• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬১ | ডিসেম্বর ২০১৫ | উপন্যাস
    Share
  • অরণ্যকথা আইভি চট্টোপাধ্যায় ১ | ২ | শেষ | : আইভি চট্টোপাধ্যায়


    || দশ ||

    টুরি তাড়াতাড়ি গাঁয়ের পথে পা বাড়ালো। ডমন বলে, সব জায়গায় খতরনাক লোক আছে। টুরিও তো ভয়ে ভয়েই থাকত। খাকি উর্দি, সবুজ জংলা উর্দি, শার্ট-প্যান্ট পরনে বাবুলোক। দেখলেই লুকিয়ে পড়া। শিখেছে ছোট্ট থেকে। কিন্তু সব বাবুলোক যে খারাপ নয়, তা জেনেছে পাত্থরবাবুকে দেখে। কত্তগুলা দিন তো হয়ে গেল, পাত্থরবাবু এসে আছে গ্রামে। কেউ একটা মন্দ কথা বলেছে! সব্বো জনে বলে, ‘বাবুটো ভালো বটেক।'

    টুরি যে সকাল সন্ধে কত্তবার যায়, বাবু ঘরে না থাকলেও কাজকাম করে আসে, ঘরে থাকলেও টুরির কোনই অসুবিধে হয় না। বাবু তো টুরিদের কারো ক্ষতি করে না। নিজের মনে পাথর কুড়ায়। ডমন বলেছে, উ পাথরগুলা নাকি অনেক কাজে লাগে। বিক্রীও হয়।

    নিজের মনে থাকে পাত্থরবাবু। মাঝে মাঝেই অন্যমনে বসে থাকে।

    ‘মানুষটা অন্যমনে আছে,’ এই কথাটা মা বলত। গুছিয়ে কথা বলত মা। আপদে বিপদে সবাই মায়ের কাছে বুদ্ধি নিতে আসত। মানুষের দুটো মন আছে। একটা ঘুরছে ফিরছে, কাজকাম করছে, কথাবার্তা বলছে। আরেকটা মন, তাকে কেউ দেখতে পায় না। মানুষ নিজেও সব সময় সে মনের খবর রাখে না। সেই অন্যমন-টাই আসল। অন্যমন-ই মানুষকে চালায়।

    মা বলত। কোনোদিন গাঁয়ের বাইরে না যাওয়া, কোনোদিন ইশকুলে না পড়া, জঙ্গলের মানুষ ছাড়া কারো সঙ্গে মেলামেশা না করেও মা যে কি করে অমন গুছিয়ে ভাবনা করত কে জানে। তখন বোঝে নি কথাটা। আজকাল টুরি কথাটা বোঝে। আজকাল টুরির অন্যমনের ওপর বেশ ভরসা হয়েছে।

    অন্যমনে থাকে বলেই পাত্থরবাবুর দেখার চোখটাও অন্য মতন। টুরিদের সব পরবে যোগ দেয়। এসে আগুনের ধারে চুপ করে বসে থাকে। মহুয়া নেশাও করে। কিন্তু কোনোদিন গাঁয়ের একটা বিটিছেল্যাকেও খারাপ নজরে ডাকে নি।

    বরং ব্যবস্থা করে দিয়েছে যাতে শহর থেকে আজকাল একজন মেয়েলোক এসে গাঁয়ের মেয়েদের বাচ্চাদের সবাইকে ইঞ্জেকশন দিয়ে যায়। গাঁয়ের নোংরা জল বেরোবার নর্দমা তৈরি করে দিয়েছে। সিস্টার যখন গাঁয়ে এসেছিল, এসব দেখে খুব অবাক হয়েছিল। ‘কে করেছে এসব কাজ’ বলে নিজে থেকে পাত্থরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। সিস্টারও তো একটা মেয়ে বটেক। তাকে দেখেও পাত্থরবাবু অন্যমনেই থেকেছে। সাধুবাবার মত চোখ। সাধুবাবার মতই মন।

    ডমন যখন বাবুকে ঘর বানিয়ে দিল, তখন লায়াবুড়োর সামনে সব মরদরা বসে কথা বলেছিল। তখনই শুনেছে টুরি, শহরে নাকি মস্ত বাড়ি আছে বাবুর। নাকি বাপ-মায়ের একমাত্র ব্যাটা। অনেক পড়ালিখা। মস্ত চাকরি করত।

    সন্ন্যিসীর মতো সব ছেড়ে টুরিদের গাঁয়ে এসে আছে। অন্যমনে থাকে বলেই তো!

    দেখেশুনে ভরসা হয়েছে টুরিদের। বাবুর মতো অনেক লোকই আছে। সিস্টারও শহরের লোক। যে মেয়েলোকটা মাসে মাসে ইঞ্জেকশন দিতে আসে, সেও তো শহরের লোক। শহরের সব লোকই খারাপ নয়।

    পাত্থরবাবু এই ক’দিন আগেও টুরিকে বলেছে, ইশকুল হাসপাতাল ইঞ্জেকশন ই সব কত্ত দরকারি জিনিস। গাঁয়ের বাচ্চাগুলাকে নিয়ে গিয়ে কুইরি গাঁয়ের ইশকুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। সে ইশকুলে গবরমেণ্ট বলে একজন বাচ্চাগুলাকে খেতেও দেয়। মিড-ডে-মিল না কি একটা নামের খাবার। কেন যে গাঁয়ের বুড়ারা ছেলেদের ইশকুলে না যেতে দিয়ে ক্ষেতের কাজে লাগতে বলে, সে নিয়ে বাবু রোজ কত বোঝায় গাঁয়ের মরদগুলাকে। টুরিদের সবাইকেও বোঝায়। পাত্থরবাবু ছাড়া কোনো মরদ বিটিছেল্যাদের এত মান্যি করে এত শক্ত শক্ত কথা বোঝায় নাকি!

    লখন বলছিল একদিন। ওই যখন সিস্টারকে নিয়ে এল গ্রামে। টুরির ঘরের উঠোনে বসেই তো কথা হচ্ছিল। লখন বলেছিল, ‘আগে জানতেম মোদের দেশটার নাম ছোটনাগপুর, তারপর শুনলেম ঝাড়খণ্ড। এবার সিস্টারের কাছে ঠিক ঠিক শিখলাম। সদরেও বলল সবাই। দেশের নাম হল ইন্ডিয়া।'

    দেশের নাম ইন্ডিয়া? সে আবার কি? এই যে বসনের বিটির বিহা হল সদরে, কিংবা সাবির বর যুগলমাঝি যে সদরে চাকরি করে, উয়ারা ‘দেশ জেচ্ছি’ বললে কোথায় আসে? গাঁয়েই তো! তাহলে? নিজের জম্মোস্থানটাই তো দেশ। মাঝখান থেকি ইন্ডিয়া এল কেমনে!

    ধৈর্য ধরে বুঝিয়েছে পাত্থরবাবু। শুধু মাঝিপাড়া নামোপাড়া বেড়াপোতা কুলহি কুইরি গ্রাম নয়, একটা মস্ত বড় দেশ আছে। টুরিদের সবার দেশ। শুধু ফরেস্টার বাবুরা নয়, পুলিশ নয়, বিডিও সাহেব নয় ... সদরের লোকরা নয় ... সে দেশটার লোক এই গ্রামের সব্বোজন। দেশ খুব ভালো, দেশ সব্বার। এই গ্রাম, পাহাড়ের ওপারের গ্রাম, ঝোরা ছাড়িয়ে টুরির বাপের বাড়ির গ্রাম, বাসুদেবের শশুরঘরের ওঁরাও গ্রাম ... যত ডুলুং আছে, ডুংরি আছে, সব ... এমনকি সাতগুরুং পাহাড়, সবরনেখা নদী ... ক্ষেতের সবুজ ধান, শালবন, জঙ্গল সব ... সবটা মিলিয়ে একটা মস্ত বড় দেশ। ইন্ডিয়া। একটু পড়ালিখা শিখলেই সে দেশের পরশ পাবে টুরিরা সবাই। সে দেশে যেখানে যখন ইচ্ছে যেতে পারে সবাই। মেয়ে বলে কেউ ভয় দেখায় না, ডান বলে কাউকে একঘরে করে না। সেই দেশটার পরশ পেয়েছে রজনী টুডু, সিস্টার। ডান নীলমণিও।

