উফ! আমেরিকায় এসে যে এত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হবে সেটা দীপ্ত জন্মেও ভাবতে পারেনি! কলকাতায় থাকতে প্রথম যখন জেনেছিল যে আমেরিকার একটা কলেজে ভর্তি হতে পেরেছে তখন ওর মনে কত আনন্দই না হয়েছিল। বড়লোক বাড়ির ছেলে নয় দীপ্ত। ওর বাবা সাধারণ একটা চাকরি করেন। নেহাৎ কলেজ থেকে স্টাইপেন্ড আর স্কলারশিপ দুটোই দিচ্ছে না-হলে ওর এখানে আসা সম্ভবই ছিল না! কিন্তু অনেক কিছুই বুঝতে পারা যায়নি দেশ থেকে। যেমন বোঝা যায়নি যে মার্কিন মুলুকের ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরের একটা কলেজে পড়তে এলে এদিক সেদিক যাওয়া আসা করার জন্যে একটা গাড়ি থাকা দরকার হয়ে পড়ে। এই মিলার্সভিল নামক গণ্ডগ্রামে বাস-টাস আদৌ চলে না, দরকারও নেই। সবার গাড়ি আছে এখানে। বেশ ঝকঝকে সুন্দর অবস্থাপন্ন গ্রাম। কলেজের ডর্মিটরিতেই থাকে দীপ্ত তাই কলেজে যাতায়াত করতে অসুবিধা হয় না কিন্তু খেয়ে পরে থাকার জন্যে বাজারহাট তো একটু করতেই হয়! কয়েকদিন বাদেই বুঝতে পারল যে ওই স্টাইপেন্ড আর স্কলারশিপ মোটেই যথেষ্ট নয়। কোন রকমে টায়েটুয়ে চলছে আর একটা গাড়ি ওকে কিনতেই হবে খুব শীঘ্রই। এদিকে পুরোনো সেকেন্ডহ্যান্ড কেনার জন্যেও যে অর্থ লাগবে সেটা জমাতেই ওর বহু সময় লেগে যাবে।
এরিকই ওকে কলোসাল বার্গার্সে কাজ করার কথাটা বলেছিল।
“তোর কী অর্থের প্রয়োজন? বিকেলে ক্লাসের পর কাজ করতে চাস? কলোসাল বার্গার্সে ওরা লোক খুঁজছে। এখান থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ তাই তোর যেতে আসতে অসুবিধা হবে না। ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতেও কাজ পাওয়া যায় কিন্তু ওদের কাছে এত বেশি অ্যাপ্লিকেশান জমা পড়ে যে চান্স পেতে পেতে ছ’-সাত মাস লেগে যেতে পারে। দোকানে কাজ করতে কী তোর আপত্তি আছে?”
“না তা নেই, কিছু বাড়তি পয়সা পেলেই হল। গাড়িটা তো কিনতেই হবে, না হলে খুব অসুবিধা হচ্ছে।”
“ব্যস ঠিক আছে। আমি ম্যানেজারের সাথে কথা বলে রাখব। তুই ক্লাসের পর গিয়ে কথা বলে নিস।”
তাই করল দীপ্ত। ওকে কয়েকটা প্রশ্ন করেই চাকরিতে বহাল করে নিলেন ম্যানেজার মিস্টার পল।
সেই শুরু। ক্লাসের পর প্রায় ছুটতে ছুটতে গিয়ে কলোসাল বার্গার্সে হাজির হয় দীপ্ত। ডাঁই ডাঁই আলু ভাজে, অসংখ্য মাংসের চাঁই পাঁউরুটির মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে বার্গার বানায়, লেটুস কাটে টমেটো কাটে। কাজের পর ফ্রিতে বার্গার খেতে পায়। যদিও সেটা রোজ খেতে মোটেই ভাল লাগে না ওর, মাঝে মাঝে খায়। বাড়িতে অবশ্য কিছু বলেনি সে। ওকে খাবার দোকানে কাজ করতে হচ্ছে শুনে মা বাবা যদি দুঃখ পান সেই ভেবে। এখানে অবশ্য বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরাই কোথাও না কোথাও কাজ করে তাই কে কোথায় কাজ করছে তাই নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।
মন দিয়ে কাজ করে বলে কিছুদিনের মধ্যেই মিস্টার পল ওর প্রতি বেশ খুশি হয়ে ওকে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার করে দিলেন। তার অবশ্য আরেকটা কারণ আছে। দীপ্ত ছাড়া দোকানে আর যারা কাজ করে তারা সবাই অঙ্কে একেবারে কাঁচা! ছোটখাটো হিসেব মেলাতেই হিমশিম খায়। বারো দুকুনে চব্বিশ বা চার সাত্তে আঠাশ হয় সেটা বুঝতেই ভির্মি লাগে বাকিদের! তাই দীপ্তকে হুড়হুড় করে হিসেব করতে দেখে বড়ই আপ্লুত হন মিস্টার পল। উনি নিজেই যে অঙ্কে বেজায় কাঁচা!
যাই হোক ক্লাসের শেষে আর শনি রবিবার এই চাকরিটা করে দীপ্তর লাভই হয়েছে। সে একটা গাড়ি কিনতে পেরেছে। একটা বিস্কুট রঙের টয়োটা করলা। যদিও প্রচুর চলেছে গাড়িটা আর পিছনের সিটে একটা কালচে ছোপ কিন্তু তাও গাড়ি তো! গাড়ির ডিলারের কাছে কিনেছে বলে পুরো দামটা দিতে হয়নি। মাসে মাসে শোধ দিচ্ছে সে। গাড়ি চালানোটাও শিখে নিয়েছে, যদিও দূরে যেতে এখনও সাহস হয়নি।
তারপর একদিন ঘটনাটা ঘটে গেল। সেদিন ক্লাস শেষ করে কাজে যেতে যেতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল দীপ্তর। আসলে ক্লাসে স্যার একটা ইন্টারেস্টিং টপিক নিয়ে পড়াচ্ছিলেন তাই অনেকের অনেক কিছু প্রশ্ন ছিল, দীপ্তরও ছিল। অবশেষে স্যার যেতে ছুটতে ছুটতে পার্কিং লট থেকে গাড়িটা নিতে গেল দীপ্ত। কাজের পর আবার দোকানে যাওয়া আছে আজকে তাই গাড়িটা লাগবে। পরের দিনের স্টুডেন্ট সেমিনারের জন্যে বিস্কুট, সফট ড্রিঙ্ক ইত্যাদি কিনতে হবে। ওটা ওদের ডিপার্টমেন্ট থেকেই ছাত্রদের উপর দায়িত্ব দেওয়া আছে। এক একদিন এক একজন। কাল দীপ্তর চান্স।
কলোসাল বার্গার্সে পৌঁছে গাড়িটা পার্ক করে কিছুটা দূর হেঁটে যেতে হয়। দীপ্ত গাড়ি থেকে নামা মাত্র আরেকটা গাড়ি এসে ঘ্যাঁচ করে এসে দাঁড়াল ওর থেকে কিছুটা দূরে। দুটো বেশ লম্বা চওড়া চেহারার লোক নামল গাড়িটা থেকে। তা নামুক। কলোসাল বার্গার্সের খাবার খুব জনপ্রিয় তাই সবাই আসে। লোক দুটোর মুখ প্রায় দেখাই যাচ্ছে না, মাথার টুপি মুখের উপর নামানো আর জামার কলার তোলা! পার্কিং লট পেরিয়ে লোক দুটো হনহন করে দোকানে ঢুকে গেল। দীপ্তও ওদের পিছন পিছন ঢুকতে যাচ্ছিল হঠাৎ ওর মনে হল গাড়িটা বোধহয় লক করা হয়নি। সেটা ভেবেই আবার ও পার্কিং লট পেরিয়ে গাড়ির কাছে ফিরে গেল। ভাগ্যিস মনে পড়েছিল, গাড়িটা সত্যি লক করা ছিল না। সেটাকে লক করে আবার চলল। যেদিন দেরি হয় সেদিন সব কিছুতে শুধু দেরিই হতে থাকে! মিস্টার পল আবার কর্মচারিরা ঠিক সময়ে না এলে বেশ রাগ করেন। দীপ্তকে তেমন কিছু বলেন না বটে কিন্তু অন্যদের খুব খানিক কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেন।
কাঁচের দরজাটা দিয়ে ঢুকতে গিয়েই চমকে উঠল দীপ্ত। আরে ভিতরে তো কিছু একটা গণ্ডগোল চলছে মনে হয়! ওই ষণ্ডামার্কা লোক দুটোর হাতে বন্দুক আর মিস্টার পল আর অন্যান্য কর্মচারিরা হাত তুলে দাঁড়িয়ে! দোকানে ডাকাতি চলছে! এই সময়টা দোকানে তেমন ভিড় থাকে না, ভিড়টা একটু পরে থেকে শুরু হবে। তাও দুয়েকজন যারা ভিতরে খাচ্ছিল তারা ভয়ে তটস্থ হয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে! কী করবে এবার দীপ্ত। ভিতরে ঢোকার তো কোন মানেই হয় না। লোক দুটোর সাথে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা যে ওর নেই সেটা দীপ্ত ভালই জানে। সে প্যাংলা রোগা পটকা আর ওদের তো জাঁদরেল চেহারা, তাছাড়া ওদের কাছে বন্দুক আছে।
চট করে দরজার কাছে থেকে সরে গিয়ে মোবাইল ফোনে পুলিশকে ফোন করল দীপ্ত। যে ধরল তার ওকে হাজারটা প্রশ্ন! উফ! এত প্রশ্ন করার কী আছে? এত কিছু জিজ্ঞেস করলে ওরা আসার আগেই তো সব শেষ হয়ে যাবে!
হঠাৎ দীপ্তর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। কিছুদিন আগেই এক বন্ধুর সাথে একটা কার রেসিং দেখতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ওর। ছেলেটার কাকা রেস করেন তাই ও বেশ কিছু টিকিট ফ্রিতে পেয়েছিল আর দীপ্ত এখন ক্লাসে বেশ পপুলার পড়াশোনায় ভাল বলে তা ওকে সঙ্গে নিয়েছিল ছেলেটা। ওখানে দীপ্ত দেখেছিল গাড়ির চাকার উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে বলে কিছুক্ষণ রেস করার পর চাকা বদল করতে হয়। অত্যন্ত নিপুণ এবং প্রশিক্ষিত একটা দল থাকে প্রতি ড্রাইভারের যারা খুব কম সময়ের মধ্যে চাকা বদল করে দেয়। ওই সময়টাকে বলা হয় পিট স্টপ। দীপ্তর গাড়িতে একটা যন্ত্র আছে যেটাকে এখানে বলে জ্যাক। বাংলায় কী বলে দীপ্ত জানে না কারণ কলকাতায় সে কোনদিন গাড়ি চালায়নি। সেই জ্যাক দিয়ে গাড়ির চাকা খোলা যায়। টায়ার কী ভাবে বদলাতে হয় সেটা শিখে নিয়েছে দীপ্ত। পুরোনো গাড়ি কখন কী কাজে লাগে বলা তো যায় না!
ফোন ছেড়ে বিদ্যুৎ বেগে নিজের গাড়িটা থেকে জ্যাকটা নিয়ে ওদের গাড়ির দিকে ছুটে গেল দীপ্ত। জ্যাকটা ব্যবহার করে ওদের গাড়ির সামনের দুটো চাকা খুলে গড়াতে গড়াতে নিয়ে গিয়ে একটা দেওয়ালের পিছনে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগল। এইবার বাছাধনরা কী ভাবে পালায় দেখা যাক!
অল্প সময়ের মধ্যেই লোক দুটো দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। ছুটে নিজেদের গাড়ির কাছে এসেই তো ওদের মাথায় হাত! গাড়ির সামনের দুটো চাকা হাওয়া! অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিতে লাগল তারা কিন্তু কিছু করার নেই! ওরা গাড়ির ভিতর থেকে জিনিস বার করে করে একটা ব্যাগে ভরতে লাগল পায়ে হেঁটে পালাবে বলে মনে হয় কিন্তু তখুনি প্যাঁ পোঁ করে সাইরেন বাজিয়ে পুলিশ এসে হাজির!
লোক দুটো পালাতে গিয়েও পারল না। পুলিশের হাতে ধরা পড়ল। বিজয়ী বীরের মতন দুটো চাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখল দীপ্ত।
বুদ্ধি করে অভিনব উপায়ে বদমাইশদের ধরার জন্যে কলোসাল বার্গার্সের মালিক খুশি হয়ে দীপ্তকে মোটা টাকা পুরস্কার দিয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে গাড়ির লোনটা শোধ করে ফেলেছে দীপ্ত। ওর হয়তো আর কলোসাল বার্গার্সে কাজ করার দরকার ছিল না কিন্তু ও তাও করছে। আসলে ব্যাপারটা এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে! তাছাড়া সবাই যে ওকে বেশ হিরোর মতন দেখে আর সম্মান দেয় সেটা পেতে কার না ভাল লাগে। ক্লাসের যে ছেলেটার কাকা রেস করেন তিনি অবশ্য বলেছেন দীপ্তর যদি অন্য কিছু করতে ইচ্ছে করে তাহলে ও যে কোন দিন ওনার গাড়ি চাকা বদলের টিমে যোগ দিতে পারে!