ইদানিং বাঙালির দুই প্রিয় গোয়েন্দাকে নিয়ে তৈরি করা বেশ কয়েকটি ছায়াছবি, সিরিয়াল ইত্যাদি কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের দর্শকদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এঁরা হলেন ব্যোমকেশ বক্সী আর ফেলু মিত্তির! একই অভিনেতা এই দুটি চরিত্রে প্রায় একই সঙ্গে অভিনয় করছেন—এমনটাও ঘটে গেল সম্প্রতি। মায় ব্যোমকেশকে নিয়ে আস্ত একটি বলিউডি ছবিও বাজারে বেরিয়েছে কয়েক দিন আগে। এরপর বোধহয় ফেলুর পালা! এই দুই স্বনামধন্য রহস্যসন্ধানীর জীবনপঞ্জির মধ্যে লুকিয়ে আছে কিন্তু দুটি ভিন্ন সময়। দুটি ভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষিত। এদের গল্পের ভাঁজে ভাঁজে মিলে যায় বাঙালি জীবনের নানান ছাঁচ। নানান স্টিরিও টাইপও! সেসব আর একবার উল্টে-পাল্টে পাশাপাশি রেখে পড়ে নিলে মন্দ হয় না! আমাদের মত মধ্য চল্লিশের অনেক পাঠক-পাঠিকারই শৈশব ও কৈশোরের অনেক রোমহর্ষক অলস দুপুর বা সন্ধে কেটেছে এদের সান্নিধ্যে! এইসব ভেবেই এদের নিয়ে দু-চার কথা লেখার সাহস করলুম।
ব্যোমকেশ বক্সীর সঙ্গে আমাদের আলাপ হয় তার বন্ধু ও জীবনীকার অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে। অতুল মিত্র নামে একটি তেইশ-চব্বিশ বছরের ভদ্রবেশী, সুশ্রী ও সুগঠিত চেহারার যুবক একদা এসে বাসা বাঁধল অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগে একই ঘরে রুমমেট হিসেবে, মধ্য কলকাতার চিনেপট্টির একটি মেসে। সেই মেসকে ঘিরে তখন ঘটে চলেছে নানান রহস্যময় কাণ্ড-কারখানা। সময়টা স্বাধীনতার কিছু আগে। অতুল পরে, অর্থাৎ রহস্য সমাধান হয়ে গেলে, সেই মেস থেকে বেরিয়ে আসে তার নতুন বন্ধু অজিতকে সঙ্গে করে, আর হ্যারিসন রোডে তার আসল বাসস্থান আর একটি মেসবাড়িতে আত্মপ্রকাশ করে সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী নামে! সেখানে সে থাকত তার বিশ্বস্ত কাজের লোক পুঁটিরামকে সংগে নিয়ে। অজিত আর ব্যোমকেশ দুজনেই প্রায় সমবয়সী। অজিত বোধহয় মাস তিনেকের বড়। ব্যোমকেশ কোনদিন চাকরি-বাকরি করেছে বলে শোনা যায়নি। তিরিশের দশকে, বিষয়-সম্পত্তি কিছু থাকলে, তখনও কলকাতার শহরে চাকরি না করে সম্ভবতঃ মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করা চলত। ব্যোমকেশের প্রথম দিককার গোয়েন্দা-জীবন কেটেছে উত্তর কলকাতাতেই। পরে অবশ্য ব্যোমকেশ আর অজিত দক্ষিণ কলকাতার কেয়াতলায় বাড়ি করে উঠে যায়। উত্তরের অনেক ভাড়াটে বাসিন্দারাই, সম্বল থাকলে সেইসময় দক্ষিণ কলকাতায় বাড়ি করে উঠে যাচ্ছিলেন। রাসবিহারী এভিনিঊ পেরোলে, তখনও জমির দাম অপেক্ষাকৃত সস্তা এবং জমি পাওয়া যেত! ব্যোমকেশের বাবা ছিলেন অঙ্কের মাস্টার আবার বাড়িতে সাংখ্যদর্শন পড়তেন। আর মা গোঁড়া বৈষ্ণব পরিবারের কন্যা। ব্যোমকেশ মনে হয় বহরমপুরের লোক। কারণ আমরা জানি যে সে বহরমপুর কলেজে অধ্যাপক ঈশানচন্দ্র মজুমদারের কাছে ইতিহাস পড়েছিল (‘দূর্গ-রহস্য’)। সুতরাং অনুমান করে নেওয়া যায় ব্যোমকেশ ঐ অঞ্চলেরই লোক। ব্যোমকেশের বাপ-মা দুজনেই সে যুগের নিয়মানুসারে অল্পবয়েসে দেহ রাখেন। এছাড়া ব্যোমকেশের পিতৃকূল বা মাতৃকূলের আর কারোর খবরই আমরা পাই না। ব্যোমকেশের কর্ম সময়টা মোটামুটি ১৯৩১-১৯৭০। ব্যোমকেশ মনেহয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্যই মফঃস্বল ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিল। গ্রামাঞ্চল বা মফঃস্বল থেকে ঔপনিবেশিক নগরে ভাগ্যান্বেষণে বা উচ্চশিক্ষার সন্ধানে চলে আসার চল ইংরেজ আমল থেকেই শুরু।
জয়কৃষ্ণ মিত্তিরের ছেলে প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। ১৯৬৫ সালে, সাতাশ বছর বয়েসে মাসতুতো ভাই তপেশ আর মেসোমশাই(?)য়ের সঙ্গে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে গোয়েন্দাগিরির শুরু (‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’)। প্রদোষ মিত্র অর্থাৎ ফেলুদা, অর্থাৎ তোপসের মাসতুতো দাদার সংগে এ ভাবেই আমাদের প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় তার ভাই তপেশ রঞ্জন বোস(!), ওরফে তোপসে। তারপর তো জানা গেল যে ফেলু আসলে তোপসের খুড়তুতো দাদা! তবে, সে যুগে হামেশাই দুই বোন বিয়ের পরে হয়ে যেত দুই জা। সুতরাং তোপসে একই সঙ্গে ফেলুর মাসতুতো আর খুড়তুতো ভাই হতেই পারে! মিত্তিররা জাতে কায়েত। লোকের মুখে মুখে এক সময় একটা সস্তা লোক হাসানো ছড়া ফিরত বাংলার কুলীন কায়স্থ পদবীগুলো নিয়ে—‘ঘোষ বংশ বড় বংশ/বোস বংশ দাতা/মিত্তির কুটিল জাত/দত্ত...’ ইত্যাদি। তো, এই মিত্তির কুটিল জাত বলেই কী বাংলার দুই বিখ্যাত গোয়েন্দা প্রথমে মিত্তির পরিচয়ে আবির্ভুত হন? অবশ্য সে-কালে কায়স্থদের বৃত্তিগত পরম্পরার (আইন ব্যবসা, জমিদারির দেওয়ানি, হিসাব রক্ষা) জন্যই বোধহয় তাদের প্যাঁচালো কুটিল বুদ্ধির সুনাম/দুর্নাম ছিল। ফেলুদের দেশের বাড়ি ঢাকার সোনাদিঘি গ্রামে। তার মানে ফেলু ঢাকাই বাঙাল! ফেলুর বাবা-কাকারা পাঁচ ভাই। ফেলুর বাবা মেজো। উনি ছিলেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের অঙ্ক আর সংস্কৃতর মাস্টার। এইখানেও এই দুই গোয়েন্দার জীবনের আর একটা মিল পাওয়া যায়। দুজনের বাবাই অঙ্কের মাস্টার! বাঙালির অঙ্কশাস্ত্রের পটুত্বর প্রতি দুর্বলতা তো সর্বজনবিদিত! লোকে ধরেই নেয়, যে ভাল অঙ্ক পারে (অথবা যার বাবা ভাল অঙ্ক পারে!!) তার তো প্রচুর বুদ্ধি! সুতরাং রহস্য সমাধানেও সে নিশ্চয়ই খুব পারঙ্গম হবে। এটা একটা মার্কা-মারা বাঙালি স্টিরিওটাইপ। পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগের চাকরিতে তো অঙ্কশাস্ত্রের দক্ষতার খোঁজ করা হয় বলে মনে হয় না! এদিকে আবার ফেলুর বাবার ছিল মুগুর-ভাঁজা শরীর! আর সাঁতার ক্রিকেট কুস্তি এই সবে তিনি বেশ দড় ছিলেন! ফেলুর বাকি কাকা-জ্যাঠারা কেউ শিকারী, কেউ সন্ন্যাসী, কেউ আবার হাত দেখতে পারেন! একমাত্র তোপসের বাবাই কিছুটা নিরেস। ভদ্রলোক শান্ত প্রকৃতির, চাকুরিজীবী, আত্মীয়-বৎসল (না হলে ফেলুর পসার জমার পরেও ফেলু থেকে যায় কাকার বাড়িতে!) তবে শক্ত নার্ভের ( তোপ্সের মতে) একজন লোক। তবে মোটের ওপর বেশ বিচিত্র-কর্মা পরিবার! সে বাড়ির ছেলে হয়ে ফেলুও যে একজন বিচিত্র মানুষ হয়ে উঠবে তাতে আর আশ্চর্য কী? ফেলুর বাবা মা দুজনেই অল্প বয়েসে গত হন। এখানেও এদের দুজনের মধ্যে একটা মিল পাচ্ছি! দুজনেরই বাবা-মা অল্প বয়েসে গত। অবশ্য বাপ-মা বেঁচে থাকলে কি আর ছেলেরা এমন উদ্ভট পেশা বেছে নিতে পারত? ফেলুরা কবে ওপার বাংলা