    ওই যে মেয়েলোকটা, কলেরা টাইফয়েডের ইঞ্জেকশন দিতে আসে, রজনী টুডু, টুরিদের মতই কালো রঙ আদিবাসি। জঙ্গলের ধারে নীলমণির ঘরেও আসে। ডান বলে ভয় পায় না। পাত্থরবাবু যে সব কথা বলে, রজনী টুডুও সেইরকম বলে। ইন্ডিয়া, গবরমেন্ট, ইশকুল, হাসপাতাল। স্বাস্থ্যকেন্দ্র নামে একটা হাসপাতাল থেকেই আসে। সেটাও নাকি গবরমেন্টই তৈরি করে দিয়েছে। গবরমেন্ট বহুত ভালো লোক। এটুকু টুরি বুঝে ফেলেছে।

    মোরাম সরিয়ে, পাহাড়ের ঢাল কেটে, পাথর চেলে চেলে এই মাটির রাস্তা তৈরী করে দিয়েছে গবরমেন্ট। চারপাশে নিবিড় অরণ্য। দূরে একদল মেয়েমরদ গান গাইতে গাইতে ধামসা বুকে চলেছে। পিছু পিছু এগিয়ে গেল টুরিও।

    চেনা গ্রাম না-ই হোক, নিজের দেশের মধ্যে দিয়েই তো চলেছে। যে দেশে যেখানে খুশি যেতে পারে টুরি। যে দেশটা টুরিদের সব্বার।

    কুনো ডর নাই। শহরের লোকগুলা সব খতরনাক নয় মোটেই।

    পাত্থরবাবু বলেছে, বাইরের দুনিয়ায় কত কি ঘটে যাচ্ছে, টুরিরা তো কেউ সে খবর রাখে না। এত ভয় পাবার কোনো কারণই নেই। ডমনের কাছে মার খেয়ে খেয়ে হাতে গলায় কালশিটে। কেমন মায়ার চোখে তাকায় পাত্থরবাবু। বলে, গাঁয়ে যতই মরদের হাতে মার খাবার নিয়ম থাক, দেশে নাকি এমন আইন নেই। গবরমেন্ট নাকি টুরিদের পক্ষে। একটু পড়ালেখা শিখলেই নাকি টুরি সব বুঝতে পারবে। তখন আর কাউকে ভয় পেতে হবে না। গবরমেন্ট খুব ভালো, দেশ খুব ভালো, দেশ সব্বার।

    আজকাল খুব ভাবে টুরিও। ভেবে ভেবেই তো সাহস হযেহে টুরির। নইলে আগে কোনোদিন এমন একা একা মেলায় আসার সাহস হয়েছে নাকি!

    সামান্য অন্যমনস্ক টুরি এগোতে লাগল জঙ্গলের পথ ধরে। গান গাইতে গাইতে দলটা সামনে এগিয়ে গেছে। ভয় নেই। পেছনে আর একটা দল আসছে। কেন্দ্রি বাজিয়ে গান গাইছে একটা লোক, ‘ও সই, যাস নে বারবেলাতে ...’

    সামনের বাঁকটা পেরোলেই একটা বড় অশথ গাছ আছে। সেটা পেরিয়ে তিনটে অর্জুন গাছ আর একটা ছোট আমলকি বন। তারপর অনেকটা ফাঁকা। এক ছুটে গাঁয়ে পৌঁছে যাবে টুরি।

    ডমনের জন্যে, বাচ্চা মেয়েটার জন্যে একটু একটু মনখারাপ করছিল। এতক্ষণ ছেড়ে থাকে নি মেয়েকে। সামান্য অন্যমনস্ক টুরি এগোতে লাগল জঙ্গলের পথ ধরে।

    ঠিক সেই সময় কে যেন জঙ্গলের দিকে টান দিল টুরিকে। কাপড় ধরে টান। কে রে! কে! পেছন থেকে দলটা কাছে এসে পড়েছে। শাড়ি, ধুতি, ফতুয়া। কেন্দ্রি বাজিয়ে লোকটা যাচ্ছে এই ঝোপটার পাশ দিয়েই। টুরি চিত্কার করে ডাকতে চাইল লোকজনকে। কিন্তু কেউ জোরে মুখ বন্ধ করে রেখেছে।

    হেই সিংবোঙ্গা! বাঁচাও! রক্ষা করো!


    || এগারো ||

    টুরির আঁকা আল্পনার পাশ ঘেঁষে, টুরির লাগানো কুমড়ো লতার কাছাকাছি উঠোনের দিকে বসেছিল শমিত। সন্ধে হয়েছে অনেকক্ষণ। চারদিক নিঝুম। বুকের মধ্যেও নিঝুম অন্ধকার। শমিত ভাবছিল, ফিরেই যাবে। এ জঙ্গলে থাকার মেয়াদ শেষ করে দিলেই হয়।

    মোটামুটি সব পাথর সংগ্রহ হয়েছে। বিশেষ যে পাথরটা পাবার আশা ছিল, তা আর পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।

    ডমন আর আসে না, জঙ্গলের সঙ্গীও হয় না। শহুরে পুরুষের কামুক থাবায় ছিন্নভিন্ন এ গ্রামের শান্তি, আনন্দ। টুরির হাতে তৈরি বাগানে সবুজ পেঁপে, কুমড়ো, ঝিঙে, নেনুয়া। গাছে গাছে হাওয়ার হিল্লোল। শুধু হাসির হিল্লোল জাগানো মেয়েটা নেই। টুরি নেই। কে জানে ওর মাযের মতো করেই হারিয়ে গেল কিনা। গাঁয়ের লোকেরা ক’দিন ফুলমণির কথা খুব বলছিল। আজকাল শমিতের কাছে আর কেউ বলছে না। শমিতকে এড়িয়ে থাকছে সবাই। বাসুদেব, পবন, লখন ... কেউ না। ডমন তো নয়ই। ডমনের ভাই সুবোধ, ডমনের খুড়ো ... কেউ চাইছে না শমিত আর গ্রামে থাকুক। এখনো স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলে নি। তেমন হবার আগেই চলে যাবে শমিত। কিন্তু চলে গেলে তো আর টুরির খোঁজ পাওয়া হবে না। সত্যিই হারিয়ে গেল অমন প্রাণবন্ত মেয়েটা!

    ঝিঁঝির শব্দে আজকাল মাথাব্যথা করে শমিতের। জোনাকির টিমটিমে আলোয় চোখদুটোয় অসম্ভব জ্বালা করে। অকারণে চোখে জল আসতে চায়। আহা টুরি!

    সব নষ্ট করে দিল মানুষ। শহরের অসভ্য মানুষ! সভ্যতার অভিশাপ কি একেই বলে! কেমন বদলে গেছে গ্রামটা। শান্ত সুনিবিড় গ্রাম, জঙ্গলের ছায়ায় মায়া। বড্ড টান। আজ সব অচেনা লাগছে। ধিকিধিকি জ্বলছে অশান্তির আগুন, শহরের মতই। কোথায় হারিয়ে গেল গ্রাম?

    এ সাতদিন ডমনদের সঙ্গে কম ঘোরে নি শমিতও। মেয়েটা যেন বাতাসে উবে গেছে। ফরেস্টার থেকে কোতোয়ালি। সব জায়গায় এক কথা। ‘মালুম নহি।'

    শমিতকে বারবার তদ্বির করতে দেখে থানার অফিসার-ইন-চার্জ মারাত্মক প্রশ্নটাও করেছিল, ‘তু কওন হ্যায়? কহাঁ সে আয়া? তেরা সাথীলোগ কহাঁ?’

