ঐ সিন্ধুর টিপ,শুধু কাঞ্চনই নয়, এই ছোট্ট দ্বীপটি নানা রং-এর মণিমাণিক্যেও ভরা। অনেকদিনের ইচ্ছে, ঐ রাবণ-রাজার দেশ সিংহল (অধুনা শ্রীলঙ্কা) দেখার। সেইসঙ্গে মণিমাণিক্যের খনিগুলোও। এইবার সুযোগ এসে গেল। শ্রীলঙ্কার যুদ্ধ আপাতত স্থগিত। সুনামীরও নাম-গন্ধ নেই। বেড়াবার উৎকৃষ্ট সময়। একটাই মুশকিল যে ওদেশে দু-দুটো বর্ষাকাল—জুলাই-অগস্ট ও নভেম্বর-ডিসেম্বর—একটা না একটার খপ্পরে পড়তেই হয়। আমি অবশ্য বর্ষা সম্বন্ধে ভীষণ রোমান্টিক (বিদেশে থাকার সুবিধা), তাই বর্ষা অগ্রাহ্য করে নভেম্বরেই প্ল্যান করলাম। ফাউ-এর মধ্যে পেয়ে গেলাম—আম! ওদেশে ওই সময়ে আমের মরশুম। তাছাড়া বর্ষা বলে ট্যুরিস্টদের ভিড় কম ও হোটেলের রেটও কম। বিরাট, সুন্দর বাগানবাড়ি হোটেলগুলোয় আমরাই একমাত্র অতিথি। তাই, আমার মতে, এই সময়টাই বেড়াবার পক্ষে সবথেকে ভালো। কয়েকফোঁটা বৃষ্টিতে কি আসে যায়!
সিংহল দ্বীপ,
কাঞ্চনময় দেশ!
|
শ্রীলঙ্কা দেশটি ছোট্ট ও যুদ্ধবিক্ষত হলেও আপাতদৃষ্টিতে বেশ পরিষ্কার, ছিমছাম। শহর বা গাঁয়ে কোথাও ময়লা আস্তাকুঁড়, জঞ্জাল, বা এখানে সেখানে আরো নোংরা কিছুর দেখা পাইনি। দেয়ালে বিশ্রী পোস্টারের ছয়লাপও নেই। শহরের মধ্যে ঘিঞ্জি বাড়িঘর, মেরামতহীন ভাঙাচোরা দোকান, বর্ষার কাদাজল ইত্যাদি অবশ্য আছেই। যুদ্ধের দরুন অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের ছাপ বেশ প্রকট। অনেকটা ৫০-৬০ দশকের ভারতের কথা মনে পড়িয়ে দেয়—যানজট, ধোঁয়াশা, ভিড় এইসব সমেত আগেকার ঢিমেতালে চলা ভারত। অবশ্য ভারতের শহরের সঙ্গে তুলনা করছি। এখানে গাছের পাতা কিন্তু এখনো উজ্জ্বল সবুজ, গাড়ির ধোঁয়ায়, ধুলোয় কালো হয়ে যায়নি। গাড়ির বদলে পায়ে চলা লোকেদের ভিড়। বড়ো শহর ও শহরতলির ব্রিটিশ আমলের বাড়িগুলি হোটেলে রূপান্তরিত হয়েছে। বিরাট টানা বারান্দা, গভীর নরম আর্ম-চেয়ার, চারিদিকে চোখ জুড়োনো সবুজ গাছপালা। দেখেও চোখের আরাম। বাগানগুলো আম, আতা, পেঁপে, নারকোল গাছে ভর্তি। অনেকদিন পরে যেন আমার ছোটোবেলার ভারতকে ফিরে পেলাম।
শুধু ভাষারই একটু গোলমাল। দুই প্রধান ভাষা—সিংহলী ও তামিল। দুই-ই আমার দুর্বোধ্য। যারা একটু ইংরেজি জানে তাদের বুলিও বুঝে ওঠা কষ্টকর। (দক্ষিণ ভারতীয় অ্যাক্সেন্ট মনে করুন।) দেশের উত্তর কোণে তামিলদের প্রাধান্য। কিন্তু যুদ্ধের দরুন আমি ওদিকে পা বাড়াইনি। বাকি দেশটায় সিংহলী ভাষার চল। বেশিরভাগই বৌদ্ধ; কিন্তু অনেক হিন্দু, ক্রিশ্চান ও মুসলমানও আছে।
|
খাওয়াদাওয়ায় দক্ষিণ ভারতীয় প্রভাব স্পষ্ট। রান্নায় লংকা ও নারকোলের প্রতিপত্তি। এঁরা ঝাল খেতে পারেন খুব। লংকা ভাজা ও মশলা দিয়ে বাটা ছিল আমার প্রিয় খাবার। মাছ, মাংস ইত্যাদি দিয়ে মশলাদার কারি খুব জনপ্রিয়। বড়ো হোটেলে পশ্চিমী খাবারও পাওয়া যায়—স্বাদ অবশ্য সিংহলী।
কলম্বোতে নেমে আমরা দূরপাল্লার ট্যাক্সি ভাড়া করে অনুরাধাপুর পাড়ি দিলাম। কলম্বোর ভিড়, ধুলো ও জীর্ণ ব্রিটিশ আমলের বাড়ি দেখার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। অনুরাধাপুর কলম্বো থেকে প্রায় দু'শ কিলোমিটার উত্তরে। এটাই সিংহলের ঐতিহাসিক রাজধানী এবং সযত্নে সংরক্ষিত বৌদ্ধস্তূপ ও প্যাগোডার জন্য বিখ্যাত।
|
সুন্দর মসৃণ রাস্তা, দু'পাশে উজ্জ্বল সবুজ ধানের ক্ষেত, বর্ষার জলে টইটুম্বুর। পাশে টেলিগ্রাফের তারে লেজ ঝোলানো ফিঙে পাখি। মাথার ওপর মেঘমেদুর আকাশ। ঠিক অবিকল বর্ষার বাংলা!
|
অনুরাধাপুরের পত্তন গৌতম বুদ্ধের সময়ে। সম্রাট অশোকের এক ছেলে মহিন্দ এইখানে প্রথম রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। সে প্রায় ২৪০০ বছর আগের কথা। এখানে অনেক স্তূপে ও ডাগোবায় (প্যাগোডা) বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মঠ আছে—থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও। সবথেকে পুরোনো ডাগোবাটির নাম অভয়গিরি। কালো পাথরের তৈরি, গায়ে শতাব্দীর শ্যাওলা। ফা-হিয়েনের ভ্রমণকাহিনিতে এই স্তূপের বর্ণনা আছে।
|
অভয়গিরি ডাগোবার কাছেই আছে সিংহলের বিখ্যাত বোধিবৃক্ষ। গয়ায় যে অশ্বত্থ গাছের তলায় বুদ্ধের জ্ঞানলাভ হয়, সেই গাছেরই একটি ডাল কেটে নিয়ে খ্রিঃপূঃ ২৮৮ সালে এখানে পোঁতা হয়। তারই শাখাপ্রশাখা বেড়ে এত শতাব্দীর ঝড়-জল সয়ে এখনো গাছটি বর্তমান। পৃথিবীর সবথেকে পুরোনো হাতে-পোঁতা গাছ হিসেবে খ্যাত। এটি পৃথিবীর সব বৌদ্ধদেরই বিশিষ্ট পুণ্যস্থান। এর আশে পাশেও কয়েকটা অশ্বত্থ গাছ লাগানো হয়েছে—জল, ঝড় ও বাঁদরের উৎপাত আদি গাছের ওপরে যদি একটু কমে।
|
অনুরাধাপুরেই আছে অতি প্রাচীন ইসুরমুনিয়া গুহা ও মন্দির। একটি হ্রদের মধ্যে কালো পাহাড়ের খাঁজে প্রায় ১২০০ বছরের পুরোনো গুহাগুলি আধা অন্ধকার, ঠাণ্ডা ও স্যাঁতসেঁতে। কয়েকটা গুহা বাদুড়ে ভর্তি। সারা দেশেই আমি লক্ষ করেছি সন্ধে হলেই ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় বেরোয়। বেশ বড়োসড় (হাঁস মুরগি সাইজের) চেহারা, বেশিরভাগই ফলাহারী। সারা দেশে ইলেকট্রিক তারে ঝোলা মরা বাদুড় বা তার দেহাবশেষ দেখতে পাবেন।
|
বাদুড়ের স্বভাবই উলটো হয়ে ঝোলা—ওপরের তার থেকে ঝুলতে গিয়ে যদি নিচের তারে ছোঁয়া লাগে তাহলেই মরণ। বেচারা বাদুড়। এভাবে যে কত শত মারা প্রতি বছর কে জানে। দুটো তারের মধ্যের ফাঁকটা যদি আরো দু'ইঞ্চি বাড়ানো যায় তাহলেই এরা বেঁচে যায়, কিন্তু এই অহিংস বুদ্ধের দেশে এনিয়ে কারুর মাথাব্যথা নেই।
|
শহরের পাশেই তিস্সা হ্রদের কিনারায় সুন্দর বাগানবাড়ি হোটেলে ছিলাম। চারিদিকে আমের গাছ—কাঁচাপাকা আমে ভর্তি, কিন্তু হনুমানজীর বংশধররা বোধহয় একটিও পাকা ফল রাখবে না গাছে। আমি কিন্তু অনেকবছর পর নুন মরিচ দিয়ে কাঁচা আম খেলাম। হোটেলের কর্মচারিরাই যত্ন করে পেড়ে খাওয়ালো। হোটেলে একমাত্র অতিথি হওয়ার এটাই মজা।
পাকা ফল রাখবে না গাছে" |
অনুরাধাপুর থেকে দক্ষিণে, দেশের ঠিক মাঝখানে, পাহাড়ে ঘেরা শহর ক্যাণ্ডি। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এটাই রাজধানী ছিল এবং পাহাড়ি জায়গা ও গরম কম বলে ব্রিটিশদেরও কাছে ছিল খুব প্রিয়। এখনো শহর জুড়ে তাদের চিহ্ন বর্তমান।
ক্যাণ্ডিতেই আমি লক্ষ করলাম নানা সাইজের মণিমাণিক্যের দোকান। সবই দেশীয় পাথর, খুঁড়ে এনে, কেটে, পালিশ করে, গয়নায় বসিয়ে চোখ ধাঁধানো অলংকার বানিয়েছে। কেনাকাটার সামর্থ্য না থাকলেও শোকেসগুলো দেখে বেশ সময় কাটানো যায়।
|
ক্যাণ্ডিতেই আছে মণির থেকে দুর্মূল্য—স্বয়ং বুদ্ধের দাঁত। বাঁদিকের নিচের পাটির একটি দাঁতের অংশ। শোনা যায় বুদ্ধের মহাপ্রয়াণ ও সৎকারের পরেই কেউ বা কারা তাঁর দেহাবশেষ উদ্ধার করে নেয়। এই দাঁত হাতবদল হতে হতে সিংহলে এসে পৌঁছয়। প্রথমে অনুরাধাপুরে এবং পরে ক্যাণ্ডিতে। কিংবদন্তী মতে দাঁতটা যার হাতে থাকবে সেই রাজশাসক হবে। বলাবাহুল্য অনেক কাড়াকাড়ি, মারামারির পর এখন গত চারশ' বছর ধরে দাঁতটি ক্যাণ্ডিতে এক বিরাট মন্দিরে অধিষ্ঠিত। এবং স্বয়ং বুদ্ধের দেহাবশেষ বলে এইটি বৌদ্ধদের সর্বপ্রধান পুণ্যভূমি।
তবে এমন দুর্লভ দাঁতের দর্শন পাওয়া সহজ নয়। দাঁতটি ঘিরে বিরাট মন্দির ও বাগান। সেখানে অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে, ভিড়ের গুঁতোগুঁতি হজম করে অভ্যন্তরীণ কোষ্ঠে পৌঁছলাম। কিন্তু সেখানেও দূর থেকে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে দেখা যায় বুলেটপ্রুফ কাচে ঘেরা, মণিমাণিক্যে মোড়া, ফুলচন্দনে লেপা এতটুকু জিনিস। খালি চোখে ভালো করে দেখাই যায় না। তা হলেও দেখা তো হলো। আমার পুণ্যে এইটুকুই মাপা ছিল।
ক্যাণ্ডি থেকে দক্ষিণমুখী হলাম। এবার শুরু হলো রত্নখনির দেশ। আমাদের গন্তব্য—রত্নপুর। নাম শুনেই বোঝা যায় শহরের প্রধান ব্যবসা কি।
|
ক্যাণ্ডি থেকে রত্নপুরের পথে পড়ে নানা আয়তনের ছোটো, বড়ো চা বাগান ও মশলার বাগান। শ্রীলঙ্কার চা তো পৃথিবীখ্যাত। চায়ের চাষ চলে সব জায়গায়—ছোট্ট এক চিলতে বাগান থেকে শুরু করে বিরাট প্ল্যান্টেশান অবধি। হাঁটু-উঁচু চা-গাছগুলির সবথেকে নরম, নতুন, ছোট্ট পাতাগুলি ছেঁড়া হয়। তারপর সেগুলি শুকিয়ে, পাকিয়ে, ছোটো ছোটো করে কেটে, আমাদের পরিচিত চা-পাতায় রূপান্তরিত করা হয়। সব কিছুই বাগানের মধ্যেই পুরোনো মেশিনে বা হাতে করা হয়। পুরোদস্তুর কুটিরশিল্প যাকে বলে। তারপর সেই পাতা ভালো করে প্যাক করে দেশে বিদেশে রপ্তানী হয়। এখন নাকি চীনের আশির্বাদে সবুজ চা-এর (green tea) খুব চাহিদা। এগুলোকে গেঁজিয়ে বা ferment করে কালো করা হয় না। সিংহলীরা গাঢ় কালো চা ছেড়ে সবুজ চায়ের নেশায় পড়েছে।
|
|
শ্রীলঙ্কার মশলা বাগানগুলোও দেখার মতো। ইয়োরোপিয়ানরা তো মশলার লোভেই এদেশে প্রথম পা দিয়েছিল। তখন মশলার দাম ও চাহিদা মণিমাণিক্যের থেকে কিছু কম ছিল না। সেইজন্যেই কি ওদের রান্নায় অত্যন্ত হাত টিপে মশলা দেবার অভ্যেসটা হয়ে গিয়েছে? আরে রান্নায় মশলা যদি নাই-ই খাস, তো কেন আমাদের দেশগুলো দখল করে নিলি অত বছর!
রান্নাঘরের অনেক পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের দেখা পেলাম। মাটির তলায় ও গাছের ডালে তাদের আসল রূপ যে কেমন তা তো আমার জানাই ছিল না। গোলমরিচের ছড়া, ভ্যানিলার বরবটি-ফল, হলুদের শিকড়, দারুচিনির বাকল, এলাচের কুঁড়িফুল, জায়ফলের বিচি, আরও কতো কি!
রত্নপুরের আশে পাশে, শ্রীলঙ্কার দক্ষিণপূর্ব ভাগে পুরাকাল থেকেই রত্নখনির কাজ চলে আসছে। শোনা যায় দু'হাজার বছর আগে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নদীতে স্নানের সময় বালির তলায় রত্নের খোঁজ পান ও সেগুলি কুড়িয়ে ভারতে চালান শুরু করেন। আরও নানারকম কিংবদন্তী আছে—যেমন রাজা সলোমন একটি বিরাট সিংহলী রত্ন তাঁর রানী শেবাকে উপহার দেন। রাশিয়ার জারের মুকুটে আছে ৮০০ ক্যারাট সাইজের স্পাইনেল (spinel, চুনির মতো রত্ন)। ব্রিটিশ রাজমুকুটের অনেক রত্নই সিংহল থেকে আমদানী করা। এই কয়েকবছর আগেও একটি মুঠো-সাইজের বৈদূর্যমণি (cat's eye; ৫০০০ ক্যারাটের) পাওয়া গেছিল।
এগুলি সবই শ্রীলঙ্কার মধ্য ও দক্ষিণ সমতলে ও নদীর বালুচরে পাওয়া। সিং হলের মতই রত্নখনি পাওয়া গেছে বার্মা (মায়ানমার), ব্রাজিল, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। কিন্তু আনুপাতিক হিসেবে সবথেকে ছোটো দেশ শ্রীলঙ্কায় এর প্রাচুর্য বেশি।
|
বৈদূর্যমণি ছাড়াও পাওয়া গেছে চুনি (ruby), নীলা (sapphire), চন্দ্রকান্তমণি (moonstone), spinel, গোমেদ (garnet), পোখরাজ (topaz), পদ্মরাগমণি (amethyst) ইত্যাদি। একমাত্র পান্না (emerald) ও নীলকান্তমণি (turquoise) ছাড়া পৃথিবীর সব মণিই এদেশে পাওয়া যায়। তবে আমাদের পরিচিত নাম চুনি, নীলা, গোমেদ, পোখরাজ ইত্যাদি।
|
মণিগুলির জন্যে অবশ্য খুব গভীরে খোঁড়ার দরকার হয় না। দশ থেকে কুড়ি মিটার গভীরেই বেশিরভাগ মণি পাওয়া যায়। একবার নদীর তীরে বা জলের তলায় মণির দেখা পাওয়া গেলে আশেপাশের এলাকা চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। জমির বা খেতের মালিক, সরকারি মণিবিশারদ এবং দিনমজুর ও চাষীরা সবাই লাভের অংশিদার হয়। চাষীরা হাতে কাজ না থাকলে খনির কাজেই উপরি রোজগার করে। মণির প্রাচুর্য অনুযায়ী খোঁড়ার কাজ কয়েকমাস থেকে কয়েকবছর পর্যন্ত চলতে পারে। কাজ শেষ হলে খনির গর্ত বুজিয়ে আবার চাষের কাজে মাটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
|
ছোটো ছোটো প্লটে সবই হাতে-খোঁড়া খনি। কোনোরকম আধুনিক মোটর বা ভারি মেশিনের ব্যবহার নেই। সরকারি দপ্তর থেকেই এ-বিষয়ে মানা আছে। ভারি মেশিনের ব্যবহারে চাষের জমি নষ্ট হয়ে যায়, এবং স্থানীয় চাষীদের উপরি রোজগারও বিপন্ন হয়। তাই এখনো সেই আদ্যিকালের শাবল, কুড়ুল ইত্যাদি দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে।
খনির প্রধান মালিক সরকার থেকে খোঁড়ার অনুমতি পান। তাঁর অধীনে দশ-বারোজনকে খোঁড়ার কাজে, মাটি থেকে কাঁকর ও মণি বাছা ইত্যাদির কাজে নিযুক্ত করা হয়। প্রথমেই কয়েকটি গাছ কেটে কর্মীদের থাকার জন্য একটি ছোট্ট কুঁড়েঘর বানানো হয়। গাছের গুঁড়িগুলি খনির দেয়ালে গেঁথে দেওয়ার কাজেও লাগে, যাতে দেয়াল ধ্বসে না পড়ে। খোলা খনির ওপর একটু ছাউনি তুলে দেওয়া হয়—যাতে ঝড়-জলে না ক্ষতি হয়। তারপর শুভ দিনক্ষণ দেখে, খনির ঠাকুরের পুজো করে মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু হয়। খনিগুলি ১০x১২ ফুট আয়ত—একটা সাধারণ কুয়োর মতোই গভীর। মাটির চাঁই চুপড়ি ভর্তি করে হাতে হাতে ওপরে তোলা হয়।
|
প্রতিটি চুপড়ি পরে নদীর জলে বা অন্য কোনো জলের নিচে নেড়েচেড়ে সাবধানে ধোওয়া হয়, যাতে কাঁকর-বালি থেকে মণির পাথর আলাদা করা যায়। এই কাজ করেন অভ্যস্ত মণিবিশারদরা। এটা অনেকটা দুই আমেরিকায় সোনা panning-এর মতো কাজ। ফেলে দেওয়া মাটি দিয়ে পরে খনির কাজ শেষ হলে খনির মুখ বুজিয়ে দেওয়া হয়।
|
এইভাবে খনি কাটার কয়েকটা কুফলও আছে। খনির গর্তে বর্ষার জল জমে মশার উৎপাত ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ে। পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে অনেকেরই চোট-জখম হয়। খনিতে বাচ্চা ছেলেদের কাজে লাগানোর জন্যে তাদের বিপদও বড়োদের চেয়ে আনুপাতিক হারে বেশি। সম্প্রতি তামিল টাইগার ও সিংহলীদের গেরিলা যুদ্ধের ফলে অনেক খনিই বন্ধ করা হয়েছে। অবশ্য যুদ্ধ-হাঙ্গামা উত্তরেই সীমিত, দক্ষিণে রত্নপুরের আশেপাশে কোনো বিপদ নেই আপাতত।
|
রত্নপুরে যে খনিটি আমি দেখেছিলাম সেটা নীলার। একটি ছোট্ট নীলধূসর পাথর দেখলাম—চার-পাঁচ মিলিমিটারের মতো। তাকেই কেটে, পালিশ করে দোকানে বিক্রি করলে পাথরের গুণ অনুযায়ী ২০০ থেকে ২০০০ ডলার পাওয়া যেতে পারে।
নীলার খনিটি আমাদের হোটেলের ঠিক পিছনে, ধানখেতের মধ্যে। আমার ধারণা ছিল মণি-মাণিক্যের কারবার, নিশ্চয়ই বড়ো কিছু হবে—সুরক্ষা ইত্যাদি থাকবে। কয়লাখনির মতোই হয়তো বিরাট সুড়ঙ্গ-ওলা। তার বদলে খোলা মাঠের মধ্যে একটা ছোট্ট ছাউনির নিচে একটা ছোট্ট কুয়ো! দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। তবু এই পুরনো প্রথাতেই শতাব্দীভর এত দুর্লভ সৌন্দর্য খুঁড়ে তোলা হচ্ছে।
(ভ্রমণকাল—নভেম্বর, ২০১৪)