ছেড়ে এপারে এসে বসতি গাড়লো, সে খবর আমরা পাই না। তবে মনেহয় আর পাঁচটা পূর্ববঙ্গীয় পরিবারের মতই হয়ত দেশভাগের সময়েই ওরা এপার বাংলায় চলে আসে? আচ্ছা, তোপসের মাও কী অকালে ছেলেকে অনাথ করে চলে গেছেন? তাঁর কথা তো কিছু শুনিনা! ফেলুর গোয়েন্দাগিরির সময় ১৯৬৫-১৯৯০ সাল অবধি। প্রথম দিকে বছর দুয়েক চাকরি বজায় রেখে ছুটিছাটায় গোয়েন্দাগিরি চালালেও পরে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি গোয়েন্দা হয়ে যায় ফেলু। তিরিশের দশকে সস্তা-গণ্ডার বাজারে ব্যোমকেশ তার জীবন পুরোপুরি গোয়েন্দাগিরি দিয়ে শুরু করতে পারলেও, ষাটের দশকে বেহাল অর্থনীতির বাজারে ফেলু কিন্তু অন্ততঃ কিছুদিন চাকরি করে তারপর একটু পশার জমলে তবেই ভরসা করে চাকরি ছেড়েছিল। ফেলুরা বরাবরই মনে হয় দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। প্রথমে তারা রোডে ও পরে রজনীসেন রোডের একটি বাড়িতে ফেলু আর তোপসে (আর তোপসের বাবা) থাকত। আর ছিল তাদের বিশ্বস্ত কাজের লোক শ্রীনাথ।
সময়ের হিসেবে দেখতে গেলে ব্যোমকেশ ফেলুর চেয়ে প্রায় তিরিশ বছরের বড়। ফেলু কী ব্যোমকেশের গপ্পো পড়েই প্রথম গোয়েন্দাগিরি করার কথা ভাবে? মনে হয় না। কারণ, তোপসে লিখেই দিয়েছে যে, ‘ও বিলিতি বই পড়ে আর নিজের বুদ্ধিতে দারুণ ডিটেকটিভের কাজ শিখে নিয়েছে’। জানতে ইচ্ছে হয়, সে সব কোন কোন লেখকের বই? সে কি শুধুই কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিষ্টি, ডরোথি সেয়ার্স ইত্যাদি ব্রিটিশ লেখকদের বই? না কি মার্কিনি ‘প্রাইভেট-আই’ মার্কা লেখক রেমণ্ড শ্যান্ডলার বা ড্যাশিয়েল হ্যামেট, অথবা ইওরোপীয় লেখকদের কিছু বইও আছে তার মধ্যে? এমিল গাবোরিওর বইগুলোর ওপর যে ফেলুর বেশ দুর্বলতা ছিল সেটা আমরা জানি (‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’)। তবে বাঙালির রহস্যসন্ধানের ধারণাটা গড়ে উঠেছে প্রাথমিক ভাবে ইংরিজী রহস্যোপন্যাস পড়ে। সুতরাং অনুমান করা চলে যে সেই আদি ডিটেক্টিভ শার্লক হোমসের গল্পই নিঃসন্দেহে ফেলুকে প্রাথমিক প্রেরণা জুগিয়েছে! ব্যোমকেশের প্রেরণাও কী সেই সাগর-পারের বেকার স্ট্রীটের গোয়েন্দা? হয়ত তাই। তবে প্রেরণা যেই হোক, ব্যোমকেশ কিন্তু ‘ডিটেক্টিভ’ শব্দটি বিশেষ পছন্দ করত না! সে ছিল ‘সত্যান্বেষী’। পেশার একটা দেশজ শব্দ যে ব্যোমকেশ তৈরি করে নিয়েছিল, সেটা কী প্রাক্স্বাধীনতার যুগে ঔপনিবেশিক চিন্তার বিরুদ্ধে একটা সূক্ষ্ম প্রতিবাদ? ব্যোমকেশের অনেক মামলায় আমরা ইংরেজ আমলের শেষ দিকের কলকাতার অন্ধকার চরিত্রের বেশ একটা জমজমাট ছবি পেয়ে যাই। ত্রিশের দশকে কলকাতার কোকেন ব্যবসার রমরমা ও তাকে ঘিরে এক ধরনের অপরাধী গোষ্ঠীর কার্যকলাপ, অথবা জেলবন্দী পাকা অপরাধিদের গলায় ‘পকেট’ করে জিনিস লুকিয়ে রাখা, কিম্বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিনী সেনাদের হাত ফেরত বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রর গোপন ব্যবসার খবর কিম্বা মাকড়সার রসের মত কোন বিজাতীয় নেশার বা কিউরারির মত দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আগত বিষের খবর কিম্বা সদ্য-স্বাধীন ভারতবর্ষের উত্তাল রাজনৈতিক পটভূমির কথা, দাঙ্গার সময়ের কলকাতার বিভীষিকাময় পথ-ঘাট ইত্যাদি অনেক কিছুর খবর আমরা পেয়ে যাই নানান মামলার বিবরণে। ফেলুর মামলাতেও কলকাতা আছে। বিশেষতঃ বর্তমান কলকাতার এংলো-ইণ্ডিয়ান বাসিন্দাদের এবং সেই সংগে ব্রিটিশ রাজের সময়ের কলকাতার হোয়াইট-টাউনের ইতিহাসকে ফেলুই তো আমাদের চিনিয়ে দেয়। তবে ফেলুর বেশির ভাগ মামলায় যে কলকাতার খোঁজখবর আমরা পাই তার সময়কাল মূলতঃ ষাট, সত্তর আর আশির দশক। সে কলকাতা স্বাধীন। সে কলকাতায় বারোয়ারি পূজোর প্যান্ডেলে কাটি-পতঙ ছবির ‘ইয়ে যো মহব্বৎ হ্যায়’ গান বাজে, সা-রে-গা-মা সুরে হর্ন বাজিয়ে গাড়ি চলে, মাঝে মধ্যে হিস্পানো-সুইজার মত ভিন্টেজ্ গাড়ির দেখা মেলে, লোড-শেডিং-এর জ্বালায় বুদ্ধিমান চিন্তাশীল লোকের চিন্তার ব্যাঘাত ঘটে, কিম্বা কলকাতার বুকে স্কাই-ল্যাব ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় ভেতো বাঙালির বুক কাঁপে। সে কলকাতার অপরাধের জগতে ‘ছেলেধরা’-দের উপদ্রব। সে কলকাতায় স্ট্যাম্প কলেক্টররা লাখপতি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। ফেলুর আক্ষেপ সত্ত্বেও নিউ-মার্কেট ভেঙে যেখানে নতুন বাজার তৈরি হয়, রাস্তার নাম পালটে নতুন ইতিহাস লেখা হয়, কবর খুঁড়ে লুঠ হয়ে যায় নবাবী উপহার, কিম্বা ভারতের প্রাচীন শিল্প-কর্ম বিনা বাধায় বিক্রি হয়ে যায় বিদেশি ক্রেতার কাছে!
কাজের সূত্রে ফেলু আর ব্যোমকেশ দুজনকেই পুলিসের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলতে হয়েছে। পুলিসের সঙ্গে ব্যোমকেশের সম্পর্ক ছিল অম্ল-মধুর। ইংরেজ পুলিশ কমিশনার ব্যোমকেশকে স্নেহের চক্ষে দেখতেন। আবার বিধু দারোগা বা প্রণব দারোগার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল আদায়-কাঁচকলায়। অন্যদিকে এ-কে-রে, কিম্বা পুরন্দর পাণ্ডে, ভবানী দারোগার বা রাখাল দারোগার সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ ভাল ছিল। ফেলুর সঙ্গে কিন্তু প্রায় সব পুলিশ অফিসারেরই মোটামুটি ভাল সম্পর্ক ছিল। খালি একবার ইন্সপেক্টর বিশ্বাসের সঙ্গে একটু যা কথা কাটা-কাটি হয়েছিল (‘রয়েলবেঙ্গল রহস্য’)।
কলকাতার চেয়েও ফেলুর মামলায় যেটা বেশি করে আছে সেটা বোধহয় বিদেশ ভ্রমণ। ভারতের নানান জায়গায়, আবার ভারতের বাইরেও (কাঠমাণ্ডু, হংকং, লণ্ডন)। এক জাতিস্মর বাচ্চাকে দুষ্কৃতিদের হাত থেকে বাঁচানোর ভার নিয়ে ফেলু আর তোপসে একবার রাজস্থান গিয়েই তো পথিমধ্যে জুটিয়ে ফেলল ওদের থার্ড মাস্কেটিয়ার রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলিকে! বাঙালির ভ্রমণবিলাসী মন ফেলু-তোপসে-লালমোহন এই ত্রয়ীর হাত ধরে বেশ খানিকটা বেড়িয়ে নিতে পেরেছে! ব্যোমকেশও গেছে ইতি-উতি। সাঁওতাল পরগনার ছোট ছোট শহরে, পাটনায়, মহাবালেশ্বরে, দিল্লীতে, কাশ্মীরে বা উড়িষ্যায়। তবে দু-একবার বেড়াতে, একবার শরীর সারাতে আর বাকি কয়েকবার কাজের সূত্রে। কিন্তু সেখানে ভ্রমণের মেজাজ খুব একটা ছিল না। শরীর বলতে মনে পড়ল--ফেলু কিন্তু তার বাবার মতই শরীর সচেতন। রোজ যোগ ব্যায়াম করে। ফেলু যখন যুবক, প্রায় সেই সময় থেকেই নাগরিক বাঙালি যোগব্যায়ামের উপকারিতা সম্মন্ধে আস্তে আস্তে জানতে পারছিল। ওটা যে কেবল সাধু সন্ন্যাসীদের সাধনার ব্যাপার নয়, বরং শরীরচর্চার একটি উপায় সেটা বাঙালিকে তখন জানিয়ে দিয়েছেন বিষ্ণুচরণ ঘোষ! এছাড়া ফেলু মাঝে মাঝে খেলার ছলে তোপসের সঙ্গে কুংফু প্র্যাকটিস্ও করে। শোনা যায় যে, ফেলু ক্যারাটে আর যুযুৎসুও নাকি জানে (‘শেয়াল-দেবতা রহস্য’)। কলকাতার বাঙালি ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ বা আরো পরে, ‘থার্টি-সিক্স চেম্বার অফ্ শাওলীন’ ইত্যাদি ছবি দেখে চাইনীজ মার্শাল আর্ট সম্মন্ধেও জেনেছে ততোদিনে। ফেলুর অভ্যাসে তারই প্রতিফলন দেখি আমরা। ফেলু কলেজ টীমের হয়ে ক্রিকেটও খেলেছে! আর একাধিক বার আততায়ীদের সঙ্গে লড়ে তাদের ঘায়েল করেছে। এক কথায় বেশ ডানপিটে বলা চলে। সিগারেটের বদ অভ্যাস থাকলেও কমানোর চেষ্টা আছে; খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সংযমী তবে ভোজনরসিক বলা চলে। লালমোহন বাবুর কৃপায় কিম্বা নিজের উৎসাহে উত্তর কলকাতার কল্লোল সুইট্স্-এর ‘ডায়মণ্ডা’ বা মোহন ময়রার কচুরি কিম্বা মুম্বইয়ের কপার চিমনির পুলাউ, কুলফি কিম্বা ব্লু-ফক্সে কফি-স্যাণ্ডুইচ কিম্বা বেনারসের কচৌরি গলির রাবড়ির মত সব সুখাদ্য ফেলু বেশ জমিয়ে খায়। তুলনায় ব্যোমকেশ খুব একটা ভোজনরসিক বোধহয় ছিল না। তবে সুযোগ পেলে সেও খায়--ডিএসপি পাণ্ডে সাহেবের স্বহস্তে রাঁধা মূর্গির কাশ্মিরী কোর্মা (ইস্স্! রেসিপিটা যদি পাওয়া যেত), কিম্বা নিরুপমা হোটেলের চপ-কাটলেট ইত্যাদি পেলে ছাড়ে না। আর স্বভাবেও সে বেশ ঢিলে-ঢালা। ব্যোমকেশ বিবাহিত। একটা খুনের মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সত্যবতী নামে একটি শ্যামাঙ্গী দৃঢ় চরিত্রের মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় (‘অর্থমনর্থম’), পরে প্রেম এবং পরিশেষে বিবাহ হয়! এদিকে ফেলু কিন্তু ব্যচিলরই রয়ে গেল। এটাও কি তার সংযমী চরিত্রের একটি বিশেষ দিক? ব্যোমকেশ তো সিগারেট প্রচুর খেত; বিশেষ শরীর চর্চা করত বলে একেবারেই মনে হয় না! উপরন্তু একবার তো সে সদ্য অসুখ থেকে উঠে খালি খাই-খাই করে আর সিগারেট খাওয়ার জন্য উসখুস করে অজিত আর সত্যবতীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল (‘চিত্র-চোর’)! এদিক দিয়ে ব্যোমকেশ বিশ শতকের প্রথম দিকের মধ্যবিত্ত স্বাস্থ-‘অচেতন’ বাঙালির যথার্থ প্রতিভূ! তবে ব্যোমকেশের বজ্রমুষ্টির আঘাতে, অথবা হাতের টর্চের বাড়ি খেয়ে একাধিক আততায়ী ঘায়েল হয়েছে। সুতরাং তাকেও শক্ত-সমর্থ বলা চলে। বিয়ের পরেও অজিত ব্যোমকেশদের সংগেই একই সংসারে থেকে গেছিল। সত্যবতী অজিতকে নিজের ভাশুরের মত দেখত। এই অনাত্মীয়কে আত্মীয় করে নেওয়ার বিশেষ গুণ যে সেযুগে মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে ছিল এ তারই ইঙ্গিত। ফেলু আর তোপসেও লালমোহনবাবুকে তাদের আপনজন বলেই মনে করেছে! লালমোহনবাবুও সেকথা স্বীকার করেছেন অনেক বার। ফেলু আর তোপসের যিনি সিধুজ্যাঠা, যার কাছে ফেলুকে মাঝে মধ্যেই দৌড়ে যেতে হয় কোন পুরনো খবরের, কিম্বা কোন বইয়ে সন্ধানে--নিছক তথ্যানুসন্ধানে যিনি গুগুল্-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন, তিনিও তো গ্রাম সম্পর্কে জ্যাঠা! ব্যোমকেশের অধিকাংশ মামলার বিবরণই প্রাপ্ত-বয়স্কদের জন্য। সেখানে নারী চরিত্রের আনাগোনা অবাধ। সে নারী প্রেমিকা, কুটিলা, সরলা, চপলা,সতী, অসতী, অপরাধী ইত্যাদি বহুরূপে বিরাজমানা! ফেলুর অধিকাংশ মামলাই কিন্তু নারীবর্জিত। পরে অবশ্য কয়েকটি মামলায় নারী চরিত্রের দেখা মেলে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে নারীর ভূমিকা, কেবল একটা ঘটনা বাদ দিলে, বেশ সীমিত। আর ফেলুর ‘কেস’-এর বিষয়বস্তু মার্কা-মারা গোয়েন্দা মামলার তুলনায় কিছুটা যেন ছেলেমানুষ রয়ে গেল! তার কারণও অবশ্য ফেলু ব্যাখ্যা করে দিয়েছে। মামলার বিবরণ তো লিখেছে চির-কিশোর তোপসে, আর তার মূল লক্ষ্য কিশোর বয়সী পাঠক-পাঠিকা! নইলে লখাইপুরের জোড়া খুন, বা চন্দননগরের জোড়া খুনের মামলার খবর হয়তো আমরা পেয়ে যেতাম! প্রকৃত অপরাধের জগৎ কিন্তু আদতে কামনা-বাসনা ও নারী বহুল! সেই দিক দিয়ে দেখলে ব্যোমকেশ অনেক বাস্তবানুগ মামলা সামলেছে। ফেলুর অনেক মামলাই এক ধরনের গুপ্তধন সন্ধান বলা চলে। যেমন ‘বাদশাহী আংটি’, ‘কৈলাসে কেলেংকারী’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’, ‘রয়েলবেঙ্গল রহস্য’ বা ‘গোরস্থানে সাবধান!’ ইত্যাদি আরো কয়েকটি। ব্যোমকেশও গুপ্তধনের খোঁজে মেতেছে! তবে সেরকম মামলা সংখ্যায় কম। যেমন ‘সীমন্ত-হীরা’, ‘রক্তমুখী নীলা’, ‘দুর্গ রহস্য’ বা ‘ব্যোমকেশ ও বরদা’। ফেলুকে দেখতে শুনতে বেশ অসাধারণ। ছ-ফুট লম্বা। ওর চলন-বলন, চোখের চাহনি, গলার স্বর, রিভলভারের টিপ এসবই যে অসাধারণ তা অন্যের মুখ থেকে আমরা জেনে যাই। কিন্তু ব্যোমকেশকে দেখতে অসাধারণ কিছু না। আর পাঁচটা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির মতই তার চাল-চলন। এমনকী সে বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়াটাও করে মার্কা-মারা বাঙালিদের ঢঙে, আবার ভাব-ভালবাসাও সেই ধাঁচেই চলে। ব্যোমকেশের অসাধারণত্ব বেরিয়ে আসে যখন সে যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে অপরাধের বিশ্লেষণ করে বা কোন তর্কে বিপক্ষের (বেশির ভাগ সময়ে অজিতের) যুক্তি খণ্ডন করে! তখন তার শাণিত ঝকঝকে বুদ্ধির ছটা আমরা দেখতে পাই! ফেলু কথা নিয়ে খেলতে, শব্দের ধাঁধাঁর সমাধান করতে খুব পছন্দ করে। এদিকে সে বেশ দক্ষ! নানান ধরনের ধাঁধাঁর বইও তার পড়া আছে। মায় আস্ত একটি সংস্কৃত ধাঁধাঁর বইও তার সংগ্রহে আছে! তার বিভিন্ন মামলায় নানান ধরনের কথার ধাঁধাঁর সমাধানও তাকে করতে দেখা গেছে। যেমন ‘রয়েল-বেঙ্গল রহস্য’ বা ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ। ফেলুর হাতে কাজ না থাকলে নানান বিষয়ে দিশি-বিলিতি বই পড়ে বা মুখে মুখে লিমেরিক বানিয়ে সময় কাটাতে সে ভালবাসে। ফেলু আর তোপ্সে দুজনেই টিন্টিন্-এর কমিক্সের ভক্ত। সত্তর-আশির দশকের শহুরে বাঙালি ছেলেপুলেদের কাছে টিন্টিনের কমিক্সগুলো ছিল অতি সুখপাঠ্য! তবে ফেলুর একটা বদভ্যেস হল ফাঁক পেলেই সে তোপ্সে আর জটায়ুকে ফ্রিতে জ্ঞান বিতরণ করে। আর লালমোহনবাবুকে বিদ্রুপ-বাণে ব্যতিব্যস্ত করে! লালমোহনের গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ালেও, বা তার দৌলতে হিল্লি-দিল্লি গেলেও ফেলুর ভাবটা মাঝে মাঝে একটু যেন ‘ধন্য করে দিচ্ছি!’ গোছের!! বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সঙ্গে বই-পড়ার আর জ্ঞান দেওয়ার একটা অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ আছে বলা চলে। ফেলুর মধ্যে সেই ছাঁচটা আমরা খুব বিশদে পাই। ব্যোমকেশও বই পড়ত। তবে জ্ঞান দিত না। মাঝে মধ্যে অজিতের বোকামিতে বিরক্ত হোত বা ঠাট্টা করত, তবে সেটা সামান্যই। অজিত একবার ‘খোকা’কে (ব্যোমকেশের শিশু পুত্র) ‘আবোলতাবোল’ কিনে দেওয়ার পর ব্যোমকেশ সেটি পড়ে ফ্যালে এবং তারপর প্রাচীন বাংলা কাব্যসাহিত্য থেকে শুরু করে একে একে ভারতচন্দ্র, ঈশ্বরগুপ্ত ইত্যাদি পড়ে প্রায় আধুনিক বাংলা কবিদের লেখাও পড়ে ফেলেছিল। এছাড়া তার জয়দেব পড়া আছে, রামায়ণ-মহাভারত পড়া আছে। তবে খুব নিয়ম করে বোধহয় পড়ত না। ব্যোমকেশ মনেহয় খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের পাতা পড়তেই বেশি ভালবাসত! তার মতে, ওখানেই সব দরকারি খবর থাকে; বিশেষতঃ ‘ব্যক্তিগত’ কলামে। দুজনেই দাবা খেলতে জানত। ব্যোমকেশকে দাবাটা অজিতই শিখিয়েছিল, কিন্তু খুব শীঘ্রই তার কাছে কিস্তি-মাত হয়ে বেশ কিছুদিন মন মরা হয়ে ছিল। ফেলুও দাবা খেলতে জানত এবং মাঝে মধ্যে কয়েকটি বিশ্ব-বিখ্যাত দাবার ম্যাচের চাল বই দেখে দেখে প্র্যাকটিস্ও করত! এই দাবা খেলাও বুদ্ধিমত্তার আরেকটা স্টিরিওটাইপ! যিনি ভাল দাবাড়ু, তিনি নিশ্চয়ই তুখোড় গোয়েন্দাও হতে পারেন (অথবা উল্টোটা!) এমন একটা ধারণা যেন আপনা থেকেই এসে যায় বাঙালির মনে। ব্যোমকেশের মামলায় বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকের আরেকটি ছাঁচ আমরা পেয়ে যাই। সেটি হল সাবেকি পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ছাঁচ। যেখানে অনেকগুলি পোষ্য বা আশ্রিত এক সমর্থ পুরুষের আশ্রয়ে জীবনযাপন করে। বাড়ির কর্তাই সেখানে প্রধান। কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। এরকম অনেক কর্তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় বিভিন্ন মামলার সূত্রে। যেমন ‘অর্থমনর্থম’-এর করালীচরণ, কিম্বা ‘মগ্ন-মৈনাক’-এর সন্তোষ সমাদ্দার, কিম্বা ‘বেণী-সংহার’এর বেণীমাধব অথবা ‘দুর্গ-রহস্য’র রামকিশোর ইত্যাদি। ফেলুর গোয়েন্দাগিরির সময়টায় এই প্যাট্রিয়ার্কির আদল হারিয়ে যাচ্ছে। ফেলু নিজে তার কাকার পরিবারের সংগে থাকলেও, বৃহৎ যৌথ পরিবারগুলো সব আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে ততোদিনে। জমিদারি প্রথা তার বহু আগেই উচ্ছেদ হয়ে গেছে। ফলতঃ বাঙালির বাবুয়ানিও তখন নিভু-নিভু। বনেদিয়ানা, পুরনো সহবত, চলন-বলন, বিনয় ইত্যাদি দ্রুত অপসৃয়মান। তাই নিয়ে ফেলুকে আক্ষেপ করতেও শোনা যায় (‘বাক্স-রহস্য’)! তাই ফেলুর মামলায় আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে পড়ন্ত বনেদী বাঙালি পরিবারের কয়েকজন প্রতিভূ। যেমন কৈলাস চৌধুরী, দীননাথ লাহিড়ি, কিম্বা অম্বিকা ঘোষাল অথবা মহীতোষ সিংহরায়! ব্যোমকেশের সময় কিন্তু, অন্ততঃ পক্ষে গুটিকয়েক মামলায়, এই রকম বনেদী চরিত্র (যেমন রমেন মল্লিক, মহারাজা রমেন্দ্র সিংহ, কুমার ত্রিবিবেন্দ্রনারায়ণ, হিমাংশু রায় বা রামকিশোর সিংহ) স্বমহিমায় বিরাজমান! তখনও তাঁরা পুরনো বোল-চাল, বিলাসিতা বা দান-ধ্যান পূর্ণ মাত্রায় বজায় রেখেছেন। এটিও বোধহয় দুটি ভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতির প্রতিফলন। ফেলুর মামলায় আর একটা মজার ব্যাপার আমাদের চোখে পড়ে! যেটা সময়ের দিক থেকে কিছুটা বেখাপ্পা লাগে। সেটি হল ফেলুর মক্কেলদের মধ্যে এতো প্রাইভেট সেক্রেটারির ছড়াছড়ি! ব্যোমকেশের মামলাতেও প্রাইভেট সেক্রেটারির দেখা মেলে। যেমন মহারাজা রমেন্দ্রসিংহের সেক্রেটারি হরিপদ রক্ষিত (‘রক্তমুখী নীলা’), কিম্বা সন্তোষ সমাদ্দারের সেক্রেটারি রবিবর্মা (‘মগ্ন-মৈনাক’), কিম্বা স্যর দিগিনরায়ের প্রাইভেট সেক্রেটারি হয়ে ব্যোমকেশ আর অজিতের তার বাড়িতে ঢোকার অপ-চেষ্টা (‘সীমন্ত-হীরা’) ইত্যাদি! কিন্তু, সেসময়টাও ছিল স্বাধীনতার আশেপাশে। তখনও বাংলাদেশের বড়মানুষদের বা বিখ্যাত মানুষদের অনেকের মধ্যে সেক্রেটারি রাখার চল ছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের দুই বিখ্যাত সেক্রেটারি ছিলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও কবি অমিয় চক্রবর্তী (এঁরা দুজনে রবীন্দ্রনাথের বিদেশ সফরের সময় দুবার সেক্রেটারি হিসেবে ওনার সঙ্গে যান)! কিন্তু, ফেলুর গোয়েন্দাগিরির সময় ব্যাপারটার ততোটা চল ছিল কি? অথচ ফেলুর ‘রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য’, ‘হত্যাপুরী’, ’গোলকধাম-রহস্য’, ‘ভূ-স্বর্গ ভয়ংকর’, ‘দার্জিলিং জমজমাট’, ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’, ‘ডক্টর মুন্সীর ডায়রি’, কিম্বা ‘ইন্দ্রজাল রহস্য’ ইত্যাদি মামলায় একটু সঙ্গতি-সম্পন্ন মক্কেলদের অনেকরই সঙ্গে একটি করে প্রাইভেট সেক্রেটারির দেখা মেলে!
অন্য একটা মজার কথায় আসি। ফেলু আর ব্যোমকেশ দুজনকেই মামলার সূত্রে অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ব্যোমকেশের ক্ষেত্রে অন্ততঃ পক্ষে একবার সেটা প্রকৃতই অলৌকিক ঘটনা হয়ে উঠেছে (‘শৈলরহস্য’)। এক অশান্ত প্রেতাত্মার দেওয়া সূত্র ধরে সে একটি খুনের মামলার সত্য উদ্ঘাটন করেছে শেষ পর্যন্ত। ফেলুর ক্ষেত্রেও কিন্তু, একবার অন্ততঃ অলৌকিকের পেছনে কোন ফাঁকি ছিল না (‘দার্জিলিং জমজমাট’)। দুজনেরই নীতিবোধ অত্যন্ত প্রখর ছিল। কোন সমঝোতা, বা চাপের মুখে পিছু হটার পাত্র এরা কেউ ছিল না। আর সময় সময় ন্যায় বিচারের ভার নিজেদের হাতে তুলে নিতেও এরা পিছু-পা হয়নি; এমন কী কয়েকজন খুনিকেও এরা দুজন আইনের হাতে তুলে না দিয়ে, ক্ষেত্র বিশেষে রেহাই দিয়েছে! আইন নিজেদের হাতে তুলে নিলেও তার পেছনের কারণগুলো এতটাই স্বচ্ছ ছিল যে, আমাদের মনে সে সম্বন্ধে দ্বি-মত থাকে না।
শেষ পর্যন্ত এরা দুজনেই খাঁটি বাঙালি! হাবে, ভাবে, কথায়, কাজের ধরনে এরা মজ্জায় মজ্জায় বাঙালি! হতে পারে এরা দুজনে দুটি ভিন্ন সময়ের সন্তান। তবু, মধ্যবিত্ত বাঙালিয়ানাই এদের দুজনকে একই সূত্রে গেঁথে ফেলে আর এদেরকে আমাদের কাছে এতটা আপন করে তোলে। এরা চিরকাল আমাদের ঘরের লোকই হয়ে থাকবে। আমার স্থির বিশ্বাস যে হাজার শার্লক হোম্স্, এরক্যুল পোয়ারো, মিস্ মার্পল, স্যাম স্পেড, ফিলিপ মারলো, পেরি মেসন বা মেইগ্রের মামলার গল্প পড়ার পরও এদের কাছেই আমাদের ফিরতে হবে দু-দণ্ড স্বস্তি পেতে!
তথ্য সূত্রঃ
১) ব্যোমকেশ সমগ্র –শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (আনন্দ পাবলিশার্স)
২) ফেলুদা সমগ্র -১, ২ – সত্যজিৎ রায় (আনন্দ পাবলিশার্স)
৩) কোরক পত্রিকা – শরদিন্দু সংখ্যা