    ‘মানে? আমি একা থাকি, এই গ্রামে আটমাস ধরে এদের সঙ্গেই আছি।'

    টেবিলের ওপর জোরে ঘুষি, ‘জ্যাদা হোশিয়ার মত বন্। অন্দর কর দেঙ্গে। সব জানি আমরা। বঙ্গাল সে নিকলা, ছত্তিসগড় সে ঘুম আয়া, ওড়িশা সে ভাগ আয়া। এবার এখানে ডেরা বেঁধে আছ? সব খবর রাখি আমরা।'

    ডমন আর সুবোধকে দুদিন হাজতে আটকে রেখেছিল। ‘তোরাই হাপিশ করেছিস বৌটাকে।' শমিতের গায়ে হাত দেয় নি পুলিশ। কিন্তু শমিতের সামনেই ডমন আর সুবোধের গালে চড়চাপড়, চুলের মুঠি ধরে নিয়ে গিয়ে হাজত। খবরের কাগজের ভয় দেখিয়ে, মোবাইলে ছবি তুলে ভয় দেখিয়ে, ব্যক্তিগত মুচলেকা দিয়ে ওদের ছাড়িয়ে আনায় কম উদ্বেগ! পুলিশ এ অপমানের শোধ নেবে না? ওরা অপেক্ষায় আছে, কোনো একটা সুযোগ পেলেই হয়।

    শমিত চেয়েছিল, গাঁয়ের সবাই মিলে থানায় চলুক। হয় নি। কোতোয়ালিতে মাত্র দু’জন খাকি উর্দি। হাঁড়িয়া, নুন আর পান্তাভাত খাওয়া শরীরগুলো তবু সাহস পায় নি। গাঁয়ের পুরুষরা প্রায় সবাই জঙ্গলে লুকিয়ে পড়েছিল। পুলিশকে, ফরেস্টগার্ডকে খুব ভয় পায় সবাই। পুলিশ খুব মারে। ধরে নিয়ে যায়, সদরে চালান দেয়।

    আধমরা হয়ে ফিরেছে দুজন। ফিরে সুবোধ বউ নিয়ে ওরাঁওগ্রামে চলে গেছে। আর ফিরবে না এ গাঁয়ে। ওখানেই থাকবে ওরা। ডমন আর আসে না। দিগু, লায়াবুড়ো, পাহানখুড়ো এমন দু’চারজন কেবল কথা বলে। বলে, ‘বাবু, তু চলে যাস নাই। তু আমাদেরই একজন বটে।' টুরিকে ফিরিয়ে না এনে কি করেই বা চলে যাবে শমিত!

    কয়েকমাস আগে হয়েছে শিকার উত্‍সব। জঙ্গলের আকাশে বাতাসে আগুনের তাপ। শান্ত মানুষগুলোর চোখের আগুনে খুনখারাপির নেশা। জন্তু জানোয়াররা লুকিয়ে পড়ে। ময়ূর খরগোশ হরিণ গভীর বনে ঢুকে পড়ে এ-সময়। এমনকি ঘুঘু শালিকও ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে সরে থাকে। তার মধ্যেই তীর-ধনুকের নিপুণ ফাঁদে ধরা পড়েছিল বেশ কিছু বন্য বরাহ, খরগোশ। হরিণ, পাখি। রোজ সন্ধেবেলা খোলা মাঠের চারদিকে আগুন জ্বেলে সেসব জানোয়ারের শরীর পুড়িয়ে খাওয়া। মজাই আলাদা। ধামসা। আর উদ্দাম নাচ।

    সেই উল্লাসের সময় এই হরিণশিশুকে দেখেছিল শমিত। লায়াবুড়োর শিকার। সামনের দু’পা পুড়েই গেছে, করুণস্বরে ডাকছিল হরিণটা। লায়াবুড়োর কাছে হাত পেতেছিল শমিত, ‘এই বাচ্চাটা থেকে কতই বা মাংস পাবে তুমি! আমি তোমাকে পাঁচ কিলো মাংসের দাম দিচ্ছি। আমাকে দাও।'

    খোলা শরীরে টানটান দাঁড়িয়েছিল লায়াবুড়ো, ‘কেন দিব? গাঁয়ের দশলোক দেইখবে, একত্তর খাওয়া হবেক। দিব কেন?’

    অনেক সাধাসাধি, পাঁচ কিলো মাংসের দামের সঙ্গে এক প্যাকেট সিগারেট। তবু ঘাড় নাড়ছিল বুড়ো। তারপর লাইটার। বোতাম টিপলে আগুন, লাইটার হাতে নিয়ে একমুখ হাসি। লায়াবুড়ো রাজি হয়েছিল। হরিণশিশু সেই থেকে শমিতের কাছেই আছে।

    টুরি ওর নাম দিয়েছিল। পুতুল। প্রথম প্রথম দাঁড়াতে পারত না পুতুল। পায়ের খুর অবধি পুড়ে গেছিল, বিষিয়ে গিয়ে গভীর ক্ষত। জড়িবুটি লাগিয়ে, আলু ছেঁচে লাগিয়ে লাগিয়ে আস্তে আস্তে ঘা শুকিয়ে দিয়েছিল টুরি। উঠে দাঁড়াতে পারত না পুতুল। টুরি রোজ ঘাসপাতা এনে খাওয়াত। আলতো করে কোলে বসিয়ে, মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে। চোখ বন্ধ করে আদর খেত পুতুল। শহর থেকে আনা মলম পুতুলের বুকে পায়ে লাগিয়ে দিত শমিত। রোজ ড্রেসিং করা, মলম লাগানো শিখে নিয়েছিল টুরি।

    আস্তে আস্তে সেরে উঠল পুতুল। আজকাল সারাদিন ঘাসপাতা খাবার জন্যে ঘোরাঘুরি করে। আর সন্ধে হবার আগেই ফিরে আসে। রাতের বেলায় শমিতের বিছানায় গুটিসুটি ঘুমিয়ে থাকে ছোট্ট পুতুল।

    খাবার টানে টানে সামনের জঙ্গলের রাস্তা ধরে কতদূর অবধি চলে যায়। মজার কথা, একদিনও বেড়ার গায়ের লতা পাতায় মুখ দেয় না পুতুল। টুরি বলত, ‘দেখেছিস বাবু! টুরি কেমন বুঝমান হয়েছে!’

    সেই বুঝমান পুতুল অবোধ চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই বেড়ার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। টুরিকে খোঁজে পুতুল! ও কি বুঝতে পারছে, টুরি হারিয়ে গেছে!

    রাত প্রায় এগারোটা। সন্ধে থেকেই গাঁ নিঝুম। আজকাল আরো নি:শব্দ হয়েছে। রাত এগারোটা অনেক রাত। একা একা জেগেছিল শমিত। বনফুলের গন্ধটা বুকের মধ্যে ঢুকে এল। ঘুম ঘুম ঝিমুনি, হাত বাড়িয়ে লণ্ঠনের আলোটা কমিয়ে দিল শমিত। ঘুম আসছে। আরেকটা দিন শেষ। আজও টুরির খোঁজ পাওয়া গেল না।

    পুতুল নি:সাড়ে ঘুমিয়েছিল। কথা নেই, বার্তা নেই, লাফিয়ে উঠে শমিতের কোলে চড়ে বসল। বাইরে অচেনা শব্দ। কেউ পা টেনে দৌড়ে চলে গেল?

    দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে চমকে উঠল শমিত।

    দূরে বুনো কুকুরদের চোখগুলো জ্বলছিল। চেরা কর্কশ ডাকে দৌড়ে আসছিল এদিকে। শমিতকে দরজা খুলে বেরোতে দেখে থমকে দাঁড়াল।

    ঠিক দরজার বাইরে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ।


    || বারো ||

    নীলমণিকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল সবাই মিলে। বাপ-মা রাগ করেছিল, কেন নীলমণি বোঙ্গা পূজা নিয়ে এত লড়াই করবে। ভাইবোনগুলার কথাও ভাববে না? গাঁয়ের লোক রাগ করেছিল, কেন একা একা মাথায় লতা জড়িয়ে শালবনে নাচ করে নীলমণি। কে জানে সেগুলো সত্যি সত্যি হিলহিলে লতা কিনা।

    তাতে অবশ্য কোনো বিকার নেই নীলমণির। একা একা থাকে। শান্ত উদ্ধত ভঙ্গিতে জঙ্গলের পথে হেঁটে বেড়ায় একা একা। কোথা থেকে এসেছে, কার সঙ্গে এসেছে, কেন এ গ্রামে এসেছে ... কেউ জানে না।

    গ্রামের একমাত্র প্রাইমারী স্কুল, সেখানে কেউ যেত না। একদিকে তিরিশটা মুরগি থাকত, দিনু বাস্কেদের মুরগীগুলো। তিনটে ক্লাসঘরের একটায় রামহরিদের কাটা পোয়াল কুচি রাখা। একটায় লখনদের ভাঙা লাঙল, কাঠের চাকা, মরচে পড়া টাঙ্গিগুলো রাখা থাকত। আর একটায় মাঝে মাঝে স্কুল হত। পাত্থরবাবু আসার পর তৈরি হয়েছিল স্কুলটা। কুইরি গাঁ থেকে পড়াতে আসত স্বর্ণকমল মাষ্টার। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে ধরে আনত মাষ্টার নিজে। আর পাত্থরবাবু। কবে থেকে সেসব বন্ধ হয়ে গেছিল। স্বর্ণকমল মাষ্টার শহরের স্কুলে চাকরি পেয়ে চলে গেছে। চেষ্টা করেও আর ছেলেদের ধরে স্কুলে আনতে পারে নি পাত্থরবাবুও।

    ওই স্কুলে এসে ছিল নীলমণি। গরুর গাড়ির চাকা আনতে গিয়ে লখনই দেখেছিল প্রথম। চারধারে রক্ত আর মানুষের খুলি। আকাশে শকুন। স্কুলঘরের পাশে বাজপড়া শুকনো গাছের ডালে চিল। এ নির্ঘাত ডান।

    গ্রামের আর পাঁচজন বলেছিল, তাড়িয়ে দাও ওকে। লখন অন্য কথা বলেছিল। ডাইনিদের অনেক ক্ষমতা। এ গাঁয়ে একটাও ডান নেই। থাক না একজন। খরার সময় বৃষ্টি নামানো, রোগা ছেলেকে সরিয়ে দেওয়া, বাণ মেরে শত্রুর রক্ত তুলে আনা ... ডাইনি না থাকলে করবে কে!

    শাকপাতা খাওয়া নীলমণির কালো চেহারায় কুসুমতেলের গন্ধ, সন্ধে হলেই শরীর থেকে নীল আলো বেরোয়। লক্ষণ সব ডাইনির মতো। কিন্তু ডান হলেও নীলমণির শরীর জুড়ে সবুজ ক্ষেতের আঘ্রাণ। ফরেস্টার সাহেবরা পর্যন্ত গন্ধে গন্ধে মাতাল। খাকি উর্দির পাঁচ সেলের টর্চ মাঝে মাঝেই রাত বিরেতে। ডান নীলমণিকে সমীহ না করে উপায় কি!

    দিনের বেলা কেউ ডান নীলমণির ঘরের দিকে আসে না। কিন্তু রাত হলেই ওই নীল আলোর টানে যুবকরা ছুটে ছুটে আসে। বাহরু মাটকু বাসুদেব সবাই দেখেছে, চাঁদের আলোয় খোলা মাঠে উদ্দাম নাচে নীলমণি। গলায় মুণ্ডুমালা, চোখে শিরীষ পাতা, মাথায় সাপ। অনেকটা ঘাসবন, হোগলা। জোনাকি, প্যাঁচার ডাক। খলখল হাসি। নীলমণি আস্ত চাঁদ গিলে খেয়ে নেয়। শরীর থেকে জ্যোত্স্না ঠিকরে ঠিকরে বেরোয়। যুবকরা স্বচক্ষে দেখেছে। তবু কি যে টান। নীল আলোর টান, নাকি গন্ধের ... কে জানে।

    শুধু যুবকরা নয়। শুধুই পুরুষ নয়। যিশুবাবার পূজা করে সিস্টার, নীলমণিকে ডেকে ডেকে কথা বলত। কদিন আগে সোন্দর একটা বিটিছেল্যা এসে নীলমণির খোঁজ করছিল। নীলমণির সঙ্গে সদরে সাহেবদের স্কুলে পড়ত নাকি! দেখেশুনে গাঁয়ের বয়স্ক মানুষরা বলেছে, নীলমণি ডান যে সে ডান নয়। নিশ্চয় ওর বাপ দেবতা, আর মা ডাইনি। গাঁয়ের দু’চারজন খুড়ি দেখেছে, নীলমণি ঝোরায় নামলে ঝাঁকে ঝাঁকে রূপোলী মাছ নাচতে নাচতে এসে ধরা দেয়। নইলে এত জোর হয়! এত রস, দুনিয়াজোড়া মরদে আশ মেটে না। যুবকরা সব বশ।

    শমিত এসব গল্প শুনেছে টুরির কাছে। নীলমণি গাঁয়ের ছোট ছেলেমেয়েদের ধরে ধরে স্কুলে বন্ধ করে দিত নাকি। জোর করে পড়ালেখা শেখাতে চাইত। গাঁয়ের সবাই মিলে ডাইনির ছেলে ধরার সে চেষ্টা বন্ধ করেছে। খোকা খুকুদের রক্ত ডাইনির প্রিয়, কে না জানে। এখান আর ওদিকপানে গাঁয়ের কোনো ছোট ছেলেমেয়ে যায় না।

    একটু কৌতূহল ছিল শমিতের। সিস্টার ডাইনির সঙ্গে মেলামেশা করছেন শুনে ইচ্ছেও হয়েছিল। কিন্তু সে ইচ্ছে প্রকাশ করে নি। এসব গ্রাম জঙ্গল এলাকায় এমন অনেক কুসংস্কার আছেই। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরলে গোটা দশ বারো ডাইনি, আট দশজন সাপুড়ে, ডজনখানেক ভূতের ওঝা, গণ্ডা দুয়েক সাপের ওঝা, পাঁচ সাতজন জড়িবুটিওয়ালা, বারো চোদ্দজন বাণ-মারার ওস্তাদ, কুলো-চালুনে, বাটি-চালুনে পাওয়া যাবেই।

    তাছাড়া ডাইনি পিটিয়ে মারা, বা পুড়িয়ে মারা প্রায় নিয়মিত একটা খেলা। প্রায়ই এমন দেখা যায়, গাঁয়ে অভাব হলেই ... সে মড়ক লেগেই হোক, বা ক্ষেতের ধান হাতি খেয়ে গেলেই হোক ... গাঁয়ের একদল লোক মিলে একজনকে ডাইনি বানিয়ে ফেলে। তার ঘর ভেঙে দেবে। সে তখন প্রাণে বাঁচার জন্যে লাঙল, গরু, বলদ বেচে গ্রামের লোকের নুন পান্তার খরচ যোগাবে।

    ভূত প্রেত ডাইনি। ডাইনি সবার সেরা। মরা খোকা নিয়ে মাঠে মাঠে নেচে বেড়ায়। কোমরে ঝাঁটা। উল্টো হয়ে হাঁটে। মানুষের কলজে খায়। পঞ্চাশ একশো সাপ তার বশ।

    আহা। অপরিসীম দারিদ্র্য। আর অশিক্ষা। খিদে, পুষ্টি, অসুখ, শুশ্রূষা ... এসব ভুলে থাকতে হবে তো।

    মাথা ঘামায় নি শমিত। এ গাঁয়ে থাকতে হলে গাঁয়ের নিয়ম মেনে থাকাই ভালো। নীলমণিকে কোনোদিন চোখেও দেখে নি।

    আজ কিন্তু চিনে ফেলল বেশ। অযত্নের জীর্ণ শীর্ণ কালো শরীর। কোঁকড়া চুলের জংলী খোঁপাটা রুক্ষ পাহাড়চুড়ার মতো। তীব্র দুটি চোখ। হাতে একটা পেতলের বালা।

    নীলমণি এখানে কেন?

    ‘তু আমার সঙ্গ সঙ্গ চল।' দাওয়ার ওপর শমিতের বুকের কাছে উঠে এল মেয়েটা। পুতুল দরজা দিয়ে মুখ বার করেছিল, ভয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

    ‘কোথায় যাব আমি? কে তুমি?’

    ‘আমাকে চিনিস নাই তু!’ খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়ে। ওর বয়সী অন্য যুবতী মেয়েদের মতই। খলখল করে কোনো প্রেতিনী হাসি নয়। চেহারাটা যদিও প্রেতিনীর মতই। রুক্ষ চুলের মাথাটা জোরে জোরে ঝাঁকাল একবার, ‘চল চল। জলদি জলদি। সময় নাই।'

    গ্রাম ছাড়িয়ে জঙ্গলের মুখে একটা জলাভূমি। তারপর অনেকটা ঝোপঝাড়। তারপর বেশ খানিকটা বাগান। ধানের ক্ষেত। এখানে তো পাথর ছিল, কি করে এমন সবুজ ক্ষেত হল?

    ‘আমি করেছি। পাথর কেটেছি একা হাতে,’ না-বলা প্রশ্নটা বুঝে নিয়েছে মেয়েটা, ‘উদিকে দ্যাখ। মেলা পাথর জমাইছি। নিজে হাতে একটা ডুংরি বানাইছি।’

    ডুংরিই বটে। পাথর জমে জমে একটা ছোট টিলা। সেই পাথরের পাশ ঘেঁষে সবুজ ক্ষেতের কাছে পড়েছিল টুরি। রাতের গভীরে অচেনা শব্দ, গাছের পাতায় হাওয়ার শব্দ ছাপিয়ে কাদের পায়ের আওয়াজ। যারা রেখে গেছে, তারা টর্চও জ্বালে নি।

    নিথর শরীর, ছেঁড়া শাড়ি জড়ানো কুণ্ডলিটা যে একটা বিটিছেল্যা, তা বুঝতে সময় লেগেছিল নীলমণির। প্রথমে ভেবেছিল, মরেই গেছে। এ নতুন নয়। ডাইনির ঘরের কাছে মরা শরীর ফেলে গেলে খুব সুবিধে। ডান যখন, অমন দু’চারটে জ্যান্ত মানুষের, জীয়ন্ত পশুপাখির রক্ত আর মাংস খাবেই।

    ‘তু ছিলি বলে মেয়াটা ফিরে এসেছে। তু রোজ থানা যেতিস। তাই।' নীলমণি বলল ফিসফিস করে। ভয় পেয়েছে মেয়েটা। এখানে থাকলে ওকে বাঁচানো যাবে না।

    ‘উয়াকে হাসপাতালে নিতে হবে।' তাই শমিতকে ডেকে এনেছে নীলমণি।

    আহা টুরি! সারা শরীরে কামুক অত্যাচারের চিহ্ন। শুকনো ঠোঁটে কামুক লালা। লাল লাল রক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে।

    ঠোঁটের দু’পাশে হাত রেখে গলার শির টানটান। ‘হো ও ও ও ...'

    শমিত তখন অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ডান-এর ডাকে কোনো মানুষই বুঝি সাড়া দেবে না। এখনি গাঁয়ের দিকে ছুটে যাবে শমিত। কাকে পাওয়া যাবে না যাবে কে জানে। তিনদিন হল গাঁয়ের সোমত্থ পুরুষরা সবাই ফেরার। পুলিশের ভয়ে। ডমন সুবোধকে পুলিশ তুলে নিয়ে যাবার পর। তিন চারবার ডাকের পর দূর থেকে প্রত্যুত্তর শোনা গেল। ‘ওহো ও ও ও ...’ লখন এসে পড়েছিল তারপর। বহুদূর থেকে একটা আওয়াজ শুরু হয়েছিল – দিম দিম দিমা দিম।


    || তেরো ||

    শেষ পর্যন্ত ফিরে এল টুরি। শমিতের ঘরের উঠোনে, টুরির নিজের তৈরী গাছের ছায়ায়। ডমন টুরিকে দেখতে আসে নি। আসে নি টুরির শ্বশুরঘরের কেউ। ওরা টুরিকে নিজের ঘরে থাকতেও দেয় নি। টুরি ডাইনির বাড়িতে ছিল যে। প্রায়শ্চিত্তের পুজো করে তবেই ঘরে আসতে পারবে। নইলে আরো বিপদ হবে গাঁয়ে। কাউকে বাঁচানো যাবে না।

    কিন্তু সাবি, ফুলমতি আসে। গুনগুন করে কথা বলে টুরির কানে কানে। নিঝুম হয়ে পড়ে থাকে টুরি। পুতুল সারাদিনে কতবার এসে টুরির গাল, পায়ের পাতা চেটে যায়। টুরি নিথর। খোলা চোখদুটো একেবারে নীরব। সবাই বলে, ‘উ আর বাঁচবেক নাই।'

    আর একজন আসে রোজ। নুনে সেদ্ধ শুয়োরের মাংস আর রুটি খাইয়ে যায় টুরিকে। ডাইনি নীলমণি। নীলমণি তো নয়, একখণ্ড উজ্জ্বল নীল বৈদূর্যমণি। এ-কদিনে এ মেয়েটাকে দেখে বারবার অবাক হয়েছে শমিত। জঙ্গলের মাটিতে পাথর খুঁজতে এসে অমূল্য এক প্রাপ্তি হয়েছে শমিতের। খুব মায়া মেয়েটার। চোখ দুখানায় সবুজ শান্তি। মায়ার চোখে টুরির দিকে চেয়ে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘণ্টা। শুধু নীলমণি হাত বাড়ালেই টেপা ঠোঁট দুখানা আলগা করে টুরি। নীরব দৃষ্টি, একভাবে মুখের দিকে চেয়ে থাকে। কি ভাবে ও-ই জানে।

    গাঁয়ের মা বউ খুড়িরা ইতিমধ্যেই বলছে, ‘বিটিছেল্যাটার যা হিম্মত, সাত গাঁয়ের মরদের সে হিম্মত নাই।'

    শমিতের বুকের মধ্যে তীব্র ব্যথা। আহা টুরি! বেচারা টুরি! শমিতের সঙ্গে দেখা না হলে নিস্তরঙ্গ এ জীবনে বেশ থাকত। শমিতই কি চিনিয়ে দিল শহর? আর লোভ? এ গ্রামে নিয়ে এল শহরের চাকচিক্য!

    চলেই যাবে শমিত। আজ লায়াবুড়োকে বলে এসেছে। ডমন নিয়ে এসেছিল এ গ্রামে, তাকে বলে যাওয়াটা উচিত। নেশা করে পড়েছিল ডমন, শমিতের যাওয়ার কথা শুনেও মাথা তোলে নি। হয়ত বা ওরও আফসোস হচ্ছে এখন, কেন শমিত এল এ গ্রামে!

    দিগুর বুড়ো বাবা মাথা নেড়ে বলেছে, ‘তু ছিলি বলেই টুরি ফিরে এল। তু রোজ থানা যেতিস বলে টুরির লাশ হাপিস হয় নাই।'

    লাশই তো। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের লোকগুলো বলেছিল, ‘এ কাকে এনেছেন? এ তো লাশ।' ভালো ডাক্তার নেই কোনো, লোকগুলো এ কেস নিতে চায় নি। শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাবার আগে একটু ফার্স্ট এইড দিতেও রাজি হয় নি।

    বলার মতো হাসপাতাল তো নেই, দশ কিলোমিটার দূরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্ত যেতে পেরেছিল টুরি। পাহাড়ু সনাতন বালিয়া লখন, গাঁয়ের পুরুষরা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল টুরিকে। মুখের দু’পাশে হাত রেখে ‘হো ও ও ও’ ডাকে পলকে দশজন যুবককে এনে ফেলেছে লখন। চারজন যুবক টুরিকে কাঁধে নিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ছুটেছে আরো চারজন। বাকিরা ডিগ ডিগ শব্দে মাদল বাজিযেছে সারারাত।

    স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ব্যবস্থা হয় নি। একটা মাত্র লোক, বলেছিল, ‘এ তো মরেই গেছে। লাশ নিয়ে কি করব আমি?’

    সেই জীয়ন্ত লাশ নিয়েই আবার ছুটে চলেছে সবাই। লখন পাহাড়ু সনাতন বালিয়া। বদলে বদলে কাঁধ দিয়েছে কালু মাটকু জাদু। মাঝে মাঝেই পেরিয়ে এসেছে টিলা, ছোট ছোট ডুংরি, ঝরনা, ডুলুং। রাস্তায় পাথর, কাঁটা এবং রুক্ষতা। একখণ্ড শাল ডালে কোনোমতে বাঁধা আছে টুরি। কৃষ্ণপক্ষের রাত। একটানা ঝিল্লীর ঝনঝন। নৈশ কুসুমের সুরভির মাদক নেশা। কত রকম বুনো ফুলে জঙ্গল বিভোর। ঝলমলে কুসুম, মসৃণ সবুজ শাল।

    ওপরের আকাশে তারারা জ্যোতিষ্মান। নিচে বনভূমিতে জোনাকিরা জ্যোতিপুঞ্জ। নিবছে আর জ্বলছে। জ্বলছে আর নিবছে। টুরির বুকের ধুকধুক শব্দটার মতই। এই বুঝে নিবে গেল সব।

    এক জায়গায় জঙ্গল শেষ হয়ে অনেকটা দূর পর্যন্ত সব ফাঁকা। ধূ ধূ মাঠ। সেইখানে এসে হঠাত্‍ কেঁদে ফেলেছিল সনাতন। হিক্কা তুলে বমি করে ফেলেছিল বালিয়া।

    লখন বলল, ‘এখন কাঁদার সময় নাই। যত জোর পারিস, দৌড় দে। টুরিকে বাঁচাইতে হবেক।' কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ব্যবস্থা হয় নি। কোকচো গ্রামের হাইওয়ে পর্যন্ত গিয়ে একটা গাড়ি যোগাড় হয়েছিল সেদিন। তারপর সরকারী হাসপাতালে।

    শমিত না থাকলে টুরির ভর্তি নিত না। তারপরও লিখে দিয়েছিল, ‘ব্রট ডেড।' চিকিৎসার দায় নিতে চায় নি। কম হুজ্জোত হয়েছিল! আজকাল শহর থেকে গাঁয়ে এসে থাকা শার্ট-প্যান্ট দেখলে একটু সমীহ করে। ভয়ে অন্তত কিছু কাজ হয়।

    লখন বাইজু রামহরি বাসু। শমিতের যাওয়ার কথায় মন ভালো নেই ওদের, আজকাল রোজই এসে বসে থাকে। শমিতের ঘরের উঠোনে, টুরির তৈরি গাছের ছায়ায়। ওরাও বলে। ফুলমণির মতো টুরিও একদিন গলায় দড়ি দেবেই, তবু যে ফিরে এল তা পাত্থরবাবুর জন্যেই।

    দাঁতে সোনার টোপর, আতরে জবজবে মোটা গোঁফ ফরেস্টারবাবু। আর গলায় লকেট, মুখে পানের রস। কোতোয়ালির বড়বাবু। ভয়ে কথা বলতেই পারে না কেউ। ‘ভাগ্যিস তু যেতি টুরির খোঁজ করতে!’

    ‘ভাগ্যিস তু উয়াকে হাসপাতাল নি গেলি!’ সাবি, ফুলমতিরাও বলেছে।

    সাহস করে গাঁয়ের কেউ কি কথা বলতে পারত থানায়, হাসপাতালে? কেউ কি কোনোদিন ওদের কথা শুনেছে? টুরিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বলেছে সাবি ফুলমতি, ‘তু গাঁয়ে না থাকলে আবার যে কি হবে! তু যাস নাই বাবু।'

    কিন্তু থাকবে না শমিত। কেন থাকবে? চোখের সামনে টুরিকে অচিন আকাশের পাখি হয়ে যেতে দেখবে? টুরিকে বাঁচানো যাবে না, হাসপাতাল থেকেও বলে দিয়েছে। ‘দেখুন যে কদিন থাকে। আর কিছু করার নেই।'

    হাসপাতালে এত বেড নেই যে দিনের পর দিন রাখা যাবে। বিশেষত যে রোগিনী কোনো চিকিৎসায় সাড়াই দিচ্ছে না। এই তো প্রায় একমাস হয়ে গেল, শরীরে প্রাণ ফিরে এসেছে। ক্ষতগুলো বেশ শুকিয়ে এসেছে, আজকাল শক্ত খাবার চিবিয়ে খেতে পড়ছে টুরি, রোদ পড়লে চোখ কুঁচকে উঠছে, তবু তো টুরি আর সেরে উঠল না। উঠে বসে না, কাউকে চিনতে পারে না, কোনোদিনই কি আর আগের মতো হবে না টুরি!

    খুব ইচ্ছে করে শমিতের, একবার কলকাতায় বড় কোনো শহরের হাসপাতালে নিয়ে যায় টুরিকে। স্পেশালিস্ট কোনও ডাক্তার দেখুন। এখনই তা সম্ভব নয়। টুরির ওপর যে কোনো জোর নেই শমিতের। কোন অধিকারে জোর করবে শমিত? যে জোর করতে পারত, যাকে জোর করতে পারত শমিত, সে ডমন। ডমন আর শমিতের কাছে আসে না। শমিতকে ভুল বুঝেছে ডমন। কেন টুরিকে নিজের ঘরে থাকতে দিয়েছে পাত্থরবাবু। কেন ডাইনির ডাকে সাড়া দিয়ে টুরিকে তার হাতে তুলে দিয়েছে পাত্থরবাবু।

    চোখের সামনে একজনকে এমন তিলতিল করে চলে যেতে দেখার যে কি যন্ত্রণা! চলেই যাবে শমিত। টুরি ফিরে এসেছে, প্রাণে বেঁচে উঠেছে, এই দেখেই নাহয় ফিরে যাবে শমিত। চাইলেই কি সব করা যায়! সাধ আর সাধ্য, দুইই যে সমাজের নিয়মের বেড়াজালে আটক দুই পাখি। আহা টুরি!


    || চোদ্দ ||

    নেকদিন পর আবার গ্রামে এসেছে সুমিত্রা। শীতের ছুটিতে স্কুল থেকে গোয়া নিয়ে গেছিল। এই প্রথম সমুদ্র দেখেছে সুমিত্রা। বাইরের পৃথিবীটায় যে কত কিছু দেখার আছে, জীবন যে কত বড়, তা সদরের স্কুলে না গেলে জানতেই পারত না।

    পরীক্ষার পর গ্রামে এসেছে। মা আজকাল সুমিত্রাকে খুব খাতির করে। যেন মেয়ে নয়, কোনো মান্যিগণ্যি অতিথি এসেছে। ভাই বোন দুটোও কেমন এড়িয়ে এড়িয়ে থাকে। শহরে পড়তে গিয়ে সুমিত্রা কি দূরে চলে গেল সবার কাছ থেকে?

    একমাত্র চার্চে গেলে সব আগের মতন। ফাদার কি খুশি যে হলেন! চার্চের স্কুলে এখন নতুন সিস্টার। ছাত্র ছাত্রীরা সব নতুন। সিস্টার নলিনী চাইবাসার নতুন চার্চে চলে গেছেন। ওদিকের মুণ্ডা গ্রামে নতুন চার্চটা তো আর হল না। সবসময় যিশুবাবার মতো হাসি লেগে থাকে ফাদারের মুখে। ওদিকের গ্রামের কথাটা উঠতেই হাসি মুছে গেল।

    ‘কি যে বলি তোকে সুমিত্রা! নীলমণি আমাদের মস্ত ক্ষতি করে দিল।'

    নীলমণি! কি বলছেন ফাদার!

    ‘হ্যাঁ রে। অবাক হলি তো?’ ফাদারের ফর্সা মুখখানা পলকে রক্তবর্ণ, ‘বেইমান। বেইমান নীলমণি। সদরের স্কুলে পড়ালাম ওকে, ভাই বোন সব চার্চের দয়ায় স্কুলে পড়ছে। বাপ-মা ওকে স্যাক্রিফাইস করেছিল না যীশুর পায়ে! বেইমান মেয়েটা সব ভুলে গেছে। বলে বেড়াচ্ছে, আমি চার্চের কাজ করব না? ভাবতে পারিস সুমিত্রা? কত বড় বেইমান?’

    জংলী আদিবাসীদের ধর্মশিক্ষা না দিয়ে পাপ করছে নীলমণি। ফাদারের ডাকে, চার্চের কাজে সাড়া না দেবার পাপ করেও কোনো অনুশোচনা নেই মেয়েটার। যারা ওকে চায় না, ডাইনি বলে দূর করে দিয়েছে, তাদের জন্যে ভালোবাসার মানুষদের অপমান করছে নীলমণি!

    ‘ঈশ্বর ওকে কঠিন শাস্তি দেবেন, দেখিস তুই সুমিত্রা।'

    গীর্জা থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে সুমিত্রা। কেমন বদলে গেছে গ্রাম। চার্চ। ফাদার। জঙ্গলের শান্ত ছায়ার মায়া কোথায় হারিয়ে গেল। কেমন ধিকিধিকি জ্বলছে অশান্তির আগুন। কোথায় হারিয়ে গেল গ্রাম? নাকি এইরকমই ছিল সব, সুমিত্রাই বুঝতে পারে নি? ফাদারের কথাগুলো মনে পড়ছিল খুব। নীলমণির কথাও। ফাদারকে, চার্চের শিক্ষাকে বড্ড ভুল বুঝেছে মেয়েটা। বলত, ‘আদিবাসী শেষ করার জন্যেই গির্জা। যতই গম দিক, দুধ দিক, ওরা আমাদের আপন ভাবে না। দয়া করে।'

    দয়া। সুমিত্রা যে অনুভূতিকে চিনেছিল করুণা, সহমর্মিতা নামে। আজ ফাদার নিজেই বললেন, চার্চের দয়ার কথা।

    তাহলে কি নীলমণিই ঠিক ঠিক বুঝেছিল? মাথার মধ্যেটা কেমন তালগোল। একবার যাবে? আর একবার ফাদারের কথাটা পৌঁছে দেবে? এই তো কাছের গ্রাম। ‘লাভ দাই নেবার’ শিক্ষাটা সুমিত্রা তো ভোলে নি। তাছাড়া সুমিত্রা তো বেইমান নয়!

    গ্রামে এসে নীলমণির ঘরটা খুঁজেই পেল না সুমিত্রা। সবুজ একটা ক্ষেত, গরু মোষ। একদিকে ডেয়ারি ফার্মিং। আরেকদিকে হাঁস মুরগি পালন। দু’ চারজন মেয়ে বউ কাজ করছে। ডাইনি নীলমণিকে কি তাড়িয়ে দিয়েছে এরা? বেঁচে আছে তো নীলমণি? না না, তেমন কোনো খবর হলে মা নিশ্চয় জানত। ডাইনিকে পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মারা হলে সাত গাঁয়ের লোক খবর পায়। কাকে যে জিজ্ঞেস করে সুমিত্রা! একটা মোষের পিঠ থেকে আরেকটা মোষের পিঠে লাফিয়ে পড়ার খেলা করছিল ছোট একটা ছেলে। সে-ই দেখিয়ে দিল ঘরটা।

    কি খুশিই যে হল নীলমণি। মুখ ভরে হাসল, ‘আয় সুমিত্রা। তুই নাকি ডাক্তারি পড়তে যাচ্ছিস! খুব ভালো হবে রে। আমাদের নিজেদের একজন ডাক্তার। ডক্টর সুমিত্রা বাস্কে। উত্তরাধিকার নিবি তুই, আমাদের মেয়ে। তাহলে এই টুরিদের আর ভাবনা থাকবে না। আকাশমণির ছায়ায় বসে সেই অপেক্ষা করব আমি।'

    রুগ্ন নিথর একটি মেয়ে। অসুস্থ বোঝাই যাচ্ছে। পরম মমতায় তার কপালে, মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল নীলমণি। অযত্নের রুক্ষ শীর্ণ কালো শরীর, তীব্র দুটো চোখে করুণ মায়া। ডাইনি নীলমণি এখন গাঁয়ের ভালোবাসার মেয়ে। ক্ষেত তৈরি করে, ঘর তৈরি করে, গরু-মোষ চরাতে যায়, লেখাপড়া শেখায়, মনের সুখে গান গায়। আর সময় পেলেই এই মেয়েটার কাছে এসে বসে থাকে। ‘জঙ্গলে বাইরে থেকে অনেক পাপ এসেছে রে সুমিত্রা। তা থেকে বাঁচতে হবে না? সবাইকে বাঁচাতে হবে না?’

    অশিক্ষায় রুগ্ন, কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসে পীড়িত গাঁয়ের লোকগুলোর মনে অন্যরকম হাওয়া লাগতে শুরু হয়েছে। গাঁয়ের মা-ঠাকুমারা বলতে শুরু করেছে, ‘ডান হয়েও বিটিছেল্যাটা যে দরদ দেখাল, আমরা তা পারি নাই।'

    গাঁয়ের সবচেয়ে বুড়ো মানুষটা, তিন মাথা এক করে বসে থাকে, সে পর্যন্ত একবার মাথা তুলে বলেছে, ‘বিপদে পড়লে সকলকে একত্তর থাকন লাগে। মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে বাপ।'

    ফাদার বলেছিলেন, বাপ-মা ধর্মের নামে স্যাক্রিফাইস করে দেবার পরও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে নীলমণি। কাছে ভিতে জঙ্গল, বাগান, মাটি, মেঠো হেটো রাস্তা। দু’পাশে সবুজ। কালচে সবুজ, নীলচে সবুজ। মাথার ওপর মস্ত বড় নীল আকাশ। আলো আলো আকাশ। সেই আলোয় নিজেকে দেখা, নিজেকে চেনা। শিকড় চেনা। নীলমণি আজ আদিবাসী জীবনের অন্দরমহলের বাসিন্দা। নীলমণি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে নি।

    ‘জানিস সুমিত্রা, এই মেয়েটা আমাকে নতুন করে জীবনের মানে শিখিয়েছে। আদিবাসী নিজেদের চেনে না। নিজেদের মানুষ হিসেবে ভাবতে পারে না। এই মেয়েটার বাঁচার লড়াই ওই বাইরে থেকে আসা মানুষটার জন্যে।'

    ঘরের বাইরে বনতুলসীর ছায়ায় বসেছিল একজন একা মানুষ। শহরের মানুষ।

    নিজের ঘরে জায়গা হয় নি, গাঁয়ের লোকেরা নানা আশঙ্কায় দূরে সরে থেকেছে। বাইরে থেকে আসা ওই মানুষ অসহায় একটি মেয়ের অপমানের সময় তাকে ত্যাগ করে যেতে পারে নি।

    বুকের মধ্যে কেমন একটা গুমোট। চোখ দিয়ে এক পশলা বৃষ্টি নেমে এলে বেশ হত। মাথার ভেতরের তালগোল পাকানো ভাবনাগুলো ধুয়ে মুছে যেত।

    ফাদার বলেছিলেন, জীবন এক তীর্থযাত্রা। আচ্ছা, এক একজনের যাত্রাপথ যদি আলাদাই হয়! ক্ষতি কি?

    কি দায় পড়েছিল নীলমণির? বেশ তো বেরিয়ে গেছিল অন্ধবিশ্বাসী সংস্কার থেকে? নতুন আলো, নতুন জীবনের ডাক এএছিল সুমিত্রার মত করেই? তাহলে? কিসের দায় নিয়ে ফিরে এল? শিকড়ের টান?

    তাই যদি হয়, কিসের দায় ছিল ওই শহরের মানুষটার? টুরির জন্যে? গাঁয়ের মানুষের জন্যে? জীবনের যাত্রাপথে কোন পরম লগ্নে জীবনে এসে দাঁড়াবেন এক দেবদূত, কে জানে। সরল জংলী টুরির জীবনে ওই শহরের মানুষটা এলেনই বা কেন! কেনই বা ডাইনি নীলমণি মায়ের মমতায় আগলে রইল টুরির সব সম্মান!

    ‘আমি জেনেছি, জীবন মানে ভালোবাসা। জীবন মানে অন্য মানুষকে আপনচোখে দেখা। এমনটা না হলে সত্যিই মুক্তি নেই রে সুমিত্রা।' নীলমণি বলল আপনমনে। ফাদারের কথাগুলো শুনতেই চাইল না। কারো সম্পর্কে অভিযোগ নেই, কোনো নালিশ নেই। যতদিন পথের হদিশ পায় নি, খাঁচায় থাকা পাখির মত ডানা ছটফট করেছে। আজ কেমন আকাশের মতো শান্ত হয়ে গেছে নীলমণি।

    ভালোবাসা। ভারি মিঠে শব্দ। পলকে বুকের মধ্যেটা টলটল।

    আর ... মুক্তি। বড্ড ভারি শব্দটা। না না, ভারি না। হালকা। পলকে প্রাণমন হালকা, ওই একটা শব্দে। প্রবল আসক্তি মানুষের জন্যে, সমাজের জন্যে ... অথচ কি বিপুলভাবে মুক্ত নীলমণি। ভেতর গড়ার তাগিদ মেটাতে পৃথিবীর শেষ প্রান্তেও চলে যেতে পারে এই নীলমণি। চাইলেই কি আর এই মেয়ের নাগাল পাবেন ফাদার?

    গ্রামের বাইরে সদরের স্কুলে পড়তে গিয়ে খোলা আকাশটায় মুক্তির ছোঁয়া পেয়েছে সুমিত্রা। বইয়ের পাতায়, ধর্মশিক্ষায়, খোলা আকাশটার কাছাকাছি উড়তে পারার একজোড়া ইচ্ছেডানা আজ সুমিত্রার নাগালের মধ্যে। ফাদারের হাত ধরে পথ চলায় মুক্তির আনন্দ।

    আজ মুক্তি অন্য অর্থ নিয়ে এল। গল্প উপন্যাসে চরিত্রগুলোকে বাস্তবতার রূপ দেবার দায়। জীবনের গল্পে সে দায় নেই। তাই বাইরে থেকে আসা শহরের মানুষ দেবদূত হয়ে মুক্তির বাতাস বয়ে আনতে পারে। ডাইনি নীলমণি মুক্তির বার্তা নিয়ে ঢুকে পড়তে পারে জীবনের অন্দরমহলে। ভালোবাসা। জীবনের অন্য নাম ভালোবাসা। ভাগ্যিস আজ নীলমণির কাছে এসেছিল সুমিত্রা!


    || পনেরো ||

    ভোরবেলা আলতো হাতের ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙল শমিতের। মাযের হাতের ছোঁয়া। অনেকদিন পর। কতদিন পর বাড়ি ফিরেছে ছেলে। চোখ বন্ধ রেখে আবেশটা ধরে রাখতে ইচ্ছে হল।

    তারপরই সজাগ। বাড়ি ফেরার ভাবনায় মন আগেই পাড়ি দিয়েছে। এখনো তো বাড়ি ফেরে নি শমিত। আজ ফিরবে। আজ এই অরণ্যবাসের শেষ দিন। মনটা ভার হয়ে আছে। এরকম ফেরা চায় নি শমিত। এ একরকমের পালিয়ে যাওয়া। না পালিয়ে করবেই বা কি। আর কি বা করতে পারে শমিত।

    টুরি আর ফিরবে না। ডমন আর আসবে না। ডমন না এলে গাঁয়ের অন্য ছেলেরাও কতদিন আসবে কে জানে। পাথর খোঁজার নেশা তো আর সবার থাকে না। ভালো না বাসলে এ কাজে টান থাকা মুশকিল। কাজের কাজ কিছুই হবে না। অরণ্যের যে মায়ায় বাঁধা ছিল মন, টুরির জন্যে কান্নায় সে মনটা অবসন্ন। বিপর্যস্ত।

    কিছুই কি করা হবে না এ জীবনে! বাবা মাকে খুশি করা হয় নি। সংসারে কারো কোনো কাজেই লাগে নি শমিত। একাকী অরণ্যবাসে জড়িয়ে পড়েছিল মায়ার সংসারে। সখী সচিব রাঁধুনী মালিনী ঘরণী গৃহিণী। কখনো মায়ের মতো, কখনো বোনের মতো, কখনো একান্ত আপন ঘরনীর মতো। পদ্মিনী নারীর মত করেই দশদিক আগলে শমিতের জন্যে একটা মায়ার সংসার গড়ে দিয়েছিল টুরি। টুরির জন্যেই কাজে মন বসেছিল ডমনের। টুরির জন্যেই অরণ্যবাসে মন বসেছিল শমিতের। কোথাও তো থিতু হয় নি মন। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ মনটা এই প্রথম বলে উঠেছিল, ‘হ্যাঁ, আমারও একটা ঘর আছে।'

    সেই টুরিকে রক্ষা করতে পারে নি। সেই টুরিকে জীবনে ফেরাতে পারে নি। চোখের সামনে এইভাবে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাবে টুরি! না, দেখতে পারবে না শমিত। কাল টুরিকেও বলেছে শমিত। আজ চলে যাবে। নিথর শরীরে একটু কম্পন উঠেছিল, একভাবে শমিতের দিকে চেয়েছিল টুরি। নীলমণি বলেছিল, ‘যাস না তু। তোর জন্যেই সব হয়েছে। টুরি ফিরে এসেছে। ডান নীলমণির ঘর হয়েছে। এখনো কত কাজ বাকি আমাদের। তু না থাকলে হবেক?’

    টুরিকে ঘিরে ধরে বসেছিল সাবি, ফুলমতি, বাসন্তী, রুকমা। কেঁদে ফেলেছে কেউ কেউ, ‘তু তো আমাদের লোক। কেন যাবি পাত্থরবাবু? টুরি যখন জিগাবে, কি বলব আমরা? আবার যদি এমন হয়, কে যাবে কোতোয়ালি? হাসপাতাল?’

    আবেগের কথা। শমিতের জন্যে কারো কিছুই আটকে থাকে নি। শমিতের জন্যে কারো কোনো কাজই হয় নি।

    ডমন কথা বলে নি। লায়াবুড়ো আর পাহানখুড়োকে বলে এসেছে শমিত। অনেক রাত পর্যন্ত ঘিরে বসেছিল পাহাড়ু বাসু লখন পবন। ওদের মন খারাপ। কিন্তু সত্যিই থেকে লাভ নেই কোনো। টুরি আর ভালো হবে না।

    চোখ খুলে মনটা ভালো হয়ে গেল। পুতুল। হরিণশিশু মানুষের মতোই মায়ায় ছুঁয়ে আছে শমিতের কপাল। শমিতকে তাকাতে দেখে আনন্দে গাল চেটে দিল। তারপরেই চমক। পুতুলের পাশে কে ও! টুরি!

    চকচকে চুল টেনে বাঁধা, বড় বড় মাতলা চোখে সকালের আলো। টুরির হাত ধরে তার কচি মেয়েটা। গোমতী। একটু দূরে দরজার কাছে ফুলমতি, কুরথি, বালিকা, যুগনি। মায়েদের হাত ধরে ছোট ছোট মেয়েরা সবাই। ছোট মেয়েগুলো অবাক চোখে তাকিয়ে। কি যেন একটা হবে আজ।

    উঠে বসতে জানলা দিয়ে বাইরে চোখ চলে গেল। উঠোনের ওপর সারি দিয়ে বসে লখনের মা, দিগুর ঠাকুমা, পবনের খুড়ি। আর বেড়ার গায়ে ঝিঙেলতা আর ঝিঙেফুল ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে সটান একটা নীল অপরাজিতা। নীলমণি।

    মেয়েটা, যাকে বলে বর্ন লিডার। এ গাঁয়ের মেয়েদের জন্যে আর চিন্তা নেই। আজ দ্যাখো, কেমন গোটা গাঁয়ের মেয়েদের জড়ো করেছে। শমিতের জন্যে এত সব! বুকের মধ্যে অন্যরকম একটা চাপ। এখুনি জলাধার ছেড়ে উছলে উঠবে প্রবল উচ্ছ্বাসের প্রস্রবণ।

    ‘তু আমাদের কুইরি গাঁয়ে নিয়া যাবি আজ,’ টুরি বলল। অনেকদিন আগের মতো। অনেকদিন পর আজ কথা বলেছে টুরি।

    ‘তু আমাকে বারবার বলেছিস তখন। আমি শুনি নাই। তু ঠিক বলেছিস পাত্থরবাবু। আমরা সব্বো লোক বিটিছেল্যাগুলাকে ইশকুলে দিব। উয়ারা লিখাপড়া শিখবেক, তাইলে আর কেউ উয়াদের গায়ে হাত দিতে সাহস করবেক লাই।'

    ফুলমণির মেয়ে আর গলায় দড়ি দেবে না। বাবু লোকটার মতো করেই আরও অনেক টুরিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ভাগ্যিস এসেছিল পাত্থরবাবু। তাই তো টুরি জেনেছে আজ। ইশকুলের কথা, গবরমেন্টের কথা। ইন্ডিয়ার কথা। সেই ইন্ডিয়া, যেখানে টুরিরা সবাই থাকতে পারে মাথা উঁচু করে। সেই ইন্ডিয়া, যেখানে নীলমণির মতো মেয়েকে ‘ডান’ না বলে সম্মান করা হয়। গাঁয়ের সব বিটিছেল্যাগুলোকে সেইটা শিখিয়ে দিতে হবে না?

    পাথর খুঁজতে ছোটনাগপুরের জঙ্গলে এসে বৈদূর্যমণি দেখতে পেয়েছিল শমিত। আজ হঠাত্‍ হীরকখণ্ড পেয়ে গেল নাকি! নইলে অমন উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে কেন! উজ্জ্বল হীরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ভরে জল এল। বুকের মধ্যে টলটল করে উঠল। গোমতীর হাতটা নিজের হাতে টেনে নিল শমিত।



    (শেষ)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments