা ধরনের মানুষের পোশাক পরে অঙ্গভঙ্গি সহযোগে গান, ছড়া কাটা এসব কিছু দিয়ে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের পরিহাস-উজ্জ্বল অনুকরণ হতে পারে সঙ। রাশিয়ান নাট্যকার হেরাসিম লেবেডফ্ যে দুখানি নাটক এদেশে অভিনয় করেন তার মধ্যে কাল্পনিক সঙ্বদল প্রকৃতপক্ষে সঙবদল বা পরিচ্ছদের পরিবর্তন অর্থাৎ ছদ্ম বেশ ধারণ। উৎসবে, পূজাপার্বণে এ দেশে সঙ বের করার প্রথা বহুদিনের। 'হুতোম প্যাঁচার নক্শা'য় নানা কিসিমের সঙ এর বর্ণনা আছে —মাটির পুতুল আর জ্যান্ত সাজা সঙ থাকতো ঘেরা কাটরায় আর দরদালানে। নানা সঙের মধ্যে 'বকা ধার্মিক' বলে জ্যান্ত সঙের ধরনটি হুতোমের পছন্দসই হয়েছিল — 'বকা ধার্মিকের শরীরটি মুচির কুকুরের মতো নাদুর — ভুঁড়িটি বিলাতি কুমড়োর মত - গলায় মালা .... চুলে ও গোঁপে কলপ দেওয়া ... গত বৎসর আশী পেরিয়েছেন ... কিন্তু প্রাণ হামাগুড়ি দিচ্ছে।' পাতার পর পাতা জুড়ে নানা বিচিত্র সঙের ফিরিস্তি দিয়েছেন হুতোম অর্থাৎ কালীপ্রসন্ন সিংহ। হুতোমের লেখা পড়লে মনে হয় সেকালের কলকাতার সংস্কৃতি যেন সঙের রঙ ঢং-এ মেতে উঠেছে।
চৈত্র সংক্রান্তির দিনে সেকেলে কলকাতায় গাজনের দলের পথে পথে ঢাক ও কাঁসি বাজিয়ে ঘোরা এবং সঙ বার হওয়া ছিল স্বাভাবিক। তাদের শব্দভাণ্ডারে শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত একশ ভাগ শব্দ ছিল না। তাই তথাকথিত ভদ্র রুচির মানুষ তাদের অশ্লীল আখ্যা দিল। অষ্টাদশ শতকে চড়ক উপলক্ষ্যে সন্ন্যাসী এবং সঙের মিছিলের একটা ছবি এঁকেছেন বিদেশী চিত্রকর স্যার চার্লস ডগলাস। ১৯২৬ সালে কলকাতার মিউনিসিপ্যাল গেজেটে তা ছাপা হয়েছে। যাত্রার আসরেতেও সঙের নাচগানের ব্যবস্থা থাকত। কবি ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছেলেবেলায় নিজে সঙ সেজে অভিনয় করতেন। জনপ্রিয়তার খাতিরে বাংলা শব্দভাণ্ডারে সঙ শব্দটি ঢুকে পড়েছে অনেকদিন। হাওড়ার শিবপুর, খুরুট, মেদিনীপুর, ঢাকা, হাওড়ার রাধাপুর, শ্রীরামপুর, কলকাতায় তালতলা, বেনেপুকুর, খিদিরপুর, কাঁশারীপাড়া আর জেলেপাড়া — এসব নানা জায়গা থেকে সঙ বের হত। জেলেপাড়ার সঙ ছিল খুব বিখ্যাত। কাঁসারী পাড়ার সঙের উৎসাহদাতা ছিলেন প্রখ্যাত ধনী তারকনাথ প্রামাণিক আর হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক কৃষ্ণদাস পাল। কাঁসারীপাড়ায় কাট্রাগাড়িতে সঙ ঘুরত। বাড়ির বারান্দায়, ছাদে ও জানালায় আবালবৃদ্ধবনিতা সঙের শোভাযাত্রা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। সে-সব দিনে কলকাতা হয়ে উঠত মিলন মেলার নামান্তর। গৃহস্থঘরে অতিথির জন্য তৈরি হত শরবত। থাকত পান তামাকের ব্যবস্থা। দর্শকের জন্য পথের উপর সামিয়ানা টাঙানো হত। নাট্যকার অভিনেতা রসরাজ অমৃতলাল বসু জেলেপাড়ার সঙের দলের জন্য গান রচনা করতেন। অমৃতলাল বসু মারা যাওয়ার পরে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে রচনা হয়েছিল সঙের গান —
এ বছরে কপাল পোড়াসঙের মিছিল বার করত জেলে, কাঁসারী, মুচি, শ্রমজীবী মানুষের দল। ভোরবেলা শুরু হয়ে সায়াহ্নে শেষ হত শোভাযাত্রা। সে শোভাযাত্রায় থাকত মিলিটারি ব্যাণ্ডের নকল, দ্রাবিড় ব্রাহ্মণের দল, ধোবার কাপড় কাচা, ঘানিতে সর্ষের ঘুরপাক, মোসাহেব সর্বস্ব বাবুদের নানা ভড়ং, কৃষ্ণ আর গোয়ালিনীদের প্রেম। ভণ্ড সাধু ভক্তদের কাঁধে চেপে মন্ত্র জপে আর ইতিউতি চায়। সামাজিক প্রথা রীতিনীতি এসব নিয়ে ব্যঙ্গ হত সঙের গানে। কখনও নব্য আইনে বিয়ের প্রথা নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক শ্লেষ — সে মিছিলে বর প্যান্টালুন আর চাপকান পরা। হিন্দুস্থান নর্তকীর সাজে বুট পরা বউ এর হাতে ধরা মস্ত বড় বই। পুরোহিতের সামনে বর ঘোষণা করে সে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, জৈন, বৌদ্ধ কিছুই নয় কন্যাও তা শপথ নেয়। তারপর 'আমেন' উচ্চারণে বিবাহ শেষ।
ভেঙে গেল রসের ঘড়া
তাই তো এবার সঙের ছড়া
হয়নি তেমন মিঠে কড়া।
ইংরেজ সরকার সঙের মিছিল, গান ও ছড়া রাজনৈতিক আন্দোলনমূলক বলে সন্দেহের চোখে দেখত। সঙের দলের সমালোচনার কুঠার ইংরেজ প্রশাসকদের চাটুকারদের বিরুদ্ধে সদাই ছিল উদ্যত। এদেরকে বিদ্রুপ করে গান বাঁধা হয়েছিল —
ডাণ্ডা ধরে গাধা পিটলে
ঘোড়া কভু হয় না
ধরে যখন কান মলা দেয়
তখন বাঁকা থাকতে পারে না।
তথাকথিত ইঙ্গবঙ্গ যুবককে নিয়ে লেখা সঙের গান —
এখন ছেলেরা এক নতুন টাইপসঙের দল হাস্যকর অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে ছড়া বলতে শুরু করলে জনতার মধ্যে হাসির রোল উঠত। হাসির, হাসানোর নানা রঙ ঢং দেখিয়ে সঙ ছড়া কাটত —
চোদ্দ না পেরতে পাকা রাইপ
মুখে আগুন ঢুকিয়ে পাইপ
একমাত্র life ধারণ wife এর চরণ কর্ত্তে ধ্যান
এরা নতুন অর্থ করেন গীতার
ভুল ধরেন পরম পিতার
নৈলে কি তার trial বিনা in হয়।
হাসি হাসব না তো কিজমাদার ছিল খিদিরপুরের সঙের মুখ্য বিষয়। জমাদার এখানে সমাজের জঞ্জাল দূর করার প্রতীক। এদের লক্ষ্যভেদ ছিল অভ্রান্ত। সেকালে থিয়েটারে অভিনয়ে সঙ সেজে দর্শকদের মনোরঞ্জন করা হত। গোয়েন্দা বিভাগ সে সময়ে দুটো যাত্রার কথা উল্লেখ করেছিল 'মহিষাসুর বধ' এবং 'মরুৎযজ্ঞ'। এদের রাষ্ট্রদ্রোহী সঙের অভিনয় পুলিশের নজরে এসেছিল। সঙের গানে আছে রাষ্ট্র চালানোর চিরন্তন গাথা —
হাসির বায়না নিয়েছি
হাসি ষোল টাকা মণ
হাসি মাঝারি রকম
হাসি বিবিয়ানা জানে
হাসি গুড়ুক তামাক টানে
হাসি প্যরা গুড়ের সেরা
হাসি হুজুর করে জেরা।
রাজ্য রথের চারটি চাকাক্যাথরিন মেয়োর 'মাদার ইণ্ডিয়া' বইটিতে ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী পত্রিকার মতোই যোগ্য কড়া সমালোচনা করেছিল জেলেপাড়ার সঙের ছড়া —
সেপাই পুলিশ মন্ত্রী টাকা
টাকার চাকা হলে ফাঁকা
রথখানিকে চলতি রাখা
চলে না আর কোনমতে।
সাগর পারের নাগর ধরাবাংলার জাতীয়তাবাদী ভাবধারা - যা মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে প্রথমে বিকশিত হয়েছিল — জেলে পাড়ার সঙ তাকে এড়িয়ে যায় নি। 'বঙ্গবাণী' পত্রিকা ১৪ই এপ্রিল ১৯৩০ সংখ্যায় লিখেছিল — 'জেলেপাড়ার সঙ সম্প্রদায় জাতীয় ভাবের প্রচারের প্রচেষ্টা করিয়াছেন দেখিয়া সকলেই যারপরনাই সুখী হইয়াছেন।' সেই জাতীয়তাবাদী অভিব্যক্তিই প্রকাশিত হয়েছিল স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের তিরোধানের পর জেলেপাড়ার সঙের গানে —
স্বেচ্ছাচারিণী
তারাই হল ভারত নারীর
কেচ্ছাকারিণী
হায়! হায়! আশুতোষের পুজোয় বসেএই সঙের দলে ছড়া লিখতেন দাদাঠাকুর অর্থাৎ নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত। হার্ড ব্রাদার্স আর কুক কোম্পানীর মহিষে টানা ট্রাক গাড়িতে চাঁদোয়া আর ঝালর ঝুলিয়ে এদের সঙ বের হত। সঙের দল খালি পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচতে নাচতে এগিয়ে যেত রোদতপ্ত পথে। তীর্থস্থানে লম্পট ও নেশাখোরদের উপদ্রব বাড়তে দেখে জেলেপাড়ার সঙ তীব্র কশাঘাত করতে ছাড়েনি। তাদের গানে ছিল—
দেখি আশু নাইকো দেশে ....
বাংলার সেই শশাঙ্কে করলি রাহু গ্রাস
অসুরের দর্পচুর
আশুতোষ যে মহাসুর
তেজে মর্ত্যের ভবানীপুর
কৈলাসে ভবানীপুরে করছেন এখন বাস
দেবতারা সব নিদ্রাগতআবার ১৯১৭ খ্রীঃ চৈত্র সংক্রান্তির দিন জেলে পাড়ার সঙের দল গেয়েছিল একটি বিশেষ গান — 'বিদ্যার মন্দিরে সিঁদ' — কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন চুরির ঘটনা নিয়ে লেখা। এদেশে সঙের দল বিভিন্ন সম্প্রদায়কে সম্প্রীতির বাঁধনে বাঁধতে চেয়েছে বারবার। হিন্দু মুসলমান ফেরিওয়ালা বা দোকানদার, গাড়ির চালক বা মুসলিম কোচোয়ান, গায়ক ও বাদকের দল সামিল হত সঙের শোভাযাত্রায়। খিদিরপুর মনসাতলার সঙের মিছিলে স্থানীয় মুসলমানরা যোগ দিতেন। এদের একটি বিখ্যাত ছড়া ছিল—
নৈলে মানুষের কি সাহস এত
Garden Party চলছে কত
কালীঘাটের পীঠস্থানে।
বছরের শেষে গাও ভাই হেসে হেসেহয়তো এসব গানের কাব্যমূল্য বেশি নয় কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে এভাবে সাধারণ মানুষ যে রাস্তায় না নেমে প্রতিবাদ করেছে তা সবচেয়ে বড় কথা, তবে কিছু স্বার্থান্ধ মানুষের চেষ্টায় তা সবসময়ে সার্থক হয়ে ওঠেনি।
স্বরাজের গান হয়ে এক প্রাণ
গোলামী আর সহে না
লোকশিল্পীদের সামাজিক অবস্থান বিংশ শতকের সূচনায় পরিবর্তিত হচ্ছিল ক্রমশঃ। যুগের চাহিদা অনুযায়ী তাদের শিল্পে নানা উপাদানের অন্তর্গত হওয়া ছিল অবধারিত ব্যাপার। ১৮২৫ সালে ৫ই ফেব্রুয়ারী 'সমাচার দর্পণ' থেকে জানা যায় যে সে বছর সরস্বতী পূজার প্রতিমা বিসর্জনের দিন শোভাযাত্রায় সঙের মূল বক্তব্যটি ছিল অন্যায়কারী, ক্ষমতাবানের ঔদ্ধত্য দেখানোর বিরুদ্ধে সাধারণের প্রতিবাদ। এমনকি এই পত্রিকার খবর অনুযায়ী সঙের আয়োজককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতে তুললে বিচারকর্তা তাকে বলেন যে তুমি তোমার দেবতার সামনে এ প্রকার কদর্য সঙ করেছ তা অতি মন্দ কর্ম। 'বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন', 'ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে', 'খ্যাঁদা পুত্রের নাম পদ্মলোচন', 'মদ খাওয়া বড়ো দায় জাত থাকার কি উপায়' সঙ যাত্রার এসব নাম শুনলে বোঝা যায় বিদ্রুপের লক্ষ্যবস্তু ছিল কে বা কারা।
অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে — দুর্ভিক্ষ, মহামারী, কৃষক বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ — কোলাহল মুখর নানা বিতর্কে সে সময়ে মুখর ছিল বাঙালি সমাজ। ভদ্রসমাজের নব অর্জিত গোঁড়া রুচিবোধ সঙের গানে অমার্জিত টীকা টিপ্পনী মেনে নিতে পারেনি বলে শিক্ষিত শ্রেণীর সম্পাদিত কাগজপত্রে তা বন্ধ করে দেবার দাবি উঠেছিল। এই সোচ্চার সংস্কৃতির জঙ্গী অভিব্যক্তি ছিল সঙ। অসহিষ্ণু অভিজাতবর্গ ইংরেজ শাসকদের ছত্রছায়ায় আইনের আশ্রয় নিয়ে সাধারণের বিনোদনের রাস্তাগুলি বন্ধ করে কৃত্রিমভাবে মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করলেন। কলকাতার রাস্তাঘাট থেকে ইতর শ্রেণীর এই সব উৎপাত তুলে দেবার সংকল্পে ১৮৭৩ খ্রীঃ ২০শে সেপ্টেম্বর টাউন হলে ভদ্রজন সমবেত হয়ে Society for the suppression of Public obscenity প্রতিষ্ঠা করে। এদের উদ্দেশ্য জনমানসের শুদ্ধতা রক্ষা করে পিনাল কোড এবং প্রিন্টিং অ্যাক্ট এর প্রয়োগে সরকারকে সাহায্য এবং দেশের নবসৃষ্ট সাহিত্যকে দূষিত করা যাবে না এই সংকল্প ঘোষণা করা। এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে য়ুরোপীয় যুগের ভিক্টোরীয় রুচির প্রভাব। 'নব্যভারত পত্রিকা' লিখেছে যে — 'কাঁসারীপাড়ার বাবু তারকনাথ প্রামাণিকের উৎসাহে কাঁসারীরা মহা উৎসাহে সঙের মিছিল বার করত। সেই সময় মহাত্মা বাবু কেশবচন্দ্র সেনের যত্নে কলিকাতার অনেকগুলি কৃতবিদ্য লোক ও খ্রীষ্টান পাদরী একটি অশ্লীলতা নিবারণী সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভার অনুরোধে গভর্ণমেন্ট প্রকাশ্যপথে অশ্লীল সঙ্গীতাদি নিবারণোদ্দেশে দণ্ডবিধির প্রচার করায় ঐ মিছিল বন্ধ হইয়া যায়।' 'নব্য ভারত পত্রিকা' আরো জানিয়েছে যে 'অমৃতবাজার পত্রিকা'র মতো সংবাদপত্র ঐ মিছিলকে বিদ্রুপ করতে ছাড়েননি। কাঁসারীপাড়ার সঙের মিছিল বন্ধ করার চেষ্টা করেন হগ্ সাহেব। সেদিন সঙের দল গান বেঁধেছিল —
শহরে এক নূতন হুজুগআবার ১৮৭৪ সালে কাঁসারী পাড়ার সঙদের বিরুদ্ধে যে অভিযান তাকে বলা যেতে পারে উনিশ শতকের বাংলা সংস্কৃতি জগতে দুই ভিন্নধর্মী ধারার সংঘাতের এক চরম অভিব্যক্তি। একদিকে অভিজাতদের শিল্পসাহিত্য অন্যদিকে নিম্নবর্গের গান বাজনা এই দুটি ধারা গত শতকে বিচিত্র গতিতে চলেছে। এক ধরনের অস্বস্তিকর সহাবস্থানে দুইপক্ষ নিজের পথ খুঁজে ফিরেছে বারবার। বিলীয়মান মোগল সাম্রাজ্যের দরবারী নাচগান, ধ্রুপদী সংগীত, লোকসংস্কৃতি আর নবাগত পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মধ্যে একটানা অসম টানাপোড়েন চলেছিল। নতুন শিক্ষিত ভদ্র সম্প্রদায় পাশ্চাত্যের প্রভাবজনিত নিজস্ব সাংস্কৃতিক রুচিতে টইটুম্বুর হয়ে রইলেন। অসহিষ্ণু অভিজাতবর্গ ইংরেজ শাসকদের ছত্রছায়ায় আইনের অস্ত্রে তথাকথিত ইতর শ্রেণীর বিনোদনের পথ রোধ করেছিলেন। সেকালে 'বসন্তক' পত্রিকা প্রশ্ন করেছিল — 'এখানে সামান্য লোকের আমোদ আহ্লাদ ও উৎসব তো সকলি একে একে শেষ হইতেছে। এখানে যাত্রা নাই, পাঁচালী নাই, কবির তো কথাই নাই। সামান্য লোকেরা কি লইয়া থাকিবেক?' 'সামান্য লোকেরা' বুঝেছিলেন যে সমাজের সমস্যাটা কোথায় - তাই তারা গান গেয়েছেন ভদ্রলোকের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে—
উঠেছে রে ভাই
অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই।
বৎসরান্তে একটি দিন
কাঁসারীরা যত
নেচেকুঁদে বেড়ায় সুখে
দেখে লোকে কত।
যদি ইহা এত মন্দ
মনে ভেবে থাকো,
নিজের মাগ্কে চাবি দিয়ে
বন্ধ করে রাখ।
সস্তা দরে মস্ত নাম(বসন্তক, ২য় পর্ব, ১০ সংখ্যা, ১৮৭৪)
কিনতে যত লোক
এই সুযোগে তাদের
সবার ফুটে গেল চোখ
গরিবের মাথায় কাঁঠাল
ভেঙে এরা ভাই
ইংরেজদের কাছে কেমন
দেখাচ্ছে বড়াই।
'এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই' — নৈরাজ্যের এই অবস্থায় নিজস্ব ভঙ্গিতে, হাসি হুল্লোড়ে সঙের মতো লৌকিক সংস্কৃতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন গরীবগুর্বোর দল। হাসির উপলক্ষ্য নির্বাচনে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। রক্ষণশীল সমাজের প্রতিনিধি ব্রাহ্মণের ভণ্ডামি বা বৈষ্ণবের লোলুপতা তাদের নিশানা আবার 'ইয়ং বেঙ্গল' নামধারী ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি যুবকরাও ছিল তাদের চাঁদমারি। স্ত্রী শিক্ষা, স্ত্রী স্বাধীনতা, দালাল, মাতাল, গুলিখোর সঙের গানে উপহাস বিদ্রুপের তালিকায় কেউ বাদ যায় নি। সঙ নামক এই লোকসংস্কৃতির মধ্যে একটা সর্বগ্রাসী cynicism এর হাস্যরসাত্মক অভিব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। সঙের গান ছিল বাৎসরিক খতিয়ান। তৎকালীন বাঙালি সমাজে বছরভর যে সব ঘটনা, দৃশ্য বা কথা দাগ কেটেছে তা আলোকিত হত সঙের ছড়ায় আর গানে। এইভাবে সঙের গানের ভিতর দিয়ে আপনার মুখ আপনি দেখতে পেতেন বাঙালি সমাজ।