• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৯ | এপ্রিল ২০১৫ | গল্প
    Share
  • চেনজিরা : রাহুল রায়


    এরপর আমাদের ‘না’ বলার আর কোনই উপায় রইলো না। প্রায় মাস ছয়েক ধরে চেনজিরা আমাদের বাড়ি দু-একদিন থেকে সপ্তাহখানেক থাকছে। আর তার লম্বা লম্বা ঝোলানো কান, গাঢ় হলুদ রঙের বড়-বড় আর ভাসা-ভাসা চোখের দৃষ্টি নিয়ে এই অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের বাড়ির সবায়ের, অর্থাৎ আমার আর আমার বৌ রত্নার মন জয় করে নিয়েছে। চেনজিরা বলে ডাক দিলেই সে লেজ নেড়ে সাড়া দেবে। আমি যখনই বলেছি--‘ড্যু ইয়্যু নো ইয়্যু আর ভেরি কিউট’ সে চোখের তারায় আশ্চর্য ঝিলিক মেরে আর কান অল্প ঝাঁকিয়ে আমায় জানিয়েছে যে একথা সে জানে। রত্নাকে এই কথা বলতে সে তো হেসেই আকুল--‘জন্তু জানোয়াররা কি মানুষের কথা বুঝতে পারে, না কথাবার্তা চালাতে পারে। বাজে গুল দিয়ো না।’

    চেনজিরা একটা কুকুর। তার বংশ-পরিচয় দেওয়ার মতো কিছু নেই। তার মা ছিল বীগল আর বাবা ককার-স্প্যানিয়েল, আর তাদের মিশ্রণে সে ‘বীকার’, কান ঝোলা-ঝোলা, কিন্তু স্প্যানিয়েলের ঘন লোম তার গায়ে নেই। তার বর্তমান মালিক আমাদের ছেলের বন্ধু ড্যানিয়েলা কোন এক অ্যানিমেল শেলটার থেকে একেবারে বাচ্চা চেনজিরা কে বাড়িতে নিয়ে আসে। তাই প্রথম যেদিন সে ড্যানিয়েলার সাথে আমাদের বাড়ি আসে সে একেবারে মায়ের কাছ ছাড়েনি। খালি আমরা কিছু খেলেই বড় বড় চোখ চেয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। যেন- বলেছে আমাকে একটু দাও। এদিকে ওর মা’র কঠোর নির্দেশ ওর ব্যাগ-ভর্তি গোল-গোল বড়ির মতো খাবার ছাড়া আর যেন সে কিচ্ছু না খায়। বড় জোর কুকুরের জন্যে আলাদা স্ন্যাক্স যা দোকানে পাওয়া যায়-–তাই তাকে দেওয়া যেতে পারে মাঝে মাঝে। তার নাকি নানা রকম অ্যালার্জি আছে। মানুষের খাবার, বিশেষ করে আমাদের তেল-ঘি মশলা দেওয়া খাবার খেলে তার অক্কা পেতে নাকি বেশি দেরি হবে না। এদিকে আমাদের বাড়ি রান্না হলেই সে কান দুটো একটু তুলে বারে-বারে গন্ধ নাকে টেনে নিয়ে হাঁ করে চেয়ে থাকবে্-তোমরা এতোসব ভাল- ভাল খাচ্ছ-–আমার বেলায়ই বাদ!

    আমাদের দুই ছেলে যথা নিয়মে বড় হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে নিজেদের জীবনের খোঁজে। তারা ছুটিতে-ছাটাতে বাড়ি আসে। এটাই জীবনের নিয়ম--এটা আমি অনেক যুক্তি দিয়ে রত্নাকে বার-বার বোঝাতে চেষ্টা করি কিন্তু ভবি ভোলার নয়। তার অবস্থা অনেকটা--‘মাঝে-মাঝে তব দেখা পাই/চিরদিন কেন পাই না’-র মত। আর চেনজিরা মাঝে-মাঝে আমাদের বাড়ি এসে যেন আমাদের সেই শূন্যতা পূরণ করে দেয়। তার বয়স অনেক, কিন্তু সে ব্যবহার করে যেন একেবারে কচি বাচ্চা; রত্না যেখানে যাবে, সেও যাবে পিছু পিছু। আর রত্নার মায়ের মন তাতে যেন পুত্রস্নেহে একেবারে কানায়-কানায় ভরে ওঠে।

