পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল প্রীতম বসু; প্রথম প্রকাশ: ২০১৫; প্রকাশক: লেখক; পৃষ্ঠাঃ ২৩০; ISBN*: 978-0-692-58858-1
"মানব-সংসারে প্রকৃত অর্থে ধ্রুব বলে সত্যিই কি কিছু আছে, নাকি নিয়ত ঘটে চলা পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুবসত্য? এই পরিবর্তন কখনো নিভৃতে ভিতরে ঘটে চলে কখনো বাহ্যিক কারণ-হেতু গতি পায়। আমাদের বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিও এর বাইরে নয়।
বাংলা ভাষার বয়স সব মিলিয়ে হাজার-দেড় হাজার বছর মাত্র। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তার রূপ-রস-লাবণ্য-মাধুর্য তাকে যথার্থই তিলোত্তমায় পরিণত করেছে। শ্রী প্রীতম বসুর “পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল” গ্রন্থটির পরতে পরতে তারই বহিঃপ্রকাশ। প্রাচীনকালের বঙ্গদেশ ও বাংলা ভাষার একটি নিটোল কথাচিত্র লেখক সুচারুরূপে তুলে ধরেছেন, যাতে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার বিভিন্নতা ও বৈশিষ্ট্য, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বৈদেশিক আক্রমণ, ভিন্নধর্মের পারস্পরিক সহাবস্থান (হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম), ধর্মাচরণ, লোকাচার, যুদ্ধবিদ্যা, এ-সবই ধরা পড়েছে তাঁর একনিষ্ঠ লেখনীতে। এই গ্রন্থটির প্রেক্ষাপট দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে আমাদেরকে দাঁড় করায় দু’টি আলাদা আলাদা সময়-সারণীর সামনে। আর এখানেই লেখকের প্রকৃত মনোযোগী ও ধৈর্যশীল গবেষক মনের পরিচয় পাওয়া যায়। পরিচয় পাওয়া যায় এক প্রকৃত অর্থেই প্রেমিক বাঙালির যিনি শুধু স্বভাব-রোমান্টিক নন, ভাষাপ্রেমিকও বটে। গ্রন্থপরিচয়ে পাওয়া তথ্যানুযায়ী লেখক আমেরিকার নিউ-ইয়র্ক শহরবাসী। শুধুমাত্র মাতৃভাষাকে ভালবেসে প্রবাসে থেকেও এমন পরিশ্রমলব্ধ একটি আলেখ্য প্রস্তুত করা যে সম্ভব তা এই বইটি না পড়লে বিশ্বাস করা কঠিন হতো।
বাংলা ভাষার ইতিহাসের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন যে ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে পঞ্চাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ অবধি প্রায় আড়াইশো বছরের ভাষা ইতিহাস সাধারণের কাছে অজ্ঞাত। তার কারণ, এই সময়কার বাংলা ভাষা সাহিত্যের কোন নমুনাই খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে, সেই সময়কার ভাষা, তার রূপ, চলন, লিপি তথা, তৎকালীন সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম কোনকিছুরই হদিস পাওয়া সম্ভব হয় না বাংলার নিজস্ব ভাষায়। লেখক এক দুঁদে গোয়েন্দার মতোই রহস্যের কিনারা ধরে আমাদের সামনে এই হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বাংলাভাষার এক অভিনব সত্যকে তুলে ধরেন তাঁর “পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল”-এর মাধ্যমে, যা পড়ে আমরা অভিভূত হই, ক্রুদ্ধ হই, সমৃদ্ধ হই।
জানা যায়, আটশো শতাব্দীর শেষভাগে ভারতীয় পণ্ডিতের হাত ধরে ভারতের সুপ্রাচীন গণিতবিদ্যা পৌঁছোয় বাগদাদের রাজসভায়, আরবিতে অনুবাদ করা হয় সেই পুঁথিগুলির। সেই সূত্রেই পরবর্তীকালে অল-খোয়ারিজমি ‘ভারতের সংখ্যা দিয়ে গণনাপদ্ধতি’ ব্যবহার করে “অ্যালগরিদম”এর জনক হিসাবে পশ্চিমী দুনিয়ার কাছে পরিচিত হন (অল-খোয়ারিজম এর অপভ্রংশই আজকের অ্যালগরিদম) আর তারপর বক্তিয়ার খিলজি ভারতের গর্ব নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণ করেন এবং সুপরিকল্পিতভাবে তিন মাস ধরে পোড়ান হয় ভারতের মহামূল্যবান পুঁথিসমূহকে, যাতে কিনা ভারতের একান্ত নিজস্ব গণিতবিদ্যা আবিষ্কারের উজ্জ্বল ইতিহাস কালের গর্ভে চিরকালের মতো নিমজ্জিত হয়। জানতে পারি তখনই আবিষ্কৃত হয়ে গেছিল আলোর গতিবেগের পরিমাপ, 'পাই'-এর মান, অ্যালজেব্রা, ত্রিকোণমিতি, দশমিকের ব্যবহার, পিথাগোরাসের থিওরেম – পিথাগোরাসের জন্মের দুশো বছর আগেই।
বইটি মন দিয়ে পড়লে তৎকালীন বাংলার সমৃদ্ধির ছবি সহজেই ধরা দেয়। ইতিহাস বইএর পাতায় লেখা থাকে মোগল সম্রাট বাবর পানিপথের প্রথম যুদ্ধে (১৫২৬ খৃঃ) ভারতে প্রথম কামান ব্যবহার করেন, কিন্তু প্রীতমবাবুর পরিশ্রমী গবেষণা জানায় পানিপথের যুদ্ধের অন্ততঃ নয় বছর আগে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পর্তুগীজদের জাহাজে কামান দাগেন। বাবর তাঁর আত্মজীবনীতেও বাঙালির কামান চালাবার প্রশংসা করেছেন। খাল-বিল, নদী-নালার বাংলা সেকালে নৌ-নির্মাণ বিদ্যাতেও পারদর্শিতা লাভ করেছিল। বিশেষতঃ যশোরের কারিগরদের দক্ষতার খবর সুদূর চীনদেশের কারিগরদেরও এদেশে নৌ-বিদ্যা শিখতে টেনে এনেছিল।
তৎকালীন বাংলা লিপি যে ব্রাহ্মী লিপির পূর্বভারতীয় রূপ ‘কুটিলা’ থেকে উৎপন্ন হয়েছে তার ফরমেটিভ নমুনা এই গ্রন্থটিতে দেওয়ায় পাঠকের লিপিটি সম্বন্ধে ধারণা পরিষ্কার করবে। বাংলা লিপি যে দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজকের চেহারায় পৌঁছেছে, কিংবা তার বর্ণ-বিন্যাস বা লেখায় নির্দিষ্ট কিছু বর্ণের ব্যবহারের আধিক্য – বিভিন্ন চরিত্রের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে লেখক তা অনায়াসে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পচ্ছলে।
'পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল'-এর হরু ঠাকুর এক ঘোর বা trance এর মধ্যে পৌঁছে গিয়ে পাঠককুলকেও নিয়ে চলে যান পনেরশ শতাব্দীতে - পুজারী নন্দীধন ও তার সুন্দরী কন্যা ভানুমতির সহজ গেরস্থালী, জমিদার জটামদনের অত্যাচার, রোমথা বলরাম ও ভানুমতির সরল প্রেম, বারাঙ্গনার সহায়তা – এসবই উঠে এসেছে প্রাচীন মঙ্গলকাব্যের অবয়বে ও চলনে। লেখকের কুশল লেখনী এবং ভাষামাধুর্য অনায়াসেই পাঠকের মনকে ছুঁয়ে যায়। প্রীতম বসুর অনায়াস লেখন প্রতিটি চরিত্র ও ঘটনাবলীকে কাব্যময় করে তোলে –
কুসুম কোঁঅলী তার ছিন্ডিআঁছে অলঙ্কারযে কোন মঙ্গলকাব্যের বিশেষত্ব এই যে তা কোন না কোন লৌকিক দেবতার মহিমাবর্ণন এবং বন্দনা করে রচিত হয়ে থাকে। এবং এই বর্ণনা ও বন্দনার কেন্দ্রে থাকে এক বা একাধিক চরিত্র, তাদের দিনযাপন, বিপদের শঙ্কা এবং বিশেষ দেব বা দেবীর মাহাত্ম্যে সেই বিপদ থেকে মুক্তি। 'পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল'ও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রীতম বসুর লেখা পঞ্চাননমঙ্গলকাব্যে বলরাম ও ভানুমতির জীবনের উপর অকস্মাৎ নেমে আসা বিপদ থেকে বাবা পঞ্চানন বা পাঁচ-মুখওয়ালা শিব ঠাকুরের কৃপায় সেই বিপদ থেকে তাদের মুক্তির গাথা বর্ণিত হয়। রচিত হয় একটি সার্থক মঙ্গলকাব্য, তৎকালীন সমাজ, ধর্ম, বিশ্বাস, লোকাচার – এ সবের সামগ্রিক রূপ নিয়ে গড়ে ওঠা এক ছন্দময় পরিবেশনা। সে যুগের প্রাচীন বাংলা ভাষা প্রকরণ সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করে, রীতি অনুযায়ী 'পঞ্চাননমঙ্গল' রচনা করেছেন এযুগের প্রীতমবাবু, যা পড়তে গিয়ে প্রায়শঃই কোন তৎকালীন কবির লেখা বলে ভ্রম হয়।
ছিন্ডিআঁছে যত মানভএ।
গোরা তার দেহকান্ত আনুপাম বীর শান্ত
দীঠি কৈল তারি মন জয়।
ছিন্ন নিচোল ছিন্ন কেশ দেয়ি আপনা বেশ
ঢাকিলেঁ তিরির লাজ
পুরুষের বসনে জেন বনদেবী বনে
অপরুব তার দেহসাজ।।
শ্রদ্ধেয় স্বর্গতঃ নীরদচন্দ্র চৌধুরী অতিসঙ্গত কারণেই বাঙালিকে ‘আত্মঘাতী জাতি’ বলে অভিহিত করেছিলেন – এ যেমন সত্য তেমনই বাংলার উপর বারংবার নেমে আসা কূট উদ্দেশ্যপূর্ণ জঘন্য আক্রমণের দ্বারা বাংলার বিশেষতঃ বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক সম্পদকে চিরতরে কালের গহ্বরে নিমজ্জিত করবার প্রচেষ্টা তার চেয়েও বেশি সত্য।
তবু আশার কথা এই যে গল্পের সেই ফিনিক্স পাখির মতোই সুপ্রাচীন সেই সংস্কৃতি, সেই ঐতিহ্য, সেই গর্ব তার সামগ্রিক রূপের ছটা নিয়ে আবার উঠে এসে দাঁড়িয়েছে 'পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল'এর মাধ্যমে। এই ফিনিক্স পাখিকে প্রাণ দিয়েছেন লেখক প্রীতম বসু স্বয়ং। তাঁর লেখনীতে উঠে এসেছে তৎকালীন বাংলাভাষার প্রচলিত রূপ, যা আজকের আমাদের কাছে একান্তই অজানা-অচেনা। লেখকের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি স্বয়ং সেই বিলুপ্ত ভাষারূপ আয়ত্ত করে প্রাচীন বাংলায় একটি সমগ্র কাব্যরচনা করেছেন – যার নিদর্শন একমাত্র তখনকার লেখাতেই পাওয়া সম্ভব। এ বড় সহজ ব্যাপার নয়।
যদিও বইটির কাহিনি 'পঞ্চাননমঙ্গল' নামক এক কাল্পনিক মঙ্গলকাব্যকে বেষ্টন করে গড়ে উঠেছে, কিন্তু লেখক শুধুমাত্র মঙ্গলকাব্যের অবয়বে বইটিকে না রেখে তাকে এক রহস্যে ঠাসা fiction-এর জ্যাকেটে মুড়ে পাঠকের কাছে পরিবেশন করেছেন। গদ্য-পদ্যের ঠাসবুনুনিতে, বিজ্ঞান-সাহিত্য-ইতিহাসের মেলবন্ধনে এ এক স্বতন্ত্রশ্রেণীর সাহিত্যের ঘরানা হয়ে উঠেছে। যারা fiction-এর রহস্য-রোমাঞ্চ পড়ে আনন্দ পেতে চান এ-বই তাদের আনন্দ দেবে, আবার যারা আরো গভীরে নেমে বাংলাভাষার হারিয়ে যাওয়া অতীতের স্বাদ পেতে চান তাদেরও এ-বই তৃপ্তি দেবে।
'পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল' বইটির স্বকীয়তার আরও একটি কারণ বইটির অনবদ্য প্রচ্ছদ। শিল্পী শ্রী দেবাশীষ রায় যথার্থই সাযুজ্য রেখে অলংকরণ করেছেন বইটির। এই বইটি যে বাংলার এক প্রাচীন সময়কে ধরতে চেয়েছে তা প্রচ্ছদটির আঙ্গিকে সুস্পষ্ট।
পরিশেষে ক’টি কথা না বললেই নয় – আত্মবিস্মৃত বাঙালিজাতির মধ্যে থেকে যখন প্রীতমবাবুর মতো একজন উঠে দাঁড়িয়ে প্রচুর সময় ও ধৈর্য সাপেক্ষ গবেষণার মাধ্যমে আমাদেরকে বাংলাভাষা এবং বাংলার ও বাঙালির স্বরূপ দর্শন করান, তখন বাঙালি হিসাবে আমাদেরও দায়িত্ব থেকে যায় এই প্রচেষ্টাকে আন্তরিক সাধুবাদ জানানোর। আর সেটা তখনই সম্ভব যখন আমরা বইটি সকলে পড়ব এবং পড়াবো।