হবুচন্দ্র আর গবুচন্দ্র প্রায় হরিহর-আত্মা। হবুচন্দ্র যেমন হোঁৎকা কালো, গবুচন্দ্র তেমনই রোগাটে আর ফর্সাটে। হবুচন্দ্রের চোখে চশমা, মুখভরা দাড়িগোঁফ, মাথায় হাফ-টাক, গবুচন্দ্রের দিব্যি চোখের জ্যোতি, নাকের তলায় 'সুচারু' গোঁফ, মাথাভরা কালো চুলের জঙ্গল। হবুচন্দ্র বক্কেশ্বর, গবুচন্দ্র মৌনীবাবা; হবুচন্দ্রকে চালশেয় ধরেছে, গবুচন্দ্র সবে তিরিশ টপকেছেন। তবু তাঁরা হরিহরাত্মা। এ দুনিয়ায় সব হয়।
তা— হবু-গবু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুক্তিনাথ পরিভ্রমণে যাবেন। মুক্তিনাথ অতীব পুণ্যতীর্থ — দর্শনেই মোক্ষলাভ। কিন্তু, হবু-গবুর ধর্মের প্রতি টান আছে, এমনটা তাঁদের অতিবড় শত্রুতেও বলবে না। তবে তাঁদের এহেন সিদ্ধান্তের পিছনে কারণ কী? কারণ আছে। একটি নয়, দু দুটি। প্রথমত — দু-জনেই হিমালয়ের পাকদণ্ডীতে বারকয় পাক মেরে হিমালয়ের সঙ্গে সাতপাকে বাঁধা পড়ে গিয়েছেন, এবং দ্বিতীয়ত — দু-জনেরই 'কমন ফ্রেণ্ড' শিশিরবাবুর (*) উসকানি। শিশিরবাবুর সঙ্গে তাঁদের বয়সের ফারাক মাত্রই তিরিশ চল্লিশ বছরের। চিরযুবা শিশিরবাবুর বেশ কয়েকটি বদভ্যাস আছে — ছোটদের জন্য যাচ্ছেতাই রকম ভালো লেখেন (শিশুসাহিত্যের প্রায় সবকটি পুরস্কারই পেয়েছেন), বিশ্রীরকম উদার হৃদয় আর অযাচিত আর নিঃস্বার্থভাবে সকলের উপকার করেন। এমন মানুষ যে হবুচন্দ্র গবুচন্দ্র এবং আরও অনেক চন্দ্রের 'বন্ধু' হবেন, এতে আর আশ্চর্য কী! শিশিরবাবু হবু-গবু-র জন্মের আগে একবার মুক্তিনাথ যাবার প্রচেষ্টায় বিফল হয়েছিলেন। সেখানে যাবার বাসনা তাঁর বুকে বাসা বেঁধে ছিল। গত একবছর ধরেই তিনি হবু-গবুকে তাতিয়ে আসছিলেন, 'চলুন না মশাই, মুক্তিনাথটা ঘুরে আসি'। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, শিশিরবাবু দ্বাদশোর্ধ যে কোনও ব্যক্তিকেই 'আপনি' সম্বোধন করতেন। হবু-গবু তা-না-না-না করছিলেন। শেষমেশ শিশিরবাবু ছাড়লেন মোক্ষম দাওয়াই — 'মশাই, আমি এই সত্তর বছর বয়সে যেতে মুখিয়ে আছি, আর আপনারা পিছিয়ে যাচ্ছেন!' শিশিরবাবু এই সত্তরেও যে তাঁদের চেয়ে অনেক 'জোয়ান', সেটা হবু-গবু মুখ ফুটে স্বীকার করেন কী করে? হাড়িকাঠে গলা দিয়েই দিলেন — রাজি হয়ে গেলেন। শুরু হয়ে গেল অভিযানের পরিকল্পনা, মানে জল্পনা-কল্পনা।বেশ মসৃণভাবেই এগোচ্ছিল সব। এর মধ্যে শিশিরবাবু একটা ভয়ানক অ-শিশিরোচিত কাজ করে বসলেন — দুম করে, প্রায় বিনা নোটিসে একা একা পাড়ি জমালেন 'মুক্তি'র দেশে, চিরকালের মতো। সকলের মতো হবু-গবুর বুকেও শেল বাজল। লীলাদি (*) সকলের মনের কথা বলে বসলেন, 'শিশিরটা যে এমন বিট্রে করবে, ভাবতেই পারিনি।' হতভম্ব অবস্থা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগল হবু-গবুর। এবার তাঁরা প্রতিজ্ঞা করলেন, মুক্তিনাথ তাঁরা যাবেনই; শিশিরদার জন্য যেতে হবে মুক্তিনাথ-এ। শুরু হলো জোর কদমে তথ্যসংগ্রহ। নানান লেখা পড়ে তাঁদের মনে হলো, রাউণ্ড অন্নপূর্ণা রুটে থোরাং-লা পেরিয়ে মুক্তিনাথ পৌঁছলেই শিশিরদা সব থেকে খুশি হবেন। পরিকল্পনায় ক্রমাগত কল্পনার জল মিশতে লাগল। একসময় এমন অবস্থা হলো যে, সতেরো হাজারি থোরাং-লাকে হবু-গবুর গড়িয়াহাটের মোড় মনে হতে লাগল।
অবশেষে এসে গেল দিন। ১৯৯৩-তে মা দুগ্গা যখন হিমালয় ছেড়ে নেমে আসার তোড়জোড় করছেন, হবু-গবু পোঁটলাপুঁটলি, মানে রাকস্যাক স্লীপিংব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হিমালয়মুখো। চেপে বসলেন দার্জিলিং মেলে।
নিউজলপাইগুড়ি— শিলিগুড়ি হয়ে তাঁরা এসে পড়লেন পানিটাঙ্কিতে। সেখান থেকে রিকশা-বাহিত হয়ে কাকরভিট্টায়— ভারত-নেপাল সীমান্তে। ভারতীয় শুল্কবিভাগ থেকে ক্যামেরার 'সাময়িক ছাড়পত্র' সংগ্রহ করে পা রাখলেন নেপালের মাটিতে। 'মুদ্রা-বিনিময়' সমাপনান্তে টিকিট কেটে পোখরার 'রাত্রিকালীন বাস সেবা'-য় চেপে বসলেন। যদিও টিকিট তাঁদের পোখরা পর্যন্ত, কিন্তু নামবেন ওঁরা ডুমরে-য়। সেখান থেকে বেসি শহর-য়ের বাস পাওয়া যায়। বেসিশহর থেকেই 'অ্যারাউণ্ড অন্নপূর্ণা' পদযাত্রার শুরু।
বাসে বাসে রাতেই দুঃসংবাদটা পেলেন হবু-গবু। ডুমরে-বেসিশহর পথের বেশিরভাগটাই আপাতত নদীগর্ভে। অতএব 'রাউণ্ড অন্নপূর্ণা'-র সলিল সমাধি ঘটল। অতঃ কিম?
পরদিন সকালে হবু-গবু সূর্যের সঙ্গেই উদিত হলেন পোখরায়। সূর্যের সোনা মেখে পোখরা আর অন্নপূর্ণা শৃঙ্গমালা তাঁদের স্বাগত জানালো। গোটা শহরটাকে অন্নপূর্ণা গিরিশ্রেণী যেন সযতনে আগলে রেখেছে। পোখরার রূপে মুগ্ধ হয়ে হবু-গবু হোটেলে পৌঁছে পেটপুরে খেয়ে বিছানায় লম্বা হলেন। সারারাত বাসে প্রচুর পরিশ্রম হয়েছে অতএব এখন প্রচুর বিশ্রাম প্রয়োজন। অন্নপূর্ণা-মাছাপুছারে পালাচ্ছে না, মুক্তিনাথও পালাচ্ছে না। ওদের সঙ্গে পরে মোলাকাত করা যাবে; আপাতত কাত হওয়াটাই একান্ত কর্তব্য।
দুই নদীর কলকাকলি শুনতে শুনতে হবু-গবু গভীর ঘুমের দেশে পৌঁছে গেলেন।
হবু-গবু যেন ঠিকই করে নিয়েছেন, পরিশ্রম সর্বদা পরিত্যাজ্য। সূয্যিমামা পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে টঙে উঠে বসলেন, বীরথাঁটে যাত্রীশূন্য হয়ে গেল, হবু-গবুর নড়ার নামটি নেই! বেশ বেলায় 'ব্রেকফাস্ট' সেরে মহা অনিচ্ছায় তাঁরা পাথুরে পথে পা রাখলেন। বীরথাঁটেকে বিদায় জানিয়ে ভুরুংডিখোলার তীর ধরে বীরদর্পে গদাইলশকরি চালে পথ চলা শুরু হলো তাঁদের। পথ চলল মাঝেমধ্যে সামান্য উঠে নেমে। সবুজ ধানক্ষেত তার সতেজ কোমল শরীর দুলিয়ে হাতছানি দিল, একটা পাকা পুল গর্বিত ভঙ্গিতে আহ্বান জানালো আর ভুরুংডিখোলা তো দুহাত বাড়িয়েই রয়েছে। এত প্রলোভনেও হবু-গবু পদযাত্রায় অটল। শুধু মাঝেমধ্যে চায়ের দোকানগুলো এসে পড়ে বাগড়া দিচ্ছে। হবুচন্দ্র মহা-চাতাল; চায়ের গন্ধ পেলে তাঁকে হাতি দিয়ে টেনেও নড়ানো অসম্ভব। গবুর মনের কথা তাঁর মুখের হাবেভাবে বিশেষ বোঝা যাচ্ছে না, তবে, তাঁর যে বিশেষ আপত্তি আছে, এমন তো মনে হচ্ছে না।
শম্বুক-গতি চলেও হবু-গবু যখন তিরখেডুঙ্গা পৌঁছলেন, সূয্যিমামা তখন সবে মধ্যগগনে হামা দিতে শুরু করেছেন। সূয্যির এহেন আচরণে তিতিবিরক্ত হয়ে দু-জনে একটা লজের 'ওপেন এয়ার রেস্তোরাঁ'র বেঞ্চিতে গা এলিয়ে দিলেন। গতবার হবু এখানে রাত্রি অতিবাহিত করেছিলেন; অতএব একটা লাঞ্চ তো অন্তত তিরখেডুঙ্গার পাওনা।
লাঞ্চ সেরে খানিক জিরিয়ে দু-জনে দু-টো ছোট্ট পুল পেরিয়ে পা রাখলেন উলেরির সেই কুখ্যাত চড়াইয়ে। ধাপে ধাপে পাথুরে সিঁড়ি উঠেছে স্বর্গে। সে পথে কি তাড়াহুড়ো করতে আছে! তাঁদের এই অলস চালচলন দেখে ভুরুংডিখোলা কোথায় যেন মুখ লুকোলো। গতবার ধর-তক্তা-মার-পেরেক এই চড়াইতে হবুচন্দ্র একফোঁটা জলও পাননি। তেষ্টায় সুকুমার রায়ের 'অবাক জলপান'-য়ের অবস্থা হয়েছিল তাঁর। তাই এবারে গবুকে সবিশেষ সাবধান করে দিয়েছিলেন এ ব্যাপারে।
কিন্তু এ কী! প্রতি পনেরো মিনিট চড়াই ভাঙলেই দেখা দিচ্ছে একাধিক চায়ের দোকান! এটা কি স্বপ্ন না সত্যি? পরখ করার জন্য তাঁরা প্রতিটি দোকানে দাঁত বার করে বসলেন, চা চাখলেন এবং পুলকভরে ঠ্যাং নাচালেন। এত সবের পরেও সূয্যিমামা ভালো করে পশ্চিম আকাশে কাত হবার আগেই হবু-গবু উলেরি উঠে এলেন। হবুচন্দ্রের মনে পড়ে গেল গতবার এখানেই রাত্রিবাস করেছিলেন এবং জায়গাটি তাঁর বেশ লেগেছিল। অতএব বিধান দিলেন — 'পাদমেকং ন গচ্ছামি'। গবু অতি সুবোধ বালক। সুড়সুড়িয়ে লজে বোঝা নামিয়ে হবুর পাশে চায়ের গ্লাস হাতে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
অরণ্যময় পাহাড়ের ঢালে উলেরি। পাথর-বাঁধানো পথটা গ্রামের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে মোচড় মেরে ঘোড়োপানির উদ্দেশে ছুট মেরেছে। তার দু-পাশে হাত-পা ছড়িয়ে ঘরবাড়ির জটলা; তার বেশিরভাগই লজও বটে। উলটোদিকের পাহাড়ের গায়ে ঝুম চাষের আঁকিবুঁকি। উত্তর দিক থেকে সদাসতর্ক সস্নেহ নজর রাখছে অন্নপূর্ণা সাউথ আর হিউঁচুলি। সেদিক থেকে এসে হিমেল বাতাস হবু-গবুর শরীরে শীতল স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে। পথ বেয়ে ট্রেকারদের আনাগোনা ছাড়া সর্বত্রই আলস্যের আবহাওয়া। রংবেরঙের পাখিরা আরামে উড়ছে আকাশে। পথের ধারের কলে গ্রামের মেয়েরা ধোয়াকাচার ফাঁকে হাসিঠাট্টায় মেতেছে। বেশ একটা স্বর্গ স্বর্গ ভাব। সূয্যিমামা পশ্চিম পাহাড়ের আড়ালে মুখ লুকোতেই কোথা থেকে মেঘেরা দলে দলে শেষবেলার আবির মেখে অন্নপূর্ণার দিকে তেড়ে গেল। ঠাণ্ডাটা 'বেশ' থেকে 'বাপ-রে'-র দিকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল। অদৃশ্য এক শিল্পী কমলা আর গোলাপী রঙ নিয়ে তুলি চালিয়ে কিছুক্ষণ এক অপূর্ব খেলায় মাতল। তারপর কে জানে কেন, গোটা ক্যানভাসটার ওপর একখানা মিশকালো চাদর চাপা দিয়ে সরে পড়ল; রাত নামল। হবু-গবু শীতে জবুথবু হয়ে খেয়েদেয়ে ঘুমথলিতে ঢুকে পড়লেন।
ভোর হলো পাখির ডাকে। প্রতিদিনের মতো অন্নপূর্ণা সাউথ আর হিউঁচুলি কনকসাজ শেষ করে সাদা জোব্বা পরে নিল। হবু-গবু 'যথাসময়ে' পা রাখলেন পথে। এট্টুখানি চড়াই ভেঙে প্রায় সমতল পথ পেয়ে তাঁরা যে মহাখুশি, সেটা বুঝতে চারদিক ঘিরে রাখা গাছপালা পাখপাখালির একটুও অসুবিধে হলো না। গতকাল উলেরির চড়াইতে হবুচন্দ্রের ভুঁড়ি কাঁপছিল 'থরোথরো'। আর আজ 'ময়দান বাটো' পেয়ে সে এখন তুড়ুক নৃত্য জুড়েছে। বনপথের বনস্পতিরা কাছে ঘনিয়ে এলো সস্নেহে। হবু গবু প্রফুল্লচিত্তে বনপথ পেরোতে থাকলেন। ঘন্টাখানেক চলার পর বন যেন খানিকটা সরে বসল — বনথাঁটে। হবুচন্দ্র তো হাঁ!
এ কোন বনথাঁটে! গতবারে দেখা ঘন বনের মাঝে একটামাত্র পাথুরে ঝুপড়ি আজ রীতিমতো জনপদ! অন্তত দশটা লজ তাদের ওপেন এয়ার রেস্তোরাঁ নিয়ে হাজির। স্বাভাবিকভাবেই দুই চাতক বোঝা নামালেন এবং চা-টায় মাতলেন। মাছাপুছারে তাঁদের এই কার্যকলাপ দেখতে থাকল। অবশেষে মাছাপুছারেকে টা-টা জানিয়ে আবার অরণ্যস্থ হলেন দু-জনে। আলোছায়ার জাফরি কাটা বনপথে তাঁদের সঙ্গী হলো পাখির গান আর ঝিঁঝির কনসার্ট। একসময়ে বনের মাঝে গতবারের মতো এবার তার দেখা পেলেন — ছোট্ট সুন্দরী এক ঝরনা। কলকলিয়ে খলখলিয়ে তার নাচ দেখে হবু-গবু মুগ্ধ। বিমুগ্ধতা কাটিয়ে আবার ঘোড়েপানিমুখো হলেন তাঁরা। হবুচন্দ্রের মনে পড়লো, মিনিট দশ-বারো পা চালালেই একটা ছোট্ট চায়ের ঝুপড়ি আছে। মনে পড়ামাত্রই তাঁর বুকে চায়ের জন্য হাহাকার উঠল। তাঁর মনের কথা টের পেয়েই যেন জঙ্গল হঠাৎ দু-পাশে সরে গিয়ে চায়ের দোকানটাকে সামনে ঠেলে দিল। সে এখন গায়ে গতরে বেড়েছে। তার দর্শনেই হবু-গবু হঠাৎই টের পেলেন তাঁরা অসম্ভব পরিশ্রান্ত — গলা শুকিয়ে কাঠ। অতএব ...। আয়েস করে চা-পর্ব সমাপন করে তরতাজা হয়ে আবার হাঁটা লাগালেন তাঁরা।
দিনের অর্ধেকটা কেটেছে হাঁটাহাঁটি করে; বাকি অর্ধেকটুকু কাটল তাঁদের প্রিয় কাজ 'আলস্যে'। মাঝেমধ্যে অবশ্য খাদ্য-পানীয় গলাধঃকরণ করার জন্য হাত মুখ নাড়াতে হয়েছে। প্রাণ-জুড়োনো বাতাসের সঙ্গে যে সময়ও বয়ে যাচ্ছিল, সেটা হবু-গবু টের পেলেন, যখন দেখলেন এক অদৃশ্য জাদুকর অদৃশ্য জাদুদণ্ড ঘুরিয়ে সমস্ত দৃশ্য অদৃশ্য করে দিল। অগত্যা হবু-গবু লজের মধ্যে অদৃশ্য হলেন। দশ হাজার ফুটের জব্বর ঠাণ্ডারও যে এ ব্যাপারে বেশ খানিকটা হাত ছিল, সেটা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তাঁরা বেশিক্ষণ ঘরে টিকতে পারলেন না — ছিটকে বেরিয়ে এলেন। পূর্ণচন্দ্রের উদয় হয়েছে। তার জ্যোৎস্নায় তুষারশৃঙ্গের দল রূপকথার সাজে সেজেছে। বেশ কিছুক্ষণ তাঁরা এবং আরও অনেকে বাক্যহারা হয়ে রইলেন। হবু-গবুর দেবভক্তি মোটেই প্রবল নয়, তবুও তাঁদের মনে হলো, স্বয়ং মহাদেব তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বিশ্রাম করছেন। দেবতাদের বিশ্রাম দেখতে দেখতে হবু-গবুর মনেও বিশ্রামের ইচ্ছা জাগ্রত হলো ঘোরতরভাবে। দুপুর থেকে অতিবিশ্রামের ফলে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে তাঁরা সেরাতের মতো চোখ বুজলেন।
পরদিন সূর্যের আগেই ঘুম ভাঙল তাঁদের। উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে চায়ের মগ হাতে বাইরে বেরিয়ে এলেন। অদ্ভুত এক শীতল নৈঃশব্দ বিরাজ করছে। নানাবয়সী মেঘের দল ঘুম মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছে পাহাড়ের নানান খাঁজে। দু-পাঁচটা দাঁড়কাক প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে। ঘোড়েপানি দেওরালি (দেবদর্শনের স্থান) আর পুন হিল্স্-য়ে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে এক অপূর্ব প্রত্যাশা নিয়ে। তাদের দেখে নীল আকাশ লজ্জায় রাঙা হতে শুরু করল। অন্নপূর্ণা শৃঙ্গমালা আর ধৌলাগিরি, টুকুচে, ধামপুলের দল, সবাই যেন কোনও এক অসাধারণ মুহূর্তের অপেক্ষায় ধ্যানে মগ্ন। অবশেষে সকলকে কৃতার্থ করতে এলো সেই মহামুহূর্ত — দিনকর তাঁর স্বর্গরশ্মি দিয়ে একে একে সমস্ত তুষারকিরীটিদের কপালে টিপ পরিয়ে দিলেন। সেই টিপ সোনা হয়ে নামতে লাগল তাদের শরীর বেয়ে। হবু-গবুর মনে হলো তাঁরা ইন্দ্রসভায় উপস্থিত হয়েছেন। দেশী-বিদেশী নানান ভাষায় 'আ-হা-হা' শব্দব্রহ্ম উত্থিত হলো। এই মুহূর্তে 'আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে'।
হিমালয়ের ইন্দ্রসভা বেশ খানিকটা সময় নিয়ে নিয়েছিল, তাই বেরোতে দেরি হলো সকলেরই। আর, হবু-গবু তো এ ব্যাপারে চ্যাম্পিয়ন। তার ওপর শুনেছেন, আজ মোটে ঘন্টা পাঁচেকের পথ — তায় উৎরাই। অতএব, বেরোনোয় গড়িমসি, চলনেও গদাই-লশকরি। দু-পাশের আকাশ-ছোঁয়া সবুজের ফাঁক দিয়ে এসে সূর্যকিরণ গায়ে মাথায় উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। বাঁদিক থেকে সারাক্ষণ সস্নেহ নজর রেখে চলেছে সুস্থির ধৌলাগিরি। আধঘন্টায় চিত্রে-য় নেমে এসে তাঁদের মনে হলো বড্ড তাড়াহুড়ো হয়ে গেল। আর, পথের ধারের চা-বিপনি মুহূর্তে তাঁদের প্রাণে প্রবল চা-তৃষ্ণা জাগিয়ে তুলল। ব্যস, চেয়ারে হেলান দিয়ে সামনের টেবিলে চায়ের গ্লাসকে সাক্ষী করে চলতে লাগল তাঁদের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, যার কেন্দ্রবিন্দু ধৌলাগিরি মহারাজ। এঁকে জয় করতে এসেই ব্যর্থ হয়ে ১৯৫০ সালে মরিস হেরজগরা খুঁজেপেতে বার করে চড়ে বসেছিলেন অন্নপূর্ণার মাথায়। মানুষের প্রথম ৮০০০ মি. শৃঙ্গ জয়।
আধঘন্টা হেঁটে আধঘন্টা বিশ্রাম। হবু-গবুর আজকের রুটিন এই ছন্দেই বাঁধা হয়ে গেল। আঁকাবাঁকা খয়েরি পথের ফিতেটা বেয়ে নামতে নামতে তাঁরা এসে পড়লেন ফালাটে-য়। অত দোকানপাট দেখার পর কি কোনও বাঙালী আর না থেমে পারে? এবার শুধু চায়ে শানালো না, টা-ও দরকার হয়ে পড়ল। একসময় রোদ এসে পিঠে ঘনঘন টোকা দিতে লাগল — ওঠো হে পি-পু-ফি-শু যুগল, বেলা যে বাড়ল। হবু-গবু বলার চেষ্টায় ছিলেন যে, বেলা তো সবে সাড়ে দশটা, এত তাড়াহুড়োর কী আছে? কিন্তু, গ্রামের চৌহদ্দির বাইরে দাঁড়ানো গাছপালা, পাহাড়ের দল, এমনকী পাখিগুলো পর্যন্ত এমন হাসাহাসি শুরু করল যে, তাঁরা উঠে পড়তে বাধ্য হলেন।
খানিকটা নামতে অরণ্য আবার তাঁদের আলিঙ্গণ করল। রোদ্দুরের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে তাঁরা এগিয়ে চললেন। এই লুকোচুরির ফাঁকেই এসে পড়ল শিখা। দিব্যি ছড়ানো ছিটানো গ্রাম, প্রচুর চা-খাবারের দোকান। একে মা মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ। একে হবুচন্দ্র, তায় চা-খাবারের দোকান — যা হবার, তা-ই হলো। শুধু গোটা হিমালয় হবু-গবুর পেটুকপনা দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
একসময় সেটা টের পেয়ে হবু-গবু উঠে পড়লেন। চলি, চলি, চলি পথের যে নেই শেষ — এঁকেবেঁকে শুধুই নেমে চলা। ঘারায় এসে দাঁড়াতেই হলো। পেটে ছুঁচোয় ডব্লু ডব্লুই শুরু করে দিয়েছে। সূয্যিমামাও বড্ড ধমকাচ্ছেন। এক দিদির কাছে ম্যাগি-র অর্ডার দেওয়া গেল। দু মিনিটের ম্যাগি বানাতে দিদির চল্লিশ মিনিট লেগে গেল। সেই সময়টুকুর সদব্যবহার করলেন দুজনে — এতটা আয়াসের পর একটু আয়েস না করলে চলে! বেলা দুটো বাজে। সূয্যিমামার রাগ খানিক পড়েছে। তাতোপানি আর কত দূর হবে! মেরেকেটে আরও দু-ঘন্টা চলার পর হবু-গবুর দু-জোড়া পা বলতে লাগল — 'ঢের হয়েছে , এবার থামো না বাপু!' দু-জনে পা-দের বোঝালেন, 'নিয়ে চল বাপু। তাতোপানি আর কতদূরই বা!'
পথচলতি একজন কিন্তু তাঁদের পথে বসিয়ে দিল — তাতোপানি নাকি আরও দুই ঘন্টার পথ!
সোয়া ঘন্টার পর আবার 'আশ্বাস' — 'ব্যস, দুই ঘন্টা'! এবার দুজনে আক্ষরিক অর্থেই পথে বসলেন — মানে, পথের ধারে। ওঁদের মতো সূয্যিমামাও ক্লান্ত হয়ে পশ্চিম-পাহাড়ের আড়ালে বিশ্রামের তাল খুঁজছেন। পাহাড়ের গাছপালারাও ওঁদের অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ল। হবু-গবুর ঝুলে পড়া জিভ, ঘামে ভেজা জামা দেখে এক দয়ালু স্থানীয় ভদ্রলোক, সম্ভবত ছদ্মবেশী দেবদূত, পরামর্শ দিলেন ঘুরপথ ছেড়ে সামনের পাথুরে সিঁড়িপথ বেয়ে সরাসরি নেমে যাবার — না হলে আজ বনবাস অবশ্যম্ভাবী।
সিঁড়িতে উঁকি মেরে হবু-গবুর প্রাণপাখি খাঁচাছাড়া হবার দাখিল। একহাত চওড়া এবড়ো-খেবড়ো পাথরের সিঁড়ি প্রায় সত্তর ডিগ্রি ঢাল নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঝাঁপ মেরেছে পাতালে। মা কালী, মৌলা আলি, যীশুখৃষ্ট, গুরুনানক, ভগবান বুদ্ধর নাম নিয়ে একরকম চোখ বুজেই হবু-গবু পা রাখলেন পাতালপথে। একশো পা নামতে না নামতেই চারশো ছাগল উঠে এলো সিঁড়ি বেয়ে। প্রাণরক্ষার তাগিদে পথের ধারের ঝোপ আঁকড়ে 'তটস্থ' হয়ে রইলেন পাক্কা উনিশ মিনিট — যদিও, তাঁদের মনে হচ্ছিল উনিশ বছর। 'ছাগলমুক্ত' পথে ওঁদের নামার করুণ দৃশ্য দেখে মূহ্যমান হয়ে সূয্যিমামাও মুখ লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
ধুঁকতে ধুঁকতে হবু-গবু যখন সিঁড়ির শেষে একটা গাছের তলায় একমাত্র বাড়িটার আঙিনায় পৌঁছলেন, ওঁদের চোখের সামনে সব তখন দুলছে। কোনওমতে হবু মুখ থেকে একটা শব্দই বার করতে পারলেন, 'ব্ল্যাক টী'। তারপর পিঠের বোঝার সঙ্গে তাঁরাও গড়িয়ে পড়লেন। বহু নীচে তখন নদীর আভাস।
চামৃতে চুমুক দিতে দিতে জানতে পারলেন, তাতোপানি এখান থেকে মাত্র দশ মিনিট, পঁয়তাল্লিশ মিনিট অথবা তিন ঘন্টার পথ! হুই নিচে যে নদীকে দেখা যাচ্ছে, উনি কালীগণ্ডকী। ওঁর ওপারেই উষ্ণকুণ্ড নিয়ে তাতোপানির অবস্থান।
দম খানিকটা ফিরেছিল; হবু-গবু 'যা থাকে কপালে' বলে আবার পা পথে নামালেন এবং আধঘন্টায় নেমেও এলেন নদীর ধারে রাতোপানিতে। এখানে এসে আবিষ্কার করলেন, নদী একজন নয় দু-জন — দু-জনকেই পেরোতে হবে পরপর, অবশ্যই পুলে চড়ে। প্রথমজন পূর্বপরিচিত ভুরুংচিখোলা; তিনি এখানে ঝাঁপ মেরেছেন কালীগণ্ডকীর বুকে। পৃথিবীর প্রাচীনতম নদীদের অন্যতমা। তাঁর প্রথম দর্শনে উদ্বেলিত হয়ে পড়ার মতো শক্তি আর তাঁদের অবশিষ্ট ছিল না। এখন তাঁরা চলেছেন বাধ্য হয়ে — কোনও কিছু উপভোগ করার ক্ষমতা তাঁদের আর নেই।
ওপারে পৌঁছে চা-ঝুপড়ি পেয়ে দুনিয়ার সেরা 'এনার্জি ড্রিংক' কালো চা-য়ে গলা ভেজাতে ভেজাতে। হবুচন্দ্র অমৃতবাণী শুনলেন, তাতোপানি সত্যিই আর দশ মিনিটের পথ। হা-ক্লান্ত হবু-গবু অবশেষে সাড়ে দশ ঘন্টা পর 'অন্তবিহীন' পথ পেরিয়ে তাতোপানি পৌঁছলেন। তাঁদেরকে লজের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়ে সূয্যিমামা নিশ্চিন্তে বিশ্রামে গেলেন।
(*) প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক শিশিরকুমার মজুমদার
(*) লীলা মজুমদার
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)