|| ১ ||
গত ১৫ই মে ২০১২, মঙ্গলবার মেহিকোর এবং স্পেনীয় ভাষার সাহিত্যের জগতে ইন্দ্রপতন—মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মৃত্যু কালজয়ী কথাসাহিত্যিক কার্লোস ফুয়েন্তেস এর; তাঁর বয়েস হয়েছিল তিরাশি। তিনি বাস করতেন মেহিকো সিটি শহরে—তাঁর চিকিৎসক ডাঃ আর্তুরো বালেস্তেরোস তাঁকে দেখতে যেতেন নিয়মিত তাঁর বাড়িতে; কয়েকদিন আগে তিনি লেখকের স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন স্থানীয় আনহেলেস দেল পেডেগাল হাসপাতালে—সেখানেই তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ।
তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মেহিকোর রাষ্ট্রপতি ফেলিপে কালদেরোস মন্তব্য করলেন টুইটারে—"I am profoundly sorry for the death of our loved and admired Carlos Fuentes, writer and universal Mexican. Rest in peace." লণ্ডন থেকে টুইট করলেন গুণগ্রাহী সলমন রুশদি—"RIP, Carlos my friend." সদ্য নির্বাচিত ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ফ্রাসোঁয়া ওলাঁদ বললেন, "তিনি আমাদের দেশের এক মহান বান্ধব।" এবং " তিনি সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন মানবিকতার সরল এবং মহিমান্বিত ধারণাটির পক্ষ নিয়ে।" ২০১০ সালের সাহিত্যে নোবেলজয়ী মারিও বার্গাস ইয়োসা লিখলেন, "With him, we lose a writer whose work and whose presence left a deep imprint." পরের দিন ১৬ই মে পালাসিও দে বেলাস আর্তেস-এ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হল—উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা ছাড়াও দেশ বিদেশের অসংখ্য গুণীজন। বেশ কিছুক্ষণ যানবাহন চলাচল থেমে গেল সামনের রাজপথে, কিন্তু একটি গাড়ির চালকও রেগে গিয়ে হর্ন বাজালেন না।
ফুয়েন্তেস-এর সাম্প্রতিকতম উপন্যাসটির নাম "লা বোলুন্তাদ ই লা ফরচুনা" ("ভবিতব্য এবং কামনা")। স্পেনীয় ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালে—সম্প্রতি তার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন এডিথ গ্রোসম্যান (Destiny and Desire, Random House, 2011)। সমালোচকেরা উপন্যাসটিকে "কৌতুকময় যুদ্ধ ও শান্তি" বলে বর্ণনা করেছেন—তলস্তয়ের গভীরতা অথবা দর্শন-সমৃদ্ধি তার মধ্যে নেই, কিন্তু রয়েছে ঘটনার বিস্তার ও চরিত্রের বৈচিত্র্য; আর রয়েছে ইতিহাস এবং তার সঙ্গে কড়া ডোজের লাতিন আমেরিকা। এক সমালোচকের জবানীতে, "It offers lavish quantities of comedy, satire, allegory, fantasy and brilliant political commentary; makes coded allusions to recognizable celebrities; evokes the works of Spinoza and Machiavelli; includes ghosts, graves, murders, a voluble flying prophet and a talking severed head." না, ছাপার ভুল নয়, উপন্যাসের প্রধান কথক একটি কাটা মুণ্ডু। মেহিকোর বিভিন্ন শহরে নিষিদ্ধ ড্রাগ্সের বেসাতি নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চলেছে—বিবদমান অপরাধী গোষ্ঠীগুলি একে অন্যের সদস্যদের খুন করে গলা কেটে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়—অনেক সময়ই কাটা মুণ্ডু বা ধড় ভেসে আসে সমুদ্র সৈকতে। মেহিকোর মানুষের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে একমাত্র শরীরহীন মস্তকের পক্ষেই তার বর্ণনা করা সম্ভব!
|| ২ ||
১৯৮০ দশকের আগে পর্যন্ত ফুয়েন্তেস-এর খ্যাতি ও প্রচার ছিল স্পেনীয় ভাষাভাষী দেশগুলিতেই সীমাবদ্ধ। ১৯৮১ সালে আমি যখন কর্মসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করি, তাঁর গুটিকয়েক গ্রন্থ পাওয়া যেত ইংরেজি অনুবাদে। এর আগের বছরই তিনি আমেরিকায় এসেছেন সাহিত্যের অধ্যাপনার কাজে ন্যু জার্সি রাজ্যের অভিজাত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে; এই সময়েই ন্যু ইয়র্ক শহরের সুখ্যাত "প্যারিস রিভিউ" সাহিত্যপত্র তাঁর একটি গভীর, মননশীল ও সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে—বলতে গেলে, ইংরেজিভাষী সুধী পাঠকদের কাছে তাঁর প্রথম ও বিস্তৃত আত্মপ্রকাশ। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল তিনি ফ্রানসে মেহিকোর রাষ্ট্রদূত ছিলেন; কিন্তু মেহিকোর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি গুস্তাভো দিয়াস ওরদাস স্পেনের রাষ্ট্রদূত পদে মনোনীত হলে তার প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন। তারপর আবার ফিরে আসেন সাহিত্যের ও অধ্যাপনার জগতে।
ওই সাক্ষাৎকার থেকেই তাঁর বিষয়ে বিশদ তথ্য জানতে পারা যায়। বেশিরভাগ সমসাময়িক লেখক যখন নিজেদের আধুনিক অথবা উত্তর-আধুনিক অভিধা দিতে আগ্রহী, তিনি যখন ফিরে যেতে চান অতীতে—নিজেকে বলেন "পূর্ব-আধুনিক" বা "Pre-modern" লেখক। আগের শতাব্দীর লেখকদের মতন তিনি কাগজ কলমে লেখেন—তাও দিনে ছ'সাত পাতার বেশি নয়। সকাল সাড়ে আটটায় লিখতে বসেন, সাড়ে বারোটা পর্যন্ত লেখেন, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে যান। ফিরে এসে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম ও লেখাপড়া। বিকেলের রুটিনটি আরও মনোহারী—তিনি হাঁটতে বেরোন এবং পরের দিনের লেখার সামগ্রীগুলি মাথার মধ্যে সংগ্রহ না হওয়া পর্যন্ত বাড়ি ফেরেন না—"I always follow a triangular pattern on my walks here in Princeton: I go to Einstein's house on Mercer Street, then down to Thomas Mann's house on Stockton Street, then over to Herman Broch's house on Evelyn Place. After visiting all three places, I return home and by that time, I have mentally written tomorrow's six or seven pages." ত্রিভুজাকৃতি হাঁটা পথ, তার তিন বিন্দুতে তিন মনীষী—লেখকের পরের দিনের সাহিত্যসৃষ্টির অনুপ্রেরণা।
ধ্রুপদী সাহিত্যিকরাই তাঁর প্রিয় এবং পথপ্রদর্শক; ফরাসি কথাসাহিত্যিক মার্সেল প্রুস্ত তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা—"Proust only wrote when he had lived what he was going to write, and yet he had to write as though he knew nothing about it - which is extraordinary." মার্কিন ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ফকনারের সঙ্গেও তিনি গভীর আত্মীয়তা অনুভব করেন—"He is probably the only western novelist who has the same sense of defeat and loss that we have." তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল—ইয়োরোপ-আমেরিকার লেখকদের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার লেখকদের প্রধান পার্থক্য কী? ফুয়েন্তেসের মতে তাঁদের রক্তাক্ত ইতিহাস এবং তাঁদের সামাজিক দায়বদ্ধতা—"Pablo Neruda used to say that every Latin American writer goes around dragging a heavy body, the body of his people, his past, of his national history. We have to assimilate the enormous weight of our past, so we will not forget what gave us life. If you forget your past, you die." তিন দশক আগে এক তীব্র শীতের অপরাহ্নে তিনি নিজের লেখক সত্তাকে উজাড় করে দিয়েছিলেন।
|| ৩ ||
রাফায়েল ফুয়েন্তেস মেহিকো সরকারের এক উচ্চপদস্থ ডিপ্লোম্যাট—কর্মসূত্রে তাঁকে এবং তার স্ত্রী বের্তা মাসিয়াস ফুয়েন্তেসকে বসবাস করতে হত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজধানী শহরে। ১১ নভেম্বর ১৯২৮ যখন তাঁর পুত্র কার্লোসের জন্ম হ'ল, তখন তাঁরা পানামার রাজধানী পানামা সিটি শহরে। কার্লোসের ছেলেবেলা কাটে লাতিন আমেরিকার নানান দেশের রাজধানীতে এবং তার ফলে পুরো অঞ্চলটির সঙ্গেই তাঁর মানসিক অভিন্নতা এবং ব্যক্তিগত পরিচয়।
১৯৩৪ থেকে ১৯৪০ সাল তাঁর পিতার কাজের দায়িত্ব ছিল ওয়াশিংটন ডিসিতে মেহিকোর দূতাবাসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলে তাঁর লেখাপড়ার শুরু এবং ইংরেজি ভাষায় তাঁর দখলও প্রশ্নাতীত। ইংরেজিতে সাহিত্য রচনার অনুরোধ ও প্রস্তাবও এসেছে অনেকবার, কিন্তু একই কথা বলে তিনি তা খারিজ করে দিয়েছেন—ইংরেজি সাহিত্যের কোনো প্রয়োজন নেই তাঁকে। ইংরেজি সাহিত্য যদি কোনোদিন দুর্বল হয়ে পড়েও, সঙ্গে সঙ্গে একজন আইরিশম্যান এসে তাঁকে চাঙ্গা করে তুলবেন! সাহিত্যে তাঁর অনুরাগের সূচনা অবশ্য আমেরিকায় বসবাস কালেই।
মেহিকোর খনিজ তেলের খনিগুলি ছিল মার্কিন কোম্পানিদের নিয়ন্ত্রণে—১৯৩৮ সালে মেহিকো সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করলেন তাদের। আমেরিকা জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে তার রেশ গিয়ে পৌঁছালো কার্লোসের স্কুলে—তাঁর প্রাণের বন্ধুরা হয়ে দাঁড়ালো তীব্র শত্রু। এমন কী সহপাঠীদের কাছেও তিনি পেলেন ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, উপহাস। সেই থেকেই তাঁর মনে মেহিকান জাতীয়তাবাদের সূচনা এবং সেই সঙ্গে উপলব্ধি মার্কিন পুঁজিবাদের নগ্ন রূপের—যেখানে সব সম্পর্কের বিচার হয় লাভক্ষতির খাতায়। আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখলেও এই কথাটি তিনি স্মরণে রেখেছেন আজীবন।
১৯৪০ সালে তাঁর বাবা বদলি হলেন চিলের রাজধানী সান্তিয়াগো শহরে; সেখানে বারো বছরের ছেলেটির অনুরাগ জন্মালো দুটি বিষয়ে—তারা একে অন্যের সঙ্গে জড়িত—সমাজবাদ এবং পাবলো নেরুদার কবিতা। সারা জীবন বজায় থাকবে সেই অনুরাগ। ১৬ বছর বয়েস থেকে মেহিকো সিটিতে বসবাসের সূচনা—স্কুল, কলেজের পাঠ সমাপ্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনবিদ্যার শিক্ষা; পিতার মত ডিপ্লোম্যাট হবার উচ্চাশা তাঁর। আইন পড়তে পড়তেই মেহিকোর সিটির "অয়" ("Hoy", "আজকে") সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার কাজ এবং গল্প লেখার সূচনা।
১৯৫০ সালে মেহিকো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিদ্যার ডিগ্রিলাভ এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের পরিচালিত তথ্যকেন্দ্রে প্রথম চাকুরি। দেশে ফেরার পর থেকেই তাঁর অভ্যাস ঠাকুমা ও দিদিমার কাছে নিয়মিত গল্প শোনা—ডাকাতদলের গল্প, বিপ্লবীদের গল্প, লাগামছেঁড়া অবৈধ প্রেমের গল্প; দুই বৃদ্ধা ভালবাসতেন বলতে, কার্লোস শুনতেন অধীর আগ্রহে। প্রায় অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, "I think I became a writer because I heard those stories. They had the whole storehouse of the past inside their heads and hearts, so this was for me very fascinating, this relationship with two grannies—the two authors of my books, really."
চাকরি করতে করতেই শুরু করলেন প্রথম উপন্যাসের কাজ—বিষয়বস্তু মেহিকোর ইতিহাস এবং মেহিকোর জাতীয় চরিত্র। কয়েক বছর লাগলো লিখতে—নাম দিলেন "লা রেহিওন মাস ত্রান্সপারেন্তে" অর্থাৎ "যে অঞ্চলে আকাশ পরিষ্কার"—প্রকাশিত হল ১৯৫৮ সালে, তাঁর বয়েস তখনও তিরিশ ছোঁয়নি।
|| ৪ ||
প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সফলতা লাভ করল প্রথম উপন্যাসটি—মেহিকোতে এবং স্পেনীয়ভাষী অন্যান্য দেশে। গ্রন্থের সময়কাল ১৯১০ থেকে ১৯২০ সাল মেহিকোর বিপ্লবের সময়—নায়ক ফেদেরিকো রব্লেস—যিনি বিপ্লবের আদর্শ ত্যাগ করে অর্থনৈতিক লেনদেনের কাজে নামেন ধনী হওয়ার জন্যে। গ্রন্থটি কেবল কয়েকটি চরিত্রের ওপরে আলো ফেলা নয়—মেহিকোর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি ও অসাধুতাও তার বিষয়বস্তু। তার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে মেহিকো সিটি শহরের বর্ণময় অথচ বাস্তবভিত্তিক বিবরণ। তাঁর শৈলীর মধ্যে সমালোচকেরা লক্ষ করলেন স্বগত: কথোপকথন এবং মানুষের অবচেতনের মধ্যে গভীর অনুসন্ধান। গ্রন্থের নামটি তিনি নিয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক আলফোন্সো রেইস-এর (১৮৮৯ - ১৯৫৯) একটি উদ্ধৃতি থেকে। মেহিকোর আনাহুয়াক উপত্যকা ছিল ছবির মতন সুন্দর এবং তার জলবায়ু বিশুদ্ধ, কিন্তু দ্রুত শিল্পায়নের ফলে শুকিয়ে যায় টেক্সকোকো হ্রদ এবং দূষিত হয় অঞ্চলের পরিবেশ।
৩৭৬ পৃষ্ঠার এই গভীর ও জটিল উপন্যাসটি তাঁকে দেয় অর্থনৈতিক সফলতা এবং তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি লেখার কাজে মনোনিবেশ করতে সমর্থ হন। বছর তিনেকের মধ্যে উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ হয় "Where the Air is clear" নামে এবং মার্কিন সাহিত্যানুরাগীরাও জানতে পারেন এই তরুণ লেখকের কথা। পরের বছর, ১৯৫৯ সালে তার জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে: প্রথম: ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারার নেতৃত্বে কুবার বিপ্লব—কুখ্যাত স্বৈরাচারী ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে সরিয়ে দিয়ে তাঁরা গড়ে তুললেন জনগণের সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। ফুয়েন্তেস গিয়ে হাজির হলেন সেখানে, লিখলেন মেহিকোর সংবাদপত্রের জন্যে সেই বিপ্লবের অভূতপূর্ব বিবরণ এবং বিপ্লবের সমর্থনে মার্কসবাদী রাজনৈতিক প্রবন্ধ। তিনি মনে প্রাণে মার্কসবাদী এবং কুবার বিপ্লবের তীব্র সমর্থক, কিন্তু কাস্ত্রোর অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কাজকর্মের ও প্রতিবাদ করতে কুণ্ঠিত হন নি। ১৯৭১ সালে কাস্ত্রো যখন কবি এবের্তো পাদিয়াকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন, ফুয়েন্তেস তার তীব্র নিন্দা করেছেন। অন্যদিকে কুবা এবং লাতিন আমেরিকার মুক্তিকামী দেশগুলির প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতামূলক আচরণের বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত উক্তি—"The United States is very good at understanding itself and very bad at understanding others."
দ্বিতীয়: মেহিকান অভিনেত্রী রিতা মাসেদোর সঙ্গে তাঁর বিবাহ। ১৪ বছর স্থায়ী হবে এই সম্পর্ক এবং কন্যা সিসিলিয়ার জন্ম ১৯৬২ সালে। সুন্দরী অভিনেত্রীদের সঙ্গে তাঁর পরকীয়া প্রেমের ঘটনাগুলিও সুপরিচিত।
তৃতীয়: তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস "লাস বুয়েনাস কনসিয়েনসিয়াস" ("উত্তম বিবেক") এর প্রকাশ। আকারে ছোট—১৫০ পৃষ্ঠা এবং অনেকের মতে প্রথাসিদ্ধ মার্কসবাদী উপন্যাস। মেহিকোর এক কাল্পনিক মাঝারি শহরের (খুব সম্ভবতঃ গুয়ানাহুয়াতো) উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনী—সেই পরিবারের সন্তান হাইমে সেবালোস অনুভব করে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য, কিন্তু প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ব্যর্থ হয়—সমাজ ও পরিবারের চাপে সমূলে বিনষ্ট হয় এক তরুণের আদর্শবাদ। স্যাম হাইলম্যান গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন "The Good Conscience" নামে। লেখকের প্রথম উপন্যাসটি ঐতিহাসিক উপাদানে ভরা, অসংখ্য চরিত্রের নাটকীয় কাহিনী। দ্বিতীয় উপন্যাসটি সংক্ষিপ্ত ও সংহত—একটি তরুণের জীবনসংগ্রাম এবং ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব—এখানে মনস্তত্ত্ব এবং ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের অবতারণা। লেখক প্রকাশ করেন তাঁর রচনাশৈলির বৈচিত্র্য।
|| ৫ ||
লেখকের কালজয়ী, রূপকাত্মক উপন্যাস "লা মুয়ের্তে দে আর্তেমিও ক্রুস" ("আর্তেমিও ক্রুসের মৃত্যু") প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসটির জনপ্রিয়তা বেড়েছে—আধুনিক লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় গ্রন্থ। উপন্যাসটির আংশিক অনুপ্রেরণা অরসন ওয়েলস পরিচালিত সুখ্যাত চলচ্চিত্র "নাগরিক কেইন" ("Citizen Kane")—চলচ্চিত্রের অনেক কলাকৌশলের ব্যবহার রয়েছে সেখানে।
কাহিনীর নায়ক আর্তেমিও ক্রুস মেহিকোর বিপ্লবের এক প্রাক্তন সৈনিক। পরবর্তীকালে বলপ্রয়োগ, জোরজুলুম, ব্ল্যাকমেইল, উৎকোচ প্রদান ও অন্যান্য বেআইনি কর্মের মাধ্যমে তার ধন ও প্রতিপত্তি লাভ। অর্থনৈতিক দুর্নীতি, দরিদ্রের ওপরে ধনীর অত্যাচার, সামাজিক মার্কিনীভবন ও শ্রেণী-সংগ্রাম এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। উপন্যাসের সূচনায় আর্তেমিও মৃত্যুশয্যায়—উপন্যাসের শরীর জুড়ে অতীত ও বর্তমানের যাতায়াত—তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি তুলে ধরা হয় ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে।
গ্রন্থটি লেখক উৎসর্গ করেছেন মার্কিন উদারপন্থী সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক চার্লস রাইট মিল্স-কে (১৯১৬-১৯৬২), যাঁর অকালমৃত্যু পুস্তকটি প্রকাশের কিছুদিন আগে; কারণ লেখকের মতে তিনি, "The voice of North America, friend and companion in the struggle of Latin America." উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে "The Death of Artemio Cruz" নামে—অনুবাদটি জনপ্রিয় হলেও মূল গ্রন্থের নির্মম, কঠোর, শক্তিশালী, কর্কশ, রুক্ষ পরিবেশটি গড়ে তুলতে ব্যর্থ। প্রায় দুদশক পরে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেনীয়ভাষার অধ্যাপক অ্যালফ্রেড ম্যাকঅ্যাডাম একটি নতুন অনুবাদের কাজ হাতে নেন এবং তাতে মূল গ্রন্থের ভাষা ও শৈলীর প্রতি সুবিচার সম্ভব হয়েছে।
আর্তেমিওর আগে প্রকাশিত হয়েছিল "আউরা" ("Aura") নামের একটি নভেলা—৫০ পৃষ্ঠা দৈর্ঘ্যের এই কাহিনী তাঁর অন্যান্য সব রচনার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা—কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক বক্তব্য নেই তার মধ্যে। ভূতের গল্প, ফ্যানটাসি, রূপকথা, স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে ঘোরাফেরা আরও নানাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে গ্রন্থটিতে। লিসেন্দার কেম্পের অনবদ্য ইংরেজি অনুবাদটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উপায় নেই।
পরবর্তী তিনটি উপন্যাসে—"ক্যাম্বিও দে পিয়েল" ("ত্বক পরিবর্তন", প্রকাশ ১৯৬৭), "জোনা সাগ্রাদা" ("পবিত্র অঞ্চল", প্রকাশ ১৯৬৭) এবং "কাম্পে-লিয়ানোস" ("জন্মদিন", প্রকাশ ১৯৬৯)—ইউরোপে ও লাতিন আমেরিকায় তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ে। ফুয়েন্তেস তার নিজের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করেন সতীর্থ লাতিন আমেরিকার লেখকদের প্রচারে—হুলিও কোর্তাসার, মারিও বার্গাস ইয়োসা, গাব্রিয়েল গার্সিয়া-মার্কেস প্রমুখের রচনাকে তিনি উপস্থাপিত করেন পৃথিবীর পাঠকদের সামনে।
লেখকের সবচেয়ে পরিশ্রমী এবং উচ্চাকাঙ্খী উপন্যাস "টেরা নস্ট্রা" ("আমাদের পৃথিবী") প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে—প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ করেন মার্গারেট সেয়ার্স পেডেন। একটি মার্কিন সংবাদপত্রে গ্রন্থটির সমালোচক লিখেছিলেন, "If Terra Nostra is a failure, it is a magnificient failure. Its conception is truly grounded, its perception often unique, its energy compelling and the inventiveness and audacity of some of its narrative maneuvers absolutely breath taking." উপন্যাসটি ইস্পাহানী সংস্কৃতির পাঁচশো বছরের ইতিহাস এবং স্পেন ও ভূমধ্যসাগরের পরিবেশে তার উৎসের অনুসন্ধান। জয়েসের 'ফিনেগান'স ওয়েক' উপন্যাসের সঙ্গে তার তুলনা করা হয়েছে।
|| ৬ ||
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সরকারী ডিপ্লোম্যাটের কাজের সূত্রে স্থগিত থাকে সাহিত্যকর্ম, তারপর আবার শুরু হয় নতুন উদ্যমে। ত্বরিত গতিতে রচনা ও প্রকাশ ঘটে তিনটি উপন্যাসের—"লা কাবেনা দে লা হাইড্রা" ("হাইড্রার মস্তক", প্রকাশ ১৯৭৮), "আগুয়া কেমাডা" ("পোড়া জল", প্রকাশ ১৯৮০) এবং "উনা ফামিলিয়া লেহানা" ("দূরত্বের আত্মীয়েরা", প্রকাশ ১৯৮০)—সগৌরবে তাঁর সাহিত্যজগতে প্রত্যাবর্তন। রচনার পটভূমি হয় বর্তমান কালের মেহিকো। ১৯১৩ সালে ৭১ বছর বয়েসি মার্কিন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, হাস্যরসিক ও অভিধান-সংকলন অ্যামব্রোজ গুইনেট বিয়ার্স মেহিকো ভ্রমণে গেলেন সেখানকার বিপ্লবের প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ লিখতে। তিনি অসামরিক সদস্য হিসেবে নাম লেখালেন বিপ্লবের প্রধান নেতা জেনারেল হোসে দোরোতেও আরাংগো আরামবুলার (১৮৭৮-১৯২৩) সেনাবাহিনীতে—এই জেনারেল বিশেষভাবে পরিচিত 'পাঞ্চো ভিয়া' নামে। ১৯১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিয়ার্স তাঁর বন্ধুকে চিঠি দিলেন—"কাল যাচ্ছি এক অজানা গন্তব্যের দিকে।" তার পর থেকে তিনি নিখোঁজ—না কোনো সংবাদ, না কোনো মৃতদেহ, না কোনো সমাধিক্ষেত্র। শতবর্ষেও সমাধান হয়নি এই রহস্যের। বিষয়টি অনুপ্রাণিত করেছিল ফুয়েন্তেসকে এবং দু' দশক ধরে (১৯৬৪ থেকে ১৯৮৪) তিনি এই বিষয়টি নিয়ে একটি উপন্যাস লেখেন—"গ্রিংগো ভিয়েহো" ("বৃদ্ধ সাহেব") প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার ইংরেজি অনুবাদ করেন মার্গারেট সেয়ার্স পেডেন ("The Old Gringo", প্রকাশ ১৯৮৬)। আমরা যেমন শ্বেতকায় মানুষদের "সাহেব" বলতে অভ্যস্ত, মেহিকোর মানুষেরা শ্বেতকায় মার্কিনদের বলেন "গ্রিংগো" (পুং) অথবা "গ্রিংগা" (স্ত্রীং)।
সব মহান উপন্যাসে যে মালমশলা থাকে—প্রেম, যুদ্ধ, মৃত্যু, যৌনতা—এই ২০০-পৃষ্ঠার উপন্যাসে তা ভীষণভাবে বর্তমান, এবং লেখক যেহেতু ফুয়েন্তেস, তার ভাষা হবে কাব্যময় এবং প্রকাশভঙ্গি দর্শনসমৃদ্ধ। এই প্রথম মেহিকোর লেখকের স্পেনীয় ভাষার রচনা ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে মার্কিন বেস্টসেলারের তালিকায় স্থান পায় এবং সেখানে থাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ। ১৯৮৯ সালে লুইস পুয়েনজোর পরিচালনায় উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়—অভিনয় করেন গ্রেগরি পেক, জেন ফন্ডা এবং জিমি স্মিটের মতন দিকপাল নট-নটীরা। কিন্তু ছবিটি জনপ্রিয় হয়নি।
বাকী জীবনে তিনি আরও এগারোটি উপন্যাস লিখেছেন—তার মধ্যে একাদশতম গ্রন্থটির কথা আমি লিখেছি প্রথম অধ্যায়ে। এ ছাড়া ন'টি ছোটগল্পের সংকলন; সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতির বিষয়ে এক ডজনের বেশি প্রবন্ধের গ্রন্থ; পাঁচটি নাটক; সাতটি চিত্রনাট্য—তার মধ্যে দুটি গার্সিয়া মার্কেস-এর সঙ্গে যৌথভাবে—সেই গ্রন্থগুলির বিষয়ে বিশদ আলোচনার পরিসর এখানে নেই। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন সক্রিয়, মুখর—১৫ই মে তাঁর মৃত্যুর দিনেই 'রিফর্মা' সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় ফ্রানসের নতুন সরকার ও তাঁর সমাজতন্ত্রী নেতার বিষয়ে লেখকের প্রবন্ধ।
মেহিকোর অন্য মহান লেখক ওক্তাবিও পাসের সঙ্গে ফুয়েন্তেসের সম্পর্কটি জটিল। প্রথম জীবনে তাঁরা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যদিও প্রতিদ্বন্দিতা ছিল তাঁদের মধ্যে—কে কোন সাহিত্য পুরস্কারটি আগে পাবেন। ১৯৮০ সালে নিকারাগুয়ায় বিপ্লবের পরে যখন সান্দিনিস্তা দল ক্ষমতায় আসেন, ফুয়েন্তেস তাঁদের সমর্থন জানান—সেই নিয়ে পাসের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধের সূচনা। ১৯৮৮ সালে পাসের সম্পাদিত "ইউয়েলটা" সাহিত্যপত্রে এক তীব্র সমালোচনা প্রকাশিত হয় ফুয়েন্তেসের সাহিত্যকর্মের এবং দুজনের সংঘর্ষ হয়ে দাঁড়ায় প্রকাশ্য এবং তীব্রতর। এবং তা প্রচলিত থাকে ১৯৯৮ সালে পাসের মৃত্যু পর্যন্ত। ১৯৯০ সালে পাস পেলেন সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার; ফুয়েন্তেসের নাম গত এক দশক ধরে নোবেল বিষয়ে জল্পনা-কল্পনার শীর্ষে—তিনি শেষ পর্যন্ত পেলেন না নোবেল।