• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬০ | আগস্ট ২০১৫ | উপন্যাস
    Share
  • অরণ্যকথা আইভি চট্টোপাধ্যায় ১ | ২ | : আইভি চট্টোপাধ্যায়


    || ছয় ||

    বে বর্ষাকাল শেষ হয়েছে। বর্ষাকাল মানেই এইসব পাহাড়ি গ্রামে নানান অসুবিধে। একে তো টিলা আর পাহাড়, মাঝে মাঝে ক্ষেত। আর জঙ্গল। শাল মহুয়া হরিতকী বহেড়া। আমলকি কেঁদ অর্জুন। আজ আকাশটা পরিষ্কার। বিকেলে রঙ্কন থানে বিনধা। এ-গ্রাম থেকে দলে দলে লোক মেলায় যাচ্ছে। ভোরবেলায় রোজকার মতই পাখিদের সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়েছে সবাই। তারপর থেকেই মেলায় যাবার প্রস্তুতি। রঙ্কন থানে পুজো দিক বা না দিক, মেলায় যাবেই সব। সুমিত্রার ভাই বোনেরা সবাই যাচ্ছে। মেলায় যাবার উত্তেজনা থেকে মুখ ফিরিয়ে একা একা চলেছে সুমিত্রা। সুমিত্রা ন্যান্সি বাস্কে।

    গাঁয়ের ক’ঘর মাত্র গীর্জায় যায়। বাকিরা তো সারা বছর এসব নিয়েই থাকে। এই তো কদিন আগে বাদনা পরব গেল। আবার এই মেলা। বছর শুরু মাঘবোঙ্গা দিয়ে। তারপর একে একে ফাগুনবোঙ্গা, চাতবোঙ্গা, বৈশাখবোঙ্গা, জেঠবোঙ্গা, আষাঢ়বোঙ্গা, সানবোঙ্গা, ভাদরবোঙ্গা, দাসায়ঁবোঙ্গা, সোহরায়বোঙ্গা, আঘাঁড়বোঙ্গা, পুষবোঙ্গা।

    প্রতিমাসে পুজো। প্রতি পুজোয় উত্সব। চাতবোঙ্গায় সেন্দ্রা-উত্সব, বৈশাখবোঙ্গায় অযোধ্যা-সেন্দ্রা, জেঠবোঙ্গায় রাজা-সাকরাত, আষাঢ়বোঙ্গায় চিতাউ-পরব। আরো আছে। হল পুনহিয়া, সরহুল, ভাগতা পরব, রোহিন, করম, বাদনা, টুসু। হই হট্টগোল। মহুলের নেশায় মাতাল মানুষ। নাকাড়া ধামসা, মন্দির থানে ছাগল মোষ বলির রক্ত, নেশায় উত্তেজিত মানুষ।

    আর লাল টালির শান্ত গীর্জায়? অরগ্যানের শব্দ, চাবির ঝুমঝুম। যিশুবাবার মায়া মায়া হাসিমুখ, অ্যাঞ্জেলের সাদা ডানা, আলো আলো মোমবাতি। কোলাহল নেই। শান্ত। শান্তি। খুব ভালো লাগে সুমিত্রার।

    আজ রবিবার। এখান থেকেই গীর্জার চূড়া দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট গীর্জাটা একটা টিলার ওপর। আশেপাশে বেশ খানিকটা বুনো ঝোপঝাড় ছিল। সিস্টার এসে সেখানে বাগান করেছিলেন। গাজর, শালগম, বেগুন, লঙ্কা। সুমিত্রা ফুলের গাছ লাগিয়েছিল। এতদিনে সেই গাছগুলোও বেশ বড় হয়েছে। রবিবার রবিবার ফাদার ব্যস্ত মাস নিয়ে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে ‘জয় যিশু জয় যিশু, জয় প্রভু জয় তব।‘ বাগানের মাটি ঝুরো ঝুরো করে আলগা করতে করতে সুমিত্রা আনমনে গলা মেলাত। সিস্টার একদিন স্কুলে ভর্তি করে নিলেন।

    সুমিত্রার বাপকে গ্রামের আরো পাঁচজনের সঙ্গে তার আগেই ক্রিশ্চান করে নিয়েছেন ফাদার। ফাদার শিখিয়েছেন, সিস্টার শিখিয়েছেন। ‘লাভ দাই নেবার।'

    ফাদার নিশ্চয় এতক্ষণে উঠে মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে ফেলেছেন। ফাদার স্টিফান। সেবার কাজ নিয়ে এসেছিলেন গ্রামে। এতদিনে মোট ন’ঘর ক্রিশ্চান করা গেছে। মাটির ঘর, না খেতে পাওয়া, অশিক্ষা আর কুশিক্ষায় জীর্ণ মানুষ। মোমের নরম আলোয় বাইবেলের গল্প, অন্ধকারে ঘন জঙ্গলের ছায়ায় দেবপুত্রের জীবনপাঠ। মুক্তির গান শেখানো কি সহজ কাজ! এই গীর্জার সম্পত্তি, পেতলের বাসন, পাথর বসানো মোমবাতি স্ট্যান্ড। উত্তরাধিকারী চাই না? কত কষ্ট করেছেন দেবপুত্র! আর ফাদার স্টিফান পারবেন না!

    এখান থেকেই গীর্জার অরগ্যানের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নীলমনির সঙ্গে দেখা করে একবার গীর্জায় যাবে আজ। ফাদারের ইচ্ছেতেই আজ নীলমনির কাছে যাচ্ছে সুমিত্রা। নীলমনির সঙ্গে দেখা করে সিস্টারের সঙ্গেও দেখা করতে হবে।

    নীলমনি সাঙ্গা। না, না। নীলমনি ভেরোনিকা সাঙ্গা। ও এসেছে বোরো পাহাড়ের ওপরের গ্রাম থেকে। কালো তেল চপচপে চুল, চ্যাপটা নাক। ওর বাপ-মা নীলমনি আর তার ভাইকে গীর্জাকে দান দিয়েছে। ভাই ব্রাদার হবে একদিন, নীলমনি সিস্টার। আরো পাঁচটা ছেলেমেয়ে আছে, তারা সবাই ক্ষেতের কাজের সঙ্গে সঙ্গে চার্চের কাজ করে। নীলমনিকে সদরের স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছিলেন ফাদার। সুমিত্রার স্কুলে। নীলমনি থাকতে পারেনি। কারো সঙ্গে মিশতে পারেনি। ক্লাসের শেষ বেঞ্চে একা একা বসে থাকত। টিফিনের সময়ও একা একা। শান্ত, কিন্তু উদ্ধত। নীলমনিকে কেউ পছন্দ করেনি। নীলমনিও কাউকে গ্রাহ্য করেনি।

    প্রথম প্রথম সবাই মেশার চেষ্টা করেছিল। সুমিত্রা বাসন্তী কুনি। নানান জঙ্গলের গ্রাম থেকে ফাদারের জন্যেই যারা সদরের স্কুলে পড়তে যেতে পেরেছে। বন্ধুদের বেশ একটা দল। কিন্তু নীলমনি বলত, ‘আমার পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস পড়তে ভালো লাগে না। আমাদের বোঙা পুজো বেশি ভালো।' হস্টেলের লনে বসে বোঙা পুজোর গান গাইত। সুপার শুনলে কি হবে, সে ভয় নেই।

    সুমিত্রা বলেছিল ফাদারের কথা। গ্রামের ছোট্ট গীর্জাটার কথা। গীর্জার অরগ্যানের সঙ্গে ফাদারের গান শুনে ছোট্ট চড়াই পাখিগুলো কেমন আনন্দে নাচে। নীলমনি বলত টুসুপরবের নাচের কথা। মাদলের বোল আর বাঁশির সুর। ওদের গ্রামের ছোট্ট মুসার নাচ। মুসা নাকি এমন নাচে যে সারা গাঁ নাচতে নামে। এমনকি ইঁদুরগুলাও।

    ভোরবেলায় কিংবা নিঝুম চাঁদের রাতে শালগাছের ফুল মাথায় গুঁজে গলায় সবুজ লতার মালা জড়িয়ে হস্টেলের বাগানে একা একাই নাচত। হস্টেল পালিয়ে রবিবারের হাটে চলে যেত। পাহাড় থেকে গ্রাম থেকে মানুষজন আসে হাটে। তাদের সঙ্গে হা হা হি হি। নিষিদ্ধ সব খাবার খেয়ে আসত। জংলীদের সঙ্গে হাটে গিয়ে নাচত নীলমনি। বেগুন আর কাঁচা লঙ্কা বিক্রী করে জংলী মেয়েটা, তাকে নিয়ে একদিন হস্টেলের গেট পর্যন্ত এসেছিল। হস্টেলের চৌকিদার সুপারের কাছে নালিশ করেছে, মেয়েটা মহুয়ার নেশা করেছিল।

    নীলমনিকে ভালো লাগত না সুমিত্রার। ইংরেজি অঙ্ক ইতিহাস ভূগোল পরিবেশ। কত পড়া। নিউ টেস্টামেণ্ট থেকে ডেভিডের নির্ভুল গাথা আবৃত্তি করে সিস্টারের হাত থেকে প্রাইজ। কারেকশনের খাতা বয়ে নিয়ে টিচার্স রুমে পৌঁছে দেওয়া। প্রজেক্ট ফাইলের গন্ধমাদন বয়ে স্টাফরুমে পৌঁছে দেওয়া। নিজের খাতা ছাড়াও অন্য মেয়েদের বিজ্ঞান খাতায় ছবি এঁকে দেওয়া। সদরের স্কুলে গাঁয়ের মেয়ের জায়গাটা পাকা হচ্ছে তখন। নীলমনির জন্যেই সব গণ্ডগোল হয়ে যায়।

    বড়দিনের ছুটির আগে স্কুলের শেষ দিন পিকনিক। ফ্রায়েড রাইস হয়েছিল। মাংস দই মিষ্টি। নীলমনি হারিয়ে গেল।

    এবার গাঁয়ে এসে ফাদারের কাছে নীলমনির খবর পেয়েছে সুমিত্রা। সিস্টার নলিনী খবর দিয়েছেন ফাদারকে।

    বাস রাস্তা পেরিয়ে তিনটে বাঁশবন পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আরো অনেকখানি যেতে হবে। একটা ডুলুং পড়বে। আর একটা ছোট পাহাড়। তারপর একটা ছোট বস্তি দেখা যাবে। বারো ঘরের বস্তি। সেইখানে আছে নীলমনি। সিস্টারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কিন্তু নীলমনি ফাদারের সঙ্গে দেখা করতে আসতে রাজি হয়নি। তাই সুমিত্রা যাচ্ছে। নীলমনিকে বোঝাতে হবে। ক্রিশ্চান মিশনারী কনভেণ্ট স্কুল। লেখাপড়া শেখার মত ভালো আর কিছু হয় নাক!

    ফাদারের কাছে শিখেছে সুমিত্রা, ‘লাভ দাই নেবার।'

    সুমিত্রাদের ভালোবেসে নতুন জীবন দিতে চেয়েছেন ফাদার। সিস্টারও। মুণ্ডা গ্রামে সবাই নীলমনিকে ‘ডান’ বলে তাড়িয়ে দিচ্ছিল। ভাগ্যিস সিস্টার ছিলেন তখন। এদিকের জঙ্গলের গ্রামে ডাইনী বলে কত মেয়েকে যে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, বাইরের দুনিয়ার লোক সে খবর জানে না। সুমিত্রা যখন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, যোগি মাস্টারকে নিয়েই তো গাঁয়ে এমন কথা উঠেছিল। ‘মেয়াটাকে ডান বানাইবি তু! বিটিছেল্যা পড়ালিখা করলে ডান হয়।'

    যোগি মাস্টারকেই তো গাঁয়ের লোক ‘ব্যাটাছেলে ডান’ বলেছিল। গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেছে যোগি মাস্টারের পরিবার। আর গাঁয়ে ফিরবে না। শহরের স্কুলে পড়ায়। ছেলেমেয়ে দুজনেই স্কুলে পড়ে। গাঁয়ের মেয়ে বলে সুমিত্রার সে বাড়িতে খুব আদর। পুজোপার্বণে, টুসি বুবুর জন্মদিনে যোগি মাষ্টার হস্টেলে এসে অনুমতি নিয়ে সুমিত্রাকে নিজের বাড়ি নিয়ে যায়।

    শহরে গিয়ে, স্কুলে গিয়ে সুমিত্রা জেনেছে গাঁয়ের লোকের নানা ভুল শিক্ষা, ভুল সংস্কারের কথা। বোকা নীলমনি সেসব ছেড়ে এসে জংলী হয়েই থাকবে! জঙ্গলে থাকতে ভালো লাগে, তাই থাকুক। তাতে যিশুবাবার কথা শোনায় বাধা কোথায়! ফাদার শিখিয়েছেন, ‘জীবন এক যাত্রাপথ। পরম করুণাময় যিশু হাত ধরে নিয়ে চলেন সে যাত্রাপথে। জয় যিশু জয় যিশু জয় বাবা! না পারি বর্ণিতে তব মহিমা।'

    মাযের কথা মনে এল সুমিত্রার। বাপকে যখন ফাদার রাজি করিয়ে ফেললেন, রোজ বাড়িতে এসে যিশুবাবার ধর্মের কথা বলতেন, মা কান্নাকাটি করত। ‘সিংবোঙ্গা পাপ দেবে। বাপ দাদার ধর্ম। আমি ছাড়বক নাই।'

    এখন মাও বোঝে। ফাদারের সঙ্গে সঙ্গে চার্চের কাজে বাপ রাঁচী জামশেদপুর বিলাসপুর কত জায়গায় যায়। আগে গাঁয়ের বাইরে কোথাও গেছে নাকি? পাকা দালান হয়েছে। ভালো খাওয়া দাওয়া। ভাইগুলো স্কুলে পড়ছে। সুমিত্রা সদরের স্কুলে পড়ছে। মা নিজেই চার্চের কাজ করে ফি হপ্তায় কত রোজগার করে।

    এই যে সিস্টার নলিনী। সুমিত্রাদের মতই কালো গায়ের রঙ। কেরালার গ্রাম থেকে এসেছেন। মিশনারী স্কুলে পড়াশোনা। ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী হবার হায়ার এডুকেশন হয়েছে বিদেশে। চার্চে ওঁর আলাদা সম্মান। সুমিত্রাদের স্কুলে পড়াতেন, তারপর নিজের ইচ্ছেয় গ্রামে চলে এসেছেন।

    আপন মনে পথ চলছিল সুমিত্রা। অনেকদিন পর এমন জঙ্গলের পথে একা একা পথ চলা। জারুল কুর্চি শিমুল পলাশ। জঙ্গলের গন্ধ। ছায়া ছায়া পথ। মায়া মায়া শান্তি। কিন্তু সবটাই এমন নিবিড় শান্ত নয়। এখন নিজে নিজেই অনেক কথা বুঝতে পারে সুমিত্রা। আদিবাসীরা নিজেদের চেনে না। নিজেদের অধিকারের কথা বোঝে না। এই জঙ্গল নিয়েই যে কতখানি অধিকার, আদিবাসী জানে না। মাদল আর নাচ গান নিয়েই আছে।

    এই যে রঙ্কন থানের মেলায় দল বেঁধে বেঁধে চলেছে, রাস্তায় এমন অনেকগুলো দলের সঙ্গে দেখা হয়েছে, একবারও কি জঙ্গলের পানে চোখ তুলে তাকাচ্ছে মানুষগুলো? মাঝে মাঝেই জঙ্গল ফাঁকা, কোথায় গেল কচি কচি করম গাছ? খোকা শাল? একটুও কি ভাবে না কেউ? স্কুল আছে, শিক্ষক নেই। টিউবওয়েল আছে, তাতে জল নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, তাতে ডাক্তার নেই। কলেরা টাইফয়েডের ইনজেকশন আছে, স্বাস্থ্যরক্ষার শিক্ষা নেই।

    না। আনমনেই মাথা নাড়াল সুমিত্রা। নীলমনিকে বোঝাতেই হবে। নিজের জন্যে, সবার জন্যে, গাঁয়ের মানুষের জন্যে, জঙ্গলের জন্যে। বোঝাতেই হবে। সিস্টারকে অন্য কাজে যেতে হয়েছে, চার্চেরই নির্দেশ। ফাদার চাইছেন নীলমণি সিস্টারের অসমাপ্ত কাজটা করুক। গ্রামের লোকেরই জন্যে কাজ। সেবার কাজ, মুক্তির কাজ।

    সবে বর্ষা শেষ হয়েছে। লালচে জলে ডুলুং ভরভরন্ত। হাঁটু ছাড়িয়েও অনেকখানি জল। আসতে আসতে হেঁটে পেরিয়ে এল। এবার ছোট পাহাড়টা পার হলেই নীলমনির সঙ্গে দেখা হবে। অচেনা একটা ছবি দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে কি করছে মানুষটা? শহরের মানুষ। কাঁধে একটা ঝোলা। একটা বড় পাথরের ওপর একলা বসে আছে।

    কেমন ঘোর লেগে গেল সুমিত্রার। ছবিটা কি সত্যি? নাকি মনে মনে শহর ডাক দিয়েছে? তাই এখানে এসেও শহরের ছবি। রঙ্কন থানের মেলায় শহর থেকে অনেক লোক আসে। তেমন করেই বুঝি এসে পড়েছে এই মানুষ! তারপর জঙ্গলে পথ হারিয়েছে! মেলা তো এদিকে নয়। একেবারে উল্টো দিকে। এতদুরে এলই বা কি করে? ডেকে দেখবে নাকি একবার!

    না থাক। কে জানে কার মনে কি আছে। আজকাল অনেক অন্যরকম লোকজন আসে জঙ্গলে। ঘন ঘন মিটিং হয়। গাঁ থেকে লোকজনকে সে মিটিং-এ ধরে নিয়ে যায়। এ লোকটা কি মতলবে এসেছে কে জানে।


    || সাত ||

    কা একাই পাথরের ওপর বসে ছিল শমিত। ডমন আর বাসুদেব সঙ্গে ছিল। দুজনেই আজ মাঝপথে কাজ বন্ধ রেখে গ্রামে ফিরে গেছে। সকাল থেকেই অবশ্য ছটফট করছিল বাসু। নতুন বিয়ে করেছে। নতুন বউ মেলায় যাবার বায়না ধরেছিল। ডমনের ভয়ে টুরি মেলায় যেতে পারবে না। তাই নিজের বৌকেও বারণ করে এসেছিল বাসুদেব। এখান পথে দল বেঁধে মেলামুখো লোকজন দেখে বউয়ের জন্যে মন খারাপ।

    বাসু ফিরে যাবার পর থেকেই উসখুস করছিল ডমন। মেলা মানেই জবর নেশা। টান কাটানো সহজ নয়। তবে ও বোধহয় মেলায় যায়নি। এই টিলাটার ওপর বসে দূরে একটা হাট দেখতে পেয়েছে শমিত। ছাগলটপার হাট। মনে পড়ল, ডমন বলেছিল।

    ‘দুপরে ইকবার ছাগলটপার হাট যাবি বাবু? মুর্গা লড়াই দেখতি ভাল্লাগে তো তুর।' তেমন মন দিয়ে শোনেনি। রবিবার সকাল মানেই হাটবার। গেল রোববার মধুটুয়া হাটে মুর্গা লড়াই দেখে এসেছে। উল্লাস। চিত্কার। তুমুল উত্তেজনা। দিনভর নেশা। তারপর তিনদিন কাজে বেরোয়নি ডমন।

    একা একাই পাহাড় জঙ্গলে ঘুরেছে শমিত। তারপর এই টিলার পাথরের ওপর এসে বসেছে। লাকড়া ডুংরি। ডুংরির গায়ে বিশাল বিশাল সব পাথর। নেড়াই বলা যায়। খানিক দূরে এদিক সেদিক ছড়ানো বুনো ঝোপঝাড়। দুটো খরগোশ তার মধ্যেই খেলে বেড়াচ্ছে। মেঠো ইঁদুর। চড়াই তিতির শালিক। বিরামহীন কিচিরমিচির। ফাঁকা টিলার মাথায় নীলিম মেঘ। পাথরের গায়ে ভেজা হাওয়া। আজ সকালবেলায় এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। দূরে আরো একটা নাম না-জানা ডুংরি। গায়ে শালগাছের আদিম শিরোনাম। সামনে অনেকখানি ফাঁকা। মাঠ ভেঙে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে।

    কেমন একটা মন খারাপ। অজানা এক আশঙ্কা। কিছু একটা ঘটবে। কি যেন একটা হারিয়ে গেছে। সবটাই কি মনের ভুল! এত দুর্বল তো নয় শমিতের মন। এবার কি তবে ফিরে যাবার পালা! কোথাও কি থিতু হবে না মন!

    ফিরে গেলেই হয়। দেরাদুনে না গিয়ে কোরবা চলে গেলেও হয়। মা সেদিন ফোনে বলছিল, কোরবা থেকে একটা চিঠি এসেছে। হয়ত চাকরির চিঠি। হয়ত নয়। একটা চাকরি যখন তখন পাবে শমিত। এখানের কাজও তো মোটামুটি হয়েই গেছে। যে যে পাথরগুলো খোঁজার কথা, মোটামুটি পাওয়া গেছে। অযাচিত কিছু প্রাপ্তিও হয়েছে। গ্রাফাইট, বক্সাইট, সিলিকেট। অভ্র, ইউরেনিয়াম। জিঙ্ক কপার। কয়লা আর লোহার আকরিক পাথরগুলো তো আছেই। পলি-মেটালিক বেশ কিছু আকরিক পাথর পাওয়া গেছে, যা ভাবা যায়নি।

    নতুন একটা সোপস্টোন পেয়েছে শমিত ক’দিন আগে। অনেকটা কোমবারবালাইট স্টোনের মত, যেটা এদেশে পাওয়ার সম্ভাবনাই ছিল না। এখনো অবশ্য নিশ্চিত নয় শমিত। ল্যাবে পরীক্ষা না করলে বলা যাবে না। কিন্তু নানা রঙের এই সোপস্টোন চিলি ছাড়া অন্য দেশে দেখা গেছে বলে এখনো খবর নেই। যদি এটা কোমবারবালাইট না হয়, তবে নতুন কোনও পাথর। পাথর সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখে দেরাদুনের অফিসে পাঠিয়েছে শমিত।

    বেশ কিছু কায়ানাইট পাথর জোগাড় হয়েছে। ডমন ছেলেটার চোখ আছে, মানতেই হবে। এমন পাথুরে জায়গায় এমন অ্যালুমিনিয়াম-রিচ সিলিকেট পাথর! কাওলিনাইট বা চায়না ক্লে পাথরের যে কত অগুনতি রকম। সবুজ দেশে পাথরের বৈচিত্র্যও কম নয়। আরো বেশ কিছু নতুন পাথর যে পাওয়া যাবেই, তা নিশ্চিত। বিশেষ যে পাথরটার খোঁজে এখানে আসা, সেটা আর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এতদিনে একবারও তো চোখে পড়েনি।

    এবার এখানের পাট ওঠালেই হয়। জঙ্গলের নেশার টানে থেকে যেতে ইচ্ছে হয়। নইলে গ্রামটাও কেমন বদলে যাচ্ছে। নতুন নতুন লোক আসছে বাইরে থেকে। সিস্টার এসেছিলেন যখন, প্রায়ই বাইরের লোক আসা যাওয়া। এখন সিস্টার চলে গেছেন, এ গ্রামে গির্জা হবার সম্ভাবনা নেই বোধ হয়। কিন্তু বাইরের লোক এ গ্রামটা চিনে নিয়েছে। পাহাড়ের আড়ালে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গ্রামে মাঝে মাঝেই গাড়ি মোটরবাইক জিপ এসে পড়ে। গাঁয়ের সহজ জীবনে নতুন তরঙ্গ। চেনা লোকগুলো মাঝে মাঝে অচেনা। ডমন সঙ্গে থাকে বলে একটু ভরসা।

    আসল জোর অবশ্য টুরি।
    ‘তু আমাদেরই লোক। ই গাঁয়েই থাকবি তু। ইবার গীতিওড়া পাঠাব তুকে। তারপর আর ই গাঁ ছাড়ি যাতে পারবি নাই।'

    কথা শেষ হয় না। গম্ভীরমুখো ডমনও হাসতে থাকে।

    গীতিওড়া। মুণ্ডা যুবক যুবতীদের জন্যে আলাদা আলাদা রাত্রিকালীন আবাস। সেখানেই প্রাথমিক মন দেওয়া নেওয়া। শমিতকে গীতিওড়া পাঠিয়ে বাসা বাঁধবার ইচ্ছে টুরির। মাকে একবার কথাটা শুনিয়ে দেবার লোভ সামলাতে পারেনি শমিত।

    ‘ওরে বাবা। তুই আর ও গ্রামে থাকিস না বাবা।' সম্ভব হলে আদরের ঋষিকে তখনই মুণ্ডা গ্রাম থেকে নিয়ে যায় মা। বাসুদেবের বিয়ের কথা শুনে সে কি দুশ্চিন্তা! ‘ওসব বিয়ে টিয়েতে যাবার দরকার নেই ঋষি। শুনেছি ওরা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়।'

    বাসুদেবের বিয়ে গীতিওড়া থেকেই। ফুলমতিকে পছন্দ ছিল অনেক যুবকেরই। টুরি সব গল্প শুনিয়েছে শমিতকে। বেড়ার গায়ে বনতুলসী। ঝিঙেলতা। বেগুন, শিম, কুঁদরু। টুরি সবুজ একটা সংসার সাজিয়ে দিয়েছে শমিতের জন্যে। কুমড়ো লতাটা বেড়ার গায়ে তুলে দিল, একটা উচ্ছে কি দুটো শিম তুলে ফেলল, আর এক নাগাড়ে গল্প। শমিতের কাছে এলেই কথার ঝাঁপি খুলে বসবে টুরি।

    আহা টুরি! আর কাকেই বা বলবে! ডমনের সঙ্গে বিয়েটা বোধহয় সুখের হয়নি। সপ্তাহে একদিন হাটবারে সবজি আর বুনো আলু নিয়ে বিক্রি করতে যাওয়া ছাড়া কোথাও যাবার অনুমতি নেই। এমনকি নাচের আখড়াতেও না। শুধু পুজোর থানে আর গাঁয়ের কারো বিয়ে হলে যেতে পারে টুরি। তাও এইজন্যে যে টুরি অসম্ভব খাটতে পারে। বাসুদেবের বিয়ের সময় কেমন মিষ্টি গলায় গান গাইছিল। ওর এ গুণের কথাটা কেউ জানে না?

    ডমনকে এ নিয়ে কিছু বলতে সঙ্কোচ হয়েছে। শমিতের ঘরে যে টুরিকে কাজ করতে দিয়েছে ডমন, তা-ই বা কেন কে জানে। শমিত নেশা করে না, অথচ ডমনের নেশার যোগানে টাকা এই শমিতেরই জন্যে। শুধু সে জন্য? কে জানে। তবে টুরি আসে। পাত্থরবাবুর ঘরখানা টুরির কাছে একফালি আকাশ। একটুকরো মুক্তি।

    বাসুর বিয়ে একটা নতুন অভিজ্ঞতা। মুণ্ডা বিয়ে। বাসুদেব আর ফুলমতি একে অন্যকে পছন্দ করেছে। বাপ-মা নেই বাসুর। খুড়ার কাছে মানুষ। খুড়া তো ওই বুড়ো বনমালী। খুড়ার ছেলে সুবোধ। আরেক খুড়ার ছেলে এই ডমন। সুবোধ আর ডমনের সঙ্গে ফুলমতির বাড়ি পাকা কথা বলতে গেছিল শমিতও। টুরিই নিয়ে গেল জোর করে।

    টুরি বুঝিয়ে বলেছিল, কিভাবে যাত্রাপথে শুভ বা অশুভ বিচার করতে হবে। যদি দেখা যায়, গাই বাছুর একে অন্যকে ডাকছে, চাষের জন্যে জোয়ালে গরু জোড়া হচ্ছে কিংবা কেউ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ধান বা চাল, জলভরা কলসী হলে তো কথাই নেই। কিংবা একটা শেয়াল বাঁদিক থেকে ডানদিকে চলে গেল, তাহলে শুভ দর্শন।

    কিন্তু যদি দেখা যায়, কোদাল কুড়ুল শাবল হাতে কেউ হেঁটে যাচ্ছে কিংবা কুড়ুল দিয়ে কেউ গাছ কাটছে, অকারণে হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে গরু, তাহলে অশুভ দর্শন। মাঝপথ থেকে ফিরে আসতে হবে। বিয়ের এই বিশেষ রীতির নাম, টুরিদের মুণ্ডারি ভাষায়, ‘চেঁড়ে-উনি’।

    ফুলমতির বুড়ো ঠাকুরদা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব লক্ষণ শোনার পর বাড়ির লোক ডমনদের হাতের লাঠি আর ছাতা গুছিয়ে রাখল। তার মানে কন্যাপক্ষ রাজি। তারপর ইলি বা ধেনো মদ খাওয়া। পাকা কথার প্রধান অঙ্গ।

    ফুলমতির বাড়ি থেকেও এই ‘চেঁড়ে-উনি’ হল তারপর। বাসুর খুড়া ছাড়াও লায়াবুড়ো এসে বসে রইল। সব শুভ লক্ষণ মিলিয়ে নিয়ে ওদের লাঠি আর ছাতা গুছিয়ে রাখল। তারপর এবাড়ি থেকে শালপাতার দোনায় হাঁড়িয়া ঢেলে বাঁ হাতে ধরে ডান হাত দিয়ে ‘জোহার জোহার’। প্রীতি নমস্কার। টুরি গান ধরল,

    স্বর্গে আছেন সিংবোঙ্গা
    ধরতিতে আছেন পঞ্চ
    সব লক্ষণ ভালো
    সব লক্ষণ শুভ
    গান ধরল সবাই। ‘সিংবোঙ্গা দুটো ঘরের চাল একই খড়ে ছেয়ে দেবেন ... সিংবোঙ্গা এই চাল চিরকাল এক করে রাখুন।' আবার জোহার। জোহারের কাজ করে টুরি সেদিন জোহারনী। কি যে খুশি। অল্পেই বড্ড খুশি হয় মেয়েটা।

    আরেকদিন এল ফুলমতির বাড়ির লোকজন। এদের সমাজে বরপণ নেই। আছে কন্যাপণ। ‘গোনোংটাকা।' ফুলমতির বাড়ি থেকে এল মাটির তৈরি গুলি, আর বিড়ের মতো পাকানো শালপাতা। বাসুর খুড়া যত টাকা দিতে পারবে, ততগুলো মাটির গুলি রাখল। যতগুলো শাড়ি দিতে পারবে, ততগুলো সুতো জড়ানো শালপাতার বিড়ে। বাকিগুলো ফিরিয়ে দিল। ব্যস, বিয়ের কথা পাকা। তারপর বাসুর খুড়া আর ফুলমতির বাপের কোলাকুলি। ‘হাপারুর জোহার।'

    দুই গাঁয়ের দুই পাহান এসে হাত মেলানো। আর গান। মাদল।

    ‘লগনতেল’। ফুলমতি বসেছে নিজের মামার কোলে। ফুলমতির হাতে একমুঠো চাল, ক’টুকরো হলুদ আর পান তুলে দিল টুরি আর সুবোধের বউ। সব ঠিকঠাক হয়ে গেল।

    কদিন পরেই ‘অড়ংদি’। আসল বিয়ে উত্সব। তিনদিন আগে থেকে মাড়োয়া বা বিয়ের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে। মাড়োয়ার চারদিকে চারটে কচি শালগাছ, মাঝখানে একসঙ্গে ভেলোয়াচারা আর বাঁশের চারা পুঁতে দেওয়া হয়েছে। সেইখানে বসে হল ‘সাসাংগোসো’। বাঙালিবাড়ির গায়ে-হলুদ যাকে বলে। তারপর ‘চুমন উৎসব।' হলুদ রঙে ছোপানো কাপড়। বর-কনের একই সাজ।

    এরপর মূল বিয়ে। ফুলমতির বাড়ি যাবে বর বাসুদেব। ‘উলিসাখি।' উলি, মানে আমগাছকে সাক্ষী রেখে যাত্রা শুরু।

    নানা মজা। সেদিন রাতে কনের বাড়িতে এক জায়গায় থাকবে বর। জায়গাটার নাম ‘জালোম।' তার পরের দিন সকালে ‘চাউলহিপ।' একটা ঝুড়ির মধ্যে বসিয়ে আনা হল ফুলমতিকে। তিনবার ঘোরানো হল বাসুদেবের চারদিকে। তিনমুঠো চাল ছড়িয়ে দিল বাসু, কনের মাথায়। তারপর দুজনে আমগাছের কাছে। উলি-দারু বা আমগাছকে সাক্ষী রেখে বিয়ে। টুরি এসে তেল হলুদ মাখিয়ে দিল ফুলমতিকে। বাসুর কড়ে আঙুল একটু কেটে রক্ত বার করে একটা ন্যাকড়ায় ভিজিয়ে রাখা হল। একটু পরে সেই রক্তমাখা কাপড় ফুলমতির ঘাড়ে ছুঁয়ে দেবে বাসু।

    তারপর সিঁদুরদান। বর-কনে নিজেদের কপালে সিঁদুর দিয়ে তিনটে করে দাগ কাটল। দুজনের গায়ের কাপড় গিঁট দিয়ে বেঁধে দেওয়া হল, বাঙালিবাড়ির বিয়ের মত করেই। এবার চিঁড়ে-গুড় খাবার পালা। বিয়ে শেষ।

    ফেরার আগে গাঁয়ের দুই আইবুড়ো বয়স্কা মহিলা মাথায় কলসি নিয়ে ঝরনায় জল আনতে যাবে। দম দমা দম মাদল। সঙ্গে দুই মুণ্ডানী, হাতে তিরধনুক আর খোলা তরোয়াল। সেই জল এনে বর-কনেকে স্নান করানো। এবার আসল মজা। সুপুষ্ট একটা খাসি আনা হল বাসুদেবের কাছে। তরোয়ালের এক কোপে খাসির ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা। সেই খাসির মাংস আর ভাত। বিয়ের ভোজ।

    ঢাক ঢোল। বাঁশি কেন্দ্রি কাঁসি শিঙ্গা। মাদলের তালে তালে নাচ। হাত ধরাধরি করে নাচছে টুরি আর মেয়েরা।

    ‘কৈসন কৈসন বাজে জোড়ারে ধমসা
    কৈসন কৈসন বাজে করতাল
    শুন মালিনী গে
    ছুমুর ছুমুর বাজে করতাল
    মধুমাসে বাজে করতাল ...’
    বাসুর বিয়ে শমিতের কাছে একটা নতুন অভিজ্ঞতা।

    শাল আকন্দ মহুল। সিংবোঙ্গা পাহাড় ডুলুং আকাশ। পাহাড়ি ফুল। পাহাড়ি নারী পুরুষ। পুরুষ মাদল বাজায়, নারী তখন বুনোফুলে কালোয় আলো। নাচের তালে চিতল হরিণ। সহজ সরল আদিম জীবন। বাইরে থেকে কিছু লাগে না আদিবাসির। আহ! এত সুন্দর জীবন যদি শমিতের হত! সভ্যতার জটিলতা কাটিয়ে যদি এই লাকড়াডুংরির ওপর বসে পাহাড়ি ডুলুং-এ পায়ের পাতা ভিজিয়ে থাকা যেত!


    || আট ||

    টুরি দেখল, সুধীর আসছে। সুধীর, টুরির বাপের বাড়ির দেশের লোক। এই মেলায় অনেক শহুরে ছেলে আসে। সুধীর তাই টুরিকে দেখে এগিয়ে এসেছে, ‘তুরা এখেনে কেন? কার সঙ্গ সঙ্গ আসছিস?’

    টুরি কিছু বলার আগেই সাবি এগিয়ে এসেছে, ‘কেন গ বাপা? তু আসতে পার, আর আমরা আসবি নাই?’ কোন দূর সম্পর্কে যুগলমাঝি সুধীরের খুড়া। সাবিকে ভালই চেনে সুধীর। কিছু না বলে চওড়া হাসল।

    সুধীরকে দেখে টুরির ইচ্ছে হল, বরফ খাবে। কাঠির মধ্যে লাল সবুজ হলুদ কমলা বরফ। অনেকক্ষণ ধরে দেখছে, দোকানে গিয়ে চাইতে সাহস হচ্ছিল না। পানের পিকে লাল ঠোঁট, টুরি জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নিল, ‘হেই সুধীর, তুকে ইকটা গেঞ্জি কিনে দেব। বরফ খাবি আয়।'

    বরফের লাল রঙে নরম জিভ লাগিয়ে ফুলমতি জোরে জোরে বলল, ‘আমাদের দেশটো ভাল লয়। মন টিঁকে না। ই মেলাটো কত্ত সোন্দর।'

    টুরি হেসে উঠল, ‘হেই ফুলমতি! ইখন থেকেই মন টিঁকে নাই! লতুন বউকে ভাই বুঝি যতন করছে নাই!’

    ঠোঁট দুটো বরফের রঙে লাল, জিভও। ফুলমতি লাল জিভ বের করে কাটল একবার, ‘ইল্লি! মেলায় পর্যন্ত আসতি দেয় না, যতন করবেক! ফু:। বুড়া সসুরের লজর সব্বো দিকে। ইকটু নিজের মনে থাকতি দেয় না আমায়।'

    সাবি বেশ চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার সসুরটো আরো জ্বালায়। লোক ভালো না। বুড়ার মাথার অসুক ধরিছে। উকে দেখার লোক নাই, তাই আমাকে সদরে পর্যন্ত যেতে দেয় না। আমাকে সব জাগায় যেতে মানা করে তুর খুড়া। মানব কেন আমি, বল সুধীর?’

    সুধীর চওড়া হাসে, গ্রামের বিটিছেল্যাগুলাকে সঙ্গ দিতে ভালোই লাগছে তার।

    ‘আ খুড়ি, মিঠা পান খাবি?’ সাবির গায়ে হাত রাখল সুধীর। ফুলমতি আর টুরি রিনরিনে চুড়ির মত হেসে উঠল। খুড়িকে নিয়ে মরদটার অবস্তা দ্যাখো!

    কানের দুল, গলার মালা, রঙ ঝলমল চুড়ি নিয়ে সাজানো দোকান। ডমন আজকাল ভালোই পয়সা আনছে। শহরের বাবুর সঙ্গে পাত্থর তুলে তুলে ভালো রোজগার। কিন্তু টুরির হাতে পয়সা থাকে না। দু’ হাত ভরে রঙিন চুড়ি কিনেছে ফুলমতি। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল টুরি। বর সদর থেকে যখনই আসে, সাবির কাছে টাকা পয়সা দিয়ে যায়। সাবিও বেশ কেনাকাটা করল। মাথার রঙিন ক্লিপ, রঙিন ব্লাউজ, ব্যাটার জন্যে খেলনা গাড়ি।

    ‘তু কী কিনবি টুরি?’ সাবি একবার জিজ্ঞেস করল। মাথা নাড়াল টুরি। এখন না। মেয়েটার জন্যে মন খারাপ করছে। এত হুল্লোড়, রঙ, মাইকে গান। কত্ত বেলুন, বাঁশি, খেলনা। মস্ত একটা নাগরদোলা। মেয়েটাকে নিয়ে এলে হত। লখনের বউয়ের কাছে গোমতীকে রেখে এসেছে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এতখানি পথ, দু’বছরের মেয়ে নিয়ে আসতে মুশকিল। তাছাড়া ডমন যদি ফিরে আসে, গোমতীকে দেখে নিশ্চিন্ত হবে। বুঝবে, টুরি ঘরেই আছে। বিটিছানাকে রেখে টুরি তো আর মেলায় যাবে না। মনের সুখে নেশা করতে যাবে ডমন। খোঁজও নেবে না আর।

    রঙ্কনমাযের থানে মানত আছে টুরির। ডমনের এই নেশা নিয়েই। এমনিতে কিছু না, নেশা করে এলেই ডমনের অন্য চেহারা। একটা কথা বলতে যাও, হাতের সুখ করে নেবে। কম মার খেয়েছে টুরি! মেরে মেরে হাতে পিঠে কালশিটে।

    এমনিই টুরিকে পছন্দ ছিল না ডমনের। সুবোধের বিয়ে হয়ে গেছিল। অন্য কিলির মেয়ে। মুণ্ডা গাঁয়ে এমন বিয়া বসে না। এমনিতে টুরি সব বোঝে না। কিন্তু একটা গল্প জানে।

    সে অনেক কাল আগের কথা। তখন ধরতি বলে কিছু ছিল না। ছিল শুধু জল, আর জল। তখন সিংবোঙ্গা প্রথম তৈরি করলেন কছুয়া। কচ্ছপ। তারপর কাটকোম। কাঁকড়া। তারপর লেনদাদ। কেঁচো। সিংবোঙ্গা এবার আদেশ করলেন, জলের তলা থেকে মাটি এনে দাও। প্রথমে কছুয়া ডুব দিল; সে জলের গভীরে পৌঁছতেই পারল না। তারপর কাটকোম গেল মাটির খোঁজে; সেও পারল না। তারপর গেল লেনদাদ। কচ্ছপ আর কাঁকড়া যা পারল না, সবার ছোট কেঁচো তাই করে ফেলল। জলের তলা থেকে মাটি নিয়ে এল। এই এট্টুখানি মাটি।

    সেই মাটি দিয়েই সিংবোঙ্গা তৈরি করলেন ‘ওতে দিশুম’। এই সুন্দর ধরতি। তৈরি করলেন সবুজ গাছপালা। জন্তু জানোয়ার। তৈরি করলেন লাল নীল সবুজ পাখি। তারা মাটিতে ঘোরে, জলে সাঁতার কাটে, আবার আকাশেও ওড়ে। তারপর হল আরো মজা।

    একদিন জলে সাঁতার কাটতে কাটতে মা-রাজহাঁস একটা ডিম পাড়ল। সে বছরে একবার একটামাত্র ডিম পাড়ে। সেই ডিম ভেঙে বেরিয়ে এল প্রথম মানুষ; একজন পুরুষ আর একজন নারী। লুতকুম হাড়াম আর লুতকুম বুঢ়িয়া। তোতা বুড়ো, আর তোতা বুড়ি। তোতা হবে না কেন, সিংবোঙ্গা তো আর জামাকাপড় তৈরি করে দেননি। তোতা বলে ওদের লজ্জাও ছিল না, এতটাই সরল আর নিষ্পাপ ছিল তারা।

    তারপর বুড়ো বলল ইলি তৈরি করতে। পবিত্র ধেনো মদ। তাই তো ইলি সব বিয়ের সময় খেতে হয়। একসঙ্গে ইলি খেল লুতকুম হাড়াম আর লুতকুম বুঢ়িয়া। সিংবোঙ্গা ওদের বিয়া দিলেন। তার ফলেই জন্ম নিল ‘হোরো হোনকো।' পৃথিবীর মানুষ।

    এই ছেলেমেয়েদের থেকেই তৈরি হয়েছে মুণ্ডাদের বারো কিলি। গোত্র। কোংরা, বোদরা, হাঁসা, কাঁদরু, বালুস, গুঁদলি। সবগুলোর নাম জানে না টুরি। কিন্তু সিংবোঙ্গা ছাড়াও যত বোঙ্গা আছেন ... জুহিরবোঙ্গা, চাণ্ডীবোঙ্গা, শরণাবোঙ্গা, ইকিরবোঙ্গা ... সব্বো বোঙ্গার এই নিয়ম। যারা বোঙ্গাপুজা করে সেই পাহানরা সব্বো লোককে বারবার বলে দিয়েছে, নিজেদের কিলির মধ্যেই বিয়া বসতে হয়।

    সুবোধ ভুলাভালা ছেল্যা। অত না বুঝেই অন্য কিলিতে বিয়া বসেছিল। শিকার করতে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ওরাঁও গাঁয়ে পৌঁছেছিল সুবোধ। সুবোধ ছিল, সালকু ছিল, হপন ছিল। তবু বোকা সুবোধই এমন কাণ্ড করেছে। গিতিওড়ার মতই ওরাঁওদেরও যুবক-যুবতীদের জন্যে আছে ধুমকুড়িয়া। ছেলেদের জন্যে জঁখ-এড়পা। বিটিছানাদের জন্যে পেল্-এড়পা। ওই গাঁয়ে ধুমকুড়িয়া দেখাশোনার কাজ করত যে ধাঙড়-মাহাতো, সেই ছেল্যাটার কারসাজি।

    সালকু আর হপন গাঁয়ে ফিরে সব বলেছে, ‘সুবোধের দোষ নাই, উয়াকে গাঁয়ে আসতি দাও না ক্যানে। উ বুড়া ধাঙড়-মাহাতো পেল্-এড়পার সামনে মাঠে আখড়া বসাইছিল। নিজের বিটির জন্যে। কেউ বিয়া বসছিল না, উ বুড়া অনেক টাকা চায়। অই যাতরা নাচ দেখেই তো সুবোধ গুরবীকে পসন্দ করে ফেলল।'

    ওরাঁও গাঁয়ে ঘরজামাই হয়ে ছিল বাসুদেব। মা মরেছে কিছুদিন আগে। বাপ তো সেই কোন ছোটকালে মরেছে। খুড়ার কাছে থাকা। বাসুদেবের খুড়া কন্যাপণ দেয়নি। বুড়া ধাঙড়-মাহাতো মেয়েকে ছাড়েনি। ঘরজামাই না থেকে কি করত বাসুদেব?

    সেই সময় তাড়াহুড়ো করে ডমনের বিয়ে। ডমনের খুড়া মস্ত শিকারী ছিল। বিয়ে করে নাই। ঘর সংসার দেখবে কে!

    এ গাঁ থেকে বেশ অনেকখানি পথ। দুটো বাঁশবন, একটা শালবন, একটা পাহাড়ি ঝোরা, তিনটে ডুংরি। সেইখানে টুরির গাঁ। গাঁয়ের লায়াবুড়ো এসেছিল মাঘে পুজোর সময়। মাঘে পূজায় পাঁচ গাঁয়ের পাহান একত্র হয়েছিল। সেইসময় এসব ব্যাপার। তড়িঘড়ি একখান পাত্রী চাই। টুরির তো মা নেই। বাপ থেকেও নেই। চব্বিশ ঘণ্টাই লিশা করে পড়ে থাকে। চার চারটা বিটি। কে বিয়া দেবে ঠিক নাই। লায়াবুড়া ব্যবস্থা করে দিল। ডমনের সঙ্গে।

    টুরিকে পছন্দ ছিল না ডমনের। বুধনের বড় বোনটার সঙ্গে বিহা বসতে চেয়েছিল। কিন্তু সে বিটি ফুচু সর্দারের চোখে পড়ে গেল। ফরেস্টার সাহেব বলে কথা! ডমনের সাধ্য কি তার সঙ্গে লড়াই করে পছন্দের মেয়েকে বিহা বসে।

    সে বিটিও তেমন বাধা দেয়নি। ফরেস্টারের সঙ্গ সঙ্গ সুখেই আছে। না, সুখে আছে কিনা জানে না টুরি। সুখ কাকে বলে কে জানে। তবে ভালো শাড়ি, রূপোর তাগা, কানে আসলি সোনার দুল, নাকে আসলি নথ। মনে হয় ভালই আছে মংরী। বুধনকেও সরকারী লাইসেন্স পাইয়ে দিয়েছে, গাছ কাটার লাইসেন্স।

    লায়াবুড়ো বিহা নিয়ে কথা তুলতে ডমন জোছনার কথা বলেছিল। টুরি নয়, টুরির বোন জোছনাকে পছন্দ হয়েছিল ডমনের। কিন্তু গাঁয়ের পাহান বুড়ার ব্যাটার সঙ্গে আশনাই জোছনার। কালো শরীরে ঢেউ, রহস্যময় ইশারা। টুরির তো অমন ঢেউ নেই শরীর জুড়ে। রোগা কালো। সরল মুখ। একটু রহস্য না থাকলে কি আর মরদ পছন্দ করে! গাঁয়ের অনেক যুবকই জোছনাকে চেয়েছিল। কিন্তু পাহানের ব্যাটার সামনে দাঁড়াবে কে! জোছনা অবশ্য মরদগুলার এই লিশা নিয়ে খুব খুশি থাকত। সালকুর সঙ্গে বিহা বসার পরও গাঁয়ের মরদদের বঞ্চিত করে না জোছনা। যেমন টুরির সঙ্গে বিহা বসার পরও জোছনাকে নিয়ে মাতামাতি ডমনের। সময় নেই, অসময় নেই, ‘জামাইদাদা’ বলে ঘরে এসে ঢুকে পড়ে জোছনা আজও। একসঙ্গে নেশা করবে, জঙ্গলে চলে যাবে। কিছু বলতে গেলেই মার খাবে টুরি।

    বাপের মতই লিশা করে পড়ে থাকত ডমন। ধরে বেঁধে শিকার করতে পাঠাতে হত। কম মার খেয়েছে সে জন্যেই! এক একজন পুরুষ মানুষ আছে, বাইরে দেখলে মনে হবে এমন শান্ত মানুষ আর দুটি নেই। অথচ বাড়িতে সে-ই শ্বাপদ বিশেষ। তর্জন গর্জন হুঙ্কার অহঙ্কার অত্যাচার। টুরিকে সহ্য করতেই পারত না ডমন। কোনো কাজ পছন্দ না। এমনকি দেখতে পেলেই রাগ। নতুন বউ পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত।

    অথচ শিকারী হিসেবে ডমনের জুড়ি নেই। তীরধনুক হাতে নিলেই ডমন অন্য লোক। অযোধ্যা পাহাড়ে মস্ত বড় বুনো শুয়োর মেরেছিল একা হাতে। পাখি, হরিণ আর ছোট জানোয়ার তো যখন তখন। টাঙ্গি দিয়ে এক কোপে পাগলা ষাঁড়া মারতে পারে।

    কিন্তু খাটতে চাইলে তো! মেয়েটা হল, কুনো ভাবনা নাই। দশ মাইল দূরের হাটে লঙ্কা বেগুন শালপাতা বেচে সংসার চালিয়েছে টুরি। একা হাতে। এই শহরের পাত্থরবাবু আসার পর একটু সুখের মুখ দেখেছে।

    ‘তুরা ইবার ঘর যা।' সুধীর এবার নেশার যোগাড়ে যাবে। অনেকক্ষণ সঙ্গ দেওয়া হয়েছে বিটিছেল্যাদের।

    বোর্ডে লাগানো কুড়ি তিরিশটা বেলুন। লাল নীল হলুদ। একটা শহুরে ছেলে বন্দুক তাক করে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে হি হি করছে আরো ক’জন। সব চোখগুলো টুরিদের দিকেই।

    শহুরে ছেলেটার হাত থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিল সুধীর। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে গাঁয়ের আরো দুটো ছেলে।

    ‘ইটা আমাদের মেলা বটে। ইখানে রসের হাসি চলবেক নাই।'

    শহুরে ছেলেগুলো আপাদমস্তক জরিপ করল সুধীরকে। অন্য আদিবাসী ছেলেগুলোকেও। তারপর সরে গিয়ে নাগরদোলার সামনেটায় দাঁড়াল।

    ‘ইটা আমাদের মেলা বটে, তুরা আরো ঘুরবি যা। কিছু ডর নাই’, টাঙ্গি হাতে অচেনা একটি যুবক সাহস দিল।

    একটা সানথাল ছেলে, জুতো জামা প্যান্ট পরনে। সানথাল হলেও এ ছেলেটা শহরে থাকে, বেশ বোঝা যাচ্ছে। মাথায় টুপি, চোখে চশমা। ওগুলাকে গগলস্ বলে, টুরি জানে। হাতে হাঁড়িয়া ভর্তি গ্লাস। টুরিদের কাছে এগিয়ে এল। শহরের কিছু বাবুলোক হাঁড়িয়াপাড়ায় গিয়ে ঘুসুরের মাংস খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করেছে। কিছু শহুরে ছেলে মেলায় আদিবাসী মেয়েদের শুধু শুধুই বিরক্ত করছে। সুধীরদের সাবধানে থাকতে বলে গেল ছেলেটা।

    ‘হাতে লিশা। নিজেই কিছুখন পর হুঁশে রইবে নাই, আমাদের সাবধান করছে’, রিনরিন করে হেসে উঠল ফুলমতি।


    || নয় ||

    গাছ গাছড়ার ফাঁক দিয়ে পোড়ামাটির মন্দির দেখা যাচ্ছে। রঙ্কিনী থান। বেশ কখানা চুড়ো ভেঙে গেছে। একসময় নাকি নয়খান চুড়ো নিয়ে নবরত্ন মন্দির ছিল। বিয়ের পর ডমনের সঙ্গে এ মন্দিরে এসে পুজো দিয়েছিল টুরি। গোমতী হবার পরও মন্দিরে এসে রঙ্কনমাকে বিটিছানা দেখিয়ে গেছে। একটু একটু মন খারাপ করছিল টুরির। এমন একা একা না এলেই হত। নাহয় আরো দু’ চারটে বার মারত ডমন, জোরজার করে সবাই মিলে মেলায় এলেই ভালো হত। পাত্থর বাবুকেও সঙ্গে আনলে বেশ হত। গোটা পরিবার সঙ্গ সঙ্গ না থাকলে কি আর ভালো লাগে!

    পায়ে পায়ে মন্দিরে এসেছে তারপর। মন্দির চত্বরে বেশ ভিড়। আজ তিথি ভালো, ইচাবনী তেলাইঘাট ধিকুলডিহ ধাতডিহি থেকে দলে দলে লোক এসেছে মন্দিরে। দুম দুম ধমসা বাজছে। দমা দম নাকাড়া। ফুল বেলপাতা সিঁদুরে মাখামাখি দেবী রঙ্কিনী।

    রঙ্কন মায়ের মাথার ওপর লাল শালুর চান্দোয়া। দেবীর বেদীতে দুটো বড় বড় খাঁড়া। বেদীর নিচে একটা টাঙ্গি, একটা খাঁড়া। বেলপাতা ফুল সিঁদুর মাখানো। বিনধার জন্যে খুঁটিতে চারটে পাঁঠা বেঁধে রাখা। একটাই কাঁড়া। এখন বলি দেবার মোষ বেশি হয় না। লোকের হাতে অত পয়সা নেই। পাঁঠাগুলোর কপালে, কাঁড়ার কপালে সিঁদুর। বিনধার পর এবার মাঝিপাড়ার লোকেরা কাঁড়ার মুণ্ডু নেবে। খরসোয়ানের নাচনীরা গতবার মুণ্ডু নিয়েছিল। এবার ধড় নেবার জন্যে হুড়োহুড়ি করছে সবাই। গাঁয়ের দু’ চারজনকেও দেখালো ফুলমতি।

    টুরির ওসব দিকে মন নেই এখন। ঘণ্টা বাজছে জোরে জোরে। দুম দুমা দুম দুম। ঢোল নাকাড়া ধমসা বাজছে জোরে জোরে। মন্দিরের হাতা বাঁশ দিয়ে ঘেরা। চৌখুপি বলির জায়গায় পাঁচটা হাঁড়িকাঠ। তীর ধনুক হাতে সা-যোয়ান পাঁচ সাতজন মানুষ।

    খানিক পরেই চারদিক থেকে তীর ছোঁড়া শুরু হল। জানোয়ারগুলোর শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত, দড়ি বাঁধা মোষটার মর্মান্তিক চিত্কাগর, পাঁঠাগুলো প্রাণপণ শক্তিতে ডাকতে লেগেছে। দুম দুমা দম দম। আরো জোরে ধমসা বাজাতে লাগল।

    টুরির চোখের মণি স্থির, গায়ের কাপড় সরে গেছে। ভিড়ের মধ্যে সাবি আর ফুলমতি কোথায় গেল কে জানে। এমনিই সাবি মেলায় এসে থেকে আর নিজের মধ্যে নেই। উঁচু গলায় হাসছে, জোরে জোরে কথা বলছে, দু’ চারজন পুরোনো প্রণয়ীর সঙ্গে দেখা হয়ে বেজায় উত্ফুতল্ল। তাদের মধ্যে একজন, যুগল মাঝির নিজের সম্বন্ধী, একখান চমকি শাড়ি কিনে দিয়েছে সাবিকে।

    ‘কুথাকে গেলি তুরা’, একটা ডাক দিল টুরি।

    ভিড়ের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা, মোষটার দাপাদাপি দেখে হাসির হুল্লোড়, তীরন্দাজদের কারো কারো নাম ধরে ডেকে উল্লাস, ‘সাবাস ভাই! দারুণ বিঁধলে বটে!’ টুরির গলা শুনতে পেল না কেউ।

    পায়ে পায়ে আবার মন্দিরের দিকেই এগিয়ে এল টুরি। ফুলমতি, সাবিকে খুঁজতে হবে। মন্দিরের ভেতরটা বেশ অন্ধকার। উঁচু অন্ধকার ছাদে অসংখ্য চামচিকে, বাদুড়। কুলুঙ্গিতে কালি। দেয়ালে কোনো রঙ নেই। একসময় ছিল কিনা তাও বোঝা যায় না।

    দু’হাত জোড় করে ভক্তিভরে প্রণাম করল টুরি। হে রঙ্কন মা, আমাদের শালবন ধানক্ষেত বাঁচায়ে রেখো। জঙ্গলকে বাঁচায়ে রেখো। আমার ছানাকে বাঁচায়ে রেখো। মরদটার লিশা ছাড়ায়ে দাও। সবাইকে ভালো রেখো। পাত্থরবাবুকেও ভালো রেখো।

    বাইরে বেরিয়ে ফুলমতিদের খুঁজল আবার। পাঁঠাগুলোর মুণ্ডু আলাদা, রক্তমাখা শরীরগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। মোষটার কষে গ্যাঁজলা, একটানা ডেকে চলেছে। মাঝে মাঝেই মোষের গলায় ডালডা ঘষছে একটা জোয়ান ছেলে। ওর নাম পীতাম্বর, টুরি চেনে। এই মন্দিরে আগেও দেখেছে ওকে। এক কোপে ষাঁড়ার গলা নামাতে পারে।

    পায়ের নিচে জল কাদা। গাঁদা ফুলে পাপড়ি। বেলপাতা। মরা পোকা। মাছি। মোষটার একটানা করুণ ডাক। কেন কে জানে, টুরির হঠাত্‍ মনখারাপ হয়ে গেল।

    ‘এ বাইজু .. বাইজু রে .. বাইজু রে এ এ ..’ দূর থেকে কে যেন কাকে ভাঙা গলায় ডাকছে। কেন জানি খুব কান্না পেয়ে গেল টুরির।

    মেলা আর ভালো লাগছে না। টুরি এবার ‘ঘর’ যাবে। কোথায় গেল সাবিরা! টুরিকে ছেড়েই চলে গেল নাকি! মাঝিপাড়ার মেয়েগুলোই বা কোথায় গেল! নাকি টুরিই হারিয়ে গেছে!

    টুসু পরবে প্রতি বছর মেলা বসে। ঝোরায় স্নান করে আশপাশের দশ বারো গাঁয়ের আদিবাসি যোগ দেয় মেলায়। হারমোনিয়াম বাজিয়ে রাবণ কবি টুসুর গান গায়। মশাল হাতে কুনা ভেলু মাটকুরা নাচে। কুনি বালিকা মোতিরা পুরু ঠোঁটে পনের রসে লাল। করঞ্জতেল কুসুমতেলের মাতোয়ারা সুগন্ধে মাতাল হয়ে নাচে।

    তারপর যেমন হয় ... গাছের পাতায় ডালে শাখাপ্রশাখায় কামুক চোখ। ইশারা। মেলা থেকেই উধাও হয় কেউ কেউ। পরদিন কিংবা তারও পরদিন কান্না চোখে, ছেঁড়া ট্যানা, শুকনো ঠোঁটে শুকনো রক্ত। গাঁয়ে ফেরা।

    হায় সিংবোঙ্গা! ক্যানে বিটিছেল্যা জনম দিলে!

    গাঁ থেকে মেলায় এসে বড় জুয়ান মেয়েরা অনেকেই হারিয়ে গেছে। ছোট ছেলেরাও। অনেকদিন পর মাকে মনে করল টুরি।

    কি সোন্দর মা ছিল টুরির। ফুলমণি। এখনো গাঁয়ের খুড়া খুড়িরা মাযের কথা বলে। মাকে মনে করে করেই তো বাপ অমন লিশা করত। অমন সুন্দর বউ গাঁয়ে আর একটাও ছিল না। বাপের নাকি সোন্দর বউ নিয়ে খুব গর্ব ছিল। গাঁয়ের খুড়িদের কাছে ছোট থেকে সেসব গল্প শুনেছে টুরি। খুব ভালো গান গাইতে পারত ফুলমণি। গাঁয়ের যে কোনো ছেলেমেয়ের বিহা, যে কোনো পূজা পার্বণ, শিকার খেলা, বন ভোজন। ফুলমণির গানে মনমাতাল সবাই।

    নাচের আখড়ায় ঘন্টার পর ঘণ্টা নাচতে পারত। ফুলমণি নাচতে শুরু করলে নাকি আকাশের চাঁদটাও চলা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত। রাতের বেলা বনদেবী সেই অপূর্ব নাচ দেখতে আসত। অনেকে নাকি জঙ্গলের দিকে সে দৃশ্য দেখেছে।

    হাটবারে হাঁড়িয়া আর বনপিপা নিয়ে হাটে বসত। দু’ঘন্টার মধ্যে সব বিক্রি হয়ে যেত। অন্যদের বিক্রিবাটার কাছে বসত তখন। ব্যাস, ঝপ ঝপ বিক্রি। এমন লক্ষ্মী বউ। সবাই কি ভালই না বাসত ফুলমণিকে।

    সেই ফুলমণি এই মেলায় এসে হারিয়ে গেছিল। সেই থেকেই তো এই মেলায় আসা নিয়ে গাঁয়ের মরদদের নিষেধ শুরু।

    কত্তদিন পর ছেঁড়া কাপড়ের ফুলমণি গ্রামে ফিরে এসেছিল। ঘরে ঢোকেনি। গাঁয়ের মুখে জঙ্গলের ধারে জুহিরবোঙ্গার থানের বড় বটগাছটার নিচে ঠায় বসে ছিল সারা রাত। ভয়ে গাঁয়ের কেউ কাছে যায়নি। পরের দিন নিজের ছেঁড়া কাপড়ে গিঁট দিয়ে জঙ্গলে ঢোকার মুখের মস্ত শিমুল গাছটার ডালে গলায় দড়ি দিয়েছিল গাঁয়ের সেরা বউ ফুলমণি।

    সে ছবিটা এখনো মনে আছে টুরির। মাযের চোখের মণি খোলা, হাওয়ায় উড়ছে চুল। মাথার পেছনে গরমের আকাশে কোনো রঙ নেই। সবটাই ফ্যাকাসে, একটুও নীল নেই আকাশে। চারদিকে বাতাস থেমে গেছিল। জঙ্গলের দিক থেকে সারাদিন হাওয়ার বাঁশির যে ডাক ভেসে আসে, সেটাও থেমে গেছিল।

    কি করে যেন গাঁয়ের মরদরা খবর পেয়েছিল। কে বা কারা ফুলমণিকে ধরে নিয়ে গেছিল, সে খবর। নাকি সন্দেহ করেছিল সবাই। গাঁয়ে সুন্দর মেয়ে বউ থাকলেই যাদের নজর পড়ে, তেমন বদ লোক। সবাই মিলে থানায় গেছিল। নালিশ করবে। একটা বিহিত চাই। কেন মরল ফুলমণি, কোথায় ছিল এতগুলো দিন, পুলিশ খোঁজ নিক।

    পুলিশ বলল, ‘নিজেরা হুজ্জোত করে থানায় এসেছিস? ও মেয়ের চরিত্র খারাপ ছিল। আমরা সব জানি। সব কটাকে অন্দর করে দেব। যা ভাগ!’



    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments