জীবন বড়ই ক্ষণস্থায়ী। এই ছোট্ট জীবনের পরিসরে দ্রুত পেরিয়ে যায় সময়। ছোটবেলায় প্রায়ই বিকালে একা একা বেরিয়ে পড়তাম। ধানক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম বেশ খানিক দূরে। যেখানে বাঁশঝাড়ের মাথায় লাল সূর্যটা ডুবে যেত। কেমন একটা অপার্থিব অনুভূতিতে ভরে উঠতো মনটা। অনেক বছর পর সবুজ দ্বীপের সাগর সৈকতে দাঁড়িয়ে অস্তমিত সূর্যটাকে দেখে ছোটবেলার সেই অনুভূতিটাই মনের মধ্যে নতুন করে আবার জেগে উঠলো।
আন্দামান.. জারোয়া.. কালাপানি। ইতিহাস আর ছেলেবেলা থেকে শোনা নানান গল্পকথা মনে মনে সৃষ্টি করেছিল এক রোমাঞ্চকর কল্পকথার আবহ। তাই রুটিনমাফিক নিত্যদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝেও ভ্রমণপিপাসু মন বেড়িয়ে পড়ল সবুজদ্বীপের হাতছানিতে। দমদম নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে পরিবারের সকলে মিলে পা বাড়ালাম পোর্টব্লেয়ারের পথে। কাকভোরে সূর্য আর প্লেন—দু'টোই একসাথে আকাশে উঠলো। প্রায় দু'ঘন্টা পর সুনীল বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে নামলাম পোর্টব্লেয়ারের বীর সাভারকর আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। বৃটিশ লেফটেন্যান্ট আর্চিবোল্ড ব্লেয়ার-এর নামে নামাঙ্কিত আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের এই ছোট রাজধানী শহর। এখানেই অবস্থিত সেই ঐতিহাসিক সেলুলার জেল—যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
|
১৯০৬ সালে সুবিশাল তিনতলা এই জেলাটি নির্মিত হয় অসংখ্য কয়েদীর ঘাম ঝরানো পরিশ্রমে। এর মাঝখানে গম্বুজাকৃতির ওয়াচ-টাওয়ার যার চারপাশে জেলের সাতটি উইং ছড়িয়ে আছে। বর্তমানে সাতটির মধ্যে আর তিনটি মাত্র অবশিষ্ট আছে। ভূমিকম্প আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের আক্রমণে বাকি চারটি উইং বহুদিন আগেই ধ্বংসপ্রাপ্ত। ভেঙে যাওয়া অংশে গড়ে উঠেছে গোবিন্দবল্লভ পন্থ হাসপাতাল। সাতটি শাখায় মোট ৬৯৬টি কুঠুরি বা সেল ছিল যার থেকে এর নাম দেওয়া হয়েছিল সেলুলার জেল। লোহার গরাদ দেওয়া অভিশপ্ত ঐ কুঠুরিগুলোতে বেড়ি পায়ে কত বন্দীর জীবন কেটে গিয়েছে অন্ধকারে। জেল প্রাঙ্গনের একদিকে শহীদ বেদী, অপরদিকের চালাঘরটি কয়েদীদের পাথর ভাঙা, ঘানি টানা—নানা অমানুষিক পরিশ্রমের নীরব সাক্ষী। একপ্রান্তে ফাঁসির কড়িকাঠটি কত শহীদের নিষ্ঠুর মৃত্যুর গোপন কাহিনি যেন কানে কানে শুনিয়ে যায়। এক পশলা বৃষ্টির পর মন খারাপ করা মেঘলা বিকেলে 'লাইট অ্যান্ড সাউন্ড'-এ জেলের ইতিবৃত্ত শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দেয় আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসহায় বন্দীদের উপর ইংরেজদের নৃশংস অত্যাচারের ছবি।
|
পোর্টব্লেয়ারের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দ্বীপগুলোয় সর্বত্রই বৃটিশ শাসনের চিহ্ন। রস আইল্যাণ্ডে গড়ে উঠেছিল বৃটিশ প্রশাসনের হাসপাতাল, চার্চ, বেকারী, অফিস, বাংলো, সুইমিং পুল। এসবই আজ কালের নিয়মে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আন্দামানে প্রথম জেল গড়ে ওঠে ১৮৬৫ সালে ভাইপার আইল্যাণ্ডে। ইংরেজদের নির্মম অত্যাচারের সাক্ষী হয়ে দ্বীপের টিলার উপরে আজও একাকী দাঁড়িয়ে আছে লালরঙা বাড়িটা। স্বাধীনতা আন্দোলনে নির্বাসিত বন্দীদের স্মৃতি বিজড়িত এর দেওয়ালের প্রতিটা ইঁট-কাঠ-পাথর। নিপীড়িত স্বদেশীদের হাহাকার যেন আজও গুমরে গুমরে মরে ভাইপার দ্বীপের আকাশে বাতাসে। শেষ বিকালে নেমে আসছি টিলার উপর থেকে বেলাভূমির দিকে। পিছন ফিরে দেখি রাঙা সূর্য অস্ত যাচ্ছে দেড়শো বছরের প্রাচীন ফাঁসিকাঠের পিছনে।
|
পোর্টব্লেয়ারের চ্যাথামে কাঠ চেরাই কলটি এশিয়ার বৃহত্তম। আন্দামানের সামগ্রিক আর্থিক পরিকাঠামোর এক বৃহৎ অংশ চ্যাথাম কাঠ চেরাই শিল্প ও তার অন্যান্য অনুসারী শিল্পের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
|
এরপর 'নর্থ বে' তে পৌঁছে দেখলাম সেখানে 'সী-ওয়াকিং'-এর ব্যবস্থা রয়েছে। জলের নীচের জগৎ এত কাছ থেকে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। উত্তেজনায় হৃদ্স্পন্দন প্রায় বন্ধ হবার জোগাড়! হেলমেট আর অক্সিজেন মাস্ক পরে নেমে পড়লাম সাগরের নীচে। একটু গভীরে যেতেই চারিপাশে রঙবেরঙের মাছেদের ছুটোছুটি। জলচরদের অবাক জীবন যেন স্বপ্নের মতো! রূপকথার মৎস্যকন্যার মতো ভেসে ভেসে বিচিত্র প্রবালদ্বীপের আনাচে কানাচে উঁকি দেওয়া—প্রবাল রাজ্য কী রঙিন। রক্তগোলাপের মত লাল, পোখরাজের মত হলুদ, মার্বেলের মত সাদা ধবধবে। সে এক রঙবাহারি ভুবন—অবর্ণনীয় তার সৌন্দর্য।
|
পরদিন ভোরবেলা আমাদের গন্তব্য হ্যাভলক দ্বীপ। পোর্টব্লেয়ার থেকে হ্যাভলকের পথেই আমাদের প্রথম জাহাজে ওঠার অভিজ্ঞতা। ইঞ্জিনের ভোঁ পড়ে গেল। ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলেছি কালাপানির বুক চিরে। সাগরের যে এত বাহারি রঙ তা আগে জানা ছিল না—কোথাও নীল, কোথাও সবুজ, কোথাও কালচে, কোথাও বা পুরো স্ফটিকের মত স্বচ্ছ! বিপুল জলরাশিতে সোনালী রোদ্দুর পড়ে চিকমিক করছে মুক্তোর মত। অপার বিস্ময়ে মনে মনে বলে উঠলাম, "আহা! কী দেখিলাম। জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলিব না।" হ্যাভলকে পৌঁছে মনে হল যেন পৌঁছে গেছি বাংলাদেশের কোনও এক ছায়াঘেরা গ্রামে। প্রকৃতির পরম যত্নে, কোমলতায় আর সস্নেহে রচিত এই সবুজ দারুচিনি দ্বীপ। চারিপাশে আম-সুপুরির বাগান, দারুচিনি আর নারকেল সারি ঘেরা পুকুর, মাঝে মাঝে ছোট কুঁড়ে ঘর। চালের মাথায় লঙ্কা, সুপুরি, দারুচিনি শুকোতে দিচ্ছে বাড়ির বউ। স্থানীয় সূত্রে শুনলাম দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরা এই দ্বীপেই ঠাঁই পায়। সেই থেকে তারা এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। হ্যাভলকের পশ্চিম পাড়ে রাধানগর বীচ। সেখানে গিয়ে মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। সামনে নারকেল—ঝাউবনের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া শান্ত নীল সমুদ্রের অপার বিস্তার আর সোনালী বালুকাবেলা। ঝিনুক কুড়োতে কুড়োতে জলভেজা পায়ে বালির উপর ছাপ ফেলে গেছে সাগর-বিলাসী কিছু মানুষ। নোঙর ফেলা জেলে নৌকাগুলো ঢেউয়ের তালে দুলছে বিরামহীন। শান্ত বেলাভূমির কোল ঘেঁষে চঞ্চল সমুদ্র-সখার অনন্তকালের অবিশ্রান্ত খেলা।
|
আন্দামানের অন্যতম আকর্ষণ হল জারোয়া—সেখানকার আদিম মানুষ। পোর্টব্লেয়ার থেকে বারাটাং হয়ে দিগলিপুরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। গ্রেট আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড পোর্টব্লেয়ার থেকে জারোয়া অধ্যুষিত জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলে গেছে সোজা দিগলিপুর পর্যন্ত। জারোয়া রিজার্ভে ঢোকার আগে সরকারী পারমিট নিতে হয়। জেনে নিলাম এই পথে গাড়ির হর্ন বাজানো, ছবি তোলা, জারোয়াদের খাবার দেওয়া নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ। সমস্ত গাড়ি একত্রে পুলিশের কনভয়ের সাথে যায়। জঙ্গলের যত গভীরে ঢুকছি, ততই বদলাছে চারিপাশের প্রকৃতি। লম্বা লম্বা গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো-আঁধারি খেলা। বনের নিস্তব্ধতা চিরে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে অচেনা পাখির ডাক। এগিয়ে চলেছি আমরা। সৌভাগ্যবশত হঠাৎ দেখা পেলাম তাদের! মাথায়, কোমরে লাল ফেট্টি বাঁধা, কেউ কেউ পাতার অলঙ্কারে সজ্জিত, কৃষ্ণকায় প্রায় নগ্ন নারী-পুরুষ-শিশু সমন্বিত জারোয়াদের একটি দল শিকার, ফলমূল আর কাঠ সংগ্রহ করতে বেরিয়েছে। ওদের দেখে মনে হল যেন টাইম মেশিনে ফিরে গেছি। হাজার বছর আগে যেখানে সময় গেছে থমকে, পৌঁছায়নি সভ্যতার আলো। সভ্য জগতে পৌঁছে যাওয়ার আগে আদিম অরণ্যের বন্য সুবাস বুক ভরে একবার নিয়ে নিলাম। উপলব্ধি করলাম, এই একবিংশ শতাব্দীতেও ভারতবর্ষের এক সুদূর দ্বীপে পৃথিবীর আদিম এক অরণ্যে একদল মানুষ এখনও আছে যারা আত্মকেন্দ্রিক নগর'সভ্যতা' থেকে অনেক দূরে আদিমতাকে আঁকড়ে গোষ্ঠীজীবনে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে বাঁচার প্রয়াসী।
|
বারাটাং-এ পৌঁছে এবার আমাদের গন্তব্য লাইমস্টোন কেভ। লাইফ জ্যাকেট পরে আমরা বোটের সওয়ারি হলাম। খাঁড়ির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে পৌঁছে গেলাম ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে। দু'পাশের গাছপালা যেন নিবিড় আলিঙ্গনে আমাদের ছুঁতে চাইছে! প্রায় আধঘন্টা পর ছোট্ট একটা কাঠের জেটি দেখা গেল। সেখান থেকে শুরু হল পায়ে হেঁটে পথ চলা—অচেনা পথে অজানা চুনাপাথরের গুহার সন্ধানে। উঁচুনীচু পাহাড়ী পথ পেরিয়ে শেষমেষ উপস্থিত হলাম গুহাসম্মুখে। গুহার ভিতর প্রবেশ করে তাজ্জব বনে যেতে হয়! প্রকৃতির আপন খেয়ালে গুহার দেওয়ালে হলদে সাদা চুনা পাথরের নিপুণ ভাস্কর্য। পাথরের ফাটল দিয়ে জল চুঁইয়ে লাইমস্টোনে তৈরি হয়েছে নানান কারুকার্য—কল্পনার কোথাও ঝাড়লণ্ঠন, কোথাও পাখি, কোথাও আবার সিদ্ধিদাতা গণেশ। এ যেন এক আদিম অরণ্যের রূপকথার রাজপ্রাসাদ!
|
এরপর রঙ্গত, মায়াবন্দর ছাড়িয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সাঁঝবেলায় এসে পৌঁছলাম দিগলিপুর। কিছুটা এগোতেই একটা টিলা। আঁকাবাঁকা পথ ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে গেছে। টিলার উপরে পথের শেষ প্রান্তে আমাদের রাত্রি যাপনের ঠিকানা—ছোট্ট একটা রিসর্ট। পূর্ণিমার আলোয় উদ্ভাসিত বিশ্বচরাচর। রিসর্টের পিছনে জঙ্গল ঘেরা পাহাড় আর সামনেই দেখা যাচ্ছে কালীপুর বীচ। সমুদ্রের অসীম জলরাশি যেন বালির বুকে আলপনা এঁকে যাচ্ছে। রিসর্টের সাজানো বাগানে আধো আলোয় তৈরি হয়েছে এক মনোরম পরিবেশ। আমরা রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম নীল নির্জন বালুচরে। চাঁদের আলোর বাঁধভাঙা বন্যায় চারিদিক ভাসছে। জ্যোৎস্নার মখমল আলো সাগরের জলে ঝিকমিক করে যেন লুকোচুরি খেলছে অবিরাম। সাতসমুদ্র পেরিয়ে আসা স্নিগ্ধ বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে মন প্রাণ। এক ঝলক শিহরণ খেলে যায় সারা শরীরে। দীর্ঘ পথের ক্লান্তি ঝরে গেল মুহূর্তেই। রাত নিঝুম। চারিপাশে আর কোনও জনমানব নেই। অদ্ভুত রোমান্টিকতা মিশে আছে সেই অনির্বচনীয় নির্জনতায়। মনে মনে ভাবি, নিস্তব্ধতারও যে গভীর একটা শব্দ আছে তা থেকে ব্যস্ত কোলাহলময় শহুরে জীবন চিরকালের জন্যই বঞ্চিত। পৃথিবী যেন একাকী তার আপন সৌন্দর্য বিছিয়ে রেখেছে এখানে—ঢেউয়ের ছন্দেই তার প্রাণবন্ততা।
|
পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্যের সমাহারে আন্দামান যেন এক কল্পরাজ্য। চোখ ঝলসানো শহুরে আড়ম্বর নয়—এখানে বিরাজ করে প্রকৃতির এক অকৃত্রিম সৌন্দর্য, রূপমাধুরীর এক অমোঘ আকর্ষণ যা মনকে শুধু মুগ্ধই করে না, ধীরে ধীরে গ্রাস করে। সফরশেষে বিদায় ঘন্টা বেজে উঠলেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়। এবার তো তাহলে ঘরে ফেরার পালা! পোর্টব্লেয়ার এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের বিমান ছাড়লো কলকাতার অভিমুখে। পাখির চোখে নীচে তাকিয়ে দেখলাম ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছে নীল সাগরের বুকে জেগে থাকা পান্নার মত সবুজ দ্বীপ। তারপর ক্রমশই আরও ছোট ... মিলিয়ে গেল। শুধু থেকে গেল একমুঠো সুখস্মৃতি।
|