    ইতিমধ্যে আবার এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে। চেনজিরা আমাদের কাছে থাকতে এসেছে কয়েকদিনের জন্য। এদিকে সেদিন আমাদের ছোটছেলে নিউইয়র্ক থেকে বাড়িতে এসেছে--কয়েকদিন থাকবে। বিকেলে আমার আর রত্নার কাছেই এক বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার কথা। ওদের রেখে আমরা সেখানে গেছি, হঠাৎ সন্ধে সাতটা নাগাদ ছেলের উৎকণ্ঠিত ফোন--‘এক্ষুণি বাড়ি চলে এসো--আগুন লেগেছে।’ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি এসে দেখি বাড়িতে পুলিশ আর ফায়ার সার্ভিসের লোকেদের ভিড়ে-ভিড়াক্কার। রত্নার ধর্মে-কর্মে মতি অচলা। তাই প্রতিদিন সে পূজো-টুজো সেরে ঠাকুরের জায়গায় একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে। সেদিনও রেখেছিল, নেভাতে ভুলে গেছে। সেই প্রদীপ থেকে কিভাবে আগুন লেগেছে। ছেলের মুখে শুনলাম যে--হঠাৎ ফায়ার অ্যালার্ম বাজতে থাকে তার সাথে ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধ। সে কিছুতেই ঠাহর করতে পারেনি ধোঁয়া কোথা থেকে আসছে। সে বেসমেন্ট দেখে, দোতলার সব ঘর খুঁজে সিঁড়ি থেকে নামছে--এমন সময় চেনজিরা তার প্যান্টের পায়ের ঝুল কামড়ে ধরে টানতে-টানতে তাকে ঠাকুরের জায়গায় নিয়ে গেছে--দেখাতে ওখানেই আগুন ধরেছে। সে বালতি-বালতি জল ঢেলে সেই আগু্ন নেভায়। টিভিতে, বা মুভিতে দেখা যায় কুকুরদের নানা বিপদে পড়া মানুষদের উদ্ধার করতে। কিন্তু তাদের তো শিখিয়ে-পড়িয়ে অভিনয় করানো হয়। কিন্তু আমাদের চেনজিরা তো শেখানো-পড়ানো কুকুর নয়। সে কেবল নিজের গুণে ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে বাড়িটাকে আগুনের হাত থেকে বাঁচিয়েছে!

    ড্যানিয়েলা পরের বার এসে বলল যে--সে অনেকদিনের জন্যে ইউরোপ চলে যাচ্ছে, কবে ফিরবে ঠিক নেই। এদিকে তার পুষ্যিকে নিয়ে যে কি করবে জানে না। তারপর গলায় বেশ একটু আবেগ এনে বলল--‘কাউকে না পেলে চেনজিরাকে আবার শেলটারে ফিরে যেতে হবে। ও তো আর পাপি নয়--কে আর নেবে। তাই ওখানেই একদিন সে শেষ হবে।’ বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে সে একথা বলেছিল মনে করার কোন কারণ নেই, কিন্তু আবেগপ্রবণ বাঙালি মন তাতে একেবারে আর্দ্র হয়ে উঠল। আমারাও তো ওকে ভালোবাসি। আর আমাদের বাড়িটাকে সেই তো আগুনের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। তাই আমরা কি চেনজিরাকে স্থায়ীভাবে রাখতে পারি না! নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু, শুনেছি কুকুর–বেড়াল রাখার নাকি অনেক কাজ। কি আর এমন কাজ! নিয়মিত খাবার দেওয়া, দিনে একবার হাঁটতে নিয়ে যাওয়া, আর তার তো আমাদের মত বাথরুম নেই--তাই দু-নম্বর করলে তা পরিষ্কার কারা-–যেটা এদেশের নিয়ম। আর আমদের ইয়ার্ডে করলে শভেল দিয়ে তুলে গাছের ঝোপের তলায় ফেলে দিলেই হল, ভাল সার হবে। সুতরাং ড্যানিয়েলার পরোক্ষ অনুরোধে আমার একবাক্যে সায় দিয়েছি।

    একদিন চেনজিরা তার মা’র সাথে বড় থলে-ভর্তি ডগ ফুড, গা আঁচড়াবার চিরুনি, শিকল, নানারকম কুকুরের খেলনা, আর একটা ফোমের বিছানা নিয়ে আমাদের বাড়ি এসে হাজির। এই দেখে অনেক-অনেকদিন আগে ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে গেছিল। কোন এক গাঁয়ের লোকের হাত ধরে ছোট্ট মেয়ে সুমিত্রা হাতে একটা বিছানার পুঁটুলি নিয়ে আমাদের বাড়ি কাজ করতে এসেছিল। ওর তিন কুলে কেউ ছিল না। তাই আমাদের মধ্যেই ও বড় হয়ে ওঠে। আর প্রায় একইভাবে চেনজিরা আমাদের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আমরা ওর নামটা সংক্ষিপ্ত করে বাঙালি ধাঁচে চেনী বা চেনু করে ফেলেছি। তাকে এই নামে ডাকলেই সে কান একটু খাড়া করে, লেজ নাড়িয়ে জানান দেয় নামটা তার অপছন্দ নয়। সকালে রোজ বেরোনোর সময় সে বড়-বড় চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে--যেন বলে-–তোমাদের কি সত্যিই যেতে হবে? তা না-করে আমার সাথে একটু খেলা করো না। আর সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরলে সে নেচে-কুঁদে, মুখে কখনো ঘোঁত-ঘোঁত, কখনো আদুরে আওয়াজ করে জানান দেয় যে সে খুব খুশি হয়েছে। তারপর কখনো মেঝের ওপর সাপের মতো পেটের ওপর হেঁটে, কখনো গড়িয়ে গিয়ে নানারকম খেলা দেখায়। আর সেই খেলা শেষ হলেই তাকে কিছু স্ন্যাকস দিতে হবে। ডিজনিল্যান্ডে দেখেছি ডলফিনদের খেলা দেখানোর পর জলের তলা থেকে আকাশের দিকে লাফিয়ে উঠে তাদের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মাছ মুখে নিয়ে জলের তলায় চলে যেতে। চেনীর ব্যাপারও একই--খেলা দেখিয়েছে এবার তার পারিতোষিক দিতে হবে। সারাদিনের পর বাড়িতে আসার পর অনেকসময়ই খুব ক্লান্ত লাগে। আর চেনুর উষ্ণ আবাহন ও ছেলেমানুষের মতো নানান খেলা দেখিয়ে সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টা আমাদের ক্লান্ত স্নায়ুর ওপর একটা ঠাণ্ডা প্রলেপ দিয়ে দেয়-–খুব শীতের দিনে গায়ের ওপর একটা মোটা লেপ চাপা দেওয়ার মতো।

    চেনীর মা ড্যানিয়েলা বার বার বলে দিয়েছে--আমরা যেন ওর খাবার ছাড়া অন্য কোন খাবার ওকে না দিই--বিশেষ করে আমাদের মশলা দেওয়া খাবার। কিন্তু আমার কাছে এটা প্রায় মরাল ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে--আমাদের নিজেদের ইচ্ছেমত যা খুশি খেতে পারি--রোজ ভাত–ডাল খেতে-খেতে পেটে চড়া পড়ে গেছে--চলো আজ রেস্ট্যুরেন্টে খেয়ে আসি, বা আজ ছুটির দিনের সকাল--লুচি আর বেগুন ভাজা, যা বৃষ্টি পড়ছে-–আজ খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা খেলে হয়। আর বেচারা চেনুর রোজ একই খাবার খেতে হবে--ভালো লাগুক বা নাই লাগুক। সুতরাং রত্নার নানান সাবধান বাণী সত্ত্বেও আমি ওকে আমার খাবার থেকে একটু-একটু দিই। সেদিন আমি তরমুজ খাচ্ছি, আর চেনী হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে একটু পাওয়ার লোভে। কুকুররা তো মাংসভোজী, তারা ফল খাবে কেন? কিন্তু কি মনে করে আমি ওকে এক টুকরো ছুঁড়ে দিতেই সে তা লুফে নিল, আর তারপর খেয়ে কী বারবার জিভ চাটার ঘটা। রত্না খুব স্বাস্থ্য-সচেতন--ওর ধারণা সবায়েরই মাছ-মাংস ছেড়ে ফল-মূল খাওয়া উচিত। তাই আমি ওকে বুক ফুলিয়ে বললাম--‘এখন থেকে তুমি ওকে ফল-মূল, তরি-তরকারি দিতে পারো, ওর স্বাস্থ্য দেখে কে!’ তবে আমাদের খাবার খেয়ে ওর মাথা ঘুরে গেছে। সকালবেলা ব্রেকফাস্ট আর দুপুরের লাঞ্চ সে নিজের খাবারই খায়, কিন্তু রাতের ডিনারে সে খাবারের সাথে আমাদের খাবার একটু মিশিয়ে না দিলে সে তা স্পর্শই করবে না।

    চেনুর স্বভাব ভারি ভাল। শুনেছিলাম কুকুরের লেজ ধরে টানতে নেই। কিন্তু আদর করতে-করতে চেনীর লেজ বা তার লম্বা-লম্বা কান টানলে কিছু বলে না। কিন্তু সেদিন বোধহয় টানাটানির বহরটা একটু বেশি হয়ে গেছিল। দেখি মুখটা একটু ফাঁক করা তা দিয়ে দাঁতগুলো অল্প দেখা যাচ্ছে, আর মুখে গ-র-র-র করে চাপা আওয়াজ। সে সাবধান করে দিচ্ছে এর বেশি এগিয়ো না। চেনীর এই রূপ আগে কোনদিন দেখিনি-–তাই আদর করা ছেড়ে ভাবতে বসলাম। কুকুররা উলফ্ বা নেকড়ে বাঘের বংশধর। আর তাদের হিংস্রতা নিয়ে কত গল্প যে আছে তার ঠিক নেই। কোনান ডয়েলের হাউন্ডস্‌ অফ দ্য বাস্কারভিলস্‌-এ যে হাউন্ডদের কথা বলা আছে তারা বোধহয় নেকড়েদের একটু কাছাকাছি। আমাদের চেনু বীগল আর ককার-স্প্যানিয়েলের মিশ্রণ, আর বীগল জাতে একটা হাউন্ড। আমার চিন্তা আরো ঘনীভূত হল।

    তাই আমি চেনুকে জিজ্ঞাসা করলাম--‘হ্যাঁরে চেনু, কত বংশ আগে তুই উলফ্‌ ছিলি?’ সে এইসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বড়-বড় চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ‘তোর পূর্বপুরুষরা তোকে মাঝে-মাঝে দেখতে আসে না কি?’-–আবার আমার প্রশ্ন। কোন উত্তর নেই। আমার মনে হয় ও বোধহয় ভাবে--আচ্ছা এই লোকটা এ-রকম অদ্ভুত-অদ্ভুত প্রশ্ন করে কেন! তাছাড়া ওর দাঁত বার করে মুখে গ-র-র-র আওয়াজ করায় আমাদের ভয়ে পিছিয়ে যেতে দেখলে ও যেন বলতে চায়--মিছিমিছি এমন ভয় পাচ্ছো। আমি কিচ্ছু করবো না। কিন্তু মিথ্যে ভয়ে পেলে সুকুমার রায়ের--‘সবাই মিলে কামড়ে দেবো’--এমন একটা ব্যবস্থা হবে। আমাদের মধ্যে চোখে-চোখে এইসব কথাবার্তা হয়। তবে রত্নার সামনে কখনোই নয়। ও ভাববে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

    আসলে চেনীর পূর্বপুরুষদের নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনা বা কিছুটা উদ্বেগ পুরোপুরি অমূলক নয়। আমাদের বাড়ির পিছনে দু-সারি বাড়ির পরেই জঙ্গলের শুরু। সেখানে নানারকম পাখপাখালি ছাড়াও শেয়াল-টেয়াল আছে--তাদের ঠেলায় মুরগি-টুরগি রাখা মুশকিল। শুনেছি অনেক-অনেক বছর আগে এই অঞ্চলে কালো ভাল্লুক, ম্যুস, ববক্যাট বা বন-বেড়াল, বুনো শুয়োর ইত্যাদি ভর্তি ছিল, আর হরিণের তো কথাই নেই। আর ছিল কয়োটি বা প্রেইরী উলফ্‌, বাংলায় যাকে নেকড়ে বলে। কয়েক শতাব্দী ধরে অবিচ্ছিন্ন শিকারের ফলে সব জীবজন্তুই এ অঞ্চল থেকে প্রায় শেষ। তবে বিগত দু-দশক ধরে জীবজন্তু সংরক্ষণ আন্দোলনের ফলে প্রকৃতির এইসব সন্তানেরা এখানে ফিরে আসতে আরম্ভ করেছে। এপ্রিল-মে মাস এলেই নানা রঙের আঁচল বিছিয়ে বসন্ত আসবে। পাতাহীন গাছে প্রায় হঠাৎই অদৃশ্য জাদুকরের ছোঁয়ায় আসবে ফুল আর পাতা--আর সঙ্গে-সঙ্গে আসবে টুকটুকে লাল, মাথায় ঝুঁটি দেওয়া রেড কার্ডিনাল, হলুদ মাথা আর পেট-ওলা ইয়োলো ওয়ার্বলার অথবা বাদামী ফোলা পেট রবিন। হঠাৎই এসে হাজির হবে এক ঝাঁক পিঠের হালকা নীল পালক-ওলা ব্লু জে।

    জীবজন্তুরও অভাব নেই। বছর তিনেক আগে একটা রেড ফক্স তার পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়ির পিছনে বেশ কিছুদিন ছিল। সেখানে বাচ্চা-টাচ্চা হল। তারপর একদিন হাওয়া। একদিন দেখি একটা পসাম সাদা মুখে বড়-বড় চোখ চেয়ে গুটি-গুটি আমাদের বিরাট উইলো গাছটার দিকে এগোচ্ছে। আর হরিণ তো যখন-তখন সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। খবরের কাগজে দেখলাম কিছুদিন আগে আমাদের প্রতিবেশী শহর ওয়েললেসলিতে একটা কালো ভাল্লুক কোথা থেকে এসে হাজির। তাতে উত্তেজনার কোন অভাব হয়নি। আর সে ভয়-টয় পেয়ে একটা লম্বা গাছে উঠে পড়েছে। এদিকে পুলিশের লোকরা তাকে অসাড় করে দিয়ে বনে পাঠাবার উদ্দেশ্যে হাতে ডার্ট গান নিয়ে তার দিকে তাক করে আছে--সুযোগ পেলেই ট্রিগার টানবে। তাই দেখে এক পুলিশ অফিসার আর একজনকে ট্যুইট করেছে--‘ব্ল্যাক বেয়ার, ব্ল্যাক বেয়ার হোয়াট ড্যু ইয়্যু সী?/আই সী ওয়েলেসলি পুলিশ লুকিং অ্যাট মী।’

    ভাল্লুক যদি আসতে পারে তাহলে নেকড়ের উদয় হতে অসুবিধা কোথায়। আমি চেনীকে জিজ্ঞাসা করলাম-- ‘তোর দাদুর দাদুর দাদুর দাদু ঘোরাফেরা করছে নাকি?’

    তাতে সে কানদুটো একটু ঝাঁকিয়ে, মুখে কেমন যেন একটা রহস্যজনক হাসি এনে বলল--‘ইয়্যু নেভার নো।’

    ‘হুম--তা সত্যি--ওয়েলেসলিতে ভাল্লুক ঘোরাফেরা করবে সে কি কেউ ভেবেছিল! তোর পূর্বপুরুষদের নিয়েই চিন্তা। তারা যদি এখানে এসে পড়ে, তখন কি হবে?’

    চেনী আবার হেসে বলল--‘কি আর হবে, তাছাড়া আমি কি আর উলফ আছি। তোমাদের খাবার খেয়ে-টেয়ে আমি প্রায় মানুষ হয়ে উঠেছি।’

    সেদিন কিভাবে রত্না আমাদের কথাবার্তার মধ্যে এসে পড়েছে। সে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকার পর বলল--‘আজই আমি সাইকায়াট্রিস্টকে ফোন করছি। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কুকুরের সাথে কথা বলছো!’

    ‘মাথা খারাপ কেন হবে। ওতো বলছে ও হাফ-মানুষ হয়ে উঠেছে।’

    ‘আর তুমি সেটা বুঝতে পারছো!’

    ‘নয় কেন--এ হচ্ছে আমাদের ম্যান-টু ম্যান টক। ফাদার-সন-টক-ও বলতে পারো।’

    ‘হ্যাঁঃ। নিজের ছেলেদের সঙ্গে এত অন্তরঙ্গতা দেখিনি।’

    ‘আরে তারা আমার কথা শুনলে তো।’

    ‘বাজে বোকো না। এখনো এইসব উদ্ভট কাজ-কর্ম ছেড়ে নিজের কাজে যাও। কুকুরের সাথে কথা! এমন সর্বনেশে কথা কেউ কখনো শুনেছে।’

    ‘আরে, এই দিয়েই তো আমি গীনেস বুকে যেতে চাই। কুকুরের সাথে ক্লেয়ারভয়েন্স।’

    ‘জীবনটা শুধু ঠাট্টা করেই কাটিয়ে দিলে।’

    ‘না, না ঠাট্টা নয়। ও আমার কথা ভালো বোঝে। দেখবে?’

    ‘থাক-থাক।’

    ‘আরে আরে মজাটা দেখোই না। চেনী--তুই কত জেনারেশন আগে উলফ্‌ ছিলি রে?’

    চেনজিরা আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে লম্বা জিভ দিয়ে তার হাত-পা চাটতে লাগল, তারপর কোন কারণে আহ্লাদে আটখানা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল--এখনো তাকে আদর করতে হবে। ওর ওই ন্যাদস-ন্যাদস ভাব দেখে রত্না ওর নতুন নাম দিয়েছে--কুচুমুচু। এই নতুন নামে ডাকলেই সে ঘাড়টা একটু কাৎ করে, একটা কান উঁচিয়ে সেই হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরটার মত তাকাবে--যেন বলতে চায়--তোমরা আমায় ডাকছো?

    আজ কিন্তু চেনী, চেনু, কুচুমুচু কোন ডাকেই সে পাত্তা না দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল।

    ‘নাঃ, মাকে দেখে ও লজ্জা পেয়েছে।’

    ‘বাজে বোকো না। নিজের কাজে যাও।’

    এদিকে আমাকে পথে বসিয়ে দিয়ে চেনী তার মার সাথে নাচতে-নাচতে চলে গেল স্ন্যাক্সের লোভে।


    এবছর মে মাসের মাঝামাঝি থেকেই বেশ গরম পড়ে গেছে। আমরা মানুষজন বেশ আশ্চর্য, আর গাছপালা, পাখ-পাখালিরাও বেশ ধাঁধায় পড়েছে--এর মধ্যেই কি ড্যাফোডিল, টিউলিপ, ডগ উ্যড--সব ফুল ফুটে যাবে! নানান পশুও লম্বা শীতঘুম থেকে উঠে সবে আড়মোড়া ভাঙতে-না-ভাঙতেই গরম পড়ে গেছে। কোথায় শুনলাম নিউ হ্যাম্পশায়ারের উত্তরে কোন জায়গায় ব্ল্যাক বেয়ারদের খাবারের খোঁজে ঘোরাফেরা করতে গেছে। সব কিছুই একটু আগে-আগে চলছে। আর আমাদেরও জানালাগুলো বছরে অন্ততঃ ছ-মাস বন্ধ রাখতে হয়, সেগুলো খুলে দিতে হয়েছে। তবে এনিয়ে কারোর কোন অভিযোগ নেই। রোদ আর আলোর প্রকৃতির অকৃপণ দান সবাই গায়ে মেখে নিতে ব্যস্ত।

    রাতের বেলায় চেনী সাধারণত আমাদের খাটের তলায় একটি বসার চৌকি বা অটোমানে শুয়ে থাকে। সেদিন রাতে হঠাৎ একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। কাঠের মেঝের ওপরে পায়ের নখের একটা অতি-পরিচিত খচর-মচর আওয়াজ তুলে চেনী দোতলা থেকে নেমে একতলায় যাচ্ছে। সাধারণত বাড়িতে দরজার বাইরে কেউ এলে ও কি করে যেন খোঁজ পেয়ে যায়, আর তার চেঁচানিতে সারা পাড়া জেনে যায় যে কেউ এসেছে। কিন্তু আজ তার মুখে কোন আওয়াজ নেই। আমি কোনরকমে পায়ে চটি গলিয়ে নিচে গিয়ে দেখি চেনী ডাইনিংরুমের মস্ত বড় স্লাইডারের সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের ঝোপঝাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে কোন শব্দ নেই, খালি লেজটা অল্প-অল্প নড়ছে। এটা কাউকে দেখে খুব খুশি হয়ে ঘন-ঘন নাড়া নয়--থেমে থেমে আস্তে-আস্তে--ঠিক খুশি হবে কি না জানে না।

    ‘চেনী, বাইরে কি দেখছিস? আয় শুতে আয়।’ আমার প্রশ্নে সে খুব পাত্তা দিল না। আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার জানালার দিকে মন দিল। রাতের অন্ধকারে তার চোখের দৃষ্টি দুটো কাঠকয়লার আগুনের গোলার মতো দেখালো। এ আমার চেনা দৃষ্টি নয়। আমি ওকে একা রেখে শুতে চলে এলাম।

    চেনীর সাথে কথাবার্তা চালানোর ব্যাপারে সত্যিই আমাদের মধ্যে চমৎকার একটা বোঝাপড়া আছে। চেনী খুব পেটুক। খাবার দেখেলেই তার চোখ খুশিতে একেবারে জ্বল-জ্বল করে ওঠে। একাগ্র দৃষ্টি নিয়ে ও চেয়ে থাকে কখন ও একটু ভাগ পাবে। ‘একটু খাবি?’--জিজ্ঞাসা করলেই তার কানের ঝাঁকানি আর চোখের ভাষায় বোঝা যায়--‘অবশ্যই।’ সন্ধের দিকে যখন ওর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া প্রয়োজন, তখন ওর দিকে তাকালেই বলে উঠবে--‘দেরি করছো কেন? আর অপেক্ষা করলে আমার এখানেই কিছু হয়ে যাবে। তখন তুমিই বিপদে পড়বে।’ আর যদি বলি--‘চল, তোকে চান করিয়ে দিই, গায়ে একটু গন্ধ হয়েছে।’ তাহলেই তার মন খারাপ। কান দুটো ন্যাতার মতো পাশে ঝুলে পড়বে, আর চোখ মাটির দিকে, কিছুতেই আমার সাথে চোখাচোখি করবে না। তখন তার সাথে নানান কথা বলতে হয়--‘তোর ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। ভালো করে চান করলে গায়ের গন্ধ চলে যাবে। পাড়ার কুকুরটা তোকে আরোও ভালোবাসবে।’--ইত্যাদি।

    কিন্তু সেই রাতের ঘটনার পর আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর ও দিতে পারেনি। আমাদের বোঝাপড়া কোন কাজেই এল না। ‘সেদিন রাতে কি দেখিছিলি?’--আমার এই প্রশ্নে সে আমার চোখের দিকে তাকালো বটে, কিন্তু তার চোখের ভাষায় বুঝলাম সে নিজেই ভারি ধাঁধায় পড়েছে।

    সেদিন রাতে আবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমাদের বাড়ির চারপাশ বেশ ফাঁকা-ফাঁকা, কাছেই বনজঙ্গল, তার পাশ দিয়ে এঁকে-বেঁকে চলেছে নদী। রাতে তাই সারা অঞ্চলটা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে থাকে--সেই ভোর অবধি, যখন পাখিরা কিচির-মিচির করে জানান দেয় তারা উঠে পড়েছে। তাই রাতে খুব অল্প কোন আওয়াজ হলেও শোনা যায়। সেদিন ঘুম ভাঙল একটা অদ্ভুত চাপা আওয়াজে। চেনী মাঝে-মাঝে ক্ষিদে পেলে এইরকম একটা চাপা গলায় গোঙায়। আওয়াজটা প্রায় সেই ধাঁচের হলেও বেশ একটু অন্যরকম যাতে বুঝতে পারলাম যে সেটা চেনীর নয়। আমি চুপি-চুপি নিজের ঘরে গিয়ে দেখি চেনী অপলকে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, তার ঝোলা কানদুটো বেশ কিছুটা ওপরে তোলা, আর সে ঘাড় একটু একপাশে হেলিয়ে কি শুনছে। আমার দিকে তাকাবার তার অবসর নেই। এদিকে আমাকে আসতে দেখেই বাইরের সেই আওয়াজ মিলিয়ে গেল। ‘চেনী, বাইরে কি দেখছিলি?’--সে প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে সে চওড়া স্লাইডারটার এ-পাশ থেকে ও-পাশ ঘোরাঘুরি করতে লাগল--লেজ অল্প-অল্প নড়ছে, কানদুটো আগের মতো অল্প তোলা। যেন কাউকে সে খুঁজে পেতে চায়।

    আমি শুতে গিয়ে ঘুমন্ত রত্নাকে ঠেলাঠেলি করে তুলে দিয়ে বললাম--‘জানো, আজ চেনীর পূর্বপুরুষ এসেছিল।’ তাতে সে ভীষণ চটে গিয়ে--‘কাল সকালে কাজে যেতে হবে, এখনো তোমার আজগুবি গল্প শোনার সময় নেই।’ বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। শুনেছি নেকড়েবাঘরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। আর তাদের মধ্যে যারা মানুষের সংস্পর্শে কুকুর হয়েছে তাদের কারোর সাথে মোলাকাত হয়ে গেলে তারা তাকে ঘিরে ধরে। তারপর তাকে আঁচড়ে-কামড়ে মেরে ফেলে--তার মানুষের সান্নিধ্যে আসার প্রায়ঃশ্চিত্ত হিসাবে। এই চিন্তায় ভয়ে আমি কেঁপে উঠলাম। নিচে গিয়ে অনেক হাত-টাত বোলানোর পর চেনী তার নিজের জায়গায় শুতে এল। একবারও সে আমার সাথে চোখাচোখি করল না।

    পরের দিন সকালে রত্নাকে বলতে সে হেসেই আকুল--‘আমাদের চারপাশে জঙ্গল-টঙ্গল থাকতে পারে, আর সেখানে দু-চারটে শেয়াল-টেয়াল হয়তো আছে, কিন্তু তা বলে নেকড়ে? আবার তুমি উর্বর মস্তিষ্ক দিয়ে গল্প বানাচ্ছ, আর সেটা আমাদের চেনীর ঘাড়ে এনে ফেলেছো।’ এই বলে সে চেনীকে আদর-টাদর করে, স্ন্যাকস খাইয়ে কাজে চলে গেল। আমারই মাঝখান থেকে বেইজ্জতির একশেষ।

    চেনজিরার একটা বাজে স্বভাব হল একটু সুযোগ পেলেই বাইরে ছুট দেওয়া--কিছুক্ষণ পাড়া বেড়িয়ে, সুবোধ বালকের মতো বাড়ি ফিরে আসে। মুখের ভাবখানা--যেন কিছুই হয়নি, এইতো একটু পাশের বাড়ির বুটস-এর সাথে একটু কথা বলে এলাম। তোমাদের এত চিন্তার কোন কারণ নেই। রত্নার কিন্তু চিন্তার কোন অভাব হয় না--যদি রাস্তায় কোন গাড়ি ধাক্কা দেয়। ও কি একা-একা রাস্তা পার হতে জানে। আমার অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে যায়--যখন ছেলেরা খুব ছোট ছিল। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া কম চললেও--সাবধানের মার নেই। কোনদিনই আমরা ওদের একা-একা খেলতে দিই নি। চেনীর ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে কেন!

    কিন্তু চেনীকে সে-কথা বোঝানো শক্ত। আমাদের মধ্যে নানান কথাবার্তা চললেও তাকে একা একা পাড়ায় ঘুরে বেড়ানোর অপকারিতা সম্বন্ধে বুঝিয়ে উঠতে পারিনি। সেদিন যথারীতি সুযোগ পেয়েই চেনী টুক করে কেটে পড়েছে। সন্ধে প্রায় ছটা। শেষ-বিকেলে কিছুটা আলো তখনও অবশিষ্ট আছে। আমি কাজ থেকে এসে গেছি। একটু ডাকাডাকি করে যখন কোন পাত্তা পাওয়া গেল না, তখন আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসলাম--কোথায়ই বা যাবে। এক্ষুনি ফিরে আসবে। সাতটা বাজে। রত্না কাজ ফেরত বাড়ি ঢুকতে গিয়েই ধাক্কা খেল--‘চেনী কই, দরজা খুলতেই কেউ তো আমায় নেচে-কুঁদে অভ্যর্থনা করলো না।’ তারপর আমার কথা শুনে--এই মারে তো সেই মারে--‘তোমার কোন আক্কেল নেই, ছেলেটা আধঘণ্টা হল কোথায় পালিয়েছে, আর তুমি চুপ করে বসে আছো। কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই!’

    সেই রাতে পাড়ার প্রত্যেক জায়গায়, প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। গাড়ি নিয়ে এ-পাশ সে-পাশ ঘোরা হয়েছে, জঙ্গলের ধারে গিয়ে--চেনী, চেনী বলে চিৎকার করা হয়েছে--যদি সে পথ ভুলে ওখানে কোথাও আটকে গিয়ে থাকে। চেনীর কোন পাত্তা নেই। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ কি করবে! সেদিন রাতে কারোর খাওয়া হয় নি। ছেলেটা না খেয়ে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে--আমরা খাই কি করে! রত্না কেঁদে-কেঁদে অস্থির। খালি বিড়-বিড় করছে--হে ঠাকুর, আমাদের চেনীকে ভালো রাখো। শেষে বলল--‘চেনু বড় পেটুক--বাইরে খাবার রেখে দিই। তার গন্ধে সে ঠিক পথ চিনে আসবে।’ কোন লাভ হয়নি।

    এক সপ্তাহ হয়ে গেছে চেনী ফিরে আসেনি। আমরা রাস্তায়-রাস্তায় চেনীর ছবি ও পুরস্কারের অঙ্ক দিয়ে পোস্টার লাগিয়েছি, চারপাশের অঞ্চলে খোঁজ নিয়েছি--চেনীর মতো কোন কুকুর গাড়ি চাপা-টাপা পড়লো কি না। আমাদের কোন প্রচেষ্টাই সফল হয়নি। সে হঠাৎই যেমন লাজুক-লাজুক মুখ করে তার ছোটবেলার মায়ের সাথে আমাদের বাড়ি এসেছিল, তেমনি হঠাৎই কোথায় উধাও হয়ে গেল।

    প্রতিদিনই কাজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় চোখ দিয়ে জল আসে। আমাদের বাড়ির সামনে একটা মস্ত ডগ-উড গাছ আছে--বছরের এইসময় তা সাদা ফুলে ভর্তি, যেন কোন জাপানী চিত্রকর ক্যানভাসে এঁকে রেখেছে। চোখ চলে যায় গাছটার তলায়। অনেকদিন পাড়া বেড়িয়ে এসে চেনী গাছটার তলায় চুপ করে বসে থাকতো। আর চেনী বলে ডাক দিলে চ্যাম্পিয়ন স্প্রিন্টারের মত দৌড়তে-দৌড়তে এসে লাফিয়ে প্রায় গায়ের ওপর উঠে পড়ত। দেখি ডগ-উডের ঝরা ফুলের সাদা চাদরে হালকা করে বিছানো গাছটার তলা--সেখানে ঝোলা-ঝোলা কান দুলিয়ে কেউ বসে নেই। রত্না কাজের শেষে বাড়ি ফিরে গাড়ি থেকে বেরিয়ে চেনী, চেনী বলে কিছুক্ষণ উদ্‌ভ্রান্তের মত ডাকাডাকি করে মুখ নিচু করে বাড়ি ঢোকে। ছেলেদের এমনিতে নিয়মিত ফোন করে খোঁজ-খবর করার বিশেষ বালাই নেই। তারা রোজ ফোন করছে--চেনী কি ফিরল।

    দিন দশেক বাদে কাজ থেকে বাড়ি ফিরছি। অন্ধকার হয়ে এসেছে। অল্প-অল্প বৃষ্টিও হচ্ছে। আমাদের রাস্তার মুখে বাঁক নেবো হঠাৎ মনে হল একটা মস্ত ফরসিথিয়া ঝোপের তলায় ঝোলা-ঝোলা কান নিয়ে চেনী দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তার বেশি কিছু বোঝা গেল না। আমি চেনী-চেনী বলে ডাকাডাকি করতে সে যেন আমার কথার উত্তর দিয়ে আমার দিকে দু'পা এগিয়ে এলো। আমি আনন্দে একেবারে আত্মহারা হয়ে গাড়ির দরজা খুলে নামতে গিয়ে দেখি চেনীর চোখ অন্ধকারে জ্বল-জ্বল করছে, আর ওর পিছনে বেশ কয়েকটা আগুনের ভাঁটার মত জোড়া-জোড়া চোখ আমার দিকে দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ একটা কালো ভয় আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামতে আরম্ভ করল। এ সন্দেহটা যে আমার মাথায় আগে আসেনি তা নয়। তবে কি চেনী নেকড়েদের দলে যোগ দিয়েছে? কিন্তু তারা তো কাউকে নিজেদের দলে নেয় না, বরং কুকুর-টুকুর পেলে পেলে আঁচড়ে কামড়ে মেরে ফেলে মানুষের সঙ্গে ঘোরাফেরার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে। তবে কি!

    আমি ভয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিতেই চেনী মুখ তুলে আমার দিকে একবার তাকিয়ে দলের সাথে ভিড়ে গেল। তারপর সবাই হাওয়া হয়ে গেল নিঃশব্দে। আমি কি সত্যিই ওকে দেখলাম? তা কি সম্ভব? ততক্ষণে আমার ভয় কেটে গিয়ে সারা মন হারিয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য পিতৃস্নেহে ভরে উঠেছে। আমার চেনী, চেনী, চেনু ডাক বাতাসে বাতাসে ঘুরে আমার কাছেই ফিরে এল।

    রত্নাকে এ কথা বলতে সে ঝর-ঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপর শান্ত হয়ে বলল--‘আমাদের চেনু বেঁচে আছে। ভগবান ওকে ভালো রাখুন।